#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব২৮
#আরশিয়া_জান্নাত
ঘড়ির কাটা ১২টা ছুঁই ছুঁই, মৃদুমন্দ বাতাসে হোটেল ঘরের জানালার সাদা পর্দা নড়ছে, দূর থেকে ভেসে আসা জাহাজের বাঁশি, মাঝেসাঝে দু একটা গাড়ির শব্দ বাদে এই মুহূর্তে কোনো কোলাহোল নেই। রাতের আধার বাড়ায় সবকিছুই ক্রমশ নিরব হয়ে এসেছে। তৃণা অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে তার প্রিয় পুরুষটির দিকে। এভাবেই একে অপরের চোখের দিকে চেয়ে কেটে যায় অনেকটা সময়, তৃণা অস্থির হয়ে উঠে ইরহামের নির্লিপ্ততায়। বুঝে নেয় এই যন্ত্রমানবের আশায় থাকলে কিছুই হবেনা, সে এভাবেই দাঁড়িয়ে রাত কাটিয়ে ভোর আনবে! মেয়ে হয়েও সে লাজলজ্জা ভুলে আগ বাড়িয়েছে, এরপরও ইরহামের এই নিরবতার অর্থ কি দাঁড়ায়? অভিমানে-অপমানে তৃণার বুক ভার হয়ে আসে, চোখ ভিজে আসে নোনাজলে। সে হাল ছেড়ে রুমের দিকে পা বাড়ায়।
অমনি ইরহামের হুঁশ ফিরে, হেঁচকা টানে তৃণাকে নিজের শক্তপোক্ত বুকটায় আঁকড়ে নেয়। তৃণার মুখ তুলে তার ভেজা চোখের পাতায় গভীর মমতায় অধোর ছোঁয়ায়। কপালের এলোচুল যত্ন করে কানের পেছনে রেখে কপালে, গালে, নাকে এলোপাথারি চুমু খায়, যেন প্রেয়সীর মান ভাঙাতে চায় তপ্ত আদরে। অনুতপ্ত স্বরে বলে উঠে, আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি কলিজা! আমাকে মাফ করো।
তৃণার ওতেই মন গলে যায়; আবেগে আপ্লুত হয়ে ওর কলার টেনে ধরে ধরা গলায় বললো, এক দিনে আর কতবার ক্ষমা চাইবেন আপনি? আমাকে কি একটুও বুঝবেন না? আমার কত কষ্ট হয় জানেন আপনি?
তৃণার রেশমি চুলের ভাঁজে আঙুল গলিয়ে আদরমাখা কন্ঠে বলল, কি করবো বলো ভুল যে হচ্ছেই বারবার! একটা সত্যি কথা বলবে তৃণা! কি জাদু করলে বলোতো? তোমার দিকে তাকালেই আমার আর কোনো হুঁশ থাকেনা, জৈবিক কামনা থাকেনা। আমি তোমার চোখের দিকে চেয়েই অনন্ত জীবন কাটিয়ে ফেলতে পারবো মনে হয়। তুমি যে বড্ড অস্থির চঞ্চলা, কিন্তু আমি যে ধীরেসুস্থে সব করতে ভালোবাসি। তোমাকে মনভরে অনুভব করতে ভালোবাসি। তোমাকে এতোটাই গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে চাই যেন তোমার নিঃশ্বাসের ছন্দপতন ঘটলেও আমি বুঝতে পারি! আমার এই বৈশিষ্ট্যকে তুমি ভুল বুঝলে! অভিমানে মন ভরালে? তোমার দোষ নেই জানি, আমার চিন্তা ভাবনাই হয়তো ভিন্ন। আমার আরো সচেতন হবার দরকার ছিল, তোমার দিকটাও ভাবা উচিত ছিল। আমার মনের কথাগুলো অন্তত বুঝিয়ে বলার দরকার ছিল। একটাই মিনতি করছি অভিমান করে আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিও না প্লিজ! আমি তাহলে মরেই যা…..
তৃণা তার ঠোঁট চেপে থামিয়ে বলল, বাজে বকছেন কেন! এসব বলতে নেই।
ইরহাম সেই হাতে চুমু খেয়ে বলে , প্রকাশ করি বা না করি জেনে রেখো তোমাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি। এটা ইরহামের জীবনের ধ্রুব সত্যি।
ঠিক বলছেন?
ইরহাম আলগোছে তাকে কোলে তুলে রুমের দিকে এগিয়ে বলল, জ্বি ১০০ভাগ ঠিক। এখানে বসে একটু অপেক্ষা করো আসছি।
কোথায় যাচ্ছেন?
প্রথমে ভেবেছিলাম আজ টায়ার্ড থাকবে। তাই ফুলগুলি ফ্রিজে রেখেছিলাম। ওগুলো আনতে যাচ্ছি।
ফুল এনেছিলেন কখন?
ফুল ছাড়া বাসর হয় নাকি? বৌকে সঙ্গে করে এনেছি যখন ফুল আনবোনা? তোমাকে আগেও বলেছি বাসর নিয়ে আমার অনেক ফ্যান্টাসি আছে। ওটা ফুলহীন হবে অসম্ভব!
তৃণার গাল রক্তিম হয়ে উঠে। এই লোক তো খুব সাংঘাতিক,জাতে মাতাল হলেও তালে ঠিক! অথচ ভাবভঙ্গি দেখে বোঝার উপায় নেই মনে মনে কি চলছে!
ইরহাম আপনমনে গোলাপ ফুলের পাপড়ি দিয়ে বেডের উপর হার্ট শেইপ করলো, চারদিকে সুগন্ধি মোমবাতি সাজিয়ে আলো জ্বালায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরটার রূপ বদলে গেল। ইরহাম লাইট অফ করে দেয়, মোমবাতির হলুদ আভায় পুরো ঘর মায়াময় হয়ে উঠে। তৃণা ততক্ষণে জামা বদলে লালশাড়িটা পড়ে নিয়েছে,,
ইরহাম তার মাথায় আচল টেনে বলল, আমার লাল টুকটুকে বৌ! মাশাআল্লাহ!
তৃণা লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। ইরহাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো অজানা আকর্ষণে এগোতে থাকে তার প্রিয়তমার কম্পিত ঠোঁটের দিকে। ভালোবাসার বাঁধভাঙা প্লাবনে দুটো মানুষ তলিয়ে যেতে থাকে স্বর্গীয় সুখের অতল গহ্বরে,,,,
।
রুমি বহুদিন ধরে লক্ষ্য করছে কলেজ থেকে ফেরার পথে রোজ কেউ একজন পেছনে থাকে। কিন্তু পেছনে ফিরলে ব্যতিক্রম কিছুই চোখে পড়েনা। রুমি একটু অস্বস্তিতেই পড়ে বটে! রুমি স্বভাবতই ভীতু প্রকৃতির। সে চায়না অনাকাঙ্ক্ষিত এমন কিছু ঘটুক যাতে তার ভাই বোনের বিশ্বাস ভঙ্গ হয়। তার মা এখন অনেকটা নমনীয় হয়েছেন বটে তবে সুযোগ পেলে তিনিই সবচেয়ে বেশি কঠোর হবেন এ তার অজানা নয়। এই বিড়ম্বনা এড়াতে রুমি প্রায়দিন তার বান্ধবী রাখিকে সঙ্গে রাখে। বাড়ি কাছাকাছি হওয়ায় তার সঙ্গেই আসা যাওয়া করতে চায়। রাখি মামার বাড়ি বেড়াতে গেছে, তাই একয়দিন বিষয়টা আরো বেশি টের পাচ্ছে সে।
দুপুরের সময় গলিপথগুলো বেশ ফাঁকাই থাকে। প্রায় সকলেই যোহরের আজান পড়তেই দোকানপাট বন্ধ করে বাসায় চলে যায়। রুমি দ্রুত বাসার দিকে এগোতে থাকে। হঠাৎ একটা পুরুষালী কন্ঠে নিজের নাম শুনে থমকে যায় সে। পেছনে ফিরে তাকায় অচেতন মনেই। মাঝারি গড়নের সুদর্শন পুরুষ বলতে হয়। পোশাক দেখে ভদ্রলোকই মনে হচ্ছে। রুমি খানিকটা সাহস সঞ্চয় করে বলে, আমাকে ডাকছেন?
লোকটা ভরাট কন্ঠে বলে, এখানে এই মুহূর্তে আপনি ছাড়া আর কে আছে যার নাম রুমি?
আপনাকে তো আমি চিনি না!
আমাকে চেনার কথাও নয়। তবে আপনাকে আমি অনেক দিন ধরেই চিনি।
কেন ডেকেছেন?
আপনার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করছি, কিন্তু সুযোগ হচ্ছে না। আজ সুযোগ হলো বলেই আসলে ডেকেছি।
আমার তাড়া আছে, আপনি বরং অন্য সময় যা বলার বলবেন।
রুমি আপনি কি আমাকে ভয় পাচ্ছেন! ভরসা করুন আমি বখাটে নই।
ভরদুপুরে নির্জন পথে একা একটি মেয়ের পথ আটকানো ভদ্রলোকের কাজ হয়?
আমি মানছি এটা কোনো সভ্য লোকের কাজ নয়, বরং কাপুরুষত্ব বোঝায়। কিন্তু কি করবো বলুন আপনিই তো ভরা মজলিসে কথা বলতে চাইবেন না। যদি আশ্বাস দেন কথা বলবেন তবে কাল ছুটির সময় কলেজ গেইটে থাকবো।
আপনি যা বলার এখুনি দ্রুত বলুন।
লোকটি মুচকি হেসে বললো, আপনি অবুঝ নন। তবুও সরাসরিই বলছি। আপনাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি আপনাকে বিয়ে করতে ইচ্ছুক।
এই কথা আমাকে বলে তো হবেনা, আপনার যদি বিয়ে করার ইচ্ছে থাকে আমার বাসায় আসতে পারেন। আমার গার্ডিয়ান আছে ওনারাই সিদ্ধান্ত নিবে।
তবুও আপনার মতামত থাকতে পারেনা?
উনাদের মতের বাইরে অবশ্যই থাকবেনা। আর কিছু বলার নেই আশা করি?
নাহ।
রুমি আর কালবিলম্ব না করে দ্রুতপদে সামনে এগোলো। পেছনে থাকা ছেলেটা হেসে বললো, ভীতু বাট কিউট! আই লাভ ইট।
সমুদ্রের তীরের নরম বালিতে তৃণা ইরহামের বাহু জড়িয়ে হাঁটছে। অফসীজন হওয়ায় বীচে তেমন লোকজন নেই। তাই বেশ আয়েশ করেই সবটা উপভোগ করা যাচ্ছে।
জানেন আমার অনেক ইচ্ছে ছিল বরের সঙ্গে সাগড়পাড়ে পথ চলার। এটা যে সত্যিই পূরণ হবে ভাবি নি।
আর কি কি ইচ্ছে ছিল শুনি?
ইচ্ছে তো অনেক ই ছিল, তবে এই মুহূর্তে সব মনে পড়ছে না।
তাহলে এক কাজ করবে যখনই মনে পড়বে লিখে রাখবে।
আচ্ছা!
।
সাপ্তাহিক ছুটিতে ওয়াসি নিয়মিত বাড়ি আসে। একটার পর একটা ঘটনার পরিক্রমায় সে বেচারা সামলে উঠতে পারছেনা যেন। তার উপর অফিসের প্যারা। বাড়িতে সে আসেই মূলত শান্তিতে ঘুমিয়ে মায়ের হাতের রান্না খেতে। ওয়াসি ফ্রেশ হয়ে বললো, কি হয়েছে মুখ ভার করে বসে আছ কেন?
রিপা কাপড় ভাঁজ করতে করতে বললো, বিয়ে হয়েছে প্রায় দেড় মাস হতে চলল, একটাদিন কোথাও বেড়াতে নিলে না!
গত ৪বছরে আমরা কম বেড়িয়েছি রিপা?
বিয়ের আগের সাথে এখনের মিল আছে? মানুষের নতুন নতুন বিয়ে হলে কত জায়গায় যায়, একসঙ্গে সময় কাটায়। এ সময়ের ব্যাপারটাই তো অন্যরকম।
তা ঠিক। কি করবো বলো শান্ত হয়ে বসবার সুযোগ ই পাইনি।
আজ চলো না কোথাও যাই? এখানে কোনো পার্ক নেই? অন্তত ফুচকা খাওয়াতে নিয়ে চলো?
আমাকে এখন একটু ঘুমাতে দাও, বিকেলে নিয়ে যাবো।
তুমি ঘুমানো মানেই শেষ, এক ঘুমে শনিবার বিকেল! তারপর উঠে বলবে টাটা।
ওয়াসি হাই তুলে বলল, আজ যাবো বলেছি তো। টেনশন নট।
রিপা আনন্দিত গলায় বললো, আচ্ছা তুমি ঘুমিয়ে উঠো তাহলে।
চলবে,,,
#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব২৯
#আরশিয়া_জান্নাত
২৯
রিপা বেশ সুন্দর করে কলাপাতা রঙের শাড়ি পড়েছে। হাতভর্তি সাত রঙা কাঁচের চুড়ি, কপালে কালো টিপ, আর চোখে কাজল দিয়ে সেজেগুজে তৈরি। এরমাঝে বেশ কয়েকবার ওয়াসিকে ডাকা হলেও সে হু হা করে করে ফের ঘুম। উঠার লক্ষণ দেখা দিচ্ছে না। একপর্যায়ে রিপা হাল ছেড়ে দিয়ে মন খারাপ করে কফি বানাতে গেল। তাকে বসার ঘরে দেখে তাহমিনা বললেন, কি ব্যাপার বৌমা এখনো বের হস নি? ওয়াসি উঠেনি?
রিপা বলল, সে উঠবেনা মা। অনেকবার ডেকেছি। বেশি টায়ার্ড হয়তো, ঘুমাক বরং।
তাহমিনা কিছুক্ষণ রিপার মুখের দিকে চেয়ে দ্রুত ওয়াসির ঘরে গেল, ঘুমন্ত ছেলেকে ঠেলে বললো, এই ওয়াসি উঠ, উঠ বলছি! পেয়েছিস কি হ্যাঁ, এটা কি তোর ঘুমের হোটেল। সপ্তাহে একদিন আসবি আর ভুশভুশ করে ঘুমাবি। কোনো দায়িত্বজ্ঞান নাই, বিয়ে করে পরের মেয়েকে এনেছিস কেন যদি তার যত্ন নিতে না পারিস। স্বামী হবার মুরোদ নাই তোর। উঠ বদের হাড্ডি।
ওয়াসি ঘুম থেকে উঠে হাবার মতো তাকিয়ে আছে। তাহমিনা ইচ্ছেমতোন চেঁচিয়ে যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। ওয়াসি ঘুম ঘুম গলায় বললো, আম্মু কি হয়েছে? আব্বু আবার কি করছে? চিল্লাচ্ছ কেন?
হবি না তো, ভালো হবি না, তোদের বংশের ধারা এটা, ভালো হবি কেমনে! তোর বাপে আজীবন রসকষহীন ছিল। এখন তুইও সেটা। যখন শুনেছি ছেলে আমার প্রেম করছে, ভেবেছি যাক বাবা একটা তো অন্তত আমার মতো রোমান্টিক হবে! কিন্তু না এ তো তার বাপের চেয়ে আরো কয়েক ধাপ পিছিয়ে। আরেহ বিয়ের পর তোর বাবা আমাকে সিলেট দরগাহশরীফে অন্তত নিছিলো। তুই তো বৌকে নিয়ে ঘরের চৌকাঠ পর্যন্ত পেরোস না। ছি ছি ছি এতো অবিবেচক, এতো নিরস!
আমি কি করছি আবার?
তাহমিনা ছেলের পিঠে চড় দিয়ে বলল, বিয়ের পর একটা দিন দেখলাম না বৌমাকে নিয়ে বেড়াতে গেছিস। মেয়েটা পুরো সপ্তাহ তোর অপেক্ষায় থাকে। তুই কি করিস?
আমি কি করবো আমার সময় হয় না?
সময় হয়না? আহাগো সোনাগো, আমার ছেলের সময় হয়না! সে মহাব্যস্ত কুদ্দুস আলী। সারা রাজ্য উদ্ধার করছে সে কামলা খেটে। মেয়েটা কত শখ করে সেজেগুজে বসে আছে। আর তুই বের হবি বলেও উঠছিস না। শোন বাবা সময় অনেক দামী জিনিস। বিয়ের পরের এই সময়টা ভালো স্মৃতি জমাতে হয়। সামনে বাচ্চা কাচ্চা আসবে, দায়িত্ব বাড়বে। ছেলেমেয়ের স্কুল টিউটর মিলে কত ঝামেলা আসবে। তখন চাইলেও বের হতে সময় হবেনা। এখন সেসব প্যারা নেই, বেশি বেশি ঘুরবি ফিরবি। তা না! দেখি বাবা উঠ জলদি। বেলা ফুরিয়ে যাচ্ছে, বৌমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আয়।
ওয়াসি উঠে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো, এজন্য আমায় তুমি এতোগুলো চড় মারলে মা, ছোটবেলায় পড়ার জন্যও মারলেনা কোনোদিন। তুমি আসলেই বুড়ি হয়ে যাচ্ছ মা, অল্পতেই খিটখিট করো খালি।
কি বললি তুই! আমি বুড়ি হয়ে যাচ্ছি!! বুড়ো হয়েছিস তুই। আমি না। জোয়ান জাওয়ান ছেলের মধ্যে বুড়ো ব্যাটার লক্ষণ!
ওয়াসি দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে গেল, নাহ মাতারাণী আজ বেশ চটেছে। গায়ে জুতা পড়বার আগেই পালানো দরকার। বৌয়ের সামনে ইজ্জত আর থাকবেনা পরে…
তাহমিনা সামনের রুমে এসে বললো, বৌমা কোথায় যেতে চাস চটজলদি বল। সিলেট যাবে নাকি চট্টগ্রাম? আমি এখনি টিকিট কাটাচ্ছি।
মা এখন হঠাৎ কোথায় যাওয়ার কথা বলছেন?
আরেহ ধুর এখন যেতে বলছি না, আমার বলদের আশায় থাকলে তোর আর কোথাও যাওয়া লাগবেনা। আমার হয়েছে কপাল। আজীবন নিজের স্বামীকে ঠেলেঠুলে বেড়াতে যেতে হয়েছে। এখন ছেলেমেয়েদেরকেও আমাকেই ঠেলেঠুলে পাঠাতে হচ্ছে! আজ দুজনে সিদ্ধান্ত নে কাল যেন তোদের বাসায় না দেখি।
বলেই হনহন করে ভেতরে চলে গেলেন।
ওয়াসি দ্রুত তৈরি হয়ে চারদিকে উঁকি দিয়ে বললো, রিপা; মা কই? তাড়াতাড়ি চলো বের হই।
পার্কে বসে রিপা হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে তার পেটে খিল ধরে যাচ্ছে। ওয়াসি মুখ ভার করে অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো। রিপা বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, ওহ আল্লাহ পেট ব্যথা করতেছে। এই তুমি এভাবেই গাল ফুলিয়ে রাখবা! মন খারাপ করছো কেন?
ধুর মন খারাপ করবো কেন? আমার মা খুব রোমান্টিক মাইন্ডের বলেছি না আগে?
হুম, ঠিক বলেছিলে। আমি ভাগ্য করে উনার মতো শাশুড়ি পেয়েছি।
চলো রেস্টুরেন্টে বসি।
নাহ আগে চটপটি খাবো।
আচ্ছা চলো।
রিপার সব মন খারাপ যেন মুহূর্তেই ভ্যানিশ হয়ে গেছে। প্রিয় মানুষটার সান্নিধ্য আসলেই ম্যাজিক্যাল হয়!
।
বহুদিন বাদে রূপাকে দেখে সবাই বেশ প্রফুল্ল হলো। তানজিনা ঊর্মি শেফা তো জড়িয়ে ধরে কত কথা জুড়ে দিয়েছে। রূপা হেসে হেসে সব কথার উত্তর দিচ্ছে। রূপা তৃণার দিকে চেয়ে এগিয়ে আসে, জড়িয়ে ধরে বলে, কেমন আছিস?
ভালো।তুই?
ভালোই।
তোর মেয়ে এটা? মাশাআল্লাহ অনেক কিউট!
তুই নিষ্ঠুর তৃণা, কতবার তোকে নক করি রেসপন্স নাই। মানুষ এত সহজে ভুলে যায়?
তৃণা হাসলো হেসে বললো, মানুষকে ভোলা যে কঠিন নয় সেটা তোর চেয়ে ভালো কে বলতে পারবে? যাই হোক সুখে আছিস তো?
হুম। শুনলাম তোর বিয়ে হয়েছে, দাওয়াত দিলি না!
তানজিনা বলল, আকদ হয়ে আছে। অনুষ্ঠান করেনি তো। রেডি থাকিস দাওয়াত খেতে।
তা ছেলে কি করে? দেখতে কেমন?
তৃণা প্রসঙ্গ পাল্টে বললো, হঠাৎ এলি যে পড়াশোনায় কামব্যাক করবি নাকি এমনিই দেখতে??
তোদেরকে দেখতে এলাম। পড়াশোনা নিয়ে আমার কবেই এতো মাথাব্যথা ছিল।
ঊর্মি বলল, বেঁচে গেছস রে। আমরা তো পিষে মরছি। শামীম আরা ম্যাম তো নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরাচ্ছে।
হঠাৎ রূপার ফোনে তার শাশুড়ির কল আসে। রূপা স্বভাবতই সবার মাঝেই ফোন রিসিভ করে।
ভদ্রমহিলার গলার তেজ এতো লাউডস্পিকার ছাড়াই সবাই তার কন্ঠ স্পষ্ট শুনতে পায়। তিনি ফোন রিসিভ করতেই চেঁচিয়ে বললেন, তোমার কি আক্কল জ্ঞান কোনোদিন হবেনা? নাচতে নাচতে যে সকালে বের হইছো দুপুরের ভাত রান্না করে যাওনাই কেন? আড্ডাগুজব শেষ করে তাড়াতাড়ি আসো। যত্তসব রঙ্গযাত্রা দেখা লাগে আমার।
রূপা ধীর গলায় বলল, আম্মা আজ আসবো বলে আমিতো ভোরে উঠেই সব তরকারি রান্না করে আসছি, সবাই গরম ভাত খায় বলে শুধু ভাত টা করিনি, ওটা করে নিলেই হবে।
এই বয়সেও আমাকেই যদি ভাত রান্না করতে হবে তোমাকে এনেছিলাম কেন শুনি?
রূপা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললো, আমি আসছি।
সকলের মুখ থমথমে হয়ে গেল। শেফা বলল, এতোদিন বাদে এলি এখনি চলে যাবি!
তানজিনা বলল, রূপা তুই ভালো আছিস তো!
রূপা ম্লান হেসে বলল, ভালোই আছি হয়তো।
যাই রে অন্য একদিন আসবো আবার।
রূপা চলে যেতেই ঊর্মি বললো, একবেলা ভাত রান্না করতেও সমস্যা! এখন বুঝেছি ভার্সিটির বেশ কাছে শ্বশুড়বাড়ি হয়েও কেন রূপা ক্লাস করেনা।
সবাই সবদিকে সুখী হয়না, স্বাভাবিক।
ঊর্মি আর শেফা মাথা নাড়িয়ে তানজিনার কথায় সম্মতি দিলো।
।
আস্সালামু আলাইকুম
ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছে আমার বৌটা?
ভালো আপনি?
ভালো আছি। ডিনার হলো?
হুম, আপনি খেয়েছেন?
হ্যাঁ।
আপনাকে মিস করছি! ক্যামেরা অন করুন দেখবো আপনাকে।
ইরহাম উঠে লাইট জ্বালিয়ে, ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করলো। প্রিয় পুরুষটার মুখদর্শনে তৃণার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো।
তৃণা তুমি কি অসুস্থ? এই গরমে এমন কাঁথা পেঁচিয়ে আছ কেন?
নাহ নাহ অসুস্থ না। আমি বারোমাস এভাবেই ঘুমাই আসলে।
ওহ তাই বলো। আমি আরো ভাবলাম জ্বর বাঁধালে কি না।
আপনার প্রজেক্ট কেমন চলছে?
ভালোই এগোচ্ছে। দোয়ায় রেখো।
চিন্তা করবেন না, দেখবেন সব ভালো হবে ইনশাআল্লাহ।
হুম, আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পড়ো কেমন? পরে কথা হবে।
আচ্ছা।
তৃণা শুনো।
হুম?
সময় থেমে নেই জানো? আর একটু ধৈর্য ধরো। আমি তোমাকে ১রাতের জন্যও সঙ্গছাড়া করবো না,,,,
সবে তো ৪মাস হলো। এখনো কত দেরি!!
পরীক্ষার ডেট দিয়ে ফেলেছে না? আর তো ক’টা মাস। আমি আছি তো কলিজা…
হুম।
মন দিয়ে পরীক্ষার প্রস্তুতি নাও।
আচ্ছা!
রাখছি এখন, আল্লাহ হাফেজ।
আল্লাহ হাফেজ, সাবধানে থাকবেন। আর ঠিকমতো খাবেন।
যথাআজ্ঞা মহারাণী!
তৃণা হেসে ফোন রাখলো। বালিশটাকে নেড়েচেড়ে বললো, উফ এটা পর্যন্ত বিরক্ত লাগে এখন। আমার বরের বুকটা বাদে পৃথিবীর আর কোনোকিছুই আর আরামদায়ক নয়! হাহ আমি বোধহয় সত্যিই জামাইপাগল হয়ে গেছি!! ইরহাম সাহেব মাত্র ৩রাতে অভ্যাস বিগড়ে দিলেন কিভাবে বলেন তো,,,,,
চলবে,,,