প্রাণেশ্বর পর্ব-৩১+৩২

0
307

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩১।

ছোট ছেলের আগমনের খবর পেয়ে আম্বিরা বেগম দোর মেললেন। আজ সারাদিন ঘরেই ছিলেন তিনি। রাদাভের খবর কানে যেতেই ছুটে বেরিয়ে এলেন। দৌড়ে গেলেন প্রধান গেইটের সম্মুখে। মেহতাবের পাশেই রাদাভ দাঁড়ানো। তিনি এসেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরলেন তাকে। শব্দ করে কেঁদে ওঠলেন। রাদাভের চোখেও জল জমে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলে,

‘মা, কেঁদো না।’

আম্বিরা বেগম মাথা তুলে চাইলেন। ছেলের কপালে চুমু খেয়ে বললেন,

‘বাবা, তুমি এসেছ? তোমার বাবাকে তো আর শেষ দেখাটা দেখতে পারলে না।’

‘চেষ্টা করেছিলাম, মা। কিন্তু, সময়মতো টিকিট ম্যানেজ করতে পারিনি। তুমি কষ্ট পেও না, মা। আমাদের বাবা ওপাড়ে ভালো থাকবেন।’

‘হ্যাঁ, সেই দোয়াই করি। তুমি ভেতরে এসো, আর কতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে?’

রাদাভ বাড়ির ভেতরে পা রেখে। সদর দরজার কাছে যেতেই রেনু হামলে পড়ে তার বুকের উপর। রাদাভ জড়িয়ে নেয় বোনকে। মাথার উপর চুমু খেয়ে বলে,

‘কাঁদিস না, বোন। বাবা যে কষ্ট পাবেন।’

রেনু কান্না থামাল। বলল,

‘এতদিন পর কেন এলে না তুমি? আজ আব্বার মৃত্যুর খবর পেয়েই আসতে মন চাইল?’

‘আসতে চেয়েছিলাম। কিন্তু, সময় সুযোগের জন্য পারিনি। এই যে, এখন চলে এসেছি; আর যাব না।’

রাদাভের আর না যাওয়ার কথা শুনে মতিব মজুমদারের কপালে ভাঁজ পড়ে।পাংশুবর্ণ ধারণ করে মুখ মন্ডল। মনে মনে বলে উঠেন, “একজন কি কম ছিল, এখন আরো একজন এসে জুটেছে।”

________

রাদাভ বসার ঘরে বসেছে। বাড়ির সকলের সাথে আলাপ শেষ তার। বাকি কেবল তনুকা। তাকে দেখা যাচ্ছে না আশেপাশে। রাদাভ চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে উঠল,

‘ভাইজান, আমাকে তো নতুন ভাবির সাথে পরিচয়’ই করালে না; কোথায় সে?’

মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। বলে,

‘চেনা মানুষকে আর নতুন করে চেনার কী আছে?’

রাদাভ চায়ের কাপ রেখে বলে উঠে,

‘ভাবি আমাকে নাও চিনতে পারেন। পরিচয় হওয়াটা জরুরি তাই।’

‘বস, আমি ডেকে নিয়ে আসছি।’

মেহতাব উঠে নিজের ঘরে এল। তনুকাকে পেল বারান্দায়। তার পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

‘আমার ছোট ভাইয়ের কথা বলেছিলাম না, রাদাভ; ও এসেছে। তোমার সাথে পরিচিত হতে চাইছে।’

তনুকা চাইল। বলল,

‘আপনি যান। আমি আসছি।’

ফিরে আসে মেহতাব। তনুকা ওড়না টেনে বড়ো করে ঘোমটা দেয়। তারপর ধীর পায়ে হেঁটে যায় বসার ঘরের দিকে।

‘আসসালামু আলাইকুম।’

মেয়েলী কন্ঠ শুনে ফিরে তাকায় রাদাভ। তার সামনে দাঁড়ান রমণীকে আপাদমস্তক পরখ করে ফিচেল হাসে। সালামের জবাব দিয়ে বলে,

‘কেমন আছেন, ভাবি? আমি আপনার দেবর, রাদাভ।’

তনুকা একপলক চেয়ে আবার চোখ নামাল। মৃদু আওয়াজে বলল,

‘জি ভালো, আপনি ভালো আছেন?’

‘সদ্য বাবা হারানো কোনো এতিম ছেলে কি ভালো থাকতে পারে, ভাবি?’

তনুকা জবাব দেয় না। মেহতাব রাদাভের কাঁধে হাত রাখে। স্মিত সুরে বলে,

‘আমাদের ভেঙে পড়লে চলবে না, রাদাভ। আম্মা আর রেনুকে সামলাতে হবে, এই পুরো গ্রামকে সামলাতে হবে। তার জন্য আমাদের আগে শক্ত হওয়া প্রয়োজন।’

‘হ্যাঁ, ঠিক বলেছ।’

এর মাঝেই রেনু বসার ঘরে এল। রাদাভ আর মেহতাবকে উদ্দেশ্য করে বলল,

‘ভাইজান, তোমাদের খাবার দেওয়া হয়েছে। আম্মা ডাকছেন, খেয়ে নাও গিয়ে।’

রাদাভ আর মেহতাব উঠে দাঁড়ায়। রাদাভ পা বাড়াতে নিয়েও একবার পেছনে তাকায়। তনুকার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘ভাবি, আপনি খাবেন না?’

তনুকা ধীর গলায় বলে,

‘খেয়েছি আমি। আপনারা গিয়ে খেয়ে নিন।’

রাদাভ স্মিত হেসে বসার ঘরের দিকে গেল। মেহতাবও গেল তার পেছন পেছন। তনুকা আর না দাঁড়িয়ে ফিরে এল নিজের ঘরে। মাথা থেকে কাপড় সরিয়ে চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণের মাঝেই আবার উঠে বসল। বুকের ব্যথাটা বেড়েছে। ড্রয়ার খুলে ঔষধের বক্স বের করে তাই একটা নিফেটোলল খেল সে। তারপর বক্স রেখে দিয়ে আবার এসে শুয়ে পড়ল বিছানায়।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে মেহতাব ঘরে এসে দেখে, তনুকা গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। মেহতাব তার অপর পাশে বসে। তনুকাকে দেখে বড্ড ক্লান্ত মনে হচ্ছে। অথচ ক্লান্ত থাকার কথা তার। সেও শুয়ে পড়ল তনুকার পাশে। তনুকার মুখের দিকে চেয়ে চেয়ে ঘুমিয়েও পড়ল কোনো এক বেখেয়ালে।

রাত এগারোটা। তনুকার ঘুম ভাঙে। চোখ মেলে তাকায়। প্রথমেই মেহতাবের ঘুমন্ত মুখটা দেখতে পায়। তনুকা নিমিষ চেয়ে দেখে। একদিনেই ভীষণ উস্কো খুস্কো লাগছে। ঠোঁট শুকিয়ে আছে। গালে দাঁড়ি বেড়েছে। তনুকা চট করে উঠে বসে। এত কিছু দেখা তার কাজ না। সে ফ্রেশ হয়ে বাইরে বের হয়। তেমন কাউকে চোখে পড়ে না। সবাই কি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়েছে? তনুকা রান্নাঘরের দিকে যায়। মেঝ কাকী ঊর্মিকে পায় সেখানে। তাঁকে দেখে জিজ্ঞেস করে,

‘সবার কি খাওয়া দাওয়া শেষ?’

ঊর্মি ফিরে তাকান। বলেন,

‘হ্যাঁ, তোমরা ঘুমাচ্ছিলে বলে আর ডাকা হয়নি। খাবার বেড়ে দিব এখন?’

‘না, মেহতাব উঠলে আমি বেড়ে নিব।’

ঊর্মি নিজের কাজে মনোযোগ দেন। কফি বানাচ্ছেন তিনি। তনুকা খেয়াল করে বলে,

‘কফি কার জন্য?’

‘তোমার দেবরের জন্য।’

তনুকা তপ্ত শ্বাস ছাড়ল। বলল,

‘আমি দিয়ে আসব?’

ঊর্মি জবাবে বলে উঠে,

‘প্রয়োজন নেই। আমি আছি।’

তনুকা কথা বাড়াল না। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আবার নিজের ঘরে এল। ফোনটা হাতে নিয়ে সোফায় বসল গিয়ে। দেখল, তার পরিচিত ডাক্তারের নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। যেখানে লেখা, “তুমি তো আমাকে আর কিছু জানালে না, তনুকা। আমার না আজ থেকে আসার কথা ছিল?”

তনুকা তাঁর মেসেজে স্যাড রিয়েক্ট দিয়ে উত্তর দেয়,

‘তার আর প্রয়োজন হবে না, আংকেল। আমার শ্বশুরমশাই আজ মারা গিয়েছেন।’

উত্তর দিয়ে মোবাইলটা পাশে রাখল সে। ভাবল কিয়ৎক্ষণ। এই মৃত্যু রহস্য বের করবে কীভাবে? কে সাহায্য করবে তাকে? মেহতাব তো তার কথা আমলেই নিচ্ছে না, আর বাদ বাকি এই বাড়ির কাউকেই সে ঠিক মতো বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে এই ব্যাপারে কে তাকে সাহায্য করবে? অনেক ভেবে মস্তিষ্ক জবাব দেয়, “একবার রাদাভের কাছে সাহায্য চাইতে পারিস, সব শুনলে ও অবশ্যই সাহায্য করবে তোকে।”

_______

‘মেহতাব, উঠুন; খাবেন না?’

মেহতাব একটু নড়ে। ঘুম জড়ানো সুরে বলে,

‘খাব না, তনু। তুমি খেয়ে এসে শুয়ে পড়ো।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করে,

‘একদম না খেয়ে ঘুমাবেন? অল্প কিছু খেয়ে নিন।’

মেহতাব ফের একই সুরে বলে,

‘উঁহু, তুমি খেয়ে নাও। আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।’

তনুকা আর ডাকল না। দুই দিন লোকটা ঠিক মতো ঘুমাতে পারছে না। থাক, এখন ঘুমাক। তনুকা আলো নিভিয়ে, দরজা ভিড়িয়ে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এল। বাড়ির সবাই ঘুমে। বসার ঘরে ক্ষুদ্র আলো ব্যতিত আর কোথাও কোনো আলো নেই। এর মাঝেই ত্রস্ত পায়ে হেঁটে সে সামনে এগুলো। রাদাভ কোন ঘরে শুয়েছে তার কোনো ধারণা নেই। তবে এক বা দুতালায় কোনো ঘর খালি নেই সে জানে। তাহলে নিশ্চয়ই তিনতলায় তার ঘর। তনুকা সেদিকেই অগ্রসর হয়। তিনতলায় উঠতেই বরাবর ঘরে আলো দেখতে পায় সে। ইতস্তত ভঙিতে দরজার সামনে দাঁড়ায়। ভাবতে থাকে, দরজায় করাঘাত করে কি না। দুই সেকেন্ড সময় নিয়ে ভেবে দরজায় টোকা দেয়। ভেতর থেকে আওয়াজ আসে,

‘খোলা আছে, চলে এসো।’

তনুকা দরজা মেলে ভেতরে প্রবেশ করে। ঘরের ভেতর তনুকাকে দেখে ভ্রু কুঁচকাল রাদাভ। প্রশ্ন করল,

‘ভাবি, আপনি?’

তনুকা এদিক ওদিক একটু সতর্ক দৃষ্টিতে চাইল। বলল,

‘আমার আপনার সাথে একটু জরুরি কথা আছে।’

রাদাভ কুঁচকানো ভ্রু সোজা করে হাসল। বলল,

‘এই সময় দেবরের ঘরে কোনো ভাবির কথা বলতে আসাটা মানুষ ভালো চোখে দেখবেন না, ভাবি। তার উপর ভাইজান জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হবে, পরে কথা বলব।’

তনুকা গলার স্বর শক্ত করে। বলে,

‘কথাটা জরুরি। এখনই বলা প্রয়োজন।’

রাদাভ মোবাইল রেখে উঠে বসল। বীতঃস্পৃহ সুরে বলল,

‘কী কথা, বলুন তবে।’

চলবে….

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩২।

তনুকা সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই বসার ঘরে মেহতাবকে পেল। অকস্মাৎ তাকে দেখে ঘাবড়াল সে। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিকটে স্থির হলো। মেহতাব চাইল। তীক্ষ্ণ সেই দৃষ্টি। জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় ছিলে?’

তনুকা ঢোক গিলে। জবাবে সত্য না মিথ্যা বলবে তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যেন। মেহতাব বিমূর্ত। তনুকা জিভ দিয়ে শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

‘বাবার ঘরে গিয়েছিলাম।’

‘এত রাতে আব্বার ঘরে কেন?’

তনুকা সাথে সাথেই জবাব দিল,

‘বাবার কথা খুব মনে পড়ছিল, তাই।’

মেহতাব বিশ্বাস করল কি না কে জানে? তার অভিব্যক্তি দেখে তা বোঝা দুষ্কর। তনুকা মৃদু আওয়াজে জিজ্ঞেস করল,

‘ভাত দিব? খাবেন?’

‘না, শুতে এসো।’

মেহতাব ঘরের দিকে গেল। তনুকা ভয় পাচ্ছে। চিন্তা হচ্ছে। মেহতাব বুঝে গেলে যে কেলেঙ্কারি হওয়ার আর কিছু বাকি থাকবে না।

________

পরদিন বেশ সকাল সকালই দুই ভাই বিচার মহলে উপস্থিত হয়। আজ বিচার মহল পূর্ণ হয় কানায় কানায়। অর্ধেকের বেশি লোক এসেছে কেবল রাদাভকে দেখতে। রাদাভ তার নিত্য দিনকার বেশ ভূষা পাল্টে ভাইয়ের মতো এক সাদা রঙের পাঞ্জাবী গায়ে দিয়েছে। ভাইয়ের পাশেই দাঁড়িয়েছে গম্ভীর মুখে। মেহতাব গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখে। তাদের বোঝায়, জমিদারের মৃত্যুতে সকলে ব্যথিত হলেও কেউ যেন ভেঙে না পড়ে। আরো বলে, আজ থেকে বাবার সমস্ত দায়িত্ব সে নিয়েছে। বাবা যেমন গ্রামকে এতদিন আগলে রেখেছেন, আজ থেকে সেও সেইভাবেই এই গ্রামকে আগলে রাখবে। আর তার অনুজ তো আছেই তাকে সাহায্য করতে।
রাদাভও ছোট খাটো বক্তব্য রাখে। গ্রামের মানুষের মনে একটা ভরসা আর বিশ্বাসের জায়গা তৈরি করে। ওয়াদা করে, সে আর তার ভাই আজীবন এই গ্রামকে আগলে রাখবে, আগলে রাখবে গ্রামের প্রত্যেকটা মানুষকে। গ্রামের মানুষ সন্তুষ্ট বেশ। অতঃপর বক্তব্য শেষ হতেই যার যার মতো প্রস্থান ঘটায় সকলে। মেহতাব তখন রাদাভকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘ঘাটে যাবি?’

রাদাভ চেয়ে বলল,

‘চলো।’

দুই ভাই মিলে ঘাটে বসল। দুইজনের দৃষ্টি’ই দীঘির স্বচ্ছ জলে নিবদ্ধ। মেহতাব রয়ে সয়ে প্রশ্ন করল,

‘একেবারের জন্য চলে এসেছিস?’

‘তোমার সমস্যা না থাকলে, এবার আর ফিরব না।’

মেহতাব ভ্রু কুঁচকে বলল,

‘আমার আবার কী সমস্যা হবে? বরং আমি চাই, তুই থাক এখানে। আমার একার উপর চাপ পড়ে খুব। তুই থাকলে আমারও একটু সাহায্য হবে।’

‘মেঝো আর ছোট কাকা আছেন না তোমার সাহায্যের জন্য?’

‘মেঝো কাকা তো আছেন তবে, ছোট কাকাকে তো চিনিস’ই। একমাত্র তুই ছাড়া আমি আর কাউকেই ঠিক মতো ভরসা করতে পারিনা।’

রাদাভ হেসে বলে,

‘আমাকে ভরসা করার জন্য ধন্যবাদ, ভাইজান। আশা করছি, আমি তোমার ভরসার মান রাখতে পারব।’

মেহতাবও হেসে বলে,

‘আমি জানি, তুই অবশ্যই পারবি।’

.

তারা অনেকক্ষণ ঘাটে বসে। এতে করে পরিষ্কার দীঘির জলে গোসল করার লোভ আর সামলাতে পারে না রাদাভ। বিদেশের ঐসব নীল রঙা সুইমিং পুলে গোসল করে কোনো শান্তি নেই। শান্তি তো এখানে, এই স্বচ্ছ ঘাট বাঁধানো দীঘির জলে গোসল করে। সে তাই মেহতাবকে জিজ্ঞেস করে বসে,

‘ভাইজান, দীঘিতে গোসল করবে?’

‘এইসময়?’

‘হ্যাঁ, কতদিন একসাথে দীঘির জলে গোসল করা হয় না। চলো না…’

ভাইয়ের এমন অনুরোধ উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই মেহতাবের। সে রাজি হলো। আন্দ্যপান্ত না ভেবেই দুই ভাই ঝাঁপ দিল দীঘির জলে। অবশ্য ঝাঁপ দেওয়ার আগে পান্জাবীটা খুলে রেখেছিল তারা।

বিচার মহলের জানলা দিয়ে তাদের গোসল দেখছে ইশফাক। মনে মনে ভাবছে, “এই মানুষ দুজনকে দেখলে কেউ বলবে যে, তাঁদের বাবা কালকেই মারা গিয়েছেন? বরং দেখে মনে হচ্ছে যেন, গায়ে ফুর্তির শেষ নেই।”

ঘাটে দাঁড়িয়ে মেহতাব ইশফাককে নাম ধরে ডাকে। সঙ্গে সঙ্গেই তার সম্মুখে এসে সে হাজির হয়। মেহতাব আদেশের সুরে বলে,

‘অন্দরে গিয়ে আমার বিবিজানকে ডেকে নিয়ে এসো। আর সাথে তাকে একটা গামছাও আনতে বলো।’

ইশফাক মাথা নাড়িয়ে চলে গেল সেখান থেকে। রাদাভ এখনও উঠেনি। সে সাঁতার কেটে চলছে। মেহতাব ঘাটে বসে চেয়ে দেখছে তাকে। উদম গায়ে সূর্যের আলো পড়তে হলদে ফরসা গায়ের রংটা যেন চকচক করছে তার। সে রাদাভের দিকে গভীর মনোযোগে চেয়ে বলে,

‘তুই বিদেশে থেকে আরো বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছিস, রাদাভ? নিশ্চয় কয়েক জোড়া প্রেমিকা বানিয়ে ফেলেছিস?’

রাদাভ শব্দ করে হেসে ফেলে। হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করে,

‘তোমার কি তাই মনে হয়, ভাইজান?’

‘মনে না হওয়ার কী আছে? তোর মতো একজন সুদর্শন ছেলে নিশ্চয়ই সিঙ্গেল থাকবে না।’

রাদাভ ফের হাসল। একটা ডুব দিয়ে উঠে বলল,

‘আমি একদম পিউর সিঙ্গেল।’

মেহতাব ফিচেল হাসে। বলে,

‘এখন বলতে চাচ্ছিস না, বলিস না। সময় হলে পরিচয় করিয়ে দিস, একেবারে বিয়ে পড়িয়ে দিব।’

রাদাভ কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাসল কেবল। জবাবে বলল না কিছু।

তনুকা হাতে একখানা গামছা ঝুলিয়ে ঘাটের নিকটে আসতেই হতভম্ব হলো। দুই ভাইকে এমন অবস্থাতে আশা করেনি সে। মেহতাব তনুকাকে দেখেই চমৎকার হাসল। বলল,

‘আরে বিবিজান, জলদি এসো। তোমার অপেক্ষাতে তো চুল এমনিতেই শুকিয়ে গিয়েছে আমার।’

তনুকার নাম শুনে রাদাভ ঘাটের দিকে তাকায়। তনুকার সাথে চোখে চোখ পড়তেই হাসে সে। বলে উঠে,

‘ভাইজান, ভাবির সামনে উদম গায়ে, আমার তো লজ্জা করছে।’

মেহতাব তার দিকে চেয়ে বলে,

‘লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই। ভাবি তো মা সমতুল্য।’

রাদাভ আর জবাব দিল না পরবর্তীতে। অন্যদিকে ঘুরে সাঁতার কাটায় মনোযোগ দিল। মেহতাব তনুকার দিকে চাইল। বলল,

‘তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন? এইদিকে এসো। চুল মুছে দাও আমার।’

তনুকা বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী?’

‘বললাম, চুল মুছে দাও। ঠান্ডা লাগবে নয়তো।’

তনুকা গামছাটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,

‘আপনি নিজে মুছে নিন।’

মেহতাব গামছা না নিয়ে উল্টো তার হাত ধরে হেঁচকা টান দিল। তার দরুন অতি সম্মুখে গিয়ে থামল তনুকা। ভয়ে ঢোক গিলল। ইতস্তত সুরে বলল,

‘কী করছেন? আপনার ছোট ভাই আছেন তো।’

‘কিছু করিনি তো। কেবল চুল মুছে দিতে বলেছি। তাতেই এত ইতস্তত বোধ করলে কী করে হবে? নাও, মুছে দাও এবার।’

মেহতাব তার মাথা এগিয়ে দিল। তনুকা উপায়ান্তর পেল না কোনো। একপলক সে রাদাভের দিকে চাইল। ছেলেটা এইদিকেই চেয়ে আছে। মনে মনে কী ভাবছে, কে জানে। তনুকা কোনোরকমে মাথা মুছে দেয় মেহতাবের। তাড়াহুড়ো দেখিয়ে বলে,

‘হয়েছে, এবার আমাকে যেতে দিন।’

মেহতাব বিরক্ত হলো। বলল,

‘আহা, এত তাড়া কীসের তোমার? বসো এইদিকে।’

একপ্রকার জোর করেই মেহতাব তনুকে তার পাশে বসায়। রাদাভের সামনে এসব কিছু বড্ড অস্বস্তিতে ফেলছে তাকে। মেহতাব তারপর রাদাভের দিকে তাকায়। বলে,

‘রাদাভ, ঐ দূরের পদ্মটা ছিঁড়ে আনতে পারবি?’

রাদাভ ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘মজে যাওয়া পদ্ম ফুল দিয়ে কী করবে?’

‘তোর ভাবিকে দেব।’

তনুকার কপালে ভাঁজ পড়ে। লোকটার ব্যবহার অদ্ভুত লাগে তার। তার মতো এমন কঠোর ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ ছোট ভাইয়ের সামনে বউয়ের সাথে এমন আহ্লাদীপনা কেন করছেন? কী চাইছেন তিনি?

‘কীরে, পারবি না?’

‘আজ থাক না, ভাইজান। কাল ভোরে এসে ছিঁড়ে নিয়ে যাব। ভোরের দিকে সতেজ পদ্ম পাব।’

‘ঠিক আছে তবে, কাল ভোরে এসে এই পদ্মগুলো ছিঁড়ে আমাকে দিস।’

রাদাভ মাথা নাড়াল। মেহতাব বলল,

‘উঠে আয় এবার। নয়তো ঠান্ডা লাগবে।’

‘তোমরা যাও, আমি আসছি।’

মেহতাব উঠে দাঁড়াল। তনুকাকে বলল,

‘চলো, অন্দরে ফেরা যাক তবে।’

বলেই তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল সে। পরপর অবাক হতে হতে তনুকা ক্লান্ত এবার। হাত না ধরেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘চলুন।’

সে নিজেই দ্রুত মহলের দিকে এগিয়ে গেল। মেহতাব তার পেছন পেছন এগুলো ধীরে সুস্থে।

তাদের চলে যাওয়া কেউ শক্ত চোয়ালে দেখল। অতঃপর জোরে নিশ্বাস ছাড়ল সে। দীঘিতে যত পদ্মফুল ছিল এক নাগাড়ে তা সব ছিঁড়ে ফেলল। দুই হাতে ফুল সব টেনে টুনে ছিঁড়ে একাকার করে ক্রূর হাসল সে। আওয়াজ তুলে বলল,

‘জোর করেই যদি সব পাওয়া যেত তবে, আমিও আজ এই পদ্মফুলটাকে পেয়ে যেতাম। কিন্তু, আফসোস! খালি জোর করলেই সব পাওয়া যায় না। পেতে গেলে বুদ্ধি লাগে, আর তোমার তো সেই বুদ্ধি নেই।’

বলেই ভুবন কাঁপিয়ে হাসল সে।

চলবে…..