#আষাঢ়ে_প্রণয়_সন্ধি
#লেখিকা:#ইশা_আহমেদ
#পর্ব_১২
সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। চারপাশ শুনশান নীরবতায় ছেয়ে আছে।কিছুক্ষণ পরপর কাঁক ডাকছে।চিত্রা বারান্দায় বসে সূর্য উঠা দেখছে আর চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে।চুলগুলো আলগোছে খোঁপা করা। পরনে পাতলা একটা সেলোয়ার-কামিজ। দেখতে খারাপ লাগছে না। সে আহামরি সুন্দর না।হলদে ফর্সা,লম্বায় পাঁচ ফিট দুই কি তিন।দূর থেকে আষাঢ় পর্যবেক্ষণ করছে এই রমনীকে।ছাদের এক কোণে দাঁড়িয়ে সে তার প্রিয় নারীকে দেখছে।সে যেমনই হোক না কেনো তার চোখে চিত্রা নামক রমনী অত্যাধিক সুন্দর।যাকে দেখার জন্য আষাঢ়ের হৃদয় ব্যাকুল হয়।আজকে আকাশে সাদা সাদা মেঘের দেখা মিলেছে।চিত্রা আষাঢ়কে খেয়াল করতেই সরে আসলো।আষাঢ় মৃদু এসে নিচে নেমে গেলো।সে একটু হাওয়া খেতে এসেছিলো ছাদে তবে এত সুন্দর মনোরম দৃশ্য দেখবে ভাবেনি।
চিত্রা রুমে এসে দেওয়াল ঘড়িতে দেখলো সাতটা বেজে গিয়েছে।দশটায় তার ক্লাস আছে।একটু বই নিয়ে বসলো সে।আজ যে সাজিয়া যাবে না খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে।কিছুক্ষণ পড়ার পরে বের হলো রুম থেকে।প্রহরের রুমের দরজা সামান্য খুলে দেখলো প্রহর কি করে।ঘুমাচ্ছে প্রহর।চিত্রা নিঃশব্দে রুমে প্রবেশ করলো।পড়ার টেবিলের অবস্থা দেখে সে গোছালো।এরপর ভাইয়ের মাথার কাছে এসে বসলো।তার ছোট্ট ভাইয়টা কতো বড় হয়ে গিয়েছে। ছোট্ট প্রহর তার সামনের বেড়ে উঠলো।যেই ভাইকে সে কোলে নিতো এখন সেই ভাই তাকে কোলে নিতে পারবে।সময়ের সাথে সাথে সব কিছু বদলাচ্ছে। তবে সে কেনো বদলাতে পারলো না। প্রহরের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো চিত্রা।প্রহর নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো।
“প্রহর উঠিস না কেনো?পড়া নেই তোর। সারাদিন শুধু ঘুমাবে খেলবে আর ফোন পাইলে গেম খেলবে।কোনো কাজ নেই।এি ছেলে উঠ”
প্রহর চোখ মুখ কুঁচকে উঠে বসলো।ঘুম এখনো কাটেনি তার।পিটপিট করে চোখ খুলল।চিত্রাকে দেখে জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো।অতঃপর বলল,,,
“আর একটু ঘুমাই আপু। বেশি না একটু।প্লিজ ঘুমাতে দাও।”
“এখন আর না। যা মুখ ধুয়ে আয়।পড়তে বসবি।আমি অঙ্ক বুঝিয়ে দিচ্ছি।আর বিজ্ঞানের একটা চ্যাপ্টার বুঝাবো”
প্রহর বিরক্ত নিয়ে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো। চিত্রা মৃদু হাসলো।প্রহর টেবিলে চেয়ার টেনে বসলো। ঘুমের ঠেলায় ঢুলছে এখনো।চিত্রা তা দেখে ধমক দিয়ে বলল,,
“প্রহর সোজা হয়ে বোস।মোটেও ঝিমাবি না। যা পড়াবো ঠিকমতো পড়বি। না হয় থাপ্পড় দুই চারটা খাবি কিন্তু”
বেচারা প্রহর আর কি করবে সোজা হয়ে বসলো।চিত্রা বুঝিয়ে দিলো প্রথমে বিজ্ঞান। এরপর অঙ্ক করালো। সব শেষ করতে করতে আটটা বেজে গেলো।চিত্রা প্রহরকে রেডি হতে বলে নিজের রুমে আসলো তৈরি হতে।আজ দুইটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে।না হলে আর যেতো না সে।কালো রঙের একটা সেলোয়ার-কামিজ বের করে পরে নিলো। তৈরি হতে হতে সাড়ে আটটা বাজলো। ব্যাগ নিয়ে বের হলো রুম থেকে।প্রহরের রুমে উঁকি দিতেই দেখলো ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে শার্টের বোতাম লাগাচ্ছে প্রহর।চিত্রা হেসে সেদিকে গেলো।প্রহরকে সোজা দাঁড়িয়ে থাকতে বলে।নিজেই শার্টের বোতাম লাগালো।ইন করিয়ে নিলো।এরপর নিজে টাই বেঁধে দিলো।
ছেলেটা ক’দিনে অনেক লম্বা হয়ে গিয়েছে।তবে প্রহর তার কাছে সেই ছোট্ট প্রহরই রয়ে যাবে সারা জীবন।আইডি কার্ড ঝুলিয়ে দিলো গলায়।প্রহর হালকা হেসে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বের হলো। খাবার টেবিলে বসলো সবাই।একসাথে খেয়ে উঠলো।প্রহর যাবে আরমান সাহেবের সাথে। তাদের সাথে অরিহাও যাবে।চিত্রা নিচপ নামলো। সকাল বেলা এই রাস্তাতে রিকশা পাওয়া বড্ড কঠিন।আষাঢ় ও তখনই বের হলো বাড়ি থেকে চিত্রার চোখ পরলো।দ্রুত সরিয়ে নিলো সে চোখ।তবে আজ আষাঢ়কে দেখে একটু অন্যরকম লাগলো তার কাছে।আগে কখনো খেয়াল করে দেখা হয়নি।লোকটি সুদর্শন বটে।পাঁচ ফিট দশ কি এগারো হবে হয়তো।লম্বা চওড়া শরীরে কালো শার্টটা মানিয়েছে বেশ।
চিত্রা নিজের ভাবনায় নিজেই বিরক্ত হলো।সে এলটা পুরুষকে নিয়ে এমন কেনো ভাবছে।সে যাই করুক না কেনো তার কিছু যায় আসে না।অটো দেখে থামতে বললো সে।পেছনের সিটে উঠে বসলো।আষাঢ়েরও দেরী হওয়ায় সেও ওই অটোতেই যাবে।পেছনে বসতে গিয়েও চিত্রার অস্বস্তির কথা ভেবে সে সামনে বসলো। যা চিত্রার ভালো লাগলো। আজ একটু হলেও চিত্রার মনে আষাঢ়ের জন্য ভালো ধারণা জন্মালো।ভার্সিটির সামনে নেমে পরলো সে।
আষাঢ় দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে মনে মনে আওড়ালো,,,
“আমি হয়তো ভালোবাসার আগুনে দগ্ধ হতে চলেছি।যন্ত্রণা হবে বুকের বা পাশটায়।আমি হয়তো ভালোবাসি আপনায়। তবে এখনো ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।এই অনুভূতি কিসের!ভালোবাসা নাকি শুধুই ভালো লাগা”
–
“তুমি কোথায় সাজিয়া?আমি অনেকক্ষণ যাবত তোমাদের বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছি”
সাজিয়া তাড়াহুড়ো করে বলল,,“আপনি দয়া করে আর দুমিনিট অপেক্ষা করুন আমি আসছি এখুনি।”
কিছুক্ষণ এর মাঝেই সাজিয়া তাড়াহুড়ো করে বের হলো বাড়ি থেকে।নিশীথ কাল রাতে ফোন করে বলেছে সাজিয়ার মামাকে।তিনি বিনা বাক্যে রাজি হয়েছেন।নিশীথ তাকালো তার পানে।আজ একটু বেশিই সুন্দর লাগছে মেয়েটিকে।মেরুন রঙের সেলোয়ার-কামিজে বেশ লাগছে।
“দুঃখিত আপনাকে অপেক্ষা করানোর জন্য।আসলে আজ ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো তাই আর কি দেরী হলো।আপনি কিছু মনে করবেন না”
“সমস্যা নেই। আপনার একা যেতে সমস্যা নেই তো সাজিয়া?”
সাজিয়া মাথা নাড়িয়ে না বোঝায়।দু’জন শপিং মলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায়।আজও নিশীথ যথেষ্ট দূরত্ব নিয়ে বসেছে।সাজিয়া মুগ্ধ হচ্ছে সে।তবে নিশীথের আপনি তুমি ডাকে সে একটু অস্বস্তিতে পড়ছে।কখনো তুমি আবার কখনো আপনি ডাকে নিশীথ। যা তাকে অস্বস্তিতে ফেলায়।শপিং মলের সামনে রিকশা থেকে নামে দু’জন। ভাড়া মিটিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।প্রথমে যায় বিয়ের শাড়ি বা লেহেঙ্গা কিনতে।নিশীথ নিচু স্বরে শুধালো,,,
“সাজিয়া তুমি বিয়েতে কি পরতে চাও?শাড়ি নাকি লেহেঙ্গা”
“আপনার যা পছন্দ আপনি তাই কিনুন।আর দয়া করে তুমি বা আপনি যেকোনো একটি বলুন। আমার অস্বস্তি হয়।”
নিশীথ বুঝে হাসলো।সে একবার তুমি তো একবার আপনি বলে ফেলছে।নিশীথ দোকানদারকে শাড়ি লেহেঙ্গা দু’টোই দেখাতে বলে।দোকানদার দেখাতে থাকে একের পর এক।নিশীথের শাড়ি পছন্দ হচ্ছিলো না। তাই লেহেঙ্গা দেখাতে বললো আরো কয়েকটা।তার ভেতরে তার মেরুন রঙের একটা লেহেঙ্গায় চোখ আটকায়।খুবই সুন্দর লেহেঙ্গাটি।নিশীথ সাজিয়াকে জিজ্ঞেস করে তার পছন্দ হয় কি না।সাজিয়ার পছন্দ হয়েছে লেহেঙ্গাটি।নিশীথের পছন্দ আসলেই অনেক সুন্দর। সে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দেয়।নিশীথ লেহেঙ্গাটি কিনে নেয়।এরপর শেরওয়ানি কিনতে যায় তার।লেহেঙ্গার সাথে মিলিয়ে শেরওয়ানি কিনে।শেরওয়ানি কেনা শেষ হতে সে আরেকটা শাড়ির দোকানে যায়।সেখান থেকে মোটামুটি দামের কয়েকটা শাড়ি কিনে।এরপর আরেকটা দোকান থেকে মোটামুটি দামেরই ৫ টি সেলোয়ার-কামিজ কিনে।
বিয়ের সব কেনা কাটা শেষ।আর যা বাকি সেগুলো জানাত ইসলাম কিনে নিবেন।যদিও সাজিয়া বলেছিলো এতো কিছু কেনার প্রয়োজন নেই তবে নিশীথ শুনেনি।দুপুর হয়েছে।তাই দু’জন রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে বসলো।নিশীথ বিরিয়ানি ওর্ডার করেছে।সাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“এতো টাকা খরচ করার প্রয়োজন ছিলো না নিশীথ সাহেব।অযথাই আপনি এতোগুলো টাকা খরচ করেছেন”
“প্রয়োজন ছিলো সাজিয়া।তুমি আমার বউ হবে।আমার বাড়িতে এসে তোমার যেনো কোনো অসুবিধা না হয় তার জন্যই আমি সব কিছু কিনে রাখছি।তুমি আমার বউ হবে দু’দিন পর। তোমাকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমার।”
“তবুও এতো শাড়ি সেলোয়ার-কামিজ কিনে টাকা না খরচ করলেও পারতেন।কত করে মানা করলাম।”
নিশীথ কিছু বলল না।সে খেয়াল করলো অতিরিক্ত গরমে সাজিয়া ঘেমে গিয়েছে। নিশীথ নিজের পকেট হাত দিলো।কাঙ্খিত জিনিসটি পেয়েও গেলো।রুমালটা সাজিয়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,,
“মুখ মুছে নাও সাজিয়া ঘেমে গিয়েছো অতিরিক্ত। ঠান্ডা গরম লেগে যেতে পারে।”
সাজিয়া হাত বাড়িয়ে রুমালটা নিয়ে মুখ মুছলো।এরপর ফিরিয়ে দিলো রুমালটি।নিশীথ নিয়ে আবারো পকেটে গুঁজে রাখলো।খাবার আসলে দু’জন খেলো।নিশীথ আগেই বলে দিয়েছিলো সাজিয়াকে অস্বস্তি ছাড়া খেতে।সাজিয়াও আজ খেলো।নিশীথ খাওয়ার সময় তাকায়নি সাজিয়ার দিকে। যদি সাজিয়ার অস্তিত্ব হয় এই ভেবে।নিশীথ সাজিয়াকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছে।
–
অরিহা মাঠের এক কোণায় দাঁড়িয়ে গল্প করছিলো নাজিফা এবং আরো দুই তিনজন মেয়ের সাথে।সামনে প্রহররা ক্রিকেট খেলছে।আজকে আরমান আঙ্কেলের সাথে আসার সময়ও তাড়া ঝগড়া করেছে।তবে তা ইশারায়।অরিহার আরমান সাহেবের সাথে বেশ ভাব জমেছে।বড্ড ভালো লোক তিনি।অরিহা ভেবে পায় না তিনজন ভালো মানুষের মাঝে এই বদের হাড্ডিটা কিভাবে হলো।হুট করে সবার মাঝে নাহিফ নামের একটি ছেলে অরিহাকে ডাক দিলো।অরিহা নাজিফাকে বলল,,
“এই ছেলেটা কে নাজিফা।আমাকে কেনো ডাকছে বল তো”
“তুই এক কাজ শোন কি বলে”
নাহিফকে অরিহা বলে,,,“আপনার কিছু বলতে ইচ্ছে করলে এখানেই বলুন না হয় বলার প্রয়োজন নেই”
নাহিফ আমতা আমতা করে বলল,,“আসলে তোমাকে আমার ভালো লেগেছে। তুমি কি প্রেম করবা আমার সাথে?”
অরিহা বিষ্মিত হলো।কারণ এর আগে সে কখনো এমন পরিস্থিতিতে পরেনি।এরপর চিত্রার সেদিনের কথাগুলো মনে পরলো।সে নিজেকে শক্ত করে বলল,,
“দেখুন আমি এই সবে আগ্রহী না।আপনি আসতে পারেন। আর কখনো আমাকে বিরক্ত করবেন না। নাহলে কিন্তু হেড স্যারের কাছে নালিশ করতে বাধ্য হবো”
নাহিফ দুঃখিত বলে চলে গেলো।প্রহর দূর থেকে দাঁড়িয়ে সবই খেয়াল করেছে।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলো নাহিফ নামক ছেলেটিকে।তবে অরিহা যে তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা বেশ বুঝতে পেরেছে।হাসলো সে ভীষণ কারণ নাফিন ছেলেটি নিজেকে স্কুলের সব থেকে সুদর্শন ছেলে মনে করে নিজেকে।আজ সেই ছেলেকে নতুন আসা একটি মেয়ে মুখের ওপর প্রত্যাখ্যান করেছে ভাবা যায়।ছেলেটি দশম শ্রেনীতে পড়ছে।সিনিয়র বিধায় কিছু বলতেও পারে না প্রহর।না হয় এটাকে অনেক আগেই সোজা বানিয়ে ফেলতো সে।অরিহার বান্ধবীরাও হাসলো এই ব্যাপার নিয়ে।
#চলবে~