যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-০৭

0
224

#যেখানে_পথচলা_শুরু |০৭|
#সাদিয়া_মেহরুজ

কাল পরিক্ষা। দিন – রাত এক করে তীরু একাধারে পড়ে যাচ্ছিল সপ্তাহখানেক যাবৎ। রেস্টুরেন্টে তার যাওয়া হচ্ছে না। এমন নয় যে সে অরোনের কথাটা মেনেই যাচ্ছে না। যাওয়া হচ্ছে না কেবল পরিক্ষার পড়ার জন্য। রেস্টুরেন্টের মালিক আবার ইলির খুব পরিচিত লোক। তাই এ সুযোগটা পাওয়া গিয়েছে। অরোনের বলা কথাটা নিয়ে এখনো দ্বিধাদ্বন্ধে রয়েছে সে। কি করবে? চাকরিটা আদও ছাড়বে কি না! তা নিয়ে সে চিন্তিত। লোকটা একবার বললো আর তাতেই চাকরি ছেড়ে দেয়া কি শোভা পায়? কে জানে। তীরুর মাথায় ঢুকছে না। মায়ের সাথে সে পরামর্শ করবে ভেবেছিল কিন্তু পরদিনই তানহা কল করে পাই পাই করে বলে দিয়েছে, অরোন যাই বলে তা শুনতে। তার অবাধ্য না হতে। তীরু অবশ্য তার প্রতিত্তোরে কিছু বলেনি। শুনে কল খট করে কে টে দিয়েছে।

ইলি শব্দ করে দরজা লাগাল। চেচিয়ে উঠল,

-” উইলি তুমি রাদিফের সঙ্গে রিলেশনে গিয়েছো? আর ইউ ফা কিং কিডিং উইথ মি? ”

ইলির আচানক আগমন, উচ্চস্বরে চেঁচানো আর শেষে রাদিফের প্রসঙ্গ আসতেই তীরু আড়মোড়া ভেঙে বই থেকে মুখ তুলল। উৎসুক দৃষ্টিতে তাকাল ও উইলির পানে। মেয়েটা ভাবলেশহীন! ফোনে দৃষ্টি ফেলে আপেলে ছোট্ট ছোট্ট কা ম ড় বসাচ্ছে। ইলি পুনরায় গর্জে উঠল,

-” উইলি আমি তোমাকে বলছি কিছু। শুনতে পাওনি তুমি? তোমাকে বলেছিলাম আমি রাদিফের থেকে দূরে থাকতে। তুমি কি চাও আমি বাবার কাছে বলি এসব কথা? ”

-” বল! তুই বললে আমিও বলব আমার আগে তুই রাদিফের সাথে রিলেশনে ছিলি এবং ফিজিক্যালি এটাচ’ড ও হয়েছিস। ” উইলির সোজাসাপ্টা উত্তর।

আগ্রহ হারাল তীরু! কানে ইয়ারফোন গুঁজে ও মগ্ন হলো অঙ্ক কষতে। উইলি ইলির বোন। সৎ বোন বলা চলে। ইলি তার বাবার প্রথম পক্ষের স্ত্রীর সন্তান এবং উইলি দ্বিতীয় পক্ষের সন্তান। ওদের মাঝে প্রায়সই ঝগড়া হয়, তর্ক হয়! এসব দেখে ক্লান্ত তীরু। প্রথম প্রথম থামাতে যেতো কিন্তু পরবর্তীতে খেয়াল করে, তীরু দুই বোনের মাঝে গেলে উইলি আরো হিংস্র হয়ে যায়। এরপর হতে ওদের মাঝে বাগড়া দেয়নি সে। কিয়ৎক্ষণ বাদে রুম থেকে রেগে বেড়িয়ে যায় উইলি। ইলি তার প্রস্থান দেখে আহত নয়নে। ব্যাথিত হৃদয়ে গুনগুনিয়ে কেঁদে উঠতেই তার ওপর দৃষ্টি পড়ে তীরুর। তপ্তশ্বাস ফেলে স্থান ছেড়ে সে উঠে এলো। ইলির নিকট এগিয়ে কাঁধে হাত চেপে বলে উঠলো,

-” ডোন্ট ক্রাই ইলি! প্লিজ স্টপ। ”

ইলি ফোপাঁতে ফোঁপাতে জবাব দেয়,

-” কাঁদব না তো কি করব টীরু? উইলি কেন বোঝে না আমার কথা? আমি তো ওর ভালো চাই। ও আমার বোন। ও কবে আমার কথা মানবে টীরু? কবে আমাকে একটু ভালোবাসবে? বাবা মার স্নেহ তো পাওয়ার সুযোগ হলো না এখন কেবল বোনের ভালোবাসা চাচ্ছি। স্রষ্টা কি সেটাও আমার কপালে রাখে নি? ”

তীরু করুণ চোখে তাকাল। ভীষণ করে বলতে চাইল,

-” তোমাকে উইলি কিভাবে ভালোবাসলে ইলি? ও তো তোমাকে বোন হিসেবে মানেই না। সর্বদাই হেয়, তুচ্ছ করে তোমায়। ঘৃ ণা করে! এটা কবে বুঝতে পারবে তুমি? ”

তবে ও বলল না। এই কথাটা বললে ইলি আরো ভেঙে পড়বে না? তার জন্য বিষয়টা এড়িয়ে গেলো। খানিক হাসার চেষ্টা করে শুধাল,

-” উইলি আমাদের কত্তো ছোট ইলি। কেন বুঝো না তুমি? ছোট্ট মানুষ তাই তোমার কথা বুঝতে চাচ্ছে না। আরেকটু বড় হলে ঠিকই বুঝবে। এখন কান্না বন্ধ করে পড়তে বসো তো দেখি।কালকের পরিক্ষায় ফেল করতে চাও নাকি? ”

ইলি কিয়ৎক্ষণ মৌন রইল। আপনমনে দুঃখ গুলো অন্তরালের খাঁচায় বন্দী করার চেষ্টা করল। উঁহু! হচ্ছে না যে। দুঃখের পরিমাণটা তার এতোটাই বেশি যে মন গহীনে লুকিয়ে রাখা দায় হয়ে পড়েছে।

কান এঁটো করা শব্দে ফোন বেজে উঠল। চমকাল দুজনেই! তীরুর ফোন। ইলির ভেজা গাল দু’হাতে মুছে তীরু গেল ফোনের নিকট। আননোন নাম্বার হতে ফোন। তার কপালে ভাজ পড়ল। খানিকটা চিন্তিত হয়েই কল রিসিভ করলো।

-” অরোন বলছিলাম। ” ভারী কন্ঠ।

তীরু স্তম্ভিত! কতদিন পর, ঠিক কতদিন পর এই গা শিরশির করে দেয়া কন্ঠ শুনছে সে? এক কি দু’দিন? নাহ! পুরো একটা সপ্তাহ পর। এতদিন এই লোকটা ফোন দেয়নি দেখে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করেনি তার। অরোনকে মনেও পড়েনি। কিন্তু আজ দেখো তো! লোকটা ফোন দিল আর সাথে সাথেই তার নিষ্ঠুর, বেইমান মস্তিষ্ক বারংবার বলতে লাগল, ‘ এইতো, এই কন্ঠের অপেক্ষাতেই তো ছিলাম। ‘

-” তীরু, তীরু আপনি কি লাইনে আছেন? শুনতে পাচ্ছেন কি? ” ধৈর্যহারা শোনাল অরোনের গলা।

বিমূঢ় তীরু হুঁশে এলো! চটপট শুধাল,

-” জি আছি তো। বলুন। এতো রাতে ফোন দিলেন যে? কোনো সমস্যা কি? ”

অরোন কন্ঠের খাদ নামিয়ে প্রতিত্তোর করল,

-” কোনো সমস্যা না। একচুয়েলি জরুরি একটা কথা বলা প্রয়োজন ছিল। ভেবেছিলাম সকালেই ফোন দিব কিন্তু এখন দিয়ে ফেললাম। আপনি তো মেবি ঘুমোননি, তাই না? ”

-” উহ্ না। ঘুমাইনি। পড়ছিলাম। ”

কথার মাঝে তীরু খেয়াল করল অরোন তাকে এক বার ‘ তুমি ‘ তো কখনো ‘ আপনি ‘ বলছে। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন তুলল সে তৎক্ষনাৎ।

-” আচ্ছা ওয়েট! আপনি একবার আমায় ‘ আপনি’ তো আরেকবার ‘ তুমি ‘ বলছেন কেন বলুন তো? ফিক্সড কিছু একটা ডাকুন না। ”

-” আচ্ছা। আই উইল ট্রাই। যার জন্য কল করা আপনাকে। আমি কাল আপনাকে এক্সাম হলে দিয়ে আসবো। কষ্ট করে আপনি হোষ্টেলের নিচে ৫ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলেই হবে। ”

তীরু অবাক! বলল, ” কষ্ট করে আপনি কেন আবার আসতে যাবেন? আমি বাসে করে চলে যাবো নে। আপনার আসার দরকার নেই। ”

অরোন দৃঢ় গলায় বলল,

-” দরকার আছে বলেই বলছি। অ- দরকারী কাজ আমি করি না তীরু। ”

কল কে টে গিয়েছে। কে টে দিয়েছে অরোন। কিয়ৎ সময় নিয়ে তীরু তাকিয়ে রইল ভ্যাবলার মতো তার ফোনের স্ক্রিনের পানে। হুট করে কল দিয়ে আবার হুট করেই না বলে কয়ে কে টে দিল? কি অদ্ভুত! কি অ স ভ্য ছেলে! নূন্যতম সৌজন্যবোধ অব্দি দেখাল না।

_

প্যারিসের আকাশ আজ সেজেছে নীলাভ রঙে। পরিস্কার আকাশ! একদল নাম না জানা শুভ্র পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে অম্বর জুড়ে। প্যারিসের আবহাওয়া আজ উষ্ণ। গরম পড়েছে বেশ। কড়া রৌদ্দুর গায়ে লাগছে প্রচন্ড! রাস্তার ধারে দাড়িয়েঁ রয়েছে সাড়ি সাড়ি ম্যাপল ট্রি। পাতা এসেছে গাছে। ম্যাপল ট্রির ফাঁক গলিয়ে তপ্ত রোদ এসে ছুঁয়ে দিচ্ছে তীরুকে আদুরে ভাবে। চোখ জোড়া বন্ধ তীরুর! শা শা বাতাসা বইছে। গাছের পাতা বাতাসে দুলে হৃদঃস্থল তৃপ্ত করা শব্দ করছে। তীরু চোখ মুদে সেই শব্দই প্রবল আগ্রহে শুনছে। বুক ভরে টেনে নিচ্ছে বিশুদ্ধ সমীর। এখানকার বাতাসে মিশে আছে মিষ্টি একটা ঘ্রাণটা। ঘ্রাণটা অবশ্য এক ধরনের ফুলের। ইলি এমনটাই বলেছে তাকে।

-” একবছর তো হয়ে এলো টীরু। তা কেমন লাগল আমাদের প্যারিস? ”

ধপ করে চোখজোড়া উন্মুক্ত করে তীরু। খানিক মন খারাপ নিয়ে বলল,

-” প্যারিসের সৌন্দর্য আর দেখা হলো কই? একটা বছর পেরুলো গাধার খাটুনি খাটাচ্ছে ভার্সিটি। কিন্তু যাই বলো না কেন এখানকার মানুষ চমৎকার। আর প্যারিসও সুন্দর নিশ্চয়ই। আমার স্বপ্নের মতো সুন্দর। ”

-” চাপ নিও না। সামনের বছরটা থেকে ভার্সিটি প্যারা দেয়া কমিয়ে ফেলবে। তখন ইচ্ছে মতোন ঘুরিও। প্যারিসের সাথে পুরো ফ্রান্স! ”

দুজনের কথার মাঝেই অরোন উপস্থিত হলো। হর্ণ বাজিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। তীরু, ইলি আগ্রহ নিয়ে তাকাতেই অরোন গাড়ি থেকে নেমে আসে। চোখে রোদচশমা তার। পরনে ঝকঝকে পোশাক। নীল রঙয়ের। গাঢ় নীল। ফর্সা গায়ে মানিয়েছে। তবে তীরুর মনে হলো এই ফর্সা মুখটায় অরোনকে কালো চশমাতে দারুণ মানাতো! একদম সিনেমার হিরোদের মতো লাগত। তীরুর আবোল – তাবোল ভাবনার মাঝে অরোন এসে প্রশ্ন করে,

-” বেশি অপেক্ষা করিয়েছি তোমাদের? ”

জবাব দেয় ইলি, ” না, না। মাত্রই নেমেছি আমরা। আপনারা তবে যান। আমি বাসে যাচ্ছি। ”

অরোন তৎক্ষনাৎ থামায় ইলিকে। বলে,

-” গাড়িতে চারজনের বেশি মানুষের জায়গা আছে। সেখানে আমরা মাত্র তিনজন। আপনি কেন একা যাবেন? আমাদের সাথেই আসুন। ”

তীরু নীরবতা ভাঙে, ” হ্যা ইলি। আমি কিন্তু তোমায় ফেলে যাব না। ”

দু’জনের তুমুল জোড়াজুড়িতে ইলি গাড়ির পেছনে গিয়ে উঠল। তার পরপর তীরু উঠতে নিবে তখন পেছন হতে অরোন তাকে দরজা খুলে দেয়। তীরু এক ঝলক তাকাল ছেলেটার পানে। অরোনের দৃষ্টি তখন অন্যত্রে। তীরু উঠে বসল। ইশ! আজ সবকিছু তার এতো ভাল লাগছে কেন?
অরোন, ইলি গল্প জুড়ে দিয়েছে। কতোটা মুক্তো মনা, প্রাণোচ্ছল লাগছে অরোনকে! অথচ তীরুর সাথে কথা বলতে গেলেই তার সব জড়তা, গম্ভীরতা এসে জুড়ে বসে। কেন? তীরুকে কি তার ভালো লাগেনি? ফুরফুরে মেজাজটা দপ করে নিভে গেল। হানা দিল অস্বস্তি, চাপা হাহাকার আর বেদনা! কেন এই বেদনা? তীরু কি এই ছেলেটার প্রতি দূর্বল হয়েছে? উঁহু! তীরু কারো অবজ্ঞা, উপেক্ষা সহ্য করতে পারেনা। এটাই বেদনার কারণ।

কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতেই ইলি দ্রুত নেমে যায়। বসে রয় একা তীরু! অরোন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে মেয়েটার পানে। আচানক ভাবল, তীরু হয়ত পুনরায় সিটবেল্ট জনিত সমস্যায় পড়েছে। তাই ও এগিয়ে গেল তীরুর পানে। সন্নিকটে যেতেই তীরু করল এক ভ য়া ন ক কাজ! রাগ চেপে রাখতে না পেরে সে অরোনের কলার চেপে ধরে চেঁচাল,

-” কি সমস্যা আপনার? ”

চলবে~