#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
বিংশ পর্ব
একমাস কেটে গেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এ সময়ে বেশ শীত পড়ে গেল।
আনোয়ার আংকেল এখন অনেকটাই সুস্থ। বাসায় নিয়ে গেছে। অয়ন বেশ কয়েকবার গাজীপুর যাওয়া আসা করেছে। এখন ঢাকায় নতুন বাসায় আংকেল-আন্টিকেও নিয়ে এসেছে। অয়নের বড়চাচার সাথে আবারো কোনো ঝা°মে°লা হওয়ায় আংকেলের এই অসুস্থতা হয়েছিল। তবে ঠিক কি ঝা°মে°লা হয়েছিল তা অয়ন আমাকে বলেনি।
আমি ক্লাস, পড়ার ব্যস্ততায় আছি। অয়ন আমাকে বাসায় নিয়ে যেতে চাইলেও আংকেলের অসুস্থতায় বি°র°ক্ত করতে চাইনি। আগে আংকেল সম্পূর্ণ সুস্থ হোক। নিজেদের সুখ এতোটা না ভাবলেও হবে।
আজ তানিমা আপু বাসায় এসেছে। বাসায় বেশ ভালো আয়োজন করা হলো। রাতে রুম্মান ভাইয়া আসবে, নতুন জামাই বলে কথা আয়োজন তো করতেই হবে।
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পর আপুর সাথে বারান্দায় গল্প করছি৷ বিয়ের প্রথম মাস কিভাবে কাটছে এটাই ছিল আপু গল্পের মুখ্য বিষয়।
এরমধ্যে এক অদ্ভুত কথা বলল আপু,
“আব্বু কিন্তু এখন তোর বিয়ে নিয়ে ভাবছে।”
আড়চোখে একবার তাকিয়ে বললাম,
“তো?”
“এতো আকাম করছো তাই তোমাকে তাড়াতাড়ি বিদায় করবে, না হলে তুমি মানসম্মান রাখবা না।”
আমি হেসে কিছু বলতে যাবো এমনসময় অয়নের কল আসলো।
“তনুশ্রী।”
“জি।”
“কি করিস?”
“এইতো আপু আসছে বাসায়, কথা বলি।”
“কালকে আমি তোর বাসায় আসবো।”
কথাটা হঠাৎ করে আমার কানে বা°রি খেলো। অয়ন আবারো বলল,
“আব্বু-আম্মু রাজি আছে। কালকে বিকালে আংকেলের অফিসে যাবো।”
“কেন?”
“কথা বলতে। ভুল আমাদের হয়েছে, ক্ষমা তো চাইতেই হবে। রাতে তোদের বাসায় যাবো।”
আপু দিকে তাকিয়ে দেখি সে আমার দিকে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি উঠে রুমে চলে আসলাম। অয়নকে বললাম,
“বাবা যদি আসতে নি°ষে°ধ করে?”
“কথা বলার জন্য আসতেই হবে সেটা উনার ইচ্ছা থাকুক বা না থাকুক। (একটু থেমে) রাখছি আমি, অফিসে আছি।”
অয়ন কলটা রেখে দিলো।
আপু কি জানে অয়ন আসবে? বাবা কি অয়নের সাথেই বিয়ে নিয়ে ভাবছে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে।
“কি হয়েছে?”
আপুর প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবেই বললাম,
“নাথিং।”
“কে ছিল? অয়ন ভাই?”
“না।”
অকপটে অস্বীকার করলাম। লজ্জা লাগা শুরু হলো আমার।
রাতে রুম্মান ভাইয়া আসলো। রাতের খাবারের পর সকলে বসে কথাবার্তা বললেও আমি সেখানে উপস্থিত থাকতে পারলাম না। তবে উনাদের কথার মাঝে আমার কোনো একটা বিষয় মোটা দাগে ছিল। কারণটা যে আমার বিয়ে সেটাও বুঝলাম।
সারাটা রাত ছটফট করেই কাটালাম। সকালে কলেজে যাওয়ার পথে মানহার সাথে দেখা হলো। সেও আমার মতো বাসের অপেক্ষায় আছে।
“তনুমনু।”
মানহার ডাকে দ্রুত ওর কাছে গিয়ে হাত ধরে বললাম,
“আজকে সন্ধ্যায় আমার বাসায় আসিস প্লিজ।”
“সন্ধ্যায় টিউশন আছে, কিভাবে যাবো?”
“আমি এতো কিছু জানি না, তুই আসিস।”
এরমধ্যে আমার বাস চলে এলো। বাসে উঠেও জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বললাম,
“মনে করে আসিস, না হলে আমাকে আর দেখবি কিনা জানি না।”
কলেজে ক্লাসে মনোযোগ বসলো না। ল্যাব হলো, কি যে করালো কিছুই দেখা হলো না। মন মস্তিষ্কে আজকের সন্ধ্যা ছাড়া আর কিছুই নেই।
সাড়ে তিনটায় বাসায় ফিরলাম। রাস্তায় আজ খুব জ্যাম ছিল। বাসায় এসে রুম্মান ভাইয়ার দেখা পেলাম না, অফিস থাকায় সকালেই চলে গেছে।
গোসল শেষে খাওয়াদাওয়া করে বিছানা নিলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি মানহা প্রায় সাতাশবার কল দিয়েছে, হোয়াটসঅ্যাপে পঞ্চাশোর্ধ ম্যাসেজ। আমার কথায় বেচারির অবস্থা যায় যায়। ও যে আসবে সে ব্যাপারে আমি একশো শতাংশ নিশ্চিত।
অয়নের ম্যাসেজ আসলো একটা,
“আমি আংকেলের অফিসে আছি। সন্ধ্যায় আসছি তোর কাছে।”
ব্যস, আমার হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। মস্তিষ্ক চঞ্চল হলো। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি, ভালো-মন্দ মিলিয়ে আমি যে আর আমার মাঝে নেই।
ছয়টার দিকে মানহা এসে হাজির৷ আপুর সাথে কুশল বিনিময় করেই আমার রুমে এসে বলল,
“কিসব বলছিলি সকালে?”
আমি ওর মুখ চেপে ধরে বললাম,
“শান্ত হ। জাস্ট তোকে বাসায় আনার জন্য বলেছি।”
“মানে কি? কেন?
“অয়ন আসছে, ওর বাবা মাকে নিয়ে।”
“সত্যি?”
“হুম, আর (আশেপাশে দেখে বললাম) বাবা মেনে নিয়েছে বলেই মনে হলো।”
মানহা কিছু বলার আগেই কলিং বেল বাজলো। আমি দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। বাবা এসেছে। এতো তাড়াতাড়ি অফিস থেকে ফিরেছে মানে কোনো ঘটনা আছে।
বাবা সোফায় বসে মোজা খুলছে। আমি একগ্লাস শরবত এনে সামনের টেবিলে রাখলাম। বাবা আড়চোখে একবার তাকালো৷ আর কোনো কথা না বলে সোজা চলে গেল রুমে, শরবতটুকু পড়ে রইলো।
মানহা এসে কানের কাছে বলল,
“কি ব্যাপার?”
বাবার রুমের দরজার দিকে তাকিয়ে বললাম,
“উহু, বুঝতে পারছি না।”
আপু আমার রুমের কাছ থেকে বলল,
“কি হয়েছে?”
আমি কিছু বললাম না। কি যে হচ্ছে তা আমি নিজেও জানি না।
সাড়ে সাতটা বেজে গেল। অয়নের কোনো খোঁজখবর নেই। না কল রিসিভ করছে আর না কোনো ম্যাসেজ দেখছে। তবুও আমি অয়নের আসার অপেক্ষায় আছি।
আমি সুতির একটা থ্রিপিজ পড়েছি, মুখে হালকা মেকআপও লাগিয়েছি। আপু আর মানহা শুধু আমাকে দেখেই যাচ্ছে যেন তাদেরকে দর্শক হিসেবে আমন্ত্রণ করেছি।
বাবা নাস্তা সেরে ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছে। আমি পর্দা সরিয়ে কিছুক্ষণ পর পর বাবাকে দেখছি। কি বলেছে অয়ন? আদৌ কি বাবা ক্ষমা করেছে আমাদের?
আবারো কলিং বেল বেজে উঠলো। আমি চমকে উঠে সোজা বিছানায় এসে বসে পড়লাম। আপু আমার অবস্থা দেখে বলল,
“সমস্যা কি সেটা তো বলবি? অদ্ভুত মানুষ।”
“অয়ন এসেছে, আন্টি আংকেলকে নিয়ে।”
“কি? অয়ন ভাই?”
আপু কপাল কুঁচকে কেমন করে যেন তাকালো।
আমি উঠতে নিলে আপু বলল,
“কেন এসেছে অয়ন ভাই?”
“ন্যাকামি করো না।”
আম্মু দরজা খুলে দিয়েছে, জাহানারা আন্টির কন্ঠ শুনতে পেলাম। ওড়নাটা সুন্দর করে দিয়ে বেরিয়ে আসলাম। আংকেল-আন্টির সাথে অয়নও আছে।
আপু আমার পিছুপিছু বাইরে আসলো, মানহা পর্দার ওপাশ থেকেই চেয়ে রইলো অপলক।
অয়ন আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়েই মাথানিচু করে ফেললো। কেমন যেন এক এলোমেলো দশা তার। সে হাসলো না, ভুলেও আর আমার দিকে তাকালো না। মনের ভিতরে একটা ভ°য় ট°গব°গিয়ে উঠলো।
তবুও হাসিমুখে বললাম,
“আসসালামু আলাইকুম আংকেল। আপনার শরীর কেমন এখন?”
আমার প্রশ্নে হাসিমুখে জবাব দিলেন,
“এখন ভালো আছি মা।”
বাবা উনাদের বসতে বললেন। আম্মু, আপু নাস্তার ব্যবস্থা করতে গেল। নাস্তা আসলো। আম্মু এসে আন্টির পাশে বসলো। আন্টি আমার হাত ধরে তার অন্যপাশে বসালো।
বাবা আমাকে বললেন,
“তন্বু মা, বড়রা কথা বলবো। তুমি ভিতরে যাও।”
আন্টিও বললেন,
“যাও।”
“জি।”
আমি ফিরে আসার সময় একবার অয়নের দিকে তাকালাম। সে তাকিয়ে ছিল আমার দিকেই কিন্তু চোখে চোখ পড়তেই নজর সরিয়ে নিলো। মুখে একটা শুকনো হাসি বিদ্যমান।
ভিতরে আসতেই অয়নের কন্ঠ শুনলাম,
“আ.. আমি একটু আসছি। একটা কল এসেছে। সরি ফর দ্যাট।”
অনুমতি পেয়ে অয়ন বেরিয়ে গেল। আমার মনে হলো সে পালিয়ে গেল। মানহাকে বলল,
“চল, বাইরে যাবো।”
“সবার মাঝখান দিয়ে?”
“হ্যাঁ, অয়নের সাথে কথা বলতে হবে।”
মানহা ড্রইংরুমে গিয়ে আম্মুর অনুমতি নিলো তারপরই আমাকে নিয়ে বেরিয়ে আসলো। আম্মুর অ°গ্নি°দৃষ্টি আমার চোখ এড়ায়নি।
গ্যারেজের একপাশে অয়নকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। আমি মানহাকে সিঁড়ির কাছে থাকতে বলে অয়নের দিকে এগিয়ে গেলাম।
“কোথাও আসার আগে সবার বোঝা উচিত সে কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে। পাত্রী দেখতে আসছো, সুন্দর হয়ে আসবা। ফরমাল ড্রেসআপ থাকবে, গোছানো চুল থাকবে। তা না, এলোমেলো হয়ে চলে এসেছো। শার্টের স্লিভ কনুই অব্ধি গোটানো। এলোমেলো চুল আর মুখে অফিস ফেরত ক্লান্তি, ঘামে ভেজা কপালের উপর অগোছালো চুলগুলো অবহেলায় পড়ে আছে। তার উপর জোরপূর্বক মুখে আনা চওড়া হাসি। এসবের মানে কি?”
আমার কথায় অয়ন ফিরলো। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। চোখের পানিগুলো স্পষ্ট, অয়ন কাঁদছে। অজানা ভ°য়েরা আমাকে ঘিরে ধরলো।
আমি কৌতুহলী হয়ে বললাম,
“অয়ন, কি হয়েছে?”
“আমাদের বিয়ে হচ্ছে না তনুশ্রী। (একটু থেমে) ইত্তাজার সাথে তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে।”
কপাল কুঁচকে বললাম,
“ইত্তাজা ভাইয়া?”
“হুম, আংকেল বলেছে আমাকে।”
“আমাকে না জানিয়ে বিয়ে ঠিক করে ফেললো। এটা অসম্ভব।”
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আমাদের ভুলের জন্যই নাকি ডিসিশনটা তোকে না জানিয়েই নিয়েছে।”
কথাটা বলেই অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো অয়ন। আমি একপ্রকার ত°ব্ধা খেয়ে আছি। হঠাৎ এতো বড় ধা°ক্কাটা ঠিক সামলাতে পারছি না।
ঘোর কেটে গেল, বুঝে গেলাম অয়ন আর আমার নেই বা আমি আর অয়নের নেই। আপু হয়তো ইত্তাজার কথাই বলতে চেয়েছিল আর আমি শুনিনি।
শার্টের কলার টেনে ধরে বললাম,
“কেন আগলে রাখলে না নাকি রাখতেও চাওনি?”
“যেটা তুই ভাবিস সেটাই, তবে..”
অয়ন থেমে যেতেই বললাম,
“কি তবে?”
“ফ্যামিলির জন্য মাঝে মাঝে স্যাক্রিফাইস করতে হয়। আমিও তাই করেছি।”
“কিসের দায় তোমার?”
অয়ন আমার গালে হাত দিলো। দুহাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল,
“দায় পড়েছে আমার, না হলে এই তনুশ্রীকে আমি কখনোই আমার ভাবী করার প্রস্তাবে রাজি হতাম না।”
দুদিকে মাথা নেড়ে কান্না করে দিই। হাউমাউ করে কাঁদছি আমি। অয়নের গালও ভিজে গিয়েছে। না পাওয়ার কষ্ট, প্রিয়জনের কাছে থেকেও দূরে থাকার কষ্ট আর কাউকে নিজের অবস্থা বোঝাতে না পারার কষ্টটা আঁ°ক°ড়ে ধরেছে আমাদের৷
“তনুশ্রী, কাঁদিস না। ভাগ্য আমাদের এক হতে দেয়নি। (একটু থেমে) আংকেল তার মেয়ের ভালো চান, তাইতো এমন কোনো ছেলের হাতে তুলে দিবে না যে…”
অয়ন থেমে গেল, কান্না আমার থামলো না। তারপরের কথাটা আমি জানি। অয়নকে বাবা খারাপ মনে করে। ঠিক যতটা খারাপ হলে একটা মেয়ের একাকিত্বের সুযোগ নিতে পারে, ততটা খারাপ মনে করে অথবা তারচেয়েও বেশি।
অয়ন আমার হাত ধরে বললো,
“বাসায় চল।”
“না।”
হাত ছাড়িয়ে নিলাম আমি।
মানহা আমাদের দিকে এগিয়ে আসলো। অয়নের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“আমাকে নিয়ে চলো না তোমার সাথে?”
অয়ন অন্যদিকে ঘুরে নিজের চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো। একটা ছেলে যে অবস্থায় কাঁদছে, সেখানে আমি ঠিক কিভাবে নিজেকে শান্ত করবো।
অয়ন মানহাকে চলে যেতে ইশারা করে আমাকে বলল,
“চল।”
আমার হাত ধরে বাসায় নিয়ে গেল। দরজা দিয়ে ভিতরে আসতেই দেখি সকলে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। অয়ন আমার হাত ছেড়ে দিলো।
আনোয়ার আংকেল বললেন,
“অয়ন, চলো।”
আংকেলকে দেখে মনে হলো উনি রেগে আছে৷ কিছু তো হয়েছে এখানে।
আমি বাবার কাছে গিয়ে বললাম,
“বাবা, প্লিজ…”
কথা শেষ হলো না আমার। কান্নারা আমার কথা আটকে দিয়েছে। জাহানারা আন্টি এখনো তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
আংকেল এবারে ক°ঠো°র গলায় বলেন,
“অয়ন, তুমি কি যাবে না? তুমি যে আমাদের অজান্তে কি কি করেছো তা আমরা জেনেছি।”
অয়ন মাথানিচু করে ফেললো। আমাদের কোনো কথা শোনার বা বোঝার মতো অবস্থায় উনারা নেই, বিশ্বাস করা তো বহু দূরের কথা।
বাবার দিকে তাকিয়েই আছি। হয়তো কিছু একটা বলবে, কিন্তু কিছুই বলছে না। আন্টি বেরিয়ে গেলেন, আংকেলও চলে গেলেন। অয়ন দরজার কাছে গিয়ে আবারো ফিরে তাকালো।
আমি একপ্রকার পিছু ডেকে বললাম,
“আংকেল, প্লিজ দাঁড়ান।”
আমি বাবার হাত ধরে সাহস করে বলেই দিলাম,
“বাবা, আমার ইচ্ছার কি কোনো দাম নেই?”
বাবা হাত ছাড়িয়ে শান্ত গলায় বলল,
“তন্বী, তুমি চাইলে উনাদের সাথে চলে যেতে পারো। আমি তোমাকে আর কোনো বাধাই দিবো না।”
বাবা রুমে চলে গেল। এ বাসার গ°ন্ডি আজ পেরিয়ে যাওয়া মানে আর কখনো এখানে আসতে পারবো না। অয়ন এখনো দাঁড়িয়ে আছে।
বুঝতে পারলাম এমসিকিউ প্রশ্নের মতো আমার সামনেও দুটি অপশন। হয় অয়ন আর নয়তো বাবা। একটার বেশি দুটো আমি কখনোই পাবো না।
উপায় পেলাম, একটাই উপায়। আমি যদি না থাকি তবে আর কোনো সমস্যাই বোধহয় হবে না। সকলে থাকুক তাদের ই°গো নিয়ে।
অয়নের দিকে একবার তাকিয়ে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম, বেশ জোরে শব্দ হলো। বাইরে থেকে অয়নের চিৎকার শুনলাম,
“তনু, ভুল করিস না।”
এবারে আর সে বলল না সব ঠিক হয়ে যাবে। কারণ কিছুই আর ঠিক হবার নয়।
ঘন্টাখানের পার হলো। নিজেকে শে°ষ করা এতোটাও সহজ নয় যে চাইলেই পারবো। এতোটা সাহস আমার হলো না।
শেষবারের মতো বাবার সাথে কথা বলবো, এটাই সিদ্ধান্ত আমার। কান্না করে বা দুর্বল হয়ে কিছুই হবে না। আমার অয়নকে লাগবে, খুব করে লাগবে।
দরজায় এখনো ক্রমাগত ধা°ক্কা দিচ্ছে অয়ন, সাথে বাবার কথাও শুনছি। আমি গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
বাবার আগেই অয়ন একটা ধ°ম°ক দিয়ে বলল,
“আ°ক্কে°ল হবে না তোর? দরজা বন্ধ করেছিস কেন?”
তার দিকে শুধু তাকালাম। বাবা পাশ থেকে বলে উঠলো,
“অয়ন, বাসায় যাও।”
অয়ন বাবার দিকে একবার তাকালো, তারপর তাকালো আমার দিকে। চলে যেতে নিলে আমি অয়নের হাত ধরে ফেললাম। বাবার সামনে এতোবড় সাহস করা সহজ নয় আমার জন্য।
অয়ন ফিরে তাকাতেই আমি বাবাকে বললাম,
“বাবা, আমি গুছিয়ে বলতে পারবো কি না জানি না। তবে ওকে ছাড়া আমি ভালো থাকবো না।”
অয়ন চোখ রাঙিয়ে বলল,
“পাগল হলি নাকি? থাম এবারে।”
বাবার কাছ থেকে কোনো জবাব পেলাম না। উনি চলে গেল নিজরুমে। অয়নের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললাম,
“তুমিও হয়তো চলে যেতে চাইছো। চলে যাও।”
কান্নাটা ঠু°ক°রে বাইরে আসতে চাইলে সেটা আটকে রেখেই বললাম,
“সকলকে ভালো রাখার প্রেসক্রিপশন তোমার কাছে আছে কিন্তু আমাকে ভালো রাখতে পারলে না।”
রাগে অভিমানে অয়নকে ধা°ক্কা দিতে দিতে বললাম,
“বের হও, যাও। চলে যাও। চলেই তো যাচ্ছিলে, এখন যাও।”
বারবার অয়ন কিছু বলতে চাচ্ছিলো, কিন্তু বলেনি। চলে গেল সে। সত্যিই চলে গেল, তার তনুশ্রীর জীবন থেকে। সে বলেছিলো পুরো পৃথিবী থেকে আগলে রাখবে তার তনুশ্রীকে, কিন্তু পৃথিবীটাই বাধা হয়ে গেল আমাদের মাঝে।
চলবে…..
#হঠাৎ_প্রণয়
লেখনীতে: #ইসরাত_জাহান_তন্বী
একবিংশ পর্ব
অয়ন চলে যাওয়ার পর থেকে ডাইনিং এ বসে রইলাম আমি। মানহাও চলে গেছে বাসায়। আমাকে শান্ত থাকতে বলে গেলেও ভিতরে ভিতরে আমার রাগ বাড়ছে৷ রাগ হচ্ছে আপুর সাথে৷
আপু এসে বলল,
“অয়ন ভাই বাসায় আসবে এটা আমাকে আগে বলা যায়নি? তবেই তো সব পরিষ্কার হয়ে যেতো।”
আমি কিছুই বললাম না। আপু আবারো বলল,
“আরো আগেই ইত্তাজা আব্বুকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলো আর কালকে রুম্মান ফাইনাল করেছে।”
রাগ কি°ড়°মি°ড়ি°য়ে বললাম,
“রুম্মান ভাইয়া কি জানে না একটা মেয়ের অনুমতি ছাড়া বিয়ে হওয়া উচিত না।”
“অয়নের সাথে তোর সম্পর্ক নিয়ে রুম্মান কিছুই জানে না।”
রাগটা আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো।
“তুমি তো জানতে আপু? তুমি কেন বলোনি?”
আম্মু এসে বলল,
“কি বলবে ও? একটা ছেলের সাথে রাত কা°টিয়েছিস তুই? একটা ছেলের বাসায় গিয়েছিলি? তানিমার নতুন বিয়ে, সংসারে মান থাকবে? (একটু থেমে) আর যে ছেলে তোকে নিয়ে বাসায় যেতে পারে সে অন্য মেয়ে নিয়েও যেতে পারবে।”
আম্মু যাওয়ার সময় আবার ফিরে এসে বলল,
“যেহেতু এতোকিছুর সময় আমাদের অনুমতির দরকার হয়নি তাই এবারে তোমার অনুমতি আমরা নিইনি। আমাদের ভালো চাও তো বিয়েটা করে নাও।”
বাবা রুমের দরজার কাছে এসে আম্মুকে বলল,
“বাদ দাও এসব৷ ও বড় হয়েছে, নিজের বুঝ বুঝতে শিখেছে। ও যদি চলে যেতে চায় তো যেতে পারে। এভাবে পায়ে বে°ড়ি পড়িয়ে কতদিন আটকাবে?”
আম্মু চলে গেল। আম্মু এমনভাবে বিয়ে করতে বলে গেল যেন এটা একদুই দিনের বিষয়। আপুর দিকে তাকালে বলল,
“কথাগুলো আমি তোকে আগেও বোঝাতে চেয়েছিলাম।”
“তুমিও অয়নকে খারাপ ভাবো, তাই না?”
“বাস্তবিক হয়ে চিন্তা কর।”
রুমে চলে আসলাম। চিন্তায় চিন্তায় সারারাত কা°টলো। আমার কারণে বাবা কষ্ট পাচ্ছে, কতটা কষ্ট থেকে আমাকে এই কথাগুলো বলেছে। অয়নকেও তো কষ্ট দিয়েছি। ধা°ক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছি। এসব না হলে কি খুব ক্ষতি হতো?
রাতে কখন ঘুমিয়েছি জানি না। সকালে আপু এসে আমাকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বলল,
“আজকে ইত্তাজার বাসা থেকে এসে আংটি পড়িয়ে যাবে।”
“আজকে? (একটু থেমে) এতো তা°ড়া কেন তাদের?”
আম্মু এসে রুমে ঢুকলো,
“রুম্মান চায়, তাই তা°ড়া।”
আমি চেঁ°চিয়ে উঠে বললাম,
“রুম্মান, রুম্মান আর রুম্মান। বাসায় কি এই একজনের কথারই মূল্য আছে?”
আম্মু স্বাভাবিকভাবে বলল,
“হ্যাঁ আছে। (আপুকে বলল) রুম গুছিয়ে রাখিস। এখন নাস্তা বানাও তো, যাও।”
আপু মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেল।আপু চলে যেতেই আম্মু এসে আমাকে বসিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“রুম্মান, তানিমার হাসবেন্ড। এ বাসায় ওর অপমান হলে ওই বাসায় তানিমার উপর কোন ঝ°ড় বয়ে যাবে আল্লাহ জানে। তানিমাকে দেখতে আসার কয়েকদিন পরেই ইত্তাজা তোমার আব্বুর সাথে কথা বলেছে। শুধু ইত্তাজা না রুম্মানও বলেছে। না বলার উপায় সবসময় থাকে না। বোঝার চেষ্টা করো, তোমার জন্য তানিমা কষ্ট পাবে সারাজীবন।”
অবাক চোখে তাকিয়ে আছি আমি। আপুর কষ্ট চোখে পড়ছে অথচ আমার কথা দিব্যি ভুলে গেল। এই আমি নাকি তাদের আদরের মেয়ে?
“আজ ইত্তাজার বাবা-মা আসবে, তৈরি থেকো। আর ইত্তাজার সামনে অয়ন বা তার ফ্যামিলি নিয়ে কোনো কথাই উঠাবে না। অয়ন সবটা জানে আর মেনেও নিয়েছে।”
অয়ন যে কোন পরিস্থিতিতে মেনে নিয়েছে তা আমি জানি। ইত্তাজার বাবা আর আংকেলের সম্পর্ক নিয়ে বাসার কেউ না জানলেও আমি জানি।
“তুমি মেনে নাও সবটা।”
আম্মু বেরিয়ে গেল। আমি এখনো স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছি। ছোটবেলা থেকে আদরে আগলে বড় করা এই মানুষগুলো আজ আপুর ভালোর জন্য আমাকে স্যাক্রিফাইস করতে বলছে।
কিছুক্ষণ পর আপু রুমে এসে বলল,
“খেতে আয়।”
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“সকলকে ভালো রাখার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপর, খাবার কি আর হজম হবে?”
তবুও খেতে যেতে হলো। কারো সাথে কোনো কথাই বলিনি সারাদিন। অয়নকেও কল দেইনি। “আমি বারবার বেহায়ার মতো কাছে আসবো” বলা অয়নও আর কল দেয়নি।
আজকেও সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাবা তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এলো। আজকে আবারো শরবত এনে বাবার হাতে দিয়ে সামনে বসে পড়লাম।
বাবা তাকাতেই বললাম,
“ইত্তাজাকে বিয়ে করে নিলে খুশি হবে খুব বাবা?”
বাবা কিছুই বললেন না। আমি আবারো বললাম,
“আপনাদের কারো কথার কোনো দ্বিমত করবো না আমি। আপনারা আমার ভালোই চাইবেন।”
বাবা চেয়ে রইলেন আমার দিকে, আমি আর কথা না বাড়িয়ে রুমে চলে আসলাম। দরজা লাগিয়ে গিয়ে বিছানায় রাখা শাড়িটার দিকে তাকিয়ে আছি।
আমি জানি বাবা কখনোই সিনেমার মতো বলবে না “বিয়ে করে নাও নাহলে আমার ম°রা মু°খ দেখবে।” তবে আমার ভুল সিদ্ধান্ত সত্যিই বাবার মৃ°ত্যু°র কারণ হবে।
সী ব্লু রঙের শাড়িটা আজ পড়তে হবে। কিন্তু আজ আর অয়ন আমাকে লজ্জা দিবে না, অপলক তাকিয়ে থাকবে না আমার দিকে।
রাত আটটায় ইত্তাজা ও তার পরিবার আসলো, সাথে রুম্মান ভাইয়া এসেছে। শাড়ি পড়েছি, সেজেছি আমি। ইত্তাজার মা শারমিন আন্টি আম্মুর সাথে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছেন।
আমাকে বিশেষিত করে দেখার মতো কিছু নেই। কথা হলো, আংটি পড়ানো হলো। বিয়ের তারিখ ঠিক করার কথায় আমি জানালাম,
“আমি সেকেন্ড টাইম ভার্সিটিতে ভর্তি পরীক্ষা দিবো। ভর্তি পরীক্ষার আগে বিয়ে হোক আমি চাই না।”
বাবা মত দিলেন আমার কথায়। ইত্তাজাও রাজি হলো, ইত্তাজার বাবা একটু না°খো°শ হলো বলেই মনে হলো।
মেহমানরা চলে যেতেই মানহাকে কল দিলাম। দুইবার, তিনবার, চারবারে সে রিসিভ করলো।
“মানহা, আজকে বাসায় আসলি না যে।”
ও কিছুই বলছে না। আমি শান্তভাবে বললাম,
“মানহু?”
হুট করে কেঁদে উঠলো মানহা। আমি চমকে গেলাম। এখন তো আমার কান্না করার কথা, অথচ মানহা কাঁদছে৷
ব্যস্ত হয়ে উঠলাম আমি,
“মানহু কি হয়েছে? বল না।”
মানহা নাক ঝে°ড়ে বলল,
“জীবন থমকে গেছে আমার। এই মানহা সারাজীবনে কাউকে ভালোবাসিনি, ভালোবাসা কি? তাই তো বুঝিনি আমি। অথচ আজ যখন সে চলে গেল তখন বুঝলাম ভালোবাসতাম আমি ওকে।”
“কে সে?”
মানহা উত্তর দিলো না। কল কে°টে গেল। কয়েকবার কল দিলেও রিসিভ করলো না। আমার জীবনের ঝ°ড়ের কথাটাও বলা হলো না।
সময় পেরিয়ে গেল একদিন দুদিন করে পুরো একমাস। নতুন বছর চলে আসলো, কিন্তু আমার জীবনে নতুন গল্প আসলো না।
মানহাও যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছে, কিন্তু ও আমাকে একেবারে ছাড়েনি। প্রতিদিন নিয়ম করে কল দেয়া হয়। ওর মনের সেই ব্যক্তিকে আজও লুকিয়ে রেখেছে, তাই আমিও আর জোর করিনি।
আর রইলো অয়ন, সেদিনের পর না দেখা আর না কথা। তাকে ধা°ক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিলাম, সে কি আদৌ আর কথা বলবে আমার সাথে? কল দিয়েছিল কিনা জানি না। কারণ আমার ফোন বদলানোর নাম করে সিমও পালটে দিয়েছে আপু। আমি তো নিজের প্রতি ঘৃ°ণা আর লজ্জা থেকে কলই দেইনি।
সকালে নাস্তা না করেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেলাম। কলেজের ক্লাসও আজ তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল।
শাহবাগের দিকে এসেছি, শুধুই নিজেকে ব্যস্ত রাখার বৃ°থা চেষ্টা করছি আমি।
হঠাৎ রাস্তার অপরপাশে অয়নকে দেখলাম। সে আমাকে দেখেনি। কাঁধে ব্যাগ, ভার্সিটিতে এসেছিল বোধহয়।
আমি দাঁড়িয়ে পড়লাম। এতো গাড়ি আর এতো মানুষের মাঝে আমাকে আলাদা করে নোটিশ করবে বলে মনে হয় না।
রাস্তা পার হয়ে অয়নের কাছে যাবো আমি। কথা বলবো ওর সাথে। কতদিন পর ওকে দেখছি। পাগলের মতো দৌড়ে রাস্তার প্রায় মাঝে চলে গেছি অপরপাশ থেকে গাড়ি আসছিলো।
অয়ন হাত ধরে একটা°নে সরিয়ে নিলো। দুজনের নিশ্বাসটুকু কয়েক সেকেন্ডের জন্য মিলে গেল। পরক্ষণেই অয়ন সরে গেল।
জোরপূর্বক হেসে বলল,
“তনুশ্রী, এখানে তুই?”
কথায় কোনো পার্থক্য নেই। আগের মতোই তনুশ্রী বলেই ডাকলো, ঠিক প্রথমদিনের মতোই আছে সে। অভিমান নেই, রাগ নেই, বি°র°ক্তি নেই।
“আমি ভার্সিটিতে এসেছিলাম, ল্যাব ছিল।”
আমি হাঁটতে শুরু করলাম। অয়ন আমার পাশাপাশি এসে হাঁটছে। আমি বললাম,
“একটুও বদলে যাওনি?”
অয়ন হাসলো।
“এমনভাবে বললি যেন তুই খুব বদলে গেছিস? এখনো তো রাস্তা পেরোতে পারিস না।”
“আমাকে মনে পড়ে?”
“ভুলিনি তো।”
অয়নের দিকে তাকালাম। আমার হাত ধরে একটু দ্রুত হাঁটতে শুরু করলো।
“আজ অফিস নেই?”
“হাফ ডে ছুটি নিয়েছি।”
“কিসের ল্যাব করেছো?”
“মাস্টার্সের।”
“ওহ।”
কিছুক্ষণ পর অয়নের হাঁটার গতি ধীর হলো।
“ইত্তাজা, বড়চাচার ছেলে বলেই আম্মু আর এসবে জড়াতে চাচ্ছে না। আব্বুকেও জড়াতে দিচ্ছে না। বড়চাচার খারাপ আচরণ সহ্য করতে না পেরেই আব্বু স্ট্রোক করেছিল। আর ঝামেলা হোক, আম্মু চায় না। (একটু থেমে) ইত্তাজা তোর-আমার সম্পর্কে কিছুই জানে না। জানাতেও চাই না আর।”
আমি মাথানিচু করে শুনছি আর হাঁটছি। সে আবারো বলল,
“ইত্তাজারও দোষ নেই। কখন, কার জীবনে কাকে ভালো লাগবে বা কার জন্য অনুভূতি জন্ম নিবে তা তো আমরা নিজেরাও জানি না।”
অভিমানী সুরে বললাম,
“সত্যিটা কি চাপা থাকবে অয়ন? তুমিই বলো। যেদিন সত্যটা ইত্তাজা জানবে, সেদিন কি বলবে?”
অয়ন কিছুই বলল না। আমি আবারো বললাম,
“অয়ন, রিসোর্টে সে রাতে কি হয়েছিল তা আমি জানি, তুমি জানো। আমাদের মাঝে দূরত্ব ছিল, এ দুনিয়াকে তুমি এটা বিশ্বাস করাতে পারবে না।”
“তনুশ্রী, বলিস না ওসব।”
একটু থেমে বলল,
“আর তোর আব্বু আম্মু তোর ভালোই চায়। উনারা তোর জন্য বেস্টটাই দেখবে।”
“সব দোষ তবে আমার?”
“না, আমিও দোষী।”
“আমিই তো কুমিল্লা যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম, থাকার বায়না করেছিলাম। সব দোষ তো আমার।”
অয়ন একটা রিকশা ডাকলো। দুজনে উঠে বসলাম। খিলঁগাও পর্যন্ত যাবো একসাথে।
আমাকে একহাতে জড়িয়ে ধরে বলল,
“কারো কোনো দোষ নেই। ভুল আমরা করেছি, এরজন্য সবাইকে দায়ী করতে পারবো না।”
“ভুল করেছি?”
“হুম, হুট করে মনে যে অনুভূতি এসেছিল তাকে প্রশ্রয় দিয়ে ভুল করেছি। ভালোবেসেই ভুল করেছি।”
এই প্রথম অয়নের মুখে এমন কথা শুনলাম, ভালোবেসে ভুল করেছি। সত্যি বলেছে আসলেও ভুল করেছি।
“ভুল শুধরানোর উপায় একটাই তনুশ্রী।”
“কি?”
আমাকে ছেড়ে দিয়ে অয়ন বলল,
“ইত্তাজাকে বিয়ে করে নে। সবাই ভালো থাকুক। স্বা°র্থ°প°র হয়ে সুখী হবো না। তোর সিদ্ধান্তটা আমি জেনেছি। ইত্তাজা আর তোর যে এনগেজমেন্ট হয়েছে তাও শুনেছি। ভালো থাকবে সবাই।”
আমি নিচুস্বরে বললাম,
“আর তুমি?”
“আমি নাহয় মন্তু মিয়া হয়ে কোনো আম্বিয়া খুঁজে নিবো।”
“তবে আমিও টুনি হয়ে মকবুলের মৃ°ত্যু কামনা করবো।”
অয়ন হেসে দিলো।
“পাগলী আমার।”
“আমার” কথাটা বুকে তী°রে°র মতো বিঁ°ধ°লো। আমি যে আর তার থাকবো না। আ°হ°ত হ°রি°ণী°র মতো ছ°টফ°ট করছে আমার মন।
“কাদম্বরী হবি তুই আমার। আমার প্রতিটা নিশ্বাসে থাকবি তুই। আমার জীবনে থাকবি না, কিন্তু মন থেকে মুছে যাবি না।”
অশ্রুধারা লুকাতে পারলাম না৷ অয়ন আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,
“আর কত কাঁদবি?”
“যতদিন মৃ°ত্যু না আসে।”
চেয়ে রইলাম তার মুখের দিকে। একটু কি রাগ করতে পারতো না আমার সাথে? একটু ধ°ম°ক দিয়ে বলতো তো পারতো “সেদিন আমাকে কেন বের করে দিয়েছিলি?”
“সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দিবি কেন?”
“পাবলিকে পড়বো।”
“আমার তো অন্যকিছু মনে হচ্ছে। এমন ইচ্ছা তো তোর ছিল না।”
অয়নের দিকে তাকিয়ে বললাম,
“শুনেছি অনেক পড়তে থাকলে আর রাত জাগলে মানুষ পাগল হয়ে যায় বা মনে যায়। আমিও তাই চাই।”
অয়ন আবারো হাসলো। তার হাসিগুলো দেখে আমার কষ্টের পরিমাণ বাড়তে থাকলো। এই হাসিতে সে নিজের অবস্থাটা লুকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। হয়তো সকলের সামনেই এভাবে হাসিখুশি থাকে সে।
“এসব কে বলে তোকে? (একটু থেমে) পাবলিকে চান্স পেয়ে মিষ্টি খাওয়াতে ভুলিস না।”
“বিয়েতে আসবে?”
অয়নের হাসিটা মুছে গেল। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো সে। ওর মুখটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বললাম,
“একটু রাগ হলো না আমার প্রতি? অপেক্ষা করবো বলেও অপেক্ষা করিনি, তোমাকে বের করে দিয়েছিলাম। অভিমান হয়নি?”
“অনুভূতিহীন হয়ে গেছি আমি তনুশ্রী।”
দুজনে দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। অয়ন দৃষ্টি সরিয়ে বলল,
“তোকে অনেকবার কল করেছিলাম। নাম্বার বন্ধ ছিল, হোয়াটসঅ্যাপ বন্ধ।”
“হুম, নাম্বার পাল্টানো হয়েছে।”
“আমাকে কেন কল দিসনি?”
“লজ্জায় দেইনি অয়ন। তোমাকে বের করার পর থেকে শুধু ভাবছিলাম কেন করলাম এটা? ঘৃ°ণা লাগছিলো নিজেদের জন্য।”
অয়নের হাত ধরে বললাম,
“সেদিন তোমার সাথে চলে আসলেই ভালো হতো। স্বা°র্থ°প°র না হলে সকলে আমাদের স°স্তা হিসেবে ধরে নেয়। সকলের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেদের কথাই ভুলে যাওয়া লাগে।”
সেও আমার হাতটা ধরে রাখলো। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“আমাকে তোর বাসার সবাই খারাপ মনে করে। সবাই ধরে নিয়েছে আমার চরিত্রে সমস্যা, একাধিক মেয়ের সাথে সম্পর্ক আছে। সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে তানিমা।”
দুজনেই চুপ করে রইলাম। হয়তো আজই শেষ দেখা আর শেষ কথা। ওর কন্ঠটা আর শুনবো না।
অয়নের হাতের মুঠোয় থাকা হাতখানা শক্ত করে ধরে বলল,
“ঘৃ°ণা করিস না নিজেকে, আজও ভালোবাসি তোকে।”
“এ ভালোবাসা আমার জন্যই রেখে দাও না, অয়ন?”
হয়তো এ অনুরোধ সে রাখতে পারবে না৷ হাতটা ছেড়ে দিলো। বুক চি°রে বেরিয়ে আসা ওর এই দীর্ঘশ্বাসটুকু আমাকে জীবন্ত লা°শ করে দিলো।
চলবে……..