আসমানী পর্ব-১১

0
211

#আসমানী
#পর্ব_১১
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা

নাবিলের মনে লাড্ডু ফুটছে।হাত পা থরথর করে কাঁপছে।সারাদিনের ক্লান্তি শেষে ভেবেছিল এখন শান্তির ঘুম দিবে।কিন্তু হুট করেই বলা নেই কওয়া নেই সেই বোঁচা মেয়েটা মেসেজ দিয়েছে।এইটা কি তার কাছে সহজলভ্য কিছু?নাবিল বেশ কিছুক্ষণ মোবাইল হাতে নিয়ে চুপ করে বসে থাকে।মেয়েটি আবারও তাকে মেসেজ দেয়,”বিজি নাকি, নাবিল?”

নাবিল এবার তার ব্যক্তিগত ধ্যান থেকে বের হয়ে ভাবে এখন মেসেজের রিপ্লে দেওয়াটা আবশ্যক।না দিলে যদি আবার সে রাগ করে।সে দ্রুত হাতে টাইপ করে,”নাহ,বিজি নই আমি।এই মাত্র রুমে আসলাম।”
“কিছুদিন ধরে তুমি কলেজে আসছো না যে?কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“নাহ।কোনো সমস্যা নেই আসলে।আমাদের বাড়িতে নতুন ঘর দিচ্ছে।বাবা তো স্কুলে থাকে।ভাইয়া অফিসে।তাই আমাকেই দেখাশোনা করতে হয়।”
“অহ।”
নাবিল আবার ভাবনায় পড়ে যায়।মেয়েটা অহ বলেছে।তবে কি এখন আর কোনো কথা বলতে চায় না? নাকি তার মেসেজের অপেক্ষা করছে?নাবিল কিছু না বুঝেই তাকে আবার মেসেজ করে,”কেমন আছো দিশা?”
“ভালো আছি।তুমি তো বোধহয় সারাদিন কাজ করে অনেক ক্লান্ত।”
“না,সেইরকম কিছু না।তুমি বলো।”
“কলেজে আসতে পারবে কবে নাগাদ?”
“জানা নেই।”
“কোচিং করো না?”
“আগে করতাম।এখন করি না।”
“কেন?কাজের জন্য?”
“নাহ।এখন আমি আমার ভাবীর কাছেই পড়ি।”
“আগে তাহলে উনার কাছে পড়োনি কেন?”
নাবিল একটা হাসির ইমোজি দিয়ে বলে,”কারণ তখন সে আমাদের বাড়িতে আসে নি।বিয়ের মাত্র তিন মাসের মতো হয়েছে।”
“অহ,আচ্ছা।তাই বলো।”
“কলেজে ক্লাস কেমন হয়?পরীক্ষা কবে জানা আছে?”
“নাহ।এখনও জানায়নি কিছু।কিন্তু কলেজ এ ক্লাস ভালোই হয়।”
“তাহলে তো আমি অনেক কিছুই মিস করে ফেলছি।”
“হুমম।”
আবার কোনো কথা নেই।নাবিলের রাগ হয়।হুমম বলার পর কি বলা উচিত সে জানে না।বন্ধুদের সাথে একরকম কথা বলা হয়।তার ৩-৪টা মেয়ে বন্ধুও আছে।তাদের সাথেও কথা বলা যায়। কিন্তু এই বোঁচা মেয়েটাকে কি রিপ্লে দিবে সে বুঝতে পারে না।
‘নাবিল,তুমি বোধহয় অনেক ক্লান্ত।ঘুমিয়ে পড়ো।”
নাবিল আর কোনো মেসেজ দেওয়ার আগেই মেয়েটি অফলাইন হয়ে যায়।নাবিলের মেয়েটির উপর ভীষণ রাগ হয়।নিজেই নিজেকে বলে,”আহা,নাবিল ঘুমাও।যেন উনি এসে আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে যাবে।আমার ঘুমের বারোটা বাজিয়ে দিয়ে আবার বলে ঘুমাও, তুমি ক্লান্ত।”
নাবিল জানে আরও একটা রাত তাকে নির্ঘুম কাটাতে হবে।কেমন একটা মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে তার মনে।মনে মনে সে সিদ্ধান্ত নেয় কাল যে করেই হোক একবার কলেজে যাবেই সে।কালকে কিভাবে গিয়ে মেয়েটির সাথে কথা বলবে ভাবতেই তো তার লজ্জা লাগছে।কিন্তু হুট করেই তার খেয়াল হয় কালকে শুক্রবার।কলেজ বন্ধ।এইদিকে মেয়েটির বাসার ঠিকানাও সে জানে না।মেয়েটিকে দেখতে হলে তাকে রবিবার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।তার মেয়ে বান্ধবীদের থেকে কি জানা যাবে? পরক্ষণেই ভাবে ওরা ক্ষেপাবে।নাবিলের বুকের ভিতরটা কেমন যেন খালি খালি লাগে।বারবার শুধু তার মনে হয় কাল শুক্রবার,কলেজ বন্ধ।
★★★
“তোমার কেন মনে হচ্ছে আমি তোমাকে দয়া করছি?” কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে মুহিত।
“আমি জানিনা।কিন্তু আমার মনে হচ্ছে।”
“রোজি,আমি তোমাকে মোটেও দয়া দেখাচ্ছি না।তুমি জানো আমি কেন তোমাকে বিয়ে করতে চাইছি।আর তুমি যেটা জানো সেটা আমিও জানি।”
“আমি কি বলবো জানিনা। মাস দুয়েক হয়েছে আমার ডিভোর্স হয়েছে।আমি এখনই এইসব বিষয়ে কোনো কিছু ভাবতে পারছি না।”
“আমি জানি তোমার সময় লাগবে।তুমি সময় নাও।৬ মাস,৯ মাস,১ বছর।সমস্যা নেই।আমি অপেক্ষা করবো।”
“আমি জানিনা আমি কি করবো।তুমি এতো তাড়াতাড়িই কেন এসেছো?আর তুমি জানলে কিভাবে যে আমার ডিভোর্স হয়েছে?আর আমার জানামতে আমার ডিভোর্স হওয়ার আগেই তুমি জানতে পেরেছো যে আমার ডিভোর্স হচ্ছে।তুমি হুডি পড়ে আরো আগে থেকেই আমাদের মহল্লায় ঘুরাঘুরি করছো।”
মুহিত একটা ঢোক গিলে বলে,”তুমি কিভাবে জানলে?”
“আসমানী বলেছে।”
“আসমানী যেন কে?”
“ওহ,তোমাকে তো বলা হয়নি।নাহিদের বউ।কিছুদিন আগেই ওদের বিয়ে হয়েছে।”
“অহ,হ্যাঁ।তোমার কাকা সেদিন বলেছিল।”
“হুমম।”
বেশ কিছুক্ষণ দুজনের মধ্যে নীরব থাকার একটা যুদ্ধ হয়।শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে হেরে গিয়ে মুহিত বলে,”তোমার মনে আছে রোজি,আমরা আগে টং থেকে চা খেতাম।মাঝে মাঝে এক কাপ চা দুজন ভাগ বসাতাম।তুমি বলতে এক কাপ চা ভাগাভাগি করে খেলে ভালোবাসা বাড়বে।কিন্তু আমি জানতাম তুমি আমার টাকা বাঁচানোর জন্য এমনটা করতে।”
রোজি কিছু না বলে শুধু একটু হাসে।মুহিত আবার বলে,”কিন্তু আজ দেখো,দামী কফিশপে এসে কফি খেয়েও আমরা সুখী হতে পারছি না।কারণ টা কি জানো?”
“জানি।”
“কি বলোতো?”
“সম্পর্ক যত্ন নিতে হয়।না হলে চলে গেলে ফেরার রাস্তাটা আপনা আপনিই বন্ধ হয়ে যায়।সম্পর্ক আগের মতো না হলে আমরা একে অন্যের উপর অধিকার খাটানো যায় না।”
মুহিত মুচকি হেসে বলে,”হুমম।ঠিকই বলেছো।”
“তুমি এতো তাড়াতাড়ি করছো কেন?”
“আসলে তোমার বাবার জন্য।আমার ভয় হচ্ছিল সে যদি তোমার বিয়ে আবার অন্য কোথাও ঠিক করে ফেলে।আর আমার অতো সাহসও নেই যে তোমার বাবার সামনে গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দিব।আসলে আমি আজও তোমাদের মতো এতো বড়লোক হয়ে উঠতে পারিনি।আর জীবনে পারবো কি না জানিও না।তবে হ্যাঁ, এইটুকু বলতে পারি যে তোমার সংসারে তুমিই রানী হবে।কেউ তোমাকে হুকুম করার থাকবে না।আর আমি এখন সম্পূর্ণ আগের মতো চালচুলোহীন নই।আমার মাথা গুজার মতো একটা বাড়ি, ঘর আছে।তোমাদের বাড়ির মতো না হলেও তোমার অসুবিধে হবে না আশাকরি।”
“আমার বাবাকে তোমার ভয় পাওয়ার কিছুই নেই মুহিত।সে এখন আর আমার জীবনের কোনো সিদ্ধান্তই নিবে না।সে সেই অধিকার হারিয়েছে।আমি জানি সে নিজে থেকেও আর আসবেনা।”
মুহিত কিছু না বলে শুধু অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে।রোজি তাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে,”তোমার নিজের বাচ্চা চাই না?”
“নাহ।চাই না।”
“কেন?”
“আমি ছোটবেলা থেকেই অনাথ।একা একা বড় হয়েছি।যে আমাকে বড় করেছে সেও আহামরি কেউ না আমার।সে আমার সাথে ছিল কারণ তারও একটা মাথা গুজার মতো আশ্রয়ের দরকার ছিল।ধরো আমাদের বাচ্চা হলো।তারপর কোনো দূর্ঘটনায় আমি আর তুমি মারা গেলাম।ধরো তোমার বাবা মাও আর বেঁচে নেই।তখন আমাদের সেই বাচ্চাটার কি হবে?সেও কি আমার মতো মানুষের লাত্থি খেয়ে খেয়ে বড় হবে?অন্যের বাড়ির বাসি খাবার খাবে?আমি কি তা মরেও সইতে পারব?আমি জানি এর কষ্ট কি রকম।তাই শুধু শুধু কেন একটা নিষ্পাপ প্রাণকে নষ্ট করবো?তারচেয়ে বরং আমরা অনাথ আশ্রম থেকে একটা বাচ্চা নিয়ে আসবো।কি বলো?কেমন লাগলো আমার বুদ্ধি?”
রোজিনার চোখে আনন্দে পানি চলে আসে।মুহিত বুঝতে পারে রোজির মনের অবস্থা। সে প্রসঙ্গ বদলানোর জন্য বলে,”তুমি না বললে তোমার সাথে কে যেন এসেছে।সে কোথায় গেছে?”
রোজি নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”আসমানী ভাবি?এইদিকে নাকি ওর একটা বান্ধবীর বাসা আছে।তার সাথে দেখা করতে গেছে।”
“রোজি।”
“হুমম।”
“আমি অপেক্ষা করবো।”
রোজিনা কিছুই বলে না। শুধু প্রাণপণে চেষ্টা করে নিজের চোখের পানি লুকাতে।
★★★
কলিংবেল বাজছে।একবার,দুবার,তিনবার।ভিতর থেকে তেমন কোনো সাড়াশব্দ নেই।চতুর্থবারের মতো বাজানোর আগেই ভেতর থেকে কমবয়সী এক ছেলে চোখ ডলতে ডলতে এসে দরজা খুলে বলে,”এতোবার কলিংবেল বাজায় কেউ?ঘুমাচ্ছিলাম তো।এসো ভিতরে এসো।”
সে ফিরে যেতে যেতে হুট করেই পিছনে ফিরে তাকিয়ে ভুত দেখার মতো চমকে উঠে।প্রায় আর্তনাদের মতো করে উঠে বলে, “মা দেখো আসমানী আপু এসেছে।”
“সামনে থেকে সরে আমাকে ভিতরে যেতে দিবি নাকি আমি বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকবো?”

কমবয়সী ছেলেটি কিছু না বলেই সামনে থেকে সরে দাঁড়ায়।আসমানী কোনো কথা না বলে রুমের ভিতরে গিয়ে সোফার আয়েসি ভঙ্গিতে বসে পড়ে।
কয়েক মুহুর্ত পরই ভিতরের রুম থেকে মাঝবয়সী এক মহিলা এসে সেখানে উপস্থিত হয়।মহিলাটি আসমানীকে দেখে কোনো কথা না বলে আবারও ভিতরের রুমে চলে যায়।আসমানী বেশ চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে বলে,”বিয়ের পর প্রথম বাবার বাড়িতে এসেছি।বাবা মা তো নেই।আছে চাচা আর চাচী।তারা কি আমায় একটু আপ্যায়ন করবে না?নাকি আমি খালি মুখেই চলে যাবো?”
কমবয়সী ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলে,”একটু জুস নিয়ে আয় তো।এখন বানিয়ে আনবি।ফ্রেশ জুস।আর এসি টা চালিয়ে দিয়ে যা।যা রোদ পড়েছে বাইরে।ক্ষুধায় আমার পেট জ্বলে যাচ্ছে।”

কমবয়সী ছেলেটিও কিছু না বলে সেখান থেকে রান্নাঘরে চলে যায়।আসমানীর কথাগুলো শেষ হতেই ভেতরের রুম থেকে মহিলাটিও বের হয়ে রান্নাঘরে ঢুকে।

আসমানী বেশ স্বাভাবিকভাবেই টিভির রিমোট নিয়ে নিজের পছন্দ মতো চ্যানেল ঘুরাতে থাকে।বেশ কিছুক্ষণ পর ছেলেটি এসে আসমানীকে এক গ্লাস জুস এনে দিলে আসমানী বেশ আয়েস করে সেটায় চুমুক দেয়।আসমানী ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করে,”বড় চাচা আর ভাইয়ারা কই?”
“নামাজে গিয়েছিল।এখনও আসেনি।”
“তুই যাসনি কেন?”
‘ইয়ে মানে ঘুমাচ্ছিলাম।”
আসমানী মুখ ভেঙ্গিয়ে বলে,”আহা,লাটসাহেব ঘুমুচ্ছিলেন।আমার সামনে থেকে সরে যা।”
ছেলেটি তবুও যায় না।একপাশে কাচুমাচু হয়ে এক দৃষ্টিতে আসমানীর দিকে তাকিয়ে থাকে।যেন কত বছর পর দেখছে তাকে।
কিছুক্ষণ পর আসমানী লক্ষ্য করে মাঝবয়সী মহিলাটি খাবার টেবিলে এসে খাবার বাড়ছে।আসমানী মহিলাটির কাছে গিয়ে পিছনে থেকে জড়িয়ে ধরে বেশ আহ্লাদের স্বরে বলে,”রাগ করছো কেন বড় মা?দেখো আমার কিছুই হয়নি।আমি ভীষণ ভালো আছি।আমার কাজ শেষ হলেই আমি তোমার কাছে চলে আসবো।”
মহিলাটি প্লেটে খাবার রাখতে রাখতে বলে,”আসবে কিভাবে?ঐ বাড়িতে যে তোমার জন্য খুঁটি গেড়ে রেখেছো।আসবে কিভাবে?তোমার চাচা ঐ বাড়ি তোমাকে রেখে এসে বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদলো।তোমাকে আমরা ঐভাবে মানুষ করেছি?ঐ বাড়িতে থাকতে কষ্ট হয় না?কি দরকার ছিল এইভাবে বিয়ে করার?প্ল্যান ফেইল হয়ে তো পুরো মহল্লার সামনে কাজি ডেকে, রেজিস্ট্রি করে বিয়ে হয়েছে।এখন তো ঐটাই তোমার পরিবার।ফিরবে কিভাবে আমার কাছে?”
আসমানীর মন মুহুর্তেই খারাপ হয়ে যায়।সত্যিই তো।সে ফিরবে কিভাবে?ঐটাই এখন তার বাড়ি,তার পরিবার।এতো ভালো বাব-মায়ের মতো শ্বশুর শাশুড়ী, ভাই-বোন এর মতো ননদ আর দেবর।আর জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত চলার মতো একজন স্বামী।এদেরকে ছেড়ে কিভাবে আসবে সে?এ কি এই ইহজন্মে সম্ভব তার কাছে?
চলবে…..