চারুকাব্য পর্ব-২৩+২৪

0
270

#চারুকাব্য ২৩
লেখা : #azyah_সূচনা

মানুষের কণ্ঠধ্বনিতে জমজমাট কোর্ট রুম।একে অপরের সাথে কথায় ব্যস্ত।তাদের আলাপের ধর্ম আলাদা। খোশগল্প করছে না কেউ। মুখে মুখে আসামি,অপরাধ,নির্দোষ শব্দগুলোই শোনা যাচ্ছে।মানুষের পাশাপাশি আছে পুলিশ আর নিরাপত্তা কর্মীরাও।চঞ্চল সাহেবের আসার মতন অবস্থা নেই। নাহয় কোনোদিন এই দৃশ্য দেখতে মিস করতেন না।অপরাধের অন্ত দেখতে সবার আগে এসে হাজির হতেন।সাথে সাবিনা আর তার ছেলে মেয়েও। জজ এসে হাজির হলে হৈচৈও থেমে গেলো।আদালতের কার্যক্রম শুরু হবে এখনই। সর্বপ্রথম কেস কবির আফনানের।বছরের পর বছর অনৈতিক কাজের সাথে জড়িত এবং পলাতক আসামির শক্তপোক্ত মামলা।

কার্যক্রম শুরু হয়েছে।লয়ারের গলার কন্ঠ ভাসছে সারা কোর্ট রুম জুড়ে।একের পর এক সাক্ষী আর প্রমাণ পেশ করছে। তন্মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।তার অতীতের কুকর্মের অক্ষরে অক্ষরে লিখিত প্রমাণ।যেটা কাব্য নিজে তুলে দিয়েছিলো মুহিতের হাতে। উপস্থিত সকলেই অবাক।এত এত সাক্ষী হয়তোবা তারা কখনো দেখেনি।একজন ব্যক্তি এত মানুষের ক্ষতি করেছে?তাও বলা হচ্ছে এরা সংখ্যায় কম।সবচেয়ে আশ্চর্য হলো নিজের ছেলের প্রতি করা অন্যায়ের কথা শুনে। সমস্ত প্রমাণের ভিত্তিতে কবির আফনানকে যাজ্জিবন কারাদন্ড প্রদান করা হয় আদালতের পক্ষ থেকে।কেস ডিসমিস।

হাতকড়া পরিয়ে কবির আদনানকে ভ্যানের নিয়ে যাওয়ার সময় কাব্যকে দেখতে পেলো কবির।গাড়িতে হেলান দিয়ে পকেটে হাত গুজে দাড়িয়ে আছে।যেনো তার বেরিয়ে আসার অপেক্ষায়ই ছিলো।কবির আফনানকে দেখে এগিয়ে আসে নিজ থেকে।

আকষ্মিক সামনে দাড়িয়ে কবিরের শার্টের কাধে ময়লা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো,

“ময়লা ছিলো।ঝেড়ে নিঃশেষ করে দিলাম।”

তেজ বরাবরের মতই প্রখর।এক বিন্দু কলুষ নেই কবিরের চোখে।কটমট করে চেয়ে বলতে লাগলো,

“ঠকিয়েছিস তুই আমাকে!আমার সাথে থেকে আমারটা খেয়ে আমার রক্ত হয়ে আমার বিরুদ্ধেই এত বছর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলি?”

“হ্যা ঠকিয়েছি। আপনার হয়ে কাজ করে আপনার সব কৃতকর্ম টুকে রেখেছি।ব্ল্যাকমেইল করেছি।ঐযে আপনি বললেন না?আপনার রক্ত আমার শরীরে।ঠিক!আপনার আদর্শ আমি ছাড়তে পারি?ঠকবাজি আপনারইতো শিক্ষা।”

“তোকে আমি দেখে নিবো।”

কাব্য পাশ চেয়ে হাসলো। কবির আফনানকে ব্যঙ্গ করে হাসছে।হাসি থামিয়ে শান্ত গলায় বলে উঠে,

“আমাকে দেখার জন্য জেলের চার দেয়াল থেকে বের হন আগে।বাহিরের জগৎ থেকে আপনার চির ছুটি হয়েছে সেটা কি ভুলে গেলেন?”

পুলিশ তাড়া দিতে লাগলো।তার মধ্যে এগিয়ে এসেছে মুহিত সাহেব।বাকি কনস্টেবলদের ইশারা করে।চোখের ভাষা বুঝে কবির আফনানকে ধরে রেখেই তাদের কথোপকথন দীর্ঘায়িত করার সুযোগ দেয়।

কাব্য পূর্ণবার বলে উঠে, “আমাকে একদিন একটা কথা বলেছিলেন। এই লড়াইয়ে একজন জিতবে একজন হারবে। কংগ্রাচুেশন মিস্টার কবির আফনান।ইউ আর দ্যা আল্টিমেট লুজার।”

বোধ হলো তাদের কথা শেষ। হাতে টান পরে কবিরের। ভ্যানে উঠানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করেছে পুলিশ। কাব্য হাত এগিয়ে দেয় সামনের পথ দেখিয়ে।নিয়ে যেতে পারে তারা। নিজের গাড়ীর দিকে এগোনোর আগে মনে হলো আর কয়েকটা বাক্য বলা বাকি।গলা উচুঁ করে কাব্য বলে উঠে,

“আপনার মত বাবা কোনো সন্তানের না হোক।কোনো মা স্বার্থপর না হোক।”

__

বিশ্বাসের জায়গায় মাথা পেতেছে।মনের অভ্যন্তরে লালিত প্রণয়িনীর স্কন্ধে।বিশ্রাম মেলে এই বাহুতে।তাইতো নিথরভাবে পড়ে থাকা।গাড়ীর গতির সাথে দেহটা হেলে উঠলেও মন মস্তিষ্ক সবটাই হিমায়িত।বোঝা নেমেছে অনেক বর্ষের। নিজের মধ্যে ঝুঁকে একবার প্রশ্ন করেছিল নিজেকে কাব্য।কেনো মায়া হচ্ছে না তার?বাবা ছিলো?রক্তের বাঁধন।কেনো সহনুভূতি হলো না?উত্তর এসেছে ব্যতিক্রমী।এখন যাহা আছে সবটাই চারুলতায় ঘেরা।

চারুকে অপরদিকে বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে দেখা গেলো। ঝাঁকড়া চুলবিশিষ্ট মাথায় নিজের মাথাটাও এলিয়ে দিয়েছে। সর্বদার মত প্রশ্নে ঘেরাও করতে চেয়েছিল কাব্যকে।জানতে চেয়েছিল কি আলাপ চললো কাব্য আর কবিরের মধ্যে।নিজের ইচ্ছেকে নিজের মধ্যেই চেপে নেয়।এই মুহূর্তে তাকে নিশ্চুপ থাকতে দেওয়াটাই শ্রেয়।অপরাধের বিনাশ হয়েছে। এতটুকুই যথেষ্ট।

খানিক বাদে কাব্যই নিরবতা ভাঙ্গে।বলে, “এখন বাবা মার কাছে ফিরে যাচ্ছো।নিশ্চয়ই ভীষণ খুশি মহারানী?”

চারু উত্তরে বলে, “এতদিন কি অখুশি ছিলাম নাকি?”

কাব্য সামান্য মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলো, “খুশি ছিলে আমার সাথে একা?বাবা মা ছাড়া?”

“আমি তাদের সাথে যতটা খুশি থাকি। আপনার সাথেও ঠিক ততটা খুশিই ছিলাম। জনমানব শূন্য দ্বীপ উপভোগ করেছি।ভিন্ন পরিবেশে ভিন্ন অনুভূতি।আমরা আবার সন্দীপে গেলে বাবা মা চয়নকেও সাথে নিবো কেমন?”

কাব্য হাসি মুখে মেনে নেয়।আঁধারে আমজাদের চোখের অগোচরে চারুর গালে ঠোট ছুয়ে দিয়ে সম্মতি জানালো,

“আচ্ছা”

মাথা নুয়ে চোখ বুজলো চারু।নিজের তমসায় আবৃত আবছা মুখমণ্ডল অন্তরাল করতে এবার নিজে মাথা রেখেছে কাব্যর কাধে।

নম্র গলায় জানতে চাইলো, “কষ্ট হচ্ছে?”

“একদম না চারুলতা”

“সত্যিই?”

“তোমার কাছে মিথ্যে বলবো।এসো বুকে অনুভব করে দেখো কোনো পীড়া আছে নাকি ভুলের মতন সুভাসিত এই হৃদয়?”

আমজাদ লুকিং গ্লাসে নজর তুলছে বারবার।কাব্যর উল্টোপাল্টা কাজ থামাতে দূরত্ব নিলো।বিনাবাক্যে আঙ্গুল দেখিয়ে শাসিয়েছে।কাব্য ক্ষণিকের জন্য কথা শুনলেও পরবর্তীতে কানে কানে বললো,

“রাতে বুকে মাথা পেতে অনুভব করবে কেমন?”

কি অদ্ভুত! দুষ্টুমিপূর্ন কথা বলছে তবে কণ্ঠে গম্ভিরতা নিয়ে। এ কেমন কন্ঠস্বর?সত্যিই বোঝা যায় না সে কখন ব্যঙ্গ করে কখন কঠোর।আওয়াজের ধাঁচ সর্বক্ষণ এক রকম।শুধু কান্নার স্বরটাই ভিন্ন।সেদিন রাতে যা অনুভব করেছিলো চারু।

আকস্মিক কাব্য বলে উঠলো, “চারুলতা?”

“হুম?”

“শাশুড়ি মা কি আমাকে ঘরে ঢুকতে দিবে?মেনে নিবে আমাকে?….. আমারতো মনে হয় আমাকে দেখে বলবে আবার এসেছে আমার মেয়ের জীবনকে ধ্বংস করতে।”

অস্পষ্টতায় মুচকি হাসির রেখা ফুটে চারুর মুখে। শায়লাতো জানেনই না কাব্যর কথা।শুধু বাবাকে ফোন করে জানিয়েছে।এতদিন সন্দ্বীপে ভুল করেও ভিডিও কলে কথা বলেনি মার সাথে।ভেবে নিয়েছিলো সারপ্রাইজ দিবে তাকে।দেখতে চায় চারু তার মার প্রতিক্রীয়া। জবাবের আশায় চারুর বাহু ঝাঁকিয়েও কোনো নাফা পেলো না কাব্য।চুপ করে রইলো আপনমনে।

গাড়ি থেমেছে বাড়ির গেটে। গটগট করে কাব্যর হাত ধরে ঢুকে পড়তে লাগলো চারু। স্মৃতিবহ জায়গাটা।যেখানে হাতটা ছেড়ে দিয়েছিল চারু।সময়ের মোড় ঘুরে নিজেই কিনা টেনে নিয়ে চলেছে ভেতরে।বরাবরের মতই শায়লা বেগম দরজা খুলেছেন।চোখের ভ্রান্তিতে মেয়েকে দেখে হাসি এসেছিল সেটা থেমে গেলো।ভুত দেখার মতন চমকে দাড়িয়ে আছেন।পলকহীন চোখজোড়া হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে।শায়লা তৎক্ষনাৎ পলক ঝাপটান। একি স্বপ্ন!না বাস্তব।শুষ্ক ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে কিছু বলতে চেয়েও পারলেন না।সেদিনের মতই আশ্চর্যের চরম সীমায় যেদিন চারুকে বিয়ে করে এনেছিল কাব্য।আজ দ্বিতীয়দফায় এমন অনুভূতির স্বীকার।কাটকাট হয়ে দাড়িয়ে রইলো শায়লা দরজা ধরে।

“কেমন লাগলো সারপ্রাইজ মা?”

চারুর কথায় গোলগোল নয়ন প্রসারিত হয়।তর্জনী আঙ্গুল কাব্যর দিকে আলতো তুলে চারুকে প্রশ্ন করলো, “ও… ও বেচে আছে?”

“তোমার সামনেই আছে মা!”

আমজাদ নাক গলায়।তাদের মধ্যে বাম হাত ঢুকিয়ে বললো, “ম্যাডাম বিশ্বাস না হলে ছুঁয়ে দেখেন।উনি ভুত না।যদি ভুত হয় ছুঁয়ে দেখলেই আপনার হাত এপার ওপার হয়ে যাবে।”

বেকুবের মত কথাবার্তা গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে!এখানে কি নাটকের শুটিং চলছে নাকি?এমনেতেই শায়লা বেগম তব্দা খেয়ে আছেন।তার মধ্যে আমজাদের আজেবাজে আইডিয়া।বড্ড মুখ খুলেছে তার।কাব্য মাথা ঘুরায়।চোখ রাঙানির শিকার হয়ে আমজাদ মাথা মানিয়ে নিলো।ভাবতে লাগলো ফ্যামিলি ড্রামা কখন শেষ হবে?ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার তার।ভালো আইডিয়া কানে নেওয়া হলো না।এখনই ছুঁয়ে দিলে শায়লার বিশ্বাস অবিশ্বাসের কেসটাও ডিসমিস হয়ে যেতো।

চারুর হাত চেপে ঠিক একইভাবে ভেতরে প্রবেশ করার পূর্বে শায়লা বেগম বলে উঠলেন,

“এই থামো অনুমতি দিয়েছি তোমাকে ভেতরে আসার?”

যেমনটা ভেবেছিল কাব্য। মুখটা লটকে নেয়।এত দ্রুত ক্ষমা পাবে শায়লার কাছে?তাদের দরজায় দাড় করিয়ে রেখেই ভেতরে ঢুকে গেলেন শায়লা।কাব্যর বিরস মুখের দিকে চেয়ে চারুর মায়া হচ্ছে।মা এমন করলো কেনো? দাড় করিয়ে রেখে কোথায়ই বা গেলো?
হাতে অল্প সংখক গোলাপের পাপড়ি দিয়ে ভেতর এসেছেন।

এসেই দীর্ঘশ্বাস টেনে বললেন, “সেদিনের ফুল দিয়ে বরণ হওয়ার শখটা আজ পূরণ করে দিচ্ছি।এবার সংসারে মনোযোগী হবে সব ছেড়ে আশা করি”

ফুলের বর্ষণে কদম এগিয়েছে ঘরের দিকে। বারবার করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছেন শায়লা।কাব্যর যে সুখপূর্ণ মনোভাবটা?সেটা সঠিক অর্থে প্রকাশ করতে পারছে না কেনো?তার গাম্ভীর্যে ঢাকা মুখটার সাথে যায়না বলে? এখানে তৃপ্তির পর্ব চুকিয়ে চঞ্চল সাহেবের ঘরের দিকে পা বাড়ায় কাব্য।জেগে আছেন সেও।আভাস পেয়েছেন।মেয়ে আর মেয়ের জামাই এসেছে।চোখ পেতে ছিলেন ঘরের দরজায়।কাব্য সরাসরি এসে চঞ্চল সাহেবের পাশ ঘেঁষে বসে পড়লো।

হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,

“আপনাকে এমনভাবে দেখতে হচ্ছে কেনো বাবা?নিজের ক্ষতি করলেন?আমার জন্য?একটু শক্ত হওয়া যেতো না?এত সহজেই কাব্য চলে যাবে?আপনার এই বিশ্বাসটুকু ছিলো না নাকি?”

বাঁকা মুখটা নিয়ে আদো স্বরে কিছু বলতে চাচ্ছেন। স্পষ্ট না হলেও কথা বলতে পারেন তিনি।চোখের জলগুলো যে ওই সুযোগটাও দিচ্ছে না।আটকে আসছে কথা কন্ঠনালীতে।

কাব্য তাকে থামায়।পায়ে হাত চেপে বলে উঠলো, “অনেক বছর পূর্বে আমাকে যে সতর্ক সংকেত দিয়েছিলেন।আমি সেটা মেনেছি।কবির আফনানকে সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে দিয়ে এসেছি।”

“তো… ত..তোমার বাবা”

“আমি আমার বাবার কাছেই আছি।আমার পরিবারের কাছে।আপনি আর কিছু নিয়ে কোনো চিন্তা করবেন না।আর নিজের অবস্থা শুধরান।আমি আপনাকে এভাবে সহ্য করবো না।”

জোর খাটিয়ে কথাগুলো বলে কাব্য।পিছু ঘুরে আমজাদকে ডাকলো।সাথে নার্সকেও।আদেশ করলো, “প্যারালাইজড পেশেন্টদের ঠিক করার যত ধরনের ট্রিটমেন্ট আছে খবর নাও।আমাকে জানাবে দ্রুত।”

নার্স এর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো, “ওনার কন্ডিশন কি?”

উৎসুক গলায় নার্স জানান, “আমি ওনার ডিউটিতে আছি প্রায় সাত মাস।ততদিন কন্ডিশন একই রকম ছিলো যেমনটা একটা পেশেন্টের হওয়া উচিত। বিগত পাঁচ ছয়দিন যাবৎ বেশ ভালো রেসপন্স করছেন”

এর প্রেক্ষিতে চারু বলে উঠে, “আমি কত ডাকলাম বাবা?কই আমার কথাতো শুনোনি।যেদিন শুনেছো কাব্য বেচে আছে সেদিন থেকেই অবস্থার উন্নতি।আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসো তাকে?”

অনেক কাল পর চঞ্চল সাহেবের মুখে হাসি দেখা গেলো। বাচ্চাদের মতন হয়ে গেছেন একদম।বাবাকে হাসতে দেখে যেনো বুকের মধ্যে শান্তির ছড়াছড়ি হচ্ছে।

___

এক বিশাল পারাবার ফেলে এসেছে সন্দ্বীপে।তার স্থান দখল করে আছে শৈবালময় জলাশয়।বিশাল সমুদ্র ধারণ করে ফিরে আসা চক্ষুর সম্মুখে এই পুকুর অত্যন্ত ক্ষুদ্র।স্থির! জোয়ার নেই কোনো কোনো নীরের উচ্ছাস। ঝিঝি পোকা ডাকে এক পৃথক পরিবেশ। ভেসে উঠে এক যুগ পূর্বের জোনাকি পোকার আলোয় আবৃত যামিনী।সুন্দর দিনের শেষে উপভোগ্য রাত ছিলো সেকালে।আজ যান্ত্রিক দাপটে বিলুপ্ত বাস্তবিক সুন্দর নিসর্গ।

কালো চাঁদর মুড়িয়ে নিসাড় দাড়িয়ে আছে কাব্য।অল্প নয় বেশ খানিক সময় জুড়েই দেখছে চারুর অন্যমনস্কতা।তিন তিনটে গাঢ় ভাজ ঠিক কপালের মধ্য বরাবর।সেও ভাবছে।চারু কি ভাবতে সেটা নিয়েই তার প্রখর ভাবনা।এখন কোনো কিছু নিয়ে ভাবার বাকি আছে?নাকি চারুর মন খারাপ?এভাবে না জানিয়ে পুকুর পাড়ে এসে বসে আছে কেনো?

“ভুতের মতন দাড়িয়ে আছেন কেনো?পাশে বসেন এসে”

কাব্য মনে করেছিল তার উপস্থিতি টের পায়নি চারু।এখন দেখা যাচ্ছে উল্টো তাকেই চমকে দিলো।পাশ ঘেঁষে বসে নিজের গায়ের চাদরটা চারুকে উড়িয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,

“কিভাবে বুঝলে?”

“ষাঁড়ের মতন নিঃশ্বাস নিলে আমি কেনো এখানে উপস্থিত পোকা মাকড়রাও টের পাবে” বলে হেসে উঠে চারু।

হাহ শব্দ করে উঠে কাব্য। পরবর্তীতে বললো,

“এখানে বসে আছো যে?মন খারাপ?কোনো চিন্তা?”

“মন খারাপ,চিন্তা কোনোটাই না।আমি সন্দ্বীপে সাগর পাড়ে বসে চাঁদ দেখাটাকে খুব মিস করছি।”

“আবার যাবে?”

“কিভাবে যাবো?একজন শিক্ষিকা হয়ে এক সপ্তাহের মতন ছুটি কাটিয়েছি।আর সম্ভব নয়।আমারও কিছু দায়িত্ব আছে।আপনাকে পেয়েতো দায়িত্ব ভুলতেই বসেছিলাম।” পূনরায় হাসে চারু।

কাব্য কিছু বলতে যাচ্ছিলো।তার আগেই আমজাদ এসে হাজির।লোহার বালতি হাতে। কাঠ এনেছে কুড়িয়ে।দুর থেকেই অন্যদিকে চেয়ে সামান্য চেচিয়ে বললো, “স্যার আগুন জ্বালাই?ঠান্ডা এখানে। মশাও আছে”

দুজনই ঘুরে চায়।আমজাদের ভুল সময় আগমনটা পছন্দ হয়নি কারোই।তবে তার কথাও ঠিক আছে।মশার উপদ্রব বেশি। তাছাড়াও এখন হালকা শীত শীত ভাব।এই যাত্রায় ক্ষমা করে দেওয়াটাই শ্রেয় বলে মনে হয়।অনুমতি পেয়ে আমজাদ তার কাজে উদ্যত।আগুন জ্বালিয়ে আনমনে গুনগুন করতে করতে চলে গেলো ঘরের দিকে।সে বুজে একান্ত সময়ের মর্ম।যতই অবিবাহিত হোক।

“ধন্যবাদ তোমায়”

আগুনের শিখায় কাঠ দিয়ে নাড়াচাড়া করতে থাকা হাত থামে কাব্যর।বোকা লোক! মনভুলা।আমজাদ এসে ভুলিয়ে দিয়ে গেছে কিছু বলার ছিলো।এর আগেই চারুর জাদুকরী ‘ তুমিময় ‘ ডাকে আপ্লুত করে তুলেছে সর্ব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ।জানার ইচ্ছে পোষণ করছে হৃদয়।কেনো এই সুমধুর ডাক?কেনো জানানো হলো ধন্যবাদ?

“কেনো ধন্যবাদ দিচ্ছ চারুলতা?”

চারু উত্তর দেওয়ার পূর্বে কালো চাদরটি কাব্যর গায়ে উড়িয়ে দিল।চাদরের আদান প্রদান হচ্ছে একে ওপরের দেহে।তবে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে চারু।এগিয়ে নিরিহ মানবের বক্ষে নিজের মাথা পাতে অভিলাষে।চাদরের উষ্ণতা কাব্যর গরম দেহের উষ্ণতার কাছে তুচ্ছ।চোখ জোড়া বুজে উন্মুক্ত করতে লাগলো মনের মাঝে পুষে রাখা কৃতজ্ঞবাণী।

“পরীক্ষা খুব ভালো দিয়েছিলাম।নিজের উপর ভরসা ছিল হয়তো আমার চাকরি হয়ে যাবে।একটু একটু আত্মবিশ্বাস হচ্ছিলো নিজের উপর।এক্সাম হল থেকে বেরিয়েই আমার চোখজোড়া সবার আগে কাকে খুঁজেছে জানেন?”

অবলীলায় উত্তর আসে কাব্যের দিক থেকে, “আমাকে”

“হ্যা।সেদিন আপনার জন্য রাগ অভিমান বাদ দিয়ে মন থেকে ধন্যবাদ দিতে চেয়েছিলাম।আমাকে সুযোগ দিলেন না!”

মৃদু কেপে উঠে চারু।শেষ বাক্যেই ছিলো ছোটোখাটো ভূমিকম্প।বারবার স্মৃতিচারণ হয়ে থমকে দেয়।কাব্য বুঝতে পেরে বাঁধন শক্ত করে। দুর্বল লতাকে লুকিয়ে রাখবে।আড়ালে, আবডালে।

“আপনি বলেছিলেন হাওয়ায় মিশে ছুঁয়ে দিতে আসবেন আমায়।আপনার কথা সত্যি ছিলো।প্রতিরাতে আমাকে বিরক্ত করতো আপনার কন্ঠস্বর।বাতাস ছুঁয়ে দিলেই মনে হতো আপনি আশপাশেই আছেন।লুকিয়ে বেড়াতাম নিজের কাছ থেকেই কাব্য!আমি নিজের শ্রুতি ভ্রম,এই বাতাস,আপনার অনুভবকে এড়ানোর চেষ্টা করতাম।যেদিন বেশি খারাপ লাগতো আপনার শার্ট পরে ঘুমিয়েছি।আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন।অনেক কাঁদিয়েছেন।অনেক!”

কান্নার আভাস স্পষ্ট।অভিযোগ করছে বাচ্চাদের মতন।বুকে লেপ্টে থাকা বিশাল ঝড়।হৃদয়ের ঝড়।নিজের প্রতি নিজের আক্রোশ বাড়াচ্ছে।সেই বা কি করতো? পরিস্থিতির কাছে নিজেই যে হাতকড়া পড়ে ছিলো।তারপরও নিজের ঘাড়ে নিলো এই দোষ।চারুকে কাঁদানোর শাস্তি চেয়ে বললো,

“আর কখনো যাবো না চারুলতা। প্রয়োজন হলে শাস্তি দাও।”

“দিবো!আমি অনেক জ্বালাবো আপনাকে।মা বলেছে সংসারে মনোযোগী হতে।আপনাকে এখন হতে হবে সাংসারিক পুরুষ। মাস্তানি সব বাদ!”

কিঞ্চিত হাসি ফুটে কাব্যর মুখশ্রীতে।বলে উঠে, “আমি মাস্তানি করি?”
“তো করেন না?যেসব ছেলেদের কাছে পিস্তল থাকে তারা সবাই মাস্তান, গুন্ডা ”

“তাই?আজ প্রথম শুনলাম।তোমার মতেতো তাহলে আর্মি, পুলিশ সবাই মাস্তান গুন্ডা ”

আকস্মিক কন্ঠে ঝাঁঝের আভাস পাওয়া গেলো।কাব্যর যুক্তির কাছে হেরে যাবে যাবে ভাব।তাই নিজের অস্ত্র প্রয়োগ করে।ধমকের অস্ত্র।

চারু ধারালো গলায় বলে উঠে, “চুপ থাকেন।আমি এত যুক্তিযুক্ত কথা শুনতে চাই না।”

ক্রমান্বয়ী হাসির গুঞ্জন ছড়ায় চারুর কর্ণকুহরে। মাঝেমধ্যেই এভাবে হাসে কাব্য।নাহয় মুচকি হাসি। ব্যাস!এটাই তার হাসির ছোট এবং বড় উভয় সংজ্ঞা।চারু মিস করতে চাইলো না এই দৃশ্য। দ্রুত চোখ তুললো।এরই মাঝে বিলীন হয়েছে পুরুষালি হাসির ঝংকার।

ক্ষুদ্র ভাসা অক্ষিজোড়া চারুলতায় মত্ত হয়। ভরাট কণ্ঠে বলে,

“সম্মোহনী লতার মাদকতায় তলিয়ে যাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এ কেমন আসক্তি? হৃদয়কে সুখময় যন্ত্রণা দিচ্ছে”

চলবে…

#চারুকাব্য ২৪
লেখা : #azyah_সূচনা

ডাক পড়েছে শীত আসবে।কনকনে হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় জড়োসড়ো হবে প্রত্যেকটা মানব দেহ।তবে থেমে থাকবে না। বদ্ধ গাড়ীর ভেতরে গুমোট পরিবেশ।কাব্য উকি দিয়ে আছে বাহিরে।কাছ ভেদ করে চক্ষু দেখছে ছাত্রছাত্রীদের দলকে।আড্ডায় মেতে থাকা তরুণ তরুণীদের হাসি খেলা মুখগুলো কাব্যের ঠোঁটেও সামান্য ছোঁয়া দিয়েছে।শিশুরা উৎসুক হয়।নতুন কিছু দেখলে দৃষ্টিকে আগ্রহী করে।কাব্যর ক্ষেত্রে বর্তমানে এর বিপরীত কি?সেও একই কাজ করছে।

কৌতূহলি হয়ে কাব্য মুখ ঘুরিয়ে বললো, “পুরনো সময়ের কথা মনে পড়ছে চারু।আমিও এক সময় এদের মধ্যে একজন ছিলাম”

তার কথার ভাঁজে চরুও একই সুরে আওড়ায়, “আমিও”

“তোমার ক্ষেত্রে সময় দূরত্ব অল্প।আমার বিশাল।আমি একে অতীত বলেই ধরি।সুন্দর অতীত।সব খারাপের মধ্যে এই সময়টাইতো সবচেয়ে ভালো ছিলো।”

“এখনও সময় ভালো।উপভোগ করুন।আর আমাকে যেতে দিন আমার ক্লাসের সময় হচ্ছে।”

আজ চারুর সাথে এসেছে কাব্য।তার কর্মস্থান দেখবে বলে। আমজাদকে রেখে নিজেই আজ গাড়ীর স্ট্যারিং ধরে। বসিয়ে রেখেছিলো। ক্লাস শুরুর পাঁচ মিনিট পূর্বেই সে ছাড়া পাবে। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো নয়টা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। দীর্ঘশ্বাস ব্যতীত আর কিছুই করার নেই।এখন তার লতা বিশাল এক সময়ের জন্য চক্ষু আড়ালে থাকবে।চার ঘণ্টা!কম নয়।

চারুর কপালে চুমু খেয়ে বললো, “যাও।আমি অপেক্ষা করছি”

চক্ষু কপালে তুলে চারু প্রশ্ন করলো, “এখানে অপেক্ষা করবেন?”

“হ্যা করতেই পারি।আমি কি তোমার মত কর্মজীবী নারী নাকি?আমার হাতে অঢেল সময়।”

“একদম না!বাড়ি যান।ছুটি হলে নিতে আসবেন।”

“অপেক্ষার মর্ম বুঝো লতা?তৃষ্ণার্ত-প্রতীক্ষায় নেতিয়ে পড়া চোখ যখন হুট করেই কাঙ্ক্ষিত মানুষের দেখা পাবে? সেই অনুভুত সস্তির কোনো উপমা হয় না”

চারু ঘড়িতে দৃষ্টি দেয়।দুর্ভাগ্য! কাব্যর এই সুন্দর কহনের বিপরীতে হাসিটুকু দেওয়ার সময় নেই। দ্রুততম উপায়ে তার কপাল ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে বলে,

“পাগল তুমি! আসছি”

অতিমাত্রায় প্রেমের জোয়ার যখন নারী হৃদয়ে বয়ে যায়?তখন তা প্রকাশ পায় তার ডাকে। কথায়।লজ্জায়।চারুর ক্ষেত্রেও তাই। কাব্যর জন্য কখন বেশি আবেগপ্রবণ হয় তার টোটকা নিজেই নীরবে বলেছে। ‘ তুমিময় ‘ ডাকে ছুরাঘাত চালায় অন্তরে। কণ্ঠের মোহে ডুববে নাকি সঙ্গেসঙ্গে প্রতিক্রীয়া দেবে? তা ভাবতে ভাবতেই সময় যায় অধম প্রেমিকের।এইতো!দাগ কেটে চলে গেলো।সে কি জানে?তার স্পর্শের চেয়ে বেশি তার এই ডাকে আসক্ত স্থির পুরুষটি?

অপেক্ষার মর্ম উপলব্ধি করেছে কাব্য।ব্যাকুল হৃদয় এক ঘণ্টায় ছটফট শুরু করেছে চারুলতার দেখা পাওয়ার জন্য।এখনও অনেক সময়।এমন পাগলামোর মানে আছে। অবচেতন মন শাসিয়ে প্রশ্ন করছে কাব্যকে।কিভাবে থেকেছে তাকে ছাড়া প্রায় এক বছর? দূর থেকেই সেধেছে তাকে।এখন কাছে পেয়ে লাভ দ্বিগুণ কেনো?তার সর্বত্র হরণ হয়েছে পূর্বেই।আর কি বাকি আছে? কিছুইতো না।নিজের কপালে হাত চেপে অবাধ্য মাথাটাকেও সিটে এলিয়ে দেয়।ঘুম হলো শ্রেষ্ঠ ঔষধ।স্বপ্নে চারুকে নাহয় কাছাকাছি অনুভব করে নেবে?
এ্যালার্ম এর ধ্বনিতে লাফিয়ে উঠে।চারু বেরিয়ে আসার পাঁচ মিনিট পূর্বের এলার্ম দিয়েছিলো।যেনো ঘুম আসলেও আগে আগেই জেগে উঠতে পারে।সেই মোতাবেক কাজ করেছে মোবাইল ফোন।কানের কাছটায় বেজে উঠেছে সময়মতো।কাব্য চোখ কচলে নেয়।গ্লাস ভেদ করে পুনরায় বাহিরে তাকায়।মিনিট পাঁচেক পর চারু বেরিয়ে এসেছে।আসন্ন মুখের হাসি বাঁধা প্রাপ্ত হলো কোথাও। ভারাক্রান্ত হয়ে উঠলো চোখ মুখ।একজন পুরুষকে চারুর পাশে দেখে।এরই মাঝে পিত্তি জ্বলে উঠে।এই লোকটা ওই তানভীর নয়তো? তড়াক করে দরজা খুলে বেরিয়েছে।সরাসরি চারুর পাশে দাড়িয়ে তাকে সামান্য নিজের দিকে টেনে সরিয়ে নিলো।একহাতে চারুর হাত চেপে অন্য হাত পকেটে গুজেছে।

কাব্যর এমন কাণ্ডে সামান্য বিব্রত হলেও চারু সামলে নেয় পরিস্থিতি। তানভীরের উদ্দেশ্যে বলে, “জানতে চেয়েছিলেন না কে সেই সৌভাগ্যবান লোক?যে আমাকে সবার আগে এসে নিজের করে নিয়েছে?”

তানভীর হাসার চেষ্টা করলো সামান্য।হৃদয়ের কয়লা মুখে কেনো প্রকাশ হবে?সেটা নাহয় এক কোণে চাপা পরেই থাক।

কাব্যর দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে, “উনি?”

“হ্যাঁ।আমার স্বামী কাব্য”

এখন বোধ হলো কাব্য ভুল। ‘ তুমিময় ‘ ডাকের চেয়ে ‘আমার স্বামী ‘ সন্মধনটা বেশি মধুতুল্য মিষ্ট।কতই না মান করে পরিচয় দিচ্ছে তার?চারু বেজায় ঝামেলায় ফেলে দিলো কাব্যকে। প্রণয়ের হরেক রং। কোনোটাইতো নেই কাব্যতে।এভাবে নিত্য নতুন ভালো লাগায় ঘেরাও করলেতো মস্তিষ্ক দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়বে।

নিজের ভালো লাগায় ডুবে যে তানভীরের এগিয়ে রাখা হাতটা উপেক্ষা করে যাচ্ছে সেখানে খেয়াল নেই। চারু সামান্য ধাক্কা দিয়ে তার জ্ঞান ফেরায়।

চারু বলে,

“উনি হচ্ছেন আমার কলিগ মিস্টার তানভীর।”

যেমন চিন্তা করেছিলো সেটাই। এখন হাতটা এগিয়ে দিতেও ইচ্ছে করছে না।কতবড় সাহস তার!চারুকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।এখন আবার এসেছে হ্যান্ডশেক করতে।চারুর দিকে এক পলক চেয়ে না পারতে হাত এগিয়ে দিলো।

তানভীর ভদ্রতা সুলভ বলে উঠে, “এক এক কাপ চা খাওয়া যাক?আপনার সাথে আমার প্রথম দেখা খালি মুখে ফিরিয়ে দেবো না।আসুন”

কাব্য স্বাভাবিকভাবেই যেতে নারাজ।কেনো চা খাবে? অযথা সময় নষ্ট। তানভীরের অগোচরে চারুকে ইশারায় বারণ করে যাচ্ছে। চারুও একইভাবে তাকে আশ্বস্ত করলো। মিনমিনিয়ে বললো, “এক কাপ চা ই তো”

চায়ের স্বাদ মিষ্টি হয়।তেতো লাগছে কেনো কাব্যর কাছে। পাশেতো চারুলতা আছে।তারপরও বিরক্তিকর পরিবেশ।ইচ্ছে হচ্ছে গরম ফুটন্ত চা তানভীর নামক চারুর কলিগের মাথায় ঢেলে দিক।নিতান্তই বাচ্চাসুলভ চিন্তাভাবনা।তবে এই ভাবনাকে দমাতে পারলো না।যখন সে জানে তানভীর চারুর মায়ায় আটকে।চোখ বলে তাঁর। ব্যথিত প্রেমিকের মতন করুন মুখ।

“আপনি বিয়ে করবেন?”

তানভীরের নাকে মুখে উঠে গেছে আকস্মিক। কিংকর্তব্যিমূঢ় চারুর নয়নদ্বয়ও।এটা কেমন প্রশ্ন?তাও হটাৎ তানভীরের পানে চেয়ে।

কাব্য আবার প্রশ্ন করে, “আপনিতো অবিবাহিত রাইট?বিয়ে করে নেন একটা ভালো মেয়ে খুজে।আপনি না পারলে আমি আপনাকে সাহায্য করবো।”

পথ থেকে সরানোর পাঁয়তারা।ভালোভাবেই বুঝেছে তানভীর।মাথা দুলিয়ে হেসে উঠলো।পরক্ষনেই মুখ ফুটে বলে, “আমার জন্য অলরেডি মেয়ে খুঁজছে আমার মা।হয়তো শীগ্রই আমার জন্য নির্ধারিত কাউকে পেয়ে যাবো।আপনি অবশ্যই আসবেন আপনার স্ত্রীকে নিয়ে”

মন বিদ্রোহ করে বলে উঠে কাব্যর, “আসবো না!কোনোভাবেই আসবো না!”

গটগট করে চা গিলে সাবার। কাব্য তানভীরকে সুযোগ না দিয়েই বিল মিটিয়ে নেয়।চারুর হাত চেপে নিচু গলায় বললো, “চলো চারুলতা”
চারুলতা? পূনরায় হাসে তানভীর কাব্য আর চারুকে বিদায় দিতে দিতে।ধরতে পারলো ঘটনার বিস্তারিত।চারুলতা বলতে কঠোরভাবে বারণ করেছিল তাকে।কেননা এই নামটা একজনের জন্যই বরাদ্দ।হাসি মিয়ে যেতেও সময় নেয়নি।এক অদ্ভুত পীড়া ছুঁয়ে যাচ্ছে।খারাপ লাগছে।কষ্ট হচ্ছে।ভালোবাসার দহন কি এরূপও হয়? ধড়ফড় করতে থাকা হৃদপিণ্ডকে শান্ত করলো তানভীর।বড্ড দেরি করে ফেলেছে।এখন নাহয় আসন্ন সঙ্গিনীর জন্য প্রস্তুত করুক নিজের হৃদয়কে?

__

আমজাদের জন্য কোথা থেকে কখন আটটি মেয়ের ছবি আর বায়োডাটা কালেক্ট করেছে কাব্য।ঠোঁটের উপর তর্জনি আঙ্গুল চেপে।পায়ের উপর পা তুলে সাহেবী ভঙ্গিতে বসে। যার বিয়ে তাকে দেখতে দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না।নিজেই চোখে চশমা পরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।আমজাদ কাকে দেখবে?অনেক শত দিন পর সচ্ছ চশমায় চক্ষু আবৃত করা কাব্যকে নাকি মেয়েদের ছবি?মনে মনে ভেবে নিলো কাব্যকে দেখে লাভ নেই।সুদর্শন হওয়া সত্বেও হুতুম পেঁচার মতন মুখ বানিয়ে রাখে।কি করে চারু তার প্রেমে পড়ল!
নিজের দেখা শেষ করে ছবি আর বায়োডাটা আমজাদের কাছে এগিয়ে দিলো।

বললো, “দেখো কাকে পছন্দ হয়”

ছবি দেখার আগে আরেকটি প্রশ্ন মনে উকি ঝুঁকি দিচ্ছে।করবে?করেই ফেলা যাক।আমজাদ জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে বলল, “আপনি এই মেয়েগুলোকে কোথায় পেলেন?”

“কোথায় পেলাম মানে?এমন ইঙ্গিতে বলছো যেনো আমি মেয়েদের ধরে এনেছি!”

“না না স্যার!আমি বলতে চাচ্ছিলাম আপনার ছোটো থেকে বড় কাজ আমিই করি।আপনি কিভাবে?কাকে দিয়ে?”

ঘুম ঘুম ভাব কাব্যর মুখে। হাই তুলে বললো, “শাশুড়ি মা হেল্প করেছে।আজকাল একটু ভালোবাসে। সেই সুযোগে তোমার কাজটাও হয়ে গেলো”

উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট আমজাদ। সিনা টেনে বসেছে তার হবু বউ বাছাই করতে।কি মুশকিল!একে একে তিনটে মেয়ে পছন্দ হয়ে গেলো।তাদের বায়োডাটাতে বয়স দেখে কপালে ভাজ পড়ে আমজাদের।কারো বয়স আটাশ কারো ত্রিশের উপরে।

চিন্তামগ্ন আমজাদের দিকে চেয়ে কাব্য সুরেলা কন্ঠ টানে,

“আমজাআআদদদ”

“জ্বি!…. জ্বি স্যার?”

“পছন্দ হয়নি”

“হয়েছে স্যার।কিন্তু এদের বয়স বেশি”

“তো?আমি ইচ্ছে করেই এমন বয়সের মেয়ের তলব করেছি”

“কেনো স্যার!” বিরস,করুন মুখে প্রশ্ন করে আমজাদ।

গলা খাকারি দিয়ে কাব্য উত্তরে বলে, “তোমার মত দামড়া লোকের জন্য কি আমি অষ্টাদশী কিশোরী খুজবো?বয়স দেখেছো নিজের”

এতে আমজাদের দোষ কোথায়?তার বিয়েতে সর্বপ্রথম বাঁধা কাব্য।তার দায়িত্ব,সেবা যত্ন করেইতো অর্ধেক জীবন পাড় করলো।এখন কিনা নিজের পছন্দ প্রকাশ করতে পারবে না? বয়স বেড়েছে কার দায়ে।মানুষ নিজের বেলা বোঝে ষোলো আনা আমজাদের বেলায় এক আনাও নয় কেনো?

বেশি বয়সের নারীদের আমজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের একান্ত নারীর কাছে।যাবে ঠিকই।কিন্তু মন বিসন্ন।ভেবে নিয়েছে একটু রাগ দেখাবে।কি দরকার অন্য পুরুষের সাথে কথা বলার? তাকানোরই বা দরকার কি? সোজাসুজি এড়িয়ে যাওয়া ভালো নয়?হোক কলিগ!

ঘরে পা রাখতেই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়, “কোথায় ছিলেন?”

বিছানার কোণে বসে পা তুলতে তুলতে মোটা গলায় উত্তর দেয়, “আমজাদের সাথে”

কোমরে দুহাত রেখে চারু আবার বললো, “আমি আপনার বউ নাকি আমজাদ সাহেব?আপনাদের লক্ষণ আমার মোটেও ভালো লাগেনা।”

বিড়বিড় করে কাব্য বলে, “আমারও ভালো লাগেনা তানভীরের লক্ষণ।”

স্পষ্ট শুনতে না পারায় চারু জিজ্ঞাসা করে,

“কি বললেন?”

“কিছু না। লাইট নিভিয়ে দাও ঘুমাবো।”

অত্যুগ্র শোনালো কাব্যের আওয়াজ।আজ প্রশান্ত কণ্ঠে বুকে ডাকলো না। ব্যাধিতে ধরেছে তাকে। অভিমানজনিত ব্যাধি।কারণটা আচ করতে পারলেও কাব্যর মুখেই শুনতে চায়। কোমরে হাত রেখে দাড়িয়ে ক্লান্ত।রুষ্ট মানব ঘুমের ভান করেছে।আধাঁরে ঢেকে দিল নির্জন কক্ষটিকে।মুখ বরাবর শুয়ে দৃষ্টি রাখলো কাব্যর চেহারায়। ঝাপসা।তবে পুরোপুরি আড়ালে নয়।মুখের দাড়িগুলো এত দ্রুত বৃদ্ধি পেলো কি করে?এখন যে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হচ্ছে।তবে তৎক্ষনাৎ এই ইচ্ছা ত্যাগ করে চুলে হাত ছোঁয়ালো।

ধীমা গলায় প্রশ্ন করে, “রাগ নাকি জেলাস?”

থমথমে গলায় তৎক্ষনাৎ উত্তর আসে, “দুটোই”

আপনাআপনি হাসি ফুটে চারুর মুখে।রাগ করেছে, হিংসে করছে এটা কি অবলীলায় মুখ ফুটে বলে ফেললো।বুকে চেপে রাখা বালিশ টেনে নিয়ে চারু বললো,

“এটাকে চাপান।আমার জায়গায় ভাগ বসাতে এসেছে।”

“উহু!আজ কোলবালিশ চেপেই ঘুমাবো।”

“আমি আমার অধিকার ছাড়ছি না”

“তানভীরের কাছে যাও!”

“ছিঃ!এত রাতে আমি পর পুরুষের কাছে যাবো?”

“কাল সকালেতো এমনিতেও যাচ্ছো”

কষ্ট হয়েছে তারপরও নিজের কাজে সফল চারু।সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে বালিশ দূরে সরিয়ে ফেলে।কাব্যর ভাজ করে রাখা হাতের আবদ্ধতা ভেঙে নিজের অধিকার ঠিকঠাক বুঝে নেয়।

“তানভীরের কাছে গেলে তোমার কষ্ট হবে না?”

নিজের হৃদয়কে লাগাম টেনে ধরতে উদ্যত হলো। এখনই ডুব দিবে চারুর মোহে।এখন একটু রাগ দেখানো দরকার। কোনভাবেই সহ্য করতে পারছে না ব্যাপারটা। তানভীর চারুকে ভালোবাসার চোখে দেখে এই মূল জ্বলনের কারণ।

“চোখ খুলো”

কাব্য মাথা দুলায়।না বোধক উত্তর দেয়।দেখা যাক চারুর তাকে মানানোর প্রয়াস কতদূর এগোয়। তুমিময় যন্ত্রণা দিয়েও লাভ হবেনা।

“আরেহ বাবা।কলিগ উনি।এর চেয়ে বেশি ওনার সাথে আমার কথাও হয় না তেমন।আজ সকালে ছুটির সময় গেটে দেখা হয়ে গেছে। ব্যাস এইটুকুই।”

চোখ খুলে তাকায় কাব্য। শক্ত মুখটা এখনও কোমল হলো না।বলে উঠলো, “ও তোমায় ভালোবাসে।”

“আমিতো বাসি না।”

“ওর দৃষ্টি আমার পছন্দ না।”

তপ্ত নিঃশ্বাসের সাথে চারু বলতে লাগলো, “আচ্ছা ওনার সাথে কাজ ব্যতীত কোনো কথা বলবো না।একসাথে চলবো না।খুশি?নাকি আরো কিছু করা লাগবে আপনার অভিমান ভাঙ্গানোর জন্য?”

“লাগবে”

“আবার কি?”

বাঁকা হাসে কাব্য। দৃষ্টিগোচর হয় সেটাও চারুর। মতলব ভালো ঠেকছে না।চোখ বুজে অষ্ঠধর এগিয়ে বুঝালো কি চাই তার।চারুর চক্ষু চড়কগাছ। সেতো এমন কিছুই বোঝায়নি।জানতে চেয়েছে তানভীরের ক্ষেত্রে আর কোনো প্রতিশ্রুতি লাগবে কিনা। সেতো নিজের লাভ ধরে বসলো।

ভাবুক চারুর দিকে হুমকি স্বরূপ কাব্য বলে উঠে, “ইউ হ্যাভ ওনলি টু সেকেন্ডস।নাহয় আমি আগামী এক সপ্তাহ মনোব্রত করবো। সো ডু ইট ফাস্ট!”

“ব্ল্যাকমেইল করছেন?”

“তোমার যেটা মনে হয় সেটাই।আমি ওয়েট করছি”

রয়েসয়ে আগ বাড়ে চারু। লালাভ বর্ণ ধারণ করবে কপোল মুহুর্তেই। তবে কাব্যর শক্ত আবদারের কাছে নিজেও ধরা। কাব্যকে ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো চারু।চোখ বুজেছে নিজ থেকেই। তড়িৎ গতিতে ছুঁয়ে সরে গেলো। ফটাফট অক্ষি মেলে কাব্য।মুখ দেখালো পূর্বের থেকে বেশি রুঢ়।যেনো চারুর পছন্দ হয়নি তার।

কণ্ঠের গাম্ভিরতা বৃদ্ধি করে বলে উঠে, “এটা কি ছিলো?অনুভব পর্যন্ত করতে পারলাম না।তুমি কিচ্ছু পারো না চারু!”

“নাহ পারি না”

ফোঁসফোঁস নিঃশ্বাসে বোঝালো আরো রেগে যাচ্ছে।চারুর এই উত্তরেও বিরাগ।এই জেদটা দেখেছিল সেদিন।বন্দুকের ভয় দেখিয়ে চারুকে নিজের নামে করে নেয়। ভরকালো চারু।ছোট্ট একটা বিষয় মোটেও বড় করতে চায় নি। তানভীরকে নিয়ে মনোমালিন্য অহেতুক।তারই মধ্যে তার চাওয়া যথাযথ পূর্ণতা পায়নি। বলিষ্ঠ এক হাতে চারুর হাতজোড়া আটকে নিলো। পরবর্তীতে যা হবে তাতে যেনো কোনপ্রকার বাধাপ্রাপ্ত না হয়।গোলগোল চোখে অবস্থা বুঝতে চাওয়া চারুকে সূযোগ দেওয়া হয়নি।অনুভব করলো খোলা গলদেশে ধারালো দন্তের দংশন। বেদনায় লাফিয়ে উঠতে চেয়েও পারলো না।চোখ বুজেই বুঝতে পারলো চাপা পড়ে আছে বিশাল আকৃতির মানবের দেহতলে।একের পর এক মৃদু যন্ত্রণায় কাতরে উঠছে চারু।

অস্পষ্ট স্বরে ডেকে উঠলো, “কাব্য!”

কন্ঠস্বরে কম্পন। পীড়ার আভাস।হাত ছেড়ে দেয় দ্রুত। দংশিত স্থানে নরম অধরোষ্ঠ এর স্পর্শনে শুষে নেওয়ার প্রয়াস শুরু করে ক্লেশ।পরপর কম্পিত চারুর ওষ্ঠে দীর্ঘ চুম্বনে মদোন্মত্ত হয়ে শুরু করে।উন্মত্ততার বৃদ্ধি পায় সময়ের ক্রমান্বয়ে। পাগলাটে আচরণ আগে কখনো দেখা হয়নি।এক ভিন্ন চিত্তক্ষোভ। বেসামাল স্পর্শে দুমড়ে মুচড়ে দিচ্ছে চারুর সর্বাঙ্গ।কখনো আবেশ কখনো যন্ত্রণাদায়ক স্বর্গবাস। অদ্ভুত দোটানা অনুভূতি। উৎকণ্ঠা হয়ে বিড়বিড় করতেও শোনা গেলো কাব্যকে। এতোটা কাছাকাছি থেকেও কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে কর্ণকুহরে পৌঁছাচ্ছে না। মস্তিষ্কে পেকেছে জট।

“পাগলামো ক.. রছেন কেনো?এখনও রাগ?

গরম নিঃশ্বাস চারুর মুখে আছড়ে দিয়ে কাব্য উত্তর দেয়, “অস্থিরতা মিশ্রিত ভালোবাসা দেখেছো।…আজ নাহয় রাগমিশ্রিত ভালোবাসা উপভোগ করো।”

একটু থেমে আবার কাব্য মাতাল গলায় বলে উঠে, “সবটাই ভালোবাসা চারুলতা।কোনো আক্রোশ নয় তোমার প্রতি। চারুকাব্যের যন্ত্রনাময় ভালোবাসা!”

চলবে..