প্রাণেশ্বর পর্ব-৪১+৪২

0
298

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪১।

পরদিন সকালে তনুকার ঘুম ভাঙে আচানক। সে চোখ মেলে তাকাতেই মেহতাবকে পায় তার অতি নিকটে। মেহতাব ঝুঁকে আছে তার দিকে। ঘুম থেকে চোখ মেলেই এমন কিছু হয়তো সে আশা করেনি, তাই অপ্রস্তুত হয় ভীষণ। উঠতে নেয়, মেহতাব আটকায়। বলে,

‘উঠছো কেন?’

তনুকা ক্ষীণ সুরে বলে,

‘আপনি এভাবে কী দেখছেন?’

মেহতাব কিঞ্চিৎ হাসে। বলে,

‘এই কয়দিনের এত ব্যস্ততায় আমি আমার বিবিজানকে ঠিক মতো দেখতেও পারেনি, আজ তাই মন ভরে দেখে পুষিয়ে নিচ্ছি।’

তনুকা ইতস্তত সুরে বলে,

‘আমি উঠব, সরুন।’

‘উঁহু, আরো আধঘন্টা আমি তোমাকে এভাবেই দেখব।’

তনুকা ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘পাগল হয়েছেন? আজ আপনার আর কোনো কাজ নেই?’

‘না।’

মেহতাবের কন্ঠের গভীরতা আন্দাজ করতে পেরে তনুকা অস্থির হয়। সে মেহতাবের বুকে হাত রেখে তাকে সরানোর চেষ্টা করে। মেহতাব নড়ে না এক ইঞ্চিও। তনুকা বিরক্ত হয়। বলে,

‘আশ্চর্য! এমন করছেন কেন?’

মেহতাব এক হাত তনুকার গালে ঠেকায়। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,

‘তুমি সেদিন বলেছিলে না, যদি মানুষের সব চাওয়া পূর্ণ হতো তবে পৃথিবীটা সুখে ভরে যেত। কিন্তু, নির্মম সত্যি এটাই যে, মানুষের অতিরিক্ত চাওয়া জিনিসটা কখনোই তার হয় না; সেটা আজীবন অপূর্ণ’ই থেকে যায়।’

মেহতাবের গলার স্বর অবাক করে তনুকাকে। মেহতাব ফের বিধ্বস্ত সুরে বলে উঠে,

‘আমাকে একটু ভালোবাসলে কী ক্ষতি হতো, তনু? কেন ভালোবাসোনি? আমি কি খুব খারাপ?’

তনুকা নির্বাক, নিস্তব্ধ। কী বলবে সে? মেহতাবকে কখনো এভাবে আশা করেনি। সে হঠাৎ এত ভেঙে পড়ল কেন? মেহতাব এগিয়ে এসে তনুকার কপালে চুমু খায়। তনুকা দম টেনে নিশ্বাস ছাড়ে। মেহতাব আবার বলে,

‘আমার জন্য এই মুহূর্তে সবথেকে দামি বস্তুটা হলো তোমার ভালোবাসা, যেটা হয়তো কখনোই আর আমার পাওয়া হয়ে উঠবে না। কিন্তু, বিশ্বাস করো তনু, অধিকার থাকার পরও যেই জিনিসটা আমি পাবো না, সেটা আমি কখনো অন্য কাউকেও পেতে দিব না। এক্ষেত্রে আমি বড্ড স্বার্থপর, নিষ্ঠুরও বটে।’

তনুকা ঢোক গিলে। ভয় পায় সে। মেহতাব এসব কেন বলছে? সে আবার কিছু বুঝে ফেলেনি তো? তনুকার সম্বিত ফেরে নাকের উপর মেহতাবের উষ্ণ স্পর্শে। তনুকা চোখ বোজে গাঢ় নিশ্বাস ফেলে। মিইয়ে যাওয়া সুরে বলে,

‘ছাড়ুন, মেহতাব।’

মেহতাব ছাড়ল না। তনুকাকে আজ ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো তার। মন বলছে, হয়তো বেশি সময় নেই; ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার আগেই একবার সে যত্ন করে ভালোবাসতে চায়। বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে চায়। বলতে চায়, “পৃথিবীর সবকিছুতে ভুল থাকলেও আমার ভালোবাসায় কোনো ভুল নেই, বিবিজান। আমার ভালোবাসা ঐ আকাশের ন্যায় বিশুদ্ধ শুভ্র। বিশ্বাস করো, আমি তোমায় সত্যি ভীষণ ভালোবাসি।”

মেহতাবের উষ্ণ স্পর্শ প্রগাঢ় হয়। তনুকার অস্বস্তির মাত্রা বাড়ে। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা চালায়। কিন্তু, মেহতাব যেন ছাড়তে নারাজ। মেহতাব মাথা তুলে তনুকার ঠোঁটের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। সেই দৃষ্টির অর্থ আন্দাজ করতে পেরে বিচলিত হয় তনুকা। ছটফটের মাত্রা বেড়ে যায়। মেহতাব আরেকটু এগুতেই তনুকা নিজের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা দেয় তাকে। মেহতাবকে তাও চুল পরিমাণ নাড়াতে পারে না। তাই কেঁদে ফেলে এবার। বলে উঠে,

‘আপনি বলছিলেন, কোনোপ্রকার জোর জবরদস্তি আপনি করবেন না। তবে, আজ এমন কেন করছেন?’

মেহতাব নিজেকে আটকায়। গলার স্বর দৃঢ় করে বলে,

‘তখনও মনে ক্ষুদ্র আশা ছিল। কিন্তু, এখন আমার আর কোনো আশা নেই। আশাহীন প্রতীক্ষার কোনো মানে হয় না।’

‘তাই বলে আপনি জোর করবেন?’

‘আমার অধিকার আছে।’

‘আপনিও অন্য সবার মতো অধিকার খাটাতে চাইছেন, মেহতাব? এত ঠুনকো আপনার ভালোবাসা?’

মেহতাব হাসে। বেশ শব্দ করেই হাসে সে। চট করে উঠে বসে। মাথার চুল ঠিক করে। হাসি জারি রাখে বেশ কিছুক্ষণ। তনুকাও ধরফরিয়ে উঠে বসে। মেহতাবের অদ্ভুত আচরণে হতভম্ব সে। মেহতাব তার দিকে তাকায়। হাসি থামিয়ে বলে উঠে,

‘আমার ভালোবাসা ঠুনকো হলে কার ভালোবাসা দৃঢ়, বলো? বলো, কে সে? যদি আমার থেকেও প্রগাঢ় কেউ ভালোবাসে তোমায় তবে, নিজ হাতে আমি তোমাকে তার হাতে তুলে দিব।’

তনুকা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রয়। মেহতাব কী বলছে এসব? সে কি কোনো সুযোগ দিতে চাইছে তাকে? তার এখন কী করা উচিত? মেহতাবের প্রস্তাবে রাজি হওয়া উচিত, না কি না? এটা আবার তার কোনো ফাঁদ নয়তো?

তনুকা বিপাকে পড়ে। চিন্তায় কপাল কুঁচকে উঠে দাঁড়ায়। বীতঃস্পৃহ সুরে বলে,

‘এসব শুনতে ভালো লাগছে না, মেহতাব। কেন বলছেন এসব? সকাল সকাল কী হয়েছে আপনার?’

মেহতাব দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে,

‘কিছু হয়নি। ফ্রেশ হয়ে এসো, খেয়ে দেয়ে তোমাকে নিয়ে মনোহর নদীতে নৌকা ভ্রমণে যাব।’

তনুকা আর কথা বাড়াল না। সে ওয়াশরুমে গেল ফ্রেশ হতে।

ফ্রেশ হয়ে এসে মেহতাবকে আর ঘরে পায় না তনুকা। তার বলা কথাগুলো সব কানে বাজছে ক্রমাগত। তনুকা হাত মুখ মুছে নিচে যায়। ডাইনিং এ আজ সবাই থাকলেও মেহতাব নেই। রাদাভও নেই। তনুকা এক ফাঁকে রেনুর কাছে তাদের কথা জিজ্ঞেস করে। তবে রেনু জানায়, সে কিছুই জানে না।

________

অন্ধকার ঘরে জানলার শিক গলিয়ে আসা ক্ষুদ্র আলো বৈ আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তবে, শোনা যাচ্ছে এক অদ্ভুত আওয়াজ। বেশ খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এটা কারোর গোঙানোর স্বর। একটু পরেই ঘরের দরজাটা খুলে গেল বেশ শব্দ করে। সঙ্গে সঙ্গেই ঘরে প্রবেশ করল, এক পশলা আলোকচ্ছটা। চোখে মুখে আলো পড়তেই চোখ পিটপিট করে তাকায় ব্যক্তিটি। হাত, পা আর মুখ বাঁধা বলে কোনোপ্রকার শব্দ করতে পারছে না। তবে, দরজায় দাঁড়ান ব্যক্তিকে ঠাহর করতে পেরেই তার অস্থিরতার মাত্রা তীব্র হয়। দুজন ব্যক্তি খটখট করে শব্দ করে ঘরের ভেতর প্রবেশ করে। একজন গিয়ে অজ্ঞাত লোকটির ঠিক মুখ বরাবর রাখা চেয়ারটাতে আয়েশ করে বসে। পায়ের উপর পা তুলে কিছুটা ঝুঁকে আসে সে। ক্রূর হাসে। বলে উঠে,

‘এতবার সাবধান করার পরও একই ভুল করলেন। আমাকে কি একটুও ভয় করে না আপনার?’

লোকটি ভয়ে রীতিমত কাঁপছে। মুখ বাঁধা বলে কিছু বলতেও পারছে না।

‘উনি কে, ভাইজান?’

মেহতাব চাইল রাদাভের পানে। হেসে বলল,

‘সেকি! চিনতে পারছিস না?’

রাদাভ ভ্রু কুঁচকে মনোযোগের সহিত লোকটাকে দেখে বলল,

‘ওমর মামা! উনি এখানে এভাবে… কেন?’

‘আমি এনেছি।’

রাদাভ অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

‘কিন্তু, কেন?’

মেহতাব বলে,

‘জানিস, তনুকা এতদিন উনার কাছেই ছিল।’

‘হ্যাঁ, সেটা তো সবাই জানে।’

মেহতাব আচমকা প্রশ্ন করে,

‘তনুকা যে সুস্থ, সেটা জানিস?’

রাদাভ পুলকিত হয়। হ্যাঁ কী না বলবে বুঝে উঠতে পারে না। মেহতাব রাদাভের দিকে তাকায়। প্রশ্ন করে,

‘তুই জানতিস না?’

রাদাভ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। আমতা আমতা করে বলে,

‘ন না, আমি ক কী করে জানব? সবাই তো জানে, ভাবি অসুস্থ।’

‘উঁহু, তনুকা একদম সুস্থ। এতদিন উনারা আমাদের মিথ্যে বলে এসেছেন।’

রাদাভ ঢোক গিলে। তনুকার সুস্থ থাকার কথাটা যদি মেহতাব জেনে যায় তবে, পরবর্তী সব কথাও মেহতাব জেনে যাবে। আর এই মুহূর্তে মেহতাবের সবকিছু জেনে যাওয়া মানে ঘোর বিপদ।

রাদাভ অস্থির হয়। কী করে ব্যাপারটা সামাল দিবে, সেটাই ভাবছে। মেহতাব কিছুটা সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘উনাকে মে রে ফেললে কি তনু খুব বেশি কষ্ট পাবে, রাদাভ? আফটার অল, তনুকে ছোট থেকে নিজ সন্তানের মতো বড়ো করেছেন, কষ্ট হয়তো খানিকটা পাবে, তাই না?’

রাদাভ বিস্ফোরিত চোখে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘তুমি কি উনাকে মে রে ফেলতে চাইছো?’

‘হ্যাঁ, চাইছি। আমি কোনো মিথ্যাবাদীকে পৃথিবীতে রাখতে চাই না। আমাকে মিথ্যে বলা প্রত্যেকটা মানুষকে আমি নিজ হাতে খু ন করব।’

রাদাভ ঢোক গিলে। ঘামে গায়ের শার্টটা ইতিমধ্যেই ভিজে গিয়েছে তার। সে হাত দিয়ে কপালের ঘাম মুছে বলে উঠে,

‘এমন করো না, ভাইজান। পুলিশ কেইস হতে পারে।’

মেহতাব হেসে বলে,

‘সামান্য পুলিশ তোর ভাইজানের কিছুই করতে পারবে না, বোকা। ঐ ড্রয়ারে দেখ একটা চাপাতি আছে, নিয়ে আয় তো।’

চলবে….

#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪২।

এমন ভয়ানক কুৎসিত মৃত্যু রাদাভ লাস্ট একটা সিরিজে দেখেছিল হয়তো, আজ আবার দেখছে নিজের চক্ষু সম্মুখে। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে পড়েছে তার। পেট উগলিয়ে খাবার সব গলায় আটকে আছে। একটু ফুরসত পেলেই যেন বেরিয়ে আসবে। সে কস্মিনকালেও ভাবেনি যে, মেহতাব মজুমদার এত জঘন্য ভাবে মানুষ খু ন করতে পারে।

মেহতাব উঠে দাঁড়ায়। শরীরে লেপ্টে থাকা র ক্তগুলো টিস্যু দিয়ে মুছতে মুছতে বলে উঠে,

‘আজকের এই ঘটনা যেন আমার বিবিজানের কান অবধি না যায়। যদি যায় তবে, ভাই বলে কিন্তু তুই মাফ পাবি না।’

ইতিমধ্যেই রাদাভের গলা শুকিয়ে কাঠ। খাবারগুলো দলা পেঁকে গলাতেই আটকে আছে যেন। চোখের সামনে র ক্তের এই বন্যা তাকে স্থির থাকতে দিচ্ছে না। তারপর শরীরের এই খন্ড খন্ড অংশগুলো। রাদাভ আর নিতে পারল না। সে মুখে হাত চেপে দৌড়ে গিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল। মেহতাব এই কান্ড দেখে বিরক্ত হয়। বিদ্রুপের সুরে বলে উঠে,

‘এই সাহস নিয়েই এসেছে আবার মেহতাব মজুমদারকে পরাজিত করতে; বোকা ছেলে!’

রাদাভ যতক্ষণে বেরিয়ে আসল ততক্ষণে মেহতাবের সব কাজ শেষ। রাদাভ বেরিয়ে দেখল ঘর একদম চকচকে ফকফকে। মেহতাব নিজেও একেবারে ধুয়ে মুছে পরিষ্কার। একটু আগেই যে এই মেঝে র ক্ত আর মানুষের খন্ড বিখন্ড শরীরে অংশেতে ভেসে যাচ্ছিল তা এখন ক্ষুনাক্ষরেও টের পাবে না কেউ। রাদাভ রুমাল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,

‘এসব কে পরিষ্কার করেছে, ভাইজান?’

‘করেছে কেউ, তোর জেনে কাজ নেই।’

রাদাভ অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইল। মেহতাব বলল,

‘আমার কথাটা মনে থাকবে তো, তনু যেন কিছুই জানতে না পারে।’

রাদাভ মাথা কাঁত করে জানাল,

‘হ্যাঁ, মনে থাকবে।’

‘চল এবার, বেরুতে হবে।’

মেহতাব ঘর ছেড়ে বের হলো, তার পেছন পেছন বের হলো রাদাভও। আশেপাশে নজর বুলিয়ে দেখল একবার। তেমন কোনো বাড়ি ঘর নেই। বেশ গাছপালা দিয়ে বেষ্টিত জায়গাটা। পুরোনো ভাঙা ঘর, ঘরের ভেতর যে এত বিদঘুটে সব কাজ হয় বাইরে থেকে দেখে তা বোঝা মুশকিল। রাদাভকে নিয়ে মেহতাব তার গাড়িতে বসল। ইশফাক আসেনি বলে, মেহতাব’ই ড্রাইভিং সিটে বসেছে। রাদাভ স্তব্ধ। ঘটনাগুলো এখনো মস্তিষ্ক জুড়ে বিচরণ চালিয়ে যাচ্ছে। মেহতাব তাকে একবার পরখ করে বলল,

‘কীরে, এখনো ভয় পাচ্ছিস?’

রাদাভ চাইল। উত্তরে ক্ষীণ সুরে বলল,

‘উনাকে না মা রলেও পারতে, ভাইজান। ভাবি একদিন না একদিন ঠিকই জানবেন।’

‘জানুক তবে, সেটা যেন তোর মুখ থেকে না হয়।’

রাদাভ নিশ্বাস ফেলল। চোখ বোজে হেলান দিল সিটে। আর কিছু আপাতত ভাবতে পারছে না সে। মেহতাবের এই রূপ সে কখনোই ভুলতে পারবে না। আজ এক ভয়ংকর মেহতাবকে দেখেছে সে।

_____

মেহতাব আর রাদাভ যখন বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয় তখন তনুকাও সেই ঘরেতেই ছিল। তাদের উপস্থিতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়াল সে। রাদাভ কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে চলে গেল নিজের ঘরে। মেহতাব এসে সোফায় বসল। তনুকা বুঝতে পারছে না কিছু। রাদাভকে অদ্ভুত লেগেছে। তবে, মেহতাবকে ফুরফুরে লাগছে যেন। সে তাই মেহতাবকে জিজ্ঞেস করল,

‘কোথায় গিয়েছিলেন আপনারা? নাস্তাও করে যাননি।’

‘একটা জরুরি কাজ সেরে এলাম। নাস্তা খাবার টেবিলে দাও, আমি আসছি।’

তনুকা আর প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ পেল না। মেহতাবের কথা মতো নাস্তার আয়োজন করতে গেল সে।

আজ সকালে গোসল সেরে বের হয়নি বলে মেহতাব এখন গোসল সেরেছে কেবল। গায়ে গামছা জড়িয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। ভেজা চুল মুছছে এক হাতে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তা ইশফাকের মহলের দিকে। ইশফাক তার বিশ্বস্ত সহকারী। সে তাকে কখনোই ঠকাবে না, এইটুকু সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে। তবে, তনুকা কেন কাল ইশফাকের ঘরে গিয়েছিল? কেন সত্যি বলতে পারছিল না সে? আর কত কিছু লুকিয়ে যাবে? সে কি বোঝে না, যত মিথ্যে তত বিপদ। মেহতাব মজুমদার যে মিথ্যে মোটেও পছন্দ করে না।

মেহতাব চুল মুছে ঘরে ফিরে। আলমারি খুলে একটা পাঞ্জাবী বের করে গায়ে দেয়। তারপর হাঁক ছাড়ে, “বিবিজান, বিবিজান” বলে। তনুকা রান্নাঘরে ছিল। মেহতাবের ডাক কানে যেতেই ঘরে আসে সে। তার রান্নার প্রয়োজন না থাকলেও আজকাল সে রাঁধছে। ঘামে সিক্ত শরীরে পেঁচিয়ে রাখা ওড়নাটা খুলে মুখ মুছে, অতঃপর জিজ্ঞেস করে,

‘কী হয়েছে? ডাকছিলেন কেন?’

‘তুমি রান্না করছিলে?’

‘জি।’

‘কী প্রয়োজন? ভৃত্যরা আছে না?’

‘ইউটিউব দেখে নতুন রান্না ট্রাই করছিলাম।’

‘আপাতত সেসব বন্ধ রেখে ফ্রেশ হয়ে এসো, মনোহর নদীর পাড়ে যাব।’

‘এই দুপুরে?’

‘হ্যাঁ, দুপুরেই।’

‘আচ্ছা, রান্নাটা সেরে নেই তবে।’

‘উঁহু, রান্না সারতে সময় নিবে। আমার হাতে এত সময় নেই। চলো তাড়াতাড়ি।’

তনুকা একপ্রকার তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়েই মেহতাবের কথাতে রাজি হলো। মেহতাব জেদি ভীষণ, এখন যেতে হবে মানে এখনই যেতে হবে। এই ভর দুপুরে নদীতে কে নৌকা ভ্রমণে যায়, তা একমাত্র এই উদ্ভট জমিদার’ই বলতে পারবেন।
তনুকা কামিজ পরে ওয়াশরুম থেকে বের হতে মেহতাব ভ্রু কুঁচকাল। বলল,

‘এটা কী পরেছ? শাড়ি পরে এসো।’

‘না, এই গরমে আমি এখন শাড়ি পরতে পারব না।’

মেহতাব তার কথায় পাত্তা না দিয়ে আলমারি খুলে তার পছন্দ মতো এক শাড়ি বের করে আনে। সেটা তনুকার হাতে দিয়ে স্বগতোক্তি করে বলে,

‘যদি তুমি স্বেচ্ছায় পরতে না চাও তবে, আমি পরিয়ে দিব।’

তনুকা বিরক্ত ভীষণ। এই লোককে দিয়ে ভরসা নেই, দেখা যাবে সত্যি সত্যিই জোর করে শাড়ি পরাতে আরম্ভ করল। তাই বিপদ কাটাতে নিজেই চলে গেল শাড়ি পরতে।

সাদা রঙের শাড়িতে শুভ্র দেখাচ্ছে তনুকাকে। মেহতাব চেয়ে হাসল। তার হাসিতে ভাঁজ পড়ল গালে। আপ্লুত সুরে আওড়াল,
‘আমার বিবিজান, আমার শুভ্রতা।’

তনুকার শূন্য মুখ। মুখে প্রসাধনীর রেশ মাত্র নেই। তবে, মেহতাবের কথায় কপালে এক কালো টিপ লাগিয়েছে। নিরেট মুখে আজ তার নাকের ছোট্ট সাদা পাথরের নাকফুলটা যেন একটু বেশিই জ্বলজ্বল করছে। মেহতাবের দৃষ্টি যাচ্ছে বারবার সেদিকেই। সময় বের করে একবার সেই পাথরে ঠোঁট ছোঁয়ান বড্ড আবশ্যক মনে হলো তার।

মেহতাব নিচে গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে। তনুকা সিঁড়ির কাছে যেতেই রাদাভকে দেখে, সিঁড়ির কোণে দাঁড়িয়ে কারোর সাথে কথা বলছে ফোনে। তনুকা তার সম্মুখে দাঁড়াতেই সে কল কাটে। তাকে শুভ্র শাড়িতে দেখে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘আপনার ভাইয়ের সাথে, নৌকা ভ্রমণে।’

রাদাভ জবাব দেয় না আর। তনুকা অযথাই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। হয়তো কিছু শোনার অপেক্ষা নয়তো এমনিতেই।

যদিও মেহতাব আম্বিরা বেগমকে জানিয়েছে তাও তনুকা তার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েই বাইরে বের হয়। গাড়িতে উদগ্রীব হয়ে বসে আছে মেহতাব। তার যেন আজ একটু বেশিই তাড়া। তনুকা তার পাশে বসতেই গাড়ি স্টার্ট দেয়। তারা মহল ছেড়ে কিছুটা পথ আসতেই তনুকার মোবাইলে টুং করে একটা শব্দ হয়। আনমনেই শব্দের উৎস উদঘাটন করতে গিয়ে তনুকা সেখানে তার এক অতি পরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ দেখে। তনুকা আড়চোখে একবার মেহতাবকে দেখে নিয়ে মেসেজটাতে চাপ দেয়। পুরো লেখাটা চোখের সামনে আসতেই সে মনে মনে পড়ে, “আজ মেহতাবের সাথে একা কোথাও যেও না। আমার মন বলছে, আজই কোনো এক বিপদ ঘটবে।” মেসেজটা দেখে বিস্মিত হয় তনুকা। হঠাৎ বিপদের কথা কেন বলা হচ্ছে? আর মেহতাব তো স্বাভাবিক, তাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না কোনো বিপদ ঘটবে বলে? তনুকা তুখোড় দৃষ্টিতে মেহতাবকে দেখে। মনে মনে ভাবে, “মেহতাব কি আজ একটু বেশিই স্বাভাবিক? উনার এই অতি স্বাভাবিকতাই আবার কোনো অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণ হবে না তো? নয়তো আজ আচমকাই এই ভর দুপুরে নদীতে নৌকা ভ্রমণের ইচ্ছে জাগল কেন তাঁর?”

চলবে….