#চারুকাব্য ১৯
লেখা : #azyah_সূচনা
“কি সমস্যা আপনার?”
বাজখাই গলায় বললো চারু।রাত দুটোয় ঘুমোতে এসেছিল কাব্যর মুখে বিগত এক বছরের ঘটনা শুনে।এখন সময় হচ্ছে তিনটে।কাব্যর চোখে ঘুম নেই।অথচ চারু দিব্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল বুকে মাথা গুঁজে।ঘরে থাকতে দিন একই সাথে সেটাই ছিল কল্পনা বাহিরে।অথচ কাব্যকে তাক লাগিয়ে দিয়ে তার বক্ষে নিজের জায়গা দখল করে নিয়েছে।অশান্ত নির্ঘুম কাব্য। নড়চড় করে উঠছে ক্ষণেক্ষণে।যা চারুর বিরক্তির কারণ হয়ে দাড়াল।এত ছটফট করলে ঘুমোনো যায়?
“অস্থির লাগছে চারুলতা”
চিন্তিত হয়ে চারু বললো,
“কেনো? শরীর খারাপ?”
“নাহ।তোমার নিঃশ্বাস যতবার ছুঁয়ে দিচ্ছে আমার ভীষন রকমের অস্থির লাগছে ”
কাব্যর এরূপ কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় চারু।প্রিয় মানুষের সান্নিধ্যে অস্থিরতা অনুভব হয়?লজ্জার বোধের পরিবর্তে চারু প্রশ্ন করলো,
“আমি কাছে আছি বলে আপনার অস্থিরতা হচ্ছে?”
“না ব্যাপারটা ওমন নয়।তুমি কোনোদিন..এভাবে আমার কাছাকাছি থাকোনি।চারুলতা আমি অনুভূতিটা বোঝাতে পারবো না।”
মুখটা বাংলার পাঁচ এর মতন করে ফেলেছে চারু।চোখের পলকে দূরত্ব বাড়িয়ে নেয়। বিপরীত পাশে ঘুরে শুয়ে পড়লো।নিজেকে চাদরে আবৃত করে মুখ বেলুনের মতন ফুলিয়ে রেখেছে।অন্তরাত্মা কেপে উঠে কাব্যর।যতক্ষণ কাছে ছিলো তার চেয়ে দ্বিগুণ অসস্তি হতে শুরু করেছে।কাছে থেকে হৃদয়ে যে উত্তাপ ছড়াচ্ছিলো তার চেয়ে এই মুহুর্তের দহন বেশি ভয়ানক।
আমতা আমতা স্বরে কাব্য বললো, “এখন আরো খারাপ লাগছে”
চারু শুনলো না। যত্তসব ঢং!এতবড় একটা লোক জানে না সে কি চায়?কাছে থাকতে নাকি দূরে চলে যেতে?তার চিন্তাধারা আর অনুভূতি তার মতই উদ্ভট।
“চারুলতা আসো।জড়িয়ে ধরে শান্তিতে ঘুমাও”
“কোনো দরকার নেই। আপনি থাকেন আপনার মতন।আমার কাছে থাকা যেহেতু আপনার অস্থিরতার কারণ আমি দূরেই ভালো”
“এভাবে বলছো কেনো?আমাকে বোঝার চেষ্টা করো”
তড়াক করে ঘুরে তাকায় চারু।বললো, “নিজেকে বুঝেন আপনি?”
মুচকি হেসে চারুকে কাছে টেনে নিয়ে বলতে লাগলো, “আমার নিজেকে বোঝা লাগবে না।তুমি বুঝলেই চলবে চারুলতা।কখনো তোমার এতটা কাছাকাছি আসা হয়নি।নতুন অনুভূতি এটা।মন, মস্তিষ্কে জোট পাকিয়ে ফেলছে।”
শুভ্র চাদরের উষ্ণতায় আবৃত কায়াযুগল। চন্দ্রিমার মৃদু আলোয় একে অপরের মুখ পরিদর্শনে অনবসর।পিটপিট করা চোখজোড়া কাব্যর চেহারা থেকে সরলো না। অপরপক্ষে কাব্য নির্নিমেষ।লাজনম্র বোধটাকে দূরে সরিয়ে পূনরায় ঠোঁট ছোঁয়ায় কাব্যর কপালে।
চোখ বুজে হাসলো কাব্য।অত্যন্ত মৃদু শব্দে।কণ্ঠে মাদকতার সহিত বলে বসে, “তুমি আমাকে কতবার চুমু খেয়েছো এই কয়েক ঘন্টায় হিসেব আছে?নির্লজ্জ্ব লতা।”
চারু চোখ রাঙায়।চাঁদের আলো ঠিক তার মুখ বরাবর।জ্বলজ্বল করা নেত্র যুগল কাব্যর নজর এড়ালো না।চারু বললো,
“আপনি কি লজ্জাবতী?”
“ছেলেদেরও লজ্জা আছে।”
“আমার নেই।একদম নেই।আমি যাকে ভালোবাসি সবটা দিয়েই ভালোবাসি।তার সাথে আমি যা ইচ্ছে করবো। ভালোবাসবো,বকে দিবো দরকার পড়লে মারবোও”
ক্ষুদ্র চক্ষু অতিশয় ব্যাকুলতা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো, “ভালোবাসো?”
চারু চোঁখ নামায়।মাথা উপর নিচ দুলিয়ে ছোট্ট করে জবাব দিলো,
“হুম”
উচ্ছাসের দেখা মেলে কাব্যর মুখশ্রীতে।এই অস্থিরতা ভরা চিত্ত এক মুহুর্তে শীতলতায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠে।ভাসমান চোখ বেয়ে একফোঁটা অস্রু ঝড়ে পড়লো।দূরত্ব জেদের পাশাপাশি ভালোবাসতেও শিখিয়েছে তার চারুলতাকে।এখন সেও অনুভব করে তাকে।ভুলের মাধ্যমে শুরু হওয়া একটা সম্পর্কে প্রেম আসবে?ফিরে আসা হবে আবার? উপলদ্ধি করা হবে? অকল্পনীয় ছিলো।
“আর কি বললে চারুলতা?বকে দিবে মারবে?তুমি কিন্তু আমায় চড় দিয়েছো ”
“ওইটা তোর প্রাপ্য ছিলো”
“আবার তুই তুকারিও করছো”
“করবো একশোবার করবো!”
“তোমার সব অত্যাচার,ভালোবাসা মাথা পেতে নিলাম”
বলেই কাব্য মাথা তুলে চারুর গালের উপর রাখে। ঘন দাড়ির ঘর্ষণ অনুভব করায় উসখুস করে উঠে চারু। কাব্যকে দূরে দিয়ে বললো,
“এইযে বন মানুষের শ্রী ধারণ করেছেন এগুলো যেনো আর না দেখি। কালকেই চুল, দাড়ি ছাটাই করবেন।”
“আচ্ছা আচ্ছা।ঘুমাও এবার।”
____
আমজাদ এর ডাবল ডিউটি।কখনো কাব্যর কখনো চারুর।বারান্দায় আয়না ধরে দাড়িয়ে আছে।কাব্যর মুখ ভর্তি শেভিং ফোম।এতখন অবশ্য সিংকের আয়নায় দাড়িয়েই গোঁফ দাড়ি ছাটাই করছিলো।কিন্তু এতে নাকি তার পা ব্যথা করে।তাই এখানে এসে বসেছে। আমজাদকে দিয়েছে দাড়িয়ে পা ব্যথা করার দায়িত্ব।আয়নার দিকে চেয়ে ট্রিমিং মেশিন চালাতে চালাতে কাব্য বললো,
“বুঝলে আমজাদ? বিয়ে করলে নিজের বলে কিছু থাকে না।সবকিছু করতে হয় অন্যের মন মোতাবেক”
বিয়ে দিবে না ভালো কথা।ইনিয়ে বিনিয়ে ভয় দেখানোর কোনো দরকার আছে?সেতো মেনে নিয়েছে এই জীবন। কারাগারের জীবন।চুল পাকাবে চারু কাব্যর বাচ্চাদের ধমক খেয়ে।এই পরিকল্পনা করাও শেষ।
“জ্বি স্যার!”
“আমাকে মিস করেছো আমজাদ?”
বোকার মতন ঠোঁট উল্টে ফেললো আমজাদ।সেতো কাব্য আর চারুর মতন কঠোর নয়।কতটা মনে পড়েছে কাব্যকে সেকি জানে?নয় বছরের পরিচয়ে গড়ে উঠা বোঝাপড়া এভাবে এক নিমিষে শেষ হয়ে যাবে বিশ্বাসই করতে পারছিলো না। পুরুষের গোপন কান্নার সাক্ষী একমাত্র সৃষ্টিকর্তা আর সে নিজে।
“আপনাকে অনেক মনে পড়েছে স্যার।একটা সময় ভেবেছিলাম আমিও দূরে কোথাও চলে যাই।কিন্তু আপনি আমার ঘাড়ে যে দায়িত্বটা দিয়েছেন।সেটা থেকে যদি পালাতাম তাহলে আমি নিজের সাথেই চোখ মেলাতে পারতাম না।”
“তাইতো বলি তুমি ছাড়া আমার কে আছে?”
আমজাদ ঝট পট উত্তর দেয়, “কেনো চারু ম্যাডাম?”
“সেতো আমার হৃদয়ের একটা বিশাল অংশ।নাহ! পুরোটা হৃদয়ই ”
মুচকি হাসে আমজাদ।ভালোবাসা অবশেষে পূর্ণতা পেলো সেটাও আমজাদকে সস্তি দিচ্ছে।মাঝেমধ্যে হিংসে হয়।কেনো তার স্যারকে তার থেকে কেড়ে নেওয়া হলো।কিন্তু কাব্যর মুগ্ধ আভায় ছড়িয়ে থাকা মুখটা দেখলে ভালো লাগে। জীবনে কত উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে গেছে লোকটা।অনেক সুখ তার প্রাপ্য।
কাব্য মুখ মুছে জিজ্ঞেস করলো, “চারুকে ঠিকঠাক দেখে শুনে রেখেছিলে তো?কেউ তার দিকে কু নজর দেয়নিতো বিগত দিনগুলোতে?”
“কু নজর?ডাইরেক্ট বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে”
গুনে গুনে তিনটি গাঢ় ভাজ পড়েছে কাব্যর ভ্রূদ্বয়ের মধ্যিখানে।সদ্য শেভ করা গালটা চ্যাপটা দেখাচ্ছে।দাতে দাত চেপে তাকালো আমজাদের দিকে।
জানতে চাইলো কাব্য,
“কে সে হতভাগা?”
“সব ডিটেইল আছে স্যার বলবো?”
গম্ভির কণ্ঠে কাব্য বলে উঠে, “বলো”
“নাম তানভীর।চারু ম্যাডামের পাশের এলাকায় থাকে।এক মায়ের এক ছেলে।ম্যাডাম যে প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতায় নিয়োজিত সেও সেখানেই কাজ করে।তার মাকে পাঠিয়েছিলো আরো একটা মহিলার সাথে।চারু ম্যাডামকে বিয়ে করতে চায় বলে”
তোতা পাখির ন্যায় সবটা অনর্গল বলে থামে আমজাদ।কাব্য উঠে ঘরের দিকে এগোলো।চারু এখনো ঘুমিয়ে।তাকে আর বিরক্ত করেনি।ডাকেও নি। শাওয়ার নিতে চলে গেলো এক পলক ঘুমন্ত চারুলতার দিকে তাকিয়ে।চারু উঠেছে আড়মোড়া দিয়ে।একটা সুন্দর রাত্রি কাটিয়ে উঠে বসতেই মুখে হাসি ফুটে উঠে।এতদিন নিঃশ্বাসটাও ভারী মনে হয়।আজ প্রাণ ভরে শ্বাস ফেলছে। গতরাতে জোর জবরদস্তি কাব্যর বুকে নিজের জায়গা দখল করে নেওয়ার কাণ্ডে নতজানু হয়ে হাসলোও বটে।
নিজেকে নিজে বলে বসে, “একদিনে নির্লজ্জতার রেকর্ড ভঙ্গ করেছিস তুই চারু”
পানির নিচে দাড়িয়ে সস্তি পেলো না কাব্য।অনেকটা দিন হয়েছে অপারেশনের।সেলাই শুকিয়ে গেছে।তারপরও মধ্যে মধ্যে চিনচিন ব্যথা হয় বাহুতে।বলিষ্ঠ হাত ভেদ করেছিলো গুলিটা।সময় দীর্ঘায়িত করলো না। দ্রুতই বেরিয়ে এসেছে কাধে তাওয়াল ঝুলিয়ে।আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পেছনে চারুর প্রতিবিম্ব দেখতে পায়।সে জেগে।মেয়েটি ঠিক সেদিনের মতন ঠোঁট কামড়ে মাথা নুয়ে আছে।আমজাদ বলেছিলো ভেজা শরীরে চারুর সামনে এসে দাঁড়ানোর কারণেই নাকি সে লজ্জা পেয়েছিলো।আজও ঠিক একই অবস্থা।গায়ে তাওয়াল ছাড়া আর কোনো বস্ত্র নেই। চারুও সেটে আছে এক কোণে।একবার ভাবলো দেখবে নাকি লাজে রাঙা মুখটা? নাহ থাক! অসস্তিতে ফেলার কোনো প্রয়োজন নেই চারুলতাকে।টি শার্ট হাতে তুলে গায়ে দেওয়ার আগেই চারু ডেকে নেয়।
বলে, “দাড়ান”
দৃষ্টি নামিয়ে রেখেই ড্রয়ার থেকে মলম বের করে কাব্যর দিকে এগিয়ে আসে।ঠিক একই ভঙ্গিতে তার হাত টেনে বিছানায় বসায়।
“আমাকে বেহায়া ভাববেন না হ্যা? ক্ষতের জায়গাগুলোতে এই মলমটা দিয়ে দেই?তাকাবো না আপনার দিকে প্রমিজ।”
“না তাকালে মলমটা দিবে কি করে শুনি?”
চারু উত্তর দিলো না।চারুর মনের অবস্থা আন্দাজ করতে পেরে কাব্য বলে উঠে, “যা ইচ্ছে করো।আমার দিকে তাকানো তোমার জন্য বৈধ।এখানে বেহায়া হওয়ার কি আছে চারুলতা?”
কাব্য তাওয়াল নামিয়ে সাড়া শরীর মুছতে শুরু করে। আকষ্মিক বাহুতে টান পড়ায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো। ব্যাথাযুক্ত স্থানেই ব্যথা বাড়ছে। ধড়ফড়িয়ে উঠে চারুও।
“কি হলো?”
“কিছু না চারুলতা।একটু ব্যাথা এই আরকি”
সুঠাম বাহুতে সেলাইয়ের দাগ স্পষ্ট।কাব্যর ব্যথায় পীড়িত হতে শুরু করেছে চারুর অন্তর।এখনও অঝোরে চোখ বেয়ে শ্রাবণ নামবে।নাক টেনে চারু প্রশ্ন করলো,
“এখানে গুলি করেছিলো তাই না?”
“হ্যা।কিন্তু বেশি সমস্যা হয়নি”
“আর পায়ে?”
“হুম চারুলতার।তোমাকে দেখে কেনো মনে হচ্ছে তুমি এখনই কেদে দিবে?বিশ্বাস করো আমি এখন সম্পূর্ণ সুস্থ”
আলতো হাতে ক্ষত স্থানগুলোতে মলম লাগিয়ে দিতে লাগলো চারু। প্রত্যেকটা ক্ষত হৃদয়কে বিক্ষত করতে সক্ষম। এতোটা পাষাণ হয় কি করে মানুষ?নিজের ছেলেকে এভাবে কেউ কষ্ট দিতে পারে? কুলাঙ্গারের মনেও বোধহয় মায়া থাকে।চারুর মুখের ভঙ্গি কাব্য বারেবারে চোখ ঘুরিয়ে দেখছে।খুব বেশি ভালোবেসে ফেলেছে তাকে?কালো মেঘের ঘনঘটা কেটে নতুন সূর্যোদয় হয়েছে।অনুরাগের রোশনি ছড়াচ্ছে।হুট করে চারু ঝুঁকে পায়ে স্পর্শ করলো।
তড়িৎ গতিতে পা সরিয়ে কাব্য বলে উঠে, “কি করছো?পায়ে হাত দিচ্ছ কেনো?”
“পায়েওতো ব্যথা পেয়েছেন”
“চারুলতা উঠে দাড়াও।আমার সামনে ঝুঁকবে না কখনো। দ্রুত উঠো”
কে শোনে কার কথা?শেষ কথাটি যেনো চারুর কান অব্দি পৌঁছায় নি।সে কাব্যকে উপেক্ষা করেই আঘাতের চারিদিকে সযতনে মলম লাগিয়ে দিচ্ছে।কেনো পেরে উঠা হয় না চারুর সাথে?ভালোবাসার বাঁধনে আটকা বলে? মেয়েটিও কত দ্রুতই না তার জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লো।আবার পদেপদে ভালোবাসা জাহিরও করছে।নিজেকে অধম মনে হতে শুরু করে কাব্যর। চারুর চোখের কাছাকাছি এলেই ওলোট পালোট মনে হয় সবকিছু।ইচ্ছে হয়ে স্তব্ধ হয়ে দাড়িয়ে দেখুক চিরকাল মুখখানা।এতেই সুখ মেলে।এর চেয়ে বাড়তি কিছু চাইই না তার।
চারু উঠে দাড়িয়ে হাসি মুখে বলতে লাগলো, “এখন দেখতে ভালো দেখাচ্ছে।গতকাল বন মানুষ লাগছিলো আপনাকে। চুলগুলো কাটবেন না?”
“চুল কাটতে হলে স্যালোনে যেতে হবে।”
“যান তাহলে”
“এখন সম্ভব না।কবির সাহেবের শেষ শুনানি না আসা পর্যন্ত আমাকে সবার আড়ালে থাকতে হবে।”
দুষ্টু স্বরে চারু বললো, “ঠিক আছে।আপনাকে লুকিয়ে রাখবো এই সন্দীপে।”
অনেকতো হলো ব্যথা বেদনার গল্প।কাব্যর ইচ্ছে ছিলো।একই সাথে বসে সমুদ্র দেখার।তার চারুলতার সাথে।হাত টেনে সামান্য খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটতে শুরু করে উত্তাল সমুদ্রের পানে।চারু সমুদ্রের দিকে চেয়ে অবাক। কাব্য কি জলাধিপাকেও বশ করে রেখেছে নাকি?তার আগমনে উচ্ছাসের জোয়ার তুলছে।এক বছর আগেও হুটহাট হাতটা ছাড়িয়ে নিত।শান্ত হয়ে বসতো না কাব্যর সন্নিকটে।আজ আবহাওয়া ভিন্ন।কাব্যর হাতটিকে শক্ত করে ধরে রেখেছে সেও।কোনো প্রকার প্রশ্ন ছাড়াই হেঁটে চলেছে তার পিছু পিছু।
পাশাপাশি খোলা আকাশের নিচে বসে কাব্য আবদার করে বসলো,
“মনে আছে? ঘৃণিত এক লোককে তোমার কোলে মাথা রাখার অনুমতি দিয়েছিলে।অনিচ্ছায়!আজ সেচ্ছায় সেই অনুমতি আবার পেতে পারি?”
এই খারাপ লোকটিকে কাছে পেয়ে সমস্ত ভালোবাসা উজাড় করে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।পাগলামো করতে ইচ্ছে হচ্ছে।জিনিসের প্রথম প্রেম বুঝি এমন আনন্দদায়ক হয়?তাও আবার এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে।অবশ্যই দেবে অনুমতি।তার সব আবদার পূরণ করবে। মিষ্টির হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো সে রাজি। সেচ্ছায় অনুমতি দিতে।
“আমাকে ভালোবাসো চারুলতা? সত্যিই ভালোবাসো?”
সস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো, “খারাপ লোককে ভালোবাসতে চাইনি।বাধ্য করা হয়েছে আমাকে।”
দুষ্টুমি করাকে নিজের চরিত্র বিরোধী মনে করে কাব্য।তার সাথে নাকি যায়না। আমজাদও বলেছিলো একদিন।তাকে গম্ভিরতায় মানায়।তারপরও জং ধরা মস্তিষ্ক খাটিয়ে কাব্যও ভ্রূ নাচিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো,
“তাহলে আরেকটা বিয়ে করার প্ল্যান করছিলে কেনো?”
“কে করেছে প্ল্যান?”
“তানভীর নামের ছেলেটা কে তাহলে?আমার শ্বাশুড়ি মার রাগটা এখনও কমেনি না?বিয়ে দিতে চলেছিলো তোমাকে।আমাকে এখনও জামাই হিসেবে অপছন্দ তার তাই না?”
চলবে…
#চারুকাব্য ২০
লেখা : #azyah_সূচনা
এক ঝাঁক পক্ষীর কিচিরমিচির ধ্বনিতে প্রভাতের সূচনা হয়েছে।শীত আসবে আসবে ভাব।হিমেল হাওয়া জানার দিয়ে যাচ্ছে সেই আগাম বার্তা।দুটো রাত অনুরাগে জড়িয়ে প্রসন্ন অন্ত:করণ।নরম হাত দুটো চুলো-চকির কাজে এগিয়েছে। হলুদে রাঙিয়েছে উজ্জ্বল শ্যামলা হস্ত।বিয়ের পর নাকি মেয়েদের কার্যালয় রান্না ঘর।এখানে প্রিয়জনের জন্য শখ করে নানান পদের আয়োজন করা হয়।বৈবাহিক জীবনের এক বছর পাঁচ মাস।যেখানে প্রাক্তন এক বছরকে গোনায় ধরলো না চারু।একটি ভুলভ্রান্তির মধ্যে বেচে থাকা কালো অধ্যায় ভেবে ভুলে গেলো।নতুন নিবন্ধগ্রন্থ খুলে বসেছে চারু।নতুন পাতায় নতুন রঙিন সময়ের বর্ণনা থাকবে এতে। চারুকাব্যের নতুন সূচনা।যেনো তাদের অতীত বলে কিছুই ছিলো না।
“আফা স্যার ঝাল খাইতে পারে না”
অমনোযোগী ভাবটা কেটে উঠে রুনা আপার আওয়াজে। অতীতের ঘোরে পড়ে দুই চামচ মরিচ দিয়ে ফেলেছে মুরগির গোস্তে। মুখশ্রীর তৎক্ষনাৎ অসহায় হয়ে উঠে। এখন কি করবে? চারুর মুখ দেখে রুনা আশ্বাস দেয়।
বলে, “সমস্যা নাই।নতুন রানলে এমন হয় টুকটাক। আপনি দাড়ান আমি ব্যবস্থা করি একটা”
“আমিতো নতুন রান্না করছি না।মার সাথে অনেকবার রান্না করা হয়েছে।এক দেড় বছর হয়তো রান্নার দ্বারে কাছেও যাইনি তাই এই অবস্থা।”
রুনা দুটো লেবু কচলে পানির সাথে মিশিয়ে দিয়ে দিলেন তরকারিতে।তার মতে টকটা ঝলকে ভালোভাবে ব্যালেন্স করে নিবে।চারু টেস্টও করে নিলো।এখন একদম পারফেক্ট আছে।সেদিনের মতন চালের রুটিও করেছে।কেমন হবে?কাব্যর পছন্দ হবে কিনা ভাবতে ভাবতে টুনি দৌড়ে এলো।
বলতে লাগলো, “আপা মেহমান আইসে”
মেহমান?এখানে কে আসবে? এমন প্রশ্নই সবার আগে আসলো চারুর মনে।পরপর ভয় পেয়েও উঠে। কাব্যও এখানেই আছে।এই ঠিকানা কারো জানার কথা নয়।কোনো বিপদ আসলো নাতো আবার?মাথায় কাপড় টেনে বাহিরে আসে চারু।ভয় পাচ্ছে।কাব্যকে বলবে সেটার উপায় নেই।যে চারজন এসেছেন তারা সকলেই বারান্দার বাহিরে দাড়ানো।তাদের টপকেই ঘরে যেতে হবে।
রান্না ঘর থেকে বেরিয়েই দুজন মধ্য বয়স্ক নারী পুরুষের দেখা মেলে।তাদের সাথে আরো দুজন কিশোর কিশোরী।চারুকে আসতে দেখে বিনয়ী হাসির সাথে তাকায় তার দিকে। চারুও মিথ্যে হাসে।
চারু তাদের কাছে এসে বললো, “আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুম আসসালাম।”
“আপনাদের ঠিক চিনতে পারলাম না”
“চেনার কথাও না মা।আমার নাম মুহিত আর এরা আমার স্ত্রী এবং ছেলে মেয়ে।”
জোরপূর্বক হাসার চেষ্টায় চারু।স্বাভাবিক হতে চাচ্ছে।ছোট্ট শব্দে জবাব দিল, “ওহ”
“মা? কাব্যকে ডেকে দিবে?আমার নাম বললেই চিনবে।”
“জ্বি অবশ্যই।আপনারা বসুন”
কাব্য ঘুমিয়ে আছে।চারু ভয় আর অস্বাভাবিকতা নিয়ে কাব্যর পাশে বসে তাকে ডাকতে লাগলো।গভীর ঘুমটা ভেঙে যাওয়ায় বড্ড বিরক্ত দেখালো তাকে।চোখ খুলে চারুকে দেখে বিরক্তিটাও কেটে হাসিতে পরিণত হয়।
হাতজোড়া আকড়ে ধরে বলতে লাগলো,
“গুড মর্নিং!”
“গুড মর্নিং বাদ দেন।আপনার সাথে দেখা করতে কারা যেনো এসেছে।নাম বলছে মুহিত।আপনি কি তাদের চেনেন?”
আবারো বিরক্তভাবটা মুখে এসে জড়ো হয়।চোখ বুজে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে।এরা এখানে কেনো এসেছে?কাজ কি তাদের? একলাফে উঠে পড়ল কাব্য।এক মিনিটের মধ্যে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে আসে। পকেটে দুহাত গুজে সটাং হয়ে দাড়ালো তাদের সামনে।চোখ মুখ কাঠিন্যতায় ভরপুর।
বেয়াদবির সুরে বলে উঠে, “এখানে কেনো এসেছেন?”
“তোমার সাথে দেখা করতে এলাম কাব্য”
মুহিত সাহেব বলে উঠে। কাব্যকে দেখেই সাবিনা মাথা নুয়ে নেয়।তার তথাকথিত মায়ের এই চোখ নত করার ব্যাপারটাও কাব্যর দৃষ্টি এড়ালো না।সেখানে বিশেষ আগ্রহ দেখলো না কাব্য।আবারো চাইলো মুহিত সাহেবের দিকে।
নিজের ভাবমূর্তি বজায় রেখেই প্রশ্ন করে, “বিশেষ কোনো কাজ ছিলো?”
“বিশেষ তেমন কিছু না।তোমার হালচাল জানাটাই মূল উদ্দেশ্য।তাছারাও কবির আফনানের ব্যপারে কিছু কথা বলতাম।”
এখানে মুহিত এবং কাব্যর মধ্যে কথোপকথন চলছে। বাকিরা সবাই নিরব।তাদের মুখের দিকে চেয়ে। চারুও বিপরীতে নয়।তার ক্ষেত্রে চিন্তার ভিন্নতা।বিমূঢ় চারু।তাদের সম্পর্কটা আসলে কি?কাব্যর মুখ রূঢ়। মুহিত সাহেব যথেষ্ট বিনয়ী।কবিরের কথা শুনে চারু তাদের মধ্যে যোগসূত্র খুঁজতে লাগলো।
কাব্য চেয়ার টেনে বসে।কাছাকাছি বসেও বিশাল দূরত্ব।পায়ের উপর পা তুলে ভাবলেশহীনভাবে বললো, “অ্যাম ফিট অ্যান্ড ফাইন।কবির সাহেবের ব্যাপারে কি বলবেন বলেন।শুনবো”
মুহিত সাহেব বললেন, “আমি আপিল করেছি।যত দ্রুত সম্ভব তাকে দেশের আদালতে হাজির করার জন্য।সব প্রুফ জমা দেওয়া শেষ।মামলা দায়ের হয়ে গেছে।কবির শুধু এই দেশে নয় ইতালি গিয়েও নিজের অপকর্মের চক্র চালিয়েছিলো।এই দেশের কিছু ক্ষমতালোভী মানুষদের মাস্টারমাইন্ড হিসেবে সেখানে বসে কাজ করতো।সো ওই সূত্রে তার কেসটা ইতালির কোর্টেও উঠবে।”
“দেশে আনবে কবে?”
“সেটাই বললাম যেখানে আগামী মাসে আসার কথা আমি চেষ্টা করছি এই মাসের শেষের দিকে।ওর মতন কালপ্রিট যত দ্রুত সাজা পাবে তত ভালো।”
“গুড! বেস্ট অফ লাক। আশা করি আপনার আপিলটা মঞ্জুর হয়ে যাবে”
রুনা শরবত নিয়ে এসেছেন।চারজনের দিকে এগিয়ে দিয়ে জানতে চাইলো কাব্য খাবে কিনা।কাব্য এক শব্দে না করে দেয়।কিছু সেকেন্ডের নীরবতা বয়ে যাচ্ছে সেখানে।সকলেই একে ওপরের মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি শুরু করলো।আর কি বলে বার্তালাপ দীর্ঘ করবে?
ছেলে মেয়ে দুজনই চারুর মুখপানে চেয়ে।কিছু বলবে বলবে ভাব।
তার পূর্বে মুহিত সাহেব মুখ খুললেন,
“তোমার শরীর এখন কেমন?”
“ভালো” সিধে উত্তর কাব্যর।
“আসলে তোমার মা…..”
কাব্যর দৃষ্টিতে পুরো বাক্য সম্পূর্ণ করলেন না মুহিত।চারু কান খাড়া করে ফেললো।কাব্যর মা?কাব্যর একগুঁয়ে মুখটা দেখে চারুই আগ বাড়িয়ে প্রশ্ন করার সিদ্ধান্ত নেয়।কাব্য তাকে কিছুই বলবে না জানা আছে। আজকালতো সব জোর তারই চলে।
“কি বলতে চাচ্ছিলেন আংকেল? ওনার মা? থেমে গেলেন যে?”
“ওর মা ওকে দেখতে চাচ্ছিলো।এখানে আসার পর কেমন আছে?এটা জানার জন্য নিয়ে আসলাম ওকে।”
সাবিনার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বললেন মুহিত সাহেব।চারু হিসেব মেলানোর চেষ্টা করছে।কাব্যর মা ওকে দেখতে চাচ্ছিলো।তাদের সম্পর্কে জেনেছে সেদিন।কিন্তু তাদের পরিচয় জানা হয়নি।তাহলে কি তারাই ছিলো?যারা এতদিন কাব্যর দেখা শুনা করেছে।
“তুমি কে মা? তোমাকেতো ঠিক চিনলাম না?”
এর জবাবে কাব্য বলে উঠে, “আমার স্ত্রী”
সাবিনা এবার মুখ তুলে তাকান।এতদিন জেনেছে তার ফেলে যাওয়া একটা ছেলেই আছে।ছেলের বউও আছে এটা জানতেন না।চোখ ঘুরিয়ে দুজনকেই দেখে নেন। মুহিত সাহেব এবং সাবিনার দুই ছেলে মেয়ে সামিরা এবং রাফসান চারুর দিকে চেয়ে আছে।
সামিরা বললো, “খুব মিষ্টি আপনি ভাবি”
ভাবি ডাকে আশ্চর্য্যচকিত চাহনি চারুর।সে কি তার ভাবি হয়?হিসেব এখনও পুরোপুরি মিলে নি।দাড়িয়ে আছে ধোঁয়াশার মধ্যিখানে।
কাব্য তেতে উঠে।
বলে, “কি সমস্যা?তোমাদের না বলেছি জোর করে সম্পর্ক জুড়তে আসবে না?”
“সরি ভাইয়া”
“ভাইয়া ডাকবে না আমাকে।”
ধমকে নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলো সামিরা।এভাবেই কথা বলে কাব্য।আপন না হোক ভাই তো।কোনো না কোনো ভাবে তারা একে অপরের সাথে জড়িত।একটা সম্পর্ক আছে তাদের।বোঝার বয়স হয়েছে সামিরা,রাফসান দুজনেরই।যমজ ভাইবোন তারা।জেনেছে তার মায়ের অতীত।কাব্যর রেগে থাকাটাও জায়েজ।বয়সে অনেক বড় হওয়ায় মুখের উপর কথা বলে না। ইচ্ছেও হয়না বলতে।অল্প বয়সে মায়ের আদর থেকে বঞ্চিত হওয়া ছেলে থেকে আর কিই বা আশা করবে?
চারু কাব্যর পেছনে এসে দাঁড়িয়ে পিঠে হাত রাখলো।শান্ত করার ইচ্ছায়।আর যেনো চেঁচামেচি না করে।
মুহিত সাহেব বললেন, “খুব সুন্দর করে ঘরটা বানিয়েছো।আমি কিন্তু আশাও করতে পারিনি এমন একটা জায়গায় এত আকর্ষণীয় একটা কাঠের বাড়ি হতে পারে।”
“ধন্যবাদ।আপনাকে এই জায়গার ঠিকানা কে দিয়েছে?”
“আমজাদ”
দূরে গাছের সাথে লেপ্টে থাকা আমজাদের দিকে চোখ কটমট করে চাইলো কাব্য।আমজাদের বুঝতে বাকি নেই সেই যে তাদের এখানে নিয়ে এসেছে?এই তথ্য ফাঁস হয়ে গেছে।কাব্য উঠে দাড়ায়। স্বাভাবিকভাবেই হেঁটে যায় আমজাদের দিকে।
প্রশ্ন ছুঁড়ে, “তুমি আমার জন্য কাজ করো নাকি অন্যদের জন্য?”
“আপ…আপনার জন্য”
কাব্য থামে।কয়েক সেকেন্ডের বিরতি নিয়ে বললো, “তোমার বিয়ে করা ক্যানসেল”
ফিরে এসে বোকার মতন হা করে চেয়ে আছে কাব্য।এই কয়েক মিনিটের মধ্যে চারু তাদের অ্যাপায়ন করতে হাজির।চা নাস্তার ব্যবস্থা করেছে।হাসি মুখে তাদেরকে এগিয়ে দিচ্ছে।চারুর সঙ্গিন দৃষ্টিপাত করে নিজের ঘরে চলে গেল।এখানে কিছু বলতে চায় না।মুখটা পর্যন্ত দেখতে চায় না এদের।
“আপনি কি রেগে আছেন?”
অনেকটা সময় পাড় করে জানতে এসেছে চারু।কাব্য কি রেগে আছে নাকি?জানার কোনো প্রয়োজন ছিলো?উত্তর না দিয়েই ফোনের স্ক্রিনে মনোযোগ দিলো।
চারু এগিয়ে আসে। পূনরায় জিজ্ঞেস করে, “রেগে আছেন?”
“না”
“হ্যা আপনি রেগে আছেন।”
“জানো যেহেতু প্রশ্ন করছো কেনো?”
“আপনি আমাকে রাগ দেখাবেন না।আমি সহ্য হবে না।”
“আমি রেগে নেই।তুমি যাও তাদের কাছে।আড্ডা দাও।”
“আপনিও আসেন।নাস্তা করবেন না।আপনার মেহমান ফেলে রেখে এখানে এসে বসে থাকলে হবে?”
চারুর দিকে না চেয়েই মৃদু রাগী গলায় কাব্য বললো, “ওরা আমার কিছু হয় না।”
“ওই আন্টিটা আপনার মা তাই না?”
কাব্য শান্ত দৃষ্টি তুলে দেয় চারুর পানে।মেয়েটির পরিবর্তন লক্ষ্য করছে।এত দ্রুত কথার ধরনেও ব্যাপক অপবর্তন।চারু কাব্যর পাশে এসে বসলো।হাত এগিয়ে এলোমেলো চুলগুলো ঠিক করে দিতে দিতে বলল,
“বাদ দিন না।হয়তো উনি তার ভুলটা বুঝতে পেরেছে।আমারও মিশ্র প্রতিক্রিয়া।আমি তাকে শ্বাশুড়ি হিসেবে সম্মান করবো নাকি আপনাকে ছেড়ে যাওয়ার দায়ে তাকে অপছন্দ করবো।কিন্তু আমি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছি জানেন?”
“কি?”
“ওনাকে বোঝার জন্য সময় নিবো।উনি কি আসলেই লজ্জিত তার কাজে? অনুশোচনাবোধটা যদি সত্যিই তার মধ্যে এসে থাকে তাহলে আমি তাকে শ্বাশুড়ি হিসেবে তার প্রাপ্য সম্মানটুকু দিবো।”
সরাসরি কাব্য বলে উঠলো, “কোনো দরকার নেই।তাকে সম্মান অসম্মান কোনোটাই দেওয়ার দরকার নেই।একজন অপরিচিত মানুষের মতন ব্যবহার করো।যেমন আমি করছি”
চারু মোলায়েম কন্ঠ প্রয়োগ করলো।বললো, “মানুষ পরিবর্তনশীল।আমাকেই দেখেন কখনো ভাবনাতেও আসেনি আমি আপনাকে ভালোবাসবো।আর এখন?তাছারাও আমার মুহিত আঙ্কেলকে দেখে অমায়িক মানুষ মনে হয়েছে।”
“তাহলে তোমাকে কবির আফনানের সাথে দেখা করানো উচিত।তার মুখ দেখে তুমি বলতে পারবে না সে এতটা জঘন্য।তাছাড়াও তোমার বাবাও একই ধোকায় পড়েছিলেন।ভালো ব্যবহারের আড়ালে সবসময় ভালো মানুষ থাকে না চারু।”
কাব্যর কথার পৃষ্টে কোনো কথা বলতে পারলো না। সত্যিইতো!এই পৃথিবীতে সহজে কাউকে বিশ্বাস করা যায় না।কাব্যকে খারাপ চরিত্রের একজন ভেবে বসেছিলো চারু একসময়। জানা ছিলো না তার কোনো অতীত।যখন জানতে পারলো সম্পূর্ণ গল্পই উল্টে যায়।এই মুহূর্তে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারছে না।কাব্যও আজ চারুলতা বলে ডাকলো না। নিশ্চয়ই গোপনে রেগে আছে?
“আচ্ছা তারা কোনো আপনার কোনো ক্ষতি করবে নাতো?”
“নাহ”
“তাহলে যত সময় তারা আছে ঠান্ডা থাকেন।আসুন নাস্তা করবেন।”
“ঘরে দিয়ে যাও।”
____
সন্ধ্যা নেমেছে নির্জন দ্বীপে।মুক্ত হাওয়া সাগর পাড়ে। কৃত্রিম হলদে বাড়ি উপকূলে সামান্য আলোও ছড়িয়েছে বটে। তমসাচ্ছন্ন আঁধারে ছোটো আলোর ফোয়ারা।পাকা গিন্নির ন্যায় রান্নার কাজে হাত লাগিয়েছে চারু।ঘরে মেহমান।তাদের আসলে মেহমানও বলা চলে না।কাব্যর খুব কাছের তবে অবস্থান খুব দুরত্বে তাদের। জনাবও নাছোড়বান্দা।একটাবার উকি দিয়েও দেখেনি।ঘরবন্দী করেছে নিজেকে।তারা আজ রাতটা এখানেই থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন।এর মূলে একজনই।কাব্যর মা সাবিনা।ছেলের প্রতি মায়া দেখা যাচ্ছে তার চোখে।চোখের কাছাকাছি নয় তার অস্তিত্বের কাছাকাছি থাকার জন্য ইনিয়ে বিনিয়ে অনুরোধ করেছে।তাদের জন্য আলাদা দুটো ঘর খুলে দেওয়া হয়।রাফসান এবং সামিরা উভয়ই সাগর পাড়ে।সেখান থেকে আসার নাম গন্ধ নেই।আমজাদের সাথে খাতির জমিয়েছেন মুহিত সাহেব।
সাবিনা এসে দাড়ালেন রান্না ঘরের কাছে। অনুমতিই চেয়ে বললেন, “আসবো?”
যত সময় যাবৎ এসেছেন তার মুখ থেকে একটা শব্দ শোনা যায়নি।হটাৎ আওয়াজে মুখ ফিরে চায় চারু।কি সুন্দর মেয়েলি গলার স্বর।নিশ্চয়ই কাব্য তার থেকেই পেয়েছে মাধুর্যভরা কন্ঠ।হাত মুছে চারু বললো,
“হ্যা অবশ্যই আসুন।অনুমতি নেওয়ার কি আছে?”
“না আমি!”
“সংকোচ বোধ করার কিছু নেই।আসুন”
সাবিনা চারুর পাশে দাড়িয়ে বললেন, “আমি..আমি কাব্যর মা।”
“জানি”
“কি করে?”
চারু হাসি মুখে উত্তর দিলো, “আপনার মুখ দেখেই বুঝা যায়।অনেক মিল।”
জোরপূর্বক হাসলেন সাবিনা।মলিন হাসি।প্রাণ নেই এতে। আমতা আমতা স্বরে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি সব জানো?”
“জ্বি”
“তাহলেতো তুমিও আমাকে পছন্দ করবে না।ঘৃনা করবে তাই না?”
চারু সাবিনার মুখের দিকে চেয়ে বলল, “আমি এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি আপনাকে পছন্দ করবো নাকি অপছন্দ।আপনার ছেলের কাছে জেনেছি যতটুক জানার।তাও সেটা একপাক্ষিক।প্রয়োজন হলে আপনার পক্ষটাও জানবো।আর যদি বলেন এখন আপনাকে কি চোখে দেখছি।তাহলে বলবো আপনার জন্য এখন এই মুহূর্তে আমার কোনো রাগ নেই।আপনি আমার স্বামীকে এতটা দিন দেখে শুনে রেখেছেন।শুধুই কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো।”
“খুব ভালোবাসো কাব্যকে তাই না?”
সাবিনার প্রশ্নে চারু শুধুই মুখ নিচু করে হাসলো।কোনো উত্তর দিলো না।প্রথমবার হয়তো লজ্জা ঘিরে ধরেছে।কাব্যকে বলেছে সে কতটা ভালোবাসে।কিন্তু এখানে সম্পর্ক ভিন্ন।যতই হোক শ্বাশুড়ি হন তিনি সম্পর্কে।তার কাছে মুখ ফুটে ভালোবাসার কথা বলা যায়?
চারুর পিঠে হাত বুলিয়ে সাবিনা বললেন, “অনেক ভালোবসবে ওকে।সারাজীবন আগলে রাখবে।কাব্য অনেক স্নেহ আর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য।আমি আর ওর বাবা যেটা পারিনি সেই অপ্রাপ্তিটা ভুলিয়ে দিতে পারবে মা?আমি জানি কাব্যও তোমার যত্নে কোনো কমতি রাখবে না।আর আমরা?খুব শীগ্রই চলে যাবো। একটু দেখতে ইচ্ছে করছিল তাই বেহায়ার মত চলে এসেছি”
চলবে…