যেখানে পথচলা শুরু পর্ব-১৩+১৪

0
265

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৩|
সাদিয়া মেহরুজ

বেশ ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠেছে আজ প্রিয়। রাতে অরোনকে জ্বরাক্রান্ত দেহ নিয়ে ফিরতে দেখে চিন্তা হচ্ছিল তার! সকালে ঘুম থেকে উঠেই চটজলদি সে নাস্তা বানাতে লেগে পড়েছে। সব অরোনের পছন্দের খাবার। সকালে যদিওবা ভারী খাবার খাওয়া হয়না এ বাড়িতে তবুও অরোনের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে প্রিয় খাবারের মেন্যু বদলেছে। জ্বর হলে রুচি চলে যায়। এ সময়ে নিশ্চয়ই শাক – পাতা নামক
হেলদি ফুড খেতে ইচ্ছে করবে না অরোনের।

প্রিয় যখন ভারী ব্যাস্ত তখন পা টিপে টিপে সেখানে উপস্থিত হয় অন্তিক। চুলগুলো এলোমেলো। চোখ দু’টো ফুলে। সদ্য ঘুম থেকে ওঠার প্রমাণ দিচ্ছে তার লালচে চোখ যুগল। অন্তিক ঠোঁট বাঁকাল! বিমর্ষ গলায় বলে উঠলো,

-” কিরে কুমড়া? কি আকাম করোস? ”

অন্তিক খানিক চেঁচিয়েই বলেছিল কথাটা। প্রিয় কেঁপে উঠল। তপ্ত চোখে তাকাল অন্তিকের পানে। চিবিয়ে বলল,

-” কু ত্তা! থাপড়ায় তোর দাঁত ফালায় দেব। এতো জোরে চেঁচালি কেন? ”

-” আমার গলা আমি চিৎকার দিছি। তোর জামাইর কি? ”

কাজে মনোনিবেশ করল প্রিয়। অন্তিকটা ভীষণ বেয়াদব! এর সাথে কথা বলা মানে নিজের সময় নষ্ট করা। তারা দু’জন সমবয়সী। বয়সের পার্থক্যটা ছয় মিনিটের। এক্ষেত্রে প্রিয় বড়! তবে অন্তিকটা কখনোই তাকে ছয় মিনিটের বড় হওয়া হিসেবে নূনতম সম্মানটুকু দেয়না। সবটা সময় পিছে লেগে ঝগড়া করে। ঝগড়াটে অন্তিক! হুহ্!

প্রিয়র মৌনতা ভাল ঠেকছে না অন্তিকের নিকট। ও খোঁচাল প্রিয়কে।

-” কুমড়োপটাশ আবার রান্না করতে জানে দেখি, ওমা! কি অখাদ্য – কুখাদ্য রান্না করিস দেখি তো একটু। ”

খাবারের দিকে হাত বাড়াল অন্তিক। বাধঁ সাধে প্রিয়, নাক সিটকে শুধায়,

-” ছিহ্ অন্তিক! তুই ফ্রেশ না হয়ে খাবারে হাত দেস কেন? মুখ ধুতে যা খবিশের বাচ্চা খবিশ। ”

অন্তিক ভ্রু কুঁচকায়! বলে, ” তুই আম্মারে খবিশ বললি কেন কুমড়া? দাঁড়া আম্মার কাছে যদি আমি বিচার না দিছি। ”

হনহনিয়ে যেতে লাগল অন্তিক। প্রিয় হাফ ছেড়ে বাচেঁ! যাক, বদমাশটা যাচ্ছে তো অন্ততপক্ষে।

_

তীব্র মাথার যন্ত্রণা নিয়ে চোখ খুলে অরোন। মাথায় কেও যেন ছু রি দিয়ে আঘাত করছে অনবরত। য ন্ত্র ণা য় শ্বাস রুখে আসার উপক্রম। উঠে বসল ও। ঘোলা দৃষ্টিতে পরখ করল চারপাশ। কি আশ্চর্য! সে ঝাপসা দেখছে কেন? চোখ দু’টো দু’বার কচলাতেই এবার স্পষ্ট হলো দৃষ্টি। আশপাশে দেখাকালীন আচানক তার নজর আটকাল পাশে। তীরু বসে! ঠিক বসে না আধশোয়া হয়ে। ফ্লোরে বসে মাথা এলিয়ে রেখেছে বিছানায়। ঘুমোচ্ছে কি? অরোন সর্বপ্রথম মনে করার চেষ্টা চালালো তীরু এখানে কখন আসলো? তৎক্ষনাৎ তার মস্তিষ্ক তাকে স্বরণ করায় কাল রাতের কথা। তীব্র জ্বর, উল্টোপাল্টা প্রলাপ বকছিল যখন তখনই মেয়েটা তার কাছে এসেছিল। হুঁশ ফেরাতে চেষ্টা চালিয়েছিল কিন্তু সে হয়েছে ব্যার্থ! অরোনের তখন ভয়াবহ অধঃপতন। তীরু তাকে ডাকা বন্ধ করে জলপট্টি দেয়া শুরু করলো, মাথা ম্যাসাজ করে দিতে লাগল তারপর… তারপর চোখে নেমে রাজ্যের ঘুম। ব্যাস! আর কিছু মনে নেই তার। জ্বরের ঘোরে আবোল – তাবোল কি যে বলেছে তাও মনে নেই।

অরোন তীরুর সন্নিকটে গেল। মেয়েটা এভাবে কেন ঘুমিয়েছে? রুমে কেন গেল না? ঘাড় ব্যাথা হয়েছে নিশ্চয়ই! অরোন ডাকল,

-” তীরু, এই তীরু। ”

কিয়ৎ নড়েচড়ে তীরু অরোনের হাত টেনে তাতে তার তুলতুলে গালটা রাখল। তবুও ঘুম থেকে সে উঠল না। অরোনের অস্বস্তি হলো এবার। দৃষ্টিপাত ফেলল অন্যত্রে। এই মেয়েটার দিকে তাকালে তার কেমন অদ্ভুত লাগে! ভীষণ অদ্ভুত! অন্যদিকে দৃষ্টি ফেলে রেখেই অরোন এবার জোর গলায় চেঁচাল,

-” বিছানায় উঠে ঘুমাও তীরু। ”

কাজ হলো! ঘুম ভেঙেছে তীরুর। আড়মোড়া ভেঙে ডাগর ডাগর চোখে তাকাতে ও ভীষণ চমকাল! গাল তুলে নিল চটপট অরোনের হাতের ওপর থেকে। তারপর ভারী ব্যাস্ত হয়ে অরোনের কপালে হাত রেখে শুধাল,

-” জ্বর কমেছে কি? ”

শান্ত, নিবিড় দৃষ্টিতে তীরুর ব্যাকুলতার পরিমাণ মাপল অরোন। ধীরস্থ গলায় বলে উঠলো,

-” কমেছে। ভোরের দিকেই শরীর ঘাম দিয়েছিল। ”

তীরু হাফ ছাড়ল। ” যাক তবে। আপনার ঘন ঘন জ্বর হচ্ছে কেন বলুন তো? আজ একবার হসপিটাল থেকে ঘুরে আসবেন। ”

বিছানা থেকে নামতে নামতে অরোন জবাব দিল,

-” সিজন চেঞ্জ হলেই আমার জ্বর হয়। এটা নতুন কিছু নয়। ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই। ”

-” গিজার অন করছি। ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুবেন না কিন্তু। গোসল করারও দরকার নেই। ঠান্ডা পড়েছে। ”

নিজের প্রতি তীরুর বাড়াবাড়ি রকমের যত্ন দেখে অরোন অসন্তুষ্ট হলো। বলা বাহুল্য অস্বস্তি হচ্ছে তার। এমন যত্ন মা বাদে তো কেও করেনি। হুট করে জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসা নারীর তার প্রতি এরূপ যত্নআত্তি হজম হলো না!

-” আই নো হাউ টু টেক কেয়ার অফ মাইসেল্ফ তীরু। ডোন্ট ওয়ারি টু মাচ! ”

দরজা বন্ধের শব্দ হলো। তীরু ঠায় বসে। গাল দু’টো লাল হয়ে তার। অপমানিত বোধ হচ্ছে! কার জন্য সে চিন্তা করছে? ছেলেটা তো রীতিমতো তাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা চালাচ্ছে বারংবার। তবুও সে ছ্যাচড়ার মতো অরোনের পিছু পড়ে থাকে! রুম থেকে বেরুলো ও। যেতে যেতে ভাবল রাতের কথা। অরোনের ওপর আপাতত রাগ হচ্ছে না। সে ভাবছে কাল রাতের কথা। এই পরিবারে যে বিশাল এক রহস্য লুকিয়ে তা সে নিশ্চিত, পুরোদমে! চিন্তায় পড়েছে ও। এই বিষয় কি অরোনকে সরাসরি প্রশ্ন করা উচিত? অরোনের হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে না কাল রাতের কথা তার মনে আছে।

_

-” বাবা কেমন আছেন অরোন? ওনার সাথে তো কথাই হলো না। বাবা ফোনও দিলেন না। উনি কি এখন খুব বেশি অ সু স্থ? ”

খাবার টেবিলে উপস্থিত সকলের মুখোবয়ব রেখা পরিবর্তন হলো। প্রিয় এবং অন্তিকের চেহারা হলো ফ্যাকাশে। অরোন কেমন গম্ভীর হয়ে গেল! সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে সকলের পরিবর্তনটা বেশ ভালোভাবেই খেয়াল করল তীরু। তার বলা কয়েকটি বাক্যে পরিবেশ কেমন গুমোট হয়ে গেছে। গুমোট, নির্জন পরিবেশে শব্দের উৎপত্তি ঘটাল প্রিয়।

-” চাচাজান খুব চাপা স্বভাবের ভাবী। কারো সাথে তেমন একটা কথাই বলে না তাই বোধহয় তোমায় ফোন করেননি। ”

তীরু ছোট্ট করে উত্তর দিল, ” ওহ। ”

এ ব্যাপারে কথা হলো না আর।প্রিয়, তীরু নিজেদের
মতো খাচ্ছিল। অন্তিক টুকটাকি প্রয়োজনীয় আলাপ সেড়ে নিচ্ছে অরোনের সাথে। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাকি উত্তর দিচ্ছে অরোন। হাসঁ ফাসঁ করছে তীরু! কিছু বলতে চাচ্ছিল, প্রসঙ্গটা এগিয়ে নেয়ার প্রবল আগ্রহ থাকলেও শব্দগুচ্ছো খুঁজে না পাওয়াতে মৌন রইল।

তীরুর শপিং এ যাওয়া প্রয়োজন ছিল। দরকারী কিছু জিনিসপত্র আনতে। কথাটা অরোনের কাছে তুলতেই সে তাড়া দিয়ে বলল,

-” রেডি হও। আমার সাথে বের হবে তুমি। ”

তীরু চটপট শুধাল,

-” আপনার সাথে বের হবো মানে? আপনি এই অ সু স্থ শরীর নিয়ে কোথায় যাচ্ছেন আবার? আপনার তো এখন বেডরেস্টে থাকা প্রয়োজন। ”

অরোন নিষ্প্রাণ কন্ঠে প্রতিত্তুর করল,

-” বেডরেস্টের দরকার নেই। ”

তীরু এগোল। কাবার্ড থেকে নতুন শার্ট বের করছিল অরোন। তীরু সেই শার্টটা হাতে নিয়ে জেদী গলায় বলল,

-” দরকার আছে অরোন। ”

লহমায় কেমন অবিন্যস্ত হলো পরিবেশ। অরোন গম্ভীর গলায় শাসন করল তীরুকে।

-” জেদ ভালো নয় তীরু। শার্ট দাও। আমার ওপর কখনোই অধিকার খাটাতে আসবে না তুমি। এটা আমার পছন্দ না। ”

-” যখন আমাকে স্ত্রী হিসেবে মানতেই পারবেন না তবে আমায় বিয়ে কেন করেছেন? ” তীরু চেঁচাল!

উদ্ভ্রান্তের ন্যায় এগিয়ে এলো অরোন। তীরুর বাহু চেপে ধরে শুধাল,

-” করুণা করে। দয়া করে। বিস্তারিত নিজের মায়ের কাছ থেকে জেনে নিও। ”

অরোন শার্ট ছুঁড়ে ফেলে বেড়িয়ে গেল। কক্ষে নেমে এলো নি ষ্ঠু র নীরবতা। তীরু স্তব্ধ! একটু হলেও বুঝতে পারছে সবটা। পা কাঁপছে তার। হাটুঁ ভেঙে বসে পড়ল শব্দ করে। বিড়বিড়িয়ে বলে উঠলো,

-” কেনো মা? কেনে আমায় ছোট করলে তুমি! ”

চলবে~

#যেখানে_পথচলা_শুরু |১৪|
#সাদিয়া_মেহরুজ

কিংকর্তব্যবিমুঢ় তানহা! আতঙ্কিত দৃষ্টিতে মেয়েকে দেখছেন তিনি। তার মনে ভয়, শঙ্কা! চিন্তায় চিন্তায় মাথা ব্যাথা শুরু হয়েছে। বুকে চাপ অনুভূত হচ্ছে। তানহার মনে হচ্ছে, তিনি এক্ষুণি হার্ট অ্যাটার্ক করে বসবেন। পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়ার সময় হয়তবা এসে গেছে। বিড়বিড় করা সূরা ইয়াসিন থেকে শুরু করে আয়াতুল কুরসি পড়লেন। অন্তকরণ বোধহয় একটু শান্ত হলো। তিনি এবার সাহস করে বললেন,

-” তীরু! মা আমার। থামো মা। মা রে! ও আম্মা আমার। শুনো একটু। ” কাতর কণ্ঠ!

মায়ের কাতর কণ্ঠ হৃদয়স্পর্শ করল তীরুর। উন্মাদ এর মতো আচরণ করা থামাল একটু। হাতের শেষ গ্লাসটা স্ব-শব্দে ভূমিতে নিক্ষেপ করে ল্যাপটপের সামনে এসে বসে পড়ল। স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে তানহার ভীত মুখোশ্রী! তীরুর মায়া হলো। চেঁচাতে গিয়েও কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

-” আমি তোমায় কক্ষনো মাফ করবোনা মা। আই হেইট ইউ! আই হেইট ইউ সো মাচ মা। ”

তীরু তাকে ঘৃ ণা করে! এ কথাটা তেমন বুকে কাটাঁ দিল না তানহার। কারণ তিনি জানেন, মেয়ে মিথ্যা বলছে। ঘৃ ণা করলে কি তীরু এ সময় মায়ের কথা শুনতো? উঁহু! তীরুর রাগ ভ য়ং ক র!একবার রেগে গেলে তাকে কেওই শান্ত করতে পারেনা, পারেনি।

-” আম্মারে, আমার ভুল হয়ে গেছে আম্মা। আমাকে ক্ষমা কইরো তুমি। বিশ্বাস করো আম্মা! অরোনের পা ধরে আমি বলি নাই তোমারে বিয়ে করতে। খালি তোমার প্রথম যেই ভন্ড বিয়েটা হলো ঐটা খুলে বলে বলছিলাম ‘ অরোন বাবা, আমার মেয়েটার কেওই নাই এই পৃথিবীতে। আমি কতদিন বাঁচি না বাঁচি! তুমি আমার মেয়েটার একটু দায়িত্ব নাও বাবা। ঐ বিদেশের মাটিতে তীরুটা কেমনে একা একা থাকবে বাবা? বলো তো তুমি! তীরুটা জেদ না করলে আমি ওকে কখনোই যেতে দিতাম না ফ্র্যান্স। ‘ বিশ্বাস কর আম্মা। এতটুকুই বলছি। তারপর অরোন রাজি হয়ে গেল। ওরাও তো পাত্রী খুঁজতেছিল। প্যারিসে থাকে এমন মেয়ে। এমনিতেই তো তোমারে বিয়ে করতো। ”

তীরু হতাশ কন্ঠে আওড়াল,

-” ওদের যদি আমাকে পছন্দ হতো তাহলে তো বিয়ে করেই নিতো তাই না মা? কেন তুমি ঐ রিকুয়েষ্টটা করতে গেলে? আমাকে ছোট করলে কেন আম্মা? আমাকে করুণা, দয়ার পাত্রী বানালে কেন? কেন? ”

সত্যি বলতে তীরুর করা এ প্রশ্নের উত্তর তানহার কাছে নেই। তানহা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করে ফেলেছেন তা এখন মনে হচ্ছে তার। অনুতপ্ত বোধ হচ্ছে! গ্রামে এক রক্ষণশীল পরিবারে তানহার বেড়ে ওঠা। ছোট থেকেই খেয়াল করতেন তিনি মেয়েদের প্রতি সমাজে রয়েছে আলাদা বৈষম্য। মেয়ে মানুষ মানেই অবহেলার পাত্রী, অপমানের পাত্রী! সংকীর্ণ মন নিয়ে বড় হয়ে ওঠা তার। স্বামীর ঘরে আসার আগে তাকে পাই পাই করে বলে দেয়া হয়েছে, মেয়ে মানুষের সবকিছু ‘ স্বামীকে ‘ ঘিরেই। স্বামী ভালো তো জগৎ ভালো! পিছে স্বামী নামক ঢাল নেই তো জীবন অন্ধকার। অতএব, স্বামী যাই বলুক না কেন তা হোক ভুল কিংবা সঠিক! সবই মুখে কুলুপ এঁটে মেনে নেওয়া স্ত্রী’দের একান্ত দায়িত্ব। তীরুর বাবা মা রা যাওয়ার পর সংসারে এক প্রকার লড়াই করে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনা তানহা তীরুর ব্যাপারে এসে কেমন সংকীর্ণমনা হয়ে গেলেন। প্রতেক বাবা – মা ই চায় তার সন্তান তাদের থেকে আরো ভালো থাকুক। তানহাও এমনটাই চাইতেন। স্বামীকে ছাড়া একাকী যে কষ্টটা তিনি করেছেন সে কষ্টটা যাতে তীরুর না করতে হয় তার জন্য উঠে পড়ে লাগলেন তিনি মেয়ে কে বিয়ে দেয়ার জন্য। প্রথম বিয়েটা কেমন অদ্ভুত কারণে বিনষ্ট হলো। দ্বিতীয়বারে তার মন শঙ্কায় আঁটসাঁট! পেলেন অরোনকে। দ্বিকবিদিক শূন্য হয়ে, নিজের আত্মসম্মান মাটিতে পিষে ফেলে অরোনকে করে বসলেন হাতজোড় করে অনুরোধ! ভাবলেন, তীরুটা কেবল বিয়ে হলেই সুখী হবে। স্বামীর ছায়া থাকলে তীরুকে কোনো বিপদ স্পর্শ করতে পারবে না সহজে। এমন উদ্ভটমনা অবশ্য তিনি এক, দুদিনে হননি। আশপাশের নানাবিধ ঘটনা, মানুষের কান পোড়াতে শক্ত তানহা হয়ে পড়েন নম্র, ভীতিগ্রস্ত। অথচ এই তিনিই একদিন মানুষের কথা কখনোই কানে তুলতেন না, আশেপাশের হৃদয়স্পর্শী ঘটনা তার হৃদয় ছুতোঁ না! সময় এবং কালের পরিবর্তন মানুষের চিন্তা – ভাবনাকে ঠিক কতটা পরিবর্তন করে দেয় তানহা তার স্পষ্টত উদাহরণ।

কল কে টে দিয়েছে তীরু। তানহা কল ব্যাক করলো কয়েকবার। তীরু কল রিসিভ করলো না। করবেও না আর! তানহার সাথে আপাতত অনির্দিষ্টকালের অভিমান পর্ব চলবে। ল্যাপটপ শব্দ করে বন্ধ করে ওটাকে ছুঁড়ে মা র ল তীরু! পড়ল ভূমিতে। ধ্যান দিল না সে। ব্যাস্ত হলো ব্যাগ গোছাতে। প্রয়োজনীয় সকল জিনিসপত্র নিয়ে চট করে চেইন লাগালো। চলে যাবে সে এ বাড়ি থেকে। আজ ক্ষীণ সময় পূর্বে অরোন যা বলে তাকে আ ঘা ত করল তারপরও কি বে হা য়া র মতো এ বাড়িতে পড়ে থাকা যায়? তীরু আরো ছোট হয়ে যাবে না? অবশ্যই হবে! কারণ এই যে, অরোন তাকে বিশেষ পছন্দ করে না আজ তা প্রমাণিত হয়েছে। ভালো মানুষীর অভিনয় করতে করতে আজ ছেলেটার আসল রূপ বেরিয়ে এসেছে।

-” ভাবী.. কোথায় যাচ্ছো তুমি? ” প্রিয় চেঁচাল!

হকচকিয়ে পিছন তাকাল তীরু। প্রিয়র চোখমুখে লুটোপুটি খাচ্ছে কৌতূহল, প্রশ্ন! ও ধীরেসুস্থে এগোল। বলল,

-” চলে যাচ্ছি। ”

প্রিয় তড়িঘড়ি করে জিজ্ঞেস করলো,

-” চলে যাচ্ছো মানে? কোথায় যাচ্ছো? ”

-” আমি হোস্টেলে ফেরত যাচ্ছি প্রিয়। এর বেশি আমি কিছু বলতে চাচ্ছি না। তুমি তোমার অরোন ভাইয়ার কাছ থেকে জেনে নিও। ”

-” তোমার কি আবার পরিক্ষা শুরু হচ্ছে নাকি ভাবী? ইশ! মাত্রই এলে। তুমি চলে যাবে এটা ভাবলে তো আমার দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইছে। ”

তীরু নিষ্প্রাণ কন্ঠে শুধাল,

-” ভালো থেকো প্রিয়। সময় পেলে হোস্টেলে এসে দেখা করে যেও। ”

কৃত্রিম হাসার চেষ্টাটা বৃথা গেল তীরুর। হাসি আসছে না। কৃত্রিম হাসিও না! সবকিছুতে কেমন নিষ্প্রভতা ছেয়ে। ব্যাগটা শক্ত করে চেপে ধরে তীরু হাঁটা ধরল। পেছন পেছন আসছে প্রিয়। মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেছে! তীরু কেন যাচ্ছে? তা তো তার জানা নেই। তবে সে নিশ্চিত অরোন এবং তীরুর মাঝে কোনো ঝামেলা চলছে। এইতো একটু আগে সে অরোনকে চেঁচাতে শুনল। অরোন প্রয়োজন এবং খুব বেশি রেগে না গেলে চেঁচায় না। প্রিয় তা খুব ভালো করেই জানে।

সদর দরজার সামনে আসতেই দু’জন খেয়াল করে অরোনকে। বাড়ির সামনেই গাড়ি রাখা। গাড়ি থেকে নেমে লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে আসছে ছেলেটা। তীরু থামল! অরোনের মুখোশ্রী সবসময়কার মতো হয়ে নয়। কেমন গুমোট, গম্ভীরতার বিচরণ। কাছে এলো অরোন। বিলম্ব না করে প্রশ্ন ছুড়ল,

-” কোথায় যাচ্ছো তীরু ব্যাগ নিয়ে? ”

গলার কাছে কেমন তেঁতো একটা ভাব এসে জমে রয়েছে। তীরুর ইচ্ছে করল এই অ স ভ্য ছেলেটাকে এক্ষুণি কিছু কঠিন কথা শুনিয়ে হনহনিয়ে চলে যেতে। কিন্তু তা সম্ভব হলো না। প্রিয় যে পাশে! কি করে বলবে? নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রেখে ও বলে উঠলো,

-” যেখানে আমার যাওয়ার কথা, যেখানে আমার থাকার কথা সেখানেই যাচ্ছি। ”

স্বামী স্ত্রীর কথার মাঝে থাকতে ইচ্ছে হলো না প্রিয় এর। ও নিরবে জায়গাটা ছেড়ে চলে গেল। প্রিয়র যাওয়া দেখে অরোন স্বস্তি পেল। ও গলার স্বর নামিয়ে নম্র গলায় শুধাল,

-” তীরু! আমার কথা শোনো। আমি তখনকার ব্যাবহারের জন্য দুঃখিত। কিছু বিষয় নিয়ে মেজাজ খারাপ ছিল তাই ভুলবশত আমি অমন আচরণ করে ফেলেছি। প্লিজ পার্ডন মাই মিস্টেক। ”

তিতকুটে চেপে রাখা রাগটা তাজা হলো! তীরু হিসহিসিয়ে তেড়ে এসে বলল,

-” অন্যের রাগ আমার ওপর ঝাড়েন? ফাজলামো করেন আমার সাথে? যখন যা ইচ্ছে করবেন যা মনে আসবে তাই করবেন। কাছে টানতে ইচ্ছে করলে টানবেন আবার হুঁশে এলে দূরে ছুঁড়ে মা র বে ন। আমি কি কোনো ফেলনা বস্তু? হুহ? ভালো করে শুনে রাখুন অরোন! আমি কারো করুণার পাত্রী হয়ে বাঁচতে চাই না। জাহান্নামে যান আপনি আর আপনার মনমেজাজ আই ডোন্ট কেয়ার! ”

চলে যাচ্ছে তীরু। ঝড়ের গতীতে অরোনের দৃষ্টির সামনে থেকে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অরোন নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে। অপরাধবোধ হচ্ছে! তাই তো ফিরে আসা। সে কিভাবে খুলে বলবে তার মনের কথা কাওকে? সে যদি নিজের অন্তরালে লুকিয়ে রাখা কথা গুলো পেশ করতে পারতো তাহলে তীরু হয়ত তাকে আজ ছেড়ে যেত না। অরোনের খুব করে বলতে ইচ্ছে হলো,

-” পৃথিবী, আমার জীবনে সুখ কবে আসবে? ”

চলবে~