যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-০৩

0
224

#যেখানে_পথচলা_শুরু |০৩|
#সাদিয়া_মেহরুজ

তীরু, রাজশাহী শহরের এক মফস্বল গ্রামে যার বেড়ে ওঠা বহু সংগ্রাম করে। সেই ছোট্ট তীরু আর আজকের সাহসী তীরুর মাঝে রয়েছে বেশ পার্থক্য! বাবা নেই তার। তিনি মা রা গেছেন। তীরুর তখন কেবল পাঁচ বছর বয়স। নিকট আত্নীয় স্বজন তার থাকলেও তারা তীরুর খোঁজ খবর নিতো না। তার কারণ তীরুর পরিবার ছিল অসচ্ছল। তীরুর চাচা, ফুপু তাদেরকে ছোট নজরে দেখতেন দারিদ্র্য- দুর্দশার কারণে। তানহার পছন্দ ছিল না তা। তাই সে মেয়েকে নিয়ে এসে ওঠেন সেই মফস্বল গ্রামে। তার পর হতেই শুরু হয় লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই, এই পৃথিবীতে টিকে থাকার লড়াই। তীরুর জন্মের পর তানহার আর পড়াশোনা করা হয়নি। এতে যেনো জীবন পরিচালনা করাটা ভারী দুষ্কর হয়ে পড়ে! তবুও দমেনি তানহা। গাধার খাটুনি খেটে মেয়েকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যথেষ্ট পরিমাণে সম্পদের মালিক হয়েছে। তীরুকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছে শেষে মাস্টার্স করতে দেশের বাহিরে পাঠিয়েছে। এত সব প্রাপ্তি সহজে হাতছানি দেয়নি। কি না সহ্য করেছে তানহা? বাজে লোকের উপদ্রব, প্রতিবেশীর কটু কথা আরো কতো কি! তবুও সে ছিল শক্ত মানুষ। তাই তো এতো দূর অব্দি তার আসা।
আর্থিক স্বচ্ছলতা আসতে শুরু করে দ্রুতই। ছোট্ট তীরু বিশাল স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়! সে মুক্তি পাখি। আকাশে ডানা মেলে উড়তে চায়। বিশাল পৃথিবী দেখার বড়ো শখ তার। কিন্তু তানহা যে মানে না। একা কোথায় যেতে দিতে রাজি নন তিনি। তীরু তবুও স্বপ্ন দেখে, একদিন সে পৃথিবীর সব দেশ ভ্রমণ করে ফেলেছে।

তীরুর এই মুক্তমোনা মন তানহার কেন যেন পছন্দ নয়। সে তীরুকে বিয়ে দিতে তাই উঠে পড়ে লাগে। তার মতে জীবনে চলার পথ একজন নারীর পাশে পুরুষের থাকা অতি আবশ্যক। নতুবা এগিয়ে যেতে বহু কষ্টের মাঝে পড়তে হয়। তার মেয়ে সেই কষ্ট সহ্য করতে পারবে না। তাই তো একজন সুপাত্রের হাতে তীরুকে তুলে দেয়ার এতোটা তোড়জোড় তার। তীরু মা কে বোঝাতেই পারল না, জীবনে চলার পথে পুরুষ মানুষ থাকা অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। নিজে ভালো হলে সব ভালো! তাছাড়া এ যুগে বউয়ের এমন আকাশে উড়ে বেড়ানোর স্বপ্ন কে – বা গ্রহণ করতে চায়? তীরুর ভয় হয়, বড্ড ভয়! যদি তার স্বপ্ন পূরণে বাঁধা দেয় তার জীবনসঙ্গী? তবে কি হবে? এই ভয়ের দরুন বিয়ের প্রতি তার এতোটা অনীহা। দু’জন দুই মেরুর বাসিন্দা! কারো মতের মিলই হয়না।

-” তীরু, এই তীরু! ”

তানহার অধৈর্য গলা। মেয়ের এরূপ স্তব্ধতা দর্শন করে তিনি বিরক্ত। ভীষণ ভীষণ বিরক্ত! এতোটা অবাক কেন হচ্ছে তীরু? সে তো তীরুকে বলেই রেখেছিল ছেলে দেখছে, একদিন হুট করে বিয়ের আয়োজন করে বসবে। বলেছে তো! তাহলে এখন এমন আহাম্মকের মতো হা করে তাকিয়ে আছে কেন মেয়েটা? আশ্চর্য!

তীরু হুঁশে এলো। ছটফটিয়ে বলল,

-” বিয়ে? আর ইউ সিরিয়াস মা? এখন বিয়ে? তুমি আমাকে কবুল বলতে বলছো! ”

তানহা বিরক্তিমাখা গলায় শুধালেন,

-” হ্যা এখনি বিয়ে। কানে শুনিস না নাকি? কবুল বল। কাজি সাহেব তাড়া দিচ্ছেন তো। ছেলে সেই কখন কবুল বলে দিয়েছে। দেখি সুন্দর করে মাথায় কাপড় দে তো। ঠিকঠাক হয়ে বস। ”

-” মা তুমি বলো তো এভাবে কি বিয়ে হয়? বিয়ে কি এতোটা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য টাইপ ব্যাপার নাকি? ছেলে কে? কি করে? তার বায়োডাটাও তো পাঠালে না। হুট করে এভাবে কি বিয়ে করা যায়? ”

-” কেন তোকে আগে থেকে বলে রেখেছিলাম না আমি হুট করে একদিন তোর বিয়ের আয়োজন করে ফেলব। আগে থেকে সেভাবে মানষিকভাবে তৈরি হতে বলিনি? ”

তীরু দুঃখী গলায় বলল, ” বলেছো তো! কিন্তু তুমি যে এরকম বিয়ের আয়োজন করবে তা কে জানত। জানলে আমি কক্ষনো হ্যা বলতাম না। ”

তানহা গলা ঝাড়লেন। আশপাশে নজর বুলিয়ে তিনি চট করে ফোন নিয়ে বেড়িয়ে এলেন বাহিরে। কন্ঠের খাদ নামিয়ে বললেন,

-” শোন তীরু, এবার আমি ছেলের খবরা-খবর একা নিজেই নিয়েছি। একদম পাই টু পাই তথ্য জেনেছি। ছেলের সাথে আমি প্রায় সাত আটবার দেখা করে ফেলেছি। ছেলে দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি তার ব্যাবহার, আচার – আচরণ মাশাআল্লাহ। ভালো পাত্র! তুই চিন্তা করিস না। ছেলের নাম অরোন। পরিবারে অ সু স্থ বাবা আর তিনবোন আছে। তোর জন্য একটা সুখবরও আছে তীরু। ছেলে তো প্যারিসে সেটেল। তোকে আর দেশেও আসতে হবে না। জামাইকে নিয়ে প্যারিসেই থাকবি। ”

তীরু মরা গলায় শুধাল, ” এখনি জামাই ডাকা শুরু করে দিয়েছ। বিয়েই তো হয়নি। ”

-” হয়নি হয়ে যাবে। আরো শোন, ছেলে ইন্টার পাশ। অরোনের বাবা অনেক আগে থেকেই অসুস্থ বুঝছিস। ওদের সংসার চালাতো ওর মা। কিন্তু তিনি মারা গেছেন তাই পরিবারের হাল ধরতে বেচারা ছেলেটা এইচএসসি দিয়েই চলে যায় প্যারিস। প্যারিসে এখন ওর নিজস্ব একটা রেস্টুরেন্টও রয়েছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। তুই সুখে থাকবি মা। ”

তীরু গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,

-” টাকা পয়সা কখনো সুখ এনে দিতে পারে না আম্মু যদিনা মানুষটা ভালো হয়। আর ছেলে ইন্টার পাশ? আমি মাস্টার্স করছি আম্মু। ”

তানহা থমকালেন যেন! চক্ষু জোড়া বড়সড় করে তাকালেন তিনি তীরুর পানে। তানহার এরূপ প্রতিক্রিয়া দেখে তীরু হতভম্ব! সে কি কোনো ভুল কথা বলে বসলো কি? তার ভাবনার মাঝেই তানহা চেঁচালেন,

-” তীরু..! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুই এমন কথা বলছিস। এটা তুই বলতে পারলি তীরু? ছেলেটা ইন্টার পাশ বলে ওকে তুই ছোট করলি? আল্লাহ তায়ালা এই দিন দেখানোর জন্য আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন! আমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না। এই শিক্ষা দিয়ে বড় করিছি তোকে? তুই অহংকার দেখালি? ভুলে যাসনা আমাদের অতীত তীরু। ”

তীরু বিচলিত হলো, ” মা রিলাক্স! ভুল বুঝছো তুমি আমাকে। আমার বলার মানে এটা ছিলোনা। আমি বলতে চাচ্ছিলাম ছেলে যেহেতু ইন্টার পাশ বিয়ের পর যদি আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দেয় এই ভেবে যে, সে ইন্টার পাশ তার বউ কেন তার থেকে বেশি শিক্ষিত হবে? ”

তানহা ভ্রু কুঁচকালেন, ” তোর কি মনে হয় তীরু আমি অমন টাইপ ছেলের কাছে তোর বিয়ে ঠিক করেছি? এতো কষ্ট করে তোমাকে পড়াশোনা শেষ করিয়েছি শেষে এসে পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে নয় নিশ্চয়ই। ”

তীরু ব্যার্থ সৈনিকের ন্যায় তাকিয়ে রইল। ইচ্ছে হলো এখন তানহাকে বিয়ের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানাতে পারত সে। তারপর হয়ত তানহা কিছুক্ষণ স্তব্ধ নেত্রে তাকে পরখ করত অতঃপর বিদায় জানিয়ে কল কেটে দিত। স্বাভাবিক একটা ব্যাপার! কিন্তু তীরু জানে এই স্বাভাবিকতার পেছনে কতোটা দুঃখ, পীড়া, বেদনা লুকিয়ে। মা যে ভীষণ ক ষ্ট পাবে। যে মা তাকে কোলেপিঠে করে এতোটা সংগ্রাম করে বড় করে তুলে এতো দূর অব্দি নিয়ে এলো তাকে কি কষ্ট দেয়া যায়? উঁহু! তাকে কষ্ট দেয়ার চিন্তা করাও তো পাপ, মহাপাপ!
কাজি সাহেব অনর্গল কিছু বলে যাচ্ছেন। ভিডিও কলে আপাতত তানহা আর কাজি সাহেব ব্যাতীত কাওকেই দেখতে পারছেনা তীরু

-” অরোন ইকবাল। বাবা মূর্তজা ইকবাল। পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া তীরুনিমা আহসানের নিকট বিবাহের প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। এই প্রস্তাবে আপনি রাজি থাকলে বলুন কবুল। ”

তীরু অবিকল যন্ত্রের মতো আওড়াল, ” কবুল, কবুল, কবুল। ”

লহমায় তীরু বিয়ে করে ফেলল সম্পূর্ণ অপরিচিত, অদেখা একজন মানুষকে।

_

একবার, দুইবার, তিনবার। নাহ্! ফোন তুলছে না। তীরুর ধৈর্যের সীমা পেরোলো। রাগ হলো! প্রচন্ড ক্ষোভে ফোনটাকে সামনে ছুঁড়ে মা র বে তৎক্ষনাৎ কল ব্যাক। শান্ত হলো তীরু। লম্বা লম্বা শ্বাস টানল। অপর পক্ষের মানুষটার সাথে রেগে কথা বলার ইচ্ছে নেই। কিয়ৎক্ষণ পর কল রিসিভ করল ও,

-” তীরুদি ভালো আছো? ” নম্র গলা।

তীরুর হৃদয় শীতল হলো। কোমল কন্ঠে জবাব দিতে গিয়ে হয়ে উঠল গম্ভীর,

-” মন্টু ঘোষ! টাকা পাঠাচ্ছি বিকাশে। আমাকে যেভাবে সাদিফের পারসোনাল ইনফরমেশন এনে দিয়েছিলি সেভাবে আরেকজনের ইনফরমেশন জোগাড় করে দিতে হবে। ”

মিন্টুর মুখোশ্রী পাংশুটে বর্ণের হলো। ও অসহায় গলায় জিজ্ঞেস করলো,

-” তুমি আবারও আমাকে মন্টু বলে ডাকছো দিদি।”

-” হ্যা। এখন এসব কথা রেখে কাজের কথায় আয়।”

-” তুমি কি অরোন দাদার ইনফরমেশন চাচ্ছো এবার? ”

তীরু কপালে সরু ভাজ ফেলল, ” তুই জানলি কি করে? ”

মিন্টু হাসল, ” এটা তো জানা কথা। যাইহোক তীরু দিদি অরোন দাদার ইনফরমেশন জোগাড় করার কোনো প্রয়োজন নেই। দাদাকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। দাদা যে কি একটা ভালো মানুষ তা উনার সাথে পরিচিত না হলে জানতে পারবে না। ইংরেজ সাহেবদের মতো ফটর ফটর করে ইংলিশে কথা বলতে পারে।ভারী ভদ্র লোক! দেখতেও ফিল্মের নায়কদের মতো। তোমার মা এবার একটা খাঁটি সোনা খুঁজে এনেছে। অরোন দাদা দেশে এলেই আমার সাথে দেখা করে। অরোন দাদার চরিত্র ফুলের মতো পবিত্র! চোখ বন্ধ করে তার সাথে চুটিয়ে সংসার করা শুরু করে ফেলো। ”

চলবে~