এই মন তোমাকে দিলাম পর্ব-২০+২১

0
356

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-২০
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
রূপন্তী মুখটা নিষ্পাপ বানিয়ে বসে আছে। তার নিশ্বাসও বুঝে শুনে নিতে হচ্ছে। কারণ তার সামনে আপাতত সোজা ভাষায় বলতে গেলে যমদূত দাঁড়িয়ে আছে। এবং তার চাহনি প্রচন্ড তীক্ষ্ণ ও ধারালো।পারছে না সেই চাহনি দিয়ে পুড়িয়ে দিতে!
রূপন্তী ঠোঁট বাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলো।লাভের লাভ কিছুই হলো না।সায়নের চাহনি বদলালো না।রূপন্তী আর থাকতে না পেরে ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– গরুর মতো তাকিয়ে আছিস কেন?
সায়ন এবার দাঁত চিবাতে চিবাতে বলল,
– সোনামণি, আমাকে একটু বলো তো তুমি গতকাল কি কি করেছ?
রূপন্তী একটু ভড়কালো।এই পোলা ক্ষেইপ্পা রইসে কেন?
সে মুখ বাঁকালো।তারপর আঙুলে গুণে গুণে হিসেব দিতে লাগলো,
– গতকাল আমি আমার হসপিটালে দুপুর একটা পর্যন্ত রোগী দেখেছি।তারপর গিয়েছি নারায়ণগঞ্জ এ।এরপর রিমিকে নিয়ে দুপুরে লাঞ্চ করে হোস্টেলে রেখে আমি ওখানকার হসপিটালে গিয়েছি।সন্ধ্যার পর দুটো ওটি এটেন্ড করেছি।ফেরত আসতে যাবো তখন আরেকটা ওটি করা লাগলো।আসার সময় রাত করেও জ্যাম পেয়েছি।তারপর বাসায়া এসেছি রাত দেড়টার দিকে। এই তো!

সায়ন এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
– কি কি খেয়েছিস সেটা বল।
রূপন্তী কিছুক্ষন ইতি-উতি করলো।তারপর মাথাটা নিচু করে আমতা আমতা করে বলল,
– ইয়ে মানে!সকালে দেরি হয়ে গিয়েছিলো বলে চলে গিয়েছিলাম।পরে এক কাপ কফি আর কেক খেয়েছিলাম।দুপুরে রিমির সাথে এক পিস চিকেন আর সালাদ খেয়েছিলাম।সন্ধ্যায় আবার এক কাপ কফি খেয়েছিলাম।
– এরপর?রাতে?
– উমম! রাতে আসলে এসে আলসেমি করে আর কিছু খাই নাই।
সায়ন এবার তেড়ে এসে বলল,
– সারাদিনে এতটুকু খাবার খেলে তো মাথা ঘুরে পড়বিই।ভাগ্যিস আমি সময় মতো এসেছিলাম।নাহলে আজ মাথা ফাটাতি।এই!ডাক্তার হয়ে নিজের ক্যালোরি ক্যালকুলেশন পারিস না? এতটুকু খেলে এনার্জি পাওয়া যায়?।
– আসলে সময় পাই নাই।
সায়ন একটা ক্লান্তিকর শ্বাস ফেলে বলল,
– দুপুরে ওই মেয়েটার সাথে ভাত খাইতি।সালাদ কেন খেয়েছিস? তুই অসুস্থ হলে আমাকে কেও আস্ত রাখবে না।

রূপন্তী আর কিছু বলল না।সায়নও কিছু না বলে চলে গেলো।যাওয়ার আগে অবশ্য রূপন্তীকে নাস্তা খেতে আসতে বলল।
রূপন্তী এক মনে সায়নের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো।ছেলেটা কি নিজে বকা খাওয়ার ভয়ে তাকে ঝাড়ি মারলো?নাকি নিজের উৎকণ্ঠা থেকে ঝাড়লো।ছেলেটা ইদানীং ওর প্র‍তি অনেক নরম হয়েছে৷
রূপন্তী সায়নকে নিয়ে বিভোর হতে চাইলেও আর পারলো না। তার মাথায় এখন অন্য এক চিন্তা বাসা বেঁধেছে। এবং সে সেই চিন্তাটাই করতে করতে ওয়াশরুমে ঢুকলো ফ্রেশ হতে।

খাওয়ার সময় আধা রুটি খেয়ে উঠতে গেলেই সায়ন ওকে আবার ঝাড়ি মেরে বসিয়ে দিলো।তারপর নিজে যত্ন করে পাশে বসে খাইয়ে দিলো।রূপন্তীর কোনো ভাবাবেগ নেই।সে একমনে কিছু একটা ভেবেই চলেছে।এদিকে সায়ন যে তাকে দুটো রুটি খাইয়ে দিয়েছে সেদিকে তার খেয়ালও নেই।
সায়ন ভ্রূ কুঁচকে খানিকক্ষণ রূপন্তীকে পর্যবেক্ষণ করলো।তারপর গলা খাকাড়ি দিয়ে ওকে এই দুনিয়ায় টেনে আনার জন্য মেঘস্বরে জিজ্ঞেস করলো,
– এই মেয়ে! কি ভাবিস এত?
রূপন্তীর চমকে উঠার কথা থাকলেও সে চমকালো না।বরং চিন্তিত ভাবে সায়নকে জিজ্ঞেস করলো,
– তুই ভালো কোনো লয়ারকে চিনিস?একজনকে হুমকি দেওয়ার ব্যাবস্থা করতে হবে।
সায়ব ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
– কেন? কাকে হুমকি দিবি।
– তুই বল।তোকে পরে বলবো।
সায়ন হাত ধুয়ে রূপন্তী মুখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
– তাফসি ভাবি আছে।
– কিন্তু ভাবি তো প্রেগন্যান্ট!
– কথা তো বলে দেখতে পারিস। আপু না পারুক, অন্য কারো কথা বলতে পারবে। বস,আমি চা টা নিয়ে আসি।

সায়ন দুই কাপ চা নিয়ে ফেরত আসলো।এক কাপ রূপন্তীর দিকে এগিয়ে দিয়ে আরেক কাপ নিজের কাছে রাখলো।
রূপন্তীর চায়ে চুমুক দিতেই টনক নড়লো।সায়নের দিকে তাকিয়ে বলল,
– রুটি-ভাজি তুই বানিয়েছিস?
– হুম।
– তুই রান্নাবান্না করতে পারিস?
সায়ন এবার বিরক্ত হয়ে বলল,
– বেকুব,দেশের বাহিরে তোর মতো আমিও একা থাকতাম।মুখের সামনে কেউ খাবার এনে দিতো না।
-বেকুব বলবি না।
সায়ন এবার ব্যাঙ্গ করে বলল,
– হ,এখন তো পাগল ছাগলদেরকেও মানুষ ডাকতে হয়।
রূপন্তী এই কথা আর পাত্তা দিলো না।চায়ে আরেকটা চুমুক দিয়ে বলল,
– তুই রান্না পারলে আমাকে এতদিন কামলার মতো খাটালি কেন?
-তুই নিজেই সব করতি। আমি আর কই খাটালাম?
– আচ্ছা, এখন থেকে এক সপ্তাহ তুই বাজার করে রান্না করে খাওয়াবি। আরেক সপ্তাহ আমি বাজার করে রান্না করে খাওয়াবো।
– আচ্ছা।এখন বল লয়ার খুঁজছিস কেন?
রূপন্তী তখন চা টা শেষ করে উঠে যেতে যেতে বলল,
-বড় কাহিনী।সময় নিয়ে বলব। এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে।
.
তাফসির পাঁচ মাস চলছে। শরীর ইদানীং ভালো যায় না।ডাক্তার স্ট্রেস কম নিতে বলেছে। তাই সে আপাতত সপ্তাহে তিন দিন প্র‍্যাক্টিস এ যায়। সামনের মাস থেকে পুরোপুরি বন্ধ করে দিবে। বাচ্চাটার গ্রোথ ওত একটা ভালো না।এজন্যই চিন্তা।
আজ প্র‍্যাক্টিস এ যাওয়ার কথা থাকলেও গেলো না।রূপন্তী আসবে কি নিয়ে কথা বলতে।লাঞ্চ টাইমে আসবে।তাই সে আপাতত রান্না বসিয়েছে।
রান্না শেষ করে সব গোছগাছ করতেই রূপন্তীর আগমব ঘটলো।তাফসি নগদে আগে ওকে খেতে বসিয়ে দিলো।এর পেছনে অবশ্য একজনের নির্দেশ আছে। রূপন্তীকে ঠিকঠাক ভাবে খাওয়ানোর দায়িত্ব পড়েছে তার ঘাড়ে।
রূপন্তী না চাইলেও জোর করে বেশ খানিকটা খেতে হলো।তারপর দুজনে বসলো তাফসির বেড রুমে। রূপন্তীর আবার বিকাল থেকে রোগী দেখতে হবে।হাতে সময় কম।তাই সে যত দ্রুত সম্ভব পুরো কাহিনী বলল।সব শুনে তাফসি মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
– এই লোকটার নামে আরো অনেক কেস আছে।তবে ক্ষমতার জোরে কখনো ধরতে পারেনি।এই লোক মানুষ মারতেও দ্বিধাবোধ করে না।এখন ব্যাপার হচ্ছে, আমি মাত্র প্র‍্যাক্টিস করি। ওই লোক আমাকে এক ফোটাও গুণবে না।
– তাহলে তোমার চেনা কেউ আছে।
– হুম।দাঁড়া।
রূপন্তী উঠে ফোন হাতে নিলো।তারপর একটা নাম্বার বের করে রূপন্তীকে পাঠিয়ে বলল,
– একটা নাম্বার পাঠিয়েছি।উনি আমার অবেক সিনিয়র।যথেষ্ট পাওয়ারফুল।আমি ওনাকে বলে দিবো। তুই উনার কাছ থেকে হেল্প নে।
– আচ্ছা।
দুজন আরো টুকটাক কথা বলল।তারপর রূপন্তী উঠলো বের হয়ে যাওয়ার।
দরজার সামনে গিয়ে তাফসি রূপন্তীকে খালিএকটা কথাই বলল,
– রাফি এহমাদ মানুষটা ভয়ংকর রূপু। খুব সাবধান! বাড়াবাড়ি করিস না।
রূপন্তীও মলিন হেসে উত্তরে খালি একটা কথা বলল,
– আমি নিজেকে নিয়ে ভয় পাচ্ছি না।

রাতে সায়নের ফিরতে ফিরতে অনেক দেরি হয়ে গেলো।ভেবেছিলো রাতে ফিরে রূপন্তীর সাথে কথা বলবে। মেয়েটা কি নিয়ে এত চিন্তা করছিলো শুনবে। সবচেয়ে বড় চিন্তা হলো শ’য়’তা’ন মেয়েটা খেয়েছে নাকি।নাহলে কাল আবার মাথা ঘুরে পড়বে।
কিন্তু আসতে আসতে এত দেরি হলো যে রূপন্তী তখন ঘুমে বিভোর।ওর রুমে একবার উঁকি দিয়ে সায়ন আগে ফ্রেশ হলো।এরপর রান্নাঘরের দিকে রওয়ানা হলো।যদি মেয়েটা না খেয়ে থাকে, তাহলে একটা থাপ্পড় মেরে ঘুম থেকে উঠাবে। তারপর খাইয়ে দিবে।তবে সিংকে এঁটো প্লেট দেখে বুঝলো খেয়েছে। সে নিজেও খেয়ে নিলো।তারপর রুমে যাওয়ার আগে আরেকবার রূপন্তীর রুমে উঁকি দিলো।মেয়েটা গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।ভারি নিশ্বাসের আওয়াজ আসছে।
সে পা টিপে টিপে বিছানার কাছে আসলো।আবাছা অন্ধকারে মেয়েটার মুখের নিকট ঝুঁকলো।তারপর দুই গালে দুটো চুমু খেয়ে কপালে টুপ করে একটা চুমু খেয়ে সরে এলো।বাহিরের আবছা আলোয় এক মনে তাকিয়ে রইলো আদুরে মুখটার দিকে। এই আদুরে ভাবটাই তো ইদানীং তার বুকে দামামার সৃষ্টি ঘটয়েছে।
.
সপ্তাহ ঘুরলো। তারপর আবারো শনিবার এলো।এই দিনটা রূপন্তীর জন্য সবচেয়ে হেক্টিক। এই যেমন এখন রাত সাড়ে বারোটা বাজে, মাত্র একটা ওটি শেষ হলো।আজকে মোট পাঁচটা ওটি করেছে।আজ অবশ্য দিনে একটা কাজের জন্য তার এখান আসতে দেরি হয়েছে।কাজটা সফল হয়েছে নাকি সেটাই ভাবনার বিষয়।তার মাথায় আপাতত সেটাই ঘুরছে।
সব গুছিয়ে রূপন্তী বের হবে, তখনি একটা নার্স হন্তদন্তভাবে ওর কেবিনে ঢুকলো।হাপাতে হাপাতে বলল,
– ম্যাম, একটা পেশেন্ট এসেছে। আপনাকে আসতে হবে।
রূপন্তী ব্যাগটা রেখে সেখান থেকে স্টেথোস্কোপ বের করতে করতে বলল,
– কেস কী?ব্যাথা পেয়েছে।
নার্সটা তখন গলা নিচু করে বলল,
– না ম্যাম।
– তাহলে?
– রেপ কেস!
#চলবে।

#এই_মন_তোমাকে_দিলাম
#পর্ব-২১
#আরাদ্ধা_সাদাত_খান
নারায়নগঞ্জ সদরের এই হাসপাতালটা মোটামুটি নতুন বলা চলে।হাসপাতালের মালিক নিজেও একজন ডাক্তার। নিজেকে সপেছে মানব কল্যাণে।দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ান, সেমিনার এটেন্ড করেন, রিসার্চ করেন।
নারায়নগঞ্জের এই হাসপাতালে তিনি কোনো প্রকার ক্রুটি রাখেননি।ভালো যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে সপ্তাহে সাত দিন ই শহর থেকে ভালো ডাক্তার আসে।তাছাড়া প্রতিদিন যারা বসে তারাও খুবই ভালো।খুব কমদিনে এম.কে হস্পিটাল চিকিৎসা দানের ক্ষেত্রে ভালো নাম ধারণ করেছে।
সেই হাসপাতালের তিন তলায় অবস্থিত আইসিউতে সকাল ৮টায় রিমি মারা গেলো।রূপন্তীর নীরব চোখে দেখা ছাড়া আর কোনো কিছু করার ছিলো না।
গাইনোকলজিস্ট সেলিনা পারভিনের মেয়েটাকে খুবই জঘন্যভাবে কষ্ট দেয়া হয়েছে।
রূপন্তী নিজের কেবিন পাথরের মতো বসে রইলো অনেক্ষন।তারপর ব্যাগ হাতে বেরিয়ে পড়লো।সে খুব ভালোমতোই জানে তার এখন কি করতে হবে।শুধুমাত্র হাতে কিছু স্ট্রং আলামত দরকার।রিমির বডিটা পোস্টমর্টেম করতে হবে।
পোস্টমর্টেম এর কথা চিন্তা করতে এতক্ষনের জমে থাকা কষ্টটা অশ্রু স্বরূপ বেরিয়ে এলো।মেয়েটা কত আশা করে তার সাথে এসেছিলো!সেই আশার বিনিময়ে রূপন্তী মেয়েটার শরীরকে এখন পাঠাবে খন্ডে খন্ডে বিভক্ত করতে?
.
নিজের কাজ শেষ করে রূপন্তী বাসায় ঢুকলো এগারোটার সময়। সারারাত নির্ঘুম।ছিলো,খাওয়া দাওয়া নেই, কোনো রেস্ট নেই, ফোলা লাল চোখ সব মিলিয়ে রূপন্তীকে উদ্ভ্রান্তের মতো লাগছিলো।অপরদিকে সায়ন গত রাত থেকে মেয়েটাকে কল দিতে দিতে অস্থির হয়ে গেছে। শেষে হাসপাতালে কল দিয়ে জানতে পেরেছে রূপন্তী হাসপাতালেই আছে এবং একটা সিরিয়াস কেস হ্যান্ডেল করছে। তবুও সায়নের রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। সকালে উঠে নিজের হাসপাতালে জানিয়ে দিয়েছে আজ দুপুরের পরে বসবে, সকালে যাবে না।এত চিন্তা নিয়ে রোগী দেখা যায়? পরে দেখা যাবে ভুল চিকিৎসা দিয়ে মানুষ মেরে ফেলেছে।
রূপন্তী যখন ঢুকলো তখন সে বসে বসে এনাটমির একটা বই উল্টাচ্ছিলো।তাই বই থেকে চোখ না তুলেই শ্রাগ করে বলল,
– এই ছাগল!রাতে যে ফিরতে পারবি না এক ফাঁকে জানিয়ে দিবি না?আমি তো চিন্তায় নিজের ঘুম হারাম করে ফেলেছি।

রূপন্তী কোনো উত্তর দিলো না।সায়ন ও কোনো সাড়া শব্দ না পেয়ে চোখ তুলে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো।রূপন্তী দরজার সামনেই ফ্লোরে বসে অঝোরে কাঁদছে। কিন্তু নীরবে, নিশব্দে!
সায়ন তাড়াতাড়ি উঠে ওর কাছে গেলো।টেনে ওকে উঠে দাঁড় করালো।কাঁধে হাত রেখে অস্থির হয়ে কি হয়েছে জানতে চাইলো।রূপন্তীর মুখে কোনো কথা নেই।তার কান্না বেড়েই চলছে। এবার সাথে ফুপানোর আওয়াজও শোনা যাচ্ছে।
সায়ন কি করবে ভেবে না পেয়ে মেয়েটাকে নিজের বুকে আবদ্ধ করলো।মাথায় পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে আদুরে গলায় বলল,
– আমাকে বল কী হয়েছে?সমস্যা না বললে তো সমাধান করা যাবে না। বল না সোনা!

অনেক্ষন বলার পর রূপন্তীর মুখ থেকে আবছা কথা শুনে সায়ন যা বুঝলো তা হলো, রূপন্তী গত রাতে যে পেশেন্টটার ও.টি করেছে, তাকে বাঁচাতে পারেনি।এজন্য মেয়েটা এভাবে কান্নায় ভেঙে পড়েছে! সায়ন আপাতত পেশেন্টের কি হয়েছিলো,কিভাবে মারা গেলো, এসবের ধারে কাছে গেলো না।তাদের জন্য এসব নিত্যদিনের ব্যাপার।প্রতিদিনই তারা মানুষের মৃত্যুর সাক্ষী হয়।

সে রূপন্তীকে সেভাবে কোলে তুলে নিলো।তারপর রুমে গিয়ে মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো।স্ফিগমোমেনোমিটার এনে প্রেশার মাপলো।সব সময়ের মতো লো।কি জানি শেষ কখন খাবার খেয়েছে! নাহলে এত ক্লান্ত হতো না যে কোলে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়বে।
সময় দেখলো ঘড়িতে।সাড়ে এগারোটার বেশি বাজে। তার আবার দুইটার সময় ওটি আছে।এর মধ্যে লাঞ্চহের ব্যাবস্থা করে তাকে রেডি হতে হবে।দেরি করলো না আর।এবার ভালোই শীত পড়েছে।রূপন্তী ইতিমধ্যে শীতে কুকড়ে গোল হয়ে ঘুমাচ্ছে।সায়ন আনমনেই হাসলো।উঠে দরজা জানালার পর্দা টেনে দিলো। তারপর কম্ফোর্টার টা রূপন্তীর গায়ের উপর ভালোভাবে জড়িয়ে দিলো।এরপর রুমের দরজাটা টেনে বেরিয়ে গেলো।

সায়ন কি রান্না করবে ভাবতে ভাবতে দুনিয়া উল্টে ফেললো।তারপর ফ্রীজ হাতিয়ে রুই মাছে পেলো।কাটা আছে।যাক আল্লাহ বাঁচিয়েছে!
রান্না শেষ করে, গোসল করে,নামাজ পড়ে সে যখন ঘড়ির দিকে তাকালো তখন দেড়টা বাজে। রূপন্তীর রুমে একবার ঢু মেরে দেখলো সে এখনো বেঘোরে ঘুমাচ্ছে।সায়ন আর জাগালো না। নিজের মতো খেয়ে রেডি হয়ে বেরিয়ে গেলো।
.
রূপন্তীর যখন ঘুম ভাঙলো তখন সন্ধ্যা হয়ে এসেছে।
ঘুম ভাঙার পর তার সব কিছু ধরে উঠতে সময় লাগলো।উঠে মাথা ধরে বসে থাকলো কিছুক্ষন।বালিশের চারপাশ হাতালো ফোনের জন্য,কিন্তু পেলো না।রুমে পুরো অন্ধকার। তবে দেয়াল ঘড়িটা রেডিয়ামের হওয়াতে সময় স্পষ্ট দেখা গেলো।বিকেল পাঁচটা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট।
রূপন্তী বেকুব হয়ে গেলো।এজন্যই রুম এত অন্ধকার।ডিসেম্বর চলাতে সন্ধ্যা অনেক আগেই হয়েছে।
নেমে দাঁড়াতেই টের পেলো প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে।মাথাও ঘুরাচ্ছে। রুম থেকে বের হয়ে আগে ডাইনিং রুমের লাইট জ্বালালো। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো রান্না করা আছে। সায়ন করে রেখে গেছে।প্লেটে একটি ভাত-তরকারি নিয়ে ওভেনে গরম করে নিলো।তারপর টেবিলে বসে সময় নিয়ে খেলো।
এরপর প্লেট বাটি ধুয়ে রুমে ফেরত গেলো।এবার লম্বা একটা গোসল নেয়া দরকার।গিজারের সুইচটা অন করে সে ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো।এবং সত্যি সত্যি সে পুরো পঞ্চান্ন মিনিট ধরে গোসল করলো।
গোসল সেড়ে যখন বেরিয়েছে তখন সাতটা পনেরো বাজে।বাথরোব চেঞ্জ করে জামাকাপড় পড়ে সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছে, ঠিক সেই সময় সায়ন এসে ঢুকলো।
রূপন্তী সায়নের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হা করে তাকিয়ে আছে।রূপন্তী একটু অবাক হলো।এরকম হা করে তাকিয়ে আছে কেন?
এক মিনিট পরেও যখন কোনো বদল দেখা গেলো না তখন রূপন্তী গলা ঝেড়ে জিজ্ঞেস করলো,
– এরকম হা করে কী দেখছিস?
সায়ন তখন হুশ ফিরে পেলো যেনো।তারপত বিস্মিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
– তোর চুল এত লম্বা? আগে কখনো দেখি নাই কেনো?
রূপন্তী তখন ভেংচি মেরে বলল,
– তুই আমার কোন জিনিসটাই বা আগে খেয়াল করেছিস?
– দেখি আমার দিকে ঘুরে দাঁড়া তো একটু।
রূপন্তী ঘুরে দাঁড়াতেই সায়ন এক নজরে পায়ের দিকে তাকিয়ে রইলো।তারপর বলল,
-৪০
– কী?
সায়ন কোনো উত্তর দিলো না, তার নজর আপাতত রূপন্তী কোমরে। আবার কিছুক্ষন কিছু একটা খেয়াল করে বলল,
-৩৮
রূপন্তী আবার কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই সে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে পারলো,যখন সায়নের তীক্ষ্ণ নজর গিয়ে ঠেকলো তার বুকে।লজ্জায় হতভম্ব হয়ে সে হাতে ধরে থাকা হেয়ার ব্রাশটা সায়নের দিকে ছুড়ে মারলো।সায়ন সময়মতো সরে গেলো। রূপন্তী তখন লজ্জায় হাসফাস করতে করতে চিৎকার মারলো,
– রুম থেকে যা শয়তান!
সায়ন নির্বিকার কণ্ঠে গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল,
– তুই তো বললি খেয়াল করতে।
– যা তুই।
– যাচ্ছি। যা গিয়ে চা বানা।আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।

দুজন চা খেতে বসলো ড্রয়িংরুমে।চায়ে চুমুক দিয়ে রূপন্তী সায়নের উদ্দ্যেশ্যে জিজ্ঞেস করলো,
– আজ এত তাড়াতাড়ি এলি যে?
– রোগী কম ছিলো।আর শুন,মাসের শেষ তিন দিন কিন্তু সাভারে থাকবো।।
– আচ্ছা।
সায়ন এবার নড়েচড়ে বসলো।এবার সরাসরি রূপন্তীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– বল।আজ এত কান্নাকাটি করলি কেন?

রূপন্তী অনেক আগেই ঠিক করেছে সায়নকে সব খুলে বলবে। একজনকে পাশে দরকার।
সে যখন সব খুলে বলার জন্য মুখ খুললো তখনই তার ফোনে একটা কল আসলো।সে সায়নেকে বলে ফোন হাতে ছোট ছাদটাতে চলে গেলো।
কল দিয়েছে নারায়নগঞ্জ সদর থানার ওসি।রূপন্তীর কেসটা গ্র‍্যান্টেড হয়েছে এটা জানাতে।
রূপন্তী উনার সাথে কথা বলে ফেরত আসবে, তখনই একটা মেসেজ এলো,
“তুমি স্বেচ্ছায় আগুন নিয়ে খেলতে চাচ্ছো।এমন সাহসী মেয়ে খুব কম দেখতে পাওয়া যায়। আই লাইকড ইট সুইটহার্ট! বাট রিমেম্বার,আমি কোনো সাধারণ আগুন নই।এই আগুনে যারা ঝাপ দিয়েছে, তাদের পুড়ে যাওয়া ছাইয়ের টিকিটাও কেও খুঁজে পায়নি। কাউকে মাঝে আনতে চেয়ো না।তোমার সাথে সাথে সেও কয়লা হয়ে যাবে।সি ইউ সুন সোনা!”
#চলবে।