#মেঘভেজা_দুপুরের_নিমন্ত্রণে_ফিরে_এসো
#পর্ব-১৪
“বলুন তো আমার কি আপনাদের সুযোগ দেওয়া উচিত? আপনার দিক থেকে একটা সুখ স্মৃতি বলুন যেটা মনে করে আপনাদের আরেকবার সু্যোগ দেওয়া উচিত আমার। কিংবা সারোয়ারের কোন বিষয়টা মনে করে ওকে আবার জীবনে আনবো? এতো মিথ্যাচার এতো নাটক কেন করলেন আমার সাথে?”
উনি আমার প্রশ্ন শুনলেন চুপচাপ। কিছুক্ষণ পর মাথা তুলে আমার দিকে তাকালেন-“আমি মানছি অনেক ভুল করেছি জীবনে। জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে ভুলগুলো বেশ বুঝতে পারছি। সম্পদ, সন্তান আর স্বাস্থ্য তিনটে অমুল্য জিনিস হারিয়ে ফেলেছি। জীবনে আর কোন চাওয়া পাওয়া নেই রে মা। কেবল ছেলেটাকে জীবনে স্থিতিশীল দেখে চোখ বুজতে চাই। সারোয়ারের বাবাকে কথা দিয়েছিলাম, সারোয়ারকে দেখে রাখবো। এখন ফেরার সময় দেখছি আমি জবাব দেওয়ার মতো উত্তর রেডি করতে পারিনি। শান্তি পাচ্ছি নারে মা। আমি জানি সারোয়ার অনেক ভুল করেছে জীবনে। কিন্তু ঠেকে ঠেকে ও অনেক পাল্টেছে। তুমি ওকে বিশ্বাস করতে পারছো না। এটা অবশ্য সারোয়ারেরই দোষ। তবুও আমি বলবো, তুমি আমার ছেলেটাকে শেষ একবার সু্যোগ দাও মা। অন্তত বাচ্চাটার জন্য হলেও সুযোগ দাও। তোমাদের সুখী দেখলে আমি শান্তিতে চোখ বুজতে পারবো।”
“আর এই শান্তি আমি আপনাকে কেন দেব? আমার মনে পড়ে না আপনি কখনো কোনভাবে শান্তি দিয়েছিলেন। শুধু তাই না এখানে এসে আমার বাসায় ওঠার জন্যও বিস্তর নাটক করেছেন। তবুও সু্যোগ চাইছেন?”
উনি দীর্ঘ শ্বাস ফেললেন। চেহারায় বিষাদ ছেয়ে আছে-“বিধবা জীবন খুব সহজ নয় মেয়ে। তুমি যেই ভয়ে সারোয়ারকে মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে চলে এসেছিলে ঠিক তেমন কোন ভয় আমারও ছিলো। সারোয়ারের বাবা হুট করে একদিন মারা গেলো। তার সম্পদ সে নিজে কষ্ট করে গড়েছিল কিন্তু কোন কিছু কারো নামে ছিল না। যার ফলে আমার জীবিত শাশুড়ী ছেলের সম্পদের ভাগীদার হয়ে যান। সে মা ভাগীদার হলে সমস্যা নেই কিন্তু তার ভাগীদার হওয়ার সু্যোগ নিয়ে সারোয়ারের চাচা আমাদের সবকিছু থেকে বঞ্চিত করতে উঠেপড়ে লাগলো। সারোয়ারের বাবা মারা যাওয়ার ক’দিন পরেই ওরা পরিবার সমেত এ বাড়িতে উঠে আসে। আমি ব্যবসা বুঝতাম না। তাও ভাগ্য ভালো রঙ্গনের বাবা আমাকে সেই সময় অনেক সাহায্য করেছিলো। ধীরে ধীরে দুলাভাই এর কাছ থেকে ব্যবসা বুঝে নিলাম। তবুও সারোয়ারের চাচাকে পরিবার সমেত টানতে হতো। অন্যায় আবদার মেনে নিতে হতো। এদিকে আমার ননদ তার মেয়েকে রেবাকে সারোয়ারের সাথে বিয়ে দিতে চায়। তার কথা রেবাকে বিয়ে করালে সারোয়ারের চাচা এতোটা ঝালাবে না।আমি সবদিক ভেবে ননদের প্রস্তাবে রাজি হলাম। সারোয়ার আর রেবাকে দেখলাম নিজেদের মধ্যে বেশ মিল। আমি মনে মনে স্বস্তি পেলাম। এরমধ্যে সারোয়ার তোমার কথা বললে আমি অবাক হলাম। ওকে অনেকভাবে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। সারোয়ারের কথায় রেবাও দুঃখ পেয়েছিল। আত্মহত্যা পর্যন্ত করতে গেছিল। ওর ফুপু মেয়ের হাল দেখে ক্ষেপে গেলো। ওরা আমাকে ব্লাকমেল করতে লাগলো, কারণ আমি ওদের বলেছিলাম সারোয়ারের সাথে রেবার বিয়ে দেব। অপরদিকে সারোয়ার জেদ ধরছে তোমাকে বিয়ে করবে। একটা মাত্র ছেলে বলে ওকে বেশ আদর করেছি ছোটবেলা থেকেই। তাছাড়া সম্পদ রক্ষা করতেও সারোয়ারকে প্রয়োজন। কিন্তু ছেলে তো মায়ের কষ্ট বুঝলো না। ওর চাচা ফুপুদের ক্রমাগত আক্রমনে আমি বিপর্যস্ত এটাও বুঝলোনা। তার একটাই জেদ সে তোমাকে বিয়ে করবে। বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হলো। কিন্তু সঙ্গত কারণেই তোমাকে পছন্দ হলো না আমার।”
আমি হেসে ফেলি-“তাহলে এখন কেন পছন্দ করছেন? নিজেদের সব হারিয়ে এখনই কেন আমাকে যোগ্য মনে হচ্ছে? নিরাপদ জীবনের আশায়?”
উনি বিরক্ত হলেন মনেহলো। মুখের রেখায় চাপা অসস্তি দেখলাম-“এখানে পছন্দ অপছন্দের কথা হচ্ছে না দুপুর। আমার দুই মেয়ে আমার সাথে সম্পর্ক না রাখুক কিন্তু ওরা নিজেদের জীবনে ভালো আছে। এক সারোয়ার নিজের ভুলে ভরা জীবন নিয়ে এখন পস্তাচ্ছে। মা হয়ে সন্তানের এমন কষ্ট কি করে দেখি। আমার পর সারোয়ার একদম একা হয়ে যাবে। বোনরা ওকে পছন্দ করে না, বউকে নিজের ভুলে হারিয়েছে। একা পৃথিবীতে বেঁচে থাকবে কি করে আমার ছেলে? আমি তো মরেও শান্তি পাবো না দুপুর। তুমি যেমন তোমার মেয়েকে নিয়ে ভাবো আমিও আমার ছেলেকে নিয়ে ভাবছি। এতে আমি কোথায় দোষী বলো তো?”
আমি দু’ঠোট চেপে ওনার দিকে তাকিয়ে থাকি। না, এতো কথা শোনার পরও ওনার প্রতি আমার বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগছে না। ভাবছি, মানুষ ভুল করে যদি ভুল বুঝতে না পারে তাহলে বেশ বিপদ। তার ভুলেরই সাজা সে পাচ্ছে সেই রিয়েলাইজেশন তার কখনো হবে না।
“তিতুন বড় হচ্ছে। ওকে স্কুলে দেবে। সব বাচ্চার বাবা দেখে ও নিজের বাবার আবদার করবে। তখন কি করবে দুপুর? ওকে কি বলে বুঝ দেবে? আমি স্বামী ছাড়া সন্তান মানুষ করেছি আমি জানি কি পরিমাণ কষ্ট করতে হয় একজন মাকে। আর শেষ পর্যন্ত যদি সন্তান সারোয়ারের মতো হয় তাহলে তো জীবন শেষ। তাই বলছি সব ভেবে সারোয়ারকে আর একবার সুযোগ দিয়ে দেখ। অন্তত তিতুনের কথা ভেবে হলেও। মেয়েরা মা হওয়ার পর যা কিছু সিদ্ধান্ত নেয় সন্তানের ভালো ভেবেই নেয়। তুমি নিশ্চিয়ই তার ব্যাতিক্রম না?”
ওনার কথা শুনে ধন্দে পড়ে গেলাম। তিতুনকে নিয়ে চিন্তা হচ্ছে বটে। ওনার কথাগুলো খুব ভুল কিছু নয়। তিতুন বাবার কথা খুব বলতো। আর সারোয়ারকে পাওয়ার সাথে সাথে যে পরিমাণ খুশি সে হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এখন হুট করে আবার সারোয়ার চলে গেলে ওকে সামলানো মুশকিল হবে। এতোদিন বাবাকে দেখেনি সেটা একরকম কিন্তু এখন দেখার পর আবার হারিয়ে ফেললে ওর মনোজগতে কি প্রভাব পড়বে সেটা ভাবছি। এলোমেলো ভাবতে ভাবতেই হাসপাতাল থেকে ফোন এলো। একটা সিভিয়ার কন্ডিশনের পেসেন্ট এসেছে। এখনি হাসপাতালে যেতে হবে। মোমেনা খালাকে বলে বেড়িয়ে এলাম।
*****
দু’দিন হলো রঙ্গন আমাকে এড়িয়ে চলছে। হাসপাতালে দেখা হলেও ভালোমন্দ কিছু না বলেই মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। আজও তাই করেছিল। আমি ধরলাম-“রঙ্গন, এমন করছিস কেন আমার সাথে?”
রঙ্গন অবাক হলো-“কেমন করছি?”
“কথা বলছিস না।”
“ভাইয়ের বউয়ের সাথে কি কথা বলবো? কথা বলা কি উচিত?”
রঙ্গন হেলা ভরে জবাব দিলো। আমার হৃদয়ে সুই ফোটার মতো সুক্ষ ব্যাথা টের পেলাম। হেসে বলি-“মাথা গেছে নাকি তোর? কি উল্টো পাল্টা বকছিস?”
রঙ্গন গম্ভীর হয়ে আমার দেখলো-“কেন? ভুল কিছু বলেছি? তুই এখনো সারোয়ারের বউ না? তোর স্বামী, শাশুড়ী, সন্তান সবাইকে নিয়ে সুখের সংসার। সেখানে আমি কে তোর জীবনে?”
“তুই আমার বন্ধু রঙ্গন। আর কোন পরিচয়ের দরকার আছে?”
রঙ্গন হাসলো-“স্বামীর চাইতে বড় পরিচয় আর হয় না। এতোদিন আমাকে দরকার ছিলো তোর পাশে থেকেছি। এখন আর দরকার নেই।”
আমি মৃদুস্বরে আর্তনাদ করি-“কি বলছিস এসব?”
রঙ্গন বিন্দুমাত্র ঘাবড়ে গেল না। অটল গলায় জবাব দিলো-“সত্য বলছি। শুধু শুধু আমাকে বিরক্ত করিস না। সারোয়ারকে নিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার কর।”
বলেই আর দাঁড়ালো না। আমাকে ফেলে রেখে হেঁটে চলে গেলো। আমি বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম মিনিট খানেক। নিজেকে সামলে চেম্মারে এলাম কিন্তু মন পড়ে রইলো রঙ্গনের কথায়।
রাতে চেম্বার করে ফেরার পর বাসায় ফিরে আরেকদফা ঝাঁকি খেলাম। ড্রয়িংরুমে সারোয়ার বসে আছে তিতুনের সাথে। আমাকে দেখে হাসার চেষ্টা করলো-“মার শরীর খারাপ হয়ে গেছিল। আমাকে ডাকলো দেখে আসলাম। আমি কাছে থাকলে একটু সাহস পায়।”
মেজাজ খারাপ ছিলো। উত্তর দিলাম-“তো নিজের কাছে নিয়ে গেলেই তো পারো। পরের মেয়ের কথা ফেলে রাখছো কেন?”
সারোয়ারের মুখ থেকে হাসি উধাও হলো। তিতুন পাশ থেকে বলে বসলো-“মাম্মা, বাবাকে বকছো কেন? বাবা অনেক ভালো মা। বাবাকে বকে না।”
কথা বাড়াতে মন চায় না। ঘরে এলাম। সারাদিনের ক্লান্তি শরীরে জেঁকে বসেছে। গোসল করে বেরুতেই কথা কাটাকাটির আওয়াজ পেলাম। মোমেনা খালা হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলো-“খালা, ওই লোকটা আসছে।”
আমার ভ্রু কুঁচকে গেলো-“কোন লোক?”
“ওই যে আপনাকে মাঝে মাঝে এইটা সেইটা পাঠায়। ভাইয়ার সাথে ঝগড়া লাগছে তার।”
আমি দ্রুত হাতে গায়ে ওড়না চাপিয়ে এগিয়ে গেলাম। ড্রয়িং রুমে যেতেই দেখলাম সারোয়ারের চেহারা বাংলার পাঁচ হয়ে আছে। সোফায় বসে পা দুলাচ্ছে মাশরাফি ওরফে রাফি। আমাকে দেখে গা দুলিয়ে হাসলো-“ম্যাডাম, দেশের বাইরে ছিলাম। আসার পর থেকে মনটা ছটফট করতেছিল আপনাকে দেখার জন্য। তাই বাসাতেই চলে আসলাম। কিন্তু এসে দেখি এলাহি কারবার। আপনার স্বামী ক্যারেক্টার উদয় হইছে।”
আমি রেগে চেচিয়ে উঠলাম-“আপনার সাহস তো কম না, আপনি আবার আমার বাসায় চলে এসেছেন। ঢুকতে দিলো কে আপনাকে? আমি আজই সিটিউরিটির উপর কমপ্লেন করবো।”
রাফি হো হো করে হাসলো-“নিজের তৈরি করা বাড়িতে নিজে আসতে পারবোনা? কি বলেন ম্যাডাম? যাইহোক, আসছিলাম আপনাকে একবার দেখতে। দেখলাম এখন যাইগা। আর হ্যা, আপনার স্বামী লোকটা বেশি সুবিধার না। আমাকে না চিনে বাড়াবাড়ি করতেছিল তাই একটু শাসন করছি। কিছু মনে নিয়েন না ম্যাডাম। আরেকটা কথা বলতে ভুলে গেছি ম্যাডাম। আপনের জন্য ছোট একটা গিফট আনছিলাম। এই যে টেবিলে রেখে গেলাম।”
রাফি চলে যেতেই সারোয়ার আমার উপর চেচিয়ে উঠলো-“আমাকে ছেড়ে এসে ভালোই তো আছো দুপুর। রঙ্গন, এই লোক। তোমার দেখি খোঁজ রাখার লোকের অভাব নেই। এইজন্যই আমাকে দরকার হয় না তোমার।”
আমি সন্দিহান নজরে তাকিয়ে জানতে চাইলাম-“কি বলতে চাইছো?”
সরোয়ার অবজ্ঞার সাথে হেসে বললো-“বলার কি আর দরকার আছে? একজন ইয়াং মেয়ে পাঁচ বছর স্বামীছাড়া কিভাবে থাকে তা তো পরিস্কার বুঝতে পারছি। এইজন্যই আমি ফিরে আসায় তোমার ভালো লাগছে না। তাই না?”
সারাদিনের ধকলে শরীর মন নাকাল হয়ে ছিলো। সারোয়ারের কথা শুনে শরীর ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। এগিয়ে গিয়ে স্ব জোরে চড় কষালাম ওর গালে। তারপর বললাম-“বানড় কখনো মানুষ হয় না।”
★আসন্ন বইমেলা উপলক্ষে আমার দু’টো বই আসছে। একটা পলিটিকাল মার্ডার মিস্ট্রি থ্রিলার ‘অন্ধকারে জলের কোলাহল’ অন্যটা সমকালীন রোমান্টিক জনরার ‘আমি ডুবতে রাজি আছি’। চমৎকার বইদুটোর প্রি অর্ডার চলছে রকমারিসহ আপনার পছন্দের বুকশপে। আমার লেখা ভালো লাগলো বইদুটো সংগ্রহ করুন। আশা করছি বই পড়ে নিরাশ হবেন না।★
চলবে—
©Farhana_Yesmin