#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৩।
তপ্ত দুপুর। মাথার উপর অগ্নি নৃত্য চালাচ্ছেন মার্তন্ড মহাশয়। তনুকা বিরক্ত অঢেল। এই গরমে কেউ বাইরে বের হয়? তার মাথার তালু যেন পুড়ে যাচ্ছে। বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে আছে মাত্রাধিক। মেহতাব স্বাভাবিক ভীষণ। তনুকার হাত ধরে সহসাই হেঁটে চলছে সম্মুখ পানে। তাদের পদচারণ গিয়ে থামে ঠিক মনোহর নদীর ঘাটটার সামনে। তনুকার দৃষ্টিতে সামনের দৃশ্যটুকু প্রস্ফুটিত হওয়ার সাথে সাথেই বিস্ময়ে তার ঠোঁট আলগা হয়ে যায়। সে ঘাড় ঘুরিয়ে মেহতাবকে দেখে। মেহতাবের ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসি। হাসি জারি রেখেই সে বলে উঠে,
‘শুভ জন্মদিন, বিবিজান।’
এতসব চিন্তার ঘোরে নিজের জন্মদিনটাও খেয়াল ছিল না তনুকার। সে অতি বিস্ময়ে কথা হারিয়ে ফেলে। মেহতাবের কাছ থেকে এসব তার আশাতীত ছিল। মেহতাব তার হাতের বাঁধন শক্ত করে বলে,
‘চলো, নৌকা ভ্রমণে যাই।’
তাদের সামনে নিরুপম সৌন্দর্যে সাজানো এক নৌকা। মেহতাব হাত ধরে তনুকাকে সেই নৌকাতে তুলে। নিজেও উঠে বসে। তনুকা ধীর গতিতে ছাউনির নিচে বসে গিয়ে। মেহতাব বসে নৌকার একদম শেষ মাথায়। বড়ো বৈঠাটা হাতে তুলে নিয়ে আমোদ গলায় বলে উঠে,
‘হুকুম করুন, বিবিজান; আপনার জন্য এই অধম মাঝি তৈরি।’
তনুকা ড্যাবড্যাব করে চেয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি নৌকা চালাবেন?’
‘কী মনে হয়, আমি পারব না?’
তনুকা জানে মেহতাব পারবে। তাও তাকে ক্ষেপাতে বলে,
‘জমিদার মানুষ নৌকা চালাবে, তাই ভরসা পাচ্ছি না ঠিক।’
মেহতাব হাসল। বলল,
‘চিন্তা নেই, বিবিজান। জমিদার সাহেব তার বিবিজানকে আগলে রাখতে জানেন।’
তনুকা ক্ষীণ হেসে বলে,
‘তবে চলুন, মাঝি। আমাকে ওপাড়ে নিয়ে যান।’
মেহতাব পুরো দমে বৈঠায় হাত লাগায়। সাথে তুলে সুরও,
“সব সখিরে পার করিতে নেব আনা আনা
তোমার বেলায় নেব সখি তোমার কানের সোনা
সখি গো, আমি প্রেমের ঘাটের মাঝি
তোমার কাছে পয়সা নিব না
ও সুজন সখিরে
প্রেমের ঘাটে পারাপারে দরাদরি নাই
মনের বদল মন দিতে হয়………”
মেহতাবের গলায় গান শুনতে তনুকা পলক ফেলতেও ভুলে যায় যেন। আশ্চর্য, লোকটা এত সুন্দর গাইতে পারে! মেহতাব অর্ধেক গেয়েই থেমে যায়। তনুকা বলে উঠে,
‘আপনি খুব ভালো গান করেন।’
‘ধন্যবাদ।’
তারপর দুজনেই চুপ। এই উদ্ভ্রান্ত এক গরমের দুপুরে কলকল করে কেবল শোনা যাচ্ছে পানির স্রোত ধ্বনি। দুই মানব মানবী হয়তো কান পেতে তাই শুনছে। নিবিড় নিগূঢ় তাদের দৃষ্টি। এই নদীর জলের মতোই স্বচ্ছ। উপর দিয়ে দুজনেই বড্ড স্বাভাবিক থাকলেও ভেতরে রয়েছে তাদের আলাদা জগত। সেই জগতে দুজন দুজনার নিকট বড্ড অপরিচিত, বড্ড অচেনা কেউ।অথচ সেই দুজনেই স্বাভাবিক থাকার কত নিঁখুত অভিনয় করে চলছে।
কিছুটা দূর আসার পর পরই বেশ কিছু পদ্মফুল দেখা যায়। পদ্মফুল দেখেই তনুকার মন অস্থির হয়ে ওঠে। যদিও ফুল সব মজে গিয়েছে তবুও সে নিতে চায়। সে ছাউনি থেকে বের হয়ে পানির দিকে হাত বাড়ায়। মেহতাব ভ্র কুঁচকে বলে,
‘কী করছো?’
‘নৌকাটা আরেকটু ডানদিকে নিন, আমি ঐ পদ্মফুলগুলো নিব।’
‘ঐগুলো তো সব মজে গিয়েছে।’
‘তাও নিব আমি।’
মেহতাব নৌকা ডানে নিল। পদ্মফুলগুলো কাছে বেশ। তনুকা হাত বাড়ানোর আগেই মেহতাব বলে উঠল,
‘দাঁড়াও, তুমি বসো। আমি নিয়ে দিচ্ছি।’
তনুকা বসে থাকে। মেহতাব এগিয়ে গিয়ে নৌকার এক সাইড ঘেঁষে বসে পদ্মফুলে হাত দেয়। ছিড়ে আনে একটা। তনুকার হাতে দিতেই তনুকার মুখে প্রসন্ন হাসি ফুটে। সে চট করে শাড়ি একটু টেনে পানিতে পা ভিজিয়ে বসে। মেহতাব এক হাতে ধরে তাকে, পড়ে যাওয়ার ভয় পায় সে। তনুকা তার দিকে চেয়ে বলে,
‘পড়ব না আমি। ঐ দুটো ফুলও এনে দিন।’
মেহতাব এক হাতে তনুকাকে ধরে অন্যহাতে ফুল ছিড়ে আনে।তা দেখে স্মিত হাসে তনুকা।
বেশ কয়েকটা পদ্মফুল কোলে নিয়ে বসে আছে তনুকা, একটা কানে পরেছে। মেহতাব নৌকা চালানোতে মনোযোগ দিচ্ছে কম তনুকাকে দেখছে বেশি। মেয়েটাকে যত দেখে ততই যেন মায়ায় পড়ে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো না। তার এই অতিরিক্ত মায়াও কোনো ভালো ফল বয়ে আনবে না, সে জানে।
ওপাড়ে এসে নৌকা থামে। মেহতাব দড়ি ফেলে নেমে আসে দ্রুত। নৌকা আটকে দিয়ে তনুকাকে নামায়। তনুকা হেঁটে উপরে ওঠে। এপাড়ের সেই রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার গাছের নিচে দাঁড়ায় সে। মেহতাবও এসে দাঁড়ায়। তনুকা উপরের দিকে চেয়ে ভাবে যেন, তারা এক রক্ত ঝরা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে আছে। সে অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে নিচ থেকে একটা ফুল তুলে হাতে নেয়। অতঃপর মেহতাবের দিকে তাকায় সে। ফুলটা এগিয়ে দিয়ে বলে,
‘আমার জন্মদিনটাকে মনে রেখে এত সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।’
মেহতাব হেসে গ্রহণ করে ফুলটা। বলে,
‘তোমার জন্মদিন কি ভোলা সম্ভব? সবকিছু ভুলে গেলেও এই দিনটা মনে রাখব আজীবন।’
তনুকা চেয়ে থাকে কিছুক্ষণ। পরে কী ভেবে যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মেহতাব কিছু সময় ফুলটাকে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখে বলে,
‘চলো, খেয়ে নিবে।’
তনুকা অবাক হয়ে বলে,
‘কিন্তু, এখানে খাবার পাব কোথায়?’
‘নৌকাতে আছে।’
তনুকা ফের অবাক হয়। মেহতাব যে এত আয়োজন করে এসেছে তার জানাই ছিল না। তারা নৌকা থেকে খাবারগুলো এনে গাছের নিচে বসে। তনুকা প্যাকেট খুলে দেখে, বিরিয়ানি। প্লেটে বেড়ে মেহতাবকে এগিয়ে দেয়। নিজে অন্য একটা প্যাকেট খুলে বসে। গাছের ছায়ার নিচে বসে নিজের প্রিয় খাবার খাওয়ার মজাই হয়তো আলাদা। তনুকাও বেশ আনন্দ পাচ্ছে তাতে।
খাওয়া শেষ করে সব গুছিয়ে তনুকা এসে মেহতাবের পাশে বসে। মেহতাব গাছের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। পা যুগল লম্বা করে রাখা। তনুকা পা ভাঁজ করে বসেছে। এখন বেশ বাতাসও বইছে এইদিকে। হাত জোড়া কোলের উপর ভাঁজ করে রাখা। মাথা নিচের দিকে নোয়ানো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে ক্রমাগত। ইঙ্গিত দিচ্ছে, সে কিছু বলতে চায়। মেহতাব তা দেখে ততক্ষণাৎ প্রশ্ন করে,
‘কিছু বলবে, বিবিজান?’
তনুকা ফিরে চায়। ইতস্তত লাগছে তাকে। কথাখানা পাড়তে নিজেকে ঠিক ধাতস্ত করতে পারছে না। মেহতাব বলে,
‘কিছু বলার থাকলে বলে ফেলো।’
তনুকা অপ্রস্তুত ভঙিতে বলে উঠে,
‘আমার কিছু চাই, মেহতাব।’
‘বলো, কী চাও।’
‘আগে বলুন, দিবেন।’
‘সামর্থ্যের মধ্যে হলে অবশ্যই দিব।’
‘আপনার সামর্থ্যের বাইরে আমি কিছু চাইবও না।’
‘বেশ, বলো তবে।’
তনুকা নিশ্বাস নেয় জোরে। নিজেকে শান্ত রাখার মেকি চেষ্টা তার। ক্ষীণ সুরে বলে,
‘মহলের উত্তর দিকের দীঘিসহ পুরো জমিটা আমার চাই।’
মেহতাবকে অবাক হতে দেখা গেল না। সে শান্ত সুরে জিজ্ঞেস করল,
‘ব্যস, এইটুকুই?’
‘আপাতত এইটুকুই।’
হাসল মেহতাব। বলল,
‘তিনদিনের মধ্যেই ব্যবস্থা করছি আমি।’
তনুকা কিঞ্চিৎ হেসে বলে,
‘ধন্যবাদ।’
‘আজ কেবল ধন্যবাদে হবে না, বিবিজান। ধন্যবাদের চেয়েও বেশি কিছু লাগবে আমার।’
তনুকা ভীত সুরে জিজ্ঞেস করে,
‘আর কী লাগবে?’
মেহতাব তার কোমরে হাত রেখে কাছে টেনে নেয়। তনুকা নিশ্চল হয়ে পড়ে। মেহতাব অন্য হাত রাখে তনুকার গালে। তার বৃদ্ধা আঙ্গুল সহসাই স্পর্শ করে বসে তনুকার ওষ্ঠযুগল। তনুকা ঢোক গিলে। মেহতাবের উদ্দেশ্য টের পেয়ে শরীর অসাড় হয়ে আসে তার। মেহতাব এগিয়ে আসতেই সে নড়ে ওঠে। মেহতাব হাতের বাঁধন শক্ত করে ততক্ষণাৎ। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে বলে,
‘মাঝে মধ্যে একটু বেহায়াপনা না করলে হয় না, বিবিজান। আর কত ধৈর্য্য ধরব, বলো?’
তনুকার নিশ্বাস ভারী হয়। সে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে। কিন্তু, মেহতাব আজ ছাড়তে নারাজ। বরং দ্বিগুণ দৃঢ় করেছে হাতের বাঁধন। তার নিশ্বাস তনুকার মুখে আছড়ে পড়তেই চোখের পাতা নিমীলিত করে সে। আজ হয়তো পরাস্ত হতেই হবে। তনুকার অসহায় মুখখানা দেখে মেহতাব হাসে। ভারী আনন্দ হয় তার। সে কিছুক্ষণ এক ধ্যানে দেখে তাকে। ঘোরের মাত্রা বাড়ে। নিজেকে আটকে রাখতে পারলেও আজ ইচ্ছে করেই লাগাম ছেড়ে দিল। তনুকা চোখ বোজা অবস্থাতেও টের পেল এক উষ্ণ ছোঁয়া। সঙ্গে সঙ্গেই শরীর কেঁপে উঠল তীব্র ভাবে। পায়ের তলা শিরশরিয়ে ওঠল। কান দিয়ে মনে হলো গরম ধোঁয়া বের হচ্ছে। সে নড়ল না আর, নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টাটুকুও করল না। তবে চোখের কার্ণিশ বেয়ে কিছু জল গড়িয়ে পড়ল ঠিকই। তা জানান দিল, মেহতাবের এই ছোঁয়া তাকে বড্ড দূর্বল করে তুলছে।
চলবে…..
#প্রাণেশ্বর
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
৪৪।
তনুকা দ্রুত ছুটে গিয়ে নৌকায় বসে। বক্ষঃস্থলের আন্দোলন কমছে না এখনো। সে বুকে হাত দিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নেয়। নিজেকে ধাতস্ত রাখার সবটুকু চেষ্টা সে চালিয়ে যাচ্ছে। তাও পারছে না বোধ হয়। মেহতাবের স্পর্শ আজ সবকিছু এলোমেলো করে দিয়েছে। তার পরিকল্পনায় প্রভাব ফেলছে তা। তনুকা ভাবতে না চায়লেও ভেবেই চলছে। মেহতাবও নৌকায় এসে বসে। সে স্বাভাবিক ভীষণ। বরং মেজাজ যেন আরো ফুরফুরে দেখাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করে,
‘নৌকায় বসলে যে? আজ তো আমরা ফিরছি না।’
তনুকা উদ্বেগ নিয়ে বলে,
‘কেন?’
‘ঐদিকের একটা ছোট্ট ঘরে আমাদের থাকার সব ব্যবস্থা করেছি, আজ সারাদিন সেখানেই থাকব।’
‘না না, অসম্ভব।’
তনুকাকে অস্থির দেখায়। মেহতাব ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘তুমি কি কোনোভাবে আমাকে ভয় পাচ্ছো, বিবিজান।’
তনুকা ভ্রু কুঁচকে জবাব দেয়,
‘আশ্চর্য! এখানে ভয় পাওয়ার কী আছে? আমি এখানে থাকতে চাই না, ব্যস এইটুকুই।’
‘আমি সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। এখন না থেকে উপায় নেই।’
‘আপনি কিন্তু এবার একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছেন।’
মেহতাব হেসে বলল,
‘এখনো কিছু শুরু করিনি, বিবিজান। অপেক্ষা করো, এখনো অনেক কিছু বাকি।’
মেহতাবের কথা শুনে কেন যেন তার প্রতি বিশ্বাসটা রাখতে পারল না তনুকা। সে একবার ছুঁয়েছে মানে আবার ছুঁবে। আর সে যত ছুঁবে তনুকা ততই দূর্বল হয়ে পড়বে। আর তার এই দূর্বল হয়ে পড়া মানে সবকিছু হারিয়ে ফেলা।
তনুকা বিভ্রান্ত ভাবে এদিক ওদিক চায়। চারদিকের এই অথৈয় পানি পার হয়ে ওপাড় সে কী করে যাবে? সে তো আর নৌকা চালাতে পারে না। মেহতাব উঠে এগিয়ে আসে। তনুকার পাশে বসে। মিহি সুরে বলে,
‘ভয় পেও না, বিবিজান। আমার কাছে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তোমার সম্মান; তোমার সম্মানে আঘাত লাগে এমন কিছু করব না।’
‘করে তো ফেলেছেন’ই।’
মেহতাব হাসে। বলে,
‘তুমিও তো আমাকে বাঁধা দাওনি। বরং স…’
তনুকা চট করে মেহতাবের মুখ চেপে ধরে। চোখ গরম করে বলে উঠে,
‘বাজে কথা বলবেন না একদম। আপনার সাথে আমি পেরে উঠতে পারব না, আপনি জানতেন; তাই ইচ্ছে করেই করেছেন সব।’
ঠোঁট স্পর্শ করা তনুকার হাতের পিঠে মেহতাব চুম্বন করে। তনুকা হাত সরায় সরায় সঙ্গে সঙ্গে। বড়ো বড়ো চোখে চেয়ে বলে,
‘এবার কিন্তু বেশি বেশি করছেন।’
‘আচ্ছা আর বেশি বেশি করব না, এখন থেকে একটু কম কম করব। চলো এবার, ঐদিকটা তোমাকে একটু ঘুরে দেখাই।’
মেহতাব নৌকা থেকে নেমে দাঁড়ায়। তনুকা বীতঃস্পৃহ ভঙিতে চেয়ে থাকে। সে নামতে চাইছে না মোটেও। মেহতাব হাত বাড়িয়ে দেয়, অগত্যাই উঠে দাঁড়ায় তনুকা। মেহতাবের হাত ধরে নৌকা থেকে নেমে আসে। তারপর আবার হাত ছাড়াতে নেয়। কিন্তু, মেহতাব হাত ছাড়বে না বলে আরো শক্ত করে সেই বাঁধন। তনুকা কিছুক্ষণ মোচড়া-মুচড়ি করেও যখন হাতখানা ছাড়াতে পারল না তখন ক্লান্ত হয়ে ক্ষান্ত হলো সে।
মেহতাব তনুকাকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা পথ চলে এসেছে। এতক্ষণ বেশ গাছগাছালি দেখা গেলেও এখন দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা বাড়িঘর। এটা বোধ হয় আরেকটা গ্রাম। এই গ্রামের নাম তনুকা একবার শুনেছিল তবে, এখন মনে নেই। আরেকটু এগিয়ে যেতেই দুজন লোক সামনের ঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসে। মেহতাবকে দেখে হাত উঁচু করে সালাম দেয়। হেসে বলে,
‘আরে জমিদার বাবু, আপনি আমাদের গ্রামে? হায় হায়, কী সৌভাগ্য আমাদের।’
লোক দুটোর অস্থিরতা দেখে তনুকা বিরক্ত হয়। তবে, মেহতাব হেসে বলে,
‘হ্যাঁ, আমার বিবিজানকে নিয়ে ঘুরতে এলাম।’
‘তাই! তাহলে আমাদের ঘরে আসেন না, দাঁড়ান আমি ফুলির মায়েরে ডাকতেছি।’
‘না না, আপনারা ব্যস্ত হবেন না। আমি কারোর ঘরে যাব না। এইদিকটা একটু ঘরে নিজের গৃহে ফিরব।’
লোক দুটি আরো কিছুক্ষণ জোর করল। তবে, মেহতাবকে রাজি করাতে পারল না ঠিক। তনুকা ফিসফিসিয়ে বলল,
‘চলুন না মহলে ফিরে যাই, আমার এখানে ভালো লাগছে না।’
মেহতাব বলল,
‘মহলে কাল সকালে ফিরব। এখানে একটা সুন্দর বাগান আছে, সেখানে গেলে ভালো লাগবে তোমার, চলো।’
তনুকাকে নিয়ে মেহতাব চলল সেই বাগানের উদ্দেশ্যে।
_____
‘খবর পাইছেন, ভাই; মেহতাব মজুমদার গ্রামে আইছে তাও আবার তার নতুন বউরে নিয়া।’
মদের বোতলটা মুখের কাছে নিয়েও নামিয়ে ফেলে। ভ্রু বাঁকিয়ে বলে,
‘বলিস কী? মেঘ না চাইতেই আজ বৃষ্টি হাজির?’
‘জি, ভাই।’
‘তা, জমিদার সাহেব এখন কোথায়? তাকে আমার গৃহে আমন্ত্রণ জানাও।’
ছেলেটা মাথা চুলকে বলে,
‘আপনি আমন্ত্রণ জানাইলে কি উনি আসব?’
‘কান টানলে মাথা এমনিই আসে। গাড়ি বের কর, জমিদার বউরে একবার দেখে আসা উচিত।’
_____
বাগানটা আসলেই চমৎকার। বিশাল বাগান। চারদিকে কত কত ফুলের গাছ। কী দৃষ্টি নন্দন এক দৃশ্য। এখানে এসে মেহতাব তনুকার হাত ছেড়ে দেয়। তনুকাও ছাড়া পেয়ে খুশিতে এদিক ওদিক ছুটছে। ফুলগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। এক দুটো ফুল ছিড়েও নিয়েছে। এত ফুল পেয়ে সমস্ত দুশ্চিন্তা তার নিমিষেই উবে গিয়েছে যেন। সে ভুলেই গিয়েছে সব। আপন মনে বাগানের চারদিক ঘুরে বেড়াচ্ছে। মেহতাব দূরে দাঁড়ান। তার বিবিজানকে অপলক চোখে দেখতে ব্যস্ত। যেন ছুটে চলা এই দুস্তর তরুণীকে আজ এক ষোড়শী কিশোরী মনে হচ্ছে তার। মেহতাব অতীত ভাবে, এইভাবে বেণী দুলিয়ে ছুটে চলত মেয়েটা। খিলখিলিয়ে হাসত। ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে কেঁদে কেটে ভাসিয়েছে কত, সেগুলোর এখন একটা চমৎকার স্মৃতির দেয়ালে আটকানো সব প্রতিচ্ছবি কেবল। মাঝে মাঝে মেহতাব আনমনে সেসব ভাবে, লুকিয়ে লুকিয়ে হাসে আবার কখনো বিষন্ন চোখে চেয়ে থাকে সেই মেয়েটার দিকে।
একজন লোক আসে। মেহতাবকে দেখে খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করে,
‘কেমন আছেন, জমিদার বাবু?’
মেহতাব লোকটাকে চেনে না ঠিক। তাও সৌজন্যবোধের খাতিরে জবাব দেয়। লোকটা জবাব পেয়ে আমোদ গলায় তার প্রশংসা করতে আরম্ভ করে। নিজের প্রশংসা সবারই পছন্দ, মেহতাবও তাই মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব। তনুকা এর মাঝেই হাঁটতে হাঁটতে চলে এসেছে অনেকটা দূরে। এত দূরে এসে ভাবল, এবার ফিরে যাওয়া উচিত। সেই ভেবে ঘুরতে নিলেই আচমকা কেউ একজন একটা রুমাল দিয়ে মুখ চেপে ধরে তার। কিছু বুঝে উঠার আগেই সহসাই সে ঢলে পড়ে।
চোখ খুলে আবিষ্কার করে চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। তনুকা নিজেকেও দেখতে পাচ্ছে না ঠিক মতো। মাথাটা ব্যথা করছে ভীষণ। ভয় করছে, বুক ধরফর করছে। সে আস্তে করে উঠে বসে। হাত বাড়িয়ে আশেপাশে ছোঁয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু, তাও বোঝে উঠতে পারে না কিছু। তার ভয়ের মাত্রা বাড়ে। অযাচিত এক আশঙ্কায় বুকে মোচড় দেয় তার। তাই কিছু না ভেবেই “মেহতাব” বলে চেঁচিয়ে উঠে। তার চেঁচানোর বিকট শব্দ প্রতিটা দেয়ালে বারি খেয়ে বেড়াচ্ছে। তনুকা উঠে দাঁড়ায়। দরজা জানালা কিছুই পাচ্ছে না সে। খুব কষ্টে হাতড়িয়ে হাতড়িয়ে একটা জানলা খুঁজে পায়। পর্দা সরাতেই অল্প কিছু আলো ঘরে এসে প্রবেশ করে। সে সতর্ক দৃষ্টিতে বাইরে চেয়ে বেশ কিছু গাছপালা ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না। সে অস্থির হয়ে ওঠে। কে তাকে এখানে নিয়ে এসেছে, কী তার উদ্দেশ্য? তনুকা উদ্ভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক চায়। অল্প আলোতে একটা বিছানা আর একটা দরজা ব্যতিত আর কিছুই নেই। দরজা দেখে তনুকা ছুটে যায় সেদিকে। হাতলে টান দিয়ে দেখে লক করা। সে ধাক্কাতে আরম্ভ করে,
‘কেউ আছেন? কে আমাকে আটকে রেখেছেন? দরজা খুলুন, কে আমার সাথে এমন করছেন? সামনে আসুন বলছি।’
তনুকা নিজের সবটুকু শক্তি দিয়ে দরজা ধাক্কাতে আরম্ভ করে। কিছুক্ষণ বাদেই দরজাটা খুলে যায় আপনা আপনি। তনুকা সরে দাঁড়ায়। দরজার সম্মুখে প্রকট হয় একজন ব্যক্তি। তনুকা ভ্রু কুঁচকায় তাকে দেখে। অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
‘আপনি!’
চলবে….