#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭
হাত থেকে টাপাটপ র*ক্ত ঝরছে। চোখ দিয়ে বের হচ্ছে আগুনের স্ফুরণ। আশে পাশে কয়েকজন কাতরাচ্ছে সেদিকে খেয়াল নেই এই লৌহ মানবের। সে যেন হৃদয়হীন। তার হৃদয়হরণী’র গায়ে আঁচড় লাগবে তার প্রতি নিশ্চিত সে হৃদয়বান হবে না। সব সময় তার হাতে হকি স্টিক থাকলেও এবার ছিলো রড। যার ফলে যেখানেই একবার আঘাত লেগেছে সেখান থেকে ফেটে র*ক্ত ঝরছে। পূর্ণ নিজেও ব্যাথা পেয়েছে কিন্তু সেটা তার শরীরে লাগছে না। র*ক্ত তার গরম এখন। টগবগ করছে। তান্ডব সে ঘটিয়েছে তবুও বক্ষে শান্তি নেই। আসল হোতা’কে এখন সে সায়েস্তা করতে পারে নি। এগুলো সব চ্যালাপেলা। পুলিশ এসে তারাতাড়ি পূর্ণ’কে ধরে। নিচু কন্ঠে বলে,
— পূর্ণ ভাই ছেড়ে দিন। খু*নাখু*নি হলে সমস্যা। মামলা হয়ে যাবে।
পূর্ণ গা ঝাড়া দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। বিশ্রী এক গালি দিয়ে পুলিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
— ঐ কু*ত্তার বাচ্চাকে ধরুন নাহয় এবার খু*ন আমার হাতেই হবে।
কথাটা বলেই রড’টা পাশের ঝোঁপে মারলো। পুলিশ তখন আহতদের ধরছে। এদের এখন জেলে নেয়া যাবে না আগে হসপিটালে নিতে হবে। পুলিশ অফিসার মায়ান কপালের ঘাম মুছলেন। এখন এর জবাবদিহি তো তাকেই করতে হবে। পূর্ণ’র হাতে একজন পানি ঢালতেই লাল রং ধারণ করে পানিগুলো গড়িয়ে পরলো। মুখে পানি ছিটিয়ে অফিসার মায়ানে’র হাতে পঁচিশ হাজার টাকা দিলো। তাচ্ছিল্য করে বললো,
— আশা করি এই টাকা দিয়ে কপালের ঘাম মুছে যাবে।
— জ্..জ্বি ভাই।
বলেই মায়ান এগিয়ে গেলো। পেছন থেকে পূর্ণ বলে উঠলো,
— সবগুলোই টাকা’র পা চাটা।
মায়ান কথাটা শুনলো কিন্তু কিছু বললো না। এইসব কথা গায়ে মাখতে নেই। নেতাদের মুখ খারাপ হবেই। ভেবে নিজেকে স্বান্তনা দিলো।
.
একটা গাড়ি এসে থামলো সোজা মৃত্তিকার বাসায়। দারোয়ান গেট খুলে দিতেই পূর্ণ বেরিয়ে এলো। এদিক ওদিক না তাকিয়ে একেবারে দরজায় নক করলো। একজন মধ্যেবয়স্ক মহিলা দরজা খুলে বললো,
— কাকে চাই?
বিনিময়ে পূর্ণ তাকে সালাম জানালো। মহিলাটা হেসে বললেন,
— ভেতরে আসুন।
পূর্ণ ভিতরে ঢুকেই বললো,
— মৃত্ত কোথায়?
— মৃত্ত?
— এ বাড়ীর মেয়ে?
— ওহ আম্মাজান ঘুমায় হয়তো।
— ডেকে আনুন। বলুন পূর্ণ দেখবে তাকে একবার।
পূর্ণ’র কথাগুলো ছিলো নেতাশীল৷ কথা বলার ভঙ্গিমাই যথেষ্ট তার ব্যাক্তিত্ব ফুটাতে।
মহিলা যেন আদেশ শুনেই ছুটলেন। মৃত্তিকা তখন একটা বিড়াল ছাপার টিশার্ট আর প্লাজু পড়া। কিছুটা বিরক্ত হয়েই সে রুম থেকে বের হতেই যেন চক্ষু চরকগাছ। পূর্ণ ভাই ওর সামনে। ওর বাসায়। তার থেকেও বেশি চমকায় পূর্ণ’র সাদা পাঞ্জাবি’তে র*ক্তের ছোপ দেখে। দৌড়ে এসে বললো,
— লাল দাগ কিসের? ব্যাথা পেয়েছেন?
মৃত্তিকা’র বিচলিত ভাব পূর্ণ’কে নরম করলে পারলো না। পূর্ণ দাঁত খামটি মে’রে বললো,
— দেখতে এসেছিলাম এক পলক। চোখের ক্ষুধা লেগেছিলো।
মৃত্তিকা কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই পূর্ণ বলে উঠলো,
— আমার সামনে না জেনে এই হালে এসেছেন। এরমানে সবার সামনেই যান। আপনাকে দেখে নিব মৃত্ত। এর ভয়াবহ শাস্তি পাবেন আপনি। তৈরি থাকুন।
কথাগুলো বলেই চলে গেল সদর দরজা পেরিয়ে। পেছনে রয়ে গেল কিংকর্ত্যবিমূঢ় মৃত্তিকা।
_________________
সারারাত ঘুমায় নি হিমু। চোখ দুটি যেন টেনেও খুলা দায়। লাল এই চোখ সাথে পাতলা একটা দেহ। কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ক্যানটিনে ছুটছে। এক কাপ চা ই পারবে ওকে এই দশা থেকে মুক্তি দিতে। হিমু যেতে নিলেই বোয়ালখালীতে ধাক্কা লাগে কারো সাথে। পাশের জন না পরলেও হিমু পরে যায়। সামনে তাকাতেই দেখলো রুপা। হিমু সরি বলে উঠে দাঁড়াতেই রুপা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললো,
— চোখের মাথা খেয়েছো?
হিমু একটু হেসে আবারও সরি বলতেই রুপা ব্যাঙ্গাত্মক ভাবে বললো,
— হিরোঞ্চি’দের মতো চোখ মুখ। নিশ্চিত হোস্টেলের বাইরে রাতে গা*জা টানো?
কথাটা যেন হিমুর বুকে গিয়ে লাগলো। মধ্যবিত্তদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য খারাপ না হয়েও যদি শুনতে হয় সেটা বেশ গায়ে লাগার মতোই। হিমু শুধু একবার তাকিয়ে বললো,
— সারারাত আপনার নতুন নোট গুলো তুলেছি। ঘুমাতে পারি নাই। ফজরের নামাজ পড়েই বাসা থেকে বের হয়েছি। তাই চোখ এমন হয়ে আছে।
বলে আর অপেক্ষা করলো না। সোজা ক্যান্টিনে ঢুকে চা আর পরটা ভাজি নিয়ে বসে পরলো। এভাবে বলাটা উচিত হয় নি রুপার। মনে মনে ভাবলো হিমু৷ উজ্জ্বল কোথা থেকে উড়ে এসে জুরে বসলো। হিমুর প্লেট থেকে পরটা নিয়ে ভাজি ভরে মুখে পুরে নিলো। হিমু মুখ কুঁচকে তাকিয়ে বললো,
— দেখ উল্টা পাল্টা কথা বলবি না। আমি কিন্তু রেগে আছি।
কথাটা বলতে গিয়েও সারা মুখে রাগ ফুটাতে চাইলো কিন্তু আফসোস হলো না। কিছু মানুষ ই থাকে এমন। এরা হাজার রাগলেও মনে হয় এরা ফাইজলামি করছে। ওদের কথার মাঝেই দশ কি এগারো বছর বয়সী একটা ছেলে পরটা, ভাজি আর চা এনে দিলো। উজ্জ্বল খেতে খেতে হিমু’তে ক্ষেপাতে বললো,
— এই রুপা’কে ছাড় তোকে সুশমিতা সেন এনে দিব।
উজ্জ্বলের বাজে কথায় হিমু’র রাগ হলো। চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে বললো,
— আমার প্রেম তোর সহ্য হয় না কেন? নিজে কাউকে পায় না তাই আসছে আমার রুপা’কে নিয়ে টানাটানি করতে।
উজ্জ্বল হেয়ালি করে বললো,
— ঐ ছেড়ী রুপা’কে দেখলেই আমার গা জ্বলে আর আমি কি না ওর মতো কাউকে চাইব?
হিমু আর দাঁড়ালো না। এই অহেতুক কথা শুনার মানে হয় না। ও যেতেই উজ্জ্বল মনে মনে বললো,
— এই রুপাই তোর জীবন নষ্ট করবে। রঙিন চশমা খুললেই দেখতে পাবি। শ্যা*লা উপন্যাস ভাবসে জীবনকে।
_________________
মৃত্তিকা আজ ভার্সিটি যাবে না। কাল পূর্ণ ভাই যেই হুমকি দিয়ে গেলো। ওনার মুখের কথা যে হেরফের হবে না তা ঠিক জানে মৃত্তিকা। তাই তো মন চাইছে না যেতে। যদি মাইর টাইর দেয়? ওই হকি স্টিকের এক বারি ও মৃত্তিকা’র এই দেহ সহ্য করতে পারবে না। এই বয়সেই যদি প্রাণটা হারায়? এমন হাজার ও অযাচিত জল্পনা কল্পনা করতে লাগলো। তখনই হাতে খাবার নিয়ে ওর বাবা রুমে ঢুকে বললো,
— কি করছে আমার মা?
— আব্বু?
ওর বাবা খাবারের ট্রে টা সাইড টেবিলে রাখলেন। মেয়ে’র পাশে বসে মাথায় হাত রেখে দোয়া পড়ে সারা শরীর ঝেরে দিয়ে বললেন,
— কি মা। বলুন আব্বু’কে?
মৃত্তিকা কিছু বললো না। আব্বু নিশ্চিত টেনশন করবে? তাই মাথাটা বাবা’র বুকে রাখলো। ওর বাবা মেয়ে’কে আরেকটু টেনে বুকে নিয়ে বললেন,
— কি হয়েছে আব্বুর জান’টার?
— আজকে ভার্সিটি না যাই?
— বোকা মা আমার। আপনি চাইলেও আব্বু যেতে দিতো না আজ। দেখি হাতটা।
মৃত্তিকা হাত দেখালো। হালকা ছিঁলেছিলো। শুকিয়েও গিয়েছে। ওর বাবা মেয়ে’র হাতে চুমু খেয়ে বললেন,
— আব্বু আজকে ব্রেকফাস্ট বানিয়েছি। এখন খাওয়াবো। চুপ করে খাবেন। দুপুরে বিরিয়ানি রান্না করব একসাথে।
— অফিস যাবে না?
— উহু। আমার জান তো অসুস্থ তাকে রেখে গিয়ে কি কাজ করতে পারব?
কথা বলতে বলতে মেয়েকে খাওয়ালেন ভদ্রলোক। মৃত্তিকা’কে মেডিসিন দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
— গত রাতে ঐ ছেলেটা কেন এসেছিলো?
— আমাকে দেখতে। তোমাকে বলতেই মনে নেই। কে বললো মিঠি’র মা?
— হ্যাঁ। ছেলেটাকে ধন্যবাদ ভালো ভাবে দেয়া হলো না। একদিন দাওয়াত করব।
— আচ্ছা।
বাবা মৃত্তিকা’কে নিয়ে রুম থেকে বের হলেন। বাপ বেটি মিলে আজ রান্না করবে। অনেকদিন হলো একসাথে রান্না করা হয় না। সকালটা বেশ আনন্দে কাটলো মৃত্তিকা’র। বাবা’র সাথে অনেক মজা করেছে। ওদের দেখে মিঠি’র মায়ের চোখ ভরে উঠলো। এই বাপ বেটি একজন আরেকজনের জান। মা মরা মেয়েটার দিকে তাকিয়ে ভদ্রলোক আর সংসার পাতেন নি। এই মেয়ে নিয়ে দিব্যি ভালো আছেন। বাসায় থাকলেই দুজন মিলে পুরো মাতিয়ে রাখে। মৃত্তিকা’র মাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন উনি। সেই ভালোবাসা হারিয়ে গেলেও তার চিহ্ন’কে আগলে ভালো থাকার চেষ্টা করছেন।
দুপুরেও বাবা’র হাতে বেশ মজা করে খেলো মৃত্তিকা। বাবা’র কোলে মাথা রেখে মায়ের গল্প করতে করতে এক সময় ঘুমিয়ে ও গেলো সেই শ্যামকন্যা। বাবা’র রাজ্যের রাণী।
মৃত্তিকা’র চুলে হাত বুলিয়ে মনে মনে ভাবলেন, ছেলেটার সাথে দেখা করতে হবে। কিছু তো আছে। বাবা-মা দুইজনের দায়িত্ব পালন করে এসেছেন তিনি। মেয়ে তার থেকে কিছু লুকায় না। যথাসম্ভব ভালো বন্ধু সে তার মেয়ের। কিছুটা আন্দাজ করেছেন তিনি। ভেবেই দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার মা টা কত বড় হয়ে গেলো। বাবা থেকে কথা লুকায়। কার জন্য এই লুকোচুরি সেটা সে দেখে নিবে।
#চলবে…..