বর্ণহীন রংধনু পর্ব-০১

0
296

#বর্ণহীন_রংধনু (পর্ব ১)
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ

‘ফাহাদের ফোনে একটা অপরিচিত মেয়ের সাথে তার কিছু ঘনিষ্ঠ ছবি দেখে বুকটা চিনচিন করে উঠে চৈতির। সেলফিতে হাস্যজ্জল মুখে একে অপরের সাথে ঘেঁসে মেয়েটার বাহু আঁকড়ে ধরে আছে ফাহাদ। বর্তমান যুগে এসব অসভ্যতা খুবই নরমাল একটা বিষয় হলেও এক অজানা ভয়ে বুকের ভেতরটা ধুকপুক করে উঠলো চৈতির। ফাহাদ কি তার অগোচরে কোনো পরকিয়ার সম্পর্কে জড়াচ্ছে?’

বিছানায় তার এক বছরের ছেলে ফাহিমের কান্নার শব্দ ভেষে উঠে। ফাহাদের ফোনটা আগের জায়গায় রেখে ছেলের কাছে চলে যায় চৈতি। ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে পরপর কয়েকটা চুমুতে আদরে ভরিয়ে দিলো সে। মুহুর্তেই কাঁন্না থেমে যায় শিশুটির।

শাওয়ার নিয়ে কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে আসে ফাহাদ। টি-শার্ট গায়ে জড়িয়ে চৈতির সামনে গিয়ে দাড়ায় সে। ক্ষনিকটা মৃদু হেসে চৈতির কাছ থেকে ছেলেকে কোলে তুলে নেয়।
এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে চৈতি। বাবা ছেলের এই দৃশ্য সে প্রায় দেখলেও আজ অন্যরকম তার দৃষ্টি। ফাহাদ ক্ষনিকটা বুঝতে পেরে এগিয়ে আসে তার সামনে। চৈতির গালে হাত রেখে বলে,
“তোমাকে এমন বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন?”

চৈতি ক্ষনিকটা সময় নিশ্চুপ থেকে অতঃপর বলে,
“আমি তোমাকে খুব বেশি ভালোবাসি ফাহাদ। নিজের থেকেও বেশি।”
ফাহাদ ক্ষনিকটা বিষ্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
“আজ হটাৎ এই কথা!”
চৈতি মুখে শুকনো হাসি ফুটিয়ে বলে,
“ইচ্ছে হলো তাই বললাম। যেন কখনো আমার ভালোবাসার কথা ভুলে না যাও তাই।”
ক্ষনিকটা মৃদু হাসলো ফাহাদ। চৈতিকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বলে,
“আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি প্রিয়তমা।”

মানুষ কত গুছিয়ে মিথ্যা বলতে পারে। আচ্ছা ফাহাদের কথার মাঝে তেমনই কোনো মিথ্যার অস্তিত্ব নেই তো? চৈতির মাঝে চিন্তার ছাপ এমন ভাবে ফুটে উঠেছে যে, এমন মিথ্যে মেনে নেওয়ার শক্তিটুকুও তার নেই।

ছোট বেলায় তার বয়স তখন ৯ ছিল। ঘরে তার একটা ফুলের ডিজাইন করা কাঁচের মগ ছিল। সে নিজেই পছন্দ করে বাবাকে বলেছিল কিনে দিতে। যেটা তার এতটাই শখের ছিল যে, একদিন বাড়িতে মেহমান আসার পর তাড়াহুরো করতে গিয়ে মা সেই মগে এক মেহমানকে চা দিয়েছিল। চৈতি তা দেখে এক মুহুর্তও দেড়ি করেনি। চায়ে চুমুক দেওয়ার আগেই মেহমানের হাত থেকে কাপ টা নিয়ে ফ্লোরে সজোড়ে ছুড়ে মারে। ফলস্বরূপ এতগুলো মানুষের সামনেই টুকরো টুকরো হয়ে যায় সেটা।
তবুও যেন নিজের রাগকে শান্ত করতে পারেনি চৈতি। কারণ তার শখের জিনিসে অন্য কারো হাত লাগাটা একদমই অপছন্দের তার। তার এই একঘেয়েমি ছোট বেলা থেকেই। প্রয়োজনে শখের জিনিসটাই ধ্বংস করে পেলবে। তবুও অন্য কারো অস্তিত্ব মেনে নিবে না সে।
,
,
নিরবে
কেটে গেলো কয়েকটা দিন। আজ হটাৎ বিরিয়ানি রান্নার ইচ্ছে জাগলো চৈতির। ফাহাদের প্রিয় খাবার এটা। বারোটার আগে রান্না শেষ করে চৈতি। ফাহাদের অফিস কাছেই। সেই সুবাদে সিদ্ধান্ত নিল ফাহাদকে একটা ছোটখাটো সারপ্রাইজ দেওয়া যাক। আজ সকালে বের হওয়ার সময় খাবারের বক্স দেয়নি। বলেছিল, রান্না করতে ইচ্ছে করছে না। বাইরে থেকে খেয়ে নিতে। ফাহাদও ছোট একটা হাসি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

রান্না শেষে আধা ঘন্টা সময় নিয়ে তৈরি হয়ে নেয় চৈতি। টিফিন বক্সে বিরিয়ানি নিয়ে বেড়িয়ে যায় ফাহাদের অফিসের উদ্দেশ্য। ঠোঁটের কোনো মৃদু হাসি তার। আরো একবার এভাবে খাবার নিয়ে গিয়েছিল সে। অনেক দিন আগে। তখন ফাহাদ জানতো চৈতি আসবে। কারণ সকালে ভুল করে বক্স বাসায় ফেলে গিয়েছিল ফাহাদ। তাই নিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আজ ফাহাদকে না জানিয়ে যাওয়ায় নিশ্চয়ই সারপ্রাইজড হবে সে। সাথে নিশ্চয়ই খুশিও হবে।

অফিসে পৌছালে ফাহাদের রুমটা দেখিয়ে দিল একজন। চৈতি চুপচাপ দরজা খুলতেই ফাহাদ কাজে ব্যস্ত থাকায় বলে উঠে,
“অপেক্ষা করুন।”
চৈতি ক্ষনিকটা মুচকি হেসে বলে,
“কয় মিনিট অপেক্ষা করতে হবে?”
পরিচিত কণ্ঠ পেয়েই চৈতির দিকে তাকায় ফাহাদ। ক্ষনিকটা অবাক হয়ে নিজেই উঠে চৈতির কাছে এগিয়ে আসে সে। ভেতরে নিয়ে বসতে দিয়ে নিজেও একপাশে বসলো। ক্ষনিকটা অবাক হয়ে বলে,
“তুমি হটাৎ, অফিসে! ফাহিমকে কার কাছে রেখে এসেছো?”
“ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে এসেছি। খাদিজা আছে তার কাছে।”
“হটাৎ আজ কি মনে করে?”
“তোমার পছন্দের বিরিয়ানি রান্না করলাম। ভাবলাম তোমাকে সারপ্রাইজ দেই। কেন খুশি হও নি?”
ফাহাদ ক্ষনিকটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“কি বলছো তুমি? কেন খুশি হবো না? এটা সত্যিই সারপ্রাইজ ছিল।”

চৈতির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল। লাঞ্চের সময় হয়েছে। এর মাঝেই একটা মেয়ে এসে বিনা অনুমতিতে প্রবেশ করে রুমে। প্রবেশ করতেই বলে,
“সকালে বললে, দুজন বাইরে লাঞ্চ করবো। তো আজ কোন রেস্টুরেন্টে লাঞ্চটা করছি ফাহাদ?”
বলেই চৈতিকে দেখে থেমে গেলো মেয়েটা। ফাহাদের রাঙানো দৃষ্টি দেখে ক্ষনিকটা ইতস্তত বোধ করে বলে,
“মানে ফাহাদ সাহেব। আপনি তো আজ খাবার আনেন নি। তাই ভাবলাম বাইরে লাঞ্চ করবেন কি না? সেটাই জানতে এসেছিলাম।”

চৈতি ভালো করে লক্ষ করে দেখে এটা সেই মেয়েটা। যার সাথে ফাহাদের ঘনিষ্ঠ ছবি দেখেছিল সে। তবুও এই ব্যপারে কিছু না বলে চুপ করে রইল। ফাহাদ পরিচয় করিয়ে দিল, ওর নাম,, শান্তা।

শান্তা চলে যাওয়ার পর ফাহাদের দিকে চেয়ে চৈতি বলে,
“কে এই মেয়েটা? তোমার সাথে লাঞ্চে যাওয়ার কথা বললো কেন?”
ফাহাদ স্বাভাবিক গলায় বলে,
“তেমন কেউ না। অফিস কলিগ। তাছাড়া মাঝে মাঝে কলিগরা মিলে একসাথে লাঞ্চ বা ডিনারে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয় সবাই। ওটার কথাই বলছিল হয়তো।”

কিছু বললো না চৈতি। কৌতুহলের সাথে সন্দেহকেও আপাতত মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখলো। অতঃপর ফাহাদের সাথে কিছুক্ষণ সুন্দর সময় কাটিয়ে বাসায় ফিরে আসে চৈতি।
,
,
কেটে গেলো আরো কিছু দিন। আজ দুপুরে চৈতির বড়ো বোন তিথি এসেছে বাসায়। তার বিয়ের চার বছর হলেও এখনো কোনো সন্তানের দেখা মেলেনি তার। তাই আসার পর থেকেই চৈতির ছেলে ফাহিমকে নিয়েই সময় কাটাচ্ছে সে।

সন্ধার পর ফোন বেজে উঠে চৈতির। হাতে নিয়ে দেখে ফাহাদের কল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ফাহাদ বলে, আজ অফিসের কলিগদের একটা ডিনার পার্টি আছে। ফিরতে দেড়ি হবে।

মাথাভর্তি টেনশন নিয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল চৈতি। ধারালো ছুরি টা ব্যাগে ভরে নিল সে। সেদিন ফাহাদের অফিস থেকে ফেরার পথে সেটা কিনে এনেছিল।
চোখ বন্ধ করে কয়েকটা শ্বাস নেয় চৈতি। অতঃপর ফাহাদের অফিসের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়ে বেড়িয়ে পরে সে। হয়তো আজই ফাহাদের সব মিথ্যার শেষ হবে, নয়তো চৈতির সন্দেহে কোনো ভুল থাকলে সেই ভুল ধারনা ভাঙবে।

আধা ঘন্টা হলো অফিস গেটের সামনে একটা রাস্তায় সিএনজিতে বসে আছে চৈতি। ফাহাদের অফিস ছুটির সময় আট টা। সময় হয়েছে তার অফিস থেকে বের হওয়ার।

কিছু সময় পার হওয়ার পর বের হয়ে আসে ফাহাদ। একা না। সাথে সেই শান্তা নামের মেয়েটা। রাস্তায় চলন্ত গাড়ি গুলোর মাঝে একটাকে হাত বাড়িয়ে থামিয়ে উঠে পরে দুজন। চোখ বুঁজে নিল চৈতি। নিজেকে শান্ত রেখে ড্রাইভারকে উদ্দেশ্য করে বলে গাড়িটা ফলো করতে।

একটা বাড়ির সামনে এসে দাড়ায় ফাহাদ ও শান্তার গাড়ি। দুজন গাড়ি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে চলে গেলো সে বাড়ির ভেতর। দুরে রাস্তার এক পাশে দাড়ানো চৈতির সিএনজি। ফোন বের করে ফাহাদের নাম্বারে কল করে সে। রিসিভ করেই ওপাশ থেকে ফাহাদ বলে,
“হুম, চৈতি বলো।”
চৈতি ছোট করে বলে,
“বাসায় ফিরতে কতক্ষণ লাগবে তোমার?”
ফাহাদ ব্যস্ত গলায় বলে,
“তোমাকে তো বললামই ডিনারের কথা। এখন কলিগদের সাথে আছি। ডিনার শেষেই বাসায় ফিরবো। চিন্তা করো না, মাই হার্ট।”

বলেই ফোন কেটে দিল ফাহাদ। একটা শ্বাস নিল চৈতি। তাহলে কি তার সন্দেহটাই সত্যি প্রমানিত হতে যাচ্ছে? ফোনটা বেজে উঠে চৈতির। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তার বড়ো বোন তিথি বলে,
“ফিরতে কতক্ষণ লাগবে তোর? ফাহিম কাঁদছে খুব।”
চৈতি শক্ত গলায় বলে,
“হয়তো খুব শিগ্রই ফিরে আসবো। আর ফিরতে দেড়ি হলে, কষ্ট করে সামলে নে।”

বলেই ফোন কেটে দিল চৈতি। ব্যাগ ফাক করে ছুরিটা একবার দেখে নিল সে। অতঃপর সিএনজি থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে সেই বাড়িটার দিকে পা বাড়ালো। মনে মনে একটাই দোয়া করছে, তার ভাবনা যেন মিথ্যা প্রমানিত হয়। প্রিয় মানুষটার হাত ধরে পুরো জীবন পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন টা যেন দুঃস্বপ্নে পরিনত না হয়। কারণ, মানুষটা তার খুব শখের। তার বুকে মাথা রেখে একটু জীবন নিশ্চিন্তে পার করার খুব ইচ্ছে ছিল তার। যে রংধনূর ন্যায় রাঙিয়ে রাখবে তার মনাকাশটা।

To be continue…………