হঠাৎ প্রণয় পর্ব-১৬+১৭

0
304

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

ষোড়শ পর্ব

সপ্তাহ দুই পেরিয়ে গেল অয়নের সাথে দেখা হচ্ছে না। ফোনে কথা হলেও তাকে দেখার তৃষ্ণা যে আমার মিটে না। বাসা থেকে বের হওয়ার কোনো অজুহাত না পেয়ে আজকে ভর্তির সাবজেক্ট চয়েস দেয়ার কথা বলে বেরিয়ে গেলাম।

দোকানে বসে অয়নকে কল দিলাম।
“তনুশ্রী।”
“কোথায় আছো?”
“এইতো বাসায়।”
“গাজীপুরে?”
“আরে না, ঢাকার বাসায়।”
“খিলগাঁও আসো।”
“এখন?”
“হ্যাঁ, আর এখন মানে এখনই। আমি প্লাস পয়েন্টের সামনে।”

বলে ফোন রেখে দিলাম। চয়েসের কাজ শেষ করে দোকান থেকে বেরিয়ে রাস্তার দিকে গেলাম। অয়নের কোনো নামগন্ধও নেই।

কিছুক্ষণ পর অয়ন আসলো৷ বাইক নিয়ে আসেনি, রিকশায় এসেছে। হাত এখনো ভালো হয়নি বলেই বাইক চালানোতে নি°ষে°ধা°জ্ঞা রয়েছে।

এলোমেলো অবস্থা তার। অগোছালো চুল আর পড়নে সাধারণ টিশার্ট-প্যান্ট, মুখেও ক্লান্তির ছাপ। অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি তার দিকে৷

অয়ন আশেপাশে চেয়ে বলল,
“কি হলো? এতো জরুরি তলব?”

আমার হাত থেকে ফাইলটা নিয়ে দেখলো। আমাকে চুপ থাকতে দেখে বলে,
“কি হয়েছে?”
“তোমার বাসা কোথায়?”
“খিলগাঁও মডেল কলেজের কাছে।”
“চলো, আমি যাবো।”

আমি রিকশা ডাকতে গেলে অয়ন আমার হাত ধরে থামিয়ে বলল,
“পাগল হয়েছিস? ব্যাচেলার ছেলের বাসায় যাবি?”
“হ্যাঁ যাবো।”

রিকশা ডেকে আমি উঠে পড়লাম। কিছুটা বাধ্য হয়েই বোধহয় অয়নও উঠলো। খিলগাঁও মডেলের সামনে নেমে বললাম,
“বাসা কোথায়?”
“এটা কি ঠিক হচ্ছে, তনুশ্রী? আবারো ঝা°মে°লা হবে।”

রাগি সুরে বললাম,
“বাসাটা কোথায়?”

অয়নের সাথে হেঁটে সেই বাসা পর্যন্ত এসেছি। তিনতলার দ্বিতীয় ফ্ল্যাটে নিয়ে এসেছে। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে নিয়ে গেল।

ফ্ল্যাটে ঢুকেই ছোট একটা স্পেস পেলাম, একে ঠিক ডাইনিং বলা যায় না। এর সাথে কিচেন আর ওয়াশরুম, ছোট ছোট দুটি ঘর।

“এইতো বাসা, দেখা শেষ? এখন চল।”

অয়নের কথায় পাত্তা না দিয়ে চেয়ার টেনে বসে বললাম,
“বাসায় মেহমান এলে এভাবে ভাগিয়ে দেও?”

অয়ন আমার জুতা জোড়া ভিতরে এনে দরজা লাগিয়ে এসে আমার সামনে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসলো।

“দেখ, বাসায় আমি একা না। আরেকজন থাকে এই রুমে।”
ইশারায় একটা রুম দেখালো।

“ওই ছেলে এসে বাসায় তোকে দেখলে উল্টাপাল্টা ভাববে আর আমি চাই না তোকে নিয়ে কেউ এসব ভাবুক।”
“এখন আছে ওই ছেলে?”
“না, তবে আসতেও তো পারে।”

অয়নের চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে বললাম,
“এতো এলোমেলো কেন আজকে? সকালে নাস্তা করোনি?”
“না, একটু আগেই ঘুম থেকে উঠেছি আর তোর কল..”

তার কথার মাঝেই বললাম,
“আর কল পেয়ে ছুটে গেছো?”
“হুম।”

হেসে উঠে ওর রুমে গেলাম। গোছানো, পরিপাটি রুম। একটা ছোট খাট, একটা আলমারি, একটা শেলফ আর রিডিং টেবিল। শেলফে কারি কারি বই। শুধু শেলফের ভিতরে না, শেলফ আর আলমারির উপরেও বই। তবে কোনোটাই এলোমেলো না, সব গোছানো। টেবিলের বড় বড় বই আর মোটা দাগের নোটখাতা।

আমি বইগুলো দেখছি আর সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে।

আমি ওড়নাটা একপাশে বেঁধে রান্নাঘরে গেলাম। রান্নাঘরের কিছুই বুঝতেছি না, কোনটা কার জিনিস?

“অয়ন?”
“হুম।”
দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।

“এখানে তো দুজনের জিনিসপত্র আছে, তোমার কোনটা?”
“তোর এখানে কোনো কাজ নেই, বাসায় চল।”

খু°ন্তিটা এনে অয়নের মুখের কাছে ধরে বললাম,
“যা বলছি তাই করো।”
“আচ্ছা, আচ্ছা।”

আমার হাতটা সরিয়ে বলল,
“সিংকের ওপরের তাকের সবকিছুই আমার।”
“এই হাত নিয়ে তুমি রান্না করে খাও?”

অয়ন একবার নিজের হাতের দিকে তাকালো। তারপর বলল,
“ব্যাচেলারের কষ্ট কে দেখে?”

চুপচাপ গিয়ে কাজে লেগে পড়লাম। পরোটা আর ডিম পোচ করবো, কিন্তু বিপত্তি ঘটলো চুলা জ্বা°লা°তে এসে। কিছুতেই ম্যাচ দিয়ে আ°গু°ন জ্ব°ল°ছে না, মূলত আমি জ্বা°লা°তে পারছি না।

অয়নের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, মনের সুখে হাসছে সে। রাগ হলো, ভাব নিয়ে রান্না করতে এসে শেষে কিনা আ°গু°নই জ্বা°লা°তে পারছি না।

অয়ন এসে পেছন থেকে আমার দুহাতের উপর হাত দিয়ে ম্যাচ ধরিয়ে দিলো, চুলার গ্যা°সটাও সে অন করলো আর চুলাও জ্বা°লি°য়ে দিলো৷ আমি তো তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ব্যস্ত৷ কি অনায়াসে আমাকে নিজের বাহুডোরে নিয়ে নিলো। আমার ডান পায়ে তার পায়ের স্পর্শ পেলাম। নিচের দিকে তাকাতেই অয়ন সরে গেল।

“ওকে ম্যাডাম, রান্না করেন। আমি পড়তে বসলাম। আপনাকে এখানে এনেছি এটা আপনার বাবা জানলে নি°র্ঘা°ত আমাকে জ°বা°ই করবে।”

অয়ন চলে গেল। কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে রান্নায় মন দিলাম। খাবার নিয়ে অয়নের রুমে নিয়ে টেবিলে রেখে বললাম,
“এতো পড়াশুনা কিসের?”

অয়ন বই বন্ধ করতে করতে বলল,
“ভার্সিটি শুরু হলে বুঝবি।”

তাকে খাবার ধরতে দিলাম না। আমি নিজে তাকে খাইয়ে দিচ্ছি। খেতে খেতে সে আবারো বই খুলেই বসলো। ভালো করে দেখে বুঝলাম শুধু মাস্টার্স না, চাকরি আর বিসিএসের বইও আছে।

“তুমি বিসিএস পরীক্ষা দিবা?”
“হুম।”

অয়নের মুখটা আমার দিকে ফিরিয়ে বললাম,
“বিসিএস দিয়ে তুমিও ভু°ড়ি°ওয়ালা হয়ে যাবা?”

অয়ন হো হো করে হেসে উঠে বলল,
“বিসিএস পরীক্ষা দিলেই কেউ চান্স পাবে এমনটা না। আবার ক্যাডার হলেই কেউ ভুড়িওয়ালা হয়ে যাবে না। বিসিএস ক্যাডার মানেই ভু°ড়ি°ওয়ালা কাক্কু এমন চিন্তা বাদ দে।”
“তাহলে পড়ো, তাড়াতাড়ি জব নেও।”

বইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেই অয়ন বলল,
“জব নিলে কি হবে?”
“কিছুনা।”

রাগ করে ওর মুখে পরোটা ঠে°সে দিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলাম। অয়ন আমার হাতটা ধরে ফেলতেই আড়চোখে তাকালাম, কিন্তু কিছু বলার আগেই কলিং বেল বেজে উঠলো।

অয়ন উঠে দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে বলল,
“আমার রুমে থাকবি, একদম বের হবি না।”
“হুম।”

আমার জুতা এনে রুমে রেখে দরজা বাইরে থেকে লাগিয়ে গিয়ে মেইন দরজা খুলল। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে কথা শুনার চেষ্টা করছি।

“আরে অয়ন, আর বলিস না। এসাইনমেন্ট রেখে চলে গেছি।”
“আহারে, নিয়ে নে।”

একটু পর ছেলেটি বলল,
“ফাইল কার এটা?”

নিজের মাথায় বা°রি দিতে মন চাইলো। ফাইলটা ওখানে কেন রেখেছি।

“আমার এক স্টুডেন্টের।”
“ওহ।”

ছেলেটি বোধহয় নিজের রুমে চলে গেছে। অয়ন এসে দরজা ঠে°লে রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দিলো। ফাইলটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগলো। আমি কিছু বলতে উ°দ্ধ°ত হতেই মুখ চেপে মাথা নেড়ে না বুঝালো।

“অয়ন দরজাটা লাগিয়ে দে।”

অয়ন একটু উঁচু স্বরে বলল,
“ওকে।”

দরজা লাগিয়ে এসে বলল,
“চল।”
“কোথায়?”

কপাল কুঁচকে বলল,
“ন্যাকা, এখানে তুই সংসার পাততে এসেছিস?”
“ব°কা দেও কেন?”

কাঁদোকাঁদো ভাব করে বলতেই অয়নের চেহারা পালটে গেল। আমার দুগালে হাত দিয়ে বলল,
“আচ্ছা সরি, এখন তো চল।”
“একটা শর্তে?”
“হাজারটায় রাজি।”

ওর বুকে একটা ধা°ক্কা দিয়ে বললাম,
“এমন এলোমেলো হয়ে থাকতে পারবে না। তুমি পরিপাটি গোছানো মানুষ, পরিপাটি হয়ে থাকবে। সময় মতো খাবে আর ঠিকমতো ঘুমাবে।”
“আচ্ছা মহারানী। এখন চলেন।”

বের হওয়ার আগে ওর শেলফের দিকে ইশারা করে বললাম,
“একটা গল্পের বই দেও।”

সে শেলফ থেকে জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে বইটা বের করে দিলো।
“এটা পড়িস।”
“ওকে।”

অয়ন আমাকে আমার বাসার গলি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেল। আজকে নতুন করে তার প্রেমে পড়তে বাধ্য হয়েছি। এভাবে হঠাৎ হঠাৎ করে প্রণয় পাখি জেগে উঠলে খারাপ হয় না।

বাসায় আসতেই শুরু হলো শুনানি। এতো দেরি কেন? কোথায় গিয়েছিলাম? বই কার? কোথা থেকে এনেছি? কোনোরকমে রুমে আসতেই আপু এসে বলল,
“অয়ন ভাইয়ের সাথে দেখা করেছিলি?”
“হুম, ওর বাসায় গিয়েছিলাম।”
“কি?”
চেঁচিয়ে উঠে হঠাৎ চুপ হয়ে যায় আপু।

আশেপাশে তাকিয়ে নিচুস্বরে বলল,
“কি বলিস তুই?”
“সত্যি গিয়েছিলাম।”

“এবারে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, সম্মানটুকু অবশিষ্ট রাখ। আমি সবটা মেনে নিয়েছি বলে যে লাগামছাড়া হয়ে গেছো তা ভেবো না। আর বাসায় এগুলো জানাজানি হলে কি হবে বুঝতে পারছিস তুই? ন্যূনতম কমনসেন্স খাটা। আর (একটু থেমে) অয়ন ভাই তোর মতো আর কাউকে নিয়ে যে বাসায় যায়নি কি গ্যারান্টি?”

রাগ উঠলো আমারও। হুট করে চেঁচিয়ে উঠলাম,
“অয়ন খারাপ ছেলে নয় আপু। রিসোর্টের ফাঁ°কা রুমে বা ওর বাসায় কোথাও আমাকে খারাপ স্পর্শ করেনি। খারাপ স্পর্শ তো দূরের কথা, খারাপ দৃষ্টিও দেয় না আমার দিকে। ও আমাকে সম্মান করে, ভালোবাসে। আমি..”

আম্মুকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চুপ করে গেলাম। আপু আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকিয়ে ঘা°ব°ড়ে গেল মনে হচ্ছে।

আম্মু আপুকে বলল,
“সবকিছুর জন্য কি আমি দায়ী, তানিমা? কেন নিয়ে গেছিলাম ওকে অথৈয়ের বিয়েতে? কেন আমি অয়ন আর ওকে একা ছেড়েছিলাম? (আমাকে বলল) তোমার পায়ে যদি আমি শি°ক°ল না পড়াচ্ছি তবে দেখো।”

ব্যস, খারাপ সময় শুরু হওয়ার জন্য এটাই যথেষ্ট ছিল। সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলো আমাকে। ঠিক যেভাবে ব°র্গিদের জন্য সাজু-রুপাই আলাদা হয়েছিল, সেভাবে আলাদা হলাম আমরা। যোগাযোগ শুধু বন্ধ নয়, একেবারে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে গেলাম।

পেরিয়ে গেল দেড়মাস। মানহা কয়েকবার বাসায় এসেছে, তবে আম্মু আশেপাশে থাকে বলে মনের অবস্থা কিছুই ওকে বলতে পারছি না। ও তো বোঝে, তবে ও কি অয়নকে একবারের জন্যও জানাতে পারছে না।

অবশেষে আজ, ২৫ অক্টোবর ২০২২, ইডেনে ভর্তি হওয়ার অযুহাতে বাসা থেকে বের হতে পারলাম। কলেজের ভিতরে ফোন লাগবে, এটা বলে ফোনও নিয়ে নিলাম। তবে আম্মু আমার সঙ্গে যাচ্ছে।

আমি কলেজের ভিতরে গেলাম আর আম্মু বাইরে রইলো। ভর্তি প্রক্রিয়ায় খুব বেশি সময় লাগলো না, ভর্তি শেষে অয়নকে কল দিলাম। কল কে°টে সে ব্যাক করলো।

“তনুশ্রী?”
“অয়ন, এভাবে আর কত? প্লিজ, কিছু করো। তুমি জানো…”

কান্নার জন্য আমার কথা আটকে যাচ্ছে৷ আমার কথার মাঝেই অয়ন বলল,
“আমি জানি তনুশ্রী। মানহা আমাকে সব বলেছে। কয়েকদিন তোর বাসার সামনেও গিয়েছিলাম। তোকে বারান্দায় দেখিনি। তানিমার সাথেও কথা হয়েছে।”
“আপুর জন্যই তো সব হলো।”
“এভাবে ব্লে°ই°ম করিস না৷ তানিমা তোর ভালোই চায়। কাঁদিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে৷ একটুখানি ধৈর্য ধর।”

নাক ঝেড়ে বললাম,
“বাসায় তুমি?”
“না, ডিপার্টমেন্টে।”
“তুমি ঢাবিতে? আমি ইডেনে আসছি, দেখা করতে পারবা?”
“হ্যাঁ, করা যাবে।”
“কিন্তু আম্মু আছে তো।”
“আচ্ছা, থাক তবে। বাসায় চলে যা।”

কল কে°টে গেল। অভিমান আর রাগগুলো জমে জমে পাহাড় হচ্ছে, এ পাহাড় ভা°ঙতে হলেও তাকে চাই আমার৷ বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম একই জায়গায়।

ধীরপায়ে কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে আম্মুকে বললাম,
“রিকশা নেও।”
“কিছু খাবা? চলো নাস্তা করি?”
“লাগবে না।”

আম্মু রিকশা ঠিক করতেছে, আমি কলেজ গেইটের কাছে দাঁড়িয়ে আছি। রাস্তার অপরপাশে অয়নকে দেখলাম বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

“তন্বী, আসো।”

আম্মু ডাকে চমকে উঠে বললাম,
“আসতেছি।”

রিকশায় উঠে আর অয়নকে দেখলাম না। আমি কি তবে ভুল কিছু দেখলাম? অয়নের চিন্তায় আমি চোখেও ভুল দেখা শুরু করলাম নাকি?

সিগনাল পড়ায় রিকশা থামলো। পাশ থেকে ওড়নায় টান পড়ায় তাকিয়ে দেখি অয়ন। হ্যাঁ, আমি সত্যিই দেখছি। এই মানুষটা হেলমেট পড়া থাকুক বা যে অবস্থায়ই থাকুক, আমি তাকে চিনতে ভুল করবো না। সে এতোক্ষণ আমাদের সাথে সাথেই চলছিল।

“আম্মু, রোদ লাগছে।”

রিকশার হুড তুলে দেয়া হলো, সাথে আম্মুর থেকে অয়নকে লুকানোও হলো। হেলমেট থাকায় এমনিতেও আম্মু চিনবে না, তবুও সেফটির দরকার আছে।

রিকশার ফাঁ°ক দিয়ে আমি এখনো দেখছি তাকে। এমন পাগল কেন সে? আমি তো এতোদিন ভাবতাম আমিই বোধহয় বেশি পাগল, এখন তো দেখি সে আমার চেয়েও অনেক অনেক বেশি।

খিলগাঁও পর্যন্ত তাকে দেখেছি, তারপর আর দেখছি না। বাসায় এসে ড্রেস না পাল্টেই বারান্দায় চলে গেলাম। রাস্তায় সে আছে। আমাকে দেখার জন্যই এসেছে, আমি জানি এটা।

দুহাতে বড় করে একটা লাভ সাইন দেখালো। তারপর পকেট থেকে কলম বের করে কিছু একটা ইশারা দিলো, এবারে ঠিক বুঝলাম না কি দেখালো। আমি হাত দিয়ে না দেখালাম। কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে থেকে হাত নেড়ে চলে গেল।

পেছন ফিরে আপুকে দেখে থমকে গেলাম। আমার ওড়নার পি°ন খুলতে খুলতে বলল,
“সরি, এভাবে সেদিন রিয়েক্ট করা উচিত হয়নি।”
“যা হওয়ার হয়ে গেছে।”
“আর তো কিছুদিন, তারপর বিয়ে হয়ে যাবে আমার। থাকবো না তোর সাথে।”
“তো? থেকেও কি খুব ভালো রেখেছো?”

প্রশ্নটা একপ্রকার ছুঁ°ড়ে দিলাম আপুকে। আমি জানি সে কষ্ট পাচ্ছে৷ আমার কষ্টে আপু কষ্ট পায়। পেতে থাকুক, তবুও আমার অবস্থা সে বুঝবে না।

ফ্রেশ হয়ে বিছানায় এসে শুয়ে পড়লাম। বাবা এখনো জানে না আম্মু কেন আমাকে ঘরব°ন্দী করেছে, কেন আমাকে এভাবে পাহারা দিচ্ছে। জানলে যে খুব কষ্ট পাবে। ভুলটা তো আমারই ছিল। প্রত্যেকবার ভুল করি আমি আর কষ্ট পায় আমার ভালোবাসারা।

বিকালে টিভি দেখছিলাম। এমনসময় আম্মুকে দেখলাম দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এক আন্টির সাথে কথা বলছে। সুযোগ বুঝে আম্মুর রুম থেকে ফোন নিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলাম। এমন চু°রি আগে করেছি কিনা সন্দেহ আছে।

অয়নকে কল দিলাম। রিসিভও হলো,
“তনুশ্রী, ফোন ফেরত দিয়েছে আন্টি?”
“না, চু°রি করেছি।”
“কি বলিস?”
“বাদ দাও, দুপুরে কি দেখিয়েছিলে? আমি বুঝি নাই।”

অয়ন শব্দ করে হাসলো।
“একটা সারপ্রাইজ আছে তোর জন্য, সুন্দর একটা দিন দেখে জানাবো।”
“এভাবে লো°ভ দেখিও না। সুন্দর দিন আমার আর আসবে না।”
“আরে আসবে আসবে।”

আমি চুপ করে রইলাম। আর কোনো কথা মাথায় আসছে না৷ অয়ন বলল,
“তনুশ্রী, আজ রিকশায় থেকে যে লজ্জাটা পাচ্ছিলি, ওটা ধরে রাখিস। লাজুক তনুশ্রীকে অপূর্ব লাগে।”

কান থেকে ফোনটা সরিয়ে নিলাম। সে আমাকে লজ্জা দিবে, দিতেই থাকবে। যত লজ্জা পাবো, তত বেশি লজ্জায় ফেলবে।

কানের কাছে ফোন এনে শুনলাম,
“তনুশ্রী, নিয়ম করে একবার অন্তত কল দিস। আমি তো দিতে পারবো না, তোর কাছে কখন ফোন থাকবে জানি না। না পারলে অন্তত একটা ভয়েস ম্যাসেজ দিস। সারাদিনের ক্লান্তি আমার ওতেই দূর হবে।”

“আজ কি খুব বিজি ছিলে?”
“কিছুটা। ডিপার্টমেন্টে গিয়েছিলাম কাগজপত্র তুলতে।”
“এখানে আর পড়বা না?”
“পড়বো তো, একটু দরকার ছিল, তাই আনা লাগছে।”
“আমি কি ডি°স্টার্ব করেছিলাম?”
“সবসময়ই আমার তনুশ্রী আমাকে ডি°স্টার্ব করে, যেখানেই যাই তনুশ্রীকে মনে পড়ে।”
“হেয়ালি করো না।”
“সত্যি বলছি।”
“আচ্ছা, এখন রাখি তবে। আম্মু জানলে আবার ব°কবে।”
“হুম। ভালো থাকিস আর..”

থেমে যাওয়ায় বললাম,
“আর কি?”
“কিছু না, রেখে দে।”

কল কে°টে দিলাম। অয়ন কি কিছু বলতে চাচ্ছে? বারবার কেন আটকে যাচ্ছে ও? কিছু তো লুকানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু সেটা কি তাই বুঝলাম না।

চলবে…….

#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী

সপ্তদশ পর্ব

অয়নকে প্রতিদিন একবার কল দেয়া বা ভয়েস ম্যাসেজ করা আর একটুখানি দেখার জন্য ছটফট করা, এভাবেই পেরিয়ে গেল দুদিন। আর মাত্র ছয়টা দিন, তারপরই আপুর বিয়ে।

আত্মীয়স্বজন কাদের কাদের দাওয়াত দিবে সেটার লিস্ট করতে আম্মুর সাথে বসেছি, পাশে বাবাও আছে। দুজনে বলছে আর আমি লিখছি।

হুট করে আম্মু বলল,
“জাহানারা আর আনোয়ার ভাইয়ের নাম লিখো। অথৈয়ের বিয়েতে গিয়েছিলাম, এখন দাওয়াত না দিলে খারাপ দেখায়। (বাবাকে বলল) কি বলো?”

বাবা একবার আমার দিকে তাকাতেই আমি মাথানিচু করে ফেললাম। বাবা বলল,
“সেটা দাও, কিন্তু তাদের ছেলের কথা না বললেও তো খারাপ দেখায়। তুমি তো তোমার বান্ধুবিকে কিছু বলোনি তার ছেলের ব্যাপারে।”

বাবা উঠে চলে গেল। আম্মু বলল,
“জাহানারা, আনোয়ার আর অয়নের নাম লিখো। (একটু থেমে) অথৈ আর মানাফের নামও লিখো।”

কোনোমতে নামগুলো লিখেই উঠে রুমে চলে আসলাম৷ ঠিক কি কারণে কষ্ট পাচ্ছি আমি, নির্দিষ্ট করতে পারলাম না।

চোখের পানিগুলো আর কোনো বাধা মানলো না, গড়িয়ে পড়তে লাগলো অবিরাম। হুটহাট করে ফুঁপিয়ে উঠছি, আবার নিজের মুখ চেপে শব্দ লুকিয়ে নিজের চোখের পানি মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টা করছি।

সন্ধ্যার পর মানহা বাসায় এলো। ডাইনিং এ দুজনে বসলাম। স্কুল, কলেজ একসাথে পেরিয়ে ভার্সিটি লাইফে এসে দুজনে দুদিকে চলে গেছি। মানহা তিতুমীর কলেজে ভর্তি হয়েছে আর আমি ইডেনে। এখন আর রোজ রোজ ওর সাথে খোঁ°চা°খুঁ°চি করা সম্ভব নয় বোধহয়।

ফ্রিজ থেকে একটা আপেল এনে মানহার হাতে দিলাম,
“নে।”
“একটু কে°টেও তো দিতে পারিস।”
“এতো কে°টে দিতে পারবো না।”

আপেলে কা°ম°ড় বসাতে বসাতে মানহা বলে,
“কবে যেন দিস?”

দুজনেই চুপচাপ আছি, মূলত আমার মন খারাপ বলেই কথা বলছি না। হুট করে মানহা বলল,
“আপুর বিয়েতে আমরা একটা ডান্স পারফর্ম করতে পারি না? এই বর আসার আগেই ছোটখাটো কিছু।”
“একদমই না, সবার সামনে আমি নাচবো? সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমার ভালো লাগে না।”

মানহা কানের কাছে এসে বলল,
“ভেবে দেখ, এ অযুহাতে ফোন হাতে পাবি। গানের জন্য হলেও ফোন লাগবে।”

মানহার দিকে তাকিয়ে আবারো রান্নাঘরে উঁকি দিলাম। আম্মু ওখানে দাঁড়িয়েই কিসব গুছিয়ে রাখছে। মাথা নাড়িয়ে বললাম,
“ওকে, ডান। তাহলে হলুদেও একটা পারফর্ম দেই। কি বলিস?”
“আবার জি°গায়।”

তারপর উঠে দুজনে রান্নাঘরে গেলাম। আম্মু একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে কাজে মন দিয়ে বলল,
“কি চাই?”

মানহা বেশ ভণিতা করে বলল,
“আন্টি, আসলে আমরা, স্পেসিয়ালি আমি চাচ্ছি তানিমা আপুর বিয়েতে আমরা ডান্স পারফর্ম করবো।”
“ভালো কথা, করো।”
“তনুমনুও আমার সাথে থাকুক।”

আম্মু বক্সগুলোতে জোরে দুইটা বারি দিয়ে বলল,
“জানো তো মানহা, এভাবে ফ্রিডম দিয়েই ভুল করেছি। আরেক ছেলের বাসায় চলে গেছে এই মেয়ে।”

মানহা গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“আন্টি, ভুল হয়ে গেছে ওর। ও তো এখনো ছোট্ট বাবু, বুঝে না এতোকিছু। ও যে বড় হইছে সেটা তো ও নিজেই জানে না।”

মানহা এবারে বাড়াবাড়ি করতেছে। আম্মুকে আধঘন্টা তেল মালিশ আর নানা প্রকার ম°ল°ম প°ট্টি করার পর রাজি করিয়ে ছাড়লো মানহা।

আমার রুমে এসে দুজনে একপ্রকার লা°ফালা°ফি করছি। মানহা নিজের জামার কলার টেনে বলল,
“কি বুঝলি?”

আমি বিছানায় বসে বললাম,
“বুঝলাম, তেলের ড্রাম উলটে দিতে তোর জু°ড়ি মেলা ভার।”

মানহা মুখের সামনে হাত নেড়ে বলল,
“বাদ দে, রিহার্সেল করবো আমাদের বাসার হলে।”
“পারমিশন দিবে?”
“পারমিশন নেয়া যাবে আর না হলে ছাদে যাবো।”
“ওকে, বাট গান কোনটা?”

মানহা হাঁটুতে দুহাতের ভর করে দাঁড়িয়ে নিচুস্বরে বলল,
“সেটা তুই সিলেক্ট কর, দরকার হলে অয়ন ভাইকে জিজ্ঞাসা কর।”

মানহার মুখ চেপে ধরে বললাম,
“আস্তে, কথা বল। কিভাবে জিজ্ঞাসা করবো? তার সাথে কি আমার দেখা হয়?”
“হয়তো হবে।”

তারপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
“কাল সকালে চলে আসিস, আন্টিকে আমি বলে যাচ্ছি।”
“এখনই চলে যাবি? আরেকটু থাক না।”
“না রে, আম্মু চি°ল্লা°বে।”
“আম্মুদের জাতীয় কাজ।”

দরজা পর্যন্ত গিয়ে আবারো ফিরে আসলো। জিন্সের পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমার ওড়নার কোণায় বেঁ°ধে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে চলে গেল। শুধু গেল না, যাওয়ার আগে আমার ওর বাসায় যাওয়ার পারমিশনও নিয়ে গেল।

দরজা লাগিয়ে ওড়নার বাঁ°ধন থেকে খাম খুলে ভিতরে একটা চিঠি আর চকলেট পেলাম। চকলেট খেতে খেতে চিঠিটা খুললাম। যা ভেবেছিলাম তাই, অয়নই পাঠিয়েছে।

“তনুশ্রী আমার, তানিমার বিয়েতে আমি হয়তো আসবো না। ভেবেছিলাম আসলে তোকে একটা সারপ্রাইজ দিবো, বাট আগেই দিতে হচ্ছে। আমি একটা জব পেয়েছি, সেদিন রাস্তা থেকে ইশারা করে এটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। সেলারি খুব বেশি না হলেও আশা করি তোর-আমার চলে যাবে। আমার বধূ হতে প্রস্তুত হও আমার প্রেয়সী।”

অয়নের চাকরি হয়েছে, এর চেয়ে বড় খুশির খবর আর কি হতে পারে আমার জন্য। খুশি আমার চোখেমুখে, খুশি আমার মনে একদম উপচে উপচে পড়ছে। হাসি যেন আজ আমার থামছেই না।

রাতে বাসার কারো সামনে যেতে পারলাম না। লজ্জা লাগছে খুব। বিয়ের চিন্তায় মেয়েদের বুঝি এমনই হয়।

রাতে খেলাম না। মূলত খাবার আজ আমার গলা দিয়ে নামবে না। রাতে ঘুমাতে এসে আপুর গা ঘে°ষে শুয়ে বললাম,
“আপু তোমার ফোনটা একটু দিবা?”
“কেন?”
“প্লিজ, দেও না।”

আপু ফোনটা দিতে নিলেই কল আসলো। রুম্মান ভাইয়ার নাম্বার ভেসে উঠায় আপু একটা হাসি দিয়ে উঠে বারান্দায় চলে গেল। মেজাজটা বি°গ°ড়ে গেল আমার। এটা কেমন কথা? আমার সাথেই এমন হতে হয়?

আপুর অপেক্ষায় অপেক্ষায় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে মানহার ডাকে ঘুম ভাঙলো।

“তনুমনু, ওই তনুশ্রী আমার, থু°রি অয়নের।”

লাফিয়ে উঠে মানহার দিয়ে তাকিয়ে রইলাম। মানহা হেসে উঠলো। ওর হাতে একটা চা°টি মে°রে বললাম,
“এমনে বলিস না, বাসার কেউ শুনলে খবর আছে।”
“আচ্ছা, বললাম না। এখন রিহার্সালের জন্য চল।”
“হুম।”

বলে শুয়ে পড়তেই মানহা আমারো বলল,
“অয়ন ভাই ওয়েট করছে।”

উঠে বসে বললাম,
“অয়ন?”
“ওষুধটা সেই। যা, ফ্রেশ হ।”

মানহার হাসি দেখে বুঝলাম আবারো দুষ্টুমি করেছে। অয়নের নাম করে দুষ্টুমি না করলেই নয়?

ফ্রেশ হয়ে দুজনে নাস্তা করে মানহার বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলাম। মানহাদের বাসার টপ ফ্লোরে হলরুম আছে। ওখানেই আমরা রিহার্সাল করবো।

হলে গিয়ে দুজনে চেয়ারগুলো সরিয়ে মোটামুটি একটা জায়গা করলাম। তারপর দুজনে মিলে পানি ছিটালাম। জায়গাটা নোং রা হয়ে আছে, আগে পরিষ্কার করতে হবে।

মানহাকে গুনগুনিয়ে গান গাইতে শুনলাম৷ সাধারণত মেয়েটা গান গায় না, জোর করে গলা থেকে গান বের করতে হয়।

ভালো করে শুনলাম,
“স্বপ্নে তুমি, বাস্তবে তুমি
তুমিই আছো মনে,
পৃথিবী যাক জেনে
আমি পড়েছি প্রেমে।
পৃথিবী যাক জেনে
আমি পড়েছি প্রেমে।”

ইত্তাজার গাওয়া গান এটা। অবাক হয়ে বললাম,
“মানহা তুই গান গাইছিস?”

মানহা বড়বড় চোখ করে তাকিয়ে বলল,
“আ..ওই নতুন শুনলাম তাই আরকি। কি বলি বলতো নতুন প্রেমে এমন হয়।”
“নতুন প্রেম? তুই আবার কোথায় ক্রা°শ খেলি?”
“ক্রা°শ না রে এবারে সত্যি প্রেম, একদম জান যায় প্রেম।”
“অ্যা।”

মানহা হেসে লাজুকভাবে বলল,
“তোকে পরে একদিন সবটা বলবো। আজ আমার লজ্জা লাগছে।”
“আমার সাথে লজ্জা?”
অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি আমি। এই মেয়ে নি°র্ঘা°ত মজা করছে, এর আগেও তো এমন বহুবার করেছে। তবুও কেন যেন ওর লজ্জাটা মেকি লাগছে না।

মানহা বলল,
“আমি ঝা°ড়ু নিয়ে আসি।”
“ওকে যা।”

মানহা চলে যেতেই আমি আবারো পানি ছিটাতে লাগলাম। হঠাৎ তাড়াহুড়ো করে করা খোঁপাটা খুলে গেল। বোতলটা রেখে খোঁপা করতে করতে আপন মনে বলতে লাগলাম,
“কাজের সময় চুলেও বে°ই°মা°নি করে।”

“খোলা চুলে তোকে বেশি ভালো লাগে তনুশ্রী।”

কথা শুনে পিছনে ঘুরতে নিয়েই ধা°ক্কা খেলাম অয়নের সাথে। সাত পাঁচ না ভেবে সোজা তাকে জড়িয়ে ধরলাম, অয়নও শক্ত করে আমাকে বাহুডোরে নিয়ে নিলো।

তার বুকে মাথা রেখে বললাম,
“জব পেয়ে গেছো তুমি?”
“হুম।”
“সত্যি আমরা এক হবো?”
“চিরদিনের জন্য।”
“ছেড়ে যাবে না তো?”
“কল্পনায়ও আনিস না।”

মাথা তুলে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। হাসি হাসি গোছানো এই মুখটা আমার বড্ড প্রিয়।

একটা চেয়ার টেনে ওকে বসিয়ে বললাম,
“কবে থেকে জয়েন করবে?”
“এক তারিখ থেকে।”
“নভেম্বরের এক তারিখ?”
“হুম।”
“মাঝে তো মাত্র দুদিন তবে।”

ওর ঘাড় অ°ব্ধি বড়বড় চুলে হাত বুলিয়ে বললাম,
“এগুলো কে°টে ভদ্র হয়ে যাবে।”
“অ°ভদ্রভাবেই তো ইন্টারভিউ দিলাম।”

চোখ রা°ঙিয়ে বললাম,
“যা বলেছি করবা।”
“ওকে।”

আমি ওর দুকাঁধে ভর দিয়ে ঝুঁকে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললাম,
“তারপরের চিন্তা ভাবনা কি?”
“ডিসেম্বরে নতুন বাসায় উঠবো। আর তারপর বিয়ে।”
বলেই আমার নাক টে°নে দিলো।

“বাবা যদি না মানে?”
“হাতে পায়ে ধরে হলেও রাজি করাবো।”
“তোমার বাসায়?”
“মনে হয় সমস্যা হবে না।”
“না হলেই ভালো।”

মানহা দরজার কাছে এসে একটা কাশি দিলো। দুজনে সরে গেলাম।

মানহা হেলেদুলে ভিতরে এসে ঝা°ড়ুটা ফেলে বলল,
“অয়ন ভাই?”

অয়ন ভ্রূ উঁচিয়ে বলল,
“কি?”

মানহা হাত বাড়িয়ে বলল,
“আমার চকলেট?”

অয়ন পকেট থেকে দুইটা চকলেট বের করে মানহাকে ধরিয়ে দিলো। মানহা আমার দিকে তাকিয়ে বলল,
“চোখ কুঁচকে গেলো কেন রে তনুমনু?”

আমি মাথা নাড়লাম, অয়ন হাসছে। মানহা তু°ড়ি বাজিয়ে বলল,
“চিঠি আর একটা চকলেট পাঠানোর জন্য তিনটা চকলেট নিছি আর আজকে দুইটা। আমি দুজনের মাঝে কাজ করতেছি, তাই এগুলা আমার ফি।”

আমি চশমা ঠে°লে বললাম,
“এটাকে ঘু°ষ বলে।”

অয়ন এবারে শব্দ করে হেসে বলল,
“আচ্ছা, আমরা যাই, তুমি কাজ করো মানহা।”
“কাজ করো মানে? কোথায় যাবে তোমরা?”

অয়ন আমাকে কাছে টেনে নিয়ে বলল,
“সেটা আমাদের ব্যক্তিগত বিষয়।”

দুজনে হল থেকে বেরিয়ে আসলাম। পিছনে মানহার চেঁ°চা°মে°চি শুনতে পাচ্ছি,
“তুই আসবি না রে তনুমনু? তোর প্রেম আমি বের করবো। এরজন্যই ব্রে°কাপ করায় ফ্রেন্ডরা বে°ডা পেয়েই আমি পর হয়ে গেলাম।”

দুজনেই হাসতেছি ওর কথা শুনে। সিঁড়িতে এসে বসলাম। আমি তার থেকে দুইধাপ নিচে বসেছি।

অয়ন আমার এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে নিয়ে বিনুনি পাকাতে শুরু করে।

“ওমা, কি করছো অয়ন?”
“বেনি করছি।”
“খোলা চুলে না আমাকে ভালো লাগে?”
“হ্যাঁ, কিন্তু এখন খোলা থাকলে সিঁড়ির ম°য়°লা চুলে লাগবে।”

আমি হেসে বললাম,
“আচ্ছা, করো তবে। (একটু থেমে) অফিস কোথায় তোমার?”
“এয়ারপোর্ট।”
“এখান থেকে রেগুলার এয়ারপোর্টে গিয়ে অফিস করবে?”
“হুম।”

বিনুনি শেষ করে অয়ন এসে আমার গা ঘেষে বসে বলল,
“ডিসেম্বরে বাসা নিলে আম্মু-আব্বু বাসায় আসবে, তবে আমি চাচ্ছি তার আগেই উনাদের সাথে তোর কথা বলিয়ে দিবো।”

আমি বেনিটা দেখছিলাম। ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,
“উনারা তো আমাকে দেখেছে, কথাও হয়েছে। আর নতুন কি?”

আমার থুতনিতে হাত দিয়ে বলল,
“তখন তো আর পুত্রবধূর চোখে দেখেনি নিশ্চয়ই?”

চোখ নামিয়ে নিলাম। অয়ন আমার পাশে এসে বসে দুগালে হাত দিয়ে মুখটা তুলে বলল,
“আজ যাই তবে?”
“আবার কখন দেখা হবে?”
“হবে কখনো।”

অয়ন উঠে দাঁড়ালে আমি ওর হাত ধরে বললাম,
“বিয়েতে আসবে?”
“একেবারে তোকে নিতে আসবো, তার আগে নয়।”

আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“নিচু হও নাহলে আমাকে একটু উঁচু করো।”
“কেন?”
“আহা, করো তো আগে।”

অয়ন একটু নিচু হয়ে বলল,
“কি?”

আমি ওর কপালে চুম্বন করে বললাম,
“এবারে যাও। বর বেশে, সুন্দর হয়ে এসো।”
“আসবো।”

অয়ন কয়েক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে গেল। মানহা এসে বলল,
“সব রেডি, চল।”
“ওকে।”

হলরুমে যেতেই মানহা বলল,
“তোকে একদিন শুধু সুযোগে পাই, কাঁচা চি°বি°য়ে খাবো।”
“ওকে।”

ও ভ্রূ উঁচিয়ে তাকিয়ে আছে। আমি মাথা নেড়ে কিছু বলার আগেই মানহা বলল,
“জব পেয়েছে তাতেই তুই যা খুশি হয়েছিস, বিয়ে করতে আসলে না জ্ঞা°ন হারিয়ে ফেলিস।”

আমি হাত নেড়ে বললাম,
“দূর, কি যে বলিস?”

দুজনে ইউটিউব থেকে নানা স্টেপের নাচ দেখছি। গান সিলেক্ট হলো, নাচ অনুশীলনও হলো। আমাদের সাথে আরো চারজন ফ্রেন্ড যোগ দিলো। তবে মনে শুধু একটা আক্ষেপ রইলো অয়ন তো বিয়েতে আসবে না, তবে আমার নাচ কার জন্য হবে?

দুদিন আমার অপেক্ষায় কেটে গেল। আজ নভেম্বরের পহেলা দিন। ঘড়িতে ভোর ৬ টা, সারারাত ঘুমাইনি তবুও আমি এখনো নির্ঘুম হয়ে ছটফট করছি।

ফোনটা কেঁ°পে উঠতেই আমার বুকটাও ধক করে উঠলো। স্ক্রিনে অয়নের নাম্বার দেখে আলতো হেসে কে°টে দিয়ে বারান্দায় গেলাম।

অয়ন নিচে দাঁড়িয়ে আছে। অফিসের প্রথমদিন যাওয়ার আগে দেখা করতে চেয়েছিল। আমি ওকে থাকতে ইশারা করে নিচে নেমে এলাম, সাথে আনলাম ছোট্ট একটা টিফিন বক্স।

ওর হাত ধরে টে°নে বাসা থেকে একটু দূরে এনে বললাম,
“তোমার প্রথমদিনের টিফিন।”
“নাইস।”

টিফিন বক্সটা ব্যাগে ঢুকিয়ে বলল,
“কে বানিয়েছে?”
“আর কে? আমি।”
“বাহ।”

আমি ওকে ভালো করে দেখলাম। সাদা শার্ট, কালো ফরমাল প্যান্ট, চুলগুলো কথা মতো ছোট করে কে°টে°ছে।

শার্টের উপরের একটা বোতাম লাগাতে লাগাতে বললাম,
“গোছানো, পরিপাটি লাগছে।”

কাছে এসে নাকে নাক ঘষে বলল,
“তোকে তো এলোমেলো লাগছে।”
“আমি ঘুমাইনি সারারাত।”

অয়নের কপাল কুঁচকে গেল। বলল,
“কেন? বাসায় কোনো সমস্যা?”
“আরে না, এক্সাইটমেন্ট।”

কপালের চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে বলল,
“জব আমার আর এক্সাইটমেন্ট তোর। (একটু থেমে ঘড়ি দেখে) আচ্ছা, আমি যাই৷ লেইট হয়ে যাবে।”
“হুম, বাই।”

অয়ন চলে গেল। রাস্তার অপরপাশে গিয়ে আবারো ফিরে তাকালো। আমি হাত নেড়ে বিদায় জানালাম। আবার কবে দেখে হবে কে জানে? তবুও এ বিদায়ে খুশি থাকে।

চলবে…….