#এসো_রূপকথায় (৪)
“আবেগ ছেড়ে এসেছি, এখন আর আবেগ কাজ করে না।”
কথাটি বলেই ছুটে পালাল রিয়া। সেদিকে তাকিয়ে রিসানের ভেতরটা হু হু করে ওঠল। সময় বড়ো নি ষ্ঠু র।
এর মধ্যেই বার বি কিউ এর ঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে। রিসানকে দেখে সানা বলল,”কোথায় ছিলি? একটু হলেই তো সব নষ্ট হয়ে যেত। এভাবে ফেলে কেউ যায়?”
প্রশ্নটির উত্তর না দিয়ে বার বি কিউর সামনে বসল রিসান। সানা উত্তরের অপেক্ষায়। তবে রিসান সে জবাবটি দিল না। বরং অন্য কথার সুর টানল।
“তুই যা আমি দেখছি।”
সানা বুঝল ভাইকে বলে বিশেষ লাভ নেই। তাই সে ওঠে গেল। বসল সকলের আড্ডাতে।রিয়া সকল দুঃখ ভুলে পরিবেশটিকে উপভোগের চেষ্টা করছে। তার পরনে কিছুটা পাতলা কাপল। তাই শীত অনুভব হচ্ছে। দু বাহুতে হাত বুলাল ও। এদিকে রিসান বার বি কিউ তে ব্যস্ত। কোথাও তাকাচ্ছে না। মুখের ভঙ্গিমা শক্ত। সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ফেরাল রিয়া। আসর জমাতে বলল,”চলো সবাই মিলে গানের কলি খেলা যাক।”
প্রস্তাবটি পছন্দ হলো সকলের। গানের কলি খেলা শুরু হলো। সবাই হাসি ঠাট্টায় মজেছে। অনেকক্ষণ খেলার পর ‘য’ দিয়ে গান বলতে বলা হলো। সবাই একে একে মনে করতে শুরু করল। কিন্তু কেউ মনে করতে পারছে না। যে যেটাই বলছে দেখা যাচ্ছে আগে গাওয়া হয়ে গেছে। বার বি কিউ শেষ। সব নামিয়ে এনেছে রিসান। রিয়া আড়চোখে দেখতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল। তাই চোখ নামিয়ে ফেলল। রিসান বার বি কিউ রাখল। তারপর মৃদু সুরে গাইল।
“যদি বারে বারে একই সুরে
প্রেম তোমায় কাঁদায়,
তবে প্রেমিকা কোথায়
আর প্রেম ই বা কোথায়।
যদি দিশেহারা ইশারাতে
প্রেমই ডেকে যায়,
তবে ইশারা কোথায়
আর আশারা কোথায়।
যদি মিথ্যে মনে হয়
সব পুরনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে
জমে নীরবতা।
যদি মিথ্যে মনে হয়
সব পুরনো কথা,
যদি চায়ের কাপেতে
জমে নীরবতা।
তবে বুঝে নিও চাঁদের আলো
কত নিরুপায়….”
গানটি শেষ করেই অন্যদিকে চলে গেল রিসান। রিয়া চেয়ে রইল তবে বুঝল না ছেলেটা কেন চলে গেল। গানের মাঝে কোন অনুভূতি লুকিয়ে?
শির শির বাতাস বইছে। পরিবেশ সুন্দর। অথচ দুটি মানুষের মাঝে দূরত্ব অসীম। জাহিদ বেডে আধ শোয়া হয়ে আর মেহনূর বারান্দায় বসে। দুজনের মাঝের দূরত্ব হয়ত আর কখনোই কমবে না। অথচ এমনটা হওয়ার কথা ছিল না। একটা সুন্দর সংসারের স্বপ্ন তো দুজনেই দেখেছিল।
চাদর দিয়ে মেয়েটিকে পুরোপুরি জাপটে ধরল জাহিদ। মেহনূর অনুভূতিহীন। যেন কোনো পাথর। জাহিদের মন খারাপ হলো তবে সেটি বুঝতে না দিয়ে মৃদু হেসে শুধাল,”এখানে একা দাঁড়িয়ে আছ যে?”
জবাব এল না। জাহিদ ই বলল,”নূর,তোমাকে এভাবে দেখে আমার ভালো লাগছে না।”
মেহনূর কিন্তু জবাব দিল না। চুপ করেই রইল।
“কথা কেন বলো না?”
এবার মুখ খুলল মেহনূর। তবে কণ্ঠে ভালোবাসা নেই। আছে অসহায়তা আর বিরক্তি।
“কথা বলার মতন শব্দ নেই জাহিদ। ভালো লাগছে না, ছাড়ো।”
কথাটি শেষ করেই এগিয়ে গেল মেহনূর। চোখে জল নেই। অথচ ভেতরে ভেতরে কান্নায় ভেসে যাচ্ছে। সব কিছু আড়াল করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। জাহিদ ও দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুমে এল। আলো নিভিয়ে দিল। দুটো শরীর ই একই বিছানায় অথচ দূরত্ব অসীম। অথচ বিয়ের একটি সপ্তাহ ও হয় নি। কি নিষ্ঠুর এই পৃথিবী।
পরদিন সকালে নাস্তার টেবিলে দেখা হলো রিয়া আর রিসানের। সৌজন্যতায় চেয়ার টেনে বসল রিয়া। তাকে খাবার দেওয়া হলো। অন্যমনস্ক হয়ে খাচ্ছিল। হুট করেই গলায় আটকে গেল। রিসান পাশে বসে থেকেও পানি বাড়িয়ে দিল না। নিজ থেকেই নিল রিয়া। ও ভীষণ অবাক হয়ে বলল,”একটা মানুষ কষ্টে কান্না করে দিচ্ছে আপনি পানি এগিয়ে দিবেন না! এতটা খারাপ আপনি?”
“আমি দিলে নিতে তুমি?”
রিয়া দমে গেল। পুরনো একটি ঘটনা স্মরণ করেই চুপ হলো সে। তবে ভেতরের অভিমানটা একটুও গেল না। বরং ক্ষণে ক্ষণে অভিমানের পাহাড়টা আকাশে গিয়ে ঠেকতে শুরু করেছে।
খাবার খাওয়া শেষে মেহনূরের সাথে দেখা। মেহনূর হেসে বোনের গালে হাত ছোঁয়াল।
“আপা তোর সাথে কথা আছে।”
“এখন না। পরে কথা হবে রিয়া।”
“না এখনি।”
এক প্রকার টেনেই নিতে লাগল রিয়া। মেহনূর হাতে ব্যথা পাচ্ছে।
“রিয়া,ব্যথা পাচ্ছি।”
“সরি। আচ্ছা, তুই সত্যি করে বল কেন এমনটা করলি?”
মেহনূর না বোঝার মতন করে বলল,”কেমনটা?”
“কেন পালিয়েছিলি?”
“এমনি।”
“আপা সত্যি করে বল তো তোর সাথে অন্য কারো সম্পর্ক ছিল? এটা তো হওয়ার কথা না। তুই আর জাহিদ ভাইয়া একে অপরকে পছন্দ করতি। এক প্রকার রিলেশন ছিল তোদের। তাহলে, আমি কিছু বুঝতে পারছি না।”
কথাটি বলেই রিয়া উত্তেজিত হয়ে পড়ল। মেহনূর ওকে আগলে ধরল।
“রিয়া, কিছু হয় নি।”
“তোরা কিছু লুকাচ্ছিস আপা। কেন এমনটা করলি?”
মেহনূরের চোখে মুখে অসহায়। কিছু সময় যেতেই রিসান এসে উপস্থিত হলো। ইশারায় মেহনূরকে যেতে বলে রিয়ার কাছে এল। ছেলেটার শরীরের সুবাস অনুভব করে তাকাল রিয়া। দু চোখে নোনা জল।
“কি জানতে চাও তুমি?”
“কেন আপা এমন করল। এটাই জানতে চাই আমি। বুঝেছেন,এটাই জানতে চাই।”
“কেন জানতে চাও?”
“কেন জানতে চাইব না?”
“বেশি বক বক না করলে হয় না?”
রিয়ার শ্বাস ভারী হয়ে যাচ্ছে। রিসান ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে।
“শরীর খারাপ লাগছে?”
“কাছে আসবেন না। ছুঁবেন না আমায়।”
দু চোখ ঘোলাটে অনুভব হয় রিয়ার। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নেয়। রিসান সব অবরোধ উপেক্ষা করে মেয়েটিকে জাপটে ধরে।
“এই মেয়ে, এমন করছ কেন? বলো, কী সমস্যা হচ্ছে। বলো, বলছ না কেন?”
কন্যাটি কথা বলতে পারছে না। চোখে মুখে আঁধার নেমে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই প্রাণ বেরিয়ে আসবে। রিসানের বুকের ভেতর ধীম ধীম আওয়াজ হয়। অনুভব হয় কন্যাটির নখের আ ঘা তে হাতের একটি অংশ ছিন্ন হচ্ছে। অথচ এসব নিয়ে ভাবছে না ওর মন। ও বার বার বলছে,”কী ধরনের সমস্যা হচ্ছে? বলো, বলো প্লিজ।”
নিস্তেজ শরীরে শুয়ে আছে রিয়া। ওর গায়ে কম্বল টেনে দিয়ে বেরিয়ে এল রিসান। মেহনূর চিন্তায় বুদ হয়ে আছে।
“অ্যালার্জি এট্রাক করেছে। কোনো খাবারে অ্যালার্জি আছে ওর?”
“ওর তো মাশরুমে অ্যালার্জি।”
রিসান বুঝল সকালে খাওয়া স্যুপের কারণেই এমনটা হয়েছে। ও কথা না বাড়িয়ে বলল,”রুমে যাও। ওর খেয়াল রেখো।”
যাওয়ার পূর্বে পুনরায় রুমে তাকাল রিসান। মেয়েটার সমস্ত শরীরে চাকা চাকা হয়ে লাল বর্ণ ধারন করেছে। যেন কেউ রং মেখে দিয়েছে।
রিয়ার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। রুমে কেউ ছিল না। ও একটু ভীত হয়ে পড়ল। হঠাৎ করেই সবটা অচেনা লাগছে। মস্তিষ্ক ধরতে পারছে না। ও তড়িঘড়ি করে রুম থেকে বের হলো। আলিয়া খাবার হাতে আসছেন। তাকে দেখেই থেমে গেল রিয়া। তবে ওর বিভ্রান্ত মুখটা দেখে আলিয়া বললেন,”কিছু হয়েছে মা?”
“না আন্টি। আমি আসলে হুট করে ওঠেছি তো। তাই বুঝতে পারি নি।”
“আচ্ছা, আসো আমার সাথে। ক্ষিধে পেয়েছ তো?”
রিয়া মাথা ঝাকাল। ওর খাবার রাখা হলো। ধীরে স্বস্তে মেয়েটি খাচ্ছে। আলিয়া কিছু সময় চেয়ে রইলেন।
“আমি এখন যাই। কোনো দরকার হলে কাউকে ডেকে নিও।”
“জি,আন্টি।”
খাবারটুকু শেষ করে ঘরেই বসে রইল রিয়া। মনে করতে লাগল সকাল থেকে হয়ে আসা ঘটনা গুলো।
চলবে…
কলমে~ফাতেমা তুজ নৌশি