#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-২২]
~আফিয়া আফরিন
রাফির মেসেজ সাথে সাথে এল। যেন সে জুহির একটা মেসেজের অপেক্ষাতেই বসে ছিল। একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে টাইপিং করল, ‘জুহি? তুমি সত্যি? কোথায় আছ তুমি? প্লিজ, একটাবার দেখা করার সুযোগ দাও। আমি তোমার সাথে একবার দেখা করতে চাই। একটা কথা জানতে চাই। তোমাকে কিছুক্ষণ অনুভব করতে চাই, যাতে পরবর্তীতে হারিয়ে গেলেও আমার আফসোস না হয়!’
জুহি মুচকি হাসল। মনে মনে বলল, ‘যেখানে সারাজীবন ধরে রাখার সুযোগ পাচ্ছ, সেখানে পরবর্তীতে আফসোস করার প্রয়োজন কী?’ তবে রাফিকে জানাল না নিজের মনের অব্যক্ত অনুভূতি।সে পাল্টা উত্তর দিল, ‘আচ্ছা আমি কী আপনাকে আমায় তুমি সম্বোধনের অনুমতি দিয়েছিলাম?’
রাফি বোধহয় থমকাল। কিয়ৎক্ষণ বাদেই তার উত্তর এল, ‘সব অনুমতি নিতে হয় না, কিছু অধিকার বোধ আদায় করে নিতে হয়। তুমি চলে যাওয়ার আগে আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়েছিলে? আমি কেন নিব?’
তারপর দুজনের মধ্যে আরও বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো। রাফি বারবার জিজ্ঞেস করল জুহি কোথায় আছে? বলল না, উল্টো রহস্যময় হাসি জানান দিল; জুহি কোথায় আছে এটা রাফিকেই খুঁজে বের করতে হবে।
জুহি সিদ্ধান্ত নিল, আগামীকাল গোটা দিনটাই সে এখানে থেকে যাবে। ভাগ্যিস ঐ বাড়ি থেকে ফেরার পথে রাফির মা তাকে ফোন করেছিলেন। একরাশ তৃপ্তি নিয়ে জুহি আকাশপানে তাকাল। উফফ, বুকের উপর থেকে ভারটা নেমে গেছে। বেশ শান্তি লাগছে। তবে একপলক জাহিনের পক্ষ থেকে আসা মেসেজটাতেও চোখ বুলিয়ে নিল। বুকের খুব গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
রাফির মনটা আজ বেশ ফুরফুরে। গতকাল রাতেই তো জুহির সাথে কথা হয়েছে, আজ মন বিষন্ন থাকলেও পাপ হবে। অভিমানে বেশ কয়েকদিন মায়ের সাথে ঠিকঠাক মত কথাও বলে নাই রাফি। আজ বলল, মন খুলে মনের সমস্ত কথা প্রকাশ করল। এতদিন তো তার হৃদস্পন্দন বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল, ছেলের খুশিতে ফের আনন্দের জোয়ারে ভাসলেন।
.
রাফি পরদিন ফের ছুটল চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে। জুহিও রওনা দিয়েছিল সকাল সকাল। আরেকদিন থেকে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে ছিল না। জুহি যখন বাড়ি এসে পৌঁছাল তখন দুপুর, মাথার উপর তপ্ত রোদ।
আজকের আবহাওয়াটা বেশ গরম। এতো দূর থেকে জার্নি করে এসে জুহি বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিছুক্ষণের মধ্যে গভীর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমাল। ঠিক সন্ধ্যার আগ মুহূর্তে ঘুম ভাঙল। মামা-মামী কেউ জুহিকে কিছু জিজ্ঞেস করল না। জুহিও নিজ থেকে কিছু বলে নাই। ওসব কথা মনে পড়লেই মন খারাপ হয়ে যাবে।
দিনের শেষে সূর্য তখন পশ্চিমে দেবে ডুব। নীল আকাশের বুকে পাখিরা উড়ছে হলদে ছায়ায়, পড়ন্ত বিকেলের রোদ এসে যখন সন্ধ্যা নামায়, উদাসী বাতাস এসে কত কথা চুপিসারে বলে যায়!
শেষ বিকেলের শান্ত আলো যখন শুন্য আঙ্গিনায় এসে ঠিকরে পড়ছে তখন জুহির কর্ণকুহরে পুরুষালী এক গম্ভীর কন্ঠ ভেসে এল।
‘শুভ সন্ধ্যা। গোধূলিলগ্ন মূর্ছা যাচ্ছে। হেই গোধূলী! তুমি প্রতিদিন নিয়ম করে এসো কিন্তু।’
জুহি পেছন ফিরে তাকাল। রুক্ষ এলোমেলো চুলগুলো কপালের উপর বিচ্ছিন্নভাবে লেপটে রয়েছে, চোখের নিচে কালশিটে দাগও পড়ে গেছে ছেলেটার।
জুহি রাফিকে দেখে বিন্দু পরিমান অবাক হলো না। যেন সে আগে থেকেই রাফির অপেক্ষায় রয়েছে। ওষ্ঠ্যদ্বয় প্রসারিত করে হাসল।
স্নিগ্ধকণ্ঠে রাফিকে শুধাল, ‘আরে গায়ক সাহেব যে! আপনি হঠাৎ করে এখানে? আরে আরে এমন একজন সেলিব্রেটির দেখা পাব জীবনে ভাবিও নাই। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আপনি জানেন আমি আপনার কতো বড়ো ফ্যান?’
সহসা রাফির মুখের ভাবভঙ্গি পাল্টে গেল। সে তীর্যক কণ্ঠে বলল, ‘এতো বড়ো ফ্যান বলেই বোধহয় এইভাবে মাথার উপর চরকির মতো ঘুরছিলে? তোমায় খুঁজতে খুঁজতে পাগল হয়ে গেলে কী তারপর দেখা দিতে? তুমি জানো, তুমি কতো বড়ো অন্যায় করে ফেলেছ!’
‘না জানি না তো।’ অবুঝ ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টে বলল জুহি।
জুহির নির্বিকার ভাবভঙ্গি রাফির ভালো লাগছিল না। জুহি কি জানে না, রাফি তাকে ভালোবাসে? তারপরও, এতো নিষ্ঠুরতা কেন? সারারাস্তায় জুহিকে কিছু কড়া কথা শোনানো দরকার ভেবে পথ এগিয়েছিল রাফি, কিন্তু মুহূর্তেই সবকিছু গুলিয়ে গেল। জুহিকে দেখা মাত্রই অভিমান নামক অনুভূতি পুনরায় ভালোবাসায় রুপ নিল। মেয়েটাকে দেখলেই যে ভীষণ ভালবাসতে ইচ্ছে হয়! জমিয়ে রাখা অভিমানগুলোও তো ভালোবেসে ফেলে।
রাফি রিক্ত কন্ঠে শুধাল, ‘আমায় কী আরো অপেক্ষা করতে হবে? আর কত অপেক্ষা করলে এই চোখে চোখ রাখবে জুহি!’
‘অপেক্ষা করিয়ে খুব কষ্ট দিলাম বোধহয়? ভালোবাসা কী এখনো আগের মতোই আছে, নাকি কষ্টের তীব্রতায় ভালোবাসা মূর্ছা গেছে?’
রাফি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল, ‘তোমাকে ভালোবাসার এই অদ্ভুত অসুখ আমার সারা জীবন থেকে যাবে। এই অসুখে ভুগে আমি হাসতে হাসতে জীবন দিয়ে দিতে রাজি!’
‘থাক থাক, ওতোদুর যেতে হবে না। আচ্ছা, এই কয়দিন আপনার কোনো গানের খবর পেলাম না কেন? আর চেহারার এই হাল করেছেন কেন? আয়হায় এতো অবনতি আপনার?’ কপাল চাপড়ে বলল জুহি।
‘সব তোমার জন্য, সবকিছু। আমার সব আনন্দ মিছিল তোমায় ঘিরে। যেখানে তুমি নাই, সেখানে আমার আনন্দ কি করে থাকবে? ভালো থাকতে দিয়েছ একমুহূর্তের জন্য? এভাবে পালিয়ে চলে এলে কেনো? মা যা বলছে, সেসব নিয়ে আমার সাথে আলোচনা করতে পারতে!’
জুহি চাপা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, ‘আমি চাই না, আমাকে নিয়ে কেউ আফসোস করুক। এজন্যই চলে এসেছিলাম, যাতে পরবর্তীতে কেউ আপনাকে আঙ্গুল তুলে কিছু বলতে না পারে। ঐ যে যার মা-বাবা নাই, তাকে কথা শোনানোর জন্য মানুষ মুখিয়ে থাকে সবসময়। এটা কতো বড়ো কলঙ্ক জানেন আপনি?’
‘তুমি মানুষের কথা ভাবলে তবুও একটাবার আমার কথা ভাবলে না? আর কলঙ্কের কথা বলছ? চাঁদেরও কলঙ্ক থাকে!’
‘চাঁদ আর আমি কি এক হলাম?’ চোখ তুলে তাকিয়ে পূর্ণদৃষ্টিতে কথাটা বলল জুহি।
‘কেন হবে না? চাঁদ এমন একটা জিনিস, দিনশেষে যেখানে মানুষ নিজের স্বপ্ন বুনে। একটুখানি প্রশান্তি খুঁজে পায়। ঠিক তুমিও আমার জীবনে সেইরকম একজন। কই, চাঁদের কলঙ্ক নিয়ে তো কখনো কেউ প্রশ্ন তোলে না? সেখানে তুমি আমি সাধারণ মানুষ, আমাদের গায়ে তো একটু কলঙ্কের ছিটেফোঁটা থাকবেই তাই না?’
সহসা জুহির সব অনুভূতি পাল্টে গেল। অভিমানে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত ভালোবাসা, অনুযোগ, প্রাপ্তির আশা যেনো নিজেদের আশ্রয়স্থল খুঁজে নিল। মনের গহিনে লুকিয়ে থাকা একরাশ প্রাণখোলা ভালোবাসা খুব সহজেই অপর পক্ষের মানুষের মর্ম বুঝতে পারল। রাফি তাকে ভালোবাসে, এই নিয়ে আর কোনো সংশয় নেই। একটা গেলে খুব সহজেই আরেকটা পাওয়ার— এই যুগে দাঁড়িয়ে রাফি তাকে এত ভালোবাসে! সবটাই তো শুনেছে। কিছুটা রাফির মায়ের মুখে আর কিছুটা মাহিদ ভাইয়ার কাছে।
তবুও মন মানছিল না। মনের সাথে দ্বিধাদ্বন্ধ করতে গিয়ে রাফির সাথে কথা বলে ফেলল। বুকের বাঁ’পাশে নতুন ভাবে এক অনুভূতির সৃষ্টি হল। এই অনুভূতির সাথে জুহি মোটেও পরিচিত নয়। তার এই অনুভূতির একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে শুধুমাত্র রাফি।
এইদিকে রাফির মন অগোচরে ভাবছে জুহির কথা। জানেনা, জুহি কি বলবে? কি করবে? জানতেও চায় না। শুধু চায়, এই বেলায় সে পৃথিবী হোক আর শত অভিমান সত্ত্বেও জুহি শুধুমাত্র তার কক্ষপথ জুড়েই ঘুরতে থাকুক।
অবশেষে নীরবতা মুক্তি পেল। জুহি মৃদু হাসল। খুব সহজ ভঙ্গিতে রাফিকে বলল, ‘কী বলেছিলে সব ভুলে গেছ? অনামিকাতে পূর্ণতা দিতে চেয়েছিলে না, তো দাও!’
রাফি চমকাল, থমকাল কিয়ৎক্ষণের জন্য। এই প্রথম জুহি তুমি সম্বোধন করেছে তাকে, মেনে নিয়েছে তার ভালোবাসা। চলে এসেছে হৃদয়ের খুব কাছাকাছি। অভিমান বোধহয় এভাবেই ভালোবাসা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু পরমুহূর্তেই রাফি অসহায় চোখে তাকাল। অনামিকাতে পূর্ণতা দিতে বলল জুহি? এখন আংটি পাবে কই সে? অথচ জুহি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। চোখের চাহনিতে উপচে পড়ছে ব্যাকুলতা। রাফি আশেপাশে তাকিয়ে ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে থাকা একটা টবে ভৃঙ্গরাজ ফুলের গাছ দেখতে পেল। তৎক্ষণাৎ রাফি একটা ফুল ছিড়ে নিয়ে এল। সেটাকে হাতের সাহায্যে পেঁচাল বৃত্তাকারে। তারপর জুহির অনামিকা আঙ্গুলে পড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এটা ইনস্ট্যান্ট। আমি তো আর জানতাম না, আজকেই ম্যাডাম আমায় এতো বড়ো একটা দায়িত্ব দেবে। জানলে তো আংটি পকেটে নিয়ে ঘুরতাম।’
জুহি হাসল। তার মনমাতানো হাসি জানান দিল, ইনস্ট্যান্ট উপহার তার খুব পছন্দ হয়েছে! তারপর কিছু না বলেই পিছু হটল। রাফি জুহির হাত ধরে তাকে আটকায়। জিজ্ঞেস করে, ‘কই যাচ্ছো? আবার আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ধান্ধা আঁটছো না তো?’
‘ধান্ধাই আঁটছি বটে! তবে পালিয়ে যাওয়ার নয়, পাকাপোক্ত ভাবে তোমায় নজরদারিতে নিয়ে আসার। জানতো, মামা-মামী না খুব বিয়ে বিয়ে করছে। এইবার তো মনে হয় আমার বিয়ের ফুলটা ফুটেই গেছে। যাই, তাদের গিয়ে বিয়ের বন্দোবস্ত করে আসতে বলি।’
.
.
.
চলবে…
#মন_কারিগর🩷 [পর্ব-২৩]
~আফিয়া আফরিন
রাফি যারপরানই বিস্মিত হলো। বিয়ে? জুহি সত্যি বলছে তো? স্বপ্নের দিন এতো তাড়াতাড়ি আসতে চলেছে?
শুধু এইটুকুই না, রাফি যখন এই বাড়িতে নিজের মা-বাবাকে দেখল তখন অবাক এর অষ্টম, নবম সীমানা টপকে দশমে পৌঁছাল। রাফির মা-বাবাও জুহির মামা মামীর সাথে বিয়ের আলোচনা করছিলেন। রাফি শুধু অবাক হয়ে ভাবছিল, সবটা কি পূর্ব পরিকল্পিত? জুহিকে বারবার জিজ্ঞেস করেও উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না। জুহি শুধুমাত্র রহস্যময় হাসি হেসে রাফির কথাগুলো এড়িয়ে গেছে।
সে রাতেই দুজনের বিয়ের দিন ঠিক করা হলো। পরদিন ছোটখাটো আয়োজনের মাধ্যমে খুব কাছের কিছু আত্মীয়-স্বজন নিয়ে বিয়েটা হবে। সিদ্ধান্তটা যেহেতু হঠাৎ করেই নেওয়া হয়েছে, সেহেতু আফসার তালুকদার বেশ বিপাকে পড়ে গেলেন। খুব ইচ্ছে ছিল, একমাত্র ভাগ্নির বিয়েটা ধুমধামের সহিত দিবেন। সেটা তো হচ্ছে না, তবে যেটা হচ্ছে সেটাও খারাপ না। সবকিছুর শেষে মেয়েটা তো নিজের পছন্দের মানুষকে বিয়ে করতে পারছে!
জুহি পুরোটা সময় নির্বিকার রইল। কিন্তু রাফি উসখুস করতে লাগল, সমস্ত ঘটনাটা জানার জন্য। একবার মায়ের কাছে গেল; কিন্তু মা যেহেতু বড়দের সাথে গল্প করছিলেন তাই রাফিকে খুব একটা পাত্তা দিল না। তারপর এল জুহির কাছে, কিন্তু সেখানেও মাহিদের কাছে ধমক খেয়ে ফিরে আসতে হলো। মাহিদ বেশ জোরে একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘বিয়ে না হতেই তুই আমার বোনের পিছে পিছে ঘুরছিস? এতো বড়ো সাহস তোর? দেখ রাফি, বেশি বাড়াবাড়ি করলে কিন্তু আমি বিয়ে-শাদি বাতিল করে দেব।’
রাফি সত্যি বিয়ে বাতিলের ভয়ে সরে গেল আর জুহি হেসে কুটিকুটি হলো। পরে অবশ্য রাফি জানল, ঘটনা যা ঘটেছে সবটাই পূর্ব পরিকল্পিত।
সায়রা হক গতপরশু জুহিকে ফোন করেছিলেন, যখন জুহি তার বাবার সাথে কথা শেষ করে ফিরছিল। ফোন নাম্বারটাও মাহিদের কাছ থেকে যোগাড় করেছে। সায়রা হক ফোন করার পর যখন নিজের পরিচয় দিলেন, তখন জুহি অবাক না হয়ে পারল না। রাফির মা কেন হঠাৎ করে তাকে ফোন করতে যাবে? সে তো রাফির জীবন থেকে সরে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। এখন কি আবার তাকে কথা শুনতে হবে?
জুহির ধারনা ভুল প্রমাণ করে সায়রা হক ফোনের ওপাশেই কাঁদতে আরম্ভ করলেন।
জুহি অপ্রস্তুতবোধ করল। কী বলবে কিছু ভেবে পেল না। ঠিক সেই মুহূর্তে সায়রা হক বলতে শুরু করলেন, ‘তুমি ফিরে এসো মা। আমি কি না কি বলেছি, ওতোসব মনে রেখ না। নিজের মা মনে করে মাফ করে দিও। এতোদিন বুঝি নাই, তবে এখন হারে হারে টের পাচ্ছি আমার ছেলেটা তোমায় প্রচন্ড ভালোবাসে। নাওয়া-খাওয়া, নিজের গান, শখ আহ্লাদ সব ছেড়ে দিকদ্বিক জ্ঞানশূন্য হয়ে গেছে। অন্ততপক্ষে ওকে ভালোবাসার জন্য হলেও ফিরে এসো। আমায় খুব স্বার্থপর ভাবছ, আমি জানি। ভাবছ তো, নিজের ছেলের সুখের জন্য তোমায় আপন করে নিচ্ছি? কিন্তু না, আমি মন থেকেই বলছি। আমায় কি রিক্তহস্তে ফিরিয়ে দেবে?’
জুহি ফেরাতে পারে নাই তাকে। তিনি জুহিকে এটাও বলেছিলেন, রাফি কীভাবে ছোট বাচ্চাদের মত শখের জিনিসের জন্য তার কাছে বায়না ধরেছিল। সায়রা হক নিজেই তুলেছিলেন বিয়ের কথা। মাহিদের সাথে যোগাযোগ করে এইদিকে সব বন্দোবস্ত করে রেখেছেন। জুহি না করতে পারল না, ইভেন সে মন থেকে না বলতেও চাচ্ছিল না। যে খুব সন্তর্পণে বুকের ভেতরের মরুভূমির বালিতে ভালোবাসা নামক অনুভূতির শিকড় তুলে দিয়েছে, তাকি ফিরিয়ে দেওয়ার সাহস বা সামর্থ কোনটাই জুহির পক্ষে সম্ভব নয়।
রাফি সবটা শুনে জুহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে এইবার বলে দাও, ভালোবাসি।’
জুহি রাফির দিকে এমন ভাবে তাকাল, যেন জুহিকে কেউ জোর করে করলার রস খাইয়ে দিয়েছে। রাফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কি হলো কি? এমন করছ কেন? বলে দাও!’
জুহি নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘কেন বলব? আমি কি তোমাকে ভালবাসি নাকি? নেহাত আন্টি আমায় অনুরোধ করল, তাইতো রাজি হলাম বিয়েতে। তোমায় ভালোবেসে রাজি হয়েছি নাকি?’
রাফি অবাক বিস্ময়ে শুধাল, ‘তারমানে তুমি আমায় এখনো ভালবাসো না?’
‘একদমই না।’ মুখ ঘুরিয়ে বলল জুহি।
‘তাহলে বিয়ে কেন করছ?’ রাফির কণ্ঠে প্রবল বিষ্ময়।
‘ওই যে বললাম আন্টির অনুরোধ রক্ষার্থে!’
‘না না এসব তো হবে না। যেদিন তুমি আমাকে ভালবাসতে পারবে, সেদিনই আমি তোমাকে বিয়ে করব। পরে দেখা গেল, তুমি আমাকে ভালোই বাসলে আর কখনো! তখন? থাক আমি গিয়ে সবাইকে না করে আসি।’
রাফি চলে যেতে উদ্যত হল। জুহি আচমকা তার শার্টের কলার চেপে ধরে বলল, ‘এই ছেলে, নকশা কম করো। যা হচ্ছে চুপচাপ দেখে যাও। ব্যাগরা দেওয়ার চেষ্টা করলেই একদম খুন করে ফেলব।’
রাফি মাথা চুলকে বলল, ‘কিন্তু তুমি তো ভালোবাসো না!’
‘তো? তাতে কি কোনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে? আমার জানামতে কিছুই হচ্ছে না। এত ভালোবেসে কী হবে? শোনো, তোমার সাথে আমার কথা আজকের মত শেষ। এখন যাও, মাহিদ ভাইয়ার সাথে গিয়ে লক্ষ্মী ছেলের মত ঘুমিয়ে পড়ো।’
রাফি পুনরায় কিন্তু কিন্তু করতে লাগল। কিন্তু জুহি আর কোন কথা কানে তুলল না। রাফিকে এক প্রকার ঠেলে ঘরে পাঠিয়ে দিল। রাফির দেওয়া ফুলটি যত্নসহকারে রেখে দিয়েছিল। সেটাকে আরেকবার ছুঁয়ে দেখল। হলুদ রঙের ফুলটা ইতিমধ্যে নেতিয়ে পড়েছে। জুহি পাঁপড়িগুলো আলতো করে ছুঁয়ে দিয়ে একটা ডায়েরীর ভাঁজে যত্ন করে রেখে দিল। তারপর আপনচিত্তে কিছু অনুভূতি ডায়েরী বদ্ধ করল। রাফিকে নিয়ে অগোছালো কিছু ভাবনা মস্তিষ্কে হানা দিল। তারপর স্বাগতিক্ত কণ্ঠে ফিসফিসিয়ে নিজের উদ্দেশ্যে বলল, ‘আই অ্যাবসেলেউটলি লাভ ইউ, মোর দ্যান ইউ!’
.
কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকাল। পান্ডুর প্রকৃতির মাঝে এক ধরনের নীরব সৌন্দর্য বিদ্যমান। ঘাসের ডগায় মুক্ত দানার মত শিশির বিন্দু জ্বমছে। কুয়াশার চাদর সরিয়ে খুব দৃঢ়ভাবে সূর্যিমামা উঁকি দিচ্ছে। তবুও প্রকৃতিতে কুয়াশায় ভেজা রেশটা যেন থেকেই যায়।
আজ জুহির বিয়ে। বিষয়টা ভাবতেও কেমন অবিশ্বাস্য ঠেকছে। দুইদিন আগ পর্যন্ত যেই বিষয়টা ভাবনাতেও আসে নাই, সেটা কল্পনাকে ছাপিয়ে বাস্তবে রূপ নিচ্ছে।
মিমি আর তার বর সাইমুম সকাল সকাল চলে এসেছে। এসেই নানান রকমের তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। হালকা পাতলার মধ্যে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হবে, মিমি এসে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে যদিও জুহির এতে কোন আগ্রহ ছিল না।
বিয়ের ঠিক কিছু মুহূর্ত আগে উপস্থিত হলেন রাশেদ চৌধুরী, জাহিন এবং মাইমুনা। উপস্থিত মেহমানের মধ্যে অনেকেই তাদেরকে চেনে না, কিন্তু আফসার তালুকদার আগত অতিথিদের চিনতে কালবিলম্ব করলেন না।
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা এখানে?’
উত্তর দিল জুহি। ‘আমি তাদেরকে আসতে বলেছি মামা। আসলে সেদিন আমি একদমই নিজের মধ্যে ছিলাম না। কি বলতে কী বলে ফেলেছি নিজেও জানিনা। পাপ মোচনের সুযোগ পেয়েছি, সেটা কি ছেড়ে দেওয়া উচিত বলো?’
আফসার তালুকদার কিছু বললেন না কিন্তু বেশ খুশি হলেন। একপর্যায়ে বললেন, ‘তুই গোপনে এত কিছু করে ফেলেছিস? তাইতো বলি ওখান থেকে আসার পর তো তোর মন মেজাজ এত ভালো হওয়ার কথা না। জীবনে যত সুখের ঘটনাই ঘটে থাকুক না কেন, তোকে তো চিনি আমি! তাদের নিমন্ত্রণ করার কারণেই বুঝি মনটা বেশ ফুরফুরে?’
জুহি হ্যাঁ সুচক সম্মতি জানাল। গতরাতে জাহিনের একটা মেসেজ এসেছিল।
—“জুহি এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল অথচ তুমি আমাকে কিছু জানালে না? আমার বাবাও যে তোমারই বাবা সেটা তো মাথাতেই আসে নাই কখনও আর আসার কথাও তো ছিল না। যাই হোক না কেন, তুমি এভাবে চলে কেন গেলে? একবার তো আমার সাথে কথা বললেও পারতে! তুমি জানো বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে? তুমি কী বলেছ আমি জানিনা, কিন্তু উনি তোমার কথাগুলো নিতে পারছেন না।”
তারপর ফোন করে জাহিনকে সমস্ত ঘটনা বলেছে। সাথে দুঃখ প্রকাশও করেছে। তখনই জাহিনকে বলে দিয়েছে তাদের এখানে আসার কথা। রাশেদ চৌধুরী মূলত তার মেয়ের কারণেই এখানে এসেছেন। হয়ত আবেগের বশবর্তী হয়ে একটা ভুল করে ফেলেছেন, কিন্তু শেষ বয়সে এসে তার নিজের মেয়েকে দেখার সুযোগ পাচ্ছেন; এই লোভটাকে কি এড়ানো যায়?
এখানে আসার পর জুহি উনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। রাশেদ চৌধুরী নিজেও জুহির কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। বলেছেন, ‘মা, ক্ষমার অযোগ্য মানুষটিকে ক্ষমা করা যায় না?’
উত্তরে জুহি বলেছিল, ‘আমার জীবনে খুব শিক্ষণীয় কিছু বিষয় আমি আমার মায়ের কাছ থেকে শিখেছি। তারমধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য ক্ষমা নামক এই সাধারণ শব্দটা। করো প্রতি চাপা অভিমান বা রাগ আমি আমার ভেতর পুষে রাখতে চাই না। এতে আমার ভেতরেই অশান্তি সৃষ্টি হবে। অযাচিত অশান্তি সৃষ্টি করে আমি আমার সময়টা নষ্ট করতে চাই না। তাই আপনি কোনোরূপ অপরাধবোধ মনে রাখবেন না। আমার মা আপনাকে যেই মুহূর্তে ক্ষমা করে দিয়েছে, আমিও ঠিক সেই সময় আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি।’
শুধুমাত্র নিজের মনের শান্তির জন্যই অতীতকে তার সামনে নিয়ে আসা। কোনো অভিমান, অভিযোগ, জীবনের প্রতি একঘেঁয়েমি, কারো উপর চাপা রাগ রেখে সে কিছুতেই নতুন জীবনে পা রাখতে পারে না। সব ভুলতে হবে, নিজের ভালো থাকার জন্য ভুলতে হবে। অপ্রাপ্তির আর কোনো স্থান জুহি তার নিজের জীবনে থাকতে দেবে না।
সবকিছু ভুলে খুব সুন্দর ভাবে অনাদরের সমাপ্তি ঘটল এবং সূচনা হলো নতুন এক জীবনের।
সেই রাতে বিয়ে নামক দুটি শব্দের মাধ্যমে সারা জীবনের জন্য বাঁধা পরল জুহি আর রাফি।
সেইদিন জুহি সারাজীবন ভরসা করার মতো একটা মানুষ পেল। সে সারাজীবন এমন একটা মানুষকে চেয়েছিল যার কাঁধে মাথা রেখে জুহি নিরুপদ্রব ভাবে অশ্রু বিসর্জন দিতে পারবে এবং জীবনের সব কষ্ট গুলোকে ধুয়ে মুছে ফেলতে পারবে। জুহি তাই করল, সেই রাতে নিজ মস্তক এলিয়ে দিল রাফির স্কন্ধে। সারারাত চোখের অশ্রু বিসর্জন দিয়ে গেল। মনে পড়ে গেল জীবনের সকল অতীত অধ্যায়, মায়ের কথা মনে পড়ল, বাবার কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল সমস্ত দুঃখবিলাস।
রাফি শুধুমাত্র এক মুহূর্তের জন্য জুহিকে জিজ্ঞেস করল, ‘এতো কাঁদলে চলবে কী করে?’
জুহি বাচ্চাদের মতো উত্তর দিল, ‘কাঁদতে ইচ্ছে করছে। তুমি কেন আমায় থামাচ্ছ না?’
‘কাঁদতে ইচ্ছে করলে কাঁদো। আমি থামাব কেন?’
‘তারমানে তুমি আমায় কাঁদতে বলছ? আশ্চর্য!’
‘হ্যাঁ বলছি।’
জুহি ওষ্ঠ্যদ্বয়ের নিম্নভাগ উল্টে অভিমানী স্বরে বলল, ‘কেন কাঁদতে বলছ?’
রাফি হেসে স্বাগতিক্ত করল, ‘আমি চাই আজকের কান্নাটাই তোমার জীবনের শেষ বিষাদের কান্না হোক। এরপরও তুমি কাঁদবে, তবে সেটা আনন্দে। আজকে যত খুশি দুঃখের কান্না কেঁদে নাও। আমার জীবনে প্রবেশ করেছ, আর একমুহূর্তের জন্য আমি তোমার চোখে দুঃখের কান্না দেখতে চাই না।’
জুহি এইবার চোখের পানি মুছে হেসে ফেলল। তারপর বলল, ‘সব দুঃখের কথা আজকে মনে পড়ে গেছিল। মনে হচ্ছিল জীবনে অনেক অন্যায় করে ফেলেছি। কিন্তু তোমার কথা শুনে কি মনে হল জানো?’
‘কী?’
‘জীবনে বোধহয় অজান্তে কোন পূর্ণ করে ফেলেছিলাম ফলস্বরূপ তোমাকে পেয়েছি। তুমি এতো ভালো কেন রাফি?’
রাফি হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘আমি ভালো হলে কী হবে, তুমি তো আমায় ভালই বাসো না!’
জুহি নির্নিমেষ চেয়ে রইল। ভালোবাসি কথাটা মুখে বলে দিলেই কি ভালোবাসা প্রকাশ হয়? জুহির যে একশভাগ বিশুদ্ধ নির্ভেজাল প্রেম দরকার, যে প্রেমে কথার আগায় মাথায় ভালবাসি ভালবাসি থাকবে না। যে ভালবাসায় কখনো মনের আঁশ মিটবে না, কিন্তু সে ভালোবাসা টা হবে একদম অবমুক্ত!
.
.
.
চলবে….
[কার্টেসি ছাড়া কপি করা নিষেধ]
শব্দ সংখ্যা—১৫৫০