#শান্তি_সমাবেশ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩০
” আমি আপনার নিকট একটা খোলা বই মৃত্ত। যেখান থেকে খুশি পড়ে নিন আমায় তবে হুট করে মাঝ থেকে পড়বেন না। অবশ্যই শুরু থেকে শেষ করবেন কারণ মাঝপথে হঠাৎ করে পড়লেই জটিলতায় আটকে যাবেন।”
কথাগুলো তাদের প্রণয় চলা কালীন সময়ে পূর্ণ বলেছিলো। যদিও পূর্ণ’র ভাষায় তাদের প্রেম ছিলো না তবে মৃত্তিকা’র ভাষায় ছিলো। মৃত্তিকা’র বারান্দায় বসে হঠাৎ করেই পূর্ণ’র বলা কথাগুলো মনে পরলো। তাহলে কি মৃত্তিকা মাঝ পথে এসেছে হুট করে? নাহলে কেন এতটা অচেনা লাগলো আজ পূর্ণ’কে? প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর জানা নেই। আর না ই আছে উত্তরদাতা।
বারান্দার ফ্লোরে বসে একমনে চাঁদহীনা আকাশ পানে তাকিয়ে কথাগুলো ভেবে যাচ্ছে মৃত্তিকা। গালে এখনও ব্যাথা করছে ওর। জীবনে বলতে গেলে এমন ভাবে পাওয়া প্রথম আঘাত এটা। বাবা কখনো হাত তোলা তো দূর ধমক ও দেয় নি ওকে। টিচারদের থেকেও জীবনে মা’র খাওয়া হয় নি। পূর্ণ হয়তো শুধু গালটা চেপে ধরেছিলো কিন্তু আঘাতটা ছিলো অসহনীয়। প্রিয় পুরুষের দেয়া অল্প আঘাত ও যে হৃদয় ফালাফালা করে দেয়। হঠাৎ করেই মৃত্তিকা’র ওর বাবা’র কথা মনে পরলো তীব্র ভাবে। আজকে বাবা’র কাছে যাওয়া হয়ে উঠে নি৷
সময়টা তদের এমন হওয়ার ও কথা ছিলো না। কথা ছিলো পূর্ণ’র হাত ধরে এখন কিছু একাকী সময় কাটানোর। তাহলে কেন পূর্ণ সব নষ্ট করলো? কেন ওমন আচরণ করলো মৃত্তিকা’র সাথে?
অস্পষ্ট স্বরে মৃত্তিকা কেঁদে উঠলো। ডেকে উঠলো, “বাবা”।
_______________
মৃন্ময় হাওলাদার আজ একাই ছাদে এলেন৷ মেয়ে ছাড়া তার ছাদে উঠা নিষিদ্ধ। এই নিষেধাজ্ঞা অবশ্য মৃত্তিকা নিজে করেছিলো। কারণ টা ছিলো অদ্ভুত।
পাশের বাড়ীতেই একটা মেয়ে থাকে। এই তো আষ্টাদশী হবে। মৃন্ময় হাওলাদারের সাথে ভাব জমিয়েছিলো প্রচুর। তিনি ও বেশ আদর করতেন। বাবা পাগল মৃত্তিকা’র তা মোটেও সহ্য হয় নি। বাবা’কে বেশ কঠর গলায় নিষেধ করে ঐ বাড়ীর মেয়ে থেকে দূরে থাকতে। মৃন্ময় হাওলাদার ও হেসে মাথা নেড়েছিলেন। অতঃপর মেয়ের ছেলেমানুষী মনে করে ভুলেও গিয়েছিলেন।
মনের ভুলেই একবিকেল ছাদে চা হাতে তিনি উপস্থিত হন। কথা ছিলো মৃত্তিকা কলেজ থেকে এসেছে তাই ফ্রেশ হয়ে বাবা’র কাছে ছাদে যাবে। কিন্তু যখন ছাদে গেলো তখনই দেখলো ওর বাবা ঐ বাড়ীর মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে এমনকি চা ও দিয়েছে নিজের।
অভিমানী আর একাচোরা মৃত্তিকা চুপ করে নিজ কক্ষে চলে যায়। ঘন্টা গড়াতেই মৃন্ময় হাওলাদার নিচে আসেন মেয়েকে দেখতে। এতক্ষণ তো তার কন্যা’র লাগে না গোসলে। এসেই দেখেন মৃত্তিকা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। ঘুমন্ত মেয়ে ডাকেন না তিনি কখনো। তাই ভেজা চুল গুলো সুন্দর করে নেড়ে কপালে চুমু খেয়ে চলে যান। যদিও ব্যাপার টা স্বাভাবিক ছিলো তবে মানতে পারে নি মৃত্তিকা। বাবা ডাকে নি তাকে ভেবেই রাগে সেই বিকেল থেকে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত কেঁদেছে বালিশে মুখ গুজে। মৃন্ময় হাওলাদার যখন সন্ধ্যায় রুমে আলো জ্বালাতে এলেন তখন হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন ওভাবে মেয়েকে দেখে।
সারাটা রাত ঐদিন মেয়েকে বুকে নিয়ে জেগে ছিলেন কারণ মৃত্তিকা’র জ্বর উঠেছিলো। মেয়েটা তার বড্ড অভিমানী। সেই থেকে তার একা ছাদে উঠা হয় নি।
আজ এতদিন পর এসে পাশের ছাদে তাকালেন। না ঐ বাড়ীর মেয়েটা নেই। মেয়েটার বাবা প্রবাসী তাই মৃন্ময় হাওলাদারের থেকে আদর নিতে এসে পরতো ছাদ টপকে।
রাতের আকাশে তাকাতেই মৃন্ময় হাওলাদারের মনে হয় আকাশটা উদাসীন। আচ্ছা এই উদাসীনতা কেন আজ? মন্ময় হাওলাদারের বিফলতা দেখে? বুক চিড়ে তার দীর্ঘ শ্বাস বের হয়। আজকে তার রাজকন্যা আসে নি। পূর্ণ’র সাথে নিশ্চিত সুন্দর সময় কাটাচ্ছে। মন্দ হাতে তুলে দেন নি তিনি তার রাজকন্যা’কে। চিনতে ভুল করেন নি। কিন্তু মনটা তবুও তার বিষন্ন ভরা। কারণ টা জানা নেই। মন বলছে তার রাজকন্যা ভালো নেই অথচ মস্তিষ্ক জানে রাজকন্যা এখন সুখের রাজ্যেই আছে।
মনকে বুঝ দেন মৃন্ময় হাওলাদার। পূর্ণ তার রাজকন্যা’র গায়ে ফুলবাদে কিছুর টোকা পড়তে দিবে না।
.
অন্ধকারে ঘেরা রাত্রি। চাঁদ আজ লুকিয়ে মেঘের আড়ালে। পূর্ণ বাড়ি ফিরিছে। রাগ পরেছে কি না বুঝা গেলো না। তবে মন তার মৃত্ত’র কাছে পড়ে।রুমে ঢুকা মাত্রই যেমনটা রেখে গিয়েছিলো ঠিক তেমনটাই পেলো। হঠাৎ মনে হলো তার মৃত্ত চলে গিয়েছে। পরক্ষণেই চোখ বুজে অনুভব করার চেষ্টা করলো। মন বলছে মৃত্তিকা আশেপাশেই আছে। সারা রুমে চোখ বুলিয়ে বারান্দায় গেলো পূর্ণ। সেখানেই নিজের ধ্বংস’র দেখা পেলো। এই নারী তার ধ্বংসের একমাত্র কারণ। এলোমেলো মৃত্তিকা হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আঁচলটা তার কাঁধ থেকে চ্যুত হয়েছে। খোলা বুকেটা টানলো পূর্ণ’কে খুব করে৷ দপদপিয়ে জ্বলে উঠে পূর্ণ’র কায়া। চোখের কোটরে জমে উঠে পানি। ধারণ করে তার অক্ষি লাল রঙ। ধীমি পায়ে এগিয়ে এসে একদম মৃত্তিকা’র কাছে বসে। কাছ ঘেঁষে। দুইবার শ্বাস টানে জোরে জোরে। পরপর মুখটা তুলে চুমু খায় মৃত্তিকা’র গলার নিচে। কেঁপে উঠে মৃত্তিকা’র কায়া। পূর্ণ থেমে নেই গলায় মুখ রাখে তার। হঠাৎ অল্প ব্যাথায় ঘুমের ঘোরে গুঙিয়ে উঠে মৃত্তিকা। চোখ খুলে পূর্ণ’কে দেখে সরাতে চায়। পারে না। পূর্ণ দু-হাতে শক্ত করে ধরেছে। মৃত্তিকা অল্প স্বরে জানায়,
— ব্যাথা।
পূর্ণ যেন শুনলো না বা চাইলো না শুনতে। তীব্র ভাবে সূক্ষ্ণ দাঁতের সূচালো ব্যাবহার করলো গলদেশে। ছটফটিয়ে উঠে মৃত্তিকা। ভাঙা স্বরে বললো,
— পূ..পূর্ণ আমি অনেক ব্যাথা পাচ্ছি।
ভাবলো হয়তো পূর্ণ থামবে কিন্তু তা হলো না। পূর্ণ এবারেও একটু থেমে আবারও জোরে কাঁমড়ে দিলো। মৃত্তিকা’র মনে হলো জায়গাটা থেকে হয়তো মাংস খুবলে নিতে চাইছে পূর্ণ। “বাবা” ডেকে আর্তনাদ করে মৃত্তিকা। সরতে চায়। ধাক্কা দিলেও কাজ হয় না। পূর্ণ নিজের করা ক্ষততে চুমু খায়। কিন্তু কাজ হয় না। মৃত্তিকা ফুঁপাচ্ছে। তখনও মুক্তি চাইছে পূর্ণ’র বন্ধনী থেকে। ছটফট করে যাচ্ছে অনবরত। মুখ তুলে পূর্ণ। এগুলো ঠোঁটের দিকে। লুফে নিলো নিজ শ্যামলা নারীর সেই পাতলা ওষ্ঠাধর। মৃত্তিকা’র গাল গড়িয়ে শুধু পানিই ঝড়ে গেলো৷ নিজের মুখে নোতনা স্বাদ পেতেই পূর্ণ চোখ মেললো। সোজা নজর পরলো মৃত্তিকা’র চোখে। কিছু একটা পেলো পূর্ণ সেই চাহনীতে। হ্যাঁ, মুক্তি চাওয়া পেলো। মৃত্তিকা মুক্তি চাইছে তার থেকে। পূর্ণ ধীরে সুস্থে ওষ্ঠ ত্যাগ করলো। দৃষ্টি পাত করলো মৃত্তিকা’র কাটা ঠোঁটে। মাত্র নিজেই করেছে ও এটা৷ গলা দিয়ে কন্ঠ ঠেলে বের করে বললো,
— বলেছিলাম না আমার সুন্দর রাজনী নষ্ট করার শাস্তি দিব। গলার টা ঐ শাস্তি ছিলো আর ঠোঁটের টা ছিলো আমাকে ব্যাকুল করার জন্য।
নাজুক মৃত্তিকা। বাবা’র রাজকন্যা আজ সামলাতে পারে না নিজেকে। সামনের পুরুষটাকে তার অচেনা ও মনে হচ্ছে না বরং খুব চেনা মনে হচ্ছে। এই হলো সেই প্রথম পূর্ণ যাকে মৃত্তিকা চিনতো। যে জানে শুধু শাস্তি দিতে। নিজের কথা মোতাবেক মৃত্তিকা’কে চালাতে। এতদিন বরং ও পূর্ণ’কে ভিন্ন রুপে পেয়েছিলো। ভালোবাসা ময় একটা পূর্ণ’কে দেখেছিলো।
পূর্ণ আলতো হাতে মৃত্তিকা’র আঁচলটা কাঁধে তুলে দিলো। দুইহাত বাড়াতেই মৃত্তিকা বাঁধা দিলো। পূর্ণ’র দেয়া আগের কার কষ্ট আর এই কষ্ট আলাদা। তখন পূর্ন’র প্রতি ছিলো আকর্ষণ, কিছুটা টান তবে এখন সেটা রুপান্তরিত হয়েছে ভালোবাসা আর মায়া’য়। আঘাতটা অবশ্যই ভালোবাসার মানুষ থেকে পাওয়াটাই বেশি লাগে।
পূর্ণ দমলো না। একপ্রকার জোর করেই কোলে তুলে নিলো মৃত্তিকা’কে। প্রতিবারের ন্যায় পূর্ণ’র গলা জড়িয়ে ধরলো না মৃত্তিকা। কেমন চুপ হয়ে আছে মেয়েটা। আঘাতগুলো ছোট হলেও দাগ কেটেছে গভীর ভাবে। খুব সূক্ষ্ণ ভাবে ঝাঁঝড়া করেছে মৃত্তিকা’র চড়ুই সমান মনটাকে।
রুমে এনে বিছানায় বসাতেই পূর্ণ সম্পূর্ণ আলোতে এবার তার মৃত্ত’কে দেখে নিলো। আজ শ্যামলা বলে নাহলে তখন গালে চাপটাও রাগের মাথায় আস্তে দেয় নি পূর্ণ। শ্যামলা গালেই আবছা বুঝা যাচ্ছে। হাত বাড়িয়ে তাতে ছুঁয়ে দিতেই ব্যাথাকাতুর শব্দ তুললো মৃত্তিকা। ছোট্ট করে শুধু বললো,
— বাবা’র কাছে যাব।
— আজ না।
ছোট্ট কথার পৃষ্ঠে ছোট্ট উত্তর পূর্ণ’র। গলায় তাকাতেই এতক্ষণের জমানো রাগগুলো কিছুটা কমতে চাইলো৷ র*ক্ত জমে নেই শুধু বরং গড়িছেও কিছুটা। চিকন ধারা বয়ে কাঁধে থেমেছে। পূর্ণ নিজের কাছে নিয়ে মুখ আবার সেই ক্ষততে নামাতেই মৃত্তিকা অনুরোধের সুরে বললো,
— অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার পূর্ণ। ওখানে আর না।
এই নিয়ে পরপর দুইবার আজ মৃত্তিকা ওর নাম মুখে নিলো। আচ্ছা শাস্তিটা কি বেশি হয়ে গেল? পূর্ণ তো আরো ভয়াবহ কিছু ভাবছিলো কিন্তু তা দেয় নি। পূর্ণ’র চুমুর স্পর্শ ও আজ জ্বালিয়ে দিলো মৃত্তিকা’র গলদেশ। খামচে ধরলো পূর্ণ’র চুল। সরাতে চাইলো। জায়গাটা তার ভয়ংকর ভাবে জ্বলছে। পূর্ণ সরলো। নিজের খসখসা হাতে গাল জড়িয়ে নিলো মৃত্তিকা’র। ঠান্ডা স্বরে জানালো,
— আপনার কষ্ট টা দৌহিক কিন্তু আমারটা আমার হৃদপিন্ডে মৃত্ত। আপনি আজ আমার হৃদপিণ্ডটাতে আঘাত দিয়েছেন। সেই অনুযায়ী কি শাস্তিটা নগন্য ছিলো না? বলুন।
কপালে কপাল ঠেকালো পূর্ণ। মৃত্তিকা কেঁদে ফেললো। হিচকি তুলে তুলে কাঁদছে সে। কম্পমান তার ওষ্ঠে আলত ঠোঁট ছোঁয়ালো পূর্ণ। জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। কাটা ঠোঁটে ওষ্ঠ ছুঁয়িয়ে আবার বললো,
— আর কাঁদে না।
মৃত্তিকা শুনলো না। তার কষ্ট হচ্ছে সেটা প্রকাশ করার মাধ্যমই তার কান্না। পূর্ণ এবার ধমকে উঠলো। ছিটকে সরতে চাইলো মৃত্তিকা। তবে অপারগ হলো। পূর্ণ তখন ছোট ছোট আদরে ভাসাচ্ছে তার পূর্ণময়ীকে। পূর্ণ খেই হারাতেই মৃত্তিকা আটকে দিলো। কিছুটা অভিমানী কিছুটা দৃঢ় কন্ঠে বললো,
— কথা দিয়ে করা জখমে কথা দিয়ে মলম লাগান। এভাবে না।
পূর্ণ জোরে শ্বাস টেনে নিলো। নিজের সাথে আরেকটু জড়িয়ে ধরলো তার মৃত্ত’কে। আবেশ জড়ানো কন্ঠে শুধালো,
— আপনি গল্পের মাঝখানে চলে গিয়েছেন মৃত্ত। শুরু থেকে পড়ার চেষ্টা করুন।
মৃত্তিকা বুঝলো। তবুও প্রশ্ন করলো,
— শুরুটা ঠিক কোথায়?
— আমায়।
আর বাক্য বিনিময় ঘটলো না। পূর্ণ ঘটতে দিলো না। জমিয়ে রাখা তার আদর, ভালোবাসা উথলে দিলো তার মৃত্ত’তে। দিশেহারা মৃত্তিকা বাঁচতে চাইলো আপ্রাণ তবে তা সম্ভব হলো না। পূর্ণ নিজেতো ডুবলো সাথে নিলো মৃত্তিকা’কে।
#চলবে…..