#যেখানে_পথচলা_শুরু |০৯|
সাদিয়া মেহরুজ
বেলা বারোটা। এক্সাম হল থেকে তীরু বের হয়েছে সবেমাত্র। তার মুখোবয়বে সুখী সুখী ভাবের রাজত্ব! সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে। কড়া রৌদ্দুরে গা জ্বলে যাওয়ার উপক্রম। তীরুর হেলদোল হলো না তাতে। সে আজ দারুণ খুশি! মুখোশ্রীতে তার হৃষ্টচিত্ততা লেপ্টে। টানা দেড় মাস ধরে চলমান পরিক্ষা আজ সমাপ্ত হয়েছে। নিজেকে কেমন মুক্ত পাখির মতো লাগছে তার। যেন এতদিন খাঁচায় বন্দী থেকে আজ মুক্তি মিলেছে। ক্যাম্পাসে হট্টগোল! সব স্টুডেন্ট হল থেকে বেড়িয়েছে হৈ-হুল্লোড়ে মেতেছে। তীরু তাদের আনন্দম নয়নে দেখল। নম্র পায়ে পদচারণ কালীন মিষ্টি গলায় গান ধরল। রবীন্দ্র সংগীত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান গুলো তার ভীষণ পছন্দের। গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে তীরু আবিস্কার করল, প্রায় দেড়মাস যাবৎ অরোনের সাথে তার সাক্ষাৎ নেই! আবারও বহুদিনের দূরত্ব। অবশ্য দূরত্বটা সে নিজেই সৃষ্টি করেছে। প্রথম পরিক্ষার দিন অরোন যখন তাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেল তখন অরোনকে সে শক্ত কন্ঠে বলেছিল,
-” শুনুন, আগামী দেড় মাস আমি নিজের মতো করে থাকতে চাই। আপনার এভাবে আমাকে দিয়ে নিয়ে আসার কোনো দরকার নেই। আমি অবশ্যই বাচ্চা নই যে আপনাকে এভাবে আমায় ভার্সিটিতে দিয়ে আসতে হবে আবার নিয়ে আসতে হবে। এই এক্সাম টাইমটুকু আমি একটু সবকিছু থেকে দূরে থেকে পড়াশোনায় ডুবে থাকতে চাই। আশাকরি বুঝতে পেরেছেন আমি কি বলতে চাচ্ছি। ”
অরোন সেদিন নির্লিপ্ত ছিল সম্পূর্ণ। টু শব্দ অব্দি না করে গাড়ি নিয়ে শো করে চলে গেছে! রাগ হয়েছিল তীরুর। অরোনের এই নির্লিপ্ততা, নির্বাকতা আর সহ্য হচ্ছিল না। ছেলেটা এমন কেন? শুধুমাত্র তার প্রতিই? তীরু তৎক্ষনাৎ মাথা ঝাড়া দিয়ে অরোনকে মস্তিষ্ক থেকে বের করে দিয়েছিল। অরোনটা তাকে যে দিনে দিনে উদ্ভট মানবীতে রূপান্তর করে তারপর ছেড়েছে! তীরুকে বানিয়েছে ষোড়শী। ষোড়শী কন্যার ন্যায় কেমন অদ্ভুত, টিপিক্যাল হয়ে উঠেছিল সে। অতীত ভাবতেই গাঁ কাটা দেয় তার লজ্জায়!
ক্যাম্পাস থেকে বের হতেই সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিতভাবে তীরুর সাক্ষাৎ হয় রাদিফের সাথে। ছেলেটা গাড়িতে ঠেস দিয়ে হাত নাড়িয়ে তাকে ‘ হাই ‘ দিচ্ছে। তীরু অপ্রস্তুত হাসি উপহার দিল তার বিনিময়ে। রাদিফ দ্রুত পায়ে তার নিকট এলো। হাসি হাসি মুখে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল,
-” হ্যালো তীরু! কি অবস্থা? ”
তীরু স্বাভাবিক হওয়ার প্রয়াস চালাল। নম্র গলায় শুধাল,
-” ভালো আছি। ”
-” আমাকে জিজ্ঞেস করবে না আমি কেমন আছি?”
তীরু একটুখানি লজ্জিত বোধ করল। জিজ্ঞেস করলো,
-” কেমন আছেন? ”
-” ভাল ছিলাম না কিন্তু তোমাকে দেখে ভালো হয়ে গেছি। ”
স্পষ্টত ফ্লার্ট করার ধান্দা! তীরু বেশ ভালোভাবেই বুঝতে পারল রাদিফের চোখের দৃষ্টি, কথাবার্তার ধরণ দেখে। ছেলেটার মতিগতি ভালো না। ও কেটে পড়তে নিলো। বলল,
-” আচ্ছা আল্লাহ হাফেজ। কাজ আছে আমার। ”
হাঁটা ধরেছে তীরু। পেছন হতে রাদিফ ছুটল। হন্তদন্ত হয়ে বলল,
-” আরে আরে এতো তাড়া কিসের? তোমার তো আজ এক্সাম শেষ। প্রচুর ফ্রী টাইম রয়েছে হাতে। আসো একটু কথা বলি। কফি খাবে?”
-” নো থ্যাঙ্ক’স। প্লিজ বিরক্ত করবেন না রাদিফ। কাজ আছে আমার। ”
তীরু রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে হাঁটছে। এ সময়টাতে তার রেস্টুরেন্টে থাকার কথা। আজ হাফ টাইম কাজ করে রিজাইন লেটার দিয়ে আসবে। মস্তিষ্কে আজকের দিনের রুটিন যখন ও সাজাতে ব্যাস্ত তখনি হুট করে রাদিফ পেছন হতে হাত চেপে ধরল। হকচকিয়ে তীরু হাটাঁ থামায়। পেছন তাকাতেই লক্ষ করে রাদিফকে। চমকায় ও! ভেবেছিল রাদিফ চলে গিয়েছে। কিন্তু না। এ দেখি হাত পর্যন্ত ধরে ফেলেছে তার। কত বড় সাহস! লহমায় নিজের নম্র খোলস থেকে বেড়িয়ে এলো ও। চটে গেল ভীষণ।
-” আজব! আপনি আমার হাত ধরলেন কেন? ”
হাত ঝামটা মে রে ছাড়িয়ে নেয় তীরু। রাগের প্রকোপে রীতিমত কাঁপছে সে। রাদিফ বিভ্রান্ত হয়ে বলল,
-” সামান্য হাতই তো ধরেছি। এতে এতো রাগার কি আছে? অন্যকিছুতো আর ধরিনি। এমনভাবে রেগে গেলে যেন তোমার স্পেশাল জিনিসটা ধরে ফেলেছি আমি। ”
তীরুর ধৈর্যের সীমা পেরুলো। রাদিফের অ শা লী ন কথা শোনা মাত্র চট করে চ ড় লাগাল ও। চেঁচিয়ে বলল,
-” ম্যানার্সলেস ছেলে! বাপ মা নূনতম শিক্ষা দেয়নি কিভাবে কথা বলতে হয়? ওহ্ শিট! কি বলছি আমি হাহ্। একজন ক্যারেক্টারলেস ছেলের কাছে আমি শালীন কথাবার্তা, শালীন আচরণ আশা করিই বা কি করে। ”
রাদিফ চরিত্রহীন! এটা প্যারিসের প্রতেকটা ইট – পাথরও বোধহয় জানে। প্রতেকটা মানুষ যারা কিনা রাদিফের পরিচিত কিংবা অ-পরিচিত তারা সকলে রাদিফ সম্পর্কে অবগত। ও কেমন? ওর চরিত্রগত সমস্যাটা, সবকিছু! কিন্তু কখনো কেও মুখের ওপর ওকে কথা শোনায়নি এই একমাত্র তীরু ছাড়া। গা কেঁপে উঠল রাদিফের! রাগে, ক্ষোভে কপালের শিরা সারিবদ্ধভাবে ফুটে উঠল। তীরুর সন্নিকটে এগোল ও। তৎক্ষনাৎ করে বসল এক নি কৃ ষ্ট তম কাজ! তীরুর বুকে বি শ্রী ভাবে হাত ছুয়েঁ দিয়ে বলে উঠলো,
-” সেটাই তীরু। ক্যারেক্টারলেস মানুষের মুখ দিয়ে ভালো কথা বের হয় না। তেমনি ওদের হাতও বাজে কাজ করা হতে বিরত থাকতে পারে না। ওপ্স বাজে নয় ভালো! এটা আমার কাছে একটা ভালো কাজ এর মধ্যেই পড়ে। মৌমাছির তো মধুর প্রতিই আগ্রহ থাকে তাই না? ”
কিংকর্তব্যবিমুঢ় তীরু! অপমানে, যন্ত্রণায়, লজ্জায় অক্ষিকোটরে তার পানি এসে জমেছে। হাত – পা কাঁপছে ভীষণ! বাতাসে গাছের পাতা নড়ার মতো থরথর করে কাঁপছে ও। ঘটনাটা ঘটেছে চোখের পলক ফেলার পূর্বে। সেকেন্ডের মাঝে! অপ্রত্যাশিত ঘটনাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না তীরু। তার জীবনের এক কলঙ্কময় প্রহর। তীরুর মনে হলো সে পৃথিবীতে নেই। শূন্যে ভাসছে! মস্তিষ্ক ফাঁকা। অনুভূতিহীন মানবীর মতো সে তাকিয়ে আছে রাদিফের পানে। কি হলো মাত্র? কেন হলো? তার সাথেই কেন?
জায়গাটা শান্ত। চারপাশে কয়েকজন মানুষ রয়েছে যদিও। তবে তাদের দিন – দুনিয়ার কোনো ধ্যানই নেই। নিজের মতো করে হেঁটে যাচ্ছে তারা। পলকে ধ্যান ফিরে এলো স্তব্ধমূর্তী তীরুর! রাদিফ তখনো তার গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। তীরু চটপট ভাবল কিছু। আশপাশে তাকালো উদভ্রান্তের মতো। পেয়ে গেল বোধহয় কাঙ্ক্ষিত বস্তু। ছুটল ও! ফিরে এলো র ড নিয়ে। পাশেই দোকান ছিল। দোকানের মালিক তীরুকে এভাবে নিজের দোকানের পন্য দৌড়ে নিয়ে যেতে দেখে চো র ভেবে তার পেছন পেছন চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে এলো। কিন্তু তীরু কি শোনার পাত্রী? সে ছুটে এসে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা রাদিফকে সজোরে আঘাত করা শুরু করেছে। বিরতিহীন ভাবে এক একটা আঘাত করার সময় তীরু চেঁচিয়ে বলে,
-” বাস্টার্ড! জা নো য়া র! যদি আর কোনোদিন কোনো মেয়ের গায়ে এমন বাজে ভাবে স্পর্শ করিস ঐদিন আমি তোকে নিজের হাতে খু ন করবো। কত বড় সাহস! তুই আমাকে স্পর্শ করিস। আমাকে অবলা নারী লাগে তোর? আর কোনোদিন আমার আশেপাশে দেখলে কে টে ফেলব। ”
তীরু কথা বলছিল ইংরেজিতে। আশপাশে জড়ো হওয়া মানুষ তাই তীরুকে থামাতে গিয়েও থামায়নি। রাদিফ সম্পর্কে জ্ঞান আছে তাদের। সে যে কতটা বাজে স্বভাবের ছেলে তা তারা জানে। অনেক বাজে কাজ করার রেকর্ড রয়েছে তার। কিন্তু আজ পর্যন্ত কেও কোনো অভিযোগ তুলেনি বলে সকলে চুপ ছিল। কিন্তু আজ তীরুকে প্রতিবাদ দেখে তারাও হৈ হৈ করে ছুটে এলো। প্রতিবাদী হয়ে উঠল। তীরুকে থামানোর বদলে গুঞ্জন তুলল রাদিফের অপকর্মের। পুলিশকে ফোন দিয়ে ফেলেছে কেও কেও। এদিকে রাদিফের অবস্থা করুণ! রনচন্ডী রূপ ধারণ করা তীরু থামেনি তখনও। চোখ দু’টো রাগে লাল হয়ে তার। অন্তরালে অজস্র কষ্ট পুষে রেখে আঘাত করে যাচ্ছে রাদিফকে!
ব্যাংকে যাচ্ছিল অরোন। রাস্তায় জটলা পাকানো দেখে ও যারপরনাই অবাক হলো। এরূপ দৃশ্য সাধারণত দেখা যায় বাংলাদেশে, প্যারিসে নয়! ওখানে কি এমন হচ্ছে যা দেখার জন্য মানুষের এই উপচে পড়া ভীড়! গাড়ির কাচঁ নামাতেই অরোন শুনতে পেল একজন পুরুষের আর্তনাদ। গাড়ি থেকে নামল ও। ভীড় ঠেলেঠুলে প্রবেশ করতেই সম্মুখের দৃশ্য দেখে তার চোখ ছানাবড়া! তীরু? এ কি করছে মেয়েটা!
-” তীরু, তীরু থামুন। করছেনটা কি? ”
পেছন হতে তীরুকে ঝাপটে ধরেছে অরোন। হাত থেকে রড ছোঁ মে রে নিয়ে ফেলে দিয়েছে দূরে। লম্বা লম্বা শ্বাস ফেলছে তীরু! হাত দু’টো কাঁপছে। হাতে, পোশাকে লাল লাল রক্তের দাগ। তাকে কে যে ধরে রেখেছে তা তখনও খেয়াল করেনি। রাদিফ জ্ঞান হারিয়েছে। কয়েকজন এসে ওকে ধরাধরি করে উঠানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তীরু খানিক শান্ত হলো! ঘাড় বাঁকিয়ে অরোনকে দেখা মাত্র ছোট বাচ্চার মতো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। অরোন তা দেখে ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-” কি হয়েছে তীরু? বলুন আমায়! ভয় নেই। আমি আছি না? কাঁদে না হুঁশ। ”
‘ আমি আছি না? ‘ কি ছিল এই বাক্যে? এতো টানল কেন তীরুকে? চটপট ঘুরে দাঁড়িয়ে অরোনের গলা জড়িয়ে ধরল ও। মাথা রাখল ঠিক বুকের বাম পাশে আলত করে। শব্দযোগে কেঁদে উঠল ও! বলল,
-” ও আমাকে ছুঁয়েছে। খুব বাজে ভাবে ছুঁয়েছে অরোন। ”
পুলিশ এসেছে! চারিপাশে হট্টগোল, চাপা উত্তেজনা ছড়িয়ে গিয়েছে ইতিমধ্যেই। লোকজনের চেঁচামেচি কিংবা অদ্ভুত দৃষ্টি! কোনোটারই পরোয়া করছে না তীরু। সে অরোনের বুকে মাথা রেখে কাঁদতে ব্যাস্ত। তীরু শক্ত মানুষ! সর্বত্রই। কিন্তু আজ এই সময়ে এসে কেন যেন অরোনকে পাশে পেয়ে সে দূর্বল হয়ে গেছে। না চাইতেও থামছে না তার কান্না। বাধঁ মানছেনা অশ্রুমালা।
চলবে~