বিয়ে পর্ব-১৩

0
831

#বিয়ে
#লেখনীতে – ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ১৩

ধ্রুব প্রচন্ড অস্থির হয়ে পড়লো। অদ্রি নমনীয় গলায় বলল,
— না। বাট আমাকে নিয়ে এত ইনসিকিউরড ফিল করবেন না। আমি বাচ্চা নই। আজকের জন্য সত্যি ক্ষমা চাইছি, আর কখনো এমন হবে না। আপনি অস্থির হবেন না।
ধ্রুব আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। আচমকা এক অভাবনীয় কান্ড করে বসলো। আস্তে-ধীরে ঠোঁট এগিয়ে নিলো অদ্রির দিকে। শক্ত এক চুমু বসালো অদ্রির কপালে, অনেকটা সময় নিয়ে। অদ্রির হাত-পা পুরোপুরি ঠান্ডা হয়ে গেলো। নড়তে ভুলে গেলো যেন! অদ্ভুত এক অনুভূতি কাজ করছে মনে। ধ্রুব যে এমন একটি কাজ করবে তা কস্মিনকালেও ভাবে নি সে।
ওদের দুজনের মধ্যে প্রেম, ভালোবাসা নামক কোনোকিছু গড়ে ওঠেনি। স্বাভাবিক সম্পর্কটুকু পর্যন্ত নেই। নেহায়েতই একবাড়িতে থেকে যতটুকু কথা বলা বা কাজ করার দরকার ততটুকুই দায়িত্ব হিসেবে পালন করে দু’জন। অধিকারবোধ বিহীন ধ্রুব’র এমন আচরণ তার কাছে বড্ড অস্বাভাবিক ঠেকলো। কিন্তু এই ব্যাপারটাকে ঠিক কি বলে আখ্যায়িত করবে ও বুঝে ওঠতে পারছে না। এদিকে ধ্রুব’র ঠোঁট তখনো অদ্রির কপালে ছোঁয়ানো। অন্যরকম এক ঘোর পেয়ে বসেছে তাঁকে। মনে হচ্ছে সময়টা এখানে থমকে গেলেই পৃথিবীর এক অন্যতম সুখ থেকে তাকে কেউ বঞ্চিত করতে পারতো না। সুখ সুখ জগতে ধ্রুব’র বেশিক্ষণ বিচরণ করার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গেলো। কারণ ওর এই ভাবনার মধ্যিখানেই সে দরজা খোলার শব্দ পেলো।
কিন্তু ধ্রুব মোটেও তা পাত্তা দিলো না। কে না কে এসেছে তা জেনে ওর কি? এইযে ছোট্ট একটা চুমু’তে ওর এতো ভালো লাগছে সেই অনুভূতিটা কি আবার ফিরে আসবে?

এদিকে শায়লা হাসান দেখতে এসেছিলেন তার পুত্র অদ্রির ভুলের জন্য ওকে বকাঝকা করছে কি-না!
কিন্তু ঘরে ঢুকে দু’জনের একান্ত সময় কাটানোর মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে তিনি বোকা বনে গেলেন। এরকম অসস্ত্বিকর পরিস্থিতিতে পড়ে কি করা উচিৎ তা ঠাহর করতে পারলেন না। উল্টো ঘুরে দরজার দিকে ফিরতে যাবেন তখনই অদ্রি হঠাৎ শায়লাকে দেখে ফেললো। আর নিজেকে ধ্রুব’র এত কাছাকাছি দেখে লজ্জায় তার মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে করলো। হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতেই এতক্ষণের ঘোর ভাঙলো ধ্রুব’র। মেজাজ চড়ে গেলো ওর। কার সাহস হয় এই ধ্রুব’কে এভাবে ধাক্কা দেওয়ার? উঁচু গলায় কিছু বলতেই যাবে কিন্তু নিজের মা’কে সামনে দাঁড়ানো দেখে ওর মুখের কথা মুখেই আটকে গেলো। ধ্রুব হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মায়ের সামনে এমন বিব্রত পরিস্থিতিতে সে কখনো পড়েনি, কখনো না।

দুপুরের তপ্ত রোদ্দুর জানালা ভেদ করে লুকোচুরি খেলছে ব্যলকনিতে। বাতাসে দুলছে সাদা পর্দা। গুমোট একটা অবস্থা ঘরে। শায়লা হাসান ওদের মনোভাব আঁচ করতে পারলেন। তার গুণধর পুত্র ক’টা দিন আগেও বড় বড় কথা বলেছিলো বিয়ে নিয়ে, সম্পর্ক নিয়ে। সে এই ক’দিনে এতোদূর এগিয়ে গেছে ভেবেই তিনি পুলকিত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে তিনি হালকা কেশে বলে ওঠলেন,
— খাবার দিয়েছি, খেতে আসো তোমরা।
ধ্রুব গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
— হুঁ।

শায়লা হাসান চলে গেলেন। যাওয়ার আগে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন। তিনি যেতেই অদ্রি এতক্ষণের পুষে রাখা রাগটা উগড়ে দিলো। ধ্রুব’র সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচিয়ে ওঠে বলল,
— আপনি কি করে এমন একটা কাজ করতে পারলেন আমার সাথে? আন্টি কি ভাবলো!
ধ্রুব অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো। কি উত্তর দিবে? ওর নিজেরই তো কেমন কেমন লাগছে! ওর চুপ থাকাটা অদ্রির সহ্য হলো না। দু’হাতে মুখ ঢেকে বিছানার একপাশে ধপ করে বসে পড়লো। বলতে লাগলো,
— ছিঃ আমার তো লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে করছে। শ্লীলতাহানির একটা লিমিট থাকে।
ধ্রুব রাগ নিয়ে বলে ওঠলো,
— সামান্য একটা চুমু দেওয়াতে শ্লীলতাহানির অপবাদ দেবে? দিস ইজ নট ফেয়ার।
— একশো বার দেব? আপনি আমার অনুমতি নিয়েছেন চুমু দেওয়ার জন্য? ছিঃ ছিঃ!
ধ্রুব বিস্ময় নিয়ে বলল,
— অনুমতি নিয়ে কি চুমু দেওয়া যায়? চুমু খাওয়ার ক্ষিধে জাগলে আপনাআপনি চুমু হয়ে যায়।
অদ্রি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল,
— চুমু কি খাওয়ার জিনিস? আপনার রুচিবোধ দেখে আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি। কি ভাষা এসব!
ধ্রুব পানসে গলায় বলল,
— কেন আমার চুমু কি তোমার ভালো লাগেনি? তোমাকে আমার দেওয়া প্রথম চুমু ছিলো এটা!
অদ্রি চোখ রাঙিয়ে বলল,
— ছিঃ ছিঃ৷
ধ্রুব অধৈর্য্য হয়ে বলল,
— বারবার ছিঃ ছিঃ করছো কেন অদ্রি?
অদ্রি রাগী গলায় বলল,
— আপনি আমাকে প্রথম চুমু দিয়েছেন এটা ঘটা করে আমাকে বলার কারণ কি? অপরাধ করেছেন আবার একটু লজ্জাবোধও নেই আপনার? একটা মেয়ের সামনে এসব অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করছেন।
ধ্রুব কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকলো অদ্রির দিকে। মেয়েটা এত রিয়্যাক্ট করছে কেন? তবে ওর আচরণে এখন বেশ বাচ্চামো মিশে আছে। মেয়েটা এতো উচ্ছল, কিন্তু সবসময় কেমন গম্ভীর ভাব নিয়ে থাকে!
অদ্রির উচ্ছ্বসিত আচরণ ধ্রুব খুব এনজয় করছে। ও ভাবলো সামান্য কপালে চুমু দেওয়ায় যে মেয়ে এতটা লজ্জা পাচ্ছে, ওকে বকাঝকা করছে ধ্রুব যদি ওকে আরেকটু রাগিয়ে দেয় তাহলে কেমন হবে? ওর মাথায় আচমকা দুষ্টুমি খেলে গেলো। ধ্রুব নিচু হয়ে অদ্রির সামনে বসলো। তার ঠোঁটে বাঁকা হাসি। অদ্রির মুখটা দু’হাতে ধরে নিজের দিকে ফেরালো। অদ্রি অবাক হয়ে তাকালো ওর দিকে। ধ্রুব দেরি না করে ফট করে ওর গলায় একটা কামড় বসিয়ে দিলো। অদ্রি বিস্ময়ে, লজ্জায়, কুন্ঠায়, বিব্রতবোধ নিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। কান, গালে ফুটে ওঠলো লালচে আভা। ধ্রুব
ভাবলেশহীনভাবে ওঠে দাঁড়ালো। যেন ও কিছুই করেনি। তারপর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
— চুমু দিয়ে অপরাধ করে ফেলেছিলাম, এবার কামড় দিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করে ফেললাম। ওকে মিসেস?
রাগে অদ্রির পায়ের তলা কাঁপতে লাগলো। হাত নিশপিশ করতে লাগলো। চেঁচিয়ে বলে ওঠলো,
— আপনি আসলে সরল নন, সরল সেজে থাকার অভিনয় করেন। এখন তো ডাউট হচ্ছে, সেদিন বিছানায় ঘুমানোর পর আপনি হয়তো আমার সাথে এমন ব্যবহারই করেছিলেন।
ধ্রুব শুনে হাসলো। মেয়েটাকে কি আজকে বাচ্চামো রোগে পেয়েছে নাকি? ও ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
— না তো। শুধু দেখেছিলাম।
অদ্রি কাঠ কাঠ গলায় জিজ্ঞেস করল,
— কি দেখেছিলেন?
ধ্রুব বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
— তোমার কপালে একটা তিল, পেটে তিনটা, গলায় দুটো। আমি কিন্তু চুমু খাইনি একটাও। শুধু দেখেছি। তোমার যা ঘুমানোর স্টাইল। সব দেখিয়ে বেড়াবে, আর কেউ দেখলেই দোষ? হুহ!

ধ্রুব সব ফাঁস করে আর এক মুহূর্ত ওখানে দাঁড়ালো না। কারণ অদ্রি হয়তো ওকে আজ খু’নই করে ফেলবে। মেয়েটা যতোটা চুপচাপ থাকে, আজ ততোটা নয়। হয়তো এসব শুনে ধ্রুব’কে আজ কিছু একটা করেই ফেললো। না বাবা! রিস্ক নেওয়ার কি দরকার!
এদিকে ধ্রুব’র মুখে এসব শুনে অদ্রি বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো। চোখে জল চলে এলো। মনে মনে এত ধ্রুব’র? আর অদ্রি কি-না টেরই পায়নি? নাহ! আজ থেকে একঘরে আর থাকা যাবে না। কিছুতেই না। শায়লাকে বলতে হবে অদ্রিকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা করে দিতে। জিজ্ঞেস করলে বলবে ওর পড়াশোনায় সমস্যা হয়। অদ্রি নিজেকে সামলালো। চুল আঁচড়ে, জামা-কাপড় ঠিক করে নিলো। বলা তো যায় না ধ্রুব’র কু-দৃষ্টি কোথায় কোথায় যায়!

দুপুরের খাবারের টেবিলে ধ্রুব বেশ আয়েশ করে খাচ্ছে। ওর মনমেজাজ ভালো। কেন ভালো তা শায়লা
আন্দাজ করতে পারলেন। অদ্রি নিশ্চুপ হয়ে খাচ্ছে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চাইছে না। ধ্রুব বারবার
আড়চোখে দেখতে লাগলো ওকে। বেশ হাসি পাচ্ছে ওর। হঠাৎ মনে হলো অদ্রির তো ফোন নেই। ও কি একটা ফোন গিফট করবে ওকে? কিন্তু অদ্রি কি তা নেবে? ধ্রুব খাওয়া শেষ করে রুমে এলো। ভাবলো অদ্রি ঘরে এলে জিজ্ঞেস করবে ওকে ফোনের ব্যাপারে। ততক্ষণে অফিসের কিছু ইম্পোর্টেন্ট কিছু কাজ করতে ল্যাপটপ নিয়ে বসলো। অদ্রি ঘরে এলো একদম বিকেলবেলা। এসেই নিজের বইখাতা ব্যাগে ভরতে লাগলো। ধ্রুব বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে,
— ব্যাগে ভরছো কেন এগুলো? কোথাও যাবে নাকি?
অদ্রি কঠোর গলায় উত্তর দিলো,
— অন্য ঘরে শিফট হচ্ছি। আজ থেকে ওখানেই থাকবো।
ধ্রুব আহত গলায় বলল,
— সামান্য কারণে এমন করবে?
অদ্রি মুখ গোঁজ করে বলল,
— না তো। এঘরে আমার থাকতে-পড়তে অসুবিধা হবে। আপনি কখন কোন দৃষ্টিতে তাকান আমি তো আর জানবো না।
ধ্রুব রেগে বলল,
— আমি যে দৃষ্টিতেই তাকাই না কেন সেখানে কু-দৃষ্টি থাকে না। কারণ তুমি আমার বউ।
অদ্রির হাতে থাকা বই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেল। চোখ বড় বড় করে বলে ওঠলো,
— কি বললেন?
ধ্রুব কাতরতা নিয়ে বলে,
— বলেছি তুমি এঘর ছাড়া অন্য কোথাও যেতে পারবে না। বুঝো না কেন অদ্রি? তুমি আমার ঘরে না থাকলে আমার জ্বর হবে, ভীষণ জ্বর!

[ অতবেশি রোমান্টিক হয় না আমার দ্বারা। চেষ্টা করি? হুম?]

চলবে…