#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ ১৫
#_আরজু_আরমানী
আমি নতুন যে বাড়িটায় থাকছি সেটার পরিবেশ বেশ মনোরম। আমার বারান্দা থেকে দুরে খেলার মাঠ দেখা যায়। পাশের বাড়ির ফুলের বাগান দেখা যায়। এখানে দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে। ঐ বাড়ি থেকে আমার সমস্ত জিনিস এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তিশা আর তিহা সব সাজিয়ে রেখে গেছে। কিন্তু আমার মন ভরেনি। আমি আবার নতুন করে সাজাবো। কিন্তু মন পুড়ছে আমার আগের রুমটার জন্য। সেটাকে নিজের মনের মতো তৈরি করেছিলাম। সেখানে ডুকলেই আমার মন প্রশান্তিতে ভরে যেতো। রুমের মধ্যে ফোন বাজছে। বারান্দা থেকে এসে রিসিভ করলাম। ইশতিয়াক বললো,
” রাত্রি এতোদিন তুমি কলেজে আসোনি কেন?”
” আগামী সপ্তাহ থেকে আসবো।”
” কেমন আছো?”
” হ্যা। ভালো।”
ফোন পুরোপুরি নিরবতায় ছেয়ে গেলো। ইশতিয়াক আর কোনো কথা বলেনি। আমিও ফোনটা রেখে দিলাম। কলিংবেল বাজছে। এই সময় কে আসবে? দরজা খুলে৷ দেখি ছোট ফুপি আর মেহেরিমা। তারা ভিতরে এসে বসলো। আমি ফুপির সাথে কথা বলছি আর মেহেরিমার সাথে দুষ্টুমি করছি। আমি ফুপিকে জিজ্ঞেস করলাম,
” সেদিন ঠিক কি হয়েছিল? যার জন্য আমার নিজের চেহারা পরিবর্তন করতে হলো।”
ফুপি কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমিও তার দিকে তাকিয়ে আছি উত্তরের আশায়। আমি বিশ্বাস করি তিনি আমায় সঠিক কথাটা বলবেন। তিনি তখন বললেন,
” সেদিন তুই যখন বেহুশ হয়ে গেলি। তোর মা সেটা বুঝতে পারেনি। সে ভেবেছিলো তুই ঢং করছিস। তাই সে রাগের তোড়ে তোর মুখে আয়রন মেশিন চেপে ধরেছিলো। ওটা তখন কারেন্টে ছিলো। সেটার তাপে তোর মুখের বাম পাশ একদম জ্বলসে গিয়েছিলো। আমরা যখন তোকে ওখন থেকে বের করলাম, তখন তোর অবস্থা দেখে তিশা পুরো ভয়ে কাঁপতে ছিলো। তোকে হাসপাতালে ভর্তি করার পর যখন তোর মুখটা ঠিক করার ছিলো তখন তোর বাবা ইচ্ছে করেই তোর নিজের ছবি সরিয়ে অন্য একজনের ছবি দেয়। আমি তাকে বারবার বারন করি কিন্তু সে আমার কথা শোনেনি।। জানিনা তিনি এমন কেন করলেন। আর এ ব্যাপারে তোকে জানাতে নিষেধ করেছে সবাইকে।”
ফুপির কথা শুনে আমার হাত আপনা-আপনি আমার বাম গালে চলে গেছে। এতো কিছু ঘটে গেছে। আমার মা এতোটা আঘাত আমাকে কেন করলেন? আমি ফুপিকে জিজ্ঞেস করলাম,
” সেই পুড়ে যাওয়া মুখের কোনো ছবি আছে নাকি?”
ফুপি পুরোপুরি বিস্মিত হলেন। তিনি আমার দিকে অবাক নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তার উত্তর না আসলো। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
” এশা আপু কি ফিরে এসেছেন? ”
ফুপি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
” না ফেরেনি। ”
” আমিও আর ও বাড়িতে ফিরবো না। আচ্ছা ফুপি রাত তো কম হলোনা এবার আসুন খেয়ে নেই। আপনি আজ এখানেই থাকুন।”
আমার খাবার খেতে বসেছি মাত্র তখনি আমার ফোন বাজছে। আমি উঠে ফোন রিসিভ করলাম। যিনি ফোন করেছেন আমি তাকে চিনি। সে বললো,
” রাত্রি কেমন আছো?”
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো। বলুন।”
সাদ চুপ করে রইলেন।কথাবলার মাঝে কেউ থেমে থাকলে আমার খুব মেজাজ গরম হয়। ইচ্ছে করে সেই মানুষকে থাপড়াতে। আমার রাগ হওয়া সত্বেও কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললাম,
” কিছু কি বলবেন?”
” পরে ফোন দিচ্ছি। ”
ফোন কেটে খেতে বসতেই ফুপির কথা শুনে অবাক হলাম, ” ও কি সেই প্লে গ্রাউন্ডের ছেলেটা?”
” না, হ্যা, না না। ও অন্য একজন।”
” কাউকে ভালো লাগলে বলতে পারিস। আমি তাকে দেখে টেখে দিবো।”
” নিজেকেই তো ভালো লাগেনা। সেখানে আবার অন্য কাউকে।”
আমার আর ফুপির কথা এখানেই সমাপ্তি ঘটে। সাদ আর সেদিন ফোন দেয়নি। পরদিন সকালে ফুপি চলে গেলেন। এর পর আরও এক সপ্তাহ চলে গেলো। আমি কলেজে যেতে শুরু করেছি। আজ নেহাকে পড়াতে যাবো। ক্লাস করে বাসায় এসে বেশ ক্লান্ত লাগছে। এখন ভীষন ঘুম পাচ্ছে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। তবুও আমাকে যেতে হবে।
———————————————
ঘড়ির কাটার ন্যায় আমাকেও চলতে হচ্ছে নিজের ইচ্ছে না থাকা সত্বেও। বিকাল সাড়ে ছয়টা। নেহাকে পড়িয়ে রমনায় বসে আছি। বাসায় ফিরতে ইচ্ছে করছে না। এখানে শান্তি শান্তি লাগছে। মস্তিষ্কে একটা ভালোলাগা কাজ করছে। এখানে একটু ঘুমাতে পারলে ভালো লাগতো। ডাক্তার অরুপ ঘোষ ফোন করেছেন তার চেম্বারে যাওয়ার জন্য। একটা রিকসা নিয়ে সেদিকেই চললাম। তার চেম্বারে আসতে খুব একটা সময় লাগলো না। অরুপ ঘোষের সাথে কথা বলার সময় তিনি বললেন,
‘ রাত্রি, তোমার বাবার ব্রেইন ক্যানসার হয়েছে। তিনি তোমাকে জানাতে বারন করেছেন। কিন্তু আমার মনে হলো তোমাকে জানানো দরকার।’
আমি আকাশ থেকে পরলাম। বাবার ব্রেইন ক্যানসার। এখন কি হবে? বাবা কি মারা যাবেন? তিনি কি পুরোপুরি সুস্থ হবেন? অরুপ ডাক্তারের চেম্বারে এসি চলছে তবুও আমি ঘামছি। আমার গলা শুকিয়ে আসছে। আমার সামনে এক গ্লাস পানি দিলেন অরুপ ঘোষ। আমি পানিটুকুন খেয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ এখন কি করবো? বাবা কি সেরে উঠবেন?’
‘ তিনি এখনো প্রাথমিক পজিশনে আছেন। প্রোপার ট্রিটমেন্ট নিলে সেরে ওঠার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু তিনি কোনো প্রকার চেকাপ করাতে রাজি নয়। তাই তোমাকে ডাকা। তুমি তাকে বোঝাও।’
‘ হ্যা। আচ্ছা আজ আসি।’
আমি চেম্বার থেকে বের হতে নিলেই অরুপ ঘোষ আমাকে ডেকে বললেন,
‘ আমরা কি কফি খেতে পারি?’
আমার ইচ্ছে না থাকা সত্বেও রাজি হলাম। তার চেম্বারের পাশেই একটা কফি হাউজে ঢুকলাম। অরুপ ঘোষ কফি অর্ডার দিলেন। আমি চুপচাপ বসে আছি। তিনি আমাকে বললেন,
‘ আমার সাথে কথা বলতে সমস্যা নেই, আমাকে বন্ধু ভাবতে পারো।’
‘ হ্যা….।
অরুপ হাসলেন। তার হাত আমার দিকে বাড়িয়ে বললেন,
‘ রাত্রি আমার বন্ধু হবে?’
‘ আমাদের বয়সের দূরত্বটা কিন্তু অনেক। এখানে বন্ধুত্ব সম্পর্ক একদম হয়না। তবুও আমি মেনে নিলাম।’
এরমধ্যে আমাদের কফি চলে এসেছে। দুজনে আর কোনো কথা না বাড়িয়ে কফি খাওয়ায় মনোযোগ দিলাম। কফি খেতে খেতে আমি তাকে বললাম,
‘ যেদিন আমাকে হসপিটালে নিয়ে আসা হয়, সেদিন কি আপনি ছিলেন আমাকে দেখার জন্য? ‘
‘ হুম। কেনো?’
‘ আপনি কি সেদিন আমার কোনো ছবি তুলেছেন?’
‘ না। সময় পাইনি।’
আবার দুজনেই নিরব রইলাম। কফি খেয়ে অরুপ বিল মিটিয়ে দিলেন। আমি গাড়িতে উঠে বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। বাসে বসে আছি। আমার জীবন কোন দিকে মোড় নিচ্ছে তা আমি নিজেও জানিনা। বাস চলতে চলতে রাস্তায় একটা লোককে দেখে বেশ অবাক হলাম। উনি বলেছেন, তিনি দেশের বাইরে তবে উনি এখানে কি করছেন? আমার ইচ্ছে করছে বাস থেকে নেমে কয়েকটা থাপ্পড় মেরে আসি। ফোন বের করে নেহাকে কল দিলাম। ফোন রিসিভ হতেই জিজ্ঞেস করলাম,
‘ তোমার ভাইয়া কোথায়? ‘
‘ এতোদিন সিলেট ছিলো আজ সকালে বাসায় এসেছে। কেনো? কিছু হয়েছে?’
‘ না। এমনিতেই।’
আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। সাদ সেদিন আমাকে যে চিঠি দিয়েছিলেন তাতে স্পষ্ট করে লেখা ছিলো, ‘ তিনি দেশের বাইরে চলে যাবেন এবং পুলিশের চাকরিতে রিজাইন দিবেন।’ তাহলে উনি কি সেদিন আমাকে মিথ্যা বলেছেন। কিন্তু আমি তো তার কাছে সত্য বা মিথ্যা কোনোটাই জানতে চাইনি। আচমকা মাথায় একটা কথা এলো। যখন আমি হসপিটাল থেকে রিলিজ পাই তখন বাবা, ‘ সা.. ‘ বলে কাউকে সম্বোধন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কেন যেন তিনি থেমে গেলেন। তবে সাদ কি কখনো দেশের বাইরে যায়ই নি। সে কি আমার অসুস্থতার পুরোটা সময় আমার পাশে ছিলো। আমার সাথে তিহা ছিলো। ওকে জিজ্ঞেস করলে কিছু জানতে পারবো। উনি দেশে থাক বা বিদেশে তাতে আমার কি? তিনি আমায় মিথ্যা বলায় আমার এতো রাগ কেনো হচ্ছে? সেদিন বাসায় ফেরার পরও রাগ কমছিলোনা। রাগের তোড়ে সাদকে ফোন করলাম, ওনার ফোনে বিডি শো করছে। এতোদিন আমি এটা খেয়াল করিনি কেনো? ফোন রিসিভ হতেই আমি বলে উঠলাম,
‘ আমি কি সত্যি মিথ্যা জানতে চেয়েছিলাম, কেনো মিথ্যে বললেন আমায়?’
সাদ চুপ করে আছেন। হয়তো আমার এই কড়া সুর বুঝতে তার অসুবিধে হচ্ছে। তিনি আরও কিছুক্ষন নিরবতায় থেকে উত্তর দিলেন,
‘ এতো রেগে কেনো আছো?’
‘ প্রশ্ন করেছি উত্তর দিন।’
‘ যদি না দেই।’
‘ তাহলে ফোন কেটে দেই।’
কথা বলতে দেরী ফোন কাটতে আর দেরি নেই। ফোনটাকে জোড়ে ফ্লোরে মারলাম। ফোনের ইহলিলা সাঙ্গ হলো। সাদ মিথ্যা বলায় আমার এতো রাগ কেনো হচ্ছে? আমার এতো রাগ হওয়া ঠিক নয়। না না। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? বড় বড় শ্বাস ফেলে ওয়াসরুমে গিয়ে মুখ হাত ধুয়ে এলাম। রাগ কমছে। বারান্দায় দাড়িয়ে আছি। আবহাওয়া সুন্দর। ঝিরিঝিরে বাতাস বইছে। মনের সমস্ত রাগ চলে গেছে। এবার শান্তি লাগছে। ফোনের দিকে তাকাতেই কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। আহ! আমার এতো স্বাদের ফোন। দৌড়ে ফোনটা ধরলাম। ওমা দেখি কিছু হয়নি। একদম ঠিক আছে। এবার পুরোপুরি শান্তি লাগছে।
_________________________
ভোর ০৫:৩০। কলিংবেলের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে। আমি দু’ হাতে চোখ ডলতে ডলতে দরজা খুলে অপ্রত্যশিত মানুষকে দেখে আমি হতভম্ব। সে এখানে কেন এসেছে? আমার ঠিকানা কিভাবে জানলো? এখানের সমস্ত খবর আমি বাবাকে বলতে বারন করেছি। তবে উনি কিভাবে জানলেন? উনি জানা মানে তো আমার পুরো পরিবার আমার ব্যাপারে সবটা জেনে যাবে। আমাকে হতভম্বের মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে তাহমিদ ভাইয়া বললেন,
” কেমন আছিস?”
চলবে……….