উষসী হাসবে বলে পর্ব-৩৭+৩৮

0
233

#উষসী_হাসবে_বলে (৩৭)
লিখা- Sidratul Muntaz

“ম্যাডাম, স্যারের ফোন সকাল থেকে সুইচড অফ। আমি সব জায়গায় খোঁজ নিয়েছি..স্যার যেখানে যেখানে যেতে পারেন। কিন্তু এখনও কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি…”

অনমের কণ্ঠে উদ্বিগ্নতা। শিমলা কঠিন মুখে বললেন,” তাকে খোঁজার কোনো দরকার নেই। যেখানে খুশি যাক সে৷ আমি জানতেও চাই না ওর খবর। তুমিও আমার সামনে থেকে চলে যাও।”

অনমের গলা শুকিয়ে গেল। মিসেস শিমলাকে সে একটু ভ’য় পায়। তবে আজ চুপ থাকলে চলবে না। পরিস্থিতি অনেক ঘোলাটে হয়ে গেছে। অনম ইতস্তত করে বলল,” ইয়ে.. ম্যাডাম..”

” তোমাকে যেতে বললাম না?” অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন শিমলা।

অনম কাঁচুমাচু হয়ে মাথা নিচু করল। তবে হার মানল না। একটু সময় চুপ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বলতে লাগল,” স্যারের উপর আপনি রেগে আছেন তা আমি বুঝতে পারছি ম্যাডাম। আপনার রেগে থাকা স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু এমনও তো হতে পারে যে স্যারের এখানে কোনো দোষ নেই। মানে স্যার এসবের কিছুই জানতেন না। কারণ তিনি তো তখন ড্রাংক ছিলেন। ”

শিমলা চোখ বড় করে চাইলেন। বজ্রকণ্ঠে বললেন,” তুমি ওকে ডিফেন্ড করছো? ড্রাংক ছিল বলে ওর সব অ’ন্যায় দুধভাত হয়ে যাবে? কেউ যদি ড্রাংক হয়ে গাড়ি চালায়, তারপর এক্সি’ডেন্ট হয় তাহলে সেই এক্সিডেন্টের জন্য কি তাকে পুলিশ ধরবে না? সে কি এড়িয়ে যেতে পারবে তার অন্যায়?”

” কিন্তু এইখানে ব্যাপারটা অন্যরকম ম্যাডাম। যদি এক্সিডেন্ট হওয়া ব্যক্তি নিজেই গাড়ির সামনে চলে আসে… তাহলে তো ড্রাইভারের কিছু করার নেই।”

শিমলা রাগে অঙ্গার হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। হিসহিসিয়ে বললেন,” কি বলতে চাইছো তুমি? ফাবিয়াহ নিজেই ইয়ামিনের সামনে গিয়েছিল এক্সি’ডেন্ট হওয়ার জন্য? এটাই বলতে চাও?”

প্রশ্নটা করে নিজেই হতবিহ্বল হয়ে গেলেন শিমলা। কপালে হাত রেখে বললেন,” ওহ গড… অনম, তুমি যাওতো আমার সামনে থেকে! ”

অনম অস্বস্তি নিয়ে বলল,” মানে ম্যডাম…আসলে আপনাকে একটা কথা বলা হয়নি৷ আমি তখন ভাবিওনি যে ব্যাপারটা এতো জরুরী হতে পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে না বললে মনে হচ্ছে ভুল হয়ে যাবে।”

শিমলা জোরে শ্বাস নিয়ে বললেন,” দ্রুত বলো।”

” সেদিন আপনি রিসোর্ট থেকে বের হয়ে যাওয়ার দশমিনিট পরেই ফায়া ম্যাডাম রুমের দরজা আটকে দিয়েছিলেন। স্যার তখন ঘুমন্ত ছিল। আমি নিজের চোখে দেখেছি।”

শিমলার পিলে চমকে উঠল। ভ্রু কুঁচকে বললেন,” হোয়াট? তুমি কি সত্যি বলছো না মিথ্যা?”

” কসম করে বলতে পারি ম্যাডাম। আমি এই বাড়ির নূন খেয়েছি। নিমক হা’রামি জীবনেও করব না।”

শিমলা কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে শুধালেন,” তারপর?”

” আমি অনেক ভ’য় পেয়ে গেছিলাম৷ কয়েক বার দরজা নক করলাম। ম্যাডাম খুলছিলেন না। একটু পর উষসী ম্যাডাম এলেন। তিনি খুব জোরে দরজা নক করছিলেন। তখন সম্ভবত স্যারের ঘুম ভেঙে যায় আর তিনি দরজা খুলেন। আমি তখন ফাবিয়াহ ম্যাডামকে ভেতরে কোথাও দেখিনি। আর স্যারও জানতেন না যে ফায়া ম্যাডাম ভেতরে আছে। তাহলে নিশ্চয়ই উষসী ম্যাডামকে রুমে ঢোকাতেন না৷ উষসী ম্যাডামে প্রায় বিশমিনিটের মতো স্যারের রুমে ছিলেন। তারপর উনি বের হয়ে যান। ফায়া ম্যাডামকে আমি তখনও দেখিনি।

স্যার আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঠিক আধঘণ্টা পর ফাবিয়াহ ম্যাডাম ঘর থেকে বের হোন…তাও ওরনা ছাড়া।”

কথাগুলো বলতে বলতে অনমের মুখ-চোখ লাল হয়ে যাচ্ছে। সে সহজে শিমলার দিকে তাকাতে পারছে না। মাথা নিচু করেই সব বলছে। শিমলা অবাক হয়ে শুনছেন।

” বিশ্বাস করুন ম্যাডাম, পুরোটা সময় আমি স্যারের রুমের বাইরেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। খারা’প কিছু হলে অন্তত একবার আমি ফায়া ম্যাডামের চিৎকার শুনতাম। কিন্তু তার কণ্ঠস্বর আমি একবারও শুনিনি৷ তাদের কথার আওয়াজও পাইনি৷ তাই এটা নিশ্চিত যে স্যার ঘুমিয়ে ছিলেন। আর ফায়া ম্যাডাম রুম থেকে বের হওয়ার পর আমার সাথে খুব রুড আচরণ করছিলেন। তখনি আমার সন্দেহ হয়। তারপর তার ফোনটা রিসোর্টের বাগানে ঝোঁপের মধ্যে হারিয়ে যায়। তিনি আমাকে খুঁজতে বললেন। ওই ফোন পেলে নাকি আমাকে দশ হাজার টাকা দিবেন এটাও বলেছেন। আমি বলেছি টাকা লাগবে না।

কিন্তু ফোন খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফায়া ম্যাম টেনশনে পাগল হয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন আমি যদি তাকে একটা কাজে সাহায্য করি তাহলে আমাকে অনেক টাকা দিবেন।

আমি নাকচ করে দিয়েছি৷ কারণ আমি শুধু স্যারের হয়ে কাজ করি। স্যারের বাইরে কারো থেকে টাকা নেই না৷ এটা স্যারই আমাকে শিখিয়েছেন। কারণ আমার টাকার প্রয়োজন হলে স্যার কখনও দিতে কার্পণ্য করেন না। তাহলে অন্য মানুষের থেকে আমি ঘুষ কেন খাবো বলেন?”

শিমলা বিরক্তি নিয়ে বললেন,” আচ্ছা বুঝেছি। তারপর কি হয়েছিল সেই কথা বলো।”

” এই ঘটনার প্রায় দশমিনিট পরেই আপনি এসে গেলেন। ওই দশমিনিটে নিশ্চয়ই কিছু ঘটা সম্ভব না। ফায়া ম্যাডামের সাথে যদি আগেই খারাপ কিছু ঘটতো তাহলে তিনি নিশ্চয়ই আমাকে টাকা দিতে চাইতেন না। আপনি আসার পরেই তিনি কান্নাকাটি করেছিলেন৷ এর আগে তো নরমাল-ই ছিলেন।”

শিমলা হাতের ইশারায় অনমকে থামিয়ে দিলেন। অনমও আর কিছু বলল না। কারণ তার কথা প্রায় শেষ। শিমলা একটু সময় চিন্তা করে বললেন,” তোমার কি এসব এখন মনে পড়েছে? আগে কেন বলোনি?”

” ম্যাডাম… আমি তো আগে এই ব্যাপারে কিছু জানতামই না। স্যার আর আপনার মধ্যে ঝগড়া হতে দেখেছি। কিন্তু কি নিয়ে ঝগড়া সেটা তো আমাকে কেউ বলেনি। আর আমি এসব কল্পনাও করেনি।”

” তাহলে ছবিগুলো? এসব কি মিথ্যা?” শিমলা বিভ্রান্ত হয়ে জানতে চাইলেন।

অনম বলল,” এটাই এখন আমি বলতে চাই ম্যাডাম। মোবাইল না পেয়ে রিসোর্টের কর্তৃপক্ষের কাছে বলে রেখেছিলাম। তারা আমাকে বলেছিল খুঁজে পেলে জানাবে। গতকালই আমাকে রিসোর্ট থেকে ফোন দেওয়া হয়। ফায়া ম্যামের মোবাইল পাওয়া গেছে। আমি ব্যাপারটা ম্যাডামকে জানাতেই তিনি বললেন এই মোবাইলটা নাকি তার খুব ব্যক্তিগত। তাই এই ব্যাপারে কাউকে কিছু না জানিয়ে গোপনে তাকে দিয়ে আসতে।

আমি সেটাই করেছি। তবে এখন বুঝতে পারছি কতবড় ভুল করেছি। তিনি আমাকে নোংরা খেলার গুটি হিসেবে ব্যবহার করেছেন আসলে। ”

অনম অপরাধী ভঙ্গিতে মাথা নত করে রেখেছে। শিমলা প্রচন্ড হতবাক, বিধ্বস্ত হয়ে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লেন। তিনি ভাবতেই পারছেন না, ফাবিয়াহর মতো সহজ-সরল চেহারার একটা মেয়ে এতোবড় একটা কাজ করতে পারে। এতো নোংরা হতে পারে একটা মেয়ের চিন্তা-ভাবনা? তিনি কল্পনাও করতে পারছেন না। ফাবিয়াহর প্রতি বিতৃষ্ণায় তার মন বিষাক্ত হয়ে উঠল। সেই সাথে আফসোস হলো, নিজের একমাত্র ছেলেকে অবিশ্বাস করার জন্য! এবার তিনি কিভাবে ক্ষমা চাইবেন ছেলের কাছে?

প্রিয়ন্তি যত্ন করে তিন কাপ কফি বানিয়েছে। এয়ারপোর্ট থেকে এসে গোসলের পর শরীর ঝরঝরে করতে কফির বিকল্প নেই। লাগেজ গুলো এখনও পড়ে আছে লিভিংরুমে। সব গোছাতে হবে। আজরাতে অনেক কাজ! তবে সবচেয়ে জরুরী কাজ এই মুহূর্তে কাউচে বসে আছে। প্রিয়ন্তি তার পাশে গিয়ে কফির মগ রাখল। তারপর হতাশ গলায় বলল,” চেহারার এই অবস্থা কেন তোর? কয়দিন ধরে শেভ করিস না? কবির সিং হতে চাস?”

ইয়ামিন কৌতুকপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। মুহূর্তেই গম্ভীর হয়ে অবজ্ঞার স্বরে বলল,” কবির সিং ছাড়া কি আর কারো দাঁড়ি রাখার অধিকার নেই?”

” কিন্তু তুই তো ট্রিমও করিসনি। চুলগুলোও অগোছালো লাগছে। সত্যি কথা বল, কি হয়েছে?”

” কিছু না…” একটা উত্তপ্ত দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল ইয়ামিন। চেহারায় নিরাশ ভাব।

প্রিয়ন্তি ফারদিনের উদ্দেশ্যে বলল,” কই এসো। কফি তো ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

” আরে দাঁড়াও.. টিভিটা চলছে না কেন?” ফারদিন এলইডি’র সুইচ নিয়ে এমনভাবে ঘাটাঘাটি করছে যেন এটাই পৃথিবীর সবচেয়ে জরুরী কাজ। প্রিয়ন্তি বিরক্তি মাখা কণ্ঠে বলল,” জুটেছে আমার কপালে এক সাইকো। সারাক্ষণ টিভি আর মোবাইল ছাড়া কিচ্ছু বোঝে না। বিয়ের আগে যদি বুঝতাম তাহলে বিয়েই করতাম না একে! শোন ইয়ামিন, তোকে একটা সুপরামর্শ দেই। জীবনেও বিয়ে করবি না।”

ইয়ামিন তাচ্ছিল্য হাসল।মাথা নেড়ে বলল,” তোমার দোয়া কাজে লাগবে। বিয়ে আমার এমনিও কপালে নেই।”

প্রিয়ন্তি ফিক করে হাসল। ইয়ামিনের কাঁধে কনুই ঠেঁকিয়ে দুষ্টমির স্বরে বলল,” কেন? আমার ভাই তৃষাণ খুব ডিস্টার্ব করছে বুঝি?”

ইয়ামিন জবান দিল না। ঠোঁট ভাঁজ করল। প্রিয়ন্তি আফসোসের গলায় বলল,” আহারে…বার-বার তোর প্রেমে বাগড়া দিতে তৃষাণ হাজির হয়ে যায় তাই না?”

” কারো দোষ নেই আপু৷ দোষ আমার কপালের। কপাল ভালো হলে একশোটা তৃষাণ মিলেও কিছু করতে পারতো না।”

প্রিয়ন্তি ভ্রু কুঁচকে কিছু ভাবল। তারপর হঠাৎ বলল,” দাঁড়া, উষুকে একটা ফোন দেই।”

” না! দরকার নেই।”

” শাট আপ।”

ইয়ামিনকে ধমক দিয়ে ফোন হাতে নিল প্রিয়ন্তি। তারপর হঠাৎ মনে পড়তেই জিজ্ঞেস করল,” আচ্ছা, তোর ফোন বন্ধ কেন?”

ইয়ামিন যন্ত্রের মতো বলল,” রাগে আছাড় মেরেছিলাম। তারপর কোথায় আছে আর মনে নেই।”

” কিসের উপর এতো রাগ তোর!”

ইয়ামিন কথা বলল না। সকালে ছবিগুলো দেখেই মেজাজ খুব গরম হয়ে গেছিল৷ উষসীও নিশ্চয়ই ওই ছবি দেখেই তার কাছে আসতে নিচ্ছিল। ওই মুহূর্তে উষসীর মুখোমুখি হতে ইচ্ছে করেনি তার। তাই সে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। কি জানি এখন কি অবস্থা উষুর! ইয়ামিন নিজেকে নিয়ে ভাবছে না। শুধু উষসীর চিন্তায় দমবন্ধ লাগছে তার। মেয়েটা খুব সেন্সিটিভ। যদি এসব দেখে কোনো অঘটন ঘটায়? উফ!

প্রিয়ন্তিকে নিষেধ করলেও ইয়ামিন মনে-প্রাণে চায় উষসীকে ফোন করতে। একবার তার কণ্ঠ শুনলেই যেন শান্ত হবে মন।

রিং হচ্ছে। প্রিয়ন্তি কল স্পিকারে দিয়ে রেখেছে। ইয়ামিনের বুকের ঢিপঢিপ শব্দ বেড়েই চলেছে। হঠাৎ উষসী ফোন রিসিভ করে বলল,”হ্যালো।” ব্যাস, সাথে সাথেই ইয়ামিনের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হওয়ার দশা।

প্রিয়ন্তি রাগান্বিত স্বরে বলল,” তোর হ্যালো তোর কাছেই রাখ। সেলফিশ একটা! আমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে এলি না কেন? তোকে থা’পড়াতে মন চাইছে!”

উষসী ভারী গলায় বলল,” স্যরি আপু…আমি একটু অসুস্থ ছিলাম।”

উষসীর গলা শুনে মনে হচ্ছে কাঁদছিল এতোক্ষণ। ইয়ামিন মুহূর্তেই বুঝে যায় সবকিছু। প্রচন্ড কষ্টে আছে উষসী৷ নিশ্চয়ই ছবিগুলো দেখেছে! হায় আল্লাহ, ইয়ামিন এবার কোন মুখে উষসীর সামনে যাবে? তার ম’রে যেতে মন চাইছে।

প্রিয়ন্তি চিন্তিত হয়ে বলল,” গলা এমন লাগছে কেন? আসলেই অসুস্থ তুই? নাকি আমার ভাইয়ের জন্য কেঁদে বুক ভাসাচ্ছিস? কোনটা?”

ইচ্ছে করেই ফোঁড়ন কাটল প্রিয়ন্তি। যেন উষসী একটু হাসে। অথচ সে হাসল না। আরও ভারাক্রান্ত গলায় বলল,” তেমন কিছু না। তুমি কেমন আছো বলো? তোমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করতে কে গিয়েছিল?”

” তুই তো এলি না। তৃষাণ আর মা এসেছিল শুধু। ”

” আর কেউ আসেনি? ” সাবধানে প্রশ্নটা করল উষসী।

প্রিয়ন্তি ইয়ামিনের দিকে চেয়ে একটু হাসল৷ তারপর বলল,” আমি বুঝেছি তুই কার কথা জিজ্ঞেস করছিস। কিন্তু সে আসেনি। তৃষাণ আসবে বলে আমি ইয়ামিনকে আসতে নিষেধ করেছিলাম।”

” ও আচ্ছা।”

ইয়ামিন হাসল একটু। উষসী তার কথা জানতে চেয়েছে! হৃদয়ে প্রশান্তি অনুভব হলো। প্রিয়ন্তি চটপাট করে বলল,” শোন উষু, আমি কিন্তু তোর উপর মা’রাত্মক রেগে আছি। কাল সকালে সোফিয়াকে দেখতে আমরা আসব। কিন্তু তোর সাথে আমি একদম কথা বলব না।”

উষসী একটু হেসে বলল,” আচ্ছা, কাল এসো। দেখি তোমার রাগ ভাঙাতে পারি কি-না!”

” সত্যিই রাগ ভাঙাতে চাস? আমি বিশ্বাস করি না। তুই তো এখন আমার পরোয়াও করিস না।”

” বিশ্বাস করো আপু, তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ে।”

” তাহলে এখনি আমার বাড়ি চলে এসে তোর কথার প্রমাণ দে।”

” মানে? এখন?” উষসী চমকে উঠল।

প্রিয়ন্তি অভিমানি গলায় বলল,” এইতো বুঝেছি। এখন আর পারবি না তাই না? তোর সব আসলে মুখে মুখেই।”

উষসী চিন্তা করল, ঘরে বসে সে কান্না-কাটি ছাড়া আর কিই-বা করতে পারবে? তার চেয়ে ভালো প্রিয়ন্তির বাড়িতে যাওয়া যাক। যদি সেখানে একটু ভালো লাগে! তাছাড়া তার মনও টানছে। সে বলল,” আচ্ছা, আমি একটু পর বের হচ্ছি।”

” উহুম, তোকে ত্রিশমিনিট সময় দেওয়া হলো। এর মধ্যেই আসতে হবে। নাহলে কিন্তু আমি দরজাই খুলব না। রাখছি।”

ফোন রেখেই হেসে উঠল প্রিয়ন্তি। ইয়ামিন বলল,” তোমার এটা করার কোনো দরকার ছিল না।”

” হুম, হুম বুঝি। তোর চেহারা দেখে তো মনে হচ্ছে খুশিতে এখনি ডান্স করবি। তাহলে এতো নাটক করছিস কেন শুধু শুধু?”

ইয়ামিন ঠোঁট ভিজিয়ে মৃদু হাসল৷ ফারদিন কফিতে চুমুক দিয়েই বলল,”প্রিয়, কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে দেখি।”

” খুব ভালো হয়েছে। টিভি নিয়ে ব্যস্ত হওয়ার শাস্তি এটা। এখন ঠান্ডা কফিই খাও বসে বসে।”

কলিংবেল বেজে উঠল। প্রিয়ন্তি দরজা খুলে বলল,” তুই দশমিনিট লেইট করেছিস। আমার দরজা খোলাই উচিৎ হয়নি। কিন্তু তোর ভাগ্যটা ভালো যে আমি খুব দয়ালু।”

উষসী প্রিয়ন্তির চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তাকে। ‘আপু’ বলে আর্তনাদ করে কেঁদে উঠল। প্রিয়ন্তি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে উষসীর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” ইটস ওকে। আর মাফ চাইতে হবে না। আমি তোকে ক্ষমা করে দিয়েছি। এবার আয় আমার সাথে।”

প্রিয়ন্তি তার হাত ধরে ভেতরে নিয়ে যাচ্ছে। উষসী চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” তুমি জানো না আপু… এখানে কতকিছু ঘটে গেছে। আমি তোমাকে সব বলব বলেই এসেছি। কারণ আমি একা আর এসব স’হ্য করতে পারছিলাম না।”

প্রিয়ন্তি একটু থেমে বলল,” আরে পাগলি, এখনও কিছুই তো ঘটেনি। কিন্তু ঘটবে। কারণ আমি ঘটাবো।”

উষসী কান্নার ঢোক গিলে আশ্চর্য হয়ে তাকাল,” মানে? কি ঘটাবে তুমি?”

প্রিয়ন্তি এক ধাক্কায় উষসীকে রুমের ভেতর ঢুকিয়ে দিল। সেই একই রুমের বিছানায় ইয়ামিনকে বসা দেখে আত্মা ছলাৎ করে উঠল উষসীর। এটা কি সত্যিই ইয়ামিন নাকি সে কল্পনা করছে? ইয়ামিন বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে উষসীকে। মনে হচ্ছে যেন কতবছর পর তারা মুখোমুখি হয়েছে। অথচ মাত্র কিছুদিনের দূরত্ব ছিল। তারা দু’জনেই নিশ্চুপ এবং স্তম্ভিত। পেছন থেকে খট করে শব্দ হলো। প্রিয়ন্তি দরজা আটকে দিয়েছে।

ফারদিন কাছে এসে বলল,” এটা কিন্তু বাড়াবাড়ি। দরজা লাগানোর কোনো দরকার ছিল না।”

প্রিয়ন্তি নখে ফুঁ দিয়ে বলল,” তোমাকেও বিয়ে করার কোনো দরকার ছিল না আমার, তাওতো আমি বিয়ে করেছি। এমন বেহুদা কাজ দুয়েকটা মাঝে মাঝে করতে হয়।”

ফারদিন চোখ কটমট করে বলল,” মানে? এই কথার দ্বারা তুমি কি বুঝালে? আমাকে বিয়ে করা বেহুদা কাজ?”

” সেরকম কিছু না। তুমি যাওতো, এতোকিছু না ভেবে কাজী নিয়ে এসো।”

” কাজী মানে?” ফারদিনের চোখ কপালে উঠল। প্রিয়ন্তি অতি মধুর স্বরে বলল,” এবার আমি ওদের বিয়ে দিবো৷ তাহলেই আমার আত্মা শান্তি পাবে।”

” তুমি কি ম’রে গেছো যে আত্মাকে শান্তি দিতে হবে? আর তোমার হিটলার ভাই জানলে কি হবে?”

প্রিয়ন্তি হতচকিত হয়ে মুখে হাত ঠেঁকাল। বলল,” তৃষাণকে তাহলে তুমিও ভ’য় পাও? আল্লাহ!”

ফারদিন ইতস্তত করে বলল,” না মানে…তুমি না বলেছিলে তোমার বাংলাদেশে কি জরুরী মিশন আছে? সেটা ছেড়ে হঠাৎ ওদের বিয়ে নিয়ে পড়লে কেন?”

প্রিয়ন্তি আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলল,” এটাই আমার জরুরী মিশন প্রাণের স্বামী! এবার ঝটপট যাও তো। নাহলে কিন্তু একটা ঘুঁষি দিবো নাক বরাবর। আমি তোমার দুইবছরের সিনিয়র। ভুলে গেছো?”

ফারদিন হতাশ নিশ্বাস ছাড়ল৷ এজন্যই সিনিয়র মেয়ে বিয়ে করতে হয় না। এরা তো স্বামীকে স্বামীই মনে করে না। সরকারি চাকর মনে করে!

চলবে

#উষসী_হাসবে_বলে (৩৮)
লিখা- Sidratul Muntaz

ঘন পল্লব যুক্ত, তীক্ষ্ণ চোখ দু’টোর দিকে নির্ণিমেষ চেয়ে থেকে এবার ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলল উষসী। ছুটে এসে ইয়ামিনের বুকে মাথা ঠেঁকাল। গভীর স্রোতে ভাসতে থাকা অসহায় মানুষটি যেভাবে খুঁটি আঁকড়ে ধরে.. সেভাবেই যেন উষসী আঁকড়ে ধরল ইয়ামিনের পিঠ।

বসন্তের কোমল বাতাসের মতো বিশুদ্ধ, স্নিগ্ধ ফুলেল সৌরভের মতো তীব্র আর প্রভাতের পাখির কল-কালকির মতো মিষ্ট অনুভূতিতে ভেসে গেল ইয়ামিনের বুক। প্রবল শান্তিতে চোখ বুঁজল সে। ঠিক এই মুহূর্তে ম’রে গেলেও তার এতোটুকু আফসোস থাকবে না! উষসীর একটা আলিঙ্গনই বুঝিয়ে দিয়েছে সব। সে ঘৃণা করে না ইয়ামিনকে। ভালোবাসে এখনও, বরং আগের চেয়েও বেশি!

তারা এভাবেই একে-অন্যকে জড়িয়ে ধরে রাখল তৃষ্ণায় কাতরের মতো। মাথার উপরে ফ্যানের আলতো ঘূর্ণনটাও মধুময় লাগছে। অসীম শান্তিতে উষসীর কেমন ঘুম চলে আসছে। কতদিন শান্তিতে একটু ঘুমায়নি সে!

অনেকক্ষণ পর ইয়ামিন ধীরে ধীরে বলল,” কেমন আছো?”

” আপনাকে ছাড়া কেমন থাকার কথা ছিল আমার?” উষসীর কণ্ঠে প্রকাশ পেল একরাশ অভিমান!

আলতো হাসল ইয়ামিন। এতোদিন যোগাযোগ বন্ধ রাখার কারণেই নিশ্চয়ই অভিমান করেছে উষসী। অথচ সে কি জানে, ইয়ামিন কতবার অনুসরণ করেছে তাকে! তার মুখ একটু দেখার জন্য বার-বার পারি দিয়েছে গাজীপুর থেকে সাভারের মতো দীর্ঘ দূরত্বের রাস্তাটা। কংক্রিটের এই ধুলো মাখা শহরে উষসীই যে তার একমাত্র প্রশান্তির জায়গা৷ এই প্রশান্তির অনুপস্থিতি তার হৃদয় এতোটুকু সহ্য করতে পারে না, পারবে না!

ইয়ামিন উষসীর কপালে চু’মু দিয়ে বলল,” ভেবেছিলাম আড়ালে থাকলে আমাকে ভুলতে পারবে তুমি। তোমাকে হেল্প করছিলাম। চোখের আড়াল তো মনের আড়াল বলে একটা কথা আছে না? সেটাই ট্রাই করে দেখছিলাম আর কি!”

উষসী রাগান্বিত চোখে তাকাল। ইয়ামিনের ঠোঁটে মুচকি হাসি। উষসী তার চওড়া কাঁধে একটা গাট্টা মেরে বলল,” কিভাবে ভাবলেন চোখের আড়াল হলেই আমার মনের আড়াল হতে পারবেন আপনি? আমার মনের মধ্যে আসন গেঁড়ে বসে আছেন। দূরে গেলে মনে হয় সুতোয় টান লাগে। ভীষণ কষ্ট হয়, বিশ্বাস করুন!”

ইয়ামিন অভিযোগ করে বলল,” তাহলে যেতে বলেছিলে কেন?”

” ক্ষমা চাইছি। আর কখনও আপনাকে দূরে যেতে বলব না। আপনাকে যেতে বলা মানে নিজেকেই মৃ’ত্যুদন্ড দেওয়া। এবার বুঝতে পারছি আমি।”

ইয়ামিন উষসীর চোখের জল মুছতে মুছতে বলল,” আহারে, আর কাঁদে না সুহাসিনী৷ এইতো এসে গেছি আমি৷ আর দূরে যাবো না। কথা দিলাম। প্রমিস।”

উষসী মাথা নিচু করে নিজেকে সামলালো। ইয়ামিন চুপচাপ দেখছিল তার মুখটা। মনের মধ্যে ঝিরিঝির বৃষ্টিপাত হচ্ছে। ভীষণ শীতল আর মিষ্টি অনুভূতি!

উষসী মাথা উঠিয়ে বলল,” শুনুন, একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”

” দশটা কথা জিজ্ঞেস করো।”

” আমাকে যে সেদিন প্রপোজ করেছিলেন ভার্সিটির সবার সামনে, তখন যেই রিংটা পরিয়ে দিয়েছিলেন… সেটা কি এখনও আছে?”

রিংটা এখনও ইয়ামিনের পকেটেই আছে। কিন্তু সেই কথা স্বীকার করল না সে। উল্টো বলল,” উমম। কি জানি কোথায় আছে ওটা..মনে নেই আমার। কেন?”

উষসীর মুখ অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার হয়ে গেল। সে অস্বস্তি মাখা গলায় বলল,” আই এম স্যরি… তখন ওটা আমার খুলে রাখা উচিৎ হয়নি৷ আপনার দেওয়া এতো স্পেশাল উপহার আমি হারিয়ে ফেললাম..”

তার কণ্ঠ নিভে এলো। অপরাধবোধে দগ্ধ সে। চোখ টলমল করছে। ইয়ামিন সাথে সাথে পকেট থেকে রিংটা বের করে বলল,” এটা আমি কিভাবে হারিয়ে ফেলি উষু? আমার কাছে এটা আমার ভালোবাসার চিহ্ন। দ্বিতীয়বার তোমার হাতে এই আংটি না পরালে আমার মন শান্ত হতো না!”

উষসী হেসে উঠল। মুহূর্তেই গড়িয়ে পড়ল তার চোখের অশ্রু। খুশিতে কেঁদেই ফেলল সে। ইয়ামিন তার হাত নিয়ে আঙুলে আংটিটা পরিয়ে দিল। তারপর হাতটা মুখের কাছে এনে চুমু দিল। উষসীর স্বপ্নের মতো লাগছে। আর কোনো বাঁধা না আসুক তাদের জীবনে। সে ভীষণ ক্লান্ত। এবার একটু শান্তিতে ঘুমাতে চায়। ইয়ামিনের বুকে মাথা রেখে শান্তিময় দীর্ঘ ঘুম!

দরজায় টোকা পড়ল। শোনা গেল,” এহেম, এহেম, আসতে পারি?”

প্রিয়ন্তির কণ্ঠে চাপা রসিকতা। ইয়ামিন উষসীর থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়াল। মুখ গম্ভীর করে বলল,” হুম..এসো, এসো। এমনকিছুও করছিলাম না আমরা যে তোমাকে অনুমতি নিয়ে ঘরে ঢুকতে হবে।”

প্রিয়ন্তি দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল। টিপ্পনী কেটে বলল,” দেখে বোঝাই যাচ্ছে আমার কণ্ঠ শুনে একশো মাইল বেগে দূরে গিয়ে দাঁড়িয়েছিস। এখন ভাব নিতে হবে না।”

উষসী মুখ টিপে হেসে ফেলল। প্রিয়ন্তি অবাক হয়ে উচ্চস্বরে বলল,” আরে, দেখে, দেখি! কে হাসছে? অবশেষে তাহলে মেঘ সরে চাঁদ উঠেছে আকাশে! এতোক্ষণ তো কেঁদে-কেটে নিশ্বাস আটকে ফেলছিলি। এখন এতো হাসি কোথা থেকে বের হচ্ছে? বুঝলাম, আমার ভাইয়ের ছোঁয়ায় জাদু আছে তাহলে!।”

লজায় উষসীর মুখ রাঙা হয়ে উঠল। একটু চুপ থেকে সে হঠাৎ গলায় বলল,” তুমি অনেক বদলে গেছো প্রিয় আপু। তোমার কি হয়েছে? আসার পর থেকেই শুধু হাসি-তামাশা করছো। অথচ প্যারিসে তুমি আমাদের কত সিরিয়াসভাবে শাসন করছিলে। আমরা তোমার বারণ শুনিনি। এখন অবশ্য সেজন্য আফসোসই হয়। তুমি যা বলেছিলে সব সত্যি হয়েছে। আমার বাড়িতে কেউ মেনে নেয়নি এই সম্পর্ক। নীরব যুদ্ধ শুরু হয়েছে এসব নিয়ে। ”

প্রিয়ন্তি উষসীর কাঁধে চাপড়ে বলল,” আরে এতো চিন্তার কিছু নেই।”

তারপর নিজের বুকে হাত রেখে বলল,” এখন আমি এসে গেছি না? নীরব যুদ্ধ সরব হয়ে উঠবে। প্রয়োজনে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লাগিয়ে দিবো৷ তোরা শহীদ হবি নয়তো বিজয়ী হবি। কিছু তো একটা হবেই!”

প্রিয়ন্তির কথাগুলো শুনে ইয়ামিন আর উষসী একবার চোখাচোখি করল। ইয়ামিন ভ্রু কুঁচকে বলল,” মানে? কি বলছো ক্লিয়ার করো। তোমার হিন্টস আমরা কেউই বুঝতে পারছি না।”

প্রিয়ন্তি আরাম করে বিছানায় বসল। ইয়ামিন আর উষসীকে হাতের ইশারায় কাছে ডেকে নিজের দুই পাশে বসালো। তারপর ইয়ামিনের কাঁধে কনুই রেখে বলল,” তোদের রিলেশনটা কিভাবে হয়েছে জানিস?”

ইয়ামিন ঠোঁট উল্টে জবাব দিল,” আমি প্রেমে পড়েছিলাম। আর উষসীও৷ তারপর আমরা কনফেস করেছি। ব্যস… রিলেশন হয়ে গেছে!”

প্রিয়ন্তি দুই পাশে মাথা নাড়ল, “উহুম৷ ভুল উত্তর। প্রথমে তো তুই ওকে সিলেটে দেখেছিলি। তারপর আর তোদের দেখা হওয়ার চান্স ছিল না৷ উষু তোর বাড়ির ঠিকানাও জানতো না। কিন্তু একবার তুই ওর চেহারার সাথে মিল রেখে একটা ছবি এঁকে এক্সিবিশনে পাঠালি। সেই ছবি দেখে উষু তোর ঠিকানা খুঁজে বের করল। সেই ঠিকানা ওকে কে দিয়েছি জানিস?”

” কে?”

প্রিয়ন্তি গর্বের সাথে উচ্চারণ করল,” আমি!”

ইয়ামিন বুঝে গেছে এমন ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল,” ও আচ্ছা।”

প্রিয়ন্তি এবার উষসীর দিকে চেয়ে বলল,” সত্যি করে বল, তুই কি প্রথম দেখাতেই ইয়ামিনের প্রেমে পড়েছিলি?”

উষসী মাথা নেড়ে বলল,” মোটেও না।”

তারপর মুখের উপর চলে আসা অবাধ্য চুল কানে গুঁজে বলল,” রিয়াসাতের ওই ঘটনার পর থেকে আমি উনাকে ঘৃণা করতাম। দুই চোখে দেখতেও পারতাম না। কিন্তু তোমার বিয়েতে সুইজারল্যান্ড যাওয়ার পর আর শপিং-এ প্যারিসে যাওয়ার পর.. উনাকে ক্লোজলি দেখেছি, চিনেছি, জেনেছি। আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছি উনি কত আলাদা সবার থেকে। আমাদের মতোই সাধারণ উনার মন। খুব নির্মল আর সুন্দর। উনি অন্য সেলিব্রিটিদের মতো অহংকারী কিংবা পশ না। একদম সাদামাটা! আর আমার ব্যাপারে তো উনি বেশিই স্পেশাল কেয়ার করতেন। এসব দেখে কোন মেয়ে প্রেমে না পড়ে থাকবে বলো…”

প্রিয়ন্তি হাত উঠিয়ে উষসীকে থামিয়ে দিয়ে বলল,” হয়েছে, হয়েছে.. বুঝেছি তোদের ভালোবাসা কুয়ার মতো গভীর, হাতির কানের মতো বিশাল! কিন্তু এই সবকিছুর মধ্যে একটা কমন ব্যাপার কি বলতে পারবি?”

ইয়ামিন-উষসী দু’জনেই প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল৷ প্রিয়ন্তি নিজের দিকে আঙুল তাঁক করে বলল,” এইযে আমি। তোদের নাটের গুরু। আমি যদি উষুকে প্রথমে তোর বাড়ির এড্রেস না দিতাম, আর আমার বিয়েতে ইয়ামিনকে আসার জন্য রাজি না করাতাম তাহলে এসব কিছুই ঘটতো না। তোদের প্রেমটাই হতো না। মনের উপর তো আমাদের নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই তোরা দু’জনেই নির্দোষ। মূল দোষী আমি৷ আমি বিয়ে করেছি বলেই তোরা নিজেদের লাইন ক্লিয়ার করতে পেরেছিস। সুতরাং এবার তোদের বিয়ে দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর আমি আমার এই দায়িত্ব পালন করতেই বাংলাদেশে এসেছি। তোদের এই দেবদাস, পার্বতীর কাহিনী এবার খতম হবে। একসাথে তোদের বেঁধে না দিয়ে আমি আর সুইজারল্যান্ড ফিরছি না। বুঝতে পেরেছিস?”

প্রিয়ন্তি তার দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে বড় একটা নিশ্বাস ছাড়ল। তারপর ইয়ামিন আর উষসীর দিকে চেয়ে পুনরায় শুধাল,” বুঝেছিস?”

ইয়ামিন-উষসী হতভম্বের মতো তার মুখের দিকে চেয়ে কথা শুনছিল এতোক্ষণ। দ্বিতীয়বার প্রশ্নের পর দু’জনেই মাথা ঝাঁকাল। অতএব তারা বুঝেছে!

প্রিয়ন্তি ছোট নিশ্বাস ছেড়ে বলল, ” এবার বল, বিয়ে করবি?”

ইয়ামিন সাথে সাথে বলল,” ওকে।”

উষসী আৎকে উঠল,” মানে? এখন?”

প্রিয়ন্তি অতি স্বাভাবিক গলায় বলল,” হ্যাঁ! গ্রহ-নক্ষত্র দেখে এখন কি শুভদিন বাছাই করব নাকি? আজ করিস আর দুইদিন পরে করিস… বিয়ে তো বিয়েই!”

উষসী দ্বিধাগ্রস্ত। তার মুখ দেখে ইয়ামিন সাথে সাথে মত পাল্টে ফেলল,” আরে ধূর, এভাবে বিয়ে হয় নাকি?”

প্রিয়ন্তি চোখ বড় করে ইয়ামিনের দিকে ঘুরল,” কিরে, তুই না একটু আগেই বললি ‘ওকে?’ এখন আবার পল্টি মারছিস কেন? ”

ইয়ামিন বিরস মুখে বলল,” মজা করে বলেছিলাম।”

প্রিয়ন্তি চোখ কুটি করে ইয়ামিনের দিকে তাকিয়ে রইল সন্দেহভরা দৃষ্টিতে। ইয়ামিন আঁড়চোখে চেয়ে প্রশ্ন করল,” কি?”

প্রিয়ন্তি জবাব দিল না। উষসীর দিকে ঘুরে বলল,” তোর সমস্যা কোথায় বল? বিয়ে করতে ভ*য় পাচ্ছিস?”

উষসী ইতস্তত মুখে বলল,” এইভাবে বিয়ে করে নিলেই কি প্রবলেম সোলভ হয়ে যাবে আপু? বাড়িতে কি বলব? সবাই কিভাবে রিয়েক্ট করবে?”

প্রিয়ন্তি দাঁতে দাঁত পিষে বলল,” প্রেম করার আগে বাড়িতে পারমিশন নিয়েছিলি? তখন কি একবারও ভেবেছিলি সবাই কেমন রিয়েক্ট করবে? এই কথা ভেবে প্রেম করা স্টপ রেখেছিলি?”

উষসী অসহায়ের মতো মাথা নাড়ল। প্রিয়ন্তি এবার ধমকে উঠল,” তাহলে বিয়েতে এতো তাল-বাহানা কেন? এইযে, আমার ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে দ্যাখ। কি অবস্থা হয়েছে ওর! মজনু, দেবদাস, কবির সিংকে পর্যন্ত হা’র মানাবে।”

উষসী ইয়ামিনের দিকে তাকাল আহত দৃষ্টিতে। ইয়ামিন হেসে বলল,” আমি শেভ করিনি তাই দেখতে এমন লাগছে। তুমি প্রেশার নিও না উষু। মন যেটা চায় সেটাই করো।”

উষসী বিড়বিড় করে বলল,” মন তো শুধু আপনাকেই চায়!”

সোফিয়া বিছানায় শুয়ে আছে। তার মুখ হাসি হাসি। মেয়ের হাসি মাখা মুখ যতবার দেখে, ততবার আনন্দে উথলে ওঠে উষ্ণতা। এই মেয়ে তার প্রাণ, তার জান! তার অমূল্য রত্ন! হাসপাতালের সেই কঠিন আটঘণ্টার কথা মনে পড়ে। কত অনিশ্চয়তা, বিপদের আশঙ্কা, ব্যথা, দুঃখ, যন্ত্রণা সহ্য করার পর পরীটিকে কোলে নিতে পেরেছিল সে! সেদিনের কথা ভাবলেই শিউরে ওঠে গা।

পর মুহূর্তেই আবার মেয়ের আশ্চর্য সুন্দর নিষ্পাপ মুখটার দিকে তাকালেই ভুলে যায় সব। এই ছোট্ট প্রাণটার জন্য সে সহ্য করে নিতে পারে সব কষ্ট! উষ্ণতা কাছে এসে সোফিয়ার কপালে চু’মু দিতে নিয়েই হঠাৎ তীব্র ব্যথা অনুভব করল পেটে। এতো জোরে ব্যথা লাগল যেন এখনি দম বের হয়ে যাবে। সে তীব্র চিৎকার করে উঠল। তৃষাণ মেয়ের দুধ গরম করতে রান্নাঘরে গেছিল। উষ্ণতার চিৎকার শুনে সে প্রায় ছুটে এলো!

ঘরে ঢুকতেই দেখল উষ্ণতা মেঝেতে উল্টে পড়ে কাতরাচ্ছে। এমন দৃশ্য দেখে মুহূর্তেই তার গা কাটা দিল৷ হাত থেকে ফিডার পড়ে গেল। কাঁচ ভেঙে চূর্ণ-বিচূর্ণ হচ্ছে। তৃষাণ উষ্ণতাকে কোলে তুলে বলতে লাগল, ” কিচ্ছু হবে না। এইতো আমি আছি উষ্ণ। তোমার কিচ্ছু হতে দিবো না!”

হাসপাতালে ডাক্তারের কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়ন্তি, উষসী আর ফারদিন। ইয়ামিনও তাদের সাথে এসেছে। কিন্তু তৃষাণ এখানে উপস্থিত বলে ইয়ামিন দূরে অবস্থান করছে। প্রচন্ড চিন্তায় উষসী অবিরত পায়চারী করছে। যুঁথি বেগমকে উষসী ফোন করেছিল দোয়া নেওয়ার উদ্দেশ্যে৷ সুসংবাদ দেওয়ার আগেই মা তাকে দুসংবাদ শুনিয়ে দিয়েছেন। উষ্ণতার নাকি সিজারিয়ান জায়গায় ব্যথা উঠেছিল। তৃষাণ তাক্ব নিয়ে হাসপাতালে গেছে।

এই খবর শুনে কি ঘরে বসে থাকা যায়? তাই তারাও হাসপাতালে ছুটে এসেছে। তৃষাণ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কিন্তু তার মন বেশ অস্থির। সে ঘামছে। বার-বার চোখ থেকে চশমা খুলছে আবার সেটা চোখে পরছে। প্রিয়ন্তি হঠাৎ উষসীর কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,” চিন্তা করিস না। তোর আপুর সিরিয়াস কিছুই হয়নি। মাত্র তো পনেরো দিন গেল। ওই জায়গায় চাপ লাগলে একটু ব্যথা হওয়া নরমাল। কিন্তু আমার ভাইকে তো আমি চিনি। সে বউ পাগল। বউ ‘উহু’ করলেও সে তুলে হাসপাতালে নিয়ে আসবে।”

উষসী একটু আশ্বস্ত হয়ে বলল,” সেটাই যেন হয় আপু।”

প্রিয়ন্তি বলল,” আচ্ছা, তোদের বিয়েটা তো হয়ে গেল। এটা কি তৃষাণকে বলে দিবো?”

উষসী হতবিহ্বল হয়ে বলে উঠল,” পাগল তুমি? এই সময় এই কথা বললে ভাইয়া ইয়ামিনকে মা’র্ডার করে ফেলবে। প্লিজ, চুপ থাকো।”

প্রিয়ন্তি মুখ টিপে হাসি সামলালো। তার কেন এতো হাসি পাচ্ছে কে জানে? এদিকে তৃষাণ একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে আবদ্ধ কেবিনের দরজায়। ভেতরে উষ্ণতা। ডাক্তার তাকে দেখছেন। তৃষাণ অনবরত দোয়া পড়ছে।ফারদিন বলল,” ভাইয়া, চলেন আমরা একটু নিচে থেকে হেঁটে আসি। ফ্রেশ এয়ার নিলে আপনার ভালো লাগবে।”

তৃষাণ কঠিন মুখে বলল,” তুমি যাও। আমার এখানে ছাড়া কোথাও ভালো লাগবে না।”

ফারদিন অসহায় চোখে প্রিয়ন্তির দিকে চাইল। প্রিয়ন্তি বলল,” শেখো, শেখো! ভবিষ্যতে এসব তোমাকেও করতে হবে। নয়তো ঘুঁষি মে*রে নাক ফাটিয়ে দিবো একদম!”

ডাক্তার ম্যাডাম উষ্ণতাকে চেক আপ করে বললেন,” আপনি একদম ঠিকাছেন আপু। শুধু শুধুই আপনার হাজব্যান্ড এতো টেনশন করছেন।”

উষ্ণতা ক্লান্ত হেসে বলল,” ও আসলে আমার সব বিষয়েই এমন সেন্সিটিভ। আপনারা কিছু মনে করবেন না প্লিজ।”

” আমরা শুধু একটা কথাই মনে করেছি। আপনি প্রচন্ড ভাগ্যবতী। তাই এমন স্বামী পেয়েছেন।”

উষ্ণতা লাজুক হাসল। এই কথা তো তাকে সবাই বলে! ভদ্রমহিলা উষ্ণতাকে একটা টেস্টটিউব দিয়ে বললেন,” আপনার ইউরিন লাগবে আপু। আমি একটা টেস্ট করবো। কিন্তু আপনার হাজব্যান্ড জানলে আবার ব্যস্ত হয়ে উঠবেন। তাকে না বলাই ভালো।”

উষ্ণতা টেস্টটিউব হাতে নিতে নিতে বলল,” আমিও সেটাই বলতে চাইছিলাম৷ ভাগ্যিস আপনি বলে দিলেন৷ আমাকে কি কর‍তে হবে?”

” বাথরুমে গিয়ে ইউরিন নিয়ে আসুন। এদিক দিয়ে তো যেতে পারবেন না। এই দরজা দিয়ে যান। একটা লম্বা করিডোর পড়বে। তারপরেই বাথরুম। এই ঝুমুর, ম্যাডামের সাথে একটু যাওতো।”

” হাতের কাজটা সেড়ে নেই ম্যাম?”

” কাজ পরে করবে। আগে ম্যামের সাথে যাও।”

উষ্ণতা বলল,” থাক, লাগবে না তো ম্যাডাম। আমি একাই পারব।”

” পারবেন তো?”

” নিশ্চয়ই! ”

উষ্ণতা করিডোরে এসেই আবারও ব্যথা অনুভব করল। কেমন যেন পিপড়ার কামড়ের মতো লাগছে। সে ব্যথার জায়গায় হাত রেখে বসে পড়ল মেঝেতে। হঠাৎ এক তরুণ এসে তাকে বলিষ্ঠ হাতে আগলে ধরল। বিশালদেহী, লম্বা সেই তরুণের তার মুখের দিকে চেয়ে বিস্মিত হলো উষ্ণতা। পর মুহূর্তেই মৃদু হেসে বলে উঠল,” কেমন আছো, বাজে ছেলে?”

এতোবছর পর আবার এই ডাকটা শুনে ইয়ামিন থমকাল। অপ্রস্তুত কন্ঠে বলল,” ভালো। আর আপনি? কেমন আছেন উষ্ণতা মিস?”

উষ্ণতা হেসে ফেলল। ঝরঝরে, সুন্দর হাসি! বলল,” অবশেষে আমাকে মিস বলে ডাকলে তুমি!”

ইয়ামিন হাসল এবার। উষ্ণতা তাকে দেখতে দেখতে বলল,” অনেক বড় হয়ে গেছো। আর হ্যান্ডসামও। মেয়েরা তাহলে এমনি এমনি তোমার উপর ফল করে না!”

ইয়ামিন কি বলবে বুঝতে না পেরে লাজুক হাসল। উষ্ণতা চোখ-মুখ কুঁচকে বলল,” প্লিজ হেল্প মি.. আমি দাঁড়াতে পারছি না।”

” হুম, নিশ্চয়ই..”

ইয়ামিন খুব সাবধানে উষ্ণতাকে উঠিয়ে দাঁড় করাল।

চলবে