#উষসী_হাসবে_বলে (১৯)
লিখা- Sidratul Muntaz
“রিয়াসাত এক্সিডেন্ট করেছে।”
বিধ্বস্ত অবস্থায় বাড়ি ফিরে সবার প্রশ্নের তোপে অস্থির হয়ে কথাটা বলে উষসী। প্রিয়ন্তি বিস্মিত হয়ে বলল,” মানে? কিভাবে?”
উষসী ক্লান্ত গলায় বলল,” আমি এখন হাসপাতাল থেকেই এসেছি। আবার যাচ্ছি। কেউ কি আমার সাথে যেতে চাও?”
ডোনা সঙ্গে সঙ্গে বললেন,” তুই আবার কেন বের হবি? কোনো দরকার নেই।”
এদিকে উষসী একটু স্থির হয়ে বসতেই পারছে না। প্রচন্ড হাঁসফাস লাগছে তার। দম নিতেও বেগ পেতে হচ্ছে। আবার মনে হচ্ছে যেকোনো মুহূর্তে সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। শিমলা এগিয়ে এসে বললেন,” ইয়ামিন কোথায় উষু? সেও কি হাসপাতালে?”
উষসী কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে কুণ্ঠিত গলায় বলল,” উনি কোথায় তা আমি জানি না আন্টি।”
প্রিয়ন্তি বলল,” ফোন করে দেখলেই তো হয় চাচী।”
” ফোন ধরছে না তো!” ছেলের চিন্তায় মিসেস শিমলার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে। তিনি খুব দুশ্চিন্তা করছেন। উষসী আহমেদের দিকে তাকিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,” আহমেদ ভাই, চলুন আমার সাথে।”
” তোকে না যেতে নিষেধ করলাম?” ডোনা তেতে উঠলেন।
উষসী বেপরোয়া কণ্ঠে বলল,” আমাকে যেতে হবে আন্টি। আই হ্যাভ টু গো।”
এই কথা বলেই সে কারো উত্তরের অপেক্ষা না করে স্রেফ বের হয়ে যায়। তার এহেন অদ্ভুত আচরণের কারণ খুঁজে পায় না কেউ। ডোনা বিচলিত হয়ে বললেন,” আশ্চর্য মেয়ে তো! এই ঠান্ডার মধ্যে আবার বের হচ্ছে কোন আক্কেলে সে? বাইরে হাড় কাঁপানো শীত! এই আহমেদ যাওতো ওর সাথে।”
প্রিয়ন্তি নরম গলায় বলল,” আচ্ছা আমিও যাচ্ছি ওর সাথে মা। চিন্তা কোর না তুমি।”
ঘরের পোশাকেই গায়ে শুধু ওভারকোট জড়িয়ে বের হয়ে গেল প্রিয়ন্তি। ডোনা মাথায় হাত ঠেঁকিয়ে আফসোস করতে বসলেন,” কাল মেয়েটার বিয়ে। আর আজকে এইসব কি হচ্ছে! কি অলুক্ষুণে ব্যাপার! আল্লাহ, রক্ষা করো।”
শিমলা পায়চারী করছেন। অনবরত ছেলেকে ফোন করতে লাগলেন। কিন্তু মোবাইল বন্ধ।
গাড়িটা বরফের আস্তরণে ঢেকে আছে। আহমেদ পানি দিয়ে পরিষ্কার করে নিচ্ছে। উষসী স্তম্ভের মতো দাঁড়িয়ে আছে। তাকে ভীষণ বিচলিত দেখাচ্ছে। প্রিয়ন্তি তার বাহু চেপে ধরে জিজ্ঞেস করল,” ইয়ামিন কোথায়? সত্যি করে বল।”
” আমি কিভাবে জানব? আশ্চর্য!” উষসীর কণ্ঠে অপরাধী স্বর। প্রিয়ন্তি খিটমিট করে বলল,” তুই আমার চোখের দিকে তাকাচ্ছিস না। এর মানে ডেফিনেটলি মিথ্যা বলছিস।”
” আমি কোনো মিথ্যা বলছি না।”
” রিয়াসাতের এক্সিডেন্ট কিভাবে হলো?”
উষসী উশখুশ করে বলল,” ড্রাইভিং এর সময় গাছের সাথে বারি খেয়েছিল।”
” মগা পেয়েছিস আমাকে? ইয়ামিন মেরেছে তাই না? এই ওয়েট, ইয়ামিন কি এখন পুলিশ স্টেশনে?”
উষসী জবাব দেওয়ার আগেই আহমেদ ডাকল,” হয়ে গেছে আপামণিরা। আসুন।”
প্রিয়ন্তি কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উষসী সেই ধারালো দৃষ্টি উপেক্ষা করে গাড়িতে গিয়ে বসল। প্রিয়ন্তিও এলো। উত্তোরত্তর প্রশ্ন করে মাথা খেয়ে ফেলতে লাগল সে। উষসী জবাব দিল না একটা প্রশ্নেরও। নখে কামড় দিয়ে সে কাঁদছিল কেবল। হাসপাতালে পৌঁছানোর পর জানা গেল রিয়াসাতের জ্ঞান ফিরেছে। একজন সার্জন্ট ছিলেন সেখানে। তিনি রিয়াসাতের স্টেটমেন্ট নিচ্ছেন। উষসী সেখানে ঢুকে গেল।
রিয়াসাত বলছে,” উনি সম্পর্কে আমার কাজিন হোন।”
সার্জন্ট বলছেন,” তাহলে আপনাকে এমন বীভৎসভাবে মারল কেন?”
তারা ইংরেজিতে কথোপকথন চালাচ্ছে। এই পর্যায় উষসী বলল,” উনি অসুস্থ অফিসার। এই অবস্থায় আপনি স্টেটমেন্ট নিচ্ছেন কিভাবে?”
সার্জন্ট বিরক্ত হয়ে বললেন,” ডন্ট ইন্টারফেয়ার। আমি ডাক্তারের থেকে অনুমতি নিয়েই এসেছি। আমাকে আমার কাজ করতে দিন। আপনি বাইরে যান।”
” কেন? আমি এখানে থাকলে কি সমস্যা? আমি প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম।”
” আচ্ছা, থাকুন।”
তারপর সার্জন্ট রিয়াসাতের উদ্দেশ্যে বললেন,” উনার সাথে আপনার কি ঝামেলা ছিল?”
রিয়াসাত কোনো জবাব দেওয়ার আগেই উষসী তড়িঘড়ি করে বলল,” বেশ কিছুদিন ধরেই ও আমাকে ডিস্টার্ব করছিল। সেজন্য মার খেয়েছে। ইট ওয়াজ ভ্যালিড।”
সার্জন্ট অবাক হয়ে বললেন,” আপনিই না ইয়ামিন ইব্রাহীমকে অ্যারেস্ট করতে বলেছিলেন? ”
” হ্যাঁ বলেছি। কারণ আমি ওর অবস্থা দেখে ভ*য় পেয়ে গেছিলাম। অথচ দোষ দু’জনেরই ছিল। কিন্তু ওর দোষ বেশি। আর ইয়ামিন ইব্রাহীম আমাকে হেল্প করছিল।”
” যে আপনাকে হেল্প করছিল তাকেই আপনি অ্যারেস্ট করিয়েছেন? স্ট্রেইঞ্জ!” অফিসার দ্বিতীয় দফায় অবাক হলেন।
উষসী অস্পষ্ট গলায় বলল,” তখন আমার মাথা কাজ করেনি। আই ওয়াজ ইন ট্রমা।”
” এখন এটা বললে তো হবে না।”
“কেন হবে না? এটাই সত্যি। রিয়াসাত, স্যায় সামথিং প্লিজ। টেল দ্যা ট্রুথ।”
উষসী কটমট করে তাকাল। রিয়াসাত মাথা নেড়ে বলল,” জ্বী অফিসার৷ উনি আমাকে ইনটেনশনালি মা-রেনি। আমাদের মধ্যে লড়াই হয়েছিল।”
” তাহলে কি আপনি উনার এগেইন্সটে কোনো রিপোর্ট করবেন না?”
রিয়াসাত একবার আঁড়চোখে উষুর দিকে তাকাল। এখনও রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে উষসী৷ রিয়াসাত বলল,” না, করব না।”
” ওকে, ফাইন। গেট ওয়েল সুন।”
সার্জন্ট উঠে দাঁড়ালেন। তিনি চলে যাচ্ছেন। উষসী তার পিছু যেতে নিলেই রিয়াসাত ডাকল,” শোনো।”
” কি?”
” তোমার কথামতো ইয়ামিন ভাইয়ের এগেন্সটে কিছু বলিনি। এখন আমি কি পাবো?”
উষসী দাঁত কিড়মিড় করে বলল,” তুমি সত্যি কথা বলেছো। মিথ্যা তো কিছু বলোনি। তাহলে এখানে পাওয়ার প্রসঙ্গ আসছে কেন?”
” কারণ আমি চাইলেই মিথ্যা বলতে পারতাম৷ আর পুলিশ সেটা অবশ্যই বিশ্বাস করতেন। যেহেতু আমি ভিক্টিম? তো বলা যায় আমি তোমাকে হেল্প করেছি। আমাদের সম্পর্কটা গিভ এন্ড টেক এর সম্পর্ক। আমি তোমাকে কিছু দিলে তুমিও আমাকে দিতে বাধ্য।”
উষসী ধারালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে যেতে নিলেই রিয়াসাত তার হাত চেপে ধরল,” অন্তত কথার জবাব দিয়ে যাও!”
উষসী জবাব দিল না। রিয়াসাতের ভাঙা হাত শক্ত করে মুচড়ে দিল। হাতের ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল রিয়াসাত। উষসী বলল,” তোমার জীবন যে বাঁচিয়েছি সেটাই অনেক। ওখানে ফেলে রেখে আসলে এতোক্ষণে ম’রে ভূত হয়ে থাকতে।”
উষসী রিয়াসাতকে ছেড়ে বের হয়ে এলো।প্রিয়ন্তিরা ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। এতোক্ষণে নিশ্চয়ই সব জেনে গেছে তারা। বাইরে এসেই সার্জন্ট অফিসারকে প্রশ্ন করল উষসী,” স্যার, উনাকে কখন ডিসচার্জ করা হবে?”
সার্জন্ট সন্দেহভরা দৃষ্টিতে তাকালেন,” আপনার হাব-ভাব কিছুই সুবিধার লাগছে না আমার। প্রথমে অ্যারেস্ট করানোর জন্য পাগল হয়ে গেছিলেন। আর এখন ডিসচার্জ করানোর জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছেন। আসল ঘটনাটা কি?”
“আসল ঘটনা কি সেটা আমি অলরেডি বলেছি ভেতরে।”
” কিন্তু আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।”
” আশ্চর্য, এখন আপনাকে বিশ্বাস করানোর জন্য আমি কি করব?”
” ইয়ামিন ইব্রাহীম আপনার কি হোন?”
উষসী ইতস্তত করে বলল,” সেটা জেনে আপনার কি কাজ?”
” আমার জানা দরকার, বলুন।”
” আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয় হয় উনি।”
” আর কিছু না?” সার্জন্টের দৃষ্টিতে কৌতুহল।
উষসী শ্রাগ করে বলল,” আর কি হবে?”
অফিসার মৃদু হেসে বললেন,” উনি কিন্তু বলেছিলেন আপনি উনার গার্লফ্রেন্ড।”
উষসী রেগে বলল,” সেরকম কিছুই না।”
সার্জন্ট এবার হেসে ফেললেন। তিনি যা বোঝার বুঝে নিয়েছেন। প্রিয়ন্তি সামনে এসে দাঁড়ালো। সব জেনে সে অস্থিরবোধ করছে।
” অফিসার, আমার ভাইকে কখন ছাড়া হবে?” উতলা গলায় জানতে চায় প্রিয়ন্তি।
সার্জন্ট শান্ত গলায় বললেন,” একজনকে আমার সাথে যেতে হবে।”
আহমেদ বলল,” আমি আসছি।”
সার্জন্ট উষসীর দিকে চেয়ে বললেন,” আপনিও আসুন।”
উষসী আর আহমেদ বের হলো। প্রিয়ন্তি তাদের পেছনে এসে উষসীর হাত ধরে বলল,” তুই ইয়ামিনের নামে রিপোর্ট করেছিস?”
উষসী সেই কথার জবাব না দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল,” শিমলা আন্টিকে কিছু জানিয়ো না। শুধু শুধু অস্থির হবেন। আমি যাচ্ছি। উনাকে দ্রুতই ছেড়ে দিবে।”
প্রিয়ন্তি কিছু বুঝতে পারছে না। কি হচ্ছে এসব? কেনই বা হচ্ছে? দুশ্চিন্তায় তার মাথা ঝিমঝিম করছে। সে রিয়াসাতের কেবিনে যেতে লাগল। এখন সে ছাড়া প্রশ্ন করার মতো আর কেউ নেই।
ইয়ামিন মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মধ্যে কোনো হেল-দোল নেই। যেন প্রাণহীন কোনো জড়সত্ত্বা। একটু পর সেকেন্ড ল্যাফটেন্যান্ট নিজে এসে লকাপ খুলে বললেন,” আপনাকে ডিসচার্জ করা হয়েছে। বাইরে আসুন।”
ইয়ামিন মাথা তুলে তাকাল। ভ্রু কুঁচকে শুধাল,” কে এসেছে?”
” বাইরে গেলেই দেখবেন।”
ইয়ামিন কৌতুহল নিয়ে বের হলো। উষসী আর আহমেদ বসে আছে। তাদের দেখে ইয়ামিনের ভ্রু প্রসারিত হলো।উষসী আসবে এটা সে জানতো। কিন্তু এতো দ্রুত যে চলে আসবে সেটা ভাবেনি!
ইয়ামিনকে ডিসচার্জ করাতে পাঁচশ সুইস ফ্রাংকের প্রয়োজন হলো। যা বাংলাদেশী টাকায় প্রায় ষাটহাজার টাকার সমতুল্য। উষসী নিজের পকেট থেকেই টাকাটা দেয়। ইয়ামিনকে একটা ফাইলে সাইন করতে বলা হয়। কোনো কথা না বলেই সাইন করে দেয় সে।
রিয়াসাতের ভ্যান বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল। সেটা ছেড়ে দেওয়া হয়। আহমেদ আর উষসী সার্জন্টের গাড়িতে করে এসেছিল। এবার তারা ফিরে যাওয়ার জন্য ভ্যানে ওঠে। ইয়ামিন এতোক্ষণ একটাও কথা বলেনি। উষসী চুপচাপ নিজের হাতে কফি বানিয়ে ইয়ামিনের সামনে এনে রাখল। আহমেদ ড্রাইভ করছে। ইয়ামিনের মাথা ব্যথা করছিল। সে কফি দেখে অবাক হয়ে তাকাল। উষসী চলে যেতে নিলেই ডাকল,” শোনো।”
উষসী থেমে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো জবাব দিল না। ইয়ামিন তার পাশের জায়গাটা ইশারা করে বলল,” বসো এখানে।”
উষসী বসল না। দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,” আপনার যা বলার বলুন। আমি শুনছি।”
” এসব কেন করলে?”
” আপনার জন্য করিনি। শিমলা আন্টির জন্য করেছি। তিনি আপনার চিন্তায় অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। ভালো হয় একবার ফোন করে উনার সাথে কথা বলে নিন।”
” বলব।”
উষসী খুব অস্বস্তি নিয়ে বলল,” আপনার কপাল কেটে র-ক্ত পড়ছে। ভালো হয় যদি ব্যান্ডেজ করে নেন।”
এই কথা বলেই উষসী ফার্স্ট এইড বক্সটা তার সামনে রাখল। ভ্যানে সবকিছুই মজুদ আছে। ছোট-খাটো একটা ঘর বলা যায়। চলন্ত ঘর। ইয়ামিন মৃদু হেসে বলল,” আমার কপালে তো আমি দেখব না। তুমি করে দিচ্ছো না কেন?”
” আমার এতো দায় পড়েনি।” কঠিন গলায় এই কথা বলেই উষসী চলে যায়।
ইয়ামিন হাসিমুখে কফিতে চুমুক দিল। একটু পর উষসী ফিরে এসে বক্সটা খোলে। তুলোয় স্যাভলন নিয়ে প্রথমে কপালে ঘঁষে র-ক্তটা পরিষ্কার করে নেয়। তারপর ব্যান্ডেজ লাগায়। হঠাৎ ইয়ামিনের গা গরম অনুভূত হতেই সে ভয় পেয়ে কপালে হাত ছোঁয়ায়। বিচলিত হয়ে ওঠে।
ইয়ামিন শান্ত গলায় বলল,” ভয় নেই। সামান্য কোল্ড ফিভার। সবারই হয়।”
উষসী কণ্ঠে ঝাঁজ নিয়ে বলল,” আমি ভ*য় পাচ্ছি এই কথা আপনাকে কে বলল?”
ইয়ামিন হেসে দেয়। উষসী রাগে গজগজ করে উঠল,” খবরদার হাসবেন না। লজ্জা লাগা উচিৎ আপনার।”
” তুমি কি আর কিছুই জানতে চাও না? এভাবেই মেজাজ দেখাতে থাকবে?”
” আপনাকে যে এখনও আমি খু’ন করে ফেলছি না সেটাই আপনার ভাগ্য।”
তেজ নিয়ে এই কথা বলে উষসী থামল। তারপর হঠাৎ বলল,” আমার আপু আপনার কি ক্ষতি করেছিল? কেন করলেন তার সাথে এমন? সে আপনাকে রিজেক্ট করেছিল বলে রিভেঞ্জ নিয়েছেন?”
ইয়ামিন নির্ণিমেষ তার চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলল,” আমাকে দেখে তোমার মনে হয় যে আমি রিভেঞ্জ নিতে এসব করতে পারি?”
” তাহলে কেন করেছেন? সেটাই জানতে চাইছি আমি। সত্যিটা কি?”
তারা একে-অপরের দিকে চেয়ে রইল। কেউই কোনো কথা বলছে না। হঠাৎ উষসী কাঁদতে শুরু করল। ইয়ামিন তার হাত ধরে টেনে তাকে নিজের পাশে বসালো। কাঁধে হাত বুলিয়ে বলল,” আ’ম স্যরি উষসী। কেঁদো না প্লিজ।”
উষসী ঝারি মেরে বলল,” ধরবেন না আমাকে৷ ডন্ট টাচ মি।”
ইয়ামিন হাত সরিয়ে বলল,” ওকে। ধরছি না।”
উষসী চোখ-মুখ কুঁচকে মুখে হাত ঠেঁকিয়ে বলল,” আপনি একটা নোংরা মানুষ। আমার দেখা সবচেয়ে নোংরা মানুষ আপনি।”
তারপর আকুতির স্বরে আবার বলল,” সুযোগ পেলে আমার সাথেও কি এমনই করতেন?”
ইয়ামিন ধমকের স্বরে বলল,” এটা কেমন প্রশ্ন?”
উষসী তাচ্ছিল্য হেসে বলল,” করতেই পারেন আপনি৷ কারণ আপনার আর রিয়াসাতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। আপনাদের মতো মানুষ কাউকে ভালোবাসতেই পারে না।”
” বেশি বলে ফেলছো এবার।”
” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলুন। সত্য বলুন যে আপনার কোনো দোষ নেই। আপনি নির্দোষ ছিলেন। প্লিজ, একবার বলুন শুধু। প্লিজ!”
উষসীর গলায় মিনতির সুর। সে কাঁদছে অবুঝের মতো। ইয়ামিন নির্জীব গলায় বলল,” ভালো হয় যদি এই ব্যাপারে তুমি তোমার আপুকেই জিজ্ঞেস করো। সে যদি বলে আমি দোষী তাহলে আমি সত্যি দোষী। আর সে যদি বলে আমি নির্দোষ তাহলে সেটাই ঠিক। ”
” আপনার নিজের কি কিছুই বলার নেই আমাকে?”
ইয়ামিন নিরাশ কণ্ঠে বলল,” না।”
উষসীর কান্না তখনও থামেনি। আরও বেড়ে গেল। সে পুরোপুরি আশাহত এবার। ইয়ামিন নিজের কাছেই নিজে অপরাধী। আর কিছু বুঝতে বাকি নেই তার। ইয়ামিন ভেজা কণ্ঠে বলল,” আই লভ ইউ উষসী। আমার ভালোবাসায় কোনো মিথ্যা ছিল না। শুধু এইটুকু বিশ্বাস করো।”
” আই ডন্ট ট্রাস্ট ইউ এনিমোর।”
” আমার দিকে তাকিয়ে বলো, ভালোবাসোনি আমাকে তুমি? এতো সহজে ভুলে যেতে পারবে সবকিছু? ”
উষসী কাতর দৃষ্টিতে তাকাল। ইয়ামিন আচমকা কাছে এসে তার ঠোঁটে গভীর, গাঢ়, প্রলম্বিত চুমু আঁকল। এমন অপ্রত্যাশিত কান্ডে হতবিহ্বল হয়ে গেল উষসী। কয়েক মুহূর্ত লাগল তার ব্যাপারটা বুঝতে। আগুনের ফুলকির মতো তেজ নিয়ে বলে উঠল,” এটা কি করলেন?”
ইয়ামিন বিগলিত স্বরে বলল,” তোমার কান্না থামছিলই না।”
উষসী ক্রোধে উন্মত্ত গলায় বলল,” কান্না থামানোর জন্য আপনি সবাইকেই এভাবে কিস করেন নাকি?”
তারপর কিড়মিড় করে বলল,” অসভ্য! ”
সে রেগে উঠে যেতে নিলেই খোলা ড্রয়ারের সাথে বারি খেয়ে আবার বসে পড়ল। পায়ে ভীষণ ব্যথা পেয়ে আর্তনাদ করে উঠল। ইয়ামিন উদগ্রীব হয়ে বলল,” দেখি…”
” খবরদার।”
উষসী পা সরিয়ে নিল। এমন সময় আহমেদ বলল,” আমরা পৌঁছে গেছি।”
উষসী কষ্ট করে উঠে দাঁড়াল। খুঁড়িয়ে হাঁটতে নিয়ে বলল,” আপনি যান। আমি আসছি।”
কে শোনে কার কথা? ইয়ামিন ফট করে উষসীকে কোলে তুলে নিল। বিস্ময়ে চোখ বড় করে চাইল উষসী। ডাঙায় তোলা মাছের ছটফট করে বলল,” আমাকে নিচে নামান।”
ইয়ামিন জবাব না দিয়ে তাকে নিয়েই ভ্যান থেকে নেমে এলো। তাদের এই অবস্থায় দেখে আহমেদের চোখ কোটরাগত হওয়ার উপক্রম। সে বিচলিত স্বরে বলল,” আরে, উষসী আপামণির কি হয়েছে?”
ইয়ামিন বলল,” তেমন কিছু না। পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে গেছে মনে হয়। এক্স-রে করাতে হবে।”
” আমার পায়ে কিছুই হয়নি।” গর্জে উঠল উষসী।
লিফটে ওঠার সময় তাকে কোল থেকে নামিয়ে দেয় ইয়ামিন। বের হওয়ার সময় আবার কোলে নিতে এলেই উষসী ধাক্কা মেরে বলল,” আমি নিজেই পারব এবার।”
প্রিয়ন্তি রিয়াসাতের কেবিনে দাঁড়িয়ে ছিল। সে ভীষণ ক্লান্ত। ইয়ামিনকে দেখেই এগিয়ে এসে বলল,” ভাই, ঠিকাছিস তুই?”
” ঠিকাছি আমি৷ রিয়াসাতের কি অবস্থা?”
” ভালো। উষুকে খুঁজছিল ও।”
উষসী এই কথা শুনে কেবিনের দিকে গেল। ইয়ামিনও যেতে নিলে প্রিয়ন্তি তাকে থামিয়ে বলল,” শোন, কথা আছে তোর সাথে। কি হয়েছিল আমাকে ডিটেলস বল।”
” পরে বলছি।”
রিয়াসাত আরাম করে বসে আছে সিঙ্গেল বিছানায়। উষসীকে দেখেই ঠোঁটভরা হাসি নিয়ে বলল,” হায় উষু, কেমন আছো? ইয়ামিন ভাইকে ছেড়েছে?”
” হুম। তুমি আমাকে খুঁজছিলে কেন?” গম্ভীর গলায় জানতে চায় উষসী।
” আমার ভ্যানটা সিস্ট করে নিয়ে গেছিল শা’লারা। ওটাই আমার একমাত্র সম্বল ছিল।”
” চিন্তার কিছু নেই। আমি ছাড়িয়ে এনেছি।”
রিয়াসাত কৃতজ্ঞভরা দৃষ্টিতে বলল,” থ্যাঙ্কিউ।”
উষসী কাছে এসে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো। কপাল কুঁচকে বলল,” আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করব। সত্যি কথা বলবে রিয়াসাত?”
” নিশ্চয়ই, বলো।”
” তুমি ওই ভিডিওর ব্যাপারে কিভাবে জেনেছো?”
রিয়াসাত অপ্রস্তুত হয়ে গেল। উষসী পাথরের মতো কঠিন মুখে বলল,” খবরদার মিথ্যা বলবে না। আমি সত্যি শুনতে চাই।”
” আরিশা আপু।”
” কে এই আরিশা?”
” ইয়ামিন ভাইয়ের কলেজ ফ্রেন্ড।”
” ওর কাছে এই ভিডিও কিভাবে এলো?”
” আই সুয়্যার… আমি জানি না।”
” তুমি কি শিউর যে ওই ভিডিও ইয়ামিন শ্যুট করেছে?”
” আমাকে সেরকমই বলা হয়েছে। সত্যি কি-না আমি জানি না।”
উষসী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,” ঠিকাছে। গেট ওয়েল সুন।”
সে যেতে নিলেই রিয়াসাত ডেকে বলল,” উষু শোনো, আই এম স্যরি।”
” কিসের জন্য স্যরি?”
” সবকিছুর জন্য। তোমাকে যথেষ্ট জ্বালিয়েছি আমি। তুমি চাইলেই আজ প্রতিশোধ নিতে পারতে। কিন্তু উল্টা আমাকে বাঁচিয়েছো।”
” গুড। অবশেষে তোমার বোধদয় হয়েছে। জেনে খুশি হলাম।”
” দুইবছর আগে ইয়ামিন ইব্রাহীম সেজে তোমাকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য আমি খুব লজ্জিত। কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর দিবে প্লিজ? তুমি কি শুধু আমার নকল কণ্ঠকেই ভালোবেসেছিলে? কোথাও কি আমার জন্য এতোটুকু ফিলিংস ছিল না?”
” এই সবকিছুর জন্য যদি তুমি অনুতপ্ত হয়ে ঠিক এভাবে ক্ষমা চাইতে সেদিন… তাহলে হয়তো আমি মাফ করতে পারতাম। কিন্তু এরপর তুমি আমাকে থ্রেট করেছো।এজন্য তোমাকে কখনও মাফ করতে পারব না আমি, স্যরি।”
উষসী কাঁচের দরজা ঠেলে বের হতেই দেখল ইয়ামিন দাঁড়িয়ে আছে সামনে। ভ*য়ে একটু থতমত খেল উষসী। ইয়ামিনের মুখে ছোটখাটো হাঁ। সে ভীষণ বিস্মিত হয়ে তাকিয়ে আছে। উষসী ভ্রু কুঁচকে বলল,” কি?”
ইয়ামিন অবাক স্বরে শুধাল,” তার মানে ওটা আমি ছিলাম?”
” মানে?”
” তুমি বলেছিলে ইউভান শেখ। কিন্তু রিয়াসাত এই মাত্র বলল আমার নাম। কোনটা সত্যি?”
উষসী বিব্রত হয়ে পড়ল। ইয়ামিন তাহলে সব শুনেছে এতোক্ষণ! সে জবাব না দিয়ে চলে যেতে নিলেই তার হাত চেপে ধরল ইয়ামিন। জানতে চাইল,” মিথ্যা কেন বলেছিলে?”
” এমনি।”
ইয়ামিন হেসে বলল,” এতোদিন শুধু শুধুই তাহলে ইউভান ভাইয়ের উপর জেলাস হচ্ছিলাম আমি। শিট!”
উষসী তীক্ষ্ণ গলায় বলল,” এতো খুশি হওয়ার কিছু নেই। ওটা কোনো ভালোবাসা ছিল না।”
” কিন্তু এখন তো ভালোবাসা আছে!”
” নেই।”
” আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলো।”
উষসী তাকাতে পারল না। হাত ছাড়িয়ে চলে যেতে লাগল। ইয়ামিন হেসে ফেলল। উষসীর ভীষণ লজ্জা লাগছে। তার মান-সম্মানের দফা-রফা হয়ে গেছে। রিয়াসাত আর ক্ষমা চাওয়ার সময় পেল না? ধূর, ধূর!
চলবে
#উষসী_হাসবে_বলে (২০)
লিখা- Sidratul Muntaz
স্নিগ্ধ সকাল। একটা নতুন দিনের শুরু। নতুন জীবনে পদার্পণের আখ্যান। খামারবাড়ির ঠিক সামনেই একটা কাঁচঘর সাজানো হয়েছে। বিভিন্ন ফুল দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে ঘরটি। সন্ধ্যায় এখানেই বিয়ের আসর বসবে। বরযাত্রী আসবে।
কানাডা থেকে প্রিয়ন্তির কিছু বন্ধু-বান্ধব এসেছে। তাদের সাথে আড্ডায় মজেছে ইয়ামিন। তারা নাকি মূলত ইয়ামিন ইব্রাহীমের সাথে দেখা করতেই সুইজারল্যান্ড এসেছিল। বিয়ের বাহানায় দেখা হয়ে গেল। এতোদিন সবকিছু কেমন ম্যাড়মেড়ে লাগছিল উষসীর কাছে। আজ এতো হট্টগোল দেখে মনে হচ্ছে বিয়ে বাড়ির পরিবেশ।
জুরিখ থেকে যে শেফ আসার কথা ছিল তিনি এসেছেন। অথচ তার রান্না করা কোনো রেসিপিই মিসেস শিমলা পছন্দ করছেন না। কারণে-অকারণে তিনি ধমকাচ্ছেন শেফকে। সকাল থেকে তার মেজাজ বেজায় খারাপ।
একজন বিউটিশিয়ান এসেছে জেনেভা থেকে। প্রিয়ন্তির পরিচিত। সে আপাতত প্রিয়ন্তিকে বডি ম্যাসাজ দিচ্ছে।উষসী আহমেদকে খুঁজছে। সে তৃষ্ণাকে নিয়ে স্কেটিং-এ গিয়েছিল। এখনও ফেরেনি। এদিকে উপরে লাইট লাগানোর জন্য কোনো ছেলে মানুষ দরকার।
ডেকোরেশন এর জন্য যে লোকদের আনা হয়েছিল তাদের ভাগিয়ে দিয়েছেন মিসেস শিমলা। তিনি নাকি নিজেই অনেক ভালো ডেকোরেশন করবেন। অথচ এখন তাঁর পাত্তা নেই। উষসী কষ্ট করে চেয়ারে উঠে তার উপর টুল রেখে মরিচবাতি লাগানোর চেষ্টা করছে।
” হেল্প লাগবে?”
প্রাণবন্ত,ভরাট কণ্ঠ শুনে উষসী নিচে তাকায়। ইয়ামিন হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে নেভি ব্লু জ্যাকেট। ঠোঁটে চাপা হাসি। দেখে মনে হচ্ছে সে উষসীর অবস্থায় বেশ মজা পাচ্ছে।
তাকে দেখতে নিয়ে উষসী বেসামাল হয়ে যায়। পা পিছলে প্রায় পড়ে যেতেই নিচ্ছিল। ইয়ামিন ক্ষীপ্রবেগে এসে চেয়ার আর টুল চেপে ধরায় ব্যালেন্স রক্ষা হয়। উষসী বেঁচে গিয়ে হাঁফ ছাড়ে।
” থ্যাংকস। ”
” নেমে এসো। আমি করছি।”
” কোনো দরকার নেই। সুপারস্টারদের এসব ছোট-খাটো কাজ মানায় না। তাছাড়া আপনার এমনিতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে। এই যেমন… সুন্দরী মেয়েদের সাথে আড্ডা দেওয়া!”
গম্ভীর মুখে খোঁচা মেরে উষসী কাজে মনোযোগ দেয়। ইয়ামিন মাড়িতে জীভ ঠেকিয়ে হাসে। ফোঁড়ন কেটে বলল,” এত্তো পজেসিভনেস! বিশ্বাস করো, তুমি এমন রাগবে জানলে আমি ওদের সাথে কথাই বলতাম না।”
” আমি রাগ করার কে? আপনি যাকে খুশি গান শোনাতেই পারেন। দ্যাট ইজ নান অফ মাই বিজনেস। তাছাড়া আমাদের ব্রেকাপ হয়ে গেছে। ভুলে গেছেন?”
” মানে? আমাদের ব্রেকাপ কবে হলো? আমি তো এই ব্যাপারে কিছুই জানি না!”
“সবকিছু আপনাকে জানিয়ে করতে হবে নাকি?”
উষসী ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসল। তার কণ্ঠ দায়সারা। ইয়ামিন কপাল গুটিয়ে নিল। যে টুলে ভর দিয়ে উষসী দাঁড়িয়ে আছে সেটি ধরে ঝাঁকাতে লাগল হঠাৎ। ভ*য়ে উষসীর আত্মা ছোট হয়ে গেল। সে ছটফট করে উঠল,” আরে কি করছেন? পড়ে যাবো তো!”
” আগে বলো ব্রেকাপ কিভাবে হলো? নাহলে সত্যি ফেলে দিবো।”
” আপনি কি আমাকে থ্রেট করছেন?”
” হ্যাঁ। ” ইয়ামিনের অকপট জবাব।
উষসী কিড়মিড় করে বলল,” দেখুন, ফাজলামি করবেন না। আগে আমি নেমে আসি তারপর এই বিষয়ে কথা বলবো।”
” উহুম। ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই জবাব দিবে তুমি। নাহলে আমি নামতেই দিবো না।”
উষসী চোখ বড় করল। কড়া গলায় বলল,” কত বড় অসভ্য আপনি! এসব করে কোনো লাভ নেই বুঝেছেন? ব্রেকাপ মানে ব্রেকাপ।”
ইয়ামিন টুল ধরে খুব জোরে ধাক্কা দিল এবার। উষসীর পা পিছলে গেল। সে ছিটকে এসে ঠিক ইয়ামিনের গায়ের উপরেই পড়ল। আর তাকে নিয়ে ইয়ামিন সোজা নিচে। দু’জনেই ব্যথা পেল। কিন্তু ইয়ামিন উষসীকে দুই হাতে আগলে ধরে রাখায় সে একটু কম ব্যথা পেয়েছে।
উষসী রেগে ইয়ামিনের বুকে উত্তরোত্তর ঘুঁষি মারতে লাগল। খটমট করে বলল,” এটা কেন করলেন?”
ইয়ামিন তার হাত দু’টো চেপে ধরে স্পষ্ট গলায় বলল,” তুমি আমার কনসেন্ট ছাড়া ব্রেকাপের ডিসিশন নিতে পারো না। আমি মানবো না।”
” আপনার মানা-মানিতে কিছু যায়-আসে না আমার। বুঝেছেন? আমার ব্রেকাপের পেছনে ভ্যালিড রিজন আছে।”
” আচ্ছা? কি সেই রিজন শুনি?”
উষসী চোখ কুটি করে বলল,” আপনি আমাকে সত্যি বলেননি।”
” কোন সত্যি? যেটা তোমার আপুর বলার কথা?”
” আপু কেন বলবে? দোষ আপনার। তাই এক্সপ্লানেশন আপনি দিবেন।”
ইয়ামিন রাশভারী গলায় জানতে চাইল,” আমি বললেই কি তুমি সব বিশ্বাস করবে?”
উষসী অবাক হয়ে বলল,” কেন করব না? একবার বলেই দেখুন বিশ্বাস করি কি-না!”
ইয়ামিন তাচ্ছিল্য হাসল। অভিমান পূর্ণ কণ্ঠে বলল,” আমার উপর এতো বিশ্বাস থাকলে কাল রিয়াসাতের সাথে দেখা করতে যেতে না!”
উষসী নিশ্চুপ হয়ে গেল। সত্যিই ইয়ামিনকে বিশ্বাস করেনি সে। কিংবা হয়তো রিয়াসাতের ছলে প্রভাবিত হয়েছিল। কয়েক মুহূর্তের নীরবতা। তারা তাকিয়ে আছে একে-অপরের দিকে।
“এসব কি? তোমরা কি করছো?”
মিসেস শিমলা হতভম্ব। ইয়ামিন নিচে শুয়ে আছে। উষসী তার উপরে উঠে আছে। এই দৃশ্য দেখে তিনি রীতিমতো বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌঁছে গেছেন।
উষসী লজ্জা পেয়ে দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে গেল। ইয়ামিন শোয়া থেকে উঠে বসল। হাঁটুর উপর হাত রেখে বলল,”ও পড়ে যাচ্ছিল মা। আমি না ধরলে কোমর ভাঙতো আজকে।”
” সেকি! পড়লে কিভাবে উষু?”
উষসী লজ্জিত কণ্ঠে বলল,” পা পিছলে গেছিল আন্টি।”
” এতো উঁচুতে তোমাকে উঠতে কে বলেছিল? যদি একটা দূর্ঘটনা ঘটতো? এমনিতেও ফাঁড়া লেগে আছে একটার পর একটা।”
” কোনো সমস্যা নেই আন্টি৷ এইতো আমার হয়েই গেছে।”
” না, না, তোমাকে আর উঠতে হবে না। ইয়ামিন, তুই কি করছিস জিরাফের মতো শরীরটা নিয়ে? নিজে উঠে একটু লাইটটা লাগিয়ে দিতে পারলি না?”
ইয়ামিন মুখ গম্ভীর করে বলল,” আমাকে সেই সুযোগ দিতে হবে তো। ও নিজেই পাকামি করছিল।”
উষসী বলল,” আমি আসলে আপনার মতো ব্যস্ত মানুষকে ডিস্টার্ব করতে চাইনি।”
শিমলা মুচকি হেসে বললেন,” তোমাদের দায়িত্ব দেওয়া হলো। দু’জন মিলে কাজটা কমপ্লিট করো এবার। আমি রান্না দেখে আসছি।”
এই কথা বলেই তিনি চলে গেলেন। ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। মা কি কিছু বুঝতে পেরে গেছে? উষসী খেঁকিয়ে উঠল,” দাঁড়িয়ে আছেন কেন? উঠুন এবার।”
ইয়ামিন উষসীর দিকে একপলক তাকাল। তারপর শব্দ করে টুলটা নিচে ফেলে দিল। উষসী থতমত খেয়ে কেঁপে উঠল। বিড়বিড় করে বলল,” অভদ্র!”
ইয়ামিন চেয়ারে উঠে দাঁড়াল। কাজে মনোনিবেশ করতেই নিচ থেকে চেয়ার ধরে টানতে লাগল উষসী। তার উদ্দেশ্য ইয়ামিনকে ফেলে দেওয়া। কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও চেয়ার এতোটুকু নাড়াতে পারল না সে। অগত্যা নিজেই হাঁপিয়ে উঠল। হার মেনে মিনমিন করে বলল,” উফ, মানুষ নাকি জলহস্তী?”
ইয়ামিন বলল,” শুধু শুধু এনার্জী ওয়েস্ট করছো। লাভ নেই।”
সন্ধ্যা নামার আগেই মেহমানে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল বাড়ি। প্রিয়ন্তির ননাশের দুই মেয়ে আরিশা আর ফারিশা যথেষ্ট চেঁচামেচি করে পরিবেশ মাতিয়ে রাখছে। এতো মানুষ দেখে তৃষ্ণা বরাবরই খুব বিরক্ত। তার নিজের বাড়িতে একা থাকার অভ্যাস।
উষসীর ঘরে গিয়ে আইপ্যাড নিয়ে বসেছে তৃষ্ণা৷ এতো হৈচৈ তার ভালো লাগছে না। একটু পর ফারিশাও সেখানে পৌঁছে গেল। কোমরে হাত গুঁজে বলল,” এই ছেলে, আমাদের সাথে খেলো।”
তৃষ্ণা বিরক্ত ভঙ্গিতে তাকাল। ত্যক্ত গলায় বলল,” তুমি এইখানে কেন এসেছো? তোমার এইখানে কি কাজ?”
ফারিশা পাল্টা প্রশ্ন করল” তুমি এইখানে কেন বসে আছো? তোমার এইখানে কি কাজ?”
তৃষ্ণা কপাল কুঁচকে ভারী শ্বাস নিয়ে বলল,” উফ!”
সে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে নিলেই ফারিশা হাত চেপে ধরল। টানতে টানতে বলল,” এদিকে আসো।”
” আসব না।”
” আপু, আপু, ছেলেটাকে ধরেছি। এইবার আসো।”
তৃষ্ণা দেখল দরজার আড়াল থেকে বের হয়ে এলো আরেকজন। তার হাতে লিপস্টিক। তৃষ্ণার দিকে চেয়ে সে খিকখিক করে হাসল।
তৃষ্ণা ভীত গলায় বলল,” এই মেয়ে, তোমার সমস্যা কি? এইভাবে হাসছো কেন?”
ফারিশা পেছন থেকে তৃষ্ণার হাত চেপে ধরল। সামনে থেকে আরিশা তার ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে দিল। তৃষ্ণার মন চাইল কষিয়ে দু’জনকে দু’টো চ*ড় মারে। কিন্তু মা’রল না। বাবা বলেছে মেয়ে মানুষের গায়ে কখনও হাত তুলতে হয় না!
প্রিয়ন্তি আর ফারদিনের রুস্মাত হচ্ছে। তাদের সামনে দু’টো ছোট আয়না রাখা। পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন প্রিয়ন্তির বড় ননাশ। তিনি জিজ্ঞেস করলেন,” আয়নাতে কি দেখো?”
ফারদিন হাসি মুখে বলল,” আমার আকাশের একমাত্র চাঁদ।”
প্রিয়ন্তির মুখ লজ্জায় জমে যায়। এবার উষসী বলল,” তুমি কি দেখো আপু?”
” আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ পুরুষ।”
সবাই হাত-তালি দেয়। ফারদিন প্রিয়ন্তির দিকে তাকায়। ফিসফিস করে বলল,” সত্যি প্রিয়তমা?”
” উহুম। মিথ্যা বলেছি। আমার জীবনে শ্রেষ্ঠ পুরুষ একজনই। আমার বাবা।”
” তাহলে আমি কি?”
” তুমি বাবার পরে।”
” থ্যাংক গড যে আর কেউ নেই।”
প্রিয়ন্তি হেসে ওঠে। বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা মিটে যেতেই শুরু হয় বিনোদন উৎসব। কিছু ব্যান্ড পার্টি ভাড়া করা হয়েছিল। তারা অবিরত মিউজিক বাজাচ্ছে। বিদেশী নাচের কিছু মেয়ে এসেছে। তারা হলুদ পোশাক পরে নেচে যাচ্ছে। যা দেখে অতিথিদের রীতিমতো ঘুম পাচ্ছে। অবশেষে ইয়ামিনকে অনুরোধ করা হয় গান গাইতে। তার একটি গানেই মেতে ওঠে পরিবেশ।
Bekarar karke hamein yun na jaaiye
Aapko hamari kasam laut aaiye
Bekarar karke hamein yun na jaaiye
Aapko hamari kasam laut aaiye
Dekhiye woh kaali kaali badaliyan
Zulf ki ghata chura na le kahin
Dekhiye woh kaali kaali badaliyan
Zulf ki ghata chura na le kahin
Chori chori aake shokh bijliyan
Aapki ada chura na le kahin
ইয়ামিন আশেপাশে তাকিয়ে দেখে উষসী কোথাও নেই। এতোক্ষণ তো এখানেই ছিল। কোথায় চলে গেল হঠাৎ? করতালির আওয়াজে মুখরিত পরিবেশ। সবাই আরেকটা গানের জন্য আবেদন করছে। বিয়ে বাড়ির পরিবেশ পাবলিক কনসার্টে পরিণত হয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত কনসার্ট চলবে।
উষসী এক ছুটে ঘরে চলে এসেছে। অবিরাম চোখের জল ফেলছে সে। দুঃখের হোক কি আনন্দের, ইয়ামিনের গান শুনলেই তার কান্না পায় ভীষণ। আর এই কান্না সে কাউকে দেখাতে চায় না! এই অনুভূতি তার একান্ত।
বিদায় পর্ব খুব হৃদয়বিদারক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেরকম কিছুই হয়নি। প্রিয়ন্তি একদমই কাঁদেনি। আর ডোনা যা কাঁদার সকালেই কেঁদে নিয়েছেন। তাই বিদায়ের সময় কেউই চোখের জল ফেলেনি। ভীষণ ঝামেলাহীন একটা বিদায় পর্ব কেটে গেল। সকালে উষসীরা বাংলাদেশে ফিরে যাবে। ফ্লাইটের টিকিট কাটা হয়েছে।
ডোনার মন ভালো নেই। বাড়িটা খা খা করছে। কাল তারা চলে গেলে সম্পূর্ণ বাড়ি খালি হয়ে যাবে। প্রিয়ন্তির ইচ্ছে খামারবাড়িটা বিক্রি করে জুরিখে এপার্টমেন্ট কিনবে।
শিমলা তৃষ্ণার সাথে গল্প করছেন। কারণ তৃষ্ণার মেজাজ ভালো নেই। সে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে সন্ধ্যা থেকে। শিমলা জিজ্ঞেস করলেন,” এখানে ঘুরাঘুরি করে তোমার কেমন লেগেছে তৃষ্ণা?”
তৃষ্ণা মুখ ভার করে বলল,” একদমই ভালো না।”
” ওমা, কেন?”
” জানি না।”
” বাড়ির সবাইকে মিস করছো?”
তৃষ্ণা মাথা নাড়ে। সে মিস করছে আসলেই। মায়ের জন্য তার খুব কান্না পাচ্ছে। কিন্তু লজ্জায় সে কাঁদতে পারছে না।
অনেক রাত তখন। বাইরে তুষারপাত হচ্ছে। উষসী তৃষ্ণার সাথে বিছানায় শুয়ে আছে। তার চোখে ঘুম নেই। মন বিষণ্ণ। কাল তারা ফিরে যাবে, ভাবতেই কেমন যেন লাগছে। কত দ্রুত সময় কেটে গেল! এবার বিদায়ের পালা। উষসীর চোখে পানি জমে যাচ্ছে। হঠাৎ ভায়োলিনের সুর কানে আসতেই তড়াক করে উঠে বসল সে।
কিছুক্ষণ থম মেরে বসেই রইল বিছানায়। ধীরে ধীরে সুরটা হৃদয়ে যন্ত্রণার সৃষ্টি করছে। অস্থির হয়ে উঠছে মন। সে আর বসে থাকতে পারে না। দৌড়ে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।
ইয়ামিন নিস্তব্ধ কাঁচঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। অন্ধকার চারদিক। কেবল দেখা যাচ্ছে তার লম্বাটে অবয়ব। যে অবয়ব উষসীর ভীষণ চেনা! সে ছুটে এসে ইয়ামিনকে জড়িয়ে ধরল। ইয়ামিন দুই কদম পিছিয়ে যায়। তার হাত থেকে ভায়োলিন পড়ে যায়। অতঃপর সেও উষসীকে জড়িয়ে ধরে দুইহাতে। গভীর আবেগজড়িত গলায় বলল,” আই লভ ইউ।”
উষসীর চোখ ভরে উঠল অশ্রুতে। ভেজা কণ্ঠে সেও বলল,” আই লভ ইউ টু।”
বাইরে হিমশীতল বাতাস। ছোট ছোট বেলিফুলের মতো তুষার ঝরে পড়ছে ভূপৃষ্ঠের বুকে। শীতল আবহাওয়ায় কাঁচঘরের পরিবেশ উষ্ণ হয়ে উঠেছে প্রেমিকযুগলের ভালোবাসাময় নিঃশ্বাসে।
চলবে