অলীকডোরে চন্দ্রকথা পর্ব-২৫+২৬+২৭

0
310

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-২৫)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

মেঘলা মধ্যবেলা। অনেকদিন বাদে আজ ক্লান্ত চোখে ঘুম নেমেছে সৈকতের। ব্যস্তকাল থেকে ফুরসত পেয়ে আজ প্রাণভরে রাত্রিভর প্রেয়সীর সাথে গল্প করে ভোর বেলায় ঘুমিয়েছে। সেই ঘুম ভেঙেছে মায়ের ডাকে,
“সৈকত উঠ! নাস্তা করবি না? আজ তো আবার মেয়ে দেখতে যাইতে হইবো।”

কাঁচা ঘুম ভাঙায় কপালে কুঁচকে গেছে সৈকতের। মায়ের শেষ কথাটা শুনে কুঁচকে যাওয়া কপালের রগ ফুটে উঠল। চোখ বন্ধ করেই বলল,
“আমি কোথাও যাচ্ছি না।”

সুরমা রুমের পাশ কাটছিলেন। ছেলের কথা শুনে ফিরে এলেন। কড়া স্বরে বলল,
” বেশি কথা না বাড়াইয়্যা উইঠ্যা তৈরি হইয়্যা ল।”

সৈকতের স্বর গম্ভীর হলো, ” আমি আগেই বলেছি, আমার পছন্দ আছে। বিয়ে করলে তাকেই করব। এরপরও এসবের মানে কী?”

সুরমাও রেগে বললেন, ” মানে হইল, কোন শহরের মাইয়্যা আমি মাইন্যা নিমু না। ওসব ভুইলা যা। এহানের মাইয়্যা বিয়া করতে হইব তোরে। ”

সৈকত উঠে বসল। স্পষ্ট গলায় বলল, ” এতকাল তোমরা আমাকে যাই বলেছো, তা আমি মেনে নিয়েছি। কিন্তু এই ব্যাপারে আমি তোমাদের কোন কথা শুনছি না। বিয়ে আমি আমার পছন্দের মেয়েকেই করব। আর তা আমি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরই। আগামী ছ’মাস এক বছরে আমার বিয়ের নাম নিবে না। আমি আমার মত জানিয়ে দিলাম। এরপরও যদি বিয়ের ব্যাপারে কোন জোর করো, তবে আমি আর বাড়ি ছাড়ব একবারেই। ” উঠে বসল সৈকত।

বাড়ি ছাড়ার কথায় নরম হলেন সুরমা। ছেলের কাছে এসে পিঠে হাত রাখলেন। কোমল স্বরে বললেন,
” সন্তানের ভালা চাওনেই বাপ মার কাম। আমরা তো ভালাই চাই। আমগো পছন্দের বিয়াটা কইরা ল। সুখী হবি। মাইয়্যা এক্কেবারে হুরের লাহান। একবার দেখ।”

সুরমা বেগম যে ওকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করতে চাইছেন তা বেশ বুঝতে পারল সৈকত। সে মায়ের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর উঠে দাঁড়াল। টাওয়াল কাঁধে নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলল,
“আমি চাঁদের মোহে পড়েছি, সেই চাঁদের কাছে তোমার এসব গ্রাম্য হুরটুর টিকবে না মা। তোমার ছেলে বশ মেনেছে সেই চাঁদের। শুধু শুধু এই পাত্রী দেখে সময় নষ্ট করো না।”

সৈকতের চোখে ভাসছে তার চন্দ্রকথা, ঠোঁটের কোণে হাসি। প্রসন্ন এক ভালোলাগায় ছেয়ে আছে ওর চোখ মুন। সুরমা তীক্ষ্ম চোখে দেখলেন ছেলেকে। ছেলে দৃষ্টির আড়াল হতেই হায়হায় করে বললেন,
“ছেলে তো আর নাই। কোন নাগিন জানি তাবিজ করছে। ”

সুরমা দৌড়ে গেলেন স্বামীর কাছে। আফসোসে ভাসলেন। তিনি এখন আগের চেয়ে অনেকটাই সুস্থ। গভীর ভাবনায় পড়লেন। বেলা গড়াতেই ছেলেকে ডাকলেন। পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে? বিয়ের জন্য না করছিস কেন?”

সুরমা নেই আশপাশে। সৈকত মায়ের মতো বাবাকে দৃঢ় মুখে নিজের পছন্দের কথা জানাল না। বরং বিনীত স্বরে বলল,
” সবে বিসিএস রিটেন দিলাম। পড়াশোনা শেষ, হাতে কোন চাকরি নেই। আমি চলছি এখনো তোমার টাকায়, নিজের কোন আয় নেই। চাকরি বাকরির কোন ঠিকঠাক নেই। বলা যায় ভবিষ্যত অনিশ্চিত আমার। মা বিয়ে করাতে চাইছেন, আমার চিন্তা করে। আমি একা শহরে কিভাবে থাকি। একা শহরে আমার সমস্যা হয়না। বন্ধুদের সাথে বাসা নিয়ে থাকি। এভাবে ওভাবে ম্যানেজ হয়ে যায়। কিন্তু সাথে কেউ একজন থাকলে বাড়তি দায়িত্ব। একা বাসা নিতে হবে, একটা সংসার ভার বইতে হবে। এত ভার বইবার জন্য মাসিক আয় দরকার। সেই আয়টা তো নেই বাবা। মা আবেগী হয়ে বিয়ের তোড়জোড় করছেন। কিন্তু বাস্তবতা বুঝতে হবে। একটা শহরে বেকার একটা ছেলের টিকে থাকা কতটা কঠিন আমি এখনো টের পাচ্ছি। আমার এই টানাপোড়নের জীবনে আমি কাউকে জড়াতে চাইছি না বাবা। এই অবস্থায় বিয়ের মতো একটা দায়িত্ব বইবার জন্য প্রস্তুত নই আমি। ”

বাবা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন ছেলের কথা। তারপর বলল, ” তাহলে কবে বিয়ে করতে চাইছিস?”

“বিসিএসটা হয়ে যাওয়ার পর। পুরোপুরি সেটেল্ড হওয়ার আগে আমি বিয়ে নিয়ে ভাবছি না। ”

“সে তো আরও এক দেড়বছরের ব্যাপার। তবে বিসিএস যদি না হয়?”
“আমি চাকরির চেষ্টা করব। ভাইভার আগে কিছু একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা সে অবধি সময়টা আমার চাই।” অনুরোধের সুরে বলল সৈকত। বাবা হাসলেন,
“ভালো মন্দ বুঝার বয় হয়েছে তোর। বুঝে শুনে সিদ্ধান্ত নিস। আমি তোর মাকে বুঝাব।”

স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সৈকত। বলল, “আমি কালই ঢাকা ফিরছি বাবা। তুমি পাত্র পক্ষকে মানা করে দাও। ”

সৈকত হাঁটা ধরল। বাবা পিছু ডাকলেন, ” মেয়েটা কে?”

সৈকত থমকে দাঁড়াল। পিছু ফিরল না। বাবার চোখে তাকিয়ে প্রেমিকার বিষয়ে বলতে পারবে না সে। পিছু না ফিরেই বলল, “এখনো সময় আসেনি। সময় এলে বলব।”

সৈকত বের হলো। দুপুরবেলা খেতে বসে মাকে এটা ওটা জিজ্ঞেস করল। মা উত্তর দিল না। ভীষণ রেগে আছে ওর উপর। সৈকত মাকে মানানোর চেষ্টা করল, মা মানল না। উলটো ওকে আবেগী হুমকি দিল, “তুই যদি বিয়ে না করিস আমি বাপের বাড়ি চইল্যা যামু।”

সৈকত হেসে বলল, “বাপের বাড়ি না গিয়ে ঢাকা চলো। এখন আমি ফ্রি আছি। মা-ছেলে ঢাকা ঘুরব।”

সুরমা রেগে চলে গেলেন। সিফাত বলল, “তুই ভাবির কথা বললি না কেন?”

“সময় আসেনি।”

সিফাত সন্দিহান হয়ে বলল, “তুই কি ভাবির ব্যাপারে সিরিয়াস না?”

সৈকত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” বিয়ে নিয়ে আমি তোর ভাবির বাবা ভাই সবাই সিরিয়াস। সমস্যা হলো, আমি বিয়ে করার ব্যাপারে সিরিয়াস। তারা বিয়ে না দেয়ার ব্যাপারে সিরিয়াস। এখন বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর উপযুক্ত সময় নয়। ”

পরদিন সকাল বেলা ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ল সৈকত। যাবার কালে সিফাতকে কড়া স্বরে বলল, “মুনের ব্যাপারে মুখ খুলবি না একদম। যা বলার, যখন বলার আমি বলব।”

সিফাত সায় জানাল। সৈকত বাবা ভাই থেকে বিদায় নিয়ে বের হলো। মা বিদায় দিলেনই না।

__________________

তখন ভরদুপুরে। ভার্সিটির বাইরে অসংখ্য হকার বসেছে খাবার নিয়ে। কেউ ফুচকা, কেউ ভেলপুরি, কেউ চা, কেউ ভর্তা। এসবের মাঝে মুনের পছন্দ ফুচকা। ক্যাম্পাসের ভেতরেও ফুচকা পাওয়া যায়, তবে বাইরের বসা ছেলের স্টলের ফুচকা বেশি প্রিয় মুনের। ভার্সিটি থেকে ফেরার সময় বান্ধবীদের সাথে নিয়ে ফুচকা স্টলে দাঁড়ানো ওর অভ্যাস। তারপর অর্ডার দিয়ে ফুচকার অপেক্ষায় গল্পে মেতে ওঠা। ফুচকা এলে মহাখুশিতে তড়িঘড়ি করে ফুচকা খাওয়া যে অতি আনন্দের কাজ। আজও তেমনই এক প্লেট ফুচকা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। বেশ ভীড় থাকায় আজ বসার জায়গা নেই। তাই দাঁড়িয়েই খাচ্ছে। একটার পর একটা মুখে নিচ্ছে। আকস্মিক কেউ একজন এসে পাশে দাঁড়াল। কানের কাছ হয়ে মৃদু শব্দ বাড়ি গেল।
“শুভ জন্মদিন, আমার চন্দ্রকথা।”

পুরুষালী স্বরের সেই কথার তীরে বিদ্ধ হলো মুন। চমকে তাকাল পাশে। পাশের মানুষটাকে দেখে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল। পলক অবধি ফেলতে ভুলে গেছে। মুন অবিশ্বাস্য চোখে আছে কেবল। স্বপ্ন ভেবে চোখ বন্ধ করে আবার খুলল। না যাচ্ছে না তো। তারমানে সত্যিই এসেছে! মানুষটা ওর কান্ড দেখে চমৎকার হাসল। আরেকটি তীর বিদ্ধ হলো মুনের মনের ঘরে। এবার সে বিষম খেল। মানুষটার পানে চেয়েই কাশতে লাগল। মানুষটা পানির বোতল এনে ক্যাপ খুলে মুখের সামনে ধরল। পিঠে হাত বুলিয়ে আলতো সুরে বলল,
” পানি খাও। ”

পানি তখনো যেন ঘোরে আছে। পানি ও নিল না। মুন স্তব্ধ হয়ে রইল আরও কিছুক্ষণ। এরমাঝে অবচেতন মনেই পানি নিল মুখে। ওর ধাতস্থ হতে সময় লাগল। ধাতস্থ হতেই অতিব উত্তেজিত হয়ে মানুষটার হাত ধরে ফেলল। খুশিতে গদগদ হয়ে বলল,
“আপনি চলে এসেছেন, সৈকত! সত্যিই!”

নাম ধরে সম্বোধন শুনে সৈকতের মুখে খুশি দেখা গেল। এক গাল হেসে বলল, ” সত্যিই এসেছি।”

মুনের বিশ্বাস হলো না। অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে আবার বলল,
” আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। একটু আগেও তো কথা হলো, আপনি বললেন কবে ফিরবেন ঠিক নেই। ”

মানুষটা হাসল প্রাণবন্ত। মুনের ধরা হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
” ওটা সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিলাম বলে বলিনি। এই দেখো হাত ধরেছি। মিথ্যা হলে কেউ হাত ধরতে পারে?”

মুন মানুষটার দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। খুশিতে কথাই বলতে পারল না। একটু আগেও কথা হলো। তখন তো কিছু বলল না। এমন হুট করে এসে সারপ্রাইজ দিয়ে দিবে মুনের কল্পনাতীত। মুন অস্ফুটস্বরে বলল,
“থ্যাঙ্কিউ সৈকত।”

সৈকতের হাসি সরছে না ঠোঁট থেকে। সে হাসি হাসি মুখ করছে পরখ করছে প্রেয়সীর খুশি। ওকে পেয়ে কী খুশি মেয়েটা! সৈকত হাস্যজ্বল মুখে বলল,
” মাই প্লেজার। ”
“কখন এসেছেন?”
“ঘন্টাখানেক হচ্ছে।”
” হুট করে!”

সৈকত সহজ উত্তর দিল না। মজা করে বলল,
” হুট করে মনে পড়ল, এই ভার্সিটিতে আমার গার্লফ্রেন্ড পড়ে। আর তুমি তার সাথে পরিচিত হতে চেয়েছিলে। তোমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়নি। ভাবলাম, আর দেরি নয়, আজই পরিচয় করিয়ে দিয়ে আসি। চলো।”

পুরনো কথা মনে পড়ল মুনের। না বুঝে কী পাগলামোটাই না করেছিল সে। ওসব ভাবতেই হেসে ফেলল। লজ্জাও পেল খানিকটা। স্বগতোক্তি করল,
“কী বোকা ছিলাম আমি।”

“এখনো বোকাই আছো।”

মুন প্রতিবাদ করল, ” কী বোকামো করেছি আমি?”

সৈকত স্বর নিচু করে বলল, ” বোকারাই জানে না, প্রেমিক ওতো দূর থেকে এসেছে তাকে সারপ্রাইজড করতে, বিনিময়ে এক আধটু হাগ, কিস দিয়ে আপ্যায়ন করতে হয়।”

মুনের গাল লাল হলো। হেসে অন্যদিকে তাকিয়ে ফুচকার প্লেট তুলে নিয়ে একটা ফুচকা মুখে নিল। আরেকটা ফুচকা হাতে তুলে বাড়িয়ে ধরল সৈকতের মুখের সামনে। মুখের ফুচকা খেয়ে বলল,
” এই পরিবেশে ফুচকা দিয়েই আপ্যায়ন হোক।”

সৈকত ফুচকা খায় না। এসব মেয়ালি খাবার পছন্দ না ওর। তবুও মুন এত আগ্রহ নিয়ে খাওয়াতে চাচ্ছে দেখে না করল না। মুখে নিল। নিতেই আক্কেলগুড়ুম। অতিমাত্রায় টক। টক জিনিস পছন্দ না সৈকতের। সে কোনরকম গিলল কেবল। অবাক হয়ে চাইল,
“এত টক খাও তুমি!”

মুন উৎফুল্ল হয়ে বলল, “টক ছাড়া চলেই না আমার।”

“এখনই এত টক খেলে ভবিষ্যতে তো বোধহয় টকের বাজার মিলিয়ে বসতে হবে।”

ওর কথার গভীরতা বুঝল না মুন। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে চাইল, “কেন বাজার দিতে হবে?”

সৈকত উত্তর না দিয়ে চাপা হাসল। চোখমুখে দুষ্টুমি খেলা করছে। মুন ভ্রু কুঁচকে চাইল। ভাবল কী যেন। আকস্মিক ওর কুঁচকানো ভ্রু সোজা হয়ে গেল। গাল লাল হলো। তড়িৎ চোখ ফিরিয়ে অন্যদিকে চাইল। এত লজ্জা পায় মেয়েটা! সৈকত হাসল। চেয়ে রইল ওর দিকে। এই মুখ, এই মানুষটাকে ছাড়তে বলছেন মা? এই প্রাণটার মাঝেই যেন ওর প্রাণের বাস। মেয়েটা যখন একটু হাসে, তখন ওর অন্তর শীতল হয়ে যায়। মেয়েটাকে এক পলক দেখলে সব ক্লান্তি ঝরে যায়। এখন ওর পুরো জীবন ঘুরছে যেন এই মেয়েটাকে ঘিরেই। মনটা ব্যাকুল থাকে এই মেয়েটার জন্যই। আর মা ওকে ছাড়তে বলছেন! এ আদৌ সম্ভব? নাহ,! অন্তত তার পক্ষে তো নয়ই। এই মেয়েটাকে ছাড়লে, ওর প্রাণ ছেড়ে যাবে ওকে। একে ধরে রাখতে হবে সারাকাল। যে যাই করুক।

মুন সৈকতের কাছ ছেড়ে বান্ধবীদের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। বান্ধবীরা মিলে হাসাহাসি করছে। মূলত ওকেই টিপ্পনী কাটছে। সৈকত ও গেল ওদের কাছে। কুশল বিনিময় করল। প্রস্তাব রাখল, সেদিনকার পাওনা ট্রিট দেবার। ওরা গিয়ে বসল রেস্টুরেন্টে। টুকটাক গল্প হলো। সৈকত মুনকে চমকে দিয়ে একটা কেক নিয়ে হাজির হলো। যাতে লেখা,
“হ্যাপি বার্থডে চন্দ্রকথা।”

মুন আবেগে আপ্লূত হলো। খুশি খুশি চোখে চাইল। সৈকত নাইফ এগিয়ে দিয়ে হাসল। পাশাপাশি বসে হাতে হাত রেখে কেক কা টল ওরা। কেক নাইফ বসানোর সময় সৈকত উইশ করল আবারও,
” হ্যাপি বার্থডে মাই লাভ। তোমার সবটুকু দুঃখ আমার হোক। ”

কী সুন্দর উইশ! মুনের চোখ মুখে খুশিতে ঝলমল করছে। চোখে পানি চলে এসেছে। এক টুকরো কেক সৈকতের মুখে তুলে দিয়েই ওকে জড়িয়ে ধরল আবেশে। বলল,
“আমার দিনটাকে এত সুন্দর করার জন্য ধন্যবাদ। ”

সৈকত চমৎকার হাসল। ওর খুশিটা ওর চোখেই দেখা গেল। তবে এই মুহুর্তে ও ওর স্বর থেকে মজা গেল না। মুনের এলোচুলে হাত দিয়ে বলল,
” তুমি চাইলে ধন্যবাদটা অন্যভাবেও প্রকাশ করতে পারো।”

মুন বুঝল ওর কথা। ছাড়ল ওকে। মৃদু থাপ্পড় দিল বাহুতে। চোখ রাঙিয়ে তাকাল। বিপরীতে সৈকত বাঁকা হাসল। বলল,
“চোখ বন্ধ করো।”

মুন ভাবল সৈকতের মাথায় উদ্ভট খেয়াল চলছে। সে তড়িৎ বলল, “একদম না।”

সৈকত শব্দ করে হেসে বলল, ” আরে কিছু করব না তো। ট্রাস্ট মি.! ”

মুন চোখ বন্ধ করল না। সৈকত বলে কয়ে ও ওর চোখ বোঝাতে পারল না। অগত্যা থেমে গেল। পকেট থেকে একটা বক্স বের করে বলল,
“আমি তো এটা দেয়ার জন্য চোখ বন্ধ করতে বলছিলাম। তুমি কী ভেবেছো?”

মুন বিস্মিত হয়ে তাকাল। সে ভেবেছে সৈকত মজা করছে। এখন দেখা যাচ্ছে অন্য খেয়াল সৈকতের। গিফট বক্স দেখে মুন অবাক হয়েই তাকাল। সৈকত বক্সটা ওর হাতে দিয়ে বলল,
“দিস ইজ ফর ইউ।”

“আমার জন্য!”
“হ্যাঁ, খুলে দেখো।”

মুন খুলে দেখল। ভেতরে মুন শেপের খুব সুন্দর একটা প্যান্ডেন্ট। আস্তে একটা চাঁদ ঝলমল করছে। একের পর এক চমকে মুন যেন বিস্মত হতেই ভুলে গেছে। মুন মুগ্ধ হয়ে চেয়ে রইল। সৈকত ওর তাকানো দেখে বলল,
“পছন্দ হয়েছে?”

মুন বিমোহিত স্বরে বলল, ” কী সুন্দর চাঁদটা!”

মুন দেখছে প্যান্ডেন্ট এর চাঁদ। সৈকত দেখছে ওর চাঁদ। সৈকত বলল, “আমার চাঁদ বেশি সুন্দর। ”

মুন তড়িৎ চাইল ওর দিকে। সৈকতের চোখে মুগ্ধতা, দৃষ্টি ওর পানেই। “আমার চাঁদ” কথাটা ক’বার বাজল কানে। দারুন লাগল মুনের। মানুষটা কথার যাদু জানে। কথাতেই বশ করে দেয়। মুনকেও করে ফেলেছে, সে হয়ে গেছে বশ। মুন সুন্দর করে হাসল। বক্সটা দিয়ে বলল,
“পরিয়ে দিবেন? ”

“হোয়াই নট!” সৈকত প্রফুল্লচিত্তে উঠে দাঁড়াল। মুনের পিছু দাঁড়িয়ে ওর পরিহিত চেইনে পরিয়ে দিল প্যান্ডেন্টটা। মুন ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখল চাঁদটা। আবেশে জুড়ে গেল মন। ও অনুভব করল, জীবন সুন্দর, অনুভূতি আর সম্মুখের মানুষটাও।

অনুভূতিঘন মুহুর্তে কাটবার পর এলো বিপদ।

চলবে….

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-২৬)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

মধ্যহ্ণ পেরিয়ে অপরাহ্নে পড়েছে সবে ব। এক জোড়া কপোত-কপোতী উড়ো প্রেমের ঝড়ো হাওয়ায় ভেসে হাঁটছে ফুটপাত ধরে। দুজনের ঠোঁটের কোণে প্রসন্ন হাসি। চোখে ওকে অপরের প্রতি প্রগাঢ় প্রেম। হাতে হাত রেখে হাসিমাখা কথায় মেতে আছে দুজন। বিকেলের নরম রোদে মনোহর লাগছে। সুখী সুন্দর সময় চলছে ওদের। এই সময়, এই হাসিতে ভাটা পড়ল আকস্মিক। হাসি বদলাল ভয়ে। চারদিকে হৈচৈ শুরু হলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই চারদিক থেকে মানুষ তেড়ে আসতে লাগল। হাতে ধারাল ছুরি, রাম দা, পিস্তল নিয়ে ধেয়ে এলো। বলতে লাগল, “ধর, ধর, আজ শেষ করে ফেলব।”

ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল ওরা। কিছু বুঝতেই পারল না কিছুক্ষণ। ধাতস্থ হতেই কপোত-কপোতীর মুখের হাসি উবে গেল। মেয়েটির মুখে দেখা গেল তীব্র ভয়। লোকগুলো যেন ওদের দিকেই তেড়ে আসছে। হাতে ভয়ানক অস্ত্র। দেখেই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। ওর মনে হলো, ওর জীবন আজ এখানেই শেষ।

একটা তীব্র ভয় ঝেঁকে বসল ছেলেটির মনেও। তবে কারণ ভিন্ন। সে নিজের জীবনের চিন্তা করছে না। তার সব চিন্তা পাশে থাকা প্রেয়সীকে নিয়ে। যদি তার কিছু হয়ে যায়! বুঁক কাঁপা ভয় নিয়ে সে আশপাশ চাইল। ওরা মাঝরাস্তায়। এখন বাড়ি ফেরা অসম্ভব। আশপাশে রেস্টুরেন্ট বা মল ও নেই যে আশ্রয় নিবে। নিরাপদ জায়গার খোঁজ করল খুব। তারপর চোখ পড়ল কাছে দুটো মুদি দোকানের মাঝের একটা চিপার গলির দিকে। কারো চোখে পড়বে না এদিকে। ছেলেটা কালবিলম্ব না করে ঝড়ের বেগে মেয়েটাকে নিয়ে আশ্রয় নিল সেখানে। একা থাকলে এখানে সে কখনোই আসতো না। কিন্তু এখন সাথে মেয়ে আছে। মেয়েটা ওর প্রিয় মানুষ, যাকে নিয়ে কোন ঝুঁকি নেয়া যায়না। ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রিয়জনের হারানোর ভয় মানুষকে ভীত করে দেয়, ওকেও করে দিয়েছে। গলিতে দাঁড়িয়ে ছেলেটা মৃদুস্বরে বলল,
” এখন এটা ছাড়া নিরাপদ কোন জায়গা নেই। এখানে থাকতে সমস্যা হবে তোমার?”

মেয়েটি ভীষণ ভয় পেয়েছে। একেতো চোখের সামনে ওমন মারামারি, তারপর আবার এই গলি দুটোই ভয়ের কারণ। কানে আসছে মানুষের আর্তনাদ, মানুষ মরছে। বুক কাঁপছে ওর। চারদিকে চিৎকার, গোলাগুলির আওয়াজে অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে ভয়ে। মেয়েটা কথা বলতে পারল না। কেবল সম্মুখে থাকা মানুষটাকে জড়িয়ে ধরল। তার বুকটাকেই এই মুহুর্তে সবচেয়ে বেশি নিরাপদ মনে হলো। মেয়েটির ভান দেখে ভয় ধরতে পারল ছেলেটা। আগলে নিয়ে নরম গলায় বলল,
“এত ভয় কিসের চন্দ্রকথা? আমি আছি তো! তোমার কিছু হবে না।”

চন্দ্রকথার তরফ থেকে কোন ভাবান্তর প্রকাশ পেল না, সে আরও প্রিয়তমের বাহুবন্ধনে রইল নিশ্চুপ। খানিক বাদে ভীত স্বরে বলল,
“আপনি কোথাও যাবেন না, আমার সাথেই থাকুন।”

বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে কিনা তা পরখ করতে করতে সৈকত অভয় দিল,
“তোমাকে ছেড়ে কোথায় যাব, পাগলী? আমি এখানেই আছি তোমার সাথে। এত ভয় পেওনা। কিছু হবে না। ”

প্রেয়সীকে অভয় দিলে ও সৈকতের মুখে স্বস্তি নেই। চারদিকের পরিস্থিতি ভয়ংকর। আশপাশে যাকে পাচ্ছে তাকেই মারধর করছে। নিরিহ পথচারী ও বাদ পড়ছে না। গাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে। কিছুটা দূরে একটা দোকানে ভাংচুর করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে। যে কোন সময় এদিকেও এসে যাবে হয়তো। তখন কী হবে! ওদের সবার কাছে অস্ত্র সস্ত্র আছে, সৈকতের কাছে কিছুই নেই যে বীরের বেশে প্রতিরোধ করবে। রাজনৈতিক সহিংসতা এটা। সৈকত রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত নয় বলেও পাওয়ার ও নেই। নিতান্তই নিরিহ সাধারণ মানুষ সে। তার উপর পাশে মেয়ে আছে। মুনের সম্মান জড়িয়ে আছে। এদের ভেদবিচার নেই, কী না কী করে! ভেবেই বুক কাঁপছে। এমতাবস্থায় প্রতিরোধের চেয়ে নিরাপদ আশ্রয় খোঁজা অধিক জুরুরি। কিভাবে প্রেয়সীকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাবে তার চিন্তায় অস্থির সৈকত। মেয়েটা ভীষণ ভয় পাচ্ছে, এমন পরিস্থিতিতে ভয় পাওয়াই স্বাভাবিক। সৈকত মুনকে সাহস দিচ্ছে। তবুও মুনের ভয় কমছে না। আশপাশ থেকে একেকটা গুলির আওয়াজে কেঁপে উঠছে।

সৈকতের ফোন বাজল। রিংটোনের শব্দে শ্বাস বন্ধ হয়ে এলো যেন ওর। এই বুঝি ধর ধর করে তেড়ে এলো ! তড়িঘড়ি করে ফোন হাত নিল। সিফাতের ফোন। সৈকত ফোন তুলল না। বরং ফোন বন্ধ করে রাখল। একদম ক্ষীণ স্বরে মুনকে বলল,
” তোমার ফোনটা সুইচ অফ করো। ”

মুন ফোন হাতে নিল ঠিকই। হাত কাঁপুনির জন্য কিছু পারছিল না। অগত্যা সৈকত নিজেই ফোন নিয়ে বন্ধ করে নিজের কাছে রাখল। কাছেই একটা লোককে দুজন মিলে কোপাচ্ছিল। গলির ফাঁক দিয়ে সেই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। লোকটা ভয়ানক আর্তনাদ করছে, বাঁচার আকুতি জানাচ্ছে। তবুও ওরা সদয় হচ্ছে না। কী ভয়ংকর দৃশ্য! দেখেই শ্বাস আটকে এলো মুনের। ওর ভয় বেড়ে গেল হাজারগুন। ফুঁপিয়ে উঠলো।

সৈকত ওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে মাথায় হাত বুলাল। নরম গলায় বলল,
“হুশশ! কোন শব্দ নয়। কোন দিকে তাকাবে না, কিছু শুনবে না, কোন আওয়াজ করবে না। এভাবে থাকো চুপচাপ। পরিস্থিতি ঠিক হলেই তোমায় বাসায় দিয়ে আসব। ভয় পেও না।”

মুনের কান্না থামল। সে থম ধরে দাঁড়িয়ে রইল। বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে সৈকত। প্রার্থনা একটাই, ওর যাই হোক, ওর চন্দ্রকথার সাথে বিন্দুমাত্র অসম্মান বা ক্ষতি না হয়।

__________________________

শেখ বাড়ির বসার ঘরে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন তারিনা। সবেই টেলিভিশনে সহিংসতার সংবাদ দেখলেন। ক্ষণেই মনে পড়ল তার মেয়ের ভার্সিটি তো ওদিকেই। আধাঘন্টা আগেও মেয়ের সাথে কথা হয়েছে, মেয়ে বলেছে কিছুক্ষণ পরেই বাসার জন্য রওনা হবে। রওনা কি হয়েছে না কি আটকা পড়েছে সেখানে? কিছু হয়নি তো? তড়িঘড়ি করে ফোন লাগালেন। ফোন বন্ধ এলো। এতেই তার চিন্তা বাড়ল তরতর করে। মন কেঁদে উঠল মেয়েটার জন্য। বাড়িতে কেউ নেই। মনির সাহেব অফিসে, রুবাব সেই সকালে বেরিয়েছে আর ফিরেনি। তারিনা যেন দিশেহারা হয়ে গেলেন, কী করবেন করবেন। মনির সাহেবকে কল দিলেন, তিনি উঠালেন না। মিটিং এ বোধহয়। ছেলেকে ফোন দিয়েও পেলেন না। দরকারের সময় এই ছেলেকে পাওয়া যায়না। ভয়ে চিন্তায় তারিনা চোখে সর্ষে ফুল দেখলেন। ভাগ্য সুপ্রসন্ন থাকায় মিনিট খানেক বাদেই রুবাব কলব্যাক করল। তারিনা কিছু বলতে পারলেন না। কাঁপা গলায় বললেন,
” বাবা মুন…..

মায়ের স্বরে রুবাব উদ্ধিগ্ন হলো, ” কী হয়েছে মুনের? ”

অতি কষ্টে তারিনা ঘটনা জানালেন। রুবাব হকচকিয়ে গেল। সকাল থেকে সেঁজুতির সাথেই ছিল। নিউজ দেখা হয়নি। টের পায়নি। শুনেই সব ছেড়ে দৌড় দিল। যেতে যেতে মাকে অভয় দিল, “আমি যাচ্ছি, চিন্তা করো না তুমি।”

বোনের চিন্তায় অস্থির হয়ে রুবাব পৌঁছাল ভার্সিটি এলাকায়। তখন সংঘর্ষ শেষ। পুলিশ এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করছে। মারামারি নেই। শুধু চারদিকে ধ্বংসশেষ, ভাঙা কাঁচ, রঙ, আহত মানুষের বাঁচার আকুতি। অবস্থা দেখে ভীত হলো ওর চোখমুখ। ওর বোনটা কোথায় আটকেছে। মেয়েটা তো খুব ভীতু, নিশ্চিত খুব ভয় পাচ্ছে। ও ঠিক আছে তো? কিছু হয়নি তো ওর? দোয়া পড়তে পড়তে এগুলো সেদিকে। উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটল ভার্সিটির দিকে। এদিক ওদিক কতদিক খুঁজল। নেই কোথাও। রাস্তায় একটা মেয়েকে আহতবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখল। রুবাবের অবস্থা তখন বর্ণনাতীত। শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের রুবাবের চোখে জল ভীড়ল। এ ওর আদরের বোনটা নয় তো? চেহারার রক্ত সরে গেল।

হাঁটার মাঝে আকস্মিক কেউ যেন ডেকে উঠল, ”
এই শা লা এদিকে আয়! ”

রাগের ঝঙ্কার দিল রুবাবের চোখে। আশপাশ চেয়ে বলল,
“শা লা ডাকে কে? ”

একটা হাত ওকে টেনে নিয়ে বলল, ” তুই যার শা লা সেই তোরে শা লা ডাকে। ”

রুবাব রাগ নিয়ে চাইল, কে তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। প্রাণপ্রিয় বন্ধু সৈকতকে দেখে থমকে গেল। পরক্ষণেই উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, “মুনকে দেখেছিস? সেই কখন থেকে খুঁজতেছি, পাচ্ছি না। তুই জানিস ও কোথায়? জানলে প্লিজ এটুকু বল, আমার বোনটা ঠিক আছে কি না? ওর কিছু হয়নি তো? ও না খুব ভীতু, অল্পতেই ভয় পায়। কী অবস্থায় আছে?”

রুবাবের গলা কেঁপে উঠছে। এক ভাইয়ের অস্থিরতা প্রকাশ পেল রুবাবের মাঝে। সৈকত উত্তর দিল না। একবার ঘাড় ঘুরাল। তার পিঠ খামছে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা। গুটিসুটি মেরে দাঁড়ানোয় সামনে থেকে দেখাও যাচ্ছে না। সৈকত একহাত পিছনে নিয়ে মুনের হাত টেনে সামনে আনল। রুবারের দিকে চেয়ে বলল,
” কিছু হয়নি, ও আমার সাথেই ছিল।”

বোনকে দেখে রুবাব বিস্ময়ে থ বনে গেল। কিছুক্ষণ স্থির চোখে চেয়ে রইল। তারপর উদ্ধিগ্ন হয়ে গালে হাত দিয়ে বলল, “তুই ঠিক আছিস? কিছু হয়নি তো তোর? ফোন বন্ধ কেন? জানিস কত চিন্তা হচ্ছিল! মারামারিতে পড়িস নি তো?”

মুন অবলম্বন বদলে ভাইকে আঁকড়ে ধরল। ভেতরে তখনো খুব ভয় ওর। কিছুই বলল না। চোখের সামনে একটা মানুষকে মরতে দেখে ও যেন ঘোরে চলে গেছে। রুবাব বোনের উত্তর না পেয়ে সৈকতের দিকে তাকাল। সৈকত ধীরে বলল,
“ভয় পেয়েছে। ”

রুবাব আদুরে স্বরে বোনের মাথায় হাত দিল। ” আর ভয় নেই। ভাইয়া এসে গেছি। চল বাসায় নিয়ে যাব। ”

মুন নড়ল না। বোনের অবস্থা দেখে করুণ চোখে তাকাল রুবাব। সৈকত আশ্বাস দিল,
“একটু সময় দে, ঠিক হয়ে যাবে।”

রুবাব চিন্তার শ্বাস ফেলল। মাকে ফোন দিয়ে জানাল, মুনকে পেয়েছে। ভালো আছে। চিন্তা না করতে। ফোন রেখে খেয়াল হলো বন্ধুর। এতক্ষণে সৈকতকে নিয়ে মাথা গামায় নি। হঠাৎ সৈকত এখানে কিভাবে এলো! রুবাব ভ্রু কুঁচকে বলল,

“তুই ঢাকা ফিরলি কবে?”
“আজ সকালেই।”
” হঠাৎ? ”
“ইন্টারভিউর ডাক পড়েছে।”

আসল কারণ বলল না সৈকত। দুই বন্ধু টুকটাক আলাপনের পর বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। এখানে থাকা ঠিক হবে না। ভালোয় ভালোয় বাসায় ফেরা উচিত। মুনের রেস্ট দরকার। এ অবধি সবটা মন্দের ভালো ছিল। পরিস্থিতি আবার বিগড়ে গেল গলি থেকে বেরিয়ে আসার পরেই। সদ্য হওয়া শান্ত পরিস্থিতি আবার অশান্ত হয়ে গেল। ফের বাধল সংঘর্ষ। এর আগে দুইগ্রুপের সংঘর্ষ বেধেছিল এবার বেধেছে পুলিশের সাথে ধাওয়া পাল্টাধাওয়া। ইট পাটকেল ছুড়ছে সমানে।

আতর্কিত হামলায় দুই পুরুষের চেহারা পাণ্ডুবর্ণ হয়ে গেল। দুজনেই তড়িৎ চাইল মাঝে থাকা মেয়েটার প্রতি। ফিরতি ভয়ে নীল মেয়েটির মুখ। ওদিক থেকে একদল অস্ত্র নিয়ে তেড়ে আসছে, দেখে ভয়ে সেটে গেল মুন। দুই পুরুষ ফিরতি পথ ধরল গলির। ক্ষণেই প্রচন্ড শব্দে চলল গুলির আওয়াজ। দুই পক্ষ থেকে গোলাগুলি হচ্ছে। কয়েকটা এসে দোকানের সাটারে ও লেগেছে। যেই কোন মুহুর্তে হয়তো তাদের গায়ে এসে ও লাগতে পারে।

কানের কাছেই একটা গুলির শব্দ হলো। মুনের দুই পাশে তার অতি আপন দুই পুরুষ। একজন ভাই, আরেকজন প্রাণাধিক ভালোবাসার প্রেমিক পুরুষ। মুন এবার ভাইয়ের বদলে ভরসা খুঁজল প্রেমিকের কাছেই। মৃদু চিৎকার দিয়ে সৈকতের বাহু চেপে ধরল। চোখ বন্ধ করে ফেলল। রুবাবের চিন্তার মাঝেও এক পলক চাইতে ভুলল না বোনের হাত বন্ধনে। একটা ছেলে কতটা ভরসার হলে ভাইয়ের উপস্থিতিতেও ভরসার জন্য মেয়েটা ছেলেটাকে চায়।

সৈকত ও চাইল মুনের দিকে। একটা বুলেট বাড়ি খেয়ে পড়ল পায়ের কাছেই। সৈকত মুনের হাত ছাড়াল। তারপর মুনকে টেনে নিয়ে দাঁড় করাল রুবাবের পাশে। রুবাবকে বলল,
“আমার যাই হয়ে যাক না কেন, তুই ওর হাত ছাড়বি না। পরিস্থিতি পুরোপুরি শান্ত হওয়ার আগে এখান থেকে বেরুবি না। ”

রুবাব আতঙ্ক নিয়ে বলল, ” কোথায় যাবি তুই?”

সৈকত রুবাবকে ঘিরে দাঁড়িয়ে বলল, “কোথাও না, এখানেই আছি।”

রুবাব বুঝে গেল ওর ভাবনা। সে চোখ রাঙিয়ে বলল, “ভুলেও এমন কিছু করবি না। ”

সৈকত সে কথা কানে নিল না। বলল, ” ওর যাতে কিছু না হয়। আমার কিছু হলে ওকে সামলে নিস। আমাকে তোদের সামনে রাখিস। এই ভীড়ের মধ্যে প্লিজ বের হোস না, ভীড় ভাট্টায় ওকে ব্যাড ট…. ”

আর বলল না না সৈকত। থেমে গেল। বলল, “আমার জান যায় যাক, কিন্তু ওর বিন্দুমাত্র অসম্মান না হোক।”

বন্ধুর দিকে চেয়ে দৃঢ় স্বরে বলল সৈকত। মুন যেন ঘোর ছাড়ল। সৈকত একটু আগাতেই দিক বেদিক না ভেবে ভাইয়ের পাশ ছেড়ে সৈকতের কাছে গিয়ে ওর হাত ধরে ফেলল,
” পাগল হয়ে গেছেন আপনি? ওখানে কেন যাচ্ছেন? আর জান যায় মানে কী! কী হবে আপনার! ”

সৈকত স্থির চোখ এক পল চাইল। তারপর অত্যন্ত শান্ত স্বরে আদেশ করল, ” রুবাবের পাশে গিয়ে দাঁড়াব। যতযাই হোক ভেঙে পড়বে না, বেরুবে না। মনে থাকবে?”

মুন অশান্ত হলো, ” আপনি না থাকলে আমার কিছুই মনে থাকবে না। এদিকে আসুন, গুলি লাগবে।”

মুন কেঁদেই দিল। আকস্মিক সৈকত ওকে খুব জোরে ধাক্কা দিল রুবাবের দিকে। গিয়ে পড়ল রুবাবের উপর। দুজনেই পড়ে গেল মাটিতে। উঠে বসে কারণ উদঘাটন চাইতেই দেখল রক্তে ভেসে যাচ্ছে সৈকতের সারা গা। ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল ওরা ভাইবোন। এক পর্যায়ে রক্তস্রোতে ভেসে ওদের চোখের সামনেই লুটে পড়ল সৈকত।

তবে কি শেষ অলীকডোরের প্রেমের পরিণতি মিথ্যা হবে? সৈকত চন্দ্রকথার গল্পের সমাপ্তি এখানেই? চন্দ্রকথা ডাকা মানুষটার বধ বুলেটেই! মুন হারাল তার সমুদ্রপুরুষকে? চিরতরে?

চলবে……..

#অলীকডোরের চন্দ্রকথা। (পর্ব-২৭)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা।

তখন আলো আঁধারির রাত্রী। হাসপাতালের করিডোরের বিমর্ষচিত্তে দাঁড়িয়ে আছে রুবাব। স্থির চোখে চেয়ে আছে সম্মুখে। তার ঠিক সামনে চেয়ারে বসে অঝোরে কাঁদছে এক তরুণী। যার এক ফোঁটা চোখে পানি না আসার জন্য সে কত কী করেছে। যার বিন্দুমাত্র মন খারাপ হওয়ার ভয়ে সে সর্বদা সচেতন। মুখ ফুলাবে বলে কখনো উঁচু গলায় কথা অবধি বলেনি যাকে সে কখনো কাঁদায়নি, কাঁদতে দেয়নি, যার কষ্ট সে সহ্য করতে পারেনা। সেই মেয়েটা আজ ভীষণ কষ্ট পাচ্ছে, বুকভাঙা কান্নায় ভেঙে পড়ছে। অথচ রুবাব কিছুই করতে পারছেনা। নির্বিকার চেয়ে দেখছে। এ কি তার ব্যর্থতা নয়! দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুবাব। একবার চোখ ঘুরিয়ে চাইল, দূরের বন্ধ দরজায়। ওই বদ্ধ ঘরেই অচেতন হয়ে পড়ে আছে তার প্রাণপ্রিয় বন্ধু সৈকত। দুপক্ষের সহিংসতার বলি হয়েছে নিরিহ ছেলেটা। সংঘর্ষে ছোঁড়া একটা গুলি এসে লেগেছে কাঁধে। মারাত্মক জখম লেগেছে তার। অপারেশন চলছে। বাঁচা মরা নিয়ে শঙ্কায় আছে।

রুবাবের বুকটা ভারি লাগছে। বন্ধুর জন্য হাহাকার করছে মন। ওর হালকা রঙের শার্টটা বন্ধুর রক্তে রঞ্জিত। শুধু শার্ট নয়, রক্তে মাখামাখি ওর গা হাত ও। আপনজনের রক্ত ঝরে পড়া শরীর দেখার চেয়ে ভয়ানক অনুভূতি দুটো নেই। আজকের বিকেলটা রুবাবের জীবনের সবচেয়ে ভয়ানক মুহুর্তের একটি। সৈকত যখন ওকে বলছিল মুনের খেয়াল রাখতে তখন রুবাব বুঝতে পেরেছিল, এই ছেলের মাথায় অদ্ভুত খেয়াল চলছে। কড়া স্বরে নিষেধ ও করেছে বারবার। কিন্তু ছেলেটা শুনলে তো। তখন ওর চোখে কেবল প্রিয়তমাকে নিয়ে ভয় খেলছিল।

যখন ওদের চারপাশে দেয়ালে গুলি এসে লাগছিল, তখন সৈকত ধারণা করেছিল, যে কোন সময় ওদের উপর ও গুলি এসে লাগবে। যদি এলোমেলো হয়ে থাকে তবে যে কারো গায়ে লাগবে। যদি তার চন্দ্রকথার গায়ে লাগে? কিংবা বন্ধুর! সে কি সইতে পারবে? নাহ, পারবে না। তাইতো চন্দ্রকথাকে একবারে পেছনে দাঁড় করিয়েছে, যাতে আঘাতটা তার গায়ে না লাগে। তারপর নিজে গিয়ে দাঁড়িয়েছে সামনে। যাতে আঘাত ওর গায়ে লাগে, ওর প্রাণপ্রিয় দুইজনের গায়ে না লাগে। মুন যখন ওকে বাঁধা দিল। তার ঠিক সৈকতের চোখ পড়েছিল গলির বরাবরই রাস্তার অপজিটে একটা লোক বন্ধুক তাক করে আছে। তার নিশানা এদিক ওদিক ঘুরে এখন এদিকেই এসেছে। যে কোন সময় গুলি এসে লাগবে। সৈকত তা পরখ করেই মুনকে ধাক্কা দিয়ে রুবাব সমেত ফেলে দিয়েছিল। ফলে গুলিটা এসে বিঁধেছিল ওর গায়ে। বন্ধু আর প্রেমিকার কিছুই হয়নি। এ আত্মত্যাগ তার ইচ্ছেকৃত, ভালোবাসার জন্য, বন্ধুত্বের জন্য। তবে বন্ধু থেকে ভালোবাসার পরিমাণটা বেশি। তার চিন্তা কেবল, তার যাই হোক, তার চন্দ্রকথার যাতে কিছু না হয়। তাই তো গুলি লাগার পর শেষ কথা বলেছিল, “আমার চন্দ্রকথার খেয়াল রাখিস।”

কথাটা এখনো কানে বাজছে রুবাবের। তখন রুবাব ঘোরে ডুবে ছিল যেন। ঘোর থেকে বেরিয়েই বন্ধুকে কথা দিল, ” আমি ওর খেয়াল রাখব। চিন্তা করিস না। তুই জাস্ট চোখটা মেলা রাখার চেষ্টা কর, সৈকত। চোখ বুঝিস না। আমরা এখনই হাসপাতালে যাব। ”

বন্ধুকে দেয়া কথাটা আদৌ রাখতে পেরেছে রুবাব? খেয়াল রাখতে পারছে? বোনটা কাঁদছে। রুবাব এগিয়ে গেল বোনের দিকে। পাশে দাঁড়িয়ে আলতো হাত রাখল বোনের কাধে। নিজের সব অস্থিরতা চেপে বোনকে ডাকল,
“মুন?”

ভাইয়ের ডাকে চোখ তুলে তাকাল মুন। করুণ চোখে চেয়ে রইল এক পল। রুবাব সবে সান্ত্বনার বাণী ছুঁড়তে নিচ্ছিল, সেই ক্ষণে মুন এসে ঝাপিয়ে পড়ল ওর বুকে। থেমে যাওয়া কান্নাটা আবার ভেসে এলো। তীব্র আর্তনাদ নিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠল মুন। ও যেন হুশেই নেই। ভাইয়ের বুকে থেকে প্রেমিকের জন্য আর্তনাদ করে গেল অনর্গল।
” আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। সৈকতের কিছু হলে আমি মরে যাব, ভাইয়া। ও একটাবারও আমার কথা ভাবল না, ওর কিছু হলে আমার কী হবে? আমি মরে যাব, ভাইয়া।”

মুনের একেকটা আর্তনাদে তীব্র ভালোবাসা প্রকাশ পাচ্ছিল। বোনের ওমন আর্তনাদে রুবাবের চোখ ভরে আসছিল জলে। বলতে ইচ্ছে হলো, সৈকত তোর কথাই ভেবেছে। ও তোকে নিরাপদে রাখার কথা ভেবেছে, কিন্তু ভাবেনি ওর অবর্তমানে তোর অবস্থাটা কেমন হবে।
সে কথা বলল না রুবাব। শুধু নির্বাক চেয়ে রইল। সৈকত গুলিবিদ্ধ হবার দৃশ্য দেখে মুন ভীষণ শক খেয়েছে। কিছুক্ষণ ঘোরে ছিল, কিছুই বুঝে উঠতে পারেনি। ঘোর থেকে বেরিয়ে বিস্মিত চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর জড়বস্তুর মতো এগিয়ে গেল সেদিকে। কাঁপা হাতে একবার ছুঁয়ে দেখল গা। তাতেই ওর হাত মাখামাখি হলো রক্তে। রক্তরাঙা হাতটা তুলে চেয়ে রইল এক পল, তারপর তাকাল মাটিতে পড়ে থাকা সৈকতের দিকে। চাইল, চেয়ে রইল অসাড় হয়ে। সেই তাকানোর মাঝেই ধপ করে পড়ে গেল। অতিরিক্ত শকে জ্ঞান হারিয়েছে।

তখন রুবাবের অবস্থা ভীষণ করুণ। একদিকে বন্ধু জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। রক্ত ভেসে যাচ্ছে, এখনই হাসপাতালে না নিলে মৃত্যু অনিবার্য। বাইরে তখনো গোলাগুলি চলছে। বের হওয়ার পথ নেই। অপরদিকে বোনটা ও চেতনা হারিয়েছে। এখন সে কাকে ধরবে। দুইজন চেতনাকে নিয়ে বেরুবে কিভাবে? সে কি এখানে থাকবে না কি বেরুবার পথ খুঁজবে? পথ খুঁজে পেলেও কাকে নিবে? সৈকতকে হাসপাতালে নেয়া জুরুরি। ওর চেতনা নেই, কোলে করেই নিতে হবে। বন্ধুকে নিতে গেলে বোনকে এই অবস্থায় ফেলে যেতে হবে। সেটা কিভাবে করবে সে?

দিশেহারা হয়ে গেল রুবাব। মনে মনে দোয়া ঝপছিল শুধু। যাতে পরিস্থিতিটা শান্ত হয়। অন্তত কারো সাহায্য নিয়ে দুজনকে নিয়েই একসাথে বেরুতে পারে। একেকটা সেকেন্ড ওর কাছে বছরের মতো লম্বা মনে হচ্ছে। সৈকতের অবস্থা ক্ষণেক্ষণে খারাপ হচ্ছে, রক্তের স্রোত বাড়ছে। রুবাব বন্ধুকে টেনে ভেতরে আনল। ডাকতে লাগল।

সৈকত উঠল না। ভাগ্য সুপ্রসন্ন হলো। পরিস্থিতি শান্ত হলো। রুবাব পুলিশের সহায়তায় পানি দিয়ে মুনের জ্ঞান ফিরিয়ে, সৈকতকে নিয়ে হাসপাতালের পথ ধরল। পুরো পথ মুন হাউমাউ করে কেঁদেছে। হাসপাতালে আসতেই ওর কান্না দেখে নার্স জিজ্ঞেস করেছিল, “উনি কি পেশেন্টের ওয়াইফ?” রুবাব উত্তর দেয়ার অবস্থায় ছিল না তখন। কথা ঘুরিয়ে চিকিৎসার তাড়া দিয়েছিল। সেই বিকেল থেকে এমন করুণ করে কাঁদছে মেয়েটা। চোখমুখ ফুলে বিধ্বস্ত অবস্থা।
সৈকত যদি জানতো ওর অবর্তমানে মেয়েটার এহেন অবস্থা হবে তবে আত্মত্যাগের আগের দু’বার ভাবতো। যদি জানতো!

রুবাব বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিল,
“কিছু হবে না সৈকতের। ঠিক হয়ে যাবে। একটু শান্ত হ।”

প্রেমিকের এমন অবস্থায় শান্ত হওয়া যায়? মুন পারল না শান্ত হতে। অশান্তই রইল। আর্তনাদ করল। রুবাব ওকে সান্ত্বনা দিল, সাহস জোগাল। কান্না থামিয়ে চেয়ারে বসাল। মুন ছলছল চোখে অপারেশন থিয়েটারের দিকে চেয়ে রইল।

___

করিডোর দিয়ে হন্তদন্ত হয়ে এক যুবককে দৌড়ে আসতে দেখা গেল। গায়ে কালো শেরওয়ানি পাঞ্জাবি। পরিপাটি সাজ, বিয়ে বাড়ির আমেজে মাতা শরীর। দেখেই বুঝা যাচ্ছে বিয়ে বাড়ি থেকে উঠে এসেছে। চোখে মুখে তীব্র চিন্তা, সুদর্শন মুখটা ভরাট অস্থিরতায়। এক দৌড়ে এসে থামল রুবাবের সামনে। ভীত স্বরে উচ্চারণ করল,
“সৈকত?”

রুবাব ওকে দেখে অবাক হলো না মোটেও। সে জানতো ছেলেটা আসবে। করুণ চোখে ইশারা করল অটিতে। ছেলেটাও তাকাল। তারপর দুজনে চাইল একে অপরের প্রতি। চোখে চোখে কথা হলো। পরপরই রুবাব জড়িয়ে ধরল ছেলেটাকে। এতক্ষণে ফুলেফেঁপে ওঠা বুকটা এতক্ষণে যেন দুঃখ প্রকাশের জায়গা পেল। ওরা যখন একে অপরকে ছাড়ল, তখন দুজনের চোখেই পানি। রুবাব ছেলেটার কাঁধ চাপড়ে বলল,
“নাহিদ, চিন্তা করিস না। সৈকতের কিছু হবে না।”

কথাটা রুবাব বন্ধু নাহিদকে বলল না কি নিজেকে সান্ত্বনা দিল বুঝা গেল না। দুজনেই বিমর্ষচিত্তে চেয়ে রইল অটির দিকে।

নাহিদের ফোন বাজছে অনবরত। সেদিকে খেয়াল নেই ওর। নাহিদ মূলত কাজিনের বিয়েতে ছিল। বিয়ে হচ্ছিল চট্রগ্রাম। সন্ধ্যেবেলা বরযাত্রী নিয়ে বেরুবে। নাহিদ তৈরি হয়ে বরের গাড়ি করে যাচ্ছিল সেন্টারে। মাঝপথে ফোন গেছে রুবাবের। সৈকতের অবস্থা শুনে মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে নেমেই দৌড় লাগিয়েছে। কোনদিন না ভেবে এয়ারপোর্টের দিকে রওনা হয়েছে। মাসখানেক ধরে পরিকল্পনা করা বিয়ে ছেড়ে বিমানে করে পৌঁছেছে ঢাকা।

এ পর্যায়ে মুনকে খেয়াল হলো নাহিদের। বিস্ময় দেখা গেল ওর চোয়ালে। নাহিদ জানতো না যে, মুন সৈকতের সাথেই ছিল। রুবাব এত কিছু বলেনি ফোনে, শুধু বলেছে সৈকতের গুলি লেগেছে। নাহিদ বলল,
“মুন এখানে? ওকে আনতে গেলি কেন?”

রুবাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ও সাথেই ছিল।”

নাহিদ ভয় নিয়ে বলল, “ও দেখেছে?”

রুবাব মাথা নাড়াল। নাহিদ করুণ চোখে চাইল। কীভাবে কাঁদছে মেয়েটা। রুবাব চিন্তিত সুরে বলল,
” মুনটাকে নিয়ে কী করব বলতো? ”

” আন্টি আংকেলকে বলেছিলি?”
” বলেছি, বাবা আসতেছেন।”

” মুনের যা অবস্থা, অসুস্থ হয়ে যাবে। আংকেলের সাথে বাসায় পাঠিয়ে দে।”

“এখান থেকে নড়ছে ও না, আর যাবে বাসায়?”

“আংকেল মুনকে এভাবে দেখলে তো সন্দেহ করবেন। এক ঝামেলার মাঝে আরেক ঝামেলা বাঁধবে। ”

রুবাব উত্তর দিল না। উদাস হলো। চেয়ে রইল অটির লাল বাতির দিকে। ওর চোখ মুখ অস্থিরতা ফুটে উঠল। বুক কাঁপছিল ডিপডিপ। হারানোর ভয় গ্রাস করছে ওকে। শক্তপোক্ত ব্যক্তিত্বের ছেলের চোখের কোণ ভিজল আবার। জল গড়াতে দিল না, ঠোঁট কামড়ে আটকাল। বিড়বিড় করল, ” সৈকত, সুস্থ হ তাড়াতাড়ি। তোকে ছাড়া শুধু মুন নয় আমরাও অসম্পূর্ণ। ”

_____________________

অটির লাল বাতি নিভে গেছে। বেরিয়ে এলো এক ডাক্তার। রুবাব আর নাহিদ দৌড়ে গেল সেদিকে। ভীত গলায় জিজ্ঞেস করল, ” সৈকতের কী অবস্থা? ”

শান্ত স্বরে চিকিৎসক উত্তর দিলেন, ” গুলি অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক। আইসিইউতে শিফট করা লাগবে।”

দুই বন্ধুর মুখ থেকে রক্ত সরে গেল যেন। ওরা কথাই বলতে পারল না। ওদের বাকরুদ্ধ ক্ষণে একটা ভেজা কন্ঠ বলে উঠল, ” ও ঠিক হবে তো ডক্টর?”

অল্পবয়সী মেয়েটার কান্নাভেজা মুখের দিকে তাকালেন ডক্টর। বড্ড মায়া হলো তার। স্বর নরম হলো। বললেন, ” ৪৮ঘন্টার আগে কিছু বলা যাচ্ছে না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।”

চিকিৎসক চলে গেলেন। ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ল মুন। আবার ডুকরে উঠল। নাহিদ রুবাবের তখন নিজেদের সামলানো দায়। ওরা কী মুনকে সামলাবে। সবাই অসাড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। খানিক বাদে সৈকত এলো ওদের সামনে। তবে আগের সেই হাসিখুশিভাবে নয়, স্ট্রাকচারে করে অচেতন অবস্থায়। অটি থেকে আইসিউতে শিফট করছে। মুন কান্না থামিয়ে দিল সৈকতকে দেখেই। সকালবেলার ওমন হাস্যজ্বল মানুষটার এহেন অবস্থা দেখে বুক ফেঁটে এলো। হুট করে কী হয়ে গেল! এই তো ক’ঘন্টা আগেও ওরা কী সুন্দর সময় কাটিয়েছে। মুনকে একের পর এক সারপ্রাইজ দিয়েছে। মুনকে ভালোবেসে দেয়া প্যান্ডেন্ট এখনো ওর গলায় ঝুলছে, অথচ মানুষটা নেই ওর পাশে। ওই যে কিভাবে শুয়ে আছে নিষ্প্রাণ হয়ে। মুন কাঁদল না, স্থির চোখে চেয়ে রইল। ওর চোখের সামনেই সৈকতকে নিয়ে গেল। বুকটা যেন ফুলে-ফেঁপে উঠেছে। দমবন্ধ হয়ে আসছে।

দুই বন্ধু নিজেদের দুঃখ চেপে এগিয়ে গেল, মুনের দিকে। নাহিদ আদুরে সুরে ডাকল,
“পিচ্চি, শান্ত হও। ডাক্তার শুধু শুধু ই ভয় দেখাচ্ছেন। আজ বাদে কাল দেখবে সৈকত একদম ঠিকঠাক। সামান্য লেগেছে, কিছু হবে না। ”

মুন চোখ তুলে তাকাল নাহিদের দিকে। বলল,
“আমি কী করলে ও ঠিক হবে? বলুন, আমি সব করব। শুধু ও ঠিক হয়ে যাক। আমার দমবন্ধ হয়ে আসছে। দুপুরবেলা হুট করে এসে সারপ্রাইজ দিল, কী হাসিখুশি ছিল মানুষটা। হুট করে কী হয়ে গেল। সব আমার জন্য। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে এ অবস্থা হয়েছে উনার। ”

পরপরই রক্তমাখা হাত উঠিয়ে বলল, “এই যে এগুলো দেখছেন, এগুলো সব সৈকতের রক্ত। আমার চোখের সামনে ও……..

মুনের গলা কাঁপল। বিকেলের সেই বিভৎস দৃশ্য চোখে ভাসল। আবার ডুকরে উঠল। রুবাব অন্যদিকে ফিরে চোখ বুঝে ফেলল। সবকিছু বিষাক্ত লাগছে ওর। একদিকে বন্ধু, অন্যদিকে বোন। দিশেহারা রুবাব। নাহিদ ও স্বর আটকে এলো। মেয়েটাকে সান্ত্বনা দেবার মতো ভাষা নেই ওরও।

______

মনির সাহেব হন্তদন্ত হয়ে এলেন। রুবাবকে দেখেই মেয়ের জিজ্ঞাসা জুড়ে দিলেন,
” রুবাব, মুন কেমন আছে? মুন কোথায়?”

মুন তখন অসাড় হয়ে বসা। বিষন্ন বিধ্বস্ত মেয়েকে দেখে মনির সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। ব্যতিব্যস্ত হয়ে মেয়ের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে মুন? এ অবস্থা কেন তোমার?”

বাবাকে দেখে মুনের দুঃখের ঝুলি আবার উগড়ে গেল। আপনস্থান পেয়ে আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। মনির সাহেব উদ্ধিগ্ন হয়ে বারবার জিজ্ঞেস করলেন,
“কী হয়েছে মুন? কোথায় লেগেছে? কাঁদছিস কেন মা? বাবাকে বল?”

মুন বলল না। মনির সাহেব ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন , “মুনের কী হয়েছে? এভাবে কাঁদছে কেন?”

রুবাব বলতে পারল না, “বাবা, তোমার মেয়ে তার প্রেমিকের শোকে কাতর।”

সে নিশ্চুপ রইল। অন্যদিকে চোখ ফেরাল। মনির সাহেবের ভয় হলো। কোথাও মেয়ের অসম্মান হলো না তো! তিনি ভীত স্বরে বলল, “ওর সাথে কিছু হয়ে…..

পুরো কথা উচ্চারণ করতে দিল না রুবাব। বলল, ” না। তোমার মেয়ে একদম নিরাপদে আছে। সৈকত কিছু হতেই দেয়নি।”

মনির সাহেব অবাক হলেন, ” মুন সৈকতের সাথে ছিল? মুন তো ভার্সিটি ছিল। সৈকত ছিল বাড়িতে। তবে দুজনে একসাথে হলো কিভাবে? আর সৈকত গেল কেন ভার্সিটির দিকে? মুন কাঁদছে কেন? কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।”

এই ভরা বিপদের মাঝেও ভীত ঢোক গিলল রুবাব নাহিদ। বন্ধুর চিন্তায় শূন্য মাথায় কোন উত্তর এলো না। কী বলবে ওরা?

চলবে…….