প্রাণেশ্বর পর্ব-২৯+৩০

0
318

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
২৯।

সময়ের স্রোতে কান্নার শব্দ তীব্র হয়। তনুকা আর রেনু ছুটে যায়, সেই শব্দের কারণ উদঘাটন করতে। শব্দ আসছে চারতলা থেকে। আর চারতলায় একটাই কামরা, মোহন লাল মজুমদারের।

তনুকা আর রেনু ছুটে গেল সেই কক্ষে। গিয়ে দেখল, আম্বিরা বেগম মোহন লাল মজুমদারের বিছানার পাশে বসে কাঁদছেন। সময় নিল না বেশি। ততক্ষণাৎ অযাচিত এক ভয়ে রেনুর বুকে মোচড় দিল। সে এগিয়ে গেল ত্রস্ত পায়ে। মায়ের শিউরে হাঁটু ভেঙে বসল। তনুকা দরজার কাছে ঠাই দাঁড়ান। শরীর অসাড় তার। হাত পা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে আসছে। রেনু ভয়ে ভয়ে মা’কে জিজ্ঞেস করল,

‘আম্মা, কাঁদছো কেন?’

আম্বিরা বেগম কান্নার শব্দ বাড়িয়ে দিলেন। মেয়ের বুকের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে বললেন,

‘সব শেষ রে মা, আমার সব শেষ। আমার স্বামী যে আর আমাকে দেখবেন না, মা। আমার স্বামী যে আমাকে ছেড়ে আজীবনের জন্য চলে গিয়েছেন। আমি এখন কী নিয়ে বাঁচব, কার আশায় বাঁচব? ও আল্লাহ…’

তিনি বিলাপ ছেড়ে কাঁদছেন। রেনুর গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সে একবার তার বাবার মুখের পানে চাইল। সবসময়ের মতো ঘুমন্ত’ই মনে হলো তাঁকে। কোনোদিক দিয়ে তো মৃ’ত মনে হচ্ছে না। মায়ের কি তবে কোথাও ভুল হচ্ছে? সে মা’কে ছেড়ে হাঁটুর উপর ভর করে দাঁড়ায়। বিছানার কিনারে হাত রেখে নিষ্পলক চেয়ে থাকে বাবার দিকে। কাঁপা কাঁপা হাতে একবার সাহস করে বাবার গাল স্পর্শ করে। অত্যধিক ঠান্ডায় বক্ষঃস্থল কম্পিত হয় তার। বিশ্বাস হয়, সত্যিই বাবা মৃত। ধপ করে জমিনে বসে। স্তব্ধ হয়, কান্না আসে না। অথচ বুক ফেটে চৌচির যেন। তনুকা এখনও বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একে একে বাড়ির সবাই দোরের মুখে উপস্থিত। মেহতাব বিচলিত পায়ে ছুটে এসে তনুকার পাশে দাঁড়ায়। পরিস্থিতি ঠাহর করতে না পেরে তনুকাকে জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে?’

তনুকা অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে শুধুমাত্র “বাবা” শব্দখানা। মেহতাব বাবার দিকে তাকায়। মা আর বোনকে দেখে বাকিটুকু আর বুঝতে বিলম্ব করে না। সে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয় কতক্ষণ। বাড়ির বাকি সব সদস্যের কারোর মুখে কোনো রা নেই। তারা বর্তমানে খুশি না বেজার তা বোঝা কষ্টসাধ্য।

মেহতাব এগিয়ে আসে। বাবার শিউরে বসে একবার হাতের নাড়ি পরীক্ষা করে। হয়তো ভেবেছিল, বেঁচে থাকলেও থাকতে পারে। তবে তাকে আশাহত করে দিয়ে ফলাফল বের হলো, তার আব্বাজান সত্যিই মা’রা গিয়েছেন। এখন এই তিক্ত বিদঘুটে সত্যিটা মেনে নেওয়া ছাড়া তার আর কোনো উপায় নেই।

রেনু ভাইয়ের দিকে চাইল। চোখ শুকনো, অথচ ভেতর অগ্নি দাবানলে জ্বলে যাচ্ছে। সে অসহায় কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘ভাইজান, ডাক্তার ডাকবে না? ডাক্তার কি আব্বাজানকে বাঁচাতে পারবেন না, ভাইজান? তুমি ডাক্তার ডাকো না একবার, ডাক্তার পারবেন তো।’

মেহতাব চোখ বোজে নিশ্বাস ছাড়ে। এগিয়ে এসে বোনের মাথায় হাত রেখে বলে,

‘উপর থেকে ডাক এলে, কারোর ক্ষমতা নেই সেই ডাক অগ্রাহ্য করার। পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো ডাক্তারকে নিয়ে এলেও আজ আর আমাদের আব্বা চোখ মেলে চাইবেন না, রেনু। আব্বা যে আজীবনের জন্য ঘুমিয়েছেন।’

রেনুর বুকের ভেতরে যেন কেমন করে ওঠল। এতদিন অসুস্থ বাবাকে একবার করে দেখে যেত সে; যখনই সে আসত, বাবা কেমন ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকত। রেনু একাই বাবার সাথে গল্প করত অনেক। বাবা জবাব দিতে না পারলেও শুনতেন বেশ মনোযোগ দিয়ে। আজ থেকেও তো আর সেটাও হবে না। রেনুর মনে হলো বুকের ভেতর ভারী কিছু চেপে বসে আছে। বাবা মৃ’ত, কথাটা ভাবতেই দম আটকে আসছে তার। মায়ের প্রতিটা কান্নার শব্দ সেই কষ্টকে তরান্নিত করছে কেবল।

__________

জমিদার মোহন লাল মজুমদার মা’রা গিয়েছেন, কথাটা বাতাসে ভেসে পুরো গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। ততক্ষণাৎ হাহাকার দেখা দিল সকলের মাঝে। এই মানুষটাকে গ্রামের মানুষরা ভালোবাসত বড্ড। সম্মানও করত বেশ। আজ তাঁর মৃত্যুতে পুরো গ্রামে যেন শোকের ছায়া নেমেছে।

ইতিমধ্যেই জমিদার বাড়িতে জমেছে মানুষের ভিড়। প্রিয় জমিদারকে শেষবারের জন্য একবার দেখতে সবার এত সমাগম। মোহন লাল মজুমদারের লা’শটা বাইরে বিচার মহলে রাখা হয়েছে। তাকে ঘিরে আছে প্রহরীরা। গ্রামের পুরুষরা উপচে পড়েছে সেই মহলে। ছোট বড়ো সকলের একমাত্র আগ্রহ এখন জমিদার লা’শকে একবার দেখা।

_______

‘মেহতাব, আমার আপনার সাথে কথা আছে।’

মেহতাব তাড়াহুড়ো করে বের হচ্ছিল। বাবার শবদাহের ব্যবস্থা করতে হবে। এইদিকে ছোট ভাই রাদাভও আজ আসতে পারবে না। সে নিজেও কী করে এসব করবে বুঝতে পারছে না কিছু। তাই দুশ্চিন্তায় জবাব দেয়,

‘আমার এখন সময় নেই, তনু। পরে এসে শুনব।’

তনুকা তাও উদ্বিগ্ন সুরে বলে উঠল,

‘আপনার কি মনে হয় না, বাবার লা’শটাকে একটা ময়নাতদন্তে পাঠানোর দরকার?’

মেহতাব ভ্রু কুঁচকে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

‘ময়নাতদন্ত? কেন? আব্বার মৃত্যু তো স্বাভাবিক মৃত্যু, তাহলে এখানে ময়নাতদন্তের কথা কোথ থেকে আসছে?’

‘কী করে শিউর হলেন, এটা স্বাভাবিক মৃত্যু? অস্বাভাবিকও হতে পারে।’

মেহতাব বোধ হয় এখন এসব কথা নিতে পারছে না ঠিক। সে বিরক্ত গলায় বলে,

‘তনু প্লিজ, এমনিতেই মহলের পরিস্থিতি ভালো না। তারউপর তোমার এসব উল্টা পাল্টা কথা পুরো গ্রামে হৈ চৈ ফেলে দিবে, তাই প্লিজ এসব আজগুবি চিন্তা বাদ দাও। আব্বা অসুস্থ ছিলেন; ডাক্তার প্রথম থেকেই বলছিলেন, সুস্থ হবার সম্ভাবনা খুবই কম। আর ইদানিং তো তুমি নিজেই দেখছিলে, আব্বা দিনকে দিন কেমন হয়ে যাচ্ছিলেন। হয়তো, নিজের অসুস্থতার সাথে আর পেরে উঠেননি; ধৈর্য্যহারা হয়ে তাই মৃত্যুকেই বরণ করে নিয়েছেন।’

তনুকা নিমিষ চেয়ে শুনল সব। মেহতাবের বিচলিত চোখ মুখ দেখে আর কিছু বলল না সে। মেহতাব বেরিয়ে গেল। তবে তার মনের সন্দেহ ছিটে ফোটাও কমল না। অন্তত এইটুকু সে নিশ্চিত যে, এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু না।

____

একনাগাড়ে অনেক কেঁদে আম্বিরা বেগম এখন ক্লান্ত। বিছানায় হেলান দিয়ে তাই চুপচাপ বসে আছেন। তাঁর পাশেই থমথমে মুখে বসে আছেন তার দুই জা। রেনু একটা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বোজে আছে। ভেতরে তার কী চলছে, একমাত্র সে’ই জানে।

অন্দরে বাইরে থেকে বেশ কয়জন মহিলা এসেছেন। তনুকা আর ভৃত্যরা মিলে তাদের বসার ব্যবস্থা করেছে। মহিলারা হাজার প্রশ্ন করতে করতে অস্থির। জমিদার বাবু কীভাবে মারা গেলেন, কখন মারা গেলেন…এই সব। কেউ কেউ আবার আফসোস নিয়ে বলছেন, আজই জমিদার ছেলে এত সুন্দর আয়োজন করল, আর আজই ঘটল এই অঘটন; বেচারার ভাগ্যটাই খারাপ! তনুকা শুনল সব, ধৈর্য্য নিয়ে জবাবও দিল সবকিছুর।

রাত এখন একটা। বাইরের কেউ অন্দরে নেই। বিচারমহলও খালি প্রায়। কাছের কয়জন ছাড়া সবাই চলে গিয়েছে। তনুকা নিজ ঘরে। পায়চারিতে ব্যস্ত সে। মাথায় ঘুরছে অনেক কিছু। কালই তার পরিচিত ডাক্তার আসার কথা ছিল, অথচ আজই বাবার মৃত্যু হলো। মেহতাবের কি এতে একবারও খটকা লাগছে না? উনি এতটা নিশ্চিত কী করে? তনুকা হাত কচলাচ্ছে সমানে। কী করবে বুঝতে পারছে না। যদি খু’নই হয় তবে, বাবার মতো অমন ভালো মানুষকে কে’ই বা খ’ন করবে?

তনুকা ভেবে ভেবে উত্তর মেলায়, ‘হ্যাঁ, কেন করবে না? হয়তো অর্থ, প্রতিপত্তি আর ক্ষমতার লোভে কেউ এসব করেছে?’ তবে কে সে? মেহতাবের অমন ধূর্ত চোখের আঁড়ালে কে এই ভয়ানক কাজটা করেছে? কার এত বড়ো বুকের পাটা যে, সে মেহতাব মজুমদারের চোখকে ফাঁকি দিয়ে তার আব্বাজানকে খু’ন করে বসেছে?

মাথা ব্যথা আরম্ভ হয় তনুকার, তাও উত্তর পায় না কিছু। হতাশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়ায়। দূর থেকে মেহতাবকে দেখা যাচ্ছে। এক হাত কোমরে তার। অন্যহাতে ফোন ধরে কার সাথে কথা বলছে যেন। তনুকার তখন হঠাৎই মনে হয়,

‘আচ্ছা, এই বাড়ির কেউই আবার এই খু’নটা করেনি তো?’

চলবে…..

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩০।

আরেকটি নতুন দিনের আগমন ঘটল সূর্য উদয়ের মাধ্যমে। বাইরে বাড়ল পাখির কিচিরমিচির শব্দ। কোলাহল নেই কোনো। প্রকৃতি শান্ত পরিশ্রান্ত।
তনুকা চোখ মেলতে নিজেকে পেল বসা অবস্থাতেই। খাটে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। চোখ কচলে উঠে বসে, সময় বোঝার চেষ্টা করে। ঘড়িতে দেখে ছয়টা ত্রিশ। ঘরের দরজা খোলা। রাতে কি আর একবারও মেহতাব ঘরে আসেননি? তনুকা উঠে বারান্দায় যায়। বাইরে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তাই ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে আসে। কারোর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে শাশুড়ির ঘরের দরজার সামনে দাঁড়ায়। দরজা ভেতর থেকে আটকানো। তনুকা করাঘাতের জন্য হাত উপরে তোলার আগেই রাহীলা এসে হাজির হন সেখানে। কর্কশ সুরে বলে উঠেন,

‘এই যে মেয়ে, শাশুড়িকে ডাকতে এসেছ না কি?’

তনুকা ফিরে তাকায়। বলে,

‘জি, মা কি রুমে নেই?’

‘আছেন। ঘুমাচ্ছেন উনি।’

তনুকা খানিক অবাক হয়। জিজ্ঞেস করে,

‘ঘুমাচ্ছেন? বাবার কি শবদাহ হয়ে গিয়েছে?’

‘আজ্ঞে হ্যাঁ, হয়ে গিয়েছে। আপনি পড়ে পড়ে ঘুমান আরো, বাড়ির বড়ো বউয়ের কাজ থেকে তো এটাই আশা করা যায়।’

তনুকা হতভম্ব হয়। শবদাহ শেষ? কখন হলো এসব? কেউ তাকে ডাকল না একবার? সে অস্থির গলায় বলে,

‘আমাকে কেউ ডাকেনি কেন?’

‘আপনার স্বামীর বারণ ছিল। ভীষণ বউ পাগল হয়েছে কিনা, বউয়ের ঘুম নষ্ট হবে বলে ডাকতে এসেও আর ডাকেনি; আর কাউকে ডাকতে দেয়ও নি।’

তনুকাকে অসহায় দেখায়। রাহীলা ঠোঁট নাড়িয়ে আরো কী কী যেন বলছেন। তনুকা আর দাঁড়ায় না। ধীর পায়ে রেনুর ঘরের দিকে যায়। দরজাটা ভিড়ানো ছিল। তাই আস্তে খুলে ঢুকে।
মেয়েটা হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে আছে। তনুকা তার শিউরে বসে। মাথায় আলতো হাত ছোঁয়ায়। রেনু মাথা তুলে তনুকাকে পেয়েই তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। হুহু করে কেঁদে ওঠে। বলে,

‘বউমনি, আব্বা আর কোনোদিন ফিরবেন না; তাই না, বউমনি? আব্বা আর ফিরবেন না, এই বিভৎস সত্যটা যে আমি মানতে পারছি না। আমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে, বউমনি। বুকে ভীষণ ব্যথা করছে।’

তনুকা হাতের বাঁধন শক্ত করে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে। মাথার উপর চুমু খেয়ে বলে,

‘এভাবে কেঁদো না, আমরা কেউই আজীবন বেঁচে থাকব না। একদিন সবাইকেই ম’রতে হবে। কেউ আগে, কেউ পরে, তফাৎ শুধু এইটুকুই। এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো উপায় নেই, রেনু। কষ্ট হলেও মেনে নিতে হবে।’

রেনু ফোঁপাচ্ছে। তনুকা এটা ওটা বলে বোঝাচ্ছে তাকে। একপর্যায়ে কাঁদতে কাঁদতে তার বুকেই ঘুমিয়ে পড়ে মেয়েটা। তনুকা আর জাগাল না তাকে, আস্তে করে শুইয়ে দিল বিছানায়। তারপর দরজাটা ভিড়িয়ে চলে এল নিচে।
সদর দরজা পাড় হয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। বাইরে তেমন কোনো লোক নেই এই মুহূর্তে। তনুকা এগিয়ে যায়। বাগান পাড় হয়ে বিচার মহলের সামনে দাঁড়ায়। মহলের দরজায় তালা দেওয়া। গেল কোথায় সব? আশেপাশে কাউকে না পেয়ে সে আবার যায় বড়ো গেইটের সামনে। প্রহরী একজনকে জিজ্ঞেস করে,

‘মেহতাব কোথায় জানেন?’

উত্তরে সে বলে,

‘বড়ো বাবুর শবদাহ দিয়ে জমিদার বাবু আর মহলে ফিরেন নাই; এখন কোথায় তাও জানি না।’

তনুকা আশাহত হয়ে মহলের দিকে পা বাড়াল। সোজা গেল নিজের ঘরে। মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসল। ভাবল, একবার মেহতাবকে কল দিবে। পরে মনে পড়ে, তার কাছে তো মেহতাবের নাম্বারও নেই। এখন আবার নাম্বারটা কার কাছ থেকে নিবে? উপায় না পেয়ে সে যায় ঊর্মির ঘরে। বরাবরের মতো অনুমতি নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। ঊর্মি বারান্দায় দাঁড়ান ছিলেন। তনুকাকে দেখে বসতে বলেন। তনুকা গম্ভীর সুরে বলে উঠে,

‘বসতে আসেনি। মেহতাবের নাম্বার নিশ্চয়ই আপনার কাছে আছে? এবার আবার তাতেও না করবেন না।’

ঊর্মি ঘরে এসে বললেন,

‘আছে।’

‘দিন তবে।’

ঊর্মি নাম্বার দিল তাকে। তনুকার ফিরে আসার সময় আবার একবার ঘুরে চেয়ে জিজ্ঞেস করল,

‘বাবার শবদাহের সময় আপনারা সকলে সেখানে উপস্থিত ছিলেন?’

‘মহিলারা কেউ শ্মশান ঘাটে যায়নি। বাড়ির পুরুষেরাই সব করেছেন।’

‘এখন কোথায় সবাই?’

‘জানি না আমি।’

তনুকা আর কথা বাড়াল না। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। নিজের ঘরে গিয়ে কল দিল মেহতাবের নাম্বারে। কল রিসিভ হয় না। তনুকা পরপর দুবার কল দিয়ে আর কল দেয়া না। ফোন রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়ে বিছানায়। হঠাৎ কী ভেবে যেন আবার উঠে বসে।

এই মুহূর্তে মোহন লাল মজুমদারের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তনুকা। কাল অবধি মানুষটা এই ঘরেই ছিল, অথচ আজ ঘর খালি। দরজায় আজ প্রহরীও নেই। তনুকা পুরো ঘরে একবার চোখ বুলায়। ডানদিকে একটা ছোট কেবিনেটের উপর বাবার ঔষধের বক্সটা নেই। সে পুরো ঘর খোঁজে, পায় না। ঔষধের বক্স তো সবসময় এখানেই থাকে তবে, আজ গেল কোথায়? তখন মন বলে, নিশ্চয়ই মায়ের রুমে। মা যেহেতু ঔষধ খাওয়াতেন সেহেতু আজ হয়তো ঔষধের বক্সটা সেখানেই রয়ে গিয়েছে। একবার বাবার ঔষধগুলো দেখা প্রয়োজন। মন বলছে, কিছু একটা অবশ্যই পাবে সে।

________

ঘড়িতে দুইটা বেজে পনেরো মিনিট। ফ্লাইট থেকে নেমে মাত্রই দেশের মাটিতে পা রাখল সে। চোখ বুজে জোরে শ্বাস টানল। অনুভব করল, অন্যরকম এক সোঁদা গন্ধ। অতঃপর এগিয়ে গেল ধীর পায়ে। এয়ারপোর্টের মেইন গেইটের অভিমুখে পৌঁছাতেই পরিচিত মুখ দেখে হাসল। পরক্ষণেই আবার সেই হাসি গায়েবও হয়ে গেল। চোখে মুখে ফুটিয়ে তুলল বিষন্নতা। ছুটে বেরিয়ে এসে জড়িয়ে ধরল মেহতাবকে। মেহতাবও জড়িয়ে নেয়। আবেগাপ্লুত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ভাই, কেমন আছিস?’

রাদাভ ব্যথিত সুরে বলে,

‘এমন একটা খবর পেয়ে কী করে ভালো থাকি, বলো? শেষ পর্যন্ত বাবার মুখদর্শনটাও করতে পারলাম না।’

‘তোর জন্য অপেক্ষা করতে চেয়েছিলাম তবে, কাকারা কেউ রাজি হননি।’

‘না, ভালো করেছো। আমার জন্য অপেক্ষা করে লাভ হতো না। আমি তখনও ফ্লাইটের টিকিট ম্যানেজ করতে পারছিলাম না। ভাগ্য ভালো যে, বেশি কষ্ট করে হয়নি; অল্পতেই ম্যানেজ করে ফেলেছি। বাবার আত্মার শান্তি কামনা করছি, এর থেকে বেশি আর কিছু চাই না।’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাইয়ের কাঁধে হাত রাখে। বলে,

‘হ্যাঁ, এখন বাকি কাজ সব তোকেই করতে হবে। আম্মা আর রেনু ভেঙে পড়েছেন ভীষণ। তোকে দেখে যদি এবার একটু বল পান।’

রাদাভ বিষন্ন মুখেও কিঞ্চিৎ হাসল। বলল,

‘চিন্তা নেই, ভাইজান। এখন আমি চলে এসেছি, মা আর রেনুকেও সামলে নিব।’

‘চল এবার, গাড়িতে গিয়ে বস। কাকারাও গাড়িতেই আছেন।’

মনোহর গ্রামের দিকে রওনা দেয় তারা। পথিমধ্যে ফোনে তনুকার মিসড কল দেখে তাকে মেহতাব আবার কল ব্যাক করে। তনুকা রিসিভ করে কল। জিজ্ঞেস করে,

‘কোথায় আপনি?’

‘ঢাকা এসেছি।’

তনুকা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘হঠাৎ ঢাকা?’

‘কাজে এসেছিলাম; বাড়ি এসে বলছি সব।’

‘আচ্ছা, আসুন সাবধানে।’

কল কাটল তনুকা। ভেবে পেল না, মাঝরাতেই এত তাড়াহুড়ো করে বাবার শবদাহ করে মেহতাবকে আবার ঢাকা কেন যেতে হলো? কী এমন জরুরি কাজ তার, যেটার জন্য আজ এমন একটা দিনেও ঢাকায় ছুটে যেতে হলো তাকে?

_______

দীর্ঘ বারো বছর পর নিজ গ্রামে উপস্থিত হয় রাদাভ। কত কিছু বদলে গিয়েছে। কত যোজন বিয়োজন যে ঘটেছে তার কোনো
ইয়ত্তা নেই। গ্রামের রাস্তায় গাড়ি ঢুকতেই আশেপাশের মানুষের ভিড় জমে। এত বছর পর জমিদারের ছোট ছেলেকে দেখার আগ্রহে সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রয় সকলে। রাদাভও গাড়ির কাচ নামিয়ে সকলকে দেখছে নিমিষ। মনে পড়ছে, ছোটবেলার হারানো স্মৃতিগুলোর কথা। মনে পড়ছে, কিছু প্রিয় মুখ। আরো মনে পড়ছে, অযাচিত কিছু কষ্টের মুহূর্তও। রাদাভ দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সিটে হেলান দিয়ে বসে। দেখতে দেখতেই গাড়ি এসে থামে তাদের মহলের সামনে। সকলে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। রাদাভ দাঁড়ায় ভাইয়ের পাশে। নিজের মহলের দিকে চেয়ে থাকে নিষ্পলক। মেহতাব প্রহরীকে বলে উঠে,

‘ভেতরে গিয়ে খবর দাও, বাড়ির ছোট ছেলে এসেছে; আম্মা যেন এসে বরণ করেন।’

প্রহরী আদেশ মোতাবেক দৌড়ে মহলের ভেতরে যায়। বসার ঘরেই রেনু আর তনুকা ছিল। রেনু সারাদিন কিছু খায়নি বলে তনুকা খাইয়ে দিচ্ছিল তাকে। প্রহরী এসে তাদের দেখেই খবর দেয়,

‘ছোট মাতা, বরণের ব্যবস্থা করেন; ছোট বাবু আসছেন।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘ছোট বাবু কে?’

রেনু সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠে,

‘ছোট ভাইজান? রাদাভ ভাইজান?’

প্রহরী মাথা নাড়িয়ে বলে,

‘জি জি। রাদাভ বাবু।’

চলবে…..