চুপিসারে পর্ব-২+৩

0
343

#চুপিসারে (২ + ৩)
কলমে #রেহানা_পুতুল

দাদী,চাচী, আরু সবাই কই?
সকাল না ফুরাতেই ঘরের ভিতর পুরুষালী ভরাট চেনা কন্ঠের ডাক শোনা গেলো। নদী লজ্জায়,সংকোচে,ভয়ে রুম থেকে লুকানোর প্রস্তুতি নিতে লাগলো। তার বুকের ভিতরে ধুকপুক করছে মানুষটার গলা শুনেই। ছোটবেলা থেকেই নদী তাকে ভয় পেয়ে আসছে।

আরেহ শ্রাবণ যে। আসো বাবা আসো। কালতো তোমার নির্বাচন। চাচী মন থেকে দোয়া করি তোমার জন্য। এই পরিবারের সবার বড় তুমি। মান যেনো থাকে আমাদের।

দরদের সুরে বলল নাহার বেগম।

ইনশাআল্লাহ চাচী।

হাফসা বিবিও নাতির মাথায় আশীর্বাদের হাত বুলিয়ে দিলো। কলেজ জীবন থেকেই নানাভাবে রাজনীতির সাথে জড়িত এই চেয়ারম্যান পদের পার্থীর নাম ইশতিয়াক দেওয়ান। ডাক নাম শ্রাবণ। নদীর বড় চাচা রফিক দেওয়ানের বড় ছেলে সে। অর্থনৈতিক অবস্থা বেশ সচ্ছল তাদের। তাই বাড়ি থেকে একটু দূরে নিজেদের ধানি জমি বাঁধাই করে পাকা দোতলা বাড়ি করেছে রফিক দেওয়ান।

শ্রাবণ অনেকটা শখের বশে ও এলাকার বন্ধুদের উৎসাহেই নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীর জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে পরিবারের সবার সাপোর্ট।

নাহার বেগম তোড়জোড় শুরু করলো নাস্তা দেওয়ার জন্য। শ্রাবণ তাড়া আছে বলে চাচীকে থামিয়ে দিলো ব্যস্ত গলায়। নাহার বেগম ঘরের কাজে মন দিলো অন্যদিকে গিয়ে।

শ্রাবণ দাদী, চাচীকে মুখে সালাম দিয়ে পা বাড়ালো চলে যাওয়ার জন্য। তিন পা এগিয়ে পুনরায় পিছিয়ে এলো পা ঘুরিয়ে।

কিরে ভাই মোবাইল থাইকা গ্যাছে?

নাহ। দাদী,শুনলাম নদী পরিক্ষা দিবে নাকি এখানে থেকেই ? বইপুস্তক নিয়ে একবারেই চলে এসেছে?

হ। হাঁচাই হুনছস ভাই। পোড়া কপাল ছেমরির। যাইবো কই আর।

কই এখন নদী?

মনে হয় রুমের ভিতরেই আছে। হাফসা বিবি টেনে টেনে নদী সম্পর্কে আরো কিছু বলতে গিয়েও পারলো না। শ্রাবণ বলল,

দাদী নির্বাচনের পরে ওর বিষয়ে সব আলোচনা করবো বসে। এখন আমার জরুরী কাজ চারদিকে। যেতে হবে।

আইচ্ছা ভাই। তাইলে চইলা যা।

তাকে দেখেই যাচ্ছি দাদী।

নদী রুমের দরজায় পা রাখতেই শ্রাবনের মুখোমুখি হয়ে গেলো। শ্রাবণ দরজার দু’পাশে দু’হাত রাখলো। নদীর বের হওয়ার সুযোগ নেই। সে স্ট্যাচু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো নিচু মাথায়।

শ্রাবণ দৃষ্টিতে কাঠিন্যতা এনে নদীর দিকে চাইলো।গম্ভীর কন্ঠে শাসনের সুরে বলল,

চোরের মতো পালাচ্ছিস কেন? মায়ের মুখে যেটা শুনলাম, তার শাস্তি পাওনা তুই।নির্বাচন শেষ হোক তারপর। ভিতরে গিয়ে পড়তে বোস। ফাজিল কোথাকার।

নদী নিরব রইলো। মেলানো ঠোঁট ফাঁক করলো না। বিরস মুখে খাটের এক কোনায় গিয়ে দপ করে বসে পড়লো।

আরু চেয়ারে বসা থেকে মুখ টিপে টিপে হেসে যাচ্ছে। শ্রাবণ তার দিকে চেয়েই হালকা মেজাজে ধমকে উঠলো,

এই? তোর আবার কি হলো? জ্বীন ভর করেছে নাকি? তোরও পানিশমেন্ট আছে কিন্তু।

মুহূর্তেই আরুর মুখের হাসি মিলিয়ে গেলো। মাথা নিচু করে খাতায় আঁকিবুঁকি কাটতে লাগলো।

শ্রাবণ ঘর থেকে বের হয়ে উঠান ডিঙিয়ে কাচারিঘরের সামনের দিকে চলে গেলো।

পিছন দিয়ে আরু শব্দ করে হেসে উঠলো । তার সঙ্গে চাপা হাসি দিয়ে উঠলো নদীও।

হুহ! আইছে দেওয়ান বাড়ির দেওয়ান ঘরের বড় দেওয়ান। কর্তাগিরি ফলায় সবার উপরে।

কপাল ভাঁজ করে ঠাট্টাচ্ছলে বলল কিশোরী আরু।
পাশ থেকে নদী ভারকন্ঠে আরুর দিকে চেয়ে বলল,

বড় ভাইয়া যদি চেয়ারম্যান হয় তাহলে আমরা নির্যাতিত হবো বেশি। বাইরের ক্ষমতা ভিতরে দেখানো শুরু করবে উনি।

আপা একদম ঠিক বলছিস। তবে তুই সবচেয়ে বেশি সাফারার হবি। কারণ তুই বেশী ডরাস বড় ভাইয়াকে।

আমি ডরাই আর তুই কি করিস?

ইসসইরে..আমি কি ডরাই তাকে?

তাতো একটু আগেই দেখলাম। কেমন বিলাই হয়ে গিয়েছিলি? বলল নদী।

আমি বিলাই হয়ে এককোনায় ঘাপটি মেরে বসেছিলাম। আর তুই? তুইতো ইন্দুর হয়ে গর্তে ঢুকে গিয়েছিলি। হিঃহিঃহিঃ!

মিটমিটিয়ে হেসে বলল আরু। এবং নদীর কানে গিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল,

আপা শোন, মিস্টার ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ ভাই যদি নির্বাচনে হেরে যায়। আমি মিষ্টি খাওয়াবো তোকে। নামাজ পড়ে দোয়া কর তুই। আল্লাহ অভাগীর প্রার্থনা কবুল করবে। দেখিস। তোর ভালোর জন্যই বলছি আমি।

নদী নাক কুঁচকে আরুর মুখপানে চাইলো। এরপর দাদীর ডাকে রুম থেকে বেরিয়ে নদী।

নাহার বেগমের মোবাইল বেজে উঠলো। নদীর মা রুবিনা ফোন দিলো। একমাত্র মেয়ের খবর নেওয়ার জন্য ফোনকল ছাড়া বিকল্প কোন মাধ্যম নেই তার কাছে। দুই গ্রামের দূরত্ব অনেক। চাইলেই কাউকে পাঠিয়ে খবর নেওয়া যায় না। অপরদিকে তার বাবার বাড়ির কাউকে দেখলে হাফসা বিবি ক্ষেপে উঠে অকারণেই। এদিকে নদী ছোট। তাই তার হাতে মোবাইল নেই। নদীর দাদীর বয়স্কা মহিলা। তার হাতেও কোন মোবাইল নেই। আরুর বাবা শফিক থাকে শহরে। নদীর বড় চাচার পরিবারের বাস ওদের নতুন বাড়িতে। সুতরাং মেজো জা নাহারের মোবাইলের উপরেই নির্ভর করে থাকতে হয় রুবিনার। নাহার বেগম কোনরকমে দায়সারাভাবে রুবিনার সালামের জবাব দিলো। এবং ছলছলিয়ে উঠলো। অসহিষ্ণু স্বরে ঝাড়তে লাগলো নদীর মাকে।

এত ঘন ঘন ফোন করা লাগে? সময় অসময়ে ফোন দেস ক্যান? ঢং দেখলে বাঁচি না! এতই যখন মেয়ের জন্য দিল পুড়ে তাহলে কাছে রাখতি পারলি না? আমার মাথার উপরে পাঠায়া দিলি ক্যান? পরের মাথায় নুন রাইখা বরই খাইতে খুব স্বাদ লাগে নাহ?

ফোনের ওপাশ থেকে আর কোন কথা প্রবেশ করল না নাহারের কর্ণকুহরে। পট করেই মোবাইল রেখে দিলো রুবিনা। নাহার বেগম মোবাইলকে চোখের সামনে এনে দেখলো। পরক্ষণেই ঠোঁট উল্টিয়ে ভেংচি কেটে বলল,দেমাগ কি তার!ঠাস করে আমার মুখের উপর লাইন বন্ধ কইরা দিলো?

রুবিনা ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। তার কোন অভিযোগ নেই কারো উপরে। সমস্ত অভিযোগ নিয়তির উপরে। নয়তো কেন তাকে ভুলভাল ছুতোয় বাবার বাড়ি এক কন্যাসহ তাড়িয়ে দিলো স্বামী ও শ্বাশুড়ি।

আজ দেওয়ান পরিবারে খুশীর উপচে পড়া আমেজ। উপলক্ষ নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান শ্রাবণ। তার বাবা মা সহ গোটা পরিবার পুরনো বাড়িতে চলে এসেছে আনন্দ ভাগ করে নিতে। সঙ্গে এনেছে ভ্যান ভর্তি বাহারি পদের মন্ডা মিঠাই। তার দুই ফুফু, নানা নানি, খালারাসহ নিকটাত্মীয়ের ভীড় ঘরভর্তি। উচ্ছাসে মেতে আছে সারাঘর। রজত ও উপস্থিত রয়েছে। মামাতো ভাইয়ের জন্য কম খাটেনি নির্বাচন নিয়ে। মোবাইলে, সামনে,যার যার মতো করে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিচ্ছে সকলে। একে অপরকে মিষ্টি খাইয়ে দিচ্ছে। সারা বাড়ি ও পাশাপাশি বাড়িতে মিষ্টি বিতরণ করা হচ্ছে। দুই হাঁড়িতে ভাগ করে দুধ চা ও মসলা চা তৈরি হলো। চা পরিবেশন হচ্ছে।

মোরশেদা ছেলেকে আদেশ দিয়ে বলল,

বাবা তোর দাদীকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দে।

শুধু দাদী কেন মা,সবাইকেই খাইয়ে দিব আমার হাতে। এই বলে শ্রাবণ মা,বাবা,দাদী সহ একে একে সবাইকে নিজ হাতে মিষ্টি খাইয়ে দিলো। বাকি গেল না রজতও। রজতকে বুকে জড়িয়ে থ্যাংকস জানালো।

রজতের দুচোখ নদীকে খুঁজে ফিরছে। এছাড়া নদীকে কেউই খুঁজছে না। সবাই সবার মতো উপভোগ করছে মুহূর্তগুলোকে। এই খুশীর কলরবে নদী অনুপুস্থিত। এটা রজতের খারাপ লাগলো। তার ভিতরটা ভারাক্রান্ত হলো নদীর কথা ভেবেই। সে নদীকে খুঁজে বের করলো। নদী রান্নাঘরে জলচৌকির উপরে বসে আছে অবাঞ্চিতের মতো।

কিরে নদী এখানে বসে আছিস কেন? নে ধর খা। বলেই সাদা একটা মিষ্টি নদীর মুখে তুলে ধরলো রজত।

নদী রজতের এক হাত ধরলো। মিষ্টিতে কামড় বসিয়ে কিছুটা মুখে পুরে নিলো। অমনি দেখে রান্নাঘরের দরজায় শ্রাবণও এলো। তার হাতেও একটি সাদা মিষ্টি।

নদী অপ্রস্তুত হলো ভীষণভাবে। শ্রাবণও ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো দৃশ্যটি দেখেই। শ্রাবণের প্রাণবন্ত চেহারা রুক্ষ হয়ে গেলো কিছু একটা ভেবেই। সে কিছু বলল না রজত ও নদীকে। নিঃশব্দ পায়ে সরে গেলো সেখান হতে।

নদীর বড় ফুফু রাফিয়াকে বেশ ফুরফুরে দেখা যাচ্ছে। কিছুটা অন্যদের চেয়ে বেশী। সে রঙ চায়ের কাপে, হাতে ভাজা মুড়ি মিশিয়ে নিতে নিতে বলল,

আমাদের ঘরে আজ মহাৎসোব। আজকার এই সময়ে আমি বড় ভাইজানের কাছে ও মেজোভাবির কাছে একখান প্রস্তাব রাখতে চাই। বাকিরাতো আছেনই।

তারা অবাক চোখে কিহ বলে রাফিয়ার দিকে চাইলো।
সে দরদ মাখা সুরে বলল,

আরুকে রজতের জন্য আমার ঘরে নিতে চাই। তবে এখন না। তার পড়াশোনা শ্যাষ হইলে।

নাহ ফুফু। রজতের বিয়ে হবে নদীর সঙ্গে।

দ্বিতীয় কেউ কিছু বলার আগেই ভারি গলায় কথাটা বলে উঠলো নব নির্বাচিত চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান।

#চুপিসারে #রোমান্টিক
চলবে…২

#চুপিসারে ( ৩)
কলমে #রেহানা_পুতুল
আরুকে রজতের জন্য আমার ঘরে নিতে চাই। তবে এখন না। তার পড়াশোনা শ্যাষ হইলে।

নাহ ফুফু। রজতের বিয়ে হবে নদীর সঙ্গে।

দ্বিতীয় কেউ কিছু বলার আগেই কথাটা বলে ফেলল চেয়ারম্যান ইশতিয়াক।

উপস্থিত সকলেই যেন শুকনো মাটিতে হোঁচট খেলো। তারা হতভম্ব চাহনিতে শ্রাবণের দিকে চাইলো। শ্রাবণের বাবা রফিক দেওয়ান বিরক্ত হলেন ছেলের উপরে। চট করেই বলে উঠলেন ছেলের উদ্দেশ্যে,

শ্রাবণ, তুমি যেমন আমাদের তিন পরিবারের বড় সন্তান। সবাই তোমার কথাবার্তার গুরুত্ব দেয়। কাজে কর্মে তোমার পরামর্শ চায়। তেমনি আমিও আমাদের পরিবারের বড় সন্তান। এখনো জীবিত আছি তোমার চোখের সামনে। তোমার ফুফু কথাটা বলেছে আমার কাছে ও তোমার মেজো চাচীর কাছে। সেখানে তুমি কর্তৃত্ব ফলানো অনুচিত। তুমি চেয়ারম্যান হয়েছো। নিঃসন্দেহে তুমি সর্বত্র মর্যাদাবান। কিন্তু পারিবারিক সব বিষয়ে তুমি হস্তক্ষেপ করবে না। জন্ম মৃত্যু বিয়ে আল্লাহর হাতে। এসব নিয়ে মর্জিমতে কিছু বলে ফেললেই হয় না।

হাফসা বিবি পুত্রকে থামালেন মৃদু ধমকে। বললেন,

থামতো শফিক। মুখ ফসকে তার মুখ দিয়ে একটা কথা বের হইছে তো কি হইছে? পোলাপাইন মানুষ ও।

শফিক দেওয়ান চুপ হয়ে গেলেন মায়ের কথাকে সম্মান দিয়ে।

শ্রাবণও পিতার মুখের উপরে কোন উচ্চবাচ্য করল না। অন্যকেউ হলে এতক্ষনে পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেতো। তবে সে অপমানিতবোধ করলো সবার সামনে। তার উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তা করতে গেলেও সবাই ভুল বুঝবে। পিতাও ছোট হয়ে যাবে। সে শক্ত চোয়ালে বসে রইলো সোফার এক কোণায়।

রাফিয়া বড় ভাইয়ের উপর বেশ খুশী হলো। মনে মনে টিপ্পনী কেটে বলল,
ভাইজান ঠিকই কইছে। হারামজাদা কইলোটা কি। বান্দর কোথাকার। অমন ছন্নছাড়া মেয়েকে কে ছেলের বউ করেরে?তোর মায় করবে? তুই করবি? হুহ! যেই মাইয়ার জীবন যাযাবরের মতো। আইজ এইখানে কাল ওইখানে। আদব কায়দার নাই কোন বালাই। বড় হইতাছে শাসন ছাড়া। চেহারাসুরত ও আহামরি না। তারে আমার ঘরে তুইলা নিমু। জীবনেও না। মরনেও না।

আরুর মা আছে,বাবা আছে,পরিবারের সবার আদর শাসনে উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষা পেয়ে বড় হয়ে হইতাছে। তাকেই মানায় রজতের সঙ্গে।সেই রজতের যোগ্য পাত্রী।

পাশে বসা থেকে শ্রাবণের ছোট ফুফু জাকিয়া বলল,

কাজের কথায় আসি। ভাবি তুমি কি বলো বুবুর প্রস্তাবে?

নাহার বেগম টনটনে গলায় বলল,
রজত ভাইগনারে আমারে সবসময় ভালোলাগে। আমার কোন আপত্তি নাই বড় বুজানরে বেয়াইন বানাইতে।

আচ্ছা বুঝলাম। বড় ভাইজান আপনার কি মত?

তোদের সবার মত থাকলে আমার অমত হওয়ার কোন কারণ নেই। শফিকের মতামত জানাটা গুরুত্বপূর্ণ সবচেয়ে বেশি। কারণ কন্যাটা তার।

তুমি কি বল শ্রাবণের মা?
স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলো রফিক।

আমার বলার কি আছে এখানে? আরুর মা,বাবা ও বড় আপার মত মিলে গেলে কারো দ্বিমত থাকা সাজেও না। তবে দুলাভাইয়ের মত আছে কিনা। সেটাও জানতে হবে।

রাফিয়া বলে উঠলো,

আরেহ দূর বড় ভাবি। কি যে কও না। আমার ভাইজিরে আমার ঘরে নিমু। এতে হ্যার মতের তোয়াক্কা করিই আমি?

এটা ঠিক না রাফিয়া। সে বেকার হয়ে গেল বলে তুই তারে পাত্তা না দিয়ে এতবড় সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক নয়।

বলল রফিক দেওয়ান।

পাশে থেকে নাহার বলল,

ভাইজান। আমি আপনের ছোট ভাইরে ফোন দিয়া বুঝায়া নিমু। আপনে টেনশন কইরেন না।

জাকিয়া বলল,

এই বুবু? রজত রাজি কিনা এটা জানেন?

মনে হয় রাজি। কয়দিন আগে কইলাম আর হেসে উঠলো।
বলল রাফিয়া।

হ আমিও বুজানের লগে একমত। সেদিন নদীরে নিয়া যখন বসলাম আমরা। তখনও আমি এই রকম কথা বললাম। কই রজত নাতো করলো না। তার মানে কি?

বলল আরুর মা।

মৌনতাই সম্মতির লক্ষন। তবুও রজতরে সরাসরি জিজ্ঞেস করা দরকার।
বলল জাকিয়া।

মা আপনে ওকে জিজ্ঞেস কইরেন ত। গলা বাড়িয়ে বলল রাফিয়া।

আইচ্ছা জিগামুনি। আমি যাই। আযান দিল। নমাজ পড়ুম। অজু করুম।

এরা যখন বিয়ের প্রসঙ্গ তুলল,রজত তখন বাড়ির বাইরে ছিল। শুনতে পায়নি কিছুই। নদী ও আরু রান্নাঘরে ছিলো বলে তারাও শুনতে পায়নি বড়দের আলোচনার বিষয়টা।

পূবের আকাশে বিকেল ফুরিয়ে যাচ্ছে। খোলা মাঠে উড়িয়ে দেওয়া রঙিন ঘুড়ির নাটাইগুলো গুটিয়ে নিচ্ছে একদল দুরন্ত বালক। সন্ধ্যার গাঢ় আয়োজন শুরু করে দিলো প্রকৃতি।
সবাই উঠে যার যার মতো করে চলে গেলো। সেই সুযোগে আরু শ্রাবণের সামনে এসে আপাদমস্তক চাইলো।

মিটমিটিয়ে হেসে বলল,

ওরেব্বাস! এক্কেবারে নতুন বরের মতো লাগছে দেখি আমাদের চেয়ারম্যান ইশতিয়াক দেওয়ান সাহেবকে। শর্ট পাঞ্জাবি, পায়জামা, গলায় কাঁচাফুলের মালা। দেখি মালাটা আমারে দেনতো। একটু ঘ্রাণ শুঁকি।

শ্রাবণ গলার মালাটা ঘুলেই আরুর হাতে দিয়ে দিলো। তারপর এলাকার লোকজনের ডাকে বেরিয়ে গেলো নিজেদের পুরোনো বাড়ি থেকে।

পিছনের উঠানে নলকূপের মধ্যে অজু করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে জাকিয়া। সে শিকারি চোখে এদিক ওদিক চাইলো। তারপর হাফসা বিবিকে বলল,

মা শুনেন, শ্রাবণ ট্রিকস করেই কথাটা বলল। কারণ নদীর বিয়ে সহজে হবে না। এটা সে নিজেও জানে। তাই ভাবছে সবাই যদি নদীকে তার গলায় ঝুলিয়ে দেয়। সেই ভয়েই নদীকে রজতের সাথে সেট করতে চায়। রাজনীতি করা ছেলে। মাথায় কেবল এগুলাই দৌড়াদৌড়ি করে।

হ তোরে কইছে। আমি জিগামু শাবুনরে। দেহি ক্যান কইলো ওই কথা।

শাবুন কি মা? শব্দটা শ্রাবণ। র ফলার উচ্চারণ হবে।

আমি অত শক্ত নাম কইতে পারি না। শাবন ই সুন্দর।

সন্ধ্যা মিলিয়ে গেলে রজতের সাথে শ্রাবণের দেখা হলো বাইরেই। রজত শ্রাবণকে বলল,

কিরে নদীকে মিষ্টি না খাইয়ে চলে গেলি কেন দরজা থেকে?

এতজনে খাওয়ালে ওর হজম নাও হতে পারে। তোর বিয়ে ফাইনাল করে এলাম নদীর সাথে?

রজতের পিঠ চাপড়ে বাঁকা হাসি দিয়ে বলল শ্রাবণ।

কি ফাউল বলছিস তুই? কপাল ভাঁজ করে বলল রজত।

শ্রাবণ হাঃহাঃহাঃ করে হেসে ফেলল।

দুজন দুদিকে পা বাড়িয়ে প্রস্থান নিলো।

রজত গ্রামের আলো আঁধারির মেঠোপথ মাড়িয়ে হেঁটে যাচ্ছে নানাদের বাড়ি। যেতে যেতে ভাবতে লাগলো,

নানার পরিবারের বড় নাতি সে। সবার আদরের। তার শিশুকাল কেটেছে নানার বাড়িতেই। তাই ছোট মামী রুবিনা ও তার মেয়ে নদীর জীবনের বেদনার ইতিহাস তার কাছে দৃশ্যমান। সূর্যের আলোর মতো তীব্র। উজ্জ্বল।

তালেব দেওয়ানের তিনপুত্র ও দুই মেয়ে। সময়ের করাতলে অর্থবিত্তের জৌলুশ কমে গেলেও তার বনেদি পরিবারের ঐতিহ্য চোখে পড়ার মতো।
রাফিয়া বড় জাকিয়া ছোট। দুজনেই স্বামী,সংসার,সন্তানাদি নিয়ে ভালো আছে। বড় ছেলে রফিক দেওয়ান। তার এক ছেলে এক মেয়ে। বড় ছেলে শ্রাবণ। ছোট মেয়ে সারথী।

দ্বিতীয় ছেলে শফিক দেওয়ান। তার দুই মেয়ে। বড় আরু। ছোট নিরু।

ছোট ছেলে মোহন দেওয়ান। পরিবারের পছন্দেই ধুমধাম করে বিয়ে করে দূর গ্রামের অষ্টাদশী অনূঢ়া রুবিনাকে। বছর তিনেকের মাথায় রুবিনার কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে এক কন্যা শিশু। যার নাম রুবিনা শখ করে রেখেছে নদী। রুবিনাদের বাড়ির পাশেই কলকল করে বয়ে চলে স্রোতস্বিনী মেঘনা নদী। নদী রুবিনার খুব প্রিয়। নদীর সাথে নারীর জীবনের অজস্র সাদৃশ্য খুঁজে পায় রুবিনা। নদী জন্মানোর সময় রুবিনা তার বাবার বাড়িতে ছিলো। তখন তার শারীরিক কন্ডিশনের অবনতি ঘটে। তাকে নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে। ধরা পড়ে রুবিনার জরায়ুতে সমস্যা। কেটে ফেলে দিতে হবে। তাই সে আর দ্বিতীয় সন্তানের মা হতে পারবে না। জরুরী অপারেশন করে বের করে নেওয়া হয় তুলতুলে নদীকে। দুই পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিলো হাসপাতালে। এবং বিষয়টা প্রকাশ হয়ে গেলো।

নদী জন্মাবার বছর না গড়াতেই রুবিনা পরিবারের সবার অপ্রিয় হতে লাগল বিষফোঁড়ার ন্যায়। বিশেষ করে শ্বাশুড়ি হাফসা বিবি। খোঁটার অন্ত নেই রুবিনার প্রতি। মোহনকে ইন্দন দিতে লাগল পুত্র সন্তানের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করার। রুবিনার বিরুদ্ধে অহেতুক এটা সেটা বলে মোহনের কান ভারি করে তুলল।

রুবিনা লক্ষ করলো মায়ের কথায় তার স্বামী মোহন ধীরে ধীরে নরম হয়ে যাচ্ছে মাখনের মতন। কারণ হিসেবে খুঁজে পেলো,
সে কন্যা সন্তান জন্ম দিয়েছে। এবং সেই কন্যা বাড়ির অন্য মেয়েগুলোর চেয়ে কমসুন্দর। আরেকদিকে সিজারের জন্য রুবিনা প্রায় অসুস্থ থাকে। বড় দুই জায়ের সাথে তাল মিলিয়ে স্বামীর সংসারে সমান তালে খাটতে পারে না। সন্তান গর্ভ ধারণেও অক্ষম হয়ে পড়লো।

যার ফলশ্রুতিতে নদীর দুই বছর গড়াতেই রুবিনার ঠাঁই হলো বাবার বাড়ি। কিছুদিন পর হাতে পেয়ে গেলো ডিভোর্স লেটার। রুবিনা কষ্টগুলোকে চুপিসারে পিষে ফেলল সাহস ও অদম্যতার যাঁতাকলে। শুরু করে পড়াশোনা। শেষ করে একটি কিন্ডারগার্ডেন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করলো। নদী বড় হতে লাগল নানী খালার আদরে ও মামীর অনাদরে। এই ভিতরে গত হলো নদীর দাদা তালেব দেওয়ান।

সময় গড়ায়। নদীর বয়স যখন আট। তখন তার বাবা মোহনের দ্বিতীয় বিয়ে ঠিক হয় তার দাদীর ইচ্ছেই। কিন্তু বিয়ের মাত্র এক সপ্তাহ পূর্বেই…

চলবে ৩