#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৭।
পেছনে দু হাত চেপে পায়চারি করছে মেহতাব। রাদাভের আচরণে ভীষণ রুষ্ট সে। তার বারণ করা সত্ত্বেও, রাদাভ অফিসারকে তদন্ত করতে বলেছে। মেহতাব ভেবে পায় না, ছেলেটা কেন তার বিপক্ষে কথা বলছে? এত সাহস পাচ্ছে কী করে সে? দাঁতে দাঁত চেপে শক্ত হয়ে বিছানায় বসে মেহতাব। তনুকা সেই সময় ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। মেহতাবের গম্ভীর মুখাবয়ব দেখে পরিস্থিতি বুঝতে সময় নেয় না তার। সে এগিয়ে গিয়ে তার পাশে বসে। মেহতাব নির্বিকার। তনুকা চেয়ে থেকে নিজ থেকেই বলে,
‘বাবার মৃত্যু নিয়ে আমারও সন্দেহ ছিল।’
মেহতাব কপালের সূক্ষ ভাঁজ দৃঢ় হলো; তবে, বলল না কিছু।।তনুকা ফের বলল,
‘তদন্ত হওয়া জরুরি। তাতে আপনার শত্রুদের খোঁজও পেয়ে যেতে পারেন।’
মেহতাব তনুকার দিকে চাইল। শ্যমালা চোয়াল শক্ত করে বলল,
‘এখন তদন্ত হওয়া মানে, গ্রামে এক আতঙ্ক ছড়ানো। গ্রামের সব মানুষ জানে, আব্বার মৃত্যু স্বাভাবিক। এখন হুট করেই পুলিশ দিয়ে এত তদন্ত করে গ্রামের পরিস্থিতি আমি খারাপ করতে চাই না। আমি যখন বলেছি, তদন্ত হবে না মানে হবে না। এই নিয়ে মহলে যেন আর কোনো কথা না হয়।’
‘মাঝে মাঝে আপনাকে আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয় না, মেহতাব। আমার মন বলে, এই আপনিটা আসল নন। কিছু লুকাচ্ছেন, তাই না?’
মেহতাব ক্রূর হাসে। হেয়ালির সুরে বলে,
‘সে তো লুকাচ্ছো তুমিও। আমি কি কিছু বলেছি তোমায়?’
তনুকা চকিতে চেয়ে বলে,
‘আমি? আমি কী লুকাচ্ছি?’
‘সেটা তুমিই ভালো জানো। তবে, লুকাচ্ছো তো অবশ্যই।’
তনুকা উঠে দাঁড়াল। নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলল,
‘মোটেও আমি কিছু লুকাচ্ছি না। লুকানোর মতো কিছু নেই আমার। আপনি অযথা সন্দেহ করবেন না।’
মেহতাব হাসল। যেন তনুকার কথাকে পাত্তাই দিল না সে। তনুকা ভ্রু কুঁচকে তাকায়। মেহতাবের হাসি এই মুহূর্তে সহ্য হচ্ছে না তার। তাই ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠে,
‘কী হলো, হাসছেন কেন? আমি কি কোনো মজার কথা বলেছি?’
মেহতাব হাসি থামিয়ে লম্বা শ্বাস টানে। বলে,
‘তুমি অল্পতেই খুব ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠছো, বিবিজান। আমি তো কেবল মজা করছিলাম।’
‘করবেন না মজা। আমার এমন মজা পছন্দ না।’
‘ঠিক আছে, করব না। এখন তুমি কী চাও, আব্বাজানের মৃত্যুর তদন্ত হউক?’
‘হ্যাঁ, তাই চাই।’
‘হউক তবে।’
মেহতাবের সম্মতি পেয়ে স্বস্তি পায় তনুকা। এই তদন্ত হলে কিছু না কিছু অবশ্যই বের হবে। অন্তত, তার মনের সন্দেহ দূর করার জন্য হলেও একটা তদন্তের প্রয়োজন।
________
পরদিন বড়ো মাঠে গ্রামের গরীব দুঃখীদের খাবারের আয়োজন করা হয়। মেহতাব রাদাভ দুজনেই এই মুহূর্তে সেখানে। রান্নার কাজ শেষ সব। ইতিমধ্যেই অসহায় মানুষেরা সব উপস্থিত, খাবারের জন্য। মেহতাব আর রাদাভ দুজন মিলে সকলের পাতে পাতে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। মানুষেরা সব খাচ্ছে আয়েশ করে। যাদের কাছে মাংস ভাত অসাধ্য খাবার, তারা আজ পেট ভরে খেয়ে নিচ্ছে। খাবার দেওয়া শেষ করে রাদাভও মেহতাবের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বলে,
‘ভাইজান, চলো সবার সাথে আমরাও বসে পড়ি।’
মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। বলল,
‘এখন কেন? আগে সকলের খাওয়া হয়ে যাক, তারপর।’
‘আচ্ছা, ঠিক আছে।’
খাওয়া দাওয়া শেষ করে সেই অসহায় মানুষেরা মোহন লাল মজুমদারের জন্য দোয়া করে গেল। সবাই আজ তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে। মেহতাবের সুনামেও ভেসেছে সবাই। রাদাভ বোধ হয় খানিক বিরক্ত এসবে। কিছু থেকে কিছু করলেই, চারদিকে কেবল মেহতাবের গুণগান। সেও খেটেছে, কই তাকে তো কেউ কিছু বলল না।
ইশফাক এসে জানাল, খাবার একদম সমান সমান হয়েছে। কোনো খাবার বেঁচে নেই। যেগুলো বেঁচে ছিল, কিছু মানুষ আবার পলিথনে করে তাদের বাড়ির মানুষের জন্যও নিয়ে গিয়েছে। তাই আপাতত পাতিল খালি। মেহতাব প্রসন্ন হেসে বলল,
‘সমস্যা নেই, গ্রামের মানুষেরা পেট ভরে খেতে পেরেছে আমার তাতেই শান্তি।’
তারপর সে রাদাভের দিকে চেয়ে বলল,
‘চল, আমরা বরং মহলে গিয়েই খেয়ে নিব।’
মেহতাব মহলে এসে ফ্রেশ হতে ঘরে আসে। তনুকা তখন বারান্দায় দাঁড়ান। মেহতাবের উপস্থিতি হয়তো টের পায়নি। তাই গুনগুন করে গেয়ে যাওয়া গানটা জারি ছিল। মেহতাব কাছাকাছি আসতেই সেই সুর কানে লাগে। সে এগিয়ে যায়। ঠিক দাঁড়ায়, তনুকার পেছনে। অতি নিকটে, যেন শুনতে পায় সে কী গান গাইছে। তনুকার গলার স্বর অত্যন্ত ক্ষীণ হলেও মেহতাব ঠিকই শুনতে পাচ্ছে।
“আমি তোমারি বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস–
দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী, দীর্ঘ বরষ-মাস ।
যদি আর-কারে ভালোবাস, যদি আর ফিরে নাহি আস,
তবে তুমি যাহা চাও তাই যেন পাও, আমি যত দুখ পাই গো ”
এইটুকু গেয়ে থামল তনুকা। কেন যেন গলা ধরে আসছে তার। মেহতাবের উপস্থিতি ততক্ষণে সে বুঝে গিয়েছে। সে সহসাই তার মাথা পেছন থেকে মেহতাবের বুকে ঠেকায়। মেহতাব অবাক হয় না। নিশ্চল দাঁড়িয়ে রয়। তনুকা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। জিজ্ঞেস করে,
‘আচ্ছা, মানুষ যা চায় তা কেন পায় না? কেন মানুষের চাওয়ার বিপরীতেই সবকিছু হয়? যদি চাওয়াগুলো সব পূর্ণ হতো তবে, আজ চারদিক ভরে যেত অফুরন্ত সুখে। কিন্তু, তেমনটা হয় না। মানুষের চাওয়া আজীবন অপূর্ণ’ই থেকে যায়।’
মেহতাব দুহাত দিয়ে আগলে নেয় তনুকাকে। তনুকা আজ বাঁধা দেয় না। মেহতাব বলে,
‘মানুষের চাওয়া অবশ্যই পূর্ণ হয় তবে, সব চাওয়া না। যেই চাওয়াটা মানুষের জন্য কল্যাণকর সেই চাওয়াটাই কেবল পূর্ণতা পায়। অন্যথায় বাকি সব চাওয়া অপূর্ণ’ই রয়ে যায়।’
‘আমি কি আমার জন্য অকল্যানকর কিছু চেয়েছিলাম? তবে, কেন আমার চাওয়া অপূর্ণ রইল?’
‘কী চাও, বলো? আমি পূর্ণ করব সব।’
তনুকা ফিরে চাইল। হাসল সে। মেহতাবকে গভীর মনোযোগে দেখে বলল,
‘পারবেন না আপনি। সব পারলেও, এটা আপনি কখনোই করতে পারবেন না।’
‘এত কঠিন তোমার চাওয়া?’
‘হ্যাঁ, আপনার জন্য ভীষণ কঠিন।’
‘বলো আমায়, অন্তত একটা চেষ্টা হলেও করতে পারব।’
তনুকা ফের হাসে। তাচ্ছিল্যের হাসি এটা। বলে,
‘উঁহু, অসম্ভব। আপনার জন এই কাজ অসম্ভব।’
‘তবে, কে পারবে বলো? তাকে দিয়েই করাব।’
তনুকা কিছু বলতে গিয়েও থামল। মুখে উগলে আসা কথাটা চট করে গিলে বলল,
‘খেয়ে আসেননি নিশ্চয়ই? ফ্রেশ হয়ে আসুন, আমি খাবার দিচ্ছি।’
তনুকা চলে আসে বারান্দা থেকে। মেহতাব নিষ্পলক চেয়ে তার যাওয়া দেখে। বক্ষঃস্থল ছেদ করে বেরিয়ে আসে এক বিষাদ নিশ্বাস। আনমনেই বলে,
‘হয়তো আমি জানি, তুমি কী চাও। কিন্তু, সত্যি এটাই যে, আমি বেঁচে থাকতে কখনোই তোমার সেই চাওয়া পূর্ণ হবে না। এক্ষেত্রে আমি বড্ড অক্ষম, বিবিজান। আমাকে ক্ষমা করো।’
_________
খাওয়া শেষ করে মোবাইল নিয়ে শুয়েছিল রাদাভ। সেই মুহুর্তে ছোট কাকা আসেন তার ঘরে। অনুমতি নিয়ে ভেতরে ঢুকেন। কাকাকে দেখে উঠে বসে রাদাভ। বলে,
‘তুমি এইসময় এখানে? কিছু বলবে?’
মতিব মজুমদার তার পাশে বসে হাসলেন। অযথা এমন হাসি দেখে বিরক্ত হলো রাদাভ। বলল,
‘কিছু বলার থাকলে বলো।’
‘আজকের অনুষ্ঠান কেমন গেল?’
‘ভালো। তুমি যাওনি কেন?’
‘একটু কাজে ছিলাম।’
রাদাভ বাঁকা হেসে বিদ্রুপের সুরে বলল,
‘আমাদের পেছনে লাগা বাদেও অন্য কাজ আছে তোমার? যাক, জেনে ভালো লাগল।’
রাদাভের কথায় গা জ্বলে উঠলেও আপাতত তা হজম করে নিলেন মতিব মজুমদার। মেহতাবকে হারাতে তার এই ছেলেকে লাগবে। তাই এখন কোনোভাবেই তাকে ঘাটাতে চাইছেন না। তিনি হেসে বললেন,
‘আহা! ভাতিজা, কী যে বলো না। ঐ উত্তরের জমির কাজে গিয়েছিলাম। এই এইটুকু সম্পদ’ই তো আছে আমার, নাহলে এই ফকিরের আর কী’ই বা আছে বলো?”
‘এসব আজাইরা কথা বন্ধ করে আসল কথায় এসো। কাজ হয়েছে?’
‘না।’
রাদাভ ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলল,
‘আর কতদিন লাগবে?’
‘তাড়াতাড়ি সম্ভব না, সময় লাগবে। করিমুল্লাহ’র কোনো খোঁজ নেই, ও থাকলেও আমার একটু সাহায্য হয়ে যেত।’
রাদাভ হেসে বলল,
‘খোঁজ থাকবে কী করে? শা লা বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন দেখে, তাই তাকে বোধ হয় চাঁদের কাছেই পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।’
মতিব মজুমদার বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘তুমি কী করে জানলে?’
‘তোমার সাথে থাকা প্রত্যেক লোকের এই অবস্থা হয়েছে। এখনই সাবধান হও কাকা, ভবিষ্যতের কথা তো আর বলা যায় না।’
মতিব মজুমদার ঢোক গিললেন। তাকে ভীত দেখাচ্ছে। তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
‘এখন কী করব আমি?’
রাদাভ বিছানায় হেলান দিয়ে বসল। বলল,
‘আপাতত এখন একটাই কাজ, বাঘিনীর উপর থেকে নজর সরাও। বাঘ এখন ক্ষিপ্ত, যেকোনো সময় আক্রমণ করতে পারে। পরবর্তীতে পরিবেশ ঠান্ডা হলে না হয়, বাঘিনীর স্বীকারটা আমিই করব। আফটার অল, শিকারে আমি বেশ অভিজ্ঞ; সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগাতে হবে না?’
চলবে….
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৩৮।
‘কবে কথা বলবে?’
‘এখন কি এসব বলার সময়?’
‘প্রায় এক মাস হতে চলল, এখনও কি সময় হয়নি? তুমি আর কতদিন ওর সাথে থাকতে চাও? নাকি ইতিমধ্যেই চিন্তায় কোনোরূপ বদল ঘটেছে?’
আঁতকে উঠে জবাব এল,
‘তুমি কি কোনোভাবে আমাকে সন্দেহ করছো?’
‘না, সন্দেহ না ঠিক। তবে মনের উপর তো ভরসা নেই। বলা তো যায় না, যদি বেশি সময় নিতে গিয়ে দূর্বল হয়ে পড়ো; তখন?’
‘এমন কিছুই হবে না। তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। আর আপাতত এসব বাদ দিয়ে, যেটা করতে চাইছো সেটাই করো।’
‘ঠিক আছে, যাও তুমি।’
_________
মেহতাবের জন্য আনা কফির মগটা সাইড টেবিলে রাখল তনুকা। মেহতাব ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। চোখ মুখ কুঁচকে আছে অযথা। তনুকা তার পাশে বসে। হাতে তার গরম ধোঁয়া উঠা কফির মগ। বলে,
‘আপনার কফি দিয়েছি। খেয়ে নিন, নয়তো ঠান্ডা হয়ে যাবে।’
মেহতাব কফির মগ হাতে নিয়ে তনুকার দিকে চাইল। জিজ্ঞেস করল,
‘এতক্ষণ কি রেনুর ঘরে ছিলে?’
তনুকা ততক্ষণাৎ মাথা নাড়িয়ে বলে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ও পড়ছিল তো, তাই ওকে এক মগ কফি দিয়ে এলাম।’
‘ভালো করেছো।’
মেহতাব মনোযোগ দেয় আবার ল্যাপটপের স্ক্রিনে। তনুকাও তাকায় সেদিকে। বোঝার চেষ্টা করে, মেহতাব কী করছে। দেখে, কিছু ফাইলের লেখা মেহতাব সংশোধন করছে। তনুকার বুঝতে অসুবিধা হয় বিধায় জিজ্ঞেস করে,
‘কী করছেন?’
‘একটা জরুরি কাজ।’
‘এটা কীসের ফাইল?’
‘বুঝবে না তুমি।’
তনুকার মুখ থমথমে হয়। বুঝবে না মানে কী? সে কি অশিক্ষিত না কি? বিদেশ থেকে অনার্স কমপ্লিট করে এসে সামান্য একটা ফাইল বুঝবে না। বিরক্ত হয়ে আর কথাই বললনা। চুপচাপ কফি শেষ করে শুয়ে পড়ল।
_________
সকাল এখন সাতটা। বাগানে সম্মুখ প্রান্তে নির্লিপ্ত ভঙিতে হাঁটছেন রমেজ মজুমদার। চোখে মুখে চিন্তার ছাপ তাঁর। বাগানের এক কোণে পাতা বেঞ্চে বসে আছেন ঊর্মি বেগম। নিগূঢ়, নির্বাক তাঁর অভিব্যক্তি। অনেকক্ষণ হেঁটে রমেজ মজুমদার সহধর্মিণীর শিউরে বসলেন। বললেন,
‘আমার ভীষণ চিন্তা হচ্ছে, ঊর্মি।’
‘আমারও।’
‘রাদাভ এখন না আসলেও পারতো।’
ঊর্মি চাইলেন। নিঃসাড় সেই দৃষ্টি। বললেন,
‘সে অবশ্যই আসত। আমাদের এতদিনের সব পরিকল্পনার একমাত্র বাঁধা এই ছেলে। তার উপর আমাদের মেয়ের….’
রমেজ মজুমদার সতর্কতার সহিত বললেন,
‘আহা, আস্তে। শুনবে কেউ।’
‘আর কত লুকিয়ে রাখবেন?’
‘মেহতাব জানতে পারলে গর্দান নিবে আমাদের।’
‘গর্দান সে এমনিতেই নিবে। তারউপর আপনার মেয়ে যা করছে না, ভবিষ্যতে এর জন্য আমাদের কঠিন মাশুল গুনতে হবে, দেখবেন।’
‘আমার মেয়ে কিছুই করছে না, করছে তো তার বিবিজান; যাকে প্রতিনিয়ত চোখে হারায় সে।’
ঊর্মি তাচ্ছিল্যের সুরে বলে উঠে,
‘হ্যাঁ, বেচারার বিবিজানের প্রতি এই অতি প্রেম’ই না তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।’
‘তা যা বলেছ, এই মহলে প্রেম ভালোবাসা বলতে কিছু আছে না কি? এক মহাশয় প্রেম দেখাতে গিয়ে আজ পুড়ে ছাই। অন্যজন তো তাঁরই পথে।’
ঊর্মি আফসোসের সুরে বলল,
‘ভাইজানের জন্য আমার মাঝে মাঝে খুব মায়া হয়। মানুষটা ভাবিকে মন থেকে ভালোবেসে ছিল। অথচ ভাবি…’
থামলেন তিনি। এই মহলের আনাচে কানাচে কথা শোনার মানুষের অভাব নেই। বেশি কথা বললে বিপদে পড়তে হবে অবশ্যই, তাই চুপ থাকলেন। রমেজ মজুমদার বললেন,
‘চলো, উঠা যাক এবার। আমার আবার একটু পর বেরুতে হবে।’
তাঁরা উঠতেই নিচ্ছিলেন। সেই সময় সামনে এসে প্রকট হয় তনুকা। তনুকাকে এই মুহূর্তে এখানে আশা করেননি দুজন। তাই অবাক চোখে তাকান। ঊর্মি জিজ্ঞেস করেন,
‘তুমি এখানে?’
‘হু, বারান্দা দিয়ে দেখলাম, আপনারা বসে আড্ডা দিচ্ছেন, তাই চলে এলাম একটু খোশ গল্প করার জন্য। তা কী নিয়ে কথা বলছিলেন?’
ঊর্মি বেগম আর রমেজ মজুমদার একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করে সামান্য হাসলেন। রমেজ মজুমদার বললেন,
‘তোমাকে নিয়েই কথা হচ্ছিল, বসো না।’
তনুকা হেসে বসল। বলল,
‘আমাকে নিয়ে? বাহ, কী কথা? ষড়যন্ত্র?’
রমেজ মজুমদার আর ঊর্মি বেগমকে হতাশ দেখাল। ঊর্মি বেগম বললেন,
‘তোমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে আমাদের লাভ?’
তনুকা হাসল; যেন, বেশ মজার কথা শুনেছে সে। বলল,
‘ষড়যন্ত্র ছাড়া আজ অবধি আপনারা আর কিছু করতে পেরেছেন?’
ঊর্মি বেগম কপাল কুঁচকে বললেন,
‘এসব নিয়ে কোনো কথা বলার ইচ্ছে আমাদের নেই, তুমি আসতে পারো।’
তনুকা গম্ভীর মুখে চাইল। জিজ্ঞেস করল,
‘বাবাকে কে মে’রেছে?’
রমেজ মজুমদার অবাক কন্ঠে বললেন,
‘সেটা আমরা কী করে বলব?’
‘আপনারা অবশ্যই জানেন। এখন না বললে সমস্যা নেই, পুলিশ অবশ্যই খুঁজে বের করবে।’
‘ঠিক আছে তবে, বের করলেই দেখে নিও।’
‘এখন বললে, বেঁচেও যেতে পারেন।’
রমেজ মজুমদার আঁতকে উঠে বললেন,
‘তুমি কি কোনোভাবে আমাদের সন্দেহ করছো?’
‘না করেও তো উপায় নেই। আপাতত অপেক্ষা করছি, তদন্তের পরই খোলাসা হবে সব।’
তনুকা চলে গেল সেখান থেকে। ঊর্মি বিধ্বস্ত চোখে চেয়ে বললেন,
‘দেখলেন, মেয়েটা আমাদের সন্দেহ করে। আমরা কি এতটাই খারাপ?’
__________
‘মা, ডেকেছিলেন আমায়?’
আম্বিরা বেগম বই রেখে উঠে দাঁড়ালেন। বললেন,
‘হ্যাঁ, ভেতরে এসো।’
তনুকা ভেতরে প্রবেশ করে। দাঁড়ায় চুপচাপ। আম্বিরা বেগম বইটা নিজের টেবিলে রেখে বলেন,
‘তুমি নাকি তোমার শ্বশুরের মৃত্যুর তদন্ত চাইছো?’
তনুকা নির্লিপ্ত সুরে বলল,
‘জি।’
আম্বিরা বেগম ঘুরে চাইলেন। ঘরের মাঝে রাখা রকিং চেয়ারে বসলেন আয়েশ করে। বললেন,
‘তোমার কি মনে হয়, তোমার শ্বশুর খু ন হয়েছেন?’
তনুকা চাইল। নির্বিকার তার ভাবভঙ্গি। বলল,
‘জি, আমার তাই মনে হয়।’
‘তা কাকে সন্দেহ হয় তোমার?’
‘আমার সন্দেহ তে কিছু আসে যায় না, মা। পুলিশ তদন্ত করছেন, অপরাধী ঠিকই ধরা পড়বে।’
আম্বিরা বেগম লম্বা করে শ্বাস টানলেন। বললেন,
‘দেখো বউমা, রাদাভ আমার ছেলে তাই হয়তো ওর এই নিয়ে এত মাথা ব্যথা। কিন্তু, তোমাকে এই ব্যাপার নিয়ে এত বাড়াবাড়ি করা আমার পছন্দ হচ্ছে না। বাড়ির বউ তুমি, তাই ঘর সামলাও। এসব কিছু দেখার জন্য মেহতাব আর রাদাভ আছে।’
তনুকার মাঝে তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে আগের ন্যায় নির্লিপ্ত। ঠোঁট নাড়িয়ে বলল,
‘মা, বাবার ঔষধগুলো কি আমি একটু দেখতে পারি?’
আম্বিরা বেগম কপাল কুঁচকালেন সঙ্গে সঙ্গে; যেন, বিরক্ত হলেন ভীষণ। নিরস মুখে বললেন,
‘ঔষধ দেখে তুমি কী করবে?’
‘তেমন কিছুই না, শুধু দেখব।’
‘ঔষধ মেহতাবের কাছে।’
তনুকা অবাক হলো কিঞ্চিৎ। বলল না কিছু। কেবল মাথা নাড়িয়ে বলল,
‘আচ্ছা, আমি যাই তবে।’
‘যাও। আর কথাখানা মাথায় রেখো।’
তনুকা ঘরে ফিরে আসে। মেহতাব বেরিয়েছে অনেক সময় হয়েছে। রাদাভও নেই। বলতে গেলে কোনো পুরুষ’ই নেই মহলে। রেনু স্কুলে। মহলের বউরা যার যার ঘরে। তনুকা বিষন্ন চিত্তে বিছানায় বসল। কিছু ভালো লাগছে না তার। কবে এসব শেষ হবে কে জানে? কবে ঠিক হবে সব? কবে পূর্ণ হবে তার মনের চাওয়া? আদোত কি পূর্ণ হবে? নাকি মেহতাব মজুমদার দাঁড়াবে সবথেকে বড়ো বাঁধা হয়ে?
কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই তনুকা তার গলায় পরিহিত লকেটটাতে হাত বুলায়। খুলে দেখে সেটা। মেহতাব তার আর ছোটবেলার ছবি। তনুকা মলিন হাসে। আনমনে বলে,
‘মনে যার জায়গা নেই, গলায় তাকে ঝুলিয়ে কী হবে? মেহতাব মজুমদার, জোর জবরদস্তি ব্যতিত আপনি আর কিছুই পারেন না। কিন্তু, আফসোস! আপনি এখনো বুঝতে অক্ষম যে, আমি আপনার কখনোই হব না। কখনোই না।’
চলবে….