শ্রাব‌ণের সে অপেক্ষা পর্ব-১৪

0
249

#শ্রাব‌ণের_সে_অপেক্ষা
‌লেখক: শার‌মিন আক্তার সাথী
পর্ব: ১৪

মা বেশ রে‌গে বল‌লেন,
‘কী দোষ ঢাক‌ছি?’
‘ও যখনই কো‌নো অন্যায় ক‌রে‌ছে তুমি সেটা গোপন ক‌রে‌ছে। শাসন ক‌রো‌নি, বুঝাও‌নি। খারাপটা‌কে খারাপ ব‌লো‌নি বরং সবসময় ওর দো‌ষ উপর পর্দা দি‌য়ে ঢে‌কেছো। ওর ঝগড়ু‌টে স্বভাব‌কে সবসময় বাহবা দি‌য়ে‌ছো।’
‘মানু‌ষের মু‌খের উপর সত্য বলাকে মানুষ য‌দি ঝগড়ু‌টে স্বভাব ব‌লে সেটা মানু‌ষের দোষ ওর না।’

আমি বেশ ক‌ঠিন ক‌ণ্ঠে বললাম,
‘মা, সত্য‌ বলারও স্থান, কাল, পাত্র, যু‌ক্তি আছে। ও যখন তখন যেখা‌নে সেখা‌নে বেফাঁস কথা ব‌লে ফে‌লে। এটা‌কে সত্যবাদীতা ব‌লে না। ঠোঁটকাটাও ব‌লে না। এটা‌কে বেয়াদ‌পি ব‌লে। ওর কা‌ছে কেউ তার গোপন কথা বল‌লে ও তা ফাঁস ক‌রে দেয়। ব‌ড়ো ছো‌টো কাউ‌কে মা‌নে না, ফা‌জি‌লের ম‌তো সবসময় তর্ক ক‌রে। মা‌ঝে মা‌ঝে সত্য জেনেও সবার ভা‌লোর জন্য চুপ থাক‌তে হয় সেটা ও জানে না। ও শুধু নি‌জের ম‌তো ব‌লে যায়। ওর মু‌খের ইঞ্জিন একবার চালু হ‌লে বন্ধ হওয়ার নামও নেয় না। ওর কার‌ণে তোমার নি‌জের বো‌নের সা‌থে পর্যন্ত সম্পর্ক ভা‌লো না। গতবছর ওর এই স্বভা‌বের কা‌রণে খালা রাগ ক‌রে গে‌লেন, আর আমা‌দের সা‌থে যোগা‌যোগ কর‌লেন না। তখনও তু‌মি ওর ওকেই সা‌পোর্ট ক‌রে‌ছো। অথচ ও ভুল‌ ছিল। কার গোপনীয়তা নেই? কার ব্য‌ক্তিগত সমস্যা, কথা, ত্রু‌টি, দোষ নেই? ও সেগু‌লো‌কে প্রকা‌শ্যে সবার সাম‌নে প্রকাশ ক‌রে মানুষ‌কে চরম বিব্রত ক‌রে। অপমান ক‌রে লোক‌দের।

এসব ছা‌ড়ো, ওকে আমার সংসা‌রে নাক গলা‌তে কে ব‌লে‌ছে? নিজের সংসার নি‌জের ম‌তো প‌রিচালনা করুক। আমা‌র স্ত্রীর সা‌থে কেন বা‌জে বি‌হেব ক‌রে? ওকে সে অধিকার দি‌য়ে‌ছে কে? এতটা বেয়াদপ কেন ও? ঐশী ওর চে‌য়ে ব‌ড়ো না? তা‌কে কথা শোয় কীভা‌বে ও?
এতটুকু কৃতজ্ঞতা বোধ নেই তোর, সা‌মিয়া? কী ক‌রি‌নি তোর খু‌শির জন্য? সেগু‌লো সব ভু‌লে গেছিস? আজ আমি নি‌জের জীব‌নে একটু খুশি থাকার চেষ্টা কর‌ছি তা‌তে তোর এত আপ‌ত্তি? আমার বউ‌কে বু‌ড়ি ব‌লিস। আমার বউ বু‌ড়ি হ‌লে তোর সমস্যা কোথায়? আমি ওকে নি‌য়ে খু‌শি ম‌নে সংসার কর‌তে পার‌লে তোমা‌দের সমস্যা কেন হ‌চ্ছে? ও কোন দিক দি‌য়ে খারাপ ব‌ল? দেখ‌তে তোর চে‌য়ে হাজার গুণ সুন্দর। আচর‌ণেও তোর চে‌য়ে কো‌টি গুণ ভা‌লো। নয়‌তো মা সবসময় ওকে যেভা‌বে খে‌াঁচা দি‌য়ে কথা ব‌লে, ওর স্থা‌নে তুই হ‌লে এত‌দি‌নে তুলকালাম ক‌রে ফেল‌তি। ও সবসময় চুপ থা‌কে। এটা কী প্রমাণ ক‌রে না ওর পা‌রিবা‌রিক শিক্ষা কতটা সুন্দর। ওর আদব কায়দা কতটা উচ্চ মা‌নের।

ও তো তোর চে‌য়ে সম্প‌র্কে বয়‌সে সব‌দিক দি‌য়ে ব‌ড়ো, তা-ও তোর সব কটু কথায় চুপ থা‌কে। কেন? কারণ ও প‌রিবা‌রে ঝা‌মেলা পছন্দ ক‌রে না। মি‌লে‌মি‌শে থাক‌তে পছন্দ করে। ওর-ও তো ভাইর বউ আছে। সে তো ছো‌টোও।‌ কই কখ‌নো তো নি‌জের ভাইর বউ এর কো‌নো দোষ আমার কা‌ছেও ব‌লে‌নি। আর তুই দোষ না পে‌লেও গর্ত খু‌ড়ে বের ক‌রিস? ওর স্থা‌নে আমি হ‌লে এত‌দি‌নে থাঁপ‌ড়ে তো‌কে ননদ‌গি‌রি শি‌খি‌য়ে দিতাম।’

সা‌মিয়া ওর হতভম্ব ভাব হয়‌তো কা‌টি‌য়ে উঠ‌তে পার‌ছে না। যে ভাই সবসময় কেবল ভা‌লোবাসা প্রদর্শন ক‌রে‌ছে। তার ক‌ঠিন এই রূপ হয়‌তো মান‌তে পার‌ছে না। চো‌খে জল টলমল কর‌ছিল। তা দে‌খে আমারও খুব খ‌ারাপ লাগছিল, কিন্তু ইদা‌নিং ও লি‌মিটের বাই‌রে কাজকর্ম কর‌ছিল। ওকে ওর লি‌মিট দেখা‌নোটা জরু‌রি হ‌য়ে গি‌য়েছিল। কাঁদ‌তে কাঁদ‌তে যে‌তে নি‌লে ওকে দাঁড় ক‌রি‌য়ে বললাম,
‘দাঁড়া। তোর ভা‌বি‌কে অযথা আজ যে কষ্ট দি‌য়ে‌ছিস তার জন্য মাফ চাই‌বি না?’
মা আর সা‌মিয়া বিস্ম‌য়ে আমার দি‌কে তাকাল। আমি বললাম,
‘ওভা‌বে তা‌কি‌য়ে লাভ নেই। আমি চাই‌লে এ কথাগু‌লো ওর সাম‌নে তোমা‌দের বল‌তে পারতাম, কিন্তু তা‌তে তোমরা ওর সাম‌নে অপ‌মা‌নিত হ‌তে। তোমা‌দের সম্মা‌নের দিকটা যেমন খেয়াল রে‌খে‌ছি, তেম‌নি ঐশীর সম্মা‌নের দিকটা খেয়াল রাখাও আমার কর্তব্য।’

আমি গলা হে‌কে ঐশী‌কে ডাকলাম। একটু সময় পর ঐশী মা‌য়ের রু‌মে আসল। মুখটা তখনও থমথ‌মে। আমি নি‌জের প‌কেট থে‌কে পাঁচ হাজার যোগ ক‌রে ওর পু‌রো টাকাটা ঐশীর হাতে দিলাম। সা‌থে আরও পাঁচহাজার ওর হা‌তে দিলাম। ও জিজ্ঞাসু দৃ‌ষ্টি‌তে আমার দি‌কে তাকা‌লে আমি বললাম,
‘অবাক হওয়ার কিছু নেই। তু‌মি আমার স্ত্রী। তোমার সকল খরচ বহন করা আমার দা‌য়িত্ব এবং কর্তব্য, কিন্তু তোমার উপার্জ‌নের টাকা সংসা‌রে দেওয়া তোমার দা‌য়িত্ব না। সেটা একান্ত তোমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে‌হেতু তু‌মি খু‌শি হ‌য়ে মা‌কে দি‌য়ে‌ছ; সেটা তোমার সুন্দর মান‌সিকতার প্রমাণ। তোমার টাকা প্লিজ তু‌মি নি‌জের কা‌ছে রা‌খো।’

ঐশী বেশ ভারী ক‌ণ্ঠে কথা বলল। কান্না গলায় আট‌কে গেলে যেমন কণ্ঠ হয় ঠিক তেমন। ও বলল,
‘টাকা কম ব‌লে, তু‌মি কী রাগ ক‌রে এসব বল‌ছো?’
‘‌ছি ছি কী বল‌ছো? টাকাগু‌লো দিলাম তু‌মি জ‌মিয়ে রাখ‌বে সে কার‌ণে। তু‌মি নি‌জের কা‌ছে সেইভ ক‌রে রা‌খো, আমার যখন প্র‌য়োজন হ‌বে তখন নি‌য়ে নিব। আমার আয়ের প্রায় সব টাকা সংসা‌রে খরচ ক‌রি, তু‌মিও য‌দি সংসা‌রে খরচ করা শুরু ক‌রো তাহ‌লে ভ‌বিষ্য‌তের জন্য রাখব কী? এত বছর যাবত আমরা দুজ‌নেই কেবল অন্যের কথা ভে‌বেছি। এবার থে‌কে অন্যের কথা ভাবার সা‌থে সা‌থে নি‌জেদের এবং নি‌জে‌দের ভ‌বিষ্য‌তের কথাও ভাববো।’

ঐশী যে প্রচণ্ড বি‌স্মিত তা ওর চোখ দে‌খেই বুঝা যা‌চ্ছিল। আমি ওর দি‌কে তা‌কিয়ে হাসলাম। ঐশী জি‌জ্ঞেস করল,
‘তাহ‌লে পাঁচহাজার টাকা বাড়‌তি কেন?’
‘এটা তোমার এ মা‌সের হাত খরচ। লাগ‌লে ব‌লো আরও দিব। হ্যাঁ, এটা কিন্তু হাত খরচ। তোমার প্র‌য়োজনীয় কোনো জি‌নিস লাগ‌লে তা আমি এনে দিব। তু‌মি নি‌জের বেতন থে‌কে হাত খর‌চের জন্য যে টাকাটা রে‌খো‌ছো তা-ও জমা ক‌রে রাখ‌বে। তোমার স্ব‌ামী যে‌হেতু আমি সেহেতু হাত খরচ আমি দিব। আর নি‌জের স্ত্রীর চা‌হিদা পূরণ করা, তার হাত খরচ দেওয়ার সামার্থ্য আল্লাহ আমা‌কে দি‌য়ে‌ছেন।’

ঐশী চোখ দে‌খে বুঝা যা‌চ্ছিল ও খুব খু‌শি হ‌য়ে‌ছে। আমি বললাম,
‘সা‌মিয়া তোমা‌কে কিছু কথা ব‌ল‌বে।’
‘কী কথা?’
‘‌কি‌রে সা‌মিয়া বল?’
সা‌মিয়া কর্কশ ক‌ণ্ঠে বলল,
‘স‌রি ভা‌বি। বিকা‌লে তোমা‌র সা‌থে ওমন ব্যবহার করার জন্য।’
ঐশী হে‌সে বলল,
‘সমস্যা নেই।’
আ‌মি জা‌নি আজ‌কে আমার বলা প্র‌তি‌টি কথার প্রভাব শীঘ্রই আমার উপর পড়‌বে এবং বেশ ভা‌লো ক‌রে পড়‌বে। আপাতত ঐশী‌কে একটু সময় দি কী ব‌লেন? ওর মনটা একটু ভা‌লো করার চেষ্টা ক‌রি।

আপনারা হয়তো ভাব‌ছেন বউ পে‌য়ে সায়ন বদ‌লে গে‌ছে। কেমন সব কিছু‌তে বউ বউ ক‌রে। আস‌লে আমার অতীত জীব‌নের কথা তো প‌ড়ে‌ছেন। তখন জে‌নে‌ছেন কতটা ভা‌লোবাসাহীনতায় আর একা‌কি‌ত্ব নিয়ে আমি এতগু‌লো বছর বেঁচে ছিলাম। সবার কেবল প্র‌য়োজন হ‌য়ে‌ছি, প্রিয়জন নয়। বাসস্থানহীন ভে‌সে যাওয়া মানুষ একটা খরকু‌টো পে‌লেও সেটা‌কে আঁক‌ড়ে ধ‌রে থাক‌তে চায়। মরুভূ‌মি‌তে মাই‌লের পর মাইল তৃষ্ণার্ত হাঁটার পর এক বিন্দু পা‌নি‌কেও নদী ম‌নে হয়, সেখা‌নে ঐশী নি‌জেই এক সমুদ্র ভা‌লোবাসা নি‌য়ে আমার ভা‌লোবাসাহীন জীব‌নে এসে‌ছে। চৈত্র মা‌সের দীর্ঘ খড়ার পর, শ্রাব‌ণের জলধারা নি‌য়ে এসে‌ছে‌ আমার জীব‌নে। তা‌কে একটু‌ আগ‌লে রাখব না?

১৫!!
আজ শ‌ফিক আর সা‌মিয়া এসে বলল, বাবার রে‌খে যাওয়া সকল সম্প‌ত্তির সমানভা‌গে ভাগ হোক। আমি প্রথ‌মে একটু অবাক হ‌লেও আমার অজ্ঞাত মন যেন এস‌বের জন্য প্রস্তুত ছিল। তাই বললাম,
‘ঠিক আছে কাল ছো‌টো মামা‌কে ডা‌কি। দ‌লিল পত্র সব তার কা‌ছে। সে সব বু‌ঝি‌য়ে দিবে।’
দুজনেই তখন গম্ভীর মু‌খে ঠিকা‌ছে ব‌লে চ‌লে গেল।

প‌রের‌দিন,
‌ছো‌টোমামা সবাই‌কে সুন্দরভা‌বে সব‌কিছু বু‌ঝি‌য়ে দি‌লেন এবং বল‌লেন ক‌দিন পর একজন আমিন ডেকে জায়গা মে‌পে যার যার সীমানা ঠিক ক‌রে দিব। সবাই সম্ম‌তি জানালাম। তখন সা‌মিয়া, শফিক বলল,
‘সব জমির বুঝ পে‌লেও একটা জ‌মির বুঝ পেলাম না।’
মামা বল‌লেন,
‘‌কোনটা?’
‘আমা‌দের উত্তর ভিটার জ‌মিটা।’
‘‌সেটা তো নয় বছর আগে সায়ন বি‌ক্রি করে টাকা ব্যবসায় খাটা‌লো।’
শ‌ফিক বলল,
‘‌সেখা‌নে ‌তো আমা‌দেরও ভাগ আছে। ভাইয়া তার দাম আমা‌দের দি‌বে না?’
সা‌মিয়া বলল,
‘হুম। ব্যবসা ভাইয়া কর‌ছে। টাকা ও কামা‌চ্ছে। আমা‌দের ভা‌গের জ‌মির টাকা দি‌য়ে ভা‌লোই ব্যবসা ক‌রে‌ছে। এখন আমা‌দের টাকা ফেরৎ দিক।’
আ‌মি চূড়ান্ত বি‌স্মিত হ‌য়ে বললাম,
‘‌তো‌দের সেই জ‌মির টাকা লাগ‌বে?’
দুজ‌নেই বেশ শক্ত ক‌ণ্ঠে বলল,
‘হ্যাঁ।’

আ‌মি এত অবাক খুব সময়ই কমই হ‌য়ে‌ছি। যে ভাই বোন‌দের জন্য এত করলাম তারা আজ…! ক‌ষ্টে বুকটা ফে‌টে যা‌চ্ছিল। বললাম,
‘‌ঠিক আছে দি‌য়ে দিব। সে দা‌মে জ‌মি বি‌ক্রি ক‌রে‌ছি সে হিসা‌বে সা‌মিয়া ২ লাখ আর শ‌ফিক চার লাখ পায়। সা‌মিহা তোর লাগ‌বে?’
সা‌মিহা বেশ রাগী ক‌ণ্ঠে বলল,
‘পাগল হ‌য়ে‌ছিস, ভাইয়া? আ‌মি অকৃতজ্ঞ, ইতর, লোভী না। আগেই বল‌ছি এসব ভাগ টাগ আমি নি‌ব না। আমি শুধু ভাই‌য়ের কা‌ছে সবসময় ভা‌লোবাসাটা চাই। এর ব্যতিত কিছু না।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে সা‌মিয়া, শ‌ফি‌কের দি‌কে তা‌কি‌য়ে বললাম,
‘আমা‌কে একটু সময় দে। আমি তো‌দের সব টাকা দি‌য়ে দিব। আপাতত আমার কা‌ছে এত টাকা নেই।’
সা‌মিয়া বলল,
‘কি‌সের দুই লাখ? নয় বছ‌রে জ‌মির দাম ডাবল হ‌য়ে‌ছে। আমার চার লাখ আমার চাই।’
শ‌ফিক বলল,
‘আমার আট লাখ।’
ছো‌টো মামা সা‌থে সা‌থে বললেন,;
‘‌তো‌দের ম‌তো নিমক হারাম জীব‌নে দেখি‌নি।’

মামা আর কিছু বলার আগে শ‌ফিক বলল,
‘মামা, জ‌মির ভাগ হয়ে‌ছে, আপ‌নি সব বু‌ঝি‌য়ে দি‌য়ে‌ছেন এবার আপ‌নি আস‌তে পা‌রেন। আমরা ভাই‌বোন নি‌জে‌দেরটা বু‌ঝে নিব।’
মামা যেন চরম বি‌স্মিত। হুট ক‌রে আমার যে কী হল, আমি মৃদু হে‌সে বললাম,
‘মামার হিসাব করা বা‌কি আছে। হিসাব যখন ক‌রছিস তখন স‌ঠিকভাবে কর। আমিও স‌ঠিকভা‌বেই হিসাব করব।’
ওরা খা‌নিকটা অবাক হ‌য়ে তাকালে আমি বললাম,
‘জ‌মির দাম তোরা বর্তমা‌নের দাম ধ‌রে নি‌তে চা‌চ্ছিস। ঠিকাছে সেটাই দিব। তোদের জ‌মির দাম যে‌হেতু বর্তমা‌নের দাম হিসা‌বে ধরবি, সে‌হেতু‌ আমি তো‌দের পিছ‌নে মোটা অং‌কের যে টাকা খরচ ক‌রে‌ছি সে দামও বর্তমা‌নের হিসা‌বে ধরব। খুচরা নাহয় বাদই দিলাম।’

শ‌ফিক বলল,
‘মানে?’
‘মানে ত‌ুই জ‌মির বর্তমান দাম হিসা‌বে আট লাখ টাকা দা‌বি কর‌ছিস। তো‌কে আটলাখই দিব, কিন্তু তার আগে তুই আমার টাকা ফেরত দে।’
‘‌কি‌সের টাকা।’
‘‌তোর স্মৃ‌তি শ‌ক্তি দেখ‌ছি জঘণ্য খারাপ। বছর দ‌ুই আগে তোর চাক‌রির জন্য দশ লাখ টাকা ঘুষ দি‌য়ে‌ছিলাম সেটা ফেরত দি‌বি। ছো‌টো ভাই‌য়ের চাক‌রির ঘু‌ষের টাকা দেওয়ার দা‌য়িত্ব ব‌ড়ো ভাইয়ের না। এ কথা না ধ‌র্মে খাট‌বে, না আইনে। দশলাখ টাকা দুই বছর ব্যাং‌কে থাক‌লে মা‌সে দশ হাজার ক‌রে লাভ আস‌লেও দুই বছ‌রে হ‌তো দুই লাখ চ‌ল্লিশ হাজার। তো মোট হ‌লো বারো লাখ চ‌ল্লিশ হাজ‌ার। বছর তি‌নেক আ‌গে চাক‌রির কথা ব‌লে আরও এক লাখ টাকা নি‌য়ে‌ছি‌লি। মোট তেরো লাখ চ‌ল্লিশ হাজার। তোর খাওয়া, পরা, পড়া-লেখার এবং যাবতীয় খরচ না হয় বাদই দিলাম।’

শ‌ফিক হতভম্ব হ‌য়ে বলল,
‘এসব কী বল‌ছো, ভাইয়া?’
আমি মৃদু হে‌সে বললাম,
‘‌তো‌দের কষ্ট না করা টাকার এত দাম আর আমার ঘাম ঝরানো ক‌ষ্ট করে আয় করা টাকার কো‌নো দাম নেই? ঐ এগা‌রো লাখ টাকা ব্যবসায় খাটালে এতদিনে ক‌য়েকগুণ হ‌য়ে ফি‌রে আসত। যাক এখন তে‌রো লাখ থে‌কে তোর পাওনা আট লাখ বাদ দি‌লে আমি তোর কা‌ছে পাই পাঁচ লাখ চ‌ল্লিশ হাজার। সেটা ক‌বে দি‌বি? না‌কি তোর জ‌মি বি‌ক্রি ক‌রে উসুল করব?
আর সা‌মিয়া, মে‌য়ে‌দের বি‌য়ে দেওয়ার দা‌য়িত্ব বাবা মা‌য়ের, ব‌ড়ো ভাই এর না। তো তোর বি‌য়ে‌তে তোর বর ইমন‌কে নগদ পাঁচ লাখ টাকা ক্যাশ দিয়ে‌ছিলাম। তো‌দের দুজন‌কে স্বর্ণ দি‌য়ে‌ছিলাম পাঁচ ভ‌রি। তোর ঘ‌রে ফ্রিজ, টি‌ভি, সোফা থেকে শুরু ক‌রে তরকা‌রি নাড়ার খু‌ন্তিটা পর্যন্ত মা‌য়ের কথায় কি‌নেছিলাম। তো সেসব মি‌লি‌য়ে আজ‌কের দাম হিসা‌বে পাঁচ লা‌খের অনেক বে‌শি খরচ হ‌য়ে‌ছে, কিন্তু আমি পাঁচ লাখই ধরলাম। তারপর তোর বি‌য়েতে তোর শ্বশুর বা‌ড়ির আর আমা‌দের স‌তে‌রো গু‌ষ্ঠির যে হাজার লোক খাই‌য়ে‌ছি তা বাদ দিলাম। তো তোর কা‌ছে মোট দশলাখ পাই। দশ লাখ থে‌কে চার লাখ বাদ দি‌লে ছয় লাখ পাই। ক‌বে দি‌বি বল?

সা‌মিয়া বিস্ফ‌রিত চো‌খে তা‌কি‌য়ে বলল,
‘এসব কী বল‌িছিস, ভাইয়া?’
‘‌হিসাব কর‌ছি। যেমনটা তোরা হিসাব কর‌লি ঠিক তেমন হিসাব করলাম।’
মা এতক্ষণ চুপচাপ শুন‌লেও এবার বল‌লেন,
‘সায়ন, তুই ঠিক কর‌ছিস না।’
‘‌কেন? কী কর‌ছি?’
‘শ‌ফিক, সা‌মিয়ার সা‌থে অন্যায় কর‌ছিস। তোর কথা যু‌ক্তি ছাড়া। ব‌ড়ো ভাই বাবারই ম‌তো। সে তার কর্তব্য পালন কর‌বে এটাই নিয়ম। তুই সেটার হিসাব চাইতে পা‌রিস না।’

মা‌য়ের কথা শুনে অ‌তি কষ্টে আমি হে‌সে ফেললাম। ছো‌টো মামা বললেন,
‘‌ছি শোভ‌া! তোর এত অধঃপতন! একই গ‌র্ভে রে‌খে চার সন্তান‌কে তুই চার চো‌খে দেখ‌ছিস?‌তোর স্বামী মারা যাবার পর কী ক‌রে‌নি সায়ন তো‌দের জন্য? ওরা নাহয় ভাই-‌বোন; ত‌াই লোভী, স্বার্থপ‌রের ম‌তো কথা বল‌ছে। তুই তো মা। তুই কীভা‌বে এমন এক‌চোখা‌গি‌রি কর‌ছিস?’
মা বললেন,
‘এক চোখ‌া‌গি‌রি কর‌ছি না। ভাগ যখন হয়ে‌ছে তখন সব কিছুর ভাগ সমানই হ‌বে।’

মামা বল‌লেন,
‘সমানই হ‌য়ে‌ছে। সায়ন ব্যবসা করার জন্য যে জ‌মি বিক্রি ক‌রে‌ছিল ও ব্যবসা ক‌রে, ব্যবসায় উন্নতি ক‌রে নি‌জের জন্য কী ক‌রে‌ছে দেখা আমাকে? ঠিক বয়‌সে বি‌য়েটা পর্যন্ত কর‌তে পা‌রে‌নি। যা ক‌রে‌ছে সব তো‌দের জন্য ক‌রে‌ছে। আর বে‌শি দি‌য়ে‌ছে শফিক এর সামিয়া‌কে। আজ ওরা তার ভা‌লো প্র‌তিদান দি‌চ্ছে। ওরা যখন হিসাব চে‌য়ে‌ছে তখন সায়ন হিসাব চাই‌তে পার‌বে না? সায়ন একদম ঠিক ক‌রেছে। বি‌ক্রিত জ‌মির ভাগ চে‌য়েছে, হিসাব চে‌য়ে‌ছে তা-ও বর্তমান দা‌মের হিসা‌বে। তো সায়ন হিসাব দি‌য়ে‌ছে। এখন সায়ন ওদের কা‌ছে যে টাকা পায় সেটা যেন জল‌দি ওরা দি‌য়ে ‌দেয়। নয়তো টাকা কীভা‌বে উসুল কর‌তে হয় আমার জানা আছে।’

মামার কথা শু‌নে দীর্ঘশ্বাস ছে‌ড়ে বললাম,
‘মামা, ঝা‌মেলা যে‌হেতু হ‌য়ে‌ছে তখন একবা‌রেই সব শেষ হোক। সা‌মিহা, সা‌মিয়া, শ‌ফিক সবাই এখন সে‌টেল। সা‌মিহার থে‌কে শুনল‌াম শ‌ফিক না‌কি একটা মে‌য়ের সা‌থে সম্প‌র্কে আছে। গত সপ্তা‌হে মা না‌কি সে মে‌য়ে‌কে পছন্দ ক‌রে চেইনও প‌রি‌য়ে এসে‌ছে। অথচ অমা‌কে কেউ বলার প্র‌য়োজন বোধ ক‌রে‌নি। আমি এখন বুঝ‌তে পার‌ছি এ সংসা‌রে আমার অবস্থান। আমি কেবল তা‌দের টাকা কামা‌নোর মে‌শিন, চা‌হিদা পূর‌ণের যন্ত্র মাত্র। আমি আর যন্ত্র হ‌য়ে থাক‌তে চাই না। এখন আমারও সংসার হ‌য়ে‌ছে। আমি এখন নি‌জের সংসার নি‌য়ে আলাদা থাক‌তে চাই।
শ‌ফিক নি‌জে বি‌য়ে ক‌রে নি‌জের সংস‌ার নি‌জে প‌রিচালনা করুক। বো‌নেরা যখন তখন আমার বাড়ি‌তে বেড়া‌তে আস‌তে পার‌বে। তাদের জন্য আমার দরজা সবসময় খোলা। শ‌ফিক বিপ‌দে পড়‌লে বা ওর কো‌নো সাহায্য লাগ‌লে ব‌ড়ো ভাইর ম‌তোই সা‌পোর্ট করব, পা‌শে থাক, কিন্তু আমার আলাদা সংসার চাই। এখন যার যার জীবন সে নি‌জে‌দের ম‌তো প‌রিচালনা করুক। আমা‌কে আমার ম‌তো থাক‌তে দিক। প‌নে‌রো বছর যাবত সবার বোঝা টান‌তে টান‌তে, সবার সব দা‌য়িত্ব পালন কর‌তে কর‌তে আমি বড্ড ক্লান্ত। আর মা কার কা‌ছে থাক‌বেন সেটা মা-ই ডিসাইড করুক। চাই‌লে আমার কা‌ছেও থাক‌তে পা‌রে অথবা শফি‌কের কা‌ছে।’

মা কান্না‌ভেজা ক‌ণ্ঠে বল‌লেন,
‘সায়ন, তুই সংসার ভা‌গের কথা বল‌তে পার‌লি? তোর মু‌খে আটকা‌লো না?’
‘না মা। আটকায় নি। মা, বিশ্বাস ক‌রো আমি স‌ত্যি খুব ক্লান্ত। তো‌মা‌দের সবার দায়িত্ব, কর্তব্য পালন কর‌তে কর‌তে আমি নি‌জে‌কে হা‌রি‌য়ে ফে‌লে‌ছি। আমি নি‌জের সা‌থে খুব ব‌ড়ো অন্যায় ক‌রে ফেলেছি। এখন আমি নি‌জে‌কে সময় দি‌তে চাই। নি‌জে‌কে নি‌জে বিশ্রাম দি‌তে চাই। যে‌দিন থে‌কে এটা বুঝ‌তে পে‌রে‌ছি আমা‌র প্র‌তি তোমা‌দের ভা‌লোবাসাটা কেবল দেখা‌নো ভা‌লোবাসা, সে‌দিন থে‌কে ভেত‌রে ভেত‌রে আমি রোজ হাজারবার মর‌ছি। যে‌দিন থে‌কে জানলাম তোমা‌দের কা‌ছে আমি টাকার মে‌শিন ব্য‌তিত কিছু না, সে‌দিন থে‌কে তোমা‌দের প্র‌তি আমার সেই টানটা চ‌লে গে‌ছে, যে টানটা আগে ছিল। হ্যাঁ, ভা‌লো তোমা‌দের এখনও বা‌সি ত‌বে ভা‌লোবাসায় আগের সেই কোমলতা নেই, মা। আমা‌কে একটু শা‌ন্তি দাও। আমি হাত‌জোর ক‌রে বল‌ছি বিশ্রাম দাও আমাকে।’

হুট ক‌রে আমার মাথা খুব ঘুর‌তে লাগল। চারপাশটা কেমন অন্ধকার হ‌য়ে যা‌চ্ছে। মাথা প্রচণ্ড যন্ত্রণা হ‌চ্ছে, প্রচণ্ড যন্ত্রণা। একি আমার বাম হাত পা এমন অসার হ‌য়ে যা‌চ্ছে কেন? আমি মায়ের হাত দু‌টো ধ‌রে এলো‌মে‌লোভা‌বে বললাম,
‘মা, আমা‌র মাথাটা তোমার কো‌লে নাও। আমার কষ্ট হ‌চ্ছে মা। প্রচণ্ড কষ্ট।’
ঝপসা চো‌খে দেখ‌তে লাগলাম ঐশী চিৎকার ক‌রে আমার নাম ধ‌রে ডাক‌ছে। ও কাঁদ‌ছে। আমার কষ্ট হ‌চ্ছে, ভীষণ কষ্ট। ম‌নে হ‌চ্ছে‌ যন্ত্রণায় মাথা ছি‌ড়ে যা‌বে। আমি কি ত‌বে মারা যা‌চ্ছি? আমার গল্প কী ত‌বে এখা‌নেই শেষ?

তারপর কিছু ম‌নে নেই কী হ‌লো?

চল‌বে…