#আসমানী
#পর্ব_১৭
#লেখনীতে_তাহমিনা_মিনা
আসমানী এইবার বেশ রেগে গিয়েই বলে,”নিয়ম সবার জন্যই তো সমান তাইনা?সবার জন্যই সমান?তাহলে নিজের বড় চাচা যে অবৈধ উপায়ে এত কিছু করলো,তার বেলায়?কই তাকে তো কিছুই করছেন না?নাকি আপনিও তারই মতো?নিজেদের বেলায় ষোলো আনা আর বাকিদের বেলায় কিছুই না?”
আসমানীর করা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারে না নাহিদ।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।আসমানী আবার তাকে প্রশ্ন করে,”কি হলো?বলার কিছুই নেই?”
নাহিদ শুধু বলে,”আমি নিজে তাকে শাস্তি দিয়েছি আসমানী।কিভাবে কিভাবে শাস্তি দিয়েছি সেটা তুমি জানোনা।”
আসমানী ফের বলে,”আপনি যেটা করছেন,সেটা অন্যায়।ঘোর অন্যায়।আজ যদি আপনার বাবা জানে এইসব ব্যাপারে উনি কতটা কষ্ট পাবেন আপনার কোনো ধারণা আছে?”
নাহিদ আসমানীর মুখ চেপে ধরে কড়া গলায় বলে,”খবরদার আসমানী।এই কথা যেন এই ঘরের দেয়ালও না জানে।”
“আপনি এতো বড় অন্যায় করেও কিভাবে এতো স্বাভাবিক থাকতে পারছেন?”
নাহিদ কঠিন গলায় বলে,”আমি কোনো অন্যায় করছি না আসমানী।আমার মতে আমি ভালো কাজই করছি।দুনিয়ার মানুষেরা যারা ধনী,তারা ধীরে ধীরে ধনীই হচ্ছে আর যারা গরীব তারা খাওয়ার জন্যও কিছুই পাচ্ছে না।আমি যোগ্যতা থাকলেও কত বছর চাকরি পাইনি অথচ আমার চাইতেও লো কোয়ালিটির লোক ঘুষ দিয়ে চাকরি পেয়ে যায়।আমরা সেই ঘুষের টাকা লুট করে নিই আসমানী।ঐ টাকায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের হক আছে।গরীব মানুষ গুলোর হক আছে।আমরা তাদের টাকা তাদের কাছে পৌঁছে দিই আসমানী।এখন বলো,আমরা অন্যায় করছি?”
আসমানীর মাথা ব্যথা করছে।এমন এক জায়গায় তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে নাহিদ যেখানে থেকে এতো সহজে কোনো কিছু চিন্তাভাবনা করার উপায় নেই।
নাহিদ আবার বলে,”বড়লোকের মেয়ের বিয়েতে শুধু খাবারই যে নষ্ট হয়,তার হিসেব নেই।অথচ গরীবের মেয়ের বিয়ে আঁটকে যায় একটু খানি মাংশ কম পড়ায়।আমরা সেই দূর্ভাগা বাবার মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করি।এখন বলো,আমরা খারাপ কাজ করি?বিবেক দিয়ে ভেবে বলো আসমানী।”
আসমানী তবুও চুপ করে থাকে।
নাহিদ বুঝতে পারে আসমানীর চিন্তাভাবনা করতে সময় লাগবে।তাই সে বলে,”শুয়ে পড়ো আসমানী।অনেক রাত হয়ে গেছে।”
নাহিদ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লেও আসমানী ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।হঠাৎ কি মনে হতেই প্রশ্ন করে,”একটা প্রশ্নের জবাব দিন তো আমাকে।আপনারা যদি ভুল করে কোনো ভালো মানুষের টাকা লুট করে ফেলেন,তবে তার পরিনাম কিভাবে ভোগ করবেন?নিজেদের কিভাবে ক্ষমা করবেন?”
আসমানীর দিকে তাকিয়ে নাহিদ শুধু বলে,”আমরা সবকিছু জেনেশুনেই সিদ্ধান্ত নিই আসমানী।চিন্তা করোনা।তোমার স্বামী আজ পর্যন্ত কোনো খারাপ কাজ করেনি।”
আসমানী বেশ শান্ত স্বরেই জিজ্ঞেস করে,”এইসব শুরু করেছেন কবে থেকে আপনারা?”
“ভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে।”
“কোনো বিশেষ কারণে?”
“হ্যাঁ, দেয়ালে আমাদের পিঠ ঠেকে গিয়েছিল।তাই এমন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।আমাদের মতো গরীব আর মধ্যবিত্তদের কষ্টের কথা শোনা বা দেখার সময় কারো নেই।তাই নিজেদের রাস্তা নিজেরাই বেছে নিয়েছি।”
আসমানী চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।তাকে নিশ্চুপ দেখে নাহিদ বলে,”শুয়ে পড়ো আসমানী।”
এরপর রাত গভীর হয়।দুজনেই দুদিকে মুখ ঘুড়িয়ে শুয়ে পড়ে।কারও চোখে ঘুম নেই।অথচ নিরবেই শুয়ে থাকে দুজনে।
★★★
“আমার জীবনটা অসহ্য রকমের সুন্দর,জানো তো আসমানী?” বেশ উদাসভাবে কথাগুলো বললো রোজিনা।
আসমানীও হাসিমুখে বললো,”দুলাভাই বুঝি খুব ভালোবাসে তোমায়?”
“তা তো বাসেই।ভীষণ ভালোবাসে।জানো আমরা কিছুদিন পর কি করতে চলেছি?”
“কি?”
“একটা বাচ্চাকে নিয়ে আসতে চাচ্ছি।”
“অনাথাশ্রম থেকে?”
“নাহ।”
“তাহলে?”
“আমাদের ঐদিকে এক পাগলী গর্ভবতী আসমানী।কিছুদিন পরই ওর ডেলিভারি ডেট।আমরা ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে এসেছি।ওর বাচ্চাটা হলেই আমরা ওকে নিয়ে আসবো।তারপর ওকে মেন্টাল এসাইলেম এ রেখে আসবো।ঐখানে ওর চিকিৎসা হবে।”
আসমানী কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল।বেশ ফিসফিস করে বললো,”কিন্তু আপু,বাচ্চাটা তো অবৈধ।তাকে কি করে….”
রোজিনা বেশ হাসিমুখেই বলে,”বাচ্চারা নিষ্পাপ আসমানী।আমরা কাউকেই জানাইনি।সবাইকে বলবো অনাথাশ্রম থেকে এনেছি।শুধু তোমাকেই জানালাম।কাউকে বলো না যেন।”
আসমানী শুধু অবাক হয়ে তাকিয়েই রইলো তার দিকে।আসমানীকে এইভাবে বোকার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে রোজিনা বলে,”আমার যা নেই,সেটা যদি কোনোভাবে পেয়ে যাই,তাহলে আমি সেটা লুফে নিব।ঐ পাগলির তো কোনো দোষ নেই আসমানী।হয়তো কোনো রাস্তার মাতাল কিংবা কোনো ধনকুবেরের রক্ত বইছে ঐ ছোট্ট শিশুর শরীরে।সে বের হয়ে তার পাগলি মাকে পেলে এই দুনিয়াটাকে ভাববে নিষ্ঠুর।এই সমাজ তাকে জারজের তকমা ছাড়া আর কিছুই দিবে না।সে বেড়ে উঠবে অবহেলায়,অনাদরে।সেখানে আমি যদি তাকে মায়ের মমতা দিয়ে আগলে নিই,তাহলে সে অনেক ভালো থাকবে।মা,বাবা সবই পাবে।ঐ পাগলিটারও চিকিৎসা করবো আমরা।যাতে সে ভালো থাকে,সেই ব্যবস্থা করবো।”
“আপু,একটা কথা জিজ্ঞেস করি।”
“বলো।”
“আমার জানামতে,তোমার প্রথম স্বামীও বাচ্চা দত্তক নিতে চেয়েছিল।তাহলে তাকে কেন সেই সুযোগ তুমি দিলেনা?”
রোজিনা হেসে বলে,”আমি জানি সে বাচ্চা দত্তক নিতো।সে আমাকে নিয়ে থাকতেও চেয়েছিল।কিন্তু আমি তার চোখে সন্তানের জন্য আকুতি দেখতে পেয়েছিলাম।সে জানতো আমি কখনোই মা হতে পারবো না।তারপরও সে আশা ছাড়েনি।সে আমাকে ডাক্তার,কবিরাজ সবই দেখিয়েছে।আমরা কতবার যে মাদ্রাজ গিয়েছি,তার হিসেব নেই আসমানী।সে যদি সন্তানের আশা করতে পারে,তবে আমি কেন তাকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করবো?তুমিই বলো।তার তো অধিকার আছে।সে আমার জন্য অনেক করেছে।আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।এতোদিনে হয়তো তার নিজের সন্তান স্কুলে পড়তো।সেখানে আজই তার বিয়ে হতে যাচ্ছে।আর সন্তানের আগমন তো বেশ পরে আর স্কুল তো আরও পরে।” বলেই মুচকি একটু হাসে সে।
আসমানী অবাক হয়ে বলে,”উনার বিয়ের কথা তুমি কিভাবে জানলে?”
“আমার বিয়ের রাতে সে আমাকে কল দিয়েছিল।শুভকামনা জানালো।আর বললো তার বিয়ে খুবই সামনে।সে এক বাচ্চা আছে এমন একজন কে বিয়ে করতে যাচ্ছে।” বলেই মাথা নিচু করে ফেলে সে।
আসমানী খুব ধীরে ধীরে বলে,”আপনার কি খারাপ লাগছে?”
রোজিনা খিলখিল করে হেসে বলে,”আমার বিয়ে হয়ে গেছে আসমানী।এখন আর খারাপ লাগার কোনো কথা নেই।তবে একটা কথা জানো তো,যখন তোমার সামনে দুটো অপশন খোলা থাকবে,তখন দেখা উচিত কোন অপশনে তোমার সম্মান আর শান্তি আছে।সেটাই তোমার গ্রহণ করা উচিত।আমি উনার থেকে দূরে চলে এসেছি বলেই স্বামীহারা বিধবা মেয়েটা একজন স্বামী পাচ্ছে।বাবাহারা মেয়েটা একটা বাবা পাচ্ছে।রাস্তার পাগলীটা মাথার উপর ছাদ পাচ্ছে।তার অনাগত সন্তানটা বাবা-মা পাচ্ছে।তোমার দুলাভাই আমাকে পেয়েছে।আর আমি পেয়েছি সম্মান আর ভালোবাসা।এখন বলো,আমার সিদ্ধান্ত কি ভুল ছিল?আমি চাইলেই আগেই বাচ্চা দত্তক নিতে পারতাম।কিন্তু কারও হক নষ্ট করার অধিকার আমার নেই।বুঝলে?”
আসমানী মাথা নাড়ে।যার অর্থ সে বুঝেছে।
“ভাবী,রোজি আপু,চলো ঐ ঘরে চলো।আজকে থেকে আমরা ঐ ঘরে থাকবো।তাড়াতাড়ি চলো।সবাই ডাকছে তোমাদের।”কথাগুলো নাতাশা ঝড়ের গতিতে এসে ঝড়ের গতিতে বলে আবার ঝড়ের গতিতেই চলে গেল।
রোজি আর আসমানীও তার পিছুপিছু গেল।আজকে তারা নতুন ঘরে থাকতে শুরু করবে।সেই উপলক্ষে তাদের পরিবারের সবাইকে দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য দাওয়াত দেয়া হয়েছিল।সবাই এসে গেছে।নাহিদও আজকে ছুটি নিয়েছে।সবাই বেশ খুশি।নতুন ঘরের জন্য বড় ডাইনিং টেবিল বানাতে দিয়েছে।সেটা এখনও এসে পৌঁছায়নি।তাই সবাই ফ্লোরেই খেতে বসেছে।অনেকদিন পর গোটা পরিবারের সবাই এইভাবে ফ্লোরে বসে খাচ্ছে।সবাই বেশ হাসিঠাট্টা করছে।শাহেদা বেগম হুট করেই বলে,” এই আসমানী আসার পর থেকেই আমার সংসারে শুধু উন্নতি আর উন্নতি হচ্ছে।সবাই আমার ছেলের বৌয়ের জন্য দোয়া করো,যেন এইভাবেই ও আমাদের সবার সাথে হাসিখুশি থাকতে পারে।আর ওর জীবনটাও যেন খুশিতে ভরে উঠে।”
★★★
“তুমি এইসবের মাঝে কেন নিজেকে জড়াতে চাইছো আসমানী?” উদ্বেগ নিয়েই প্রশ্ন করে নাহিদ।
আসমানী ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দেয়,”তুমি করতে পারলে আমি কেন পারবো না?”
“কিন্তু তুমি কিভাবে?তুমি তো মেয়ে।আমি চাই না তুমি এই অনিশ্চিত জীবনে জড়াও।”
আসমানী সরাসরি নাহিদের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার জীবনটা এমনিতেও অনিশ্চিত।বাবা-মা ছাড়া অনিশ্চিত ছিল আগে।আর এখন আপনার সাথে থেকেও অনিশ্চিত।আপনার নিজের জীবনটাই তো অনিশ্চিত।আর আমি আপনার সাথে সরাসরি জড়িত।আমার জীবনটা এমনিতেও অনেক বেশিই অনিশ্চিত।আপনার কিছু হয়ে গেলে আমিও সাগরে পড়ে যাব।তাই নিজের দোষে সাগরে পড়তে পারলে সেখানে বেশি সুখ পাবো।বুঝলেন জনাব?আর আমিও আপনার মতোই করিনা সমাজসেবা কিংবা বলতে পারেন ডাকাতি।”
চলবে……