#শূন্যেরে_করিব_পূর্ণ (পর্ব ১)
নুসরাত জাহান লিজা
মিরানকে নিয়ে পুরো পরিবার ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে। একদিন হলুদ রঙের পাঞ্জাবি পরে বাসায় এসে সগর্বে ঘোষণা দিল সে হিমু হতে চায়। হলুদ পাঞ্জাবি পরে পরেরদিন বাইরে যাচ্ছিল। ওর বড় ভাইয়ের ছেলে নয় বছরের সৌম্য জিজ্ঞেস করল,
“ছোটকা, তুমি সত্যিই হিমু হয়ে যাবে? হিমুরা কিন্তু খালি পায়ে হাঁটে।”
“মিথ্যামিথ্যি হিমু হতে চাইব কেন। আমিও খালি পায়ে যাব।” বলেই স্যান্ডেল খুলে সত্যি সত্যি খালি পায়ে বেরিয়ে গেল।
সেদিন বাড়ি ফিরল রক্তাক্ত পা নিয়ে। রাস্তায় নাকি কাচের টুকরো পড়েছিল। না দেখেই তাতে পা গলিয়ে এই অবস্থা। এরপর আর খালি পায়ে বাইরে যাবার সাহস করেনি।
ওর পাঞ্জাবিতে পকেট আছে। কারণ হিমুর মতো ওর ক্যারিশমাটিক পাওয়ার নেই। টাকা পয়সা লাগে। বাড়ি থেকে অফিস যেতে গাড়ি ভাড়া লাগে। টিফিনের টাকা লাগে। চাকরিতে ওর মন নেই। কিন্তু বাবা কঠিন গলায় বলেছেন,
“চাকরি ছাড়লে এই বাড়িতে জায়গা হবে না।”
মিরানের তেমন কোনো পয়সাওয়ালা বন্ধুবান্ধব নেই, যাদের কাছ থেকে বিপদে টাকাপয়সার সাহায্য পাওয়া যাবে। বিবাগী হয়ে যে হিমালয়ে যাবে, তাতেও টাকা ছাড়া গতি নেই। রাস্তায় থাকা ওর পক্ষে সম্ভব নয়৷ ঠান্ডার সমস্যা প্রবল। রোদ-বৃষ্টি কোনোটাই ওর ধাতে সয় না। সর্দিকাশি, জ্বর বাঁধিয়ে একাকার করে ফেলে। তাই এতবড় রিস্ক নেবার কোনো মানে হয় না। ওদিকে অফিসে হলুদ পাঞ্জাবি পরে যাওয়া যায় না। তাই এটাও ছাড়তে হয়েছে। সকাল সকাল অফিসে না গেলে চলে না, তাই রাত জেগে ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় হেঁটে হেঁটে জোছনা বিলাস করাও হয় না।
কয়েকদিনের মাথায় একটা জিনিস মিরান বুঝল, হিমু হওয়া সহজ কথা নয়। মাথা থেকে ভূত নামল।
তবে সব বাদ দিলেও একটা জায়গা থেকে ওকে টলানো গেল না। সেটা হলো বিয়ে। সে হিমু হতে চায়, অন্তত একটা আদর্শ হলেও সে মানবে। সে চিরকুমার থাকবে। কোনোদিন বিয়ে করবে না। মিরানের বাবা মাহমুদ সাহেবের হুমকিতেও এবার কোনো কাজ হলো না। ছেলে অটল রইল নিজের সিদ্ধান্তে।
ওরা যৌথ পরিবার। মাহমুদ আর মহিউদ্দিন সাহেব দুই ভাই একসাথে থাকেন। মহিউদ্দিন সাহেবের তিন ছেলে মেয়ে। ছোট ছেলে বাদে বাকি দুজনের বিয়ে হয়ে গেছে। নাতি-নাতনিও হয়ে গেছে। তার বড় ছেলে শোভনের ছেলে সৌম্য আর চার বছরের মেয়ে সূচি। মেয়ে শোভার একটা পাঁচ বছরের মেয়ে আছে।
মাহমুদ সাহেবের বড় মেয়ে মিতারও বিয়ে হয়ে গেছে বছর দেড়েক হয়। ছেলেকে নিয়েই তিনি মস্ত বিপাকে পড়েছেন। তার মতো বাস্তববাদী মানুষের ছেলে এমন হবে এটা তিনি ভাবতে পারছেন না। বড় ভাবির কাছে তিনি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারছেন না।
মহিউদ্দিনের স্ত্রী রাবেয়ার ভাইয়ের মেয়ের সাথে বিয়ের প্রস্তাব তিনি নিজের মুখে দিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটা যে এভাবে বেঁকে বসবে তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। ওই পরিবারে জানাবার আগে হলেও ম্যানেজ করা সম্ভব হতো। এখন লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছে।
এই জন্যই বোধহয় লোকে বলে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিয়ের সম্বন্ধ করতে হয় না।
তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে ছেলেকে ডাকলেন, আজ একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। মিরান এসে তার সামনে দৃষ্টি মেঝেতে নিবন্ধ রেখে দাঁড়িয়ে আছে।
“বিয়ে নিয়ে তোমার চূড়ান্ত মতামত কী?”
“জ্বি, আমি বিয়ে করব না।”
“যদি তোমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিই?”
“তবুও না।”
“খাবে কি?”
এবার মাথাটা তুলে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “সেজন্য আপনাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে বাবা।”
“কেন?”
“আপনি জোর না করলে চাকরি ছেড়ে দিতাম। এখন তো দেইনি। থাকা, খাওয়া, পরার সমস্যা হবে না।”
“তোমার মা তোমার জন্য রাত-দিন চোখের জল ফেলছে, এটার কোনো মূল্য তোমার কাছে নেই?”
“কী হলো? কথা বলছ না কেন?” খানিকটা ধমকের সুরে বললেন মাহমুদ সাহেব।
“আছে৷ কিন্তু আমার কিছু করার নেই।”
“তোমাকে দুইদিন সময় দিলাম। এরমধ্যে হয় আমার কাছে এসে সম্মতি জানাবে, নয়তো পাততাড়ি গুটিয়ে বিদায় হবে। আমার কথা বুঝতে পেরেছ?”
“জ্বি।”
“যাও।”
ছেলের যাওয়ার পানে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মাহমুদ সাহেব। এই ছেলেকে তিনি অত্যন্ত স্নেহ করেন৷ তাই বুকে একটা দীর্ঘশ্বাস জমা হলো।
***
শ্রাবণীর মাথায় দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। ওর মাথায় এখন চালের সাথে সঠিক পরিমাণে পানি দিলে ফুটে পারফেক্ট ভাত হয়ে যাবে। গাধা মিরানকে ওর কোনোকালেই পছন্দ ছিল না। সুন্দর গাধা ধরনের মানুষ দেখলেই ওর মেজাজ গরম হয়। ছেলেদের সৌন্দর্য ওর কাছে তাদের বুদ্ধিমত্তা। এই ছেলের সেটা আছে নাকি সন্দেহ। এত ভাব কীসের! বিয়ে করবে না বলে নাকি ঘোষণা দিয়েছে। আরে গাধা, তোকে বিয়ে করার জন্য কি মেয়েরা লাইন দিয়ে বসে আছে নাকি যে তুই এমন ঘোষণা দিবি!
নেহায়েত রাবেয়াকে শ্রাবণী ভীষণ ভালোবাসে৷ তার সান্নিধ্যে থাকতে পারবে বলে ওই ব্যাটাকে বিয়ে করার জন্য মত দিয়েছিল। যেখানে কত ব্রাইট, জুয়েল ধরনের ছেলেরা ওকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছে। তাদেরকে পর্যন্ত পাত্তা দেয়নি। সেখানে এই গবেটটার চৌদ্দ গোষ্ঠীর ভাগ্য ভালো ছিল যে তাদের ছেলের একটা গতি হতে যাচ্ছিল। অবশ্য ওই পরিবারে এই চিড়িয়াটা বাদে সবাই চমৎকার মানুষ। তাই এভাবে ভাবার জন্য কিঞ্চিৎ লজ্জাও পেল। তবুও রাগটা কিছুতেই কমছে না।
মোবাইল বাজছিল, হাতে নিয়ে দেখল রাবেয়া কল করেছে।
“ফুপু, বলো।”
“মা রে, শোন, তুই আমার উপরে রাগ করিস না।”
“ফুপু, তোমার উপরে আমি কেন রাগ করতে যাব। শোনো, আমাকে রিজেক্ট করার ফল ওই গাধাটাকে আমি হারে হারে বোঝাব।”
“কী করবি তুই?” আঁতকে উঠে জিজ্ঞেস করলেন রাবেয়া।
“ওকে বিয়ে করে ওর চিরকুমার হবার সাধ ঘুচিয়ে দেব। আমি ওর গলায় মাছ হয়ে ঢুকব, কাঁটা হয়ে গলায় ক্যাঁক করে বিঁধব। ওই ব্যাটা না পারবে গিলে হজম করতে, না পারবে বের করতে। ওই কাঁটার যন্ত্রণায় সারাজীবন ছটফট করে মরবে।”
“শোন না, এমন পাগলামি করিস না। তোর ভাগ্যে অনেক সুখ লেখা আছে দেখিস।”
“আমি একবার যা সিদ্ধান্ত নেই সেটাই করি। তুমি জানো ফুপু। তাই প্লিজ, এমন অনুরোধ করো না। আমি কালই তোমাদের বাড়িতে আসছি।”
রাবেয়া জানেন তার ভাইঝির অসম্ভব জেদ। এক কথার মানুষ। একবার মুখ দিয়ে কিছু বললে পৃথিবীর কারোর সাধ্য নেই তা নড়চড় করার। ওর মা যখন মারা গেছেন তখন শ্রাবণীর মাত্র তেরো বছর বয়স। এরপর থেকে অতিরিক্ত আদরে এতটা জেদি হয়ে উঠেছে। তিনি নিজে ওই সময় মেয়েটাকে অনেকদিন নিজের কাছে নিয়ে রেখেছিলেন। ওই বাড়িতে গিয়েও মেয়েটার সাথে থেকেছেন৷ বলা যায় ওর বাবার পাশাপাশি তিনিও মেয়েটাকে হাতে ধরে বড় করেছেন। তিনি ভয় পেলেন।
ওদিকে মিরানকেও তিনি ভালোবাসেন। মিরানের বাবার প্রস্তাব তাই লুফে নিয়েছিলেন। কিন্তু ছেলেটার কী যে মতিভ্রম হলো! দুই পক্ষের মধ্যে পড়ে তিনি চিড়েচ্যাপ্টা হচ্ছেন।
মনে মনে রোকেয়া প্রার্থনা করলেন, “আল্লাহ তুমি মেয়েটার কপালে সুখ দিও।”
***
শ্রাবণীর বাবা আশরাফ সাহেব শুরুতেই মেয়ের প্রস্তাব নাকচ করে দিলেন। এই মেয়েটাই তার সমস্ত কিছু।
“এরকম একটা ইরেসপন্সিবল মানুষকে কোনোভাবেই আমি তোর লাইফে এলাউ করব না।”
“বাবা, প্লিজ। একটু বুঝতে চেষ্টা করো। তোমার মেয়েকে কেউ প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা আমার জন্য কতটা অপমানজনক। ওর জন্য এটা গর্বের বিষয় হবে পরে! সব ওর ভং। আমি জানি। কয়দিন পরে সব আত্মীয় বন্ধুদের সাথে গল্প করে বলবে, ওকে আমি রিজেক্ট করেছিলাম। তখন তুমি সেটা নিতে পারবে? বিয়ে করে ফেললে এটা বলার জায়গা থাকবে না।”
“তোর এই ডিসিশন আমার কাছে ভীষণ বোকা বোকা লাগছে।”
“আমাকে তুমি ভরসা করো না বাবা?”
“অবশ্যই করি। কিন্তু..”
“তাহলে এসব কিন্তু টিন্তু ঝেড়ে ফেল বাবা। আমি ভালো থাকব। তুমি একদম চিন্তা করো না। আমি জানি আমি কী করতে যাচ্ছি। তাছাড়া ওইখানে ফুপু আছে তো।”
নিমরাজি হয়ে আশরাফ সাহেব শ্রাবণীকে রোকেয়ার বাড়িতে দিয়ে আসলেন৷ ওই বাড়ির সবাই প্রতিশ্রুতি দিল তারা শ্রাবণীর কোনো অসম্মান হতে দেবে না। তিনি মনে একরাশ আশঙ্কার মেঘ নিয়ে ফিরে এলেন। মেয়ে বড় হয়েছে। এখন তার একলা থাকার দিন।
***
দু’দিন থেকে কেউ মিরানকে বিয়ের কথা বলে না বলে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। ভেবেই নিয়েছিল খড়গ নেমে গেছে মাথা থেকে। ছাদে উঠতেই প্রাণ জুড়ানো ঠান্ডা বাতাসটা ওর উৎকণ্ঠা উড়িয়ে নিয়ে গেল সুদূরে। আজীবন স্বাধীনতার স্বাদ নেবার পথে এগিয়ে যাবার প্রথম বাতাসটুকু শ্বাস টেনে নিতে না নিতেই ওকে থমকে যেতে হলো।
“হবু হিমু সাহেব, দিনকাল কেমন যাচ্ছে আজকাল?”
……….
(ক্রমশ)