#এসো_রূপকথায় (১)
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি
“মা,আপা তো পালিয়ে গেছে!” কনের ছোট বোনের মুখ থেকে খবরটি শুনতে পেয়ে উঠানে থাকা বরযাত্রী শোরগোল তুলে দিল। বিয়ে বাড়ি মুহূর্তেই পরিনত হলো রম্য বাড়িতে! আশেপাশের মানুষ গুলো ছি,ছি শুরু করে দিয়েছে। রিয়ার শরীর কাঁপছে। কিছু সময় পূর্বেও আপাকে সে ঘরে দেখেছে। এর ই মধ্যে কোথায় চলে গেল! দুঃখে তার কান্না পাচ্ছে। মা বলেছিল আপার সাথে থাকতে। কিন্তু সে তো থাকে নি। ইতোমধ্যে বরের বাড়ির লোকজন হুংকার তুলে দিয়েছেন। রিয়া ভয় পাচ্ছে। পরিবেশ কেমন ভয়াবহ হয়ে ওঠেছে। ও ছুট লাগাল। সোজা বাড়ির মেইন ফটক বরাবর। বিশাল মাঠ,শস্যের ক্ষেত পেরিয়ে ছুটতে লাগল। এদিকে তার দুটি চোখ নোনা জলের ফোয়ারা নামিয়েছে। ও চিৎকার করে ডাকল,’আপা। আপা রে, কোথায় তুই।’ কোনো সাড়া এল না। রিয়া পাগলের মতো চারপাশে ছুটোছুটি করল। এই বিয়েটা না হলে মা-বাবা মুখ দেখাতে পারবে না। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে ওর। ও আবার কাঁদতে লাগল। এক পর্যায়ে মাটিতে বসে পড়ল। পা ছড়িয়ে কাঁদছে ও।
“এখন আফসোস হচ্ছে তাই না?”
কণ্ঠটি কানে আসতেই কান্না থামাল রিয়া। চোখ না মুছেই তাকাল আগন্তুকের পানে। নীল রঙা ব্লেজার,বলিষ্ঠ দেহ, ফর্সা ত্বকের পুরুষটির চোয়াল শক্ত। পুরুষটি বরের ভাই।চোখ দুটো রক্তিম। রিয়ার ভয় হলো। কণ্ঠটা ক্ষীণ শোনাল।
“আপনারা খুব খারাপ,খুব খারাপ আপনারা।”
কথাটি বলেই ওঠে পড়ল ও। রিসান দেখল কন্যাটি পুনরায় ছুটে চলেছে। এদিক সেদিক বিভ্রান্তের মতন করে। তবে,পালিয়ে যাওয়া কনে কে এত সহজে পাওয়া যায়?
বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। রিয়ার মা ফাহমিদা চিন্তিত, উৎকণ্ঠিত। তার স্বামী সেই কখন বেরিয়েছেন। অথচ এখনো ফিরেন নি। নিশ্চয়ই মেয়েকে খুঁজে পান নি। এদিকে আত্মীয় স্বজন’রা বলে বলে মুখের ফেনা তুলে ফেলেছে। মনে হচ্ছে কান পঁচে যাচ্ছে। তবু প্রতিবাদ করছেন না তিনি। কোন মুখেই বা প্রতিবাদ করবেন?
ধীর পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করল রিয়া। তাকে দেখতে প্রাণহীন মনে হচ্ছে। রিসান ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল ওকে। চোখে মুখে বিরক্তি। তখন প্রায় এশার আজান হয়ে গেল। অথচ কনের কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। রিয়া কাঁপছে। ওর হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল রিসান। বাড়ির পেছনের দিকটায়। চেপে ধরল দুটো হাত। ব্যথায় কন্যাটির মুখ লাল হয়ে এল।
“সমস্যা কী তোমার? কেন এমন করলে? আমি না হয় খারাপ। কিন্তু আমার পরিবারের কী দোষ? কেন এমন করলে?”
রিসানের কথায় কিছুই বুঝল না রিয়া। তাকিয়ে রইল ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে।
“আনসার মি, স্টুপিট কোথাকার।”
রিসান যেন রাগে ফুঁসছে। ওর মাথা কাজ করছে না। বিষয়টা সম্মানের।
“আই সয়ার,তোমার বোনকে না পেলে তোমাকে বিয়ের আসরে বসিয়ে দিব।”
এ কথা বলেই কিছুটা জোরেই ধাক্কা দিল রিসান। মেয়েটির পিঠ ঠেকল প্রাচীরে। হাত লাগল প্রকাণ্ড গাছটার সাথে। মুহূর্তেই ভে ঙে গেল কাচের চুড়ি। যার টুংটাং আওয়াজ কানে এল রিসানের। সে তাকাল না অবধি। অথচ তাকালে দেখতে পেত কোমল ফর্সা হাতটি লাল রঙে সেজে ওঠেছে।
রাত তখন দশটা। কনে কে পাওয়া গিয়েছে। রিয়া বিহ্বল। বোনের পানে তাকিয়ে। খানিক বাদে দরজা লাগিয়ে দিল। একদম কাছটায় এসে বসল।
“আপা, এই আপা।”
মেহনূর দৃষ্টি ফেরাল না। রিয়া যেন ভেতরে ভেতরে ধ্বং স হয়ে যাচ্ছে। সব থেকে বিস্ময়ের ছিল, মেহনূর কে পাওয়া গেছে গ্রামের শেষ দিকে। সে ফিরছিল বাড়ির দিকে। যদি ফিরতেই হোতো,তবে পালাল কেন? এই প্রশ্নটিই রিয়াকে বিস্মিত করে যাচ্ছে। বুকের ভেতর আনচান করছে। দরজায় আ ঘা ত পড়ল। বিয়ে শুরু হবে। রিয়াকে কিছু বলতে হলো না। মেহনূর নিজ থেকেই ওঠে গেল। দরজা খুলে চলে গেল। সবটা যেন এক আকাশ সম বিস্ময়ের সৃজন করল। বাড়ি ভরাট করে আছে মেহমান। তারা যায় নি। যেন বিশ্বাস ছিল আজ বিয়েটা হবে কিংবা তামাশা দেখার অপেক্ষা করছিল। তিন কবুল বলে আপার বিয়েটা হয়ে গেল। রিয়ার মনে হলো সে ঘুমের ঘোরে। কোনো স্বপ্ন দেখছে। রূপকথার মতন। যেন চারপাশের অতি আশ্চর্য সব ঘটনা স্বাভাবিক বৈ আর কিছুই না।
কনে বিদায়ের বেলায় কেউ কাঁদছে না। খুব সাদামাটা ভাবে কনে বিদায় হচ্ছে। রাত ও কম হয় নি তাই দ্রুতই হচ্ছে সব।মেহনূরের সাথে রিয়াকেও পাঠানো হবে। রিয়া বোনের কাছাকাছি আসতে চাচ্ছে। ওর অন্তরে একরাশ প্রশ্ন জেগেছে। অথচ উত্তর খোঁজার ফুসরত নেই। একটু সুযোগ হলো বটে,তবে শেষ রক্ষাটা হলো না। রিসান তাকে টেনে নিয়ে এল। আঁধার রাত। চারপাশ স্তব্ধ। পোকামাকড়ের ক্ষীণ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। রিসানের স্পর্শ ওকে ভীত করে তুলল। ব্যান্ডেজ করা হাতটায় ব্যথা লাগলেও কণ্ঠতে কোনো শব্দ নেই।
“কোনো পাকনামি করবে না। নতুবা মাঝ রাস্তায় ফেলে দিব।তখন কেঁদেও কূল পাবে না।”
এবার রিয়ার রাগ হলো। এই পুরুষটি একটু বেশিই করছে আজ। ও সজোরে ধাক্কাল। তবে লাভ হলো না। বলিষ্ঠ পুরুষ নড়ল না এক চুল ও! বরং লম্বা দেহটা কিছুটা বাকিয়ে চোখে চোখ রাখল। চাঁদের আলোয় দৃষ্টি মিলে গেল যেন। তবে এই দৃষ্টিতে প্রেম নেই। আছে কেবল তিরস্কার।
“তোমার ভাগ্য ভালো,মেহনূর কে পেয়েছি। নতুবা ভাইয়ার সাথে বিয়েটা তোমার হতো।”
সমস্ত শরীর জ্ব লে গেল রিয়ার। ওর কণ্ঠে এবার জোর এল।
“বললেই হলো? আমার বিয়ে কার সাথে হবে এটা আপনি ঠিক করবেন?”
রিসান জবাব দিল না। প্রসঙ্গ বদলে বলল,”লিসেন, আমার মাথা ব্যথা করছে। নো বকবক। বাসায় যাচ্ছ,অতিথি হয়ে। খারাপ হতে বাধ্য করবে না।”
কথাটা শেষ করেই এগোল রিসান। এল গাড়ির কাছে। মেহনূর গাড়িতে ওঠে বসেছে। বাকি গাড়ি গুলোও পূর্ণ। একটা সিট ও দেখা যাচ্ছে না। অসহ্য নয়নে রিয়ার পানে তাকাল সে। মেয়েটার কান্না পেল। পুরুষটির দৃষ্টিতে অবজ্ঞা। অথচ এতটা পথ এই লোকটার সাথে যেতে হবে!
চার ঘন্টার পথ। এত সময় পাশাপাশি থেকেও দুটো মানুষের মধ্যে কোনো বাক্য বিনিময় হলো না। বাসায় পৌছানোর পর দেখা গেল গাড়ির জানালায় মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে রিয়া। ক্লান্তি তার মুখশ্রী জুড়ে। রিসান ওকে ডাকল না। সোজা বোতলে থাকা পানি ঢেলে দিল। লাফিয়ে ওঠল কন্যাটি। ফলস্বরূপ মাথা ঠেকল গাড়ির সাথে। ব্যথায় আর্তনাদ করে ওঠল। অথচ রিসান নামের পা ষা ণ পুরুষের কোনো দয়া হলো না। বরং শক্ত করে বলল,”অকাজ করে ঘুমাচ্ছ,লজ্জা হয় না?”
বিপরীতে ভাষাহীন হয়ে পড়ল রিয়া। রিসান এগিয়ে যাচ্ছে। রিয়ার রাগ হলো। তেড়ে এল। তবে পুরুষটিকে আ ঘা ত করার পূর্বেই পা হড়কে গেল তার। এবার সত্যিই কেঁদে ফেলল ও। সমস্ত দিন জুড়েই ভোগান্তি যাচ্ছে। রিসান একবার ফিরে চাইল। তবে ওঠাল না। বরং তার ঠোঁটের কোণ জুড়ে তাচ্ছিল্য মাখা হাসি দেখা গেল। এদিকে ব্যথা নিয়ে পড়ে আছে অষ্টাদশী রিয়া!
কিছু নিয়ম ছিল। সেগুলোই পালন করা হচ্ছে। রিয়া সুযোগটা কাজে লাগিয়ে মেহনূরের কাছে এল।
“আপ… ‘
ডাকটি পূর্ণ করার পূর্বেই চুল টেনে ধরল রিসান। চারপাশে মানুষজন। আর্তনাদ করতে না পেরে রিয়া দমে গেল। রিসানের চোখে মুখে আক্রোশ।
“কেন বার বার এমন করছেন? আপার সাথে কথা বলতে দিচ্ছেন না কেন?”
“তুমি বাড়াবাড়ি করছো। এইটুকু কমনসেন্স নেই একটু পর ওদের বাসর রাত। আর এই সময়ে আজে বাজে ক্রোয়েশ্চন করতে যাচ্ছ!”
রিয়া বুঝতে পারল। তবে দমল না। তার ভেতরকার জিজ্ঞাসা গুলো তাকে রুখতে দিল না।
“আপা কেন ফিরে এল? এত কষ্ট করে যাওয়ার পর কেন ফিরে এল। আমায় জানতেই হবে।”
“এর মানে সত্যিই মেহনূরকে পালাতে সাহায্য করেছিলে?”
রিসানের কণ্ঠটা গুমোট। পা থেমে গেল রিয়ার। বুকের ভেতরটা আর্তনাদ করে ওঠল। রিসান ওর বরাবর এসে দাঁড়িয়েছে। এবার তাকাল কোমল হাতের পানে। ব্যান্ডেজ করা। তবে মায়া হলো না ওর। হাতটি চেপে ধরে বলল,”খুব খারাপ করলে। রাগটা আমার সাথে,অথচ ভোগান্তি দিলে আমার পুরো পরিবারকে। তোমার এই সুন্দর জীবনটা এবার তছনছ হবার পালা। বি রেডি ফর মাই টর্চার বেবি গার্ল।”
চলবে….