#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৩৯
#আরশিয়া_জান্নাত
একটা লালচে রাঙা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা, চোখ পিটপিট করে চেয়ে আছে। একটু আগেও সে গগন ফাটিয়ে কাঁদছিল কেউ বলবে? ওয়াসি এই ছোট্ট বাচ্চাটাকে কিভাবে ধরবে বুঝতে পারছেনা, এতো ছোট্ট শরীরটা কোনোভাবে ব্যথা পায় যদি! এ এক মিশ্র অনুভূতি। বুকের ভেতর ভয়ে শিরশির করছে, আবার আনন্দ ও লাগছে। পাশ থেকে নার্স বলে উঠলো, বাহ এ দেখছি বাপ পাগল মেয়ে হবে। বাবার কোলে যেতেই কান্না থেমে গেল!
ওয়াসির কানে কথাটা খুব বাজলো, এই ছোট্ট পরীটা তাকে বাবা বলবে! সে বাবা হয়ে গেছে সত্যিই?
রিপা বললো, ওকে আমার পাশে দাও তো। একটু ছুঁয়ে দেখি আমার চড়ুইকে
ওয়াসি খুব সাবধানে ওর পাশে শুইয়ে দিলো, তারপর রিপার কপালে চুমু দিয়ে বলল, তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জান। এতো সুন্দর একটা উপহার দেওয়ার জন্য।
ও বাড়িতে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। নাতনি হবার খুশিতে পুরো পাড়ায় মিষ্টি বিলানো হলো। ওয়াজেদ সাহেব স্বর্ণকারের দোকান থেকে আগে থেকে অর্ডার করা সোনার চেইনটা দিয়ে নাতনির মুখ দেখলো। আল্লাহর রহমতে মা ও সন্তান দুজনেই ভালো আছে তাই এতিমখানায় খাবার পাঠানো হলো।
তৃণা কতক্ষন লাগবে আপনার!
এইতো হয়ে গেছে। আর ২মিনিট।
ইরহাম রুমে এসে দেখে তৃণা আকাশী রঙের কটন শাড়ি পড়েছে। চুলগুলো খোঁপা করা। সাজ বলতে বিশেষ কিছু নয় শুধু চোখে আই লাইনার আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক। এইটুকু সাজেই তাকে দেখতে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। ইরহাম ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে বললো, এ কি সর্বনাশ হলো আমিতো আবার প্রেমে পড়ে গেলাম!
বারবার প্রেমে পড়া মন্দ নয়, তবে মুখ্য হলো মানুষ টা একজন কি না!
মানুষ ভিন্ন হবার প্রশ্নই উঠেনা। আমিতো একজনের প্রেমে পড়তে পড়তেই আধমরা হয়ে গেছি।
তৃণা ওর দিকে ফিরে গলা জড়িয়ে বলল, গুড। এটাই হেলদের জন্য উপকারী।
ইরহাম তার নাক টেনে বললো, এখনতাড়াতাড়ি চলো নয়তো আজ আর যাওয়া হবেনা… আমার মন ঘুরে যাচ্ছে!!!
ধুর না, ওরা সবাই অপেক্ষা করছে। চলুন তাড়াতাড়ি।
আজ সবাই তৃণাদের বাসায় যাচ্ছে, ওর ভাইঝির আকিকা ও নামকরণের অনুষ্ঠানে। ইরহাম এখন বেশ সুস্থ। হাঁটাচলা করতে পারছে স্বাভাবিকভাবে। তৃণাকে দেখে তামজিদ দৌড়ে এলো, আপুনী তোর এতো দেরী হলো আসতে। আমি সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। আস্সালামুয়ালাইকুম দুলাভাই ভালো আছেন?
ওয়ালাইকুমুস সালাম, হ্যাঁ ভালো আছি। তুমি ভালো তো?
হ্যাঁ ভালো। রুমি আপু আর মাওই আসেননি,?
হ্যাঁ উনারা পরের রিকশায় আসছেন।
আচ্ছা।
তৃণা ভেতরে ঢুকে আগুন পোহালো। তারপর রিপার ঘরে গিয়ে দেখে তার উপহার দেওয়া দোলনায় শুয়ে তার রাজকন্যা ঘুমাচ্ছেন। একি ভাবি আমার রাজকুমারীকে দেখতে ছুটে এলাম আর তিনি কি না ঘুমাচ্ছেন!
তাহমিনা বললো, সবেই খেয়ে ঘুমালো। তোকে বললাম সকাল সকাল চলে আসতে, তুই কি না এখন এলি!
আসবো আসবো করেও কোনদিক দিয়ে যে সময় পেরিয়ে যায় হুঁশ পাইনা।
তোর যত বাহানা। আমি যাই জামাইকে চা মিষ্টি দেই। তোরা বস। খবরদার ওকে টেনে তুলবিনা, কাঁচা ঘুম ভাঙলে কান্না করবে।
তৃণা গাল ফুলিয়ে বললো, তুমি শত্রুতামি করে ওকে এখন ঘুম পাড়িয়েছ আম্মু!
আমার বয়েই গেছে! বৌমা এই সুযোগে তৈরি হয়ে নাও। মেহমানরা আসার সময় হয়ে গেছে।
ভাবি এটা তোমার জন্য,
আমার জন্য! কি এটা?
সবাই তো বাবুনীর জন্য উপহার আনবে, আমি তোমার জন্য আনলাম। দেখো তো পছন্দ হয় কি না?
রিপা প্যাকেট থেকে বক্স খুলে দেখে খুব সুন্দর একজোড়া স্বর্ণের কানের দুল।
ডিজাইন টা অনেক সুন্দর হয়েছে আপু। থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ!
তোমার পছন্দ হয়েছে? যাক আমার পরিশ্রম সার্থক হলো। অনেকক্ষণ লেগেছে এই ডিজাইন সিলেক্ট করতে জানো?
তোমার চয়েজ দারুণ।
থ্যাঙ্কস। আচ্ছা ভাবী আঙ্কেল আন্টিরা আসবেন আজ? কথা বলেছিলে?
মা তো বলেছিল আসার ট্রায় করবে, জানিনা…
আমার মনে বলছে আজ উনারা আসবে, হয়তো এতোক্ষণে রওয়ানা হয়ে গেছেন।
আমিতো আরো অনেক দিন আগে থেকে এই আশা রেখেছিলাম। কেউ তো এলোনা, ওটিতে নেওয়ার আগ অবদি আশা করেছি উনারা আসবেন….আজকে আবার আশা ভাঙবে।
মন খারাপ করোনা। আমার এই রাজকুমারীকে দেখলে পাষাণ লোকেরো মন গলে যাবে। শুধু একবার আসতে দাও।
ওয়াজেদ সাহেব গেইটের ওখানে পাতা চেয়ারে বসে কয়েকজন লোকের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন এমন সময় ২টা মাইক্রো এসে থামে তাদের বাড়ির সামনে। ওয়াসী তামজিদ সহ আরো অনেকেই প্যান্ডেলে মেহমানদারিতে ব্যস্ত। ওয়াজেদ সাহেব গাড়ি দুটোর দিকে তাকিয়ে বললেন, কে এসেছে দেখ তো মাহফুজ।
চাচার আদেশ পেয়ে মাহফুজ এগিয়ে যায়। একজন বের হয়ে বলে এটা কি ওয়াজেদ সাহেবের বাড়ি?
জ্বি। আপনারা কে?
আমরা রিপার আত্মীয়। উনাকে বলো ঢাকা থেকে এসেছি…
আপনারা ভাবীর বাড়ির লোক! আসুন ভেতরে আসুন, বড় চাচা বড় চাচা দেখেন কারা আসছে। রিপা ভাবীর আত্মীয়স্বজন আসছে। আমি যাই বাড়িতে খবর দিয়ে আসি।
ওয়াজেদ সাহেব এগিয়ে দেখলেন আমজাদ সাহেব পলিবেগম সহ রিপার ভাইবোনেরা সবাই এসেছে। তিনি অতীতের ক্লেশ ভুলে উষ্ণ অভ্যর্থনায় সবাইকে স্বাগত জানায়। আমজাদ সাহেব একটু অস্বস্তিতে ভুগলেও তাদের স্বাভাবিক আচারণে লজ্জায় পড়ে গেলেন। সেদিন যখন তারা গিয়েছিল তিনি অপমান করেছেন। অথচ আজ তারা কত সহজেই সব ভুলে তাদের গ্রহণ করেছেন। বিয়ের পর
মেয়েদের চেহারা দেখলে বোঝা যায় সে কতখানি সুখে আছে, রিপার চেহারা আগের চেয়ে বেশি উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে বলা বাহুল্য। তার উপর মাতৃত্বের সৌন্দর্য, মেয়ের চোখেমুখে উজ্জ্বলতা দেখে পলি বেগমের মনটাই ভরে উঠলো। তারা আসা না আসায় এখানে কোনো প্রভাব পড়েনি। তারা রিপাকে যত্নে রেখেছে। মেয়ে হলে অনেক পরিবারে অসন্তোষ থাকলেও বড় গরু জবাই করে এতো লোকের আয়োজন করা দেখেই বোঝা যাচ্ছে নাতনি হওয়ায় এখানে কারোই দুঃখ নেই। পলি এতো দিন মেয়ের কাছে এ বাড়ির অনেক গুণগান শুনেছে, আজ চোখে দেখে বিশ্বাস করতে আর অসুবিধা হলোনা।
রিপা তার মাকে পেয়ে গত কয়েকদিনের ঘটনা হেসেখেলে বলে যাচ্ছে। বাবুনী কে নিয়ে তাদের আহ্লাদীপনা বলতে বলতে রিপার চোখেমুখে যে কিরণ ছড়াচ্ছে তা দেখে পলির সাথে সাথে আমজাদ সাহেবের মনটাও আনন্দে ভরে উঠলো। তার মেয়ে সুখে আছে, অনেক ভালো আছে। এতেই তার সব রাগ গলে গেল যেন।
।
আকাশে আজ শুক্লপক্ষের চাঁদ। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সেই চাঁদ দেখছে তৃণা। হালকা ঝিরঝির বাতাসে ক্রিস্টলের ডোরবেলের টুংটাং শব্দ পরিবেশটা বেশ উপভোগ্য করে তুলছে। গলায় পৌরুষালী আলিঙ্গন টের পেতেই বুঝতে বাকি রইলো না এ আর কেউ নয় তার বহু শখের শরৎফুলের স্পর্শ। ইরহাম তার কানের খুব কাছে ঠোঁট রেখে মৃদু স্বরে বললো, চন্দ্র বিলাস হচ্ছে বুঝি?
তৃণা চোখ খিচে শিরশিরে রোমহর্ষক অনুভূতি হজম করার চেষ্টা করলো। ইরহাম সেটা টের পেয়ে মুচকি হাসলো। হাতের বাঁধন আলগা করে ধীরে ধীরে তার হাতে স্পর্শ করে আঁচল গলিয়ে কোমল পেটে গিয়ে থামল। আলতো চাপে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে নিলো অবনত মুখে চোখ বন্ধ করে থাকা রমণীকে। কাঁধের কাছে চিবুক নামিয়ে বললো, কি ব্যাপার উত্তর দিচ্ছো না যে?
তৃণা কাঁপা গলায় আমতা আমতা করে বললো, হ্যাঁ ঐ চাঁদ উঠেছে তো তাই দেখছি।
ইরহাম তার গলায় নাক ঘষে কাঁধে চুমু খেলো। নেশাতুর গলায় বললো, দেখা শেষ হয়নি? আরো দেখবে?
তৃণা ইরহামের অবাধ্য হাতের বিচরণ ঠেকাতে বেসামাল হয়ে উঠছে। অস্থিরতায় তার নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠছে ক্রমশ। অথচ লোকটা একের পর এক প্রশ্ন করেই যাচ্ছ। তৃণা এবার ঘুরে ইরহামের বুকে মুখ গুজলো। নাহ এই তীব্র অনুভূতির কড়াঘাত আর চেপে রাখা যাচ্ছেনা। ইরহাম ওর চিবুক তুলে বললো, এই তৃণা তাকাও আমার দিকে!
তৃণা দুহাতে মুখ লুকিয়ে বললো, আপনি আজকে আমায় লজ্জায় ফেলার পায়তারা করছেন তাই না!
এসব বললে তো হবেনা, তোমার হিসাবনিকাশের খাতাটা কোথায়? দেনাপাওনা শোধ করতে দিবেনা? নাকি চাও ঋণের বোঝা মাথায় করে মরি?
তৃণা চোখ বড় বড় করে চেয়ে বললো, এসব কি কথা ইরহাম? এখানে মরার কথা আসছে কেন? সবসময় এসব ভাল্লাগেনা।
আমিতো বলিনি এখনি মরে যাবো। তুমি বলেছিলে সবকিছুর হিসাব তুলে রাখছো, আমার থেকে কড়ায়গন্ডায় শোধ নিবে। আজ যখন এগিয়ে এলাম মুখ লুকাচ্ছ কেন হুম?
আমাকে আপনার কি মনে হয় হুম? আমার বুঝি লজ্জা নেই?
নাহ তা বলিনি,,
বুঝালেন তো সেটাই! মানছি সবসময় আমিই আগ বাড়িয়ে সব চাই,, তাই বলে আপনি আমায় …
ইরহাম ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
হুশশ, ভুল বোঝার ফিরিস্তি খুলবেনা বলে দিচ্ছি। তোমার আগ বাড়িয়ে আসাটাকে আমি কখনোই নির্লজ্জতা ভাবিনা। তুমি না এলে আমি তোমাকে পেতাম না কলিজা।
তৃণা ওর গলা জড়িয়ে আহ্লাদী গলায় বললো, তাই বুঝি?
সন্দেহ আছে?
নাহ!
ইরহাম হাসলো। তৃণা ওর হাসি দেখে বললো, এই হাসিটাই আমাকে কুপোকাত করেছে মশাই! এতো সুন্দর করে হাসতে হয় আপনাকে?
কেবল হাসিই? আর কিছু পছন্দ হয়নি এই অধমের?
তৃণা তাকে জড়িয়ে ভাবুক স্বরে বলল,উমম… গোটা মানুষটাই দেখছি আমার পছন্দের!
ইরহাম তাকে কোলে তুলে বলল, বেশ তবে আজ পছন্দের মানুষটার বেসামাল ভালোবাসা সহ্য করে ধন্য করুন মহারানি!
তৃণা ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো, লাইটটা অফ করুন প্লিজ!!
চলবে,,,
#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৪০
#আরশিয়া_জান্নাত
ফাহিমকে বসার ঘরে দেখে একটু অবাক ই হলো রুমি। তবুও ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে বললো, আসসালামুয়ালাইকুম, কেমন আছেন ভাইয়া?
ভালোই আছি। তুই ভালো?
হুম।
হুম কি আবার? ভালো আছি অথবা মন্দ আছি বাক্য ব্যবহার করে বলা যায় না?
ফাহিম ভাইয়া আপনি দিনদিন খিটখিটে বুড়ো মানুষের মতো আচারণ করছেন কেন? বয়স কি বেশি বেড়ে গেছে?
আমার এখাননো ৩০ পার হয়নি এর মধ্যে বুড়ো খেতাব দিয়ে দিলি?
আমি দেই নি, আপনার কর্মকান্ড সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে তাই বললাম। আগে তো আপনি এমন ছিলেন না।
আগে এমন করার মতো কিছু ঘটেনি তাই করিনি। এবার দেশে ফেরার পর থেকেই এমন সব ঘটনা ঘটছে আমি যে এখনো টিকে আছি এই ঢের! সে যাই হোক তুই অনেক ফাজিল হয়ে গেছিস রুমি। আমি তোকে সেদিন একটা কাজ দিয়েছিলাম করলি না কেন? বড়দের কথা অমান্য করা যে কতবড় অপরাধ তুই জানিস?
রুমি গ্লাসে পানি ঢেলে। চেয়ারে বসে পান করলো। তারপর ফাহিমের চোখের দিকে চেয়ে বললো, আপনি কি প্ল্যান করছেন আমার পাসপোর্ট করে কানাডায় নিয়ে যাবেন? আর আমিও আপনার কথামতো সবার অবাধ্য হয়ে সেটা করবো!
ফাহিম শার্টের কলারটা পেছনে এলিয়ে সোফার নরম অংশে ঘাড় রেখে বলল, নিজেকে এক্সট্রিম লেভেলের ব্রিলিয়ান্ট ভাবা বন্ধ কর। মানছি তোর গেসিং পাওয়ার অন্যদের চেয়ে বেটার তার মানে এই না সবসময় একুরেট হবে।
যদি বলি এবারো সেটা একুরেট ই!
ফাহিম হেসে বললো, ধারণা সম্পূর্ণ সঠিক নয়, আংশিক সঠিক।
রুমি উঠে বলল, অযথা পরিশ্রম বন্ধ করুন। ফুফুর পছন্দ করা পাত্রীকে বিয়ে করে সুখী হোন।
শোন তোকে একটা কথা বলি, আমি বিশ্বাস করি ভাগ্য মানুষ কে বারবার সুযোগ দেয় না। আমি সরাসরি তোকে চেয়েছি, জানিনা কেন সবাই এই বিষয়ে রাজী হলো না। তারপর হন্যি হয়ে তোর জন্য ছেলে খোঁজা হলো, আমি রাগ করে বেরিয়ে গিয়ে মেজর এক্সিডেন্ট করলাম,প্রায় ১মাস অন্য শহরের হাসপাতালে পড়ে ছিলাম অনাথের মতো। ভাগ্য জোরে আমি বেঁচে ফিরেছি, ফিরেই শুনলাম তোর অ্যাংগেজমেন্ট হয়েছে সাথে সাথে তোকে কল করি। তুই বললি ইরহাম ঢাকায় মেডিক্যালে ভর্তি। আমি সেখানে গিয়েও তোকে পাইনি। আমার সাথে তোরা সবাই মিলে লুকোচুরি খেলা খেললি। আমি আসি যাই তবু তোর দেখা পাই না। আমার মা আবার এই খেলায় সুপার ওমেন। তিনি এর মাঝে কত মেয়ে দেখে ফেললেন। অথচ ছেলে নিখোঁজ তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র মাথা ব্যথা নেই। আমি দেশে থেকেও বিদেশের হালে আছি। ঐসব কিছুই না জাস্ট ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে পেলেই হলো!
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সে একটু থামলো, এই পুরো ঘটনা অবজার্ব করে একটা সহজ ইকুয়েশন বের করলাম বুঝলি! আমি তোকে বিয়ে করতে চাই এই কথাটা প্রকাশ হবার আগ অবধি সব স্বাভাবিক ছিল। না তোর বিয়ের কথা ভাবা হচ্ছিল না আমার! অথচ যেই বললাম উভয় পক্ষ ই বিয়ের জন্য লাফাচ্ছে তবে ভিন্ন জনের সাথে…এটা খুবই ফানি লাগছে আমার কাছে
ফানি লাগার মতো কিছুই ঘটেনি ভাইয়া। আপনি রাগী বদমেজাজি মানুষ। ইতিপূর্বে হুলুস্থুল কান্ড বাঁধিয়ে সবাইকে তটস্থ করেছেন। বড়োরা জানেন এই বিয়ে কিছুতেই হবার নয় তাই আপনার পাগলামি রুখতে দুই পক্ষ নিজ নিজ অবস্থান থেকে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিচ্ছে।
কেন হবার নয়? বড়োরা কেন এমনটা ভাবছে?
বড়োদের কাছে নিশ্চয়ই যথেষ্ট কারণ আছে। আর আমার মনে হয় উনারা কখনোই আমাদের অমঙ্গল চান না।
আমি তোর মতো ভালো নই। তোকে আমি বলেছি না ভাগ্য বারবার চান্স দেয় না। আমাকে যখন চান্স দিচ্ছে আমি অবশ্য ই কাজে লাগাবো।
আপনি বললেই তো সব হবেনা।
কেন হবে না? আমি দেখতে খারাপ নাকি আমার চরিত্র খারাপ?অন্যদের কথা বাদ। কে কি ভাবছে আই নেভার কেয়ারড। আমার কাছে তোর মতামত ইম্পর্ট্যান্ট। আমাকে বিয়ে না করার তুই একটা সলিড কারণ দেখা আই সয়্যার আমি পিছিয়ে যাবো।
রুমি দৃঢ় গলায় বললো, আমি আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে মানা তো দূর কল্পনা করতেও ইচ্ছুক নই। এইটুকু কি যথেষ্ট নয় না বলার?
ফাহিম থমকালো যেন, এমন উত্তর পাবে এ যেন সে কখনোই আশা করেনি। হঠাৎ ঘরটায় অসহ্য নিরবতা ছেয়ে গেল। ফাহিম ভ্রুযুগলের মাঝে দু’আঙুল চেপে মাথা নীচু করে বসে রইলো। রুমি শূন্য দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে। নিরবতা ভেঙ্গে ফাহিম বললো, তোর কাশফাতকে পছন্দ হয়েছিল রুমি? আমাকে পছন্দ করিস না বেশ মেনে নিলাম তবে কাশফাতকে পছন্দ করেছিস যখন আমি নিজে দাঁড়িয়ে তোদের বিয়ে দিবো। তোর বিয়ের খরচ আমি বহন করবো।
বাংলাদেশে অনেক মেয়ে আছে যাদের বিয়ের খরচ দেওয়ার মতো কেউ নেই। আপনি তাদের মধ্যে কারো খরচ বহন করুন।
কেন তোরটা করলে সমস্যা কি? নাকি আমি খরচ করলে তোর মান যাবে?
রুমি হাসলো। হেসে বললো, আপনার অভিশাপ লেগেছে ভাইয়া। আমার বিয়ে ভেঙ্গে গেছে। তাই আপাতত খরচার চিন্তা বাদ দিন।
ফাহিম অবিশ্বাসী দৃষ্টিতে চেয়ে বললো, তোর বিয়ে ভেঙ্গেছে? কই আমাকে তো কেউ বলেনি…
আপনাকে বলে বাঘের গুহায় কেউ হরিণ দিবে নাকি?
ফাহিম উঠে দাঁড়ালো, শার্ট ঝাড়া দিয়ে পকেটে ফোন ঢুকিয়ে বললো, দেখলি ভাগ্য আমাকে আবারো সুযোগ দিয়েছে। আমি সিওর উপরওয়ালারো এটাই ইচ্ছে। তুই না সবসময় বলতি ভাগ্যে যা হবার তা হবেই, কেউ সেটা বদলাতে পারেনা? আমিও আজ তোর কথাই মানলাম। Get ready to face determining tendency….
ফাহিম দ্রুত বেরিয়ে গেল। রুমি তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে বললো, আপনি ভীষণ বোকা ফাহিম ভাই। রাগী মানুষ আসলেই বোকা হয়!
।
তৃণা কফি করে ছাদ নিয়ে গেল।রুমিকে সেখানে দেখে হাসিমুখে বললো, যা ভেবেছিলাম তাই হলো। তুমি এখানেই আছ। নাও কফি ।
ধন্যবাদ ভাবী।
মন খারাপ?
নাহ। মন খারাপ হবে কেন?
রুমি একটা কথা বলি কিছু মনে করবে?
কি কথা ভাবী?
মাঝেমধ্যে এমন হয় আমরা যেটাকে খুব গুরুতর ভাবি অনেকে সেটাকে পাত্তাই দেয় না। আমি জানি না ফাহিম ভাইয়া কিংবা কাশফাত ভাইয়ার মধ্যে তুমি কাকে সত্যিই পছন্দ করো, তবে এইটুকু বলতে পারি যে তোমাকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে সে তোমার এমন খুতের ধার ধারবেনা যাতে তোমার হাত নেই!
জানো ভাবী তাদের দুইজনেরি দাবী তারা আমায় ভালোবাসে। কিন্তু আমার নিজেকে অনুভূতি শূন্য মনে হয়। আমি জানিনা আমি কাকে পছন্দ করি। এর পেছনে আমার জন্মপরিচয়ের যোগসূত্র আছে হয়তো। যে জানে শেষটা কি হবে সে কেন অযথা কারো প্রতি আবেগ জমাবে? তোমাকে আজকে একটা কথা শেয়ার করি, আমি যে এ বাড়ির সন্তান নই তা আমি বাবা মারা যাওয়ার পরই জেনেছিলাম। এসএসসির আগে ডিএনএ টেস্ট করিয়েছিলাম, মায়ের সঙ্গে আমার ডিএনএ মিলেনি, ভাবলাম আমি হয়তো মায়ের সন্তান নই। বাবা কিংবা তার পক্ষের কারো হবো। তাই হয়তো বাবা বেশি ভালোবাসতো মা বাসেনা। এই ভেবে বহুদিন মনকে বুঝ দিয়েছি। প্রস্তুত করেছি নিজেকে কঠিন কিছুর সম্মুখীন হতে হবে। কিন্তু তাই বলে এতো কঠিন হবে সেই সত্যিটা তা আশা করিনি। জানো সাজেদা ফুফু যখন আমার মায়ের সম্পর্কে আজেবাজে কথা বলছিল আমার ইচ্ছে করছিল সেই রাতেই প্রাণ দিয়ে দেই। আমার জন্য আব্বার সাথে দীর্ঘদিন উনি যোগাযোগ রাখেন নি, এমনকি আব্বার মৃত্যুর সংবাদ পেয়েও শেষ দেখা দেখতে আসেননি। এবারো হয়তো আসতেন না যদি না তার ছেলে আমাকে বিয়ের টপিকটা তুলতো। উনি আমাকে অনেক ঘৃণা করেন। ঘৃণার মাত্রা বুঝতে পারছো আশা করি। এমন মানুষের ছেলের বউ হবার দুঃসাহস কে করবে বলো?
বুঝতে পেরেছি, তোমার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ফাহিম ভাইয়া দমবার পাত্র নয়। তাকে সত্যিটা বলে দেখবে?
রুমি রেলিং এ ধরে বলল, আমি যদি উনাকে বলতাম এই কারণে বিয়ে করবো না বা আমার আসল পরিচয় টা বলি। উনি কি বলবে জানো? তুই আমার আপন মামাতো বোন না? তাহলে তো আরো ভালো।আর বাকি রইলো মায়ের, আমি তোকে কানাডা নিয়ে যাবো। শাশুড়ির প্যারা খাওয়ার সময় কই তোর?
তৃণা ওর কাঁধে হাত রেখে বললো, এই দুই অপশন তবে বাতিল। তোমাকে ওদের কথা আর ভাবতে হবেনা। আমার মিষ্টি ননদের জন্য অনেক ভালো একজন আসবে দেখো। যা হয় ভালোর জন্য হয়, ভরসা রাখো।
।
ইরহাম ল্যাপটপ বন্ধ করে আড়মোড়া ভাঙলো। কাজ করতে করতে কখন যে সময় পেরিয়ে যায় টের পাওয়া যায়না। বিছানায় ঘুমিয়ে থাকা রমণীর দিকে তাকাতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। এই গরমেও কেমন কাঁথা পেঁচিয়ে গুটিসুটি হয়ে ঘুমাচ্ছে। দেখে মনে হবে যেন শীতে জমে গেছে।অবশ্য মাঝরাতে ঠান্ডা একটু পড়েই। ইরহাম ফ্যানের রেগুলেশন ঘুরিয়ে স্পিড কমালো। ডিম লাইট জ্বালিয়ে বিছানায় শুয়ে তৃণাকে আলগোছে বুকে নিলো। তৃণাও উষ্ণ বুকে স্থান পেয়ে আদুরে বিল্লির মতো গাঁ এলিয়ে দিলো। ইরহাম ওর কান্ড দেখে মুচকি হাসলো। কপালে চুমু এঁকে মনে মনে বললো, আমার আদুরে বৌটা ঘুমালে কত্ত কিউট লাগে!
তৃণার মাথায় বিলি করতে করতে ভাবতে লাগলো পাগলীটাকে এখানে রেখে ঢাকায় অফিস করবে কিভাবে? এ কয়দিনে যে অভ্যাস হয়েছে বুকে জড়িয়ে না রাখলে রাতে ঘুম ই আসতে চায় না…..
চলবে..