#যদি_হঠাৎ_ইচ্ছে_হয়
#পর্ব_১২
#Saji_Afroz
ফুয়াদের কথা মনে হতেই আইরা ফোন হাতে নিলো। আজ এত কথা ওকে জানালো। কিন্তু এটাই বলল না যে, ফুয়াদের পরিচিত সেই মেয়েটির সঙ্গেই বিয়ে হতে চলেছে রাদিনের।
এই ভেবে ফোন হাতে নিলেও ফুয়াদকে ও কল করলো না।
কথাটি বলা ঠিক হবে? ফুয়াদ যদি মেয়েটিকে সবটা জানিয়ে দেয়? সব জেনে মেয়েটি রাদিনকে আইরার কথা বললে তখন যদি ও রেগে যায়! তবে আইরার বিয়েটাও ভেঙে যাবে। থাক না যে যার মতন! আইরা ফুয়াদের মতো একজন কে পেতে চলেছে। অন্যসব নিয়ে ওর না ভাবলেও চলবে। এই ভেবে ফুয়াদকে আর কিছু বলল না ও।
আরেক দফা শপিং পর্ব শেষ করলো দিশা। বরাবরই ওর ইচ্ছে ছিল সোনালী রঙের লেহেঙ্গা পরার। ওর ইচ্ছের চেয়েও বেশি পেয়ে গেছে। এত সুন্দর একটা লেহেঙ্গা পরে বিয়ের পিড়িতে বসবে ভাবতেও পারেনি।
-আর কোনো কিছু বাকি আছে দিশা?
রাদিনের প্রশ্নে দিশা বলল, হানিমুনের শপিং?
ওহহো! এতদূর অবধি ভেবে ফেললে?
-কেন নয়! আমি কোথায় যাব তাও ভেবেছি। প্রথম বিয়ে বলে কথা।
কথাটি শুনে রাদিনের মুখের আলো উধাও হয়ে যায় নিমিষেই। দিশা ওর দিকে মনোযোগ দিলে রাদিন বলল, আমার যেন দ্বিতীয় বিয়ে!
-তোমার শ’খানেক বিয়ে থাকলেও আমার সমস্যা হত না।
-তাই?
-হু। কারণ আমি তোমাকে অনেক বেশি ভালোবাসি। আর আমি জানি তুমিও আমাকে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসো। তাই না বলো?
হ্যাঁ সূচকভাবে মাথাটা নাড়ে রাদিন। হ্যাঁ, ও দিশাকে অনেক ভালোবাসে। আইরা ছিল ওর মোহ। যাকে জীবনে আনার কিছুদূর পরই ওর আর ভালো লাগছিল না। কেমন যেন আইরা! রাদিনের মতে নিরামিষ। এমন মেয়ে জীবনে থাকলে জীবনটা উপভোগ করবে কীভাবে? এই যে দিশা! হানিমুন নিয়ে অবধি ভেবে ফেলেছে। অথচ আইরা? শহরের কোনো হোটেলেই থাকতে পারলে খুশি হয়ে যেত।
গতকাল শরীর খারাপ হওয়াতে শপিং পর্ব শেষ করতে পারেনি আইরা। তাই আজ আবারও ফুয়াদের সঙ্গে বেরুলো ও। গাড়ি ঠিক করার জন্য দু’জনে হাটছে। হঠাৎ রাস্তার ধারে ফুচকার ছোট্ট দোকান দেখে আইরা থামে। ফুচকা খেতে চায় ও। ফুয়াদ বলল, এই সময়ে এসব খাওয়া আপনার জন্য উচিত নয়।
আইরা আর কিছু বলল না। ফুয়াদ ওর অন্ধকার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আবার এই সময়ে কিছু খেতে ইচ্ছে হলে খাওয়া উচিত। আর যার কাছে বায়না করে তারও আবদার রাখা উচিত। মা খালার কাছে শুনেছি।
মুখ বাঁকা করে আইরা বলল, তবুও না করলেন আমায়।
-অন্যায় করেছি। খাবেন নিশ্চয়।
আইরা খুশি হয়ে ওদিকে যেতে চাইলে ফুয়াদ বলল, উহু! এখানে নয়। শপিংমলের রেস্টুরেন্ট থেকে খাবেন। এখানে রাস্তার ধূলোবালি প্রচুর।
-কিন্তু ওখানের এক প্লেটের টাকা দিয়ে এখানে দুই প্লেট খাওয়া যায়।
-ও হ্যালো! আপনার হবু হাজবেন্ড এতটা কিপ্টে নয়! ওখানে বসেই যত প্লেট খুশি খেতে পারেন।
-পাক্কা?
-একদম।
এই বলে দু’জনে গাড়ি ঠিক করে উঠে বসে। শপিংমল এ এসে সোজা ফুড স্টলে চলে যায় ওরা। আইরা দুই প্লেট ফুচকা খায়। ফুয়াদ আরেক প্লেট অর্ডার দিতে চাইলে ও বলল, আর নয়।
-ব্যাস! মাত্র দুই প্লেট?
-পেট ভরে গেছে।
-যেভাবে বলেছিলেন আমি ভেবেছিলাম শ’খানেক খাবেন।
এই বলে হাসে ফুয়াদ। আইরা ওর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেও এক চিলতে হাসি দিলো।
ফুয়াদ বলল, আস্তেধীরে এসব খাওয়া কমাতে হবে। ভেতরে যে আছে তার জন্য ঠিক হবে না। পুষ্টিকর খাবেন বেশি বেশি। খেয়াল রাখবেন নিজের।
-আপনি আছেন তো।
-নিজের খেয়াল নিজেই ভালো রাখতে পারে। নিজের থেকে নিজেকে ভালো আর কেউ বুঝে না।
দু’জনে উঠলো। শপিং করতে শুরু করলো ওরা। একটা লিপস্টিক কেনার সময় ভুলবশত আইরার হাত থেকে তা মেঝেতে পড়ে যায়। আইরা নিচু হয়ে সেটি নিতে চাইলে তৎক্ষনাৎ ওকে নিষেধ করে ফুয়াদ। নিজে লিপস্টিকটি নিয়ে বলল, বলেছি না নিজের খেয়াল রাখতে!
আইরা মৃদু হেসে বলল, খেয়াল রাখার মানুষ পেয়ে গেছি বলে হয়তো এত বেখেয়ালি আমি ।
ফুয়াদ বলল, আবারও বলছি! নিজের খেয়াল নিজেই ভালো রাখতে পারে।
দু’জনে আবারও শপিং এ ব্যস্ত হয়ে যায়। হঠাৎ আইরার সামনে একটি মেয়ে আসে। ওকে আচমকা জড়িয়ে ধরে। আইরাও মেয়েটিকে দেখে খুশি হয়ে বলল, তোর্ষা যে!
-হু আমি। কেমন আছিস তুই? কোনো খবরই তো পাওয়া যায় না তোর!
-আছি ভালো। তুই কেমন আছিস?
-এই তো ভালো। রাদিন ভাই কেমন আছে?
আইরার মুখটা মলীন হয়ে যায়। তোর্ষা বলল, কী হলো?
-সে অনেক কথা। ওসব ছাড়। আমার এখন তাড়া আছে রে। তোকে ফোন দেব বাসায় গিয়ে। নাম্বার আগেরটা আছে তো?
-হু।
তোর্ষা ওকে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। আইরা পেছনে ফিরতেই ফুয়াদকে দেখতে পায়। যেটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ফুয়াদের প্রশ্নবিদ্ধ চেহারাটা দেখে হটকা লাগে ওর। আইরা বলল, কিছু হয়েছে?
-আপনার স্বামীর নাম রাদিন?
-হুম।
সেদিন শপিংমল এ আচমকা আইরার মুখ মলীন হয়ে যাওয়া, ও অসুস্থ হয়ে যাওয়ার সঙ্গে রাদিনের কোনো সম্পর্ক ছিল না তো!
এই ভেবে ফুয়াদ বলল, ওর সঙ্গে যার বিয়ে হচ্ছে মেয়েটির নাম?
-আমি জানি না।
-সেদিন শপিংমল এ আমার সঙ্গে যে মেয়েটি কথা বলেছিল সে কী না?
আইরা নিশ্চুপ হয়ে যায়। ফুয়াদ আবারও একই প্রশ্ন করলে ও বলল, হু!
ফুয়াদ নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলল, আপনি সেটা আমায় তখন বলেননি কেন?
আইরা আমতাআমতা করে বলল, ও ওর মতন কাউকে নিজের জীবন সঙ্গী করে নিচ্ছে। আমি নতুন করে কোনো ঝামেলা করতে চাইনি।
-সিরিয়াসলি! মেয়েটা আমার পরিচিত জানার পরেও সবটা আমাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না?
-মেয়েটাও হ্যাপি রয়েছে। তাই না?
-ও সব জানে না! রাদিন ভালো ছেলে নয়। হলে দু’টো মেয়েকে ও ঠকাতে পারতো না। আপনি মেয়ে হয়ে আরেকটা মেয়ের কথা ভাবলেন না! ভাবলেন না সেই মেয়েটির সব জানার প্রয়োজন রয়েছে!
আইরা কী বলবে ভেবে পায় না। রাদিন নিজেকে শান্ত করে বলল-
আপনাকে বিয়েটা আমি বিনাশর্তে করতে রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু এখন আমার একটা শর্ত রয়েছে।
আইরা ঘাবড়ে যায়। কাঁপাকণ্ঠে বলল, কী?
-দিশাকে সব জানাব। আর সাক্ষী হিসেবে থাকবেন আপনি। পারবেন না বলুন?
আইরা নরমস্বরে বলল, ভেবে দেখছি!
বাসায় এসে সারারুমে পায়চারি করে চলেছে আইরা। জানে না পরবর্তী সময় কিভাবে কাটবে ওর! মনে হয়েছিল সুখের দেখা মিলেছে জীবনে। কিন্তু আজ তোর্ষার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর আবারও ওর জীবনে ঝড় আসতে চলেছে।
দিশাকে সব জানালে ও রাদিনকে জানাবে। এরপর রাদিন কী ফুয়াদের সঙ্গে ওর বিয়েটা হতে দেবে? রাগের বশে যদি সবার কাছে সত্যিটা জানিয়ে দেয়?
না, না! মাথায় যন্ত্রণা শুরু হয়েছে আইরার। সামনে কী হবে ভাবতেই ভয়ে গা শিউরে উঠছে ওর। যে সত্যিটা লুকোতে ফুয়াদকে অবধি ঠকাতে বসে ছিল, আজ সেই সত্যিটা সবার সামনে চলে আসবে এটা ও মানতে পারছে না।
ফুয়াদের ফোন আসে। ও রিসিভ করতেই ফুয়াদ বলল, ঘাবড়ে আছ?
এই প্রথম আইরাকে তুমি করে বলল ফুয়াদ। আইরাও কী ওকে তুমি করে সম্বোধন করবে?
-বলতে পারো আমাকে তুমি করে।
আইরা বলল, এটা ভাবছিলাম কিভাবে বুঝলেন?
-সব বলতে হয় না মুখে। এই যেমন ঘাবড়ে আছ এটাও বুঝেছি।
-ঘাবড়ানো স্বাভাবিক নয় কী! রাদিন যদি বিয়েতে ঝামেলা করে?
-আমি তোমার হাত না ছাড়লে চলবে না? আমার জন্য নাহয় বাকি সব সহ্য করো।
এই একটা কথাতেই যেন ভরসা পেল আইরা। ঠিকই তো!
ফুয়াদ ওর জন্যে এতকিছু করছে আর ও নাহয় সাহস নিয়ে দিশাকে সব জানাবে। ফুয়াদ তো বললোই ও আইরাকে ছাড়বে না। তবে আর কিসের ভয়! আর ফুয়াদ কথা যখন দিয়েছে সে রাখবেই। এই ক’টা দিনে এতটুক অন্তত বুঝেছে আইরা। এই ভেবে ও বলল, বলুন আপনি দিশাকে সব। আমি আপনার সাথে আছি।
আইরার কাছে ভরসা পেয়ে দিশাকে ফোন করে ফুয়াদ। হঠাৎ ওর ফোন পেয়ে একটু অবাক হয় দিশা। ফোন রিসিভ করে ও বলল, কেমন আছেন?
-আছি ভালো। তুমি?
-অনেক বেশি ভালো। হঠাৎ আপনি?
-কিছু জানাতে ফোন দিলাম। আশাকরি শুনে তুমি ভেঙে পড়বে না।
দিশা একটু থেমে বলল, কী এমন বলবেন?
-রাদিন সম্পর্কে।
-রাদিন!
-হু।
-জি বলুন?
-আসলে রাদিন তোমাকে ঠকাচ্ছে। তুমি ওর প্রথম ভালোবাসা নও।
একথা শুনে হেসে দিশা বলল, রাদিনের আগেও প্রেম ছিল বুঝি? বিয়ের আগে ওমন থাকে অনেকেরই। আর বর্তমানকে এসব জানাতে নেই। এখন যখন জেনেছি তবুও আমার কোনো সমস্যা নেই।
-এমন হলে আমি তোমাকে এই ঠুংকো বিষয়টার জন্য বিরক্ত করতাম?
-তবে?
-তুমি ওর প্রথম স্ত্রী হচ্ছ না। তোমার আগেও ও অন্য একজন কে বিয়ে করেছে। যার নাম আইরা।
একথা শুনে দিশার চারপাশ যেন ঝাপসা হয়ে আসে। ও কাঁপাকণ্ঠ নিয়ে বলল, কী বলছেন এসব?
-সত্যি বলছি।
দিশা একটু থেমে এইবার কর্কশ কণ্ঠে বলল, আপনাকে আমি সম্মান করি। তাই বলে যা তা বলবেন!
-যা তা আমি বলছি না। তোমাদের লাইফ নিয়ে রাদিন যা তা করছে!
দিশা প্রায় চ্যাচিয়ে বলল, ফুয়াদ ভাই!
-শান্ত হও দিশা।
-হতে পারছি না। এসব আমি বিশ্বাসও করছি না।
-করতে তোমাকে হবেই।
-আপনার মুখের কথাতে?
-না। প্রমাণ আছে। দেখা করো কাল?
দিশা রাজি হয় দেখা করতে। ফোন রেখে ও পড়ে যায় গভীর ভাবনায়। কীসব বলছে ফুয়াদ! যতটুক ওকে চেনে মিথ্যা বলার মানুষ ফুয়াদ নয়। তবে কী রাদিন আসলেই প্রতারক!
.
চলবে