ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে পর্ব-১৯

0
344

#_ধরো_যদি_হঠাৎ_সন্ধ্যে
#_পর্বঃ১৯
#_আরজু_আরমানী

‘মা রাত্রি,

আমি জানিনা এই চিঠি কখনো তোমার কাছে পৌঁছাবে কি না। যদি পৌঁছায় তখন হয়তো আমি এই পৃথিবীতে থাকবোনা। শোন মা, আমার অবর্তমানে তোমার বাবাকে কখনো অবিশ্বাস করবেনা। একটা কথা মনে রাখবে মা, ‘যার সঙ্গীনি হবে তার হাত কখনো ছাড়বে না।’ মা তোমার পাশে ছায়া হয়ে সর্বদা আছে।

তোমার মা
মীরা।’

আমরা ছাদ থেকে ফিরে আসার কিছুক্ষণ পর সাদ ঘুমিয়ে পরলেন। আমি একটা টেবিল ল্যাম্পের ক্ষীন আলোতে মায়ের লেখা চিঠিটা পরলাম। মা আমাকে কি ইশারা করলেন? বাবাকে অবিশ্বাস করতে বারন করলেন। এই বিশ্বাস -অবিশ্বাসের পর্ব তো সেই কবেই ঘুচে গিয়েছে। মা হয়তো ভাবতেই পারেননি বা তিনি চিন্তাই করেননি তার মেয়ে তার বাবার থেকে বহুগুন দুরে ছিলো। মা কি সহজ চিন্তা করে গেলেন? তিনি ভেবে গেলেন তার মেয়ে খুব সুখে থাকবে তার বাবার কাছে। সঙ্গীর হাত ছাড়ার প্রশ্নই ওঠেনা। আমার বাবা ছেড়ে গিয়েছেন বলে আমিও কি যাবো? না। মা তার জীবনে খুব কষ্ট করেছেন। তার এই চিঠি শুধু আমাকে উপদেশ দেয়ার জন্য নয়। অন্য কোনো ইনফরমেশন দেয়ার জন্যই তিনি এই চিঠি আমার বিয়ের সময় আমাকে দিতে বলেছেন। আমার মা তার বিবাহিত জীবনেও শান্তি পাননি। একজন নারী যতই ডিগ্রিধারী হোক, সংসার করার মানসিকতা তার মধ্যে সবসময় থাকে। আমার মাও তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। আমার চোখে জল জমাট বেঁধেছে। মায়ের আক্ষেপ আমার কোনোদিন মিটবেনা। চিঠিটা আবার পুরোনো ভাঁজে ভাঁজ করে স্বর্নালি বক্সে রেখে দিলাম। খালামনি মায়ের সমস্ত কিছু আমাকে দিয়ে দিলেন। আমি আমার বাসায় আমার মায়ের সমস্ত জিনিস রেখে দিবো স্বযত্নে। তাহমিদ ভাইয়া বিয়ে করেননি আমার জন্য। তাকে একটা ফোন করা দরকার। এতো রাতে ফোন পেয়ে তিনি নিশ্চয়ই চমকে উঠবেন। ভাববেন আমি কেন এতো রাতে কল দিলাম? তাকে কল দিচ্ছি, কল বাজছে। একবার, দুবার, তিনবারের সময়ে তিনি কল রিসিভ করে ঘুম ঘুম কন্ঠে বললেন,

‘ এতো রাতে কল করে কেউ জ্বালায় নাকি?’

তার কথার ধরনে বোঝা গেলো তিনি ড্রাংক। তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু তাকে একটু চমকে দিতে ইচ্ছে করছে। তাই গলা ভারী ভারী করে বললাম,

‘ আপনার প্রিয় রাত্রির তো বিয়ে হয়ে গেছে।’

‘ কে রাত্রি? ও… আমার মামার মেয়ে। ওকে তো আমি বিয়ে করবো। ও করতে না চাইলে থাপড়িয়ে বিয়ে করবো…..

এই মাতালের সাথে কথা বলতে এখন বিরক্ত লাগছে। রাগ হচ্ছেনা। মাতালরা মাতালদের পুজো করে। তাই তাদের উপর রাগ করা যায়না। তারা সম্মানিত ব্যক্তি। কল কেটে এশা আপুকে কল দিলাম। না সে কল ধরছে না। রাত দুইটা। সাদ ঘুমাচ্ছেন। আমি বারান্দায় বসে আছি। ঘুম পালিয়েছে আমার থেকে। এই রাতটা আজ ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে? আজ বাসর রাত বলে। আচ্ছা বাসর রাত তো জেগে কাঁটানো উচিত। তবে সাদ কেন ঘুমাচ্ছেন? তার তো উচিত এখন আমার পাশে বসে এই রাতের মায়াবি দৃশ্য দেখা। তিনি এখানে এসে বসে এখন কোন গানটা গাইতেন।

‘ এই মায়াবি চাঁদের রাতে….
‘ রেখে হাত তোমার হাতে….
‘ মনের এক গোপন কথা বলতে চাই…….

ভালোই লাগত শুনতে তার কন্ঠে। তাকে কি এখন ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবো? না যদি রাগ হয়। রাগ হয়ে যদি থাপ্পড় মারে, তবে কি আমিও একটা মারবো? মারলে কেমন হবে? তিনি জেগে থাকলে এই ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করা যেতো। এমন কোনো রেকর্ড কি আছে যে, স্বামী- স্ত্রী দুজন দুজনকে ইচ্ছেমতো মেরেছে? কিসব ভাবছি আমি? ছি ছি।

________________________

সকালে আন্টির সাথে কথা বলে সাদের সাথে বেরিয়েছি। তিনি আমাকে আমার বাসার সামনে নামিয়ে দিয়ে বললেন,

‘ ব্যাগ প্যাক করে রেডি থেকে দুপুরে এসে নিয়ে যাবো।’

‘ কেনো এখানে থাকলে সমস্যা কি?’

‘ আমি আমার বউ ছাড়া থাকতে পারবোনা।’

‘ এ্যা।’ এটা কেমন কথা হলো। বউ ছাড়া থাকতে পারবেনা মানে কি? এখন কি এই লোকটাকে সারাদিন স্বামী স্বামী করে ডাকতে হবে? আমাকে ভ্রুকুটি করে থাকতে দেখে সাদ বললেন,

‘ কি ব্যাপার কি ভেবেছো? আমি কথা বলতে জানিনা। সব জানি বাট বলিনা।’

“ও আচ্ছা।’

‘ হুম’

‘ আপনার সাথে জরুরি বিষয় নিয়ে আলোচনার ছিলো বলেই আপনার বাসায় যাবো।’

তিনি গাড়ি নিয়ে সাই সাই করে চলে গেলেন। তিনি চলে যেতেই অন্য একটা গাড়ি এসে থামলো। গাড়ি থেকে চুলে হাত চালাতে চালাতে নামলেন তাহমিদ ভাইয়া। তাকে দেখে আমার হাসি পেলো। চুলে এমনভাবে হাত বুলাচ্ছেন যেনো নায়ক শাহরুখ খান। কি ভাব?

‘ কি ব্যাপার ম্যাডাম রাত্রি, কাল রাতে ফোন কেনো দিলেন?’

এই কথা বলতেই কাল রাতে ওনার মাতলামির কথা মনে পরলো। আমি আবার তাকে সেই রকম ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললাম,

‘ আপনাকে একটু চমকে দিতে।’

আমার এরুপ পরিহাসের কন্ঠ শুনে তিনি চুল থেকে হাত সরিয়ে কলার ঠিক করে সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তিনি হয়তো বুঝে গেছেন যে কাল রাতে তার মাতলামির কথা জেনে গিয়েছি। তার মুখ থেকে ভেলকিমার্কা হাসিটা চলে গেছে। আমি তাকে বললাম,

‘ রাত্রির তো বিয়ে হয়ে গেছে।’

তিনি এই বার হো হো করে হেসে উঠলেন। একদম আশফিক কাকার মতো হাসি। যেটা বড্ড বিশ্রী লাগে আমার। মনে হয় এক্ষুনি মুখ থেকে দাঁতগুলো খুলে টুলটুল করে মাটিতে পরবে। মেজাজ খারাপ হতেই বললাম,

‘ আপনার এই ক্যাঙ্গারুমার্কা হাসি বন্ধ করুন।’

‘ তোমার বিয়ের এই মিথ্যে খবরটা শুনে কি আমি পাগল হয়ে যাবো ভেবেছো? আমি তোমাকে দ্রুত বিয়ে করবো? ম্যাডাম রাত্রি তুমি আমাকে চিনতে পারলেনা।’

” আমরা ভালো মানুষ তো, তাই পাগল চিনতে একটু দেরী হয়।’

‘ রাত্রি তুই বিয়ে করে ফেললি এটা আমি জানতে পারি মামার কাছ থেকে। তুই আমাকে একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করলি না বোন।’

তামিম ভাইয়ার মুখে এই কথা শুনে তাহমিদ ভাইয়া পুরাই থ। তামিম ভাই আর তিশা এসেছে। আমি এবার তাহমিদ ভাইয়াকে বললাম,

‘ শুনলেন তো।’ তিনি চোখমুখ কুঁচকে চলে গেলেন। আমি ওদের নিয়ে রুমে এসে বসলাম। তিশা আমাকে বললো,

‘ সাদকে ভালোবেসে সবাইকে রিজেক্ট করতিস রাত্রি। ‘

‘ নাহ তখন ভালোবাসা ছিলোনা। তখন শুধুই অনুভূতি।’

‘ ভালোবেসে ফেললি কখন?’

‘ হঠাৎ।’

ওদের সব কিছু ক্লিয়ার করলাম। ও বাড়ির খবর নিলাম। সবাই ভালো আছেন। তাহিরা মাও ভালো আছেন। বাবা নাকি আজ তাসকিনকে নিয়ে সাদের বাড়ি যাবেন। এটা শুনে খুশি লাগলো। এশা আপুর কথা জিজ্ঞেস করতেই তিশা বললো,

‘ আপু শরিয়তপুরে আছেন। তিনি তার বয়ফ্রেন্ডকে বিয়ে করে তার বাড়ি গিয়ে উঠেছেন। সেখানে তাকে সবাই মেনে নিয়েছে। তিনি এখন ভালোই আছেন। খালা আর খালু ওদের বাড়ি আসতে বলেছেন। মনেহয় তারাও ওদের মেনে নিবেন।’

‘ তোকে কি মেনে নিয়েছে?”

আমার কথা শুনে তামিম ভাই আর তিশা দুজনেই হাসলেন। হেসে হেসেই তিশা বললো,

‘ আমরা ওসব মেনে নেওয়ার ধার ধারিনা। শোন রাত্রি, তোর আগে বিয়ে করেছি তবে খালা আমার আগে তুই হবি। ‘

হাসব না কাঁদব ঠিক বুঝতে পারছি না। তামিম ভাইয়া মুচকি হাসছেন। আমার অবস্থা কাহিল। তিশাটা এতো ঠোঁটকাটা কবে থেকে হলো। নিজের অবস্থা লুকানোর জন্য বললাম,

‘ তোরা বস আমি চা নিয়ে আসি।’

‘ শোন এতো ফরমালিটির দরকার নেই। তোর শ্বশুর বাড়ি কবে নিবি? আমার স্বামীর দেখা পেলেও শ্বশুর-শ্বাশুড়ির দেখা পেলাম না।’

‘ এখনো…..

কলিংবেল বাজছে। এখন আবার কে এলো? দরজা খুলে দেখি সাদ। তিনি বাসায় ডুকতে ডুকতে বললেন,

‘ তোমার রেডি হওয়া শেষ? ‘

আমার উত্তর না নিয়েই তিনি তামিম ভাইয়া আর তিশার সাথে কথা বলতে শুরু করেছেন। আমি ওখানে দাঁড়ালাম না। এই লোক আজ সকাল থেকে দেখছি উল্টো পাল্টা বকছেন। কখন কি বলছেন হুস নেই। আজ সকালে আন্টির সামনে বলে ফেললেন,

‘ মা তোমার ছেলের রুমের বারান্দায় একটা নতুন বাল্ব লাগিয়ে রেখো। তোমার পুত্রবধূর বারান্দা খুব প্রিয়। সে কাল সারারাত বারান্দায় কাটিয়েছে।’

আন্টির সামনে আমার মান-সম্মান সব ধুলায় মিশে গেছে। মুখ লুকানোর জায়গা পাইনি। শুনেছি বিয়ের পর মানুষ নির্লজ্জ হয়। সাদ কি তার প্রথম পর্যায়ে আছেন?

‘ রাত্রি…

ওই শুরু হলো। এখন ডাকতেই থাকবে। আর কোনো থামাথামি নেই। আমার রুমের সামনে এসে বললেন,

‘ তুমি কি রেডি? ‘

‘ না। সময় লাগবে।’

‘ তামিম আর তিশাকেও নিয়ে যাই কি বলো?’

‘ ওরা কি যাবে?’

‘ আমি ওদের রাজি করিয়ে ফেলেছি।’

‘ আচ্ছা।’

সাদ বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। আমি তার দিকে তাকালাম। তিনি আমার ফ্যামিলির মানুষদের কি এতো সহজে মেনে নিতে পারবেন? আন্টি কি নিতে পারবেন? যেখানে আমি নিজেই নিতে পারছিনা, তারা কিভাবে নিবেন? তারা কি বাবাকে আদৌও মেনে নিয়েছেন? তারা কি আমার জন্য বাবাকে মেনে নিয়েছেন? তাসকিন অন্য মায়ের হলেও সে আমার ভাই। আমি তাকে ভালোবাসি। নেহাকেও তো আমি বোনের মতো ভালোবাসি। আমি বাসা গোছাচ্ছি আর এসব ভাবছি। জানিনা সাদ আমার মনের কথা কিভাবে বুঝলেন? তিনি আমার কাছে এসে দাড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন,

‘ তোমার জন্য পুরো পৃথিবীকে আমি সহ্য করবো।’

চলবে……..