সে আমার শরৎফুল পর্ব-৪১+৪২

0
241

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৪১

#আরশিয়া_জান্নাত
আমি বুঝিনা তোর লাজলজ্জা সব কি নাই হয়ে গেছে? যারা তোকে রিজেক্ট করছে তাদের পেছনে ঘোরার দরকার কি? ওরা তো বলছেই মেয়ে বিয়ে দিবেনা, তবুও বেলাজার মতো পিছে পড়ে আছিস ক্যান? আমি তোর জন্য অনেক সুন্দর আর ভালো মেয়ে দেখছি। তুই ওদের মধ্যে কাউকে পছন্দ করে বিয়ে করে ফেল।

সাজেদার কথায় ফাহিমের হোলদোল নেই। সে ফোনে গেইম খেলায় বিজি এমন ভাব নিয়ে বসে আছে। সাজেদা ছেলের গায়ে মাথায় হাত পুছে বললো, দেখ বাবা তোর ছুটি ফুরিয়ে আসছে। এবার অন্তত বিয়েটা কর। আর কয়মাস রুমির আশায় থাকবি?

তোমার ভাইঝিকে ছাড়া আমি কাউকে বিয়ে করবোনা। পারলে ওকে আনো নাহয় ছেলের বৌ দেখার আশা ছেড়ে দাও। ছুটি শেষ হওয়ার অপেক্ষা ও করবোনা। সোজা চলে যাবো। আর এই যাওয়াই শেষ যাওয়া হবে আমি আর এদেশে ফিরবোনা।

এসবের মানে কি ফাহিম? পরিবারের মানুষের চেয়ে ও বড় হয়ে গেছে?

আমি তোমার সাথে অযথা তর্ক করতে চাইছি না।

আমি তো ওদেরকে বলছিই, ওরা রাজী না হলে জোর করবো নাকি? সবার নিজস্ব মতামত আছে। রুমিও তোকে বিয়ে করতে চায়না। তুই কি মাস্তান? জোর করে বিয়ে করে তুলে আনবি তোকে? এইদিন দেখতে এতো কষ্ট করে পড়াশোনা শিখিয়েছি?

শোনো মা আমি তোমার উপরেই গেছি। আব্বুর সাথে তোমার বিয়ে টা কিভাবে হয়েছে জানিনা ভাবছো? নানাভাই কখনোই চায়নাই এতো দূরে বরিশালের ছেলের সাথে তোমার বিয়ে দিতে। তখন তুমি কি কি করছো আমাকে নানু সব বলছে।

আমাদের গল্পের সাথে তোর গল্প মিলেনা। আমরা মিয়া বিবি রাজী ছিলাম তাই সবাই বাধ্য হয়েছে। এখানে তুই একাই হাবলা মজনু।

ফাহিম দুঃখের শ্বাস ফেলে বলল, এটা ঠিক বলছো মা। তোমার ভাইঝি আমারে ভালোবাসেনা। সে বড়ই নিষ্ঠুর।

এই তো লাইনে এলি। একপাক্ষিক ভালোবাসার ভিত্তি নাই। বিয়ে কর সংসার কর সব ভুলে যাবি।

ফাহিম ফোন সোজা করে বললো, আমার সিদ্ধান্তের নড়চড় হবেনা। তুমি বিরক্ত করলে আমি কালকেই ফ্লাইট ধরবো বলে দিচ্ছি।

সাজেদা নিরাশ হয়ে ছেলের ঘর থেকে বের হলেন। কত খুশিমনে ছেলের জন্য মেয়ে দেখছিলেন, ভেবেছিলেন রুমির বিয়েটা হয়ে গেলে ছেলে মনমরা থাকবে, সেই সুযোগে বিয়ে করিয়ে ফেলবেন। কুফা মেয়েটার বিয়ে ভাঙলো কেন কে জানে। পোড়ামুখী টা যেতে যেতেও যাচ্ছেনা…

টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসলো তৃণা। মুখে ক্রিম মাখতে মাখতে বললো, ইরহাম উঠুন। আর কত ঘুমাবেন?

এতো তাড়া কিসের আরেকটু ঘুমাই না।

আপনি ভুলে গেলেন? কথা ছিল আজ আপনি আমাকে স্কুলে ড্রপ করে দিবেন। উঠুন না সময় হয়ে যাচ্ছে তো। এই…

ইরহাম ঘুম ঘুম চোখে ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো, এখনো অনেক সময় আছে। আমি ২মিনিটে উঠে ৫মিনিটে রেডি হয়ে তোমাকে পৌঁছে দিবো। ডোন্ট ওয়ারি।

তৃণা সাজগোজে মন দিল। আজ স্কুলে তার প্রথম দিন। যদিও গতকাল সে স্কুলে গিয়েছিল। ক্লাস নেওয়া হয়নি। আজ থেকে ক্লাস নিবে। একটু নার্ভাস লাগছে বটে। ঘড়ির কাঁটায় ততক্ষণে ৮টা ছুঁই ছুঁই। ইরহামের দিকে তাকিয়ে দেখে সে এখনো ঘুমে বিভোর। মানুষ টা রাত জেগে কাজ করেছে, এখন ঘুমাচ্ছে যখন ঘুমাক। তাকে বিরক্ত করে লাভ নেই। সে একাই যেতে পারবে।

নীচে নেমে দেখে ময়নার মা ইতোমধ্যেই রুটি আর ডিম ভাজি করে ফেলেছে। পান খাওয়া দাঁত দেখিয়ে হেসে বললো, আমাগো মাস্টারমেডাম তৈয়ার হইয়া গেছে।

আমাকে কেমন লাগছে খালা?

ফাস্টক্লাস! তুমি নাস্তা করা শুরু করো আমি চা আনতাছি।

তৃণার নাস্তা খাওয়া শেষ না হতেই ইরহাম বাইকের চাবি নিয়ে নীচে নেমে এলো।

এরই মধ্যে তৈরি হয়ে চলে এলেন! কিভাবে সম্ভব?

ও তুমি বুঝবেনা। ভালোমতো খেয়েছ তো?

হুম। আপনি খেয়ে নিন?

তোমাকে দিয়ে এসে খাবো। এখন চলো লেট হয়ে যাচ্ছে।

তৃণা রুমানাকে বলে দ্রুত বেরিয়ে এলো। ইরহাম বাইক স্টার্ট দিয়ে বললো, কি ভেবেছিলে আমি খুব কেয়ারলেস?

তৃণা এক হাতে ওকে জড়িয়ে বলল, তা ভাবব কেন? আমি জানি আমার বর ভীষণ দায়িত্ববান।

ইরহাম লুকিং গ্লাসটা তৃণার দিকে এঙ্গেল করে হাসলো।

দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কিছু মাস। তৃণা নিজের শিক্ষকতা আর সংসার সমান তালে চালিয়ে নিচ্ছে। তাদের পরিবারে বাড়তি ঝামেলা না থাকায় বিশেষ সমস্যা পোহাতে হয়না। রুমিও নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু কোর্স করায় মন দিয়েছে।
স্কুলের ক্লাস শেষে ভাইঝিকে দেখতে আজ বাবার বাসায় যাচ্ছে তৃণা। ছোট নওরিন এখন হাত পা ছুঁড়ে নানান শব্দ তুলে। দাঁতহীন মুখে হাসিটা যখন দেয় যা আদুরে লাগে! সেই মায়ায় তৃণা সুযোগ পেলেই ওকে দেখতে ছুটে আসে মায়ের ওখানে।

তাহমিনা বেগম আচারের বয়াম রোদে দিয়ে বললো, রিপাকে ওর বাবার বাড়িতে নাইওর নিতে চাইছে। আমি বললাম নওরিন একটু শক্ত হোক তারপর নাহয় যাবে। এতো ছোট বাবু নিয়ে জার্নি করা যায়? পথটা তো হাতের কাছে না…

বিয়ের পর তো ভাবী একবারও যায়নি, বেচারির মন ছুটেছে যখন যেতে দাও‌। মানা করে মন খারাপ করাচ্ছ কেন?

আমি তো মানা করছিনা যেতে। অবশ্যই যাবে, ধৈর্য ধরেছে আরেকটু ধরুক না। ওর সবে ৩মাস হলো।

তৃণা হেসে বললো, আম্মু আমি জানি তুমি তোমার নাতনি কে চোখের আড়াল করতে ভয় পাচ্ছ। সারাক্ষণ ওকে যত্নে আগলে রাখো তো তোমার ভয় ওখানে গেলে ওকে ঠিকঠাক যত্ন করবে কি না। এতো কিছু ভেবো না তো। ওর নানী মা সবাই ওকে সাবধানেই রাখবে। কয়টা দিন ঘুরে আসুক ভাবীর ভালো রাগবে।

তাহমিনা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বললেন, আচ্ছা ওয়াসীকে বলবো এসে নিয়ে যেতে।

তৃণা মায়ের গলা জড়িয়ে বললো, এভাবে মলিন মুখে না। হাসিমুখে বলবে। তোমার ঘরের প্রাণ তোমার কাছেই ফিরে আসবে।

হুম সেটাই। আজ যাওয়ার সময় আমের আচার নিয়ে যাইস।

আচ্ছা।

তৃণা ঘরে ফিরে নওরিন কে কোলে তুলে অনেক কথা বলতে লাগলো, অবুঝ শিশু টা কি বুঝে হাসতে থাকে, হাত বাড়িয়ে ফুপীর নাক মুখ ধরতে চায়। তৃণা ওর হাতের তালুতে চুমু খেয়ে ছড়া কাটে,

নওরিন সোনা চাঁদের কণা
মিষ্টি হাসির মুখখানা
আয়রে দৌড়ে ফুপীর কোলে
চুমু দিবো দুই গালে


রুমানা বেগম বেশ যত্ন করে চিতই পিঠা তৈরি করলেন। পাশের চুলায় দুধের পাতিল বসিয়ে দুধ চিতই তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রুমির পছন্দের মধ্যে দুধচিতই অন্যতম। তাই আজ তার জন্মদিনে বেশি করে এটা তৈরি করেছেন।
তৃণা ফেরার পথে খুব সুন্দর একটা চকলেট কেক নিয়ে এসেছে।ইরহাম পৌঁছালেই কেক কাটা হবে। বাসায় চাপা উৎসবের আমেজ। কিন্তু রুমির মন আজ একদম ভালো‌ নেই। তার মতে আজকের দিনটা মোটেও ভালো দিন নয়। আজ তার জন্মদিনের সাথে সাথে তার মায়ের মৃত্যু দিন। এমন দিনে কোনো মেয়ে কিভাবে খুশি থাকতে পারে? তবুও অন্যদের আনন্দে বাগড়া দেওয়ার ইচ্ছে নেই বলে হাসিমুখেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফোনের দিকে চেয়েও মনটা বিষিয়ে উঠলো। প্রতিবছর একটি বিশেষ মেসেজ রাত ১২টায় এলেও এই প্রথম সেটা আসেনি। রুমি জানে এখন থেকে আর কখনোই হয়তো আর আসবেনা। সম্পর্কগুলো কেন যে ভালোবাসার উপস্থিতিতে পরিবর্তন হয়ে যায়! রুমি চাবি দিয়ে ওর ড্রয়ারটা খোলে।সেখানে হরেক রকম গিফট আর উইশিং কার্ড আছে। দেশের বাইরে থেকেও সে প্রতিবছর এই দিনে গিফট পাঠাতো, উইশ করতো। পরিবারের বাইরে হাতে গোনা যে দু’একজন তাকে উইশ করতো তার মধ্যে ফাহিম একজন। তাই হয়তো মনটা খারাপ একটু লাগছে।

হঠাৎ ফোনে রিং বাজতেই মনোযোগ ভঙ্গ হলো।ফোনের স্ক্রিনে শান্তার নাম দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো তার।

হ্যালো রুমি, হ্যাপি বার্থডে দোস্ত।

থ্যাঙ্কস রে। আমিতো ভেবেছি তুই বুঝি ভুলে গেছিস!

কি যে বলোস আমার বেস্টফ্রেন্ডের বার্থডে আমি ভুলে যাবো! বিয়ে হয়ে গেছে একটু দূরে চলে এসেছি তার মানে এই না বন্ধু কে ভুলে যাবো।

হুম।

কি করছিস? বাসার সবাই ভালো তো?

হ্যাঁ সবাই ভালো। তোর কি খবর? বাচ্চারা সব ভালো আছে?

ভালো আছি। দোস্ত বাঁচি গেছস বিয়ে করোস নাই এখনো। অমার চুল সব নাই করে ফেলতেছে। ছেলেটার যন্ত্রণায় বাপের বাড়ি পর্যন্ত আসিনা। কোথাও গেলে যে ভদ্র হয়ে থাকবে এই ভরসা নাই। এতো দুষ্ট হইছে। এখানে তো বকতেও পারিনা, একটু বকলেই ওর দাদীর মুখ কালো হয়ে যায়।

ছেলেরা দুষ্ট হয় বেশি। বড় হলে ঠিক হয়ে যাবে।
এতো প্যারা নিস না।

তুই ঠিক আছিস রুমি?

হুম আমার কি হবে!

আমার কাছে লুকিয়ে কি হবে? তুই যে অল্পতে সব ভুলে যাস না এ আমি ভালোই জানি। গত কয়েকমাসে যা যা ঘটেছে সব তোর মনে কঠিন প্রভাব ফেলেছে আমি টের পাই না ভাবিস?

জীবন টা গুছিয়ে নিতে হবে বুঝলি। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে। আমি ভাবছি আইইএলটিএস করে ফরেনে চলে যাবো।

ট্রায় কর। দেশে থেকে লাভ নাই। সবাই বিদেশেই সেটেলড হচ্ছে। তুই পারলে চলে যা, আমার জন্য ডাভ সাবান আর চকোলেট পাঠাইস।হেহেহে

মজা নিলি!

কি করবো তুই হাসতেছোস না।

আগে তো সবসময় বলতি আমার হাসি শুনতে শুনতে তোর কানের পোকা মরে যায়।

ঐটাতে তো লাভ হতো। এখন ওরা মরতেছে না বলেই অশান্তি তে আছি।

হাহাহা,, কানে পোকা থাকেনা বলদি।

কথার কথা আর কি। যাক হাসলি তো এই ঢের।

বিবাড়িয়া আসবি কবে?

বলতে পারিনা। আসলে তোকে জানাবো।

আচ্ছা।

রাখিরে, পরে কল দিবো। ভালো থাকিস।

তুইও ভালো থাকিস।

ফোন রাখতেই নীচ থেকে ডাক এলো ইরহাম এসেছে। রুমি সবকিছু ফের ড্রয়ারে রেখে লক করলো। ঠোঁটে মেকি হাসি ঝুলিয়ে নেমে গেল সবার সঙ্গে আনন্দ উল্লাসে অংশ নিতে।

চলবে,,,

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৪২

#আরশিয়া_জান্নাত

আম্মা একটা কথা বলি রাখবা?

কি কথা?

আগে বলো রাখবা কি না

রাখার মতো হলে রাখবো।

এমন কিছু বলবোনা যা তোমার জন্য কঠিন হবে।

কি শুনি আগে?

রুমি ফ্লোরে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল, আমার মায়ের বাড়ির ঠিকানা দাও।

রুমানা চমকে তাকালেন রুমির দিকে। উত্তেজিত গলায় বললেন, এখন এসব কেন?

আমার কাজ আছে। আমি আমার মায়ের বাড়ি যেতে চাই। প্লিজ আম্মা না করিও না।

তুই কি ভাবছিস রুমি? ওখানে গিয়ে তোর কাজ কি?

আমার মনের অবস্থা তুমি বুঝবানা আম্মা। আমি বেঁচে থাকতে পারতেছিনা। আমার সবটা জানা দরকার। অন্তত নিজের শান্তির জন্য হলেও।

আমার কথা তোর বিশ্বাস হয়না?

তোমাকে বিশ্বাস করি তবে এই বিষয়ে শতভাগ ভরসা করিনা। কেননা তুমিও শোনা কথাতেই ভরসা করেছ।

তোর ও বাড়িতে গিয়ে কাজ নেই। সত্যিমিথ্যা যাই হোক সব এখন অতীত। পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটতে নেই।

তুমি কি ভাবছো তুমি ঘাটতে না চাইলেই সেটা বন্ধ থাকবে? এই কাসুন্দি ঘেঁটে গেছে আম্মা। আমার পুরো‌ শরীরে ঘেঁটে গেছে। এর জঘন্য দূ্র্গন্ধে কেউ আমার পাশ ঘেঁষতে পারছেনা

রুমি!

আম্মা প্লিজ আমাকে ঠিকানা দাও, আমি ওখানে গিয়ে কিছু তথ্য জানবো জাস্ট। তারপর ফিরে আসবো কথা দিচ্ছি।

বেশ তবে আমিও তোর সাথে যাবো।

নাহ। তুমি যাবেনা। আমি একা যাবো।

তুই এতো বড় হস নাই একা যাবি! তাছাড়া পথটা কাছে নয়।

রুমি হেসে বলল, যার বাবা-মা তাকে একা ফেলে গেছে। তাকে একা পথ চলতে দিতে ভয় পাচ্ছ আম্মা? আমার ভাগ্য যদি আমাকে একা করে রাখে তোমরা কতক্ষণ পাহারা দিবে?

প্রিয়া তোকে আমার হাতে তুলে দিয়ে গেছে, তোর দায়িত্ব আমার। আমি যতদিন আছি ততদিন দায়িত্ব পালন করে যাবো। আমার বিশ্বাস তোর ভাইবোনেরা ও তোকে একা ছাড়বেনা।

রুমি চোখের কোণ মুছে বললো, আমি চাই না সেখানে তুমি অপমানিত হও। অনেক তো কটু কথা শুনলে! এই সময়টা আমাকে একা ফেইস করতে দাও। প্লিজ আম্মা তোমার কাছে কখনো কিছু আবদার করিনাই। আজ আমার কথাটা রাখো।

রুমানা কিয়ৎক্ষণ মৌন রইলেন। তারপর উঠে গিয়ে পুরোনো চিঠির বাক্স ঘেঁটে প্রিয়ার বাড়ির ঠিকানা দিলেন। প্রিয়ার দামী ঘড়িটা দিয়ে বললেন, এই ঘড়িটা ওর মামা লন্ডন থেকে পাঠিয়েছিল। প্রিয়া সবসময় এটা সাথে সাথে রাখতো। আশা করি এটা দেখালে উনারা তোকে চিনতে পারবেন। তাও যদি মানতে না চান আমার কথা বলিস।

একটা আভিজাত্য জমিদার বাড়ির সামনে এসে রুমির গাড়িটা থামলো। ভাড়া মিটিয়ে রুমি গেইটের দারোয়ান কে বলল, এটা কি মোস্তফা চৌধুরীর বাড়ি?

জ্বি। আপনি কে?

আমি রুমি, বিবাড়িয়া থেকে এসেছি। উনাকে একটু খবর দিতে পারবেন?

আচ্ছা আপনি অপেক্ষা করেন, খবর দিয়ে দেখতেছি।

বেশ কিছুক্ষণ পর একজন মধ্যবয়স্ক লোক গেইটে এসে বললো, আপনাকে ঠিক চিনলাম না? বড় সাহেবের সাথে আপনার কাজ কি?

আপনি?

আমি উনার ম্যানেজার। স্যার ই আমাকে পাঠালেন আপনার খোঁজ নিতে।

উনাকে এই বক্স টা দিলেই উনি আমাকে চিনতে পারবেন আশা করি। আপনি কি আমাকে উনার কাছে নিতে পারবেন?

আসলে এমন তো সিস্টেম নেই। অপরিচিত কারো বাড়ির ভেতরে ঢোকা নিষিদ্ধ। আপনি বরং একটু অপেক্ষা করুন।

রুমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো। হঠাৎ লোকটা দৌড়ে এসে বললো, আপনি দ্রুত আমার সঙ্গে আসুন। বড় সাহেব আপনাকে যেতে বলেছেন।

লোকটার হড়বড় দেখে রুমির ভেতরটা ভীত হলো। কে জানে কি ঘটতে চলেছে সামনে।
নিজেকে ধাতস্থ করে রুমি এগিয়ে গেল প্রাচীর ঘেরা বিশাল বাড়িটার দিকে।

মোস্তফা চৌধুরী রুমিকে দেখে থমকে গেলেন। স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলেন তার দিকে। মেয়েটার চেহারা যে তার বহুচেনা। মনের মধ্যে চলতে থাকা সংঘর্ষ এড়িয়ে গম্ভীরস্বরে বললেন, এই ঘড়ি তুমি কোথায় পেয়েছ?

আসসালামুয়ালাইকুম আপনি ভালো আছেন?

আমার প্রশ্নের উত্তর দাও আগে

এটা আমার মায়ের ঘড়ি।

তোমার মায়ের!

জ্বি

তো আমার কাছে এসেছ কেন?

নানাজান আমি কি আপনাকে কদমবুসি করতে পারি? আপনি কি খুব রাগ করবেন আমি আপনার পা স্পর্শ করলে?

মোস্তফা সাহেবের উত্তরের আশা না করে রুমি তার পা ছুঁয়ে স্পর্শ করলো। ধরা গলায় বললো, আমি বহুবছর পর নিজের রক্তের কাউকে স্পর্শ করলাম নানাজান! আমার ভীষণ আনন্দ লাগছে।

ভেতর থেকে বেশ কয়েকজন বের হয়ে এলো অগন্তুক মেয়েটিকে দেখতে। তার মধ্যে সবচেয়ে প্রবীণ রমণী এগিয়ে এসে বললো, ওগো এ কে? অবিকল প্রিয়ার মতো দেখতে? আমার প্রিয়ার মেয়ে বুঝি?

তিনি মমতা ভরে রুমিকে জড়িয়ে ধরে মাথা পুছে বললো, এতো বছর কোথায় ছিলি তোরা নানুভাই? কত খুঁজেছি তোদের। এতো রাগ এতো জেদ তোর মায়ের, একটা চিঠি পর্যন্ত লিখেনি কোনোদিন। ওরে আমরা কি ওর খারাপ চেয়েছিলাম? আমার মেয়ে কই? কেমন আছে ও আসেনি তোর সাথে?

মোস্তফা সাহেব সোফায় বসে পড়লেন, শক্ত গলায় বললেন, ফাহমিদা শান্ত হয়ে বসো। ও অনেক দূর থেকে এসেছে, ওর খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করো। বাকি কথা পরেও বলতে পারবে।

ফাহমিদা মাথা নেড়ে বললো, তাই তো তাইতো। চল বোন আমার সঙ্গে আয়, আমি খুশিতে ভুলেই গেছি সব। রত্না, পাখি দ্রুত খাবারের ব্যবস্থা কর। আমার নাতনি এসেছে।

মোস্তফা সাহেব হাতে থাকা ঘড়ির দিকে চেয়ে নিঃশব্দে চোখের পানি ফেললেন। রুমিকে একা দেখে তার বুঝতে বাকি রইল না তার অতি আদরের মেয়ে এই পৃথিবীতে আর নেই। এতো দিন তাও বুকে আশা ছিল একদিন না একদিন মেয়ে ফিরবে। আজ সেই আশাভঙ্গ হওয়ায় তার বুকটা ভার হয়ে আসছে। কেন যে তিনি সেদিন বলেছিলেন বাচ্চা টা না রাখতে! নয়তো আজ তার মেয়ে তার কাছেই থাকতো।

ইরহাম বিচলিত কন্ঠে বললো, আম্মা তুমি ঠাকুরগাঁও এ রুমিকে একা পাঠালে! এতো দূরে পাঠানোর আগে আমাকে একটাবার বললেনা! আমি দরকার হলে যেতাম ওর সাথে!

ও যথেষ্ট বুঝদার হয়েছে, আমার কাছে এমনভাবে বললো আমিও না করতে পারিনি। তবে চিন্তার কিছু নেই। ও ঠিকমত পৌঁছেছে।

কিন্তু তাই বলে,,

অশান্ত হবার কিছু নেই ইরহাম। ও সত্যি অনুসন্ধান করতে গেছে ওকে ওর মতো ছেড়ে দে।

এমন হয়না আম্মা। ও আমার বোন। আমি ওকে একা ছাড়তে পারিনা। আল্লাহ না করুন কোনো বিপদাপদ হতো যদি?আপনি আমাকে কেন বললেন না।

আমার যতো জ্বালা। পারমিশন না দিলেও জ্বালা এখন দিয়েও জ্বালা হয়েছে। আমি আর পারিনা এতো অশান্তি নিতে। আমায় মাফ কর বাপ!

ইরহাম অসহায় মুখ করে মায়ের যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো। মেয়েদের আল্লাহ কি মাটি দিয়ে যে বানিয়েছেন। এদের মনের খবর বোঝা বড় কঠিন! ইরহামের ভেতরটা ছটফট করছে, রুমি একা কোথাও যায়নি। সেখানে এতোদূর অচেনা শহরে অচেনা মানুষের মাঝে চলে গেল? এটা কি নিশ্চিত থাকার মতো ঘটনা?
ইরহাম অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করতে লাগলো। তৃণাও বাসায় ছিল না, ওর বাবার ওখানে কয়দিনের জন্য গেছে। এর মাঝে এইসব কাহিনী ঘটালো। সে থাকলে নিশ্চয়ই তাকে জানাতো। ইরহাম ফোন হাতে তুলে রুমিকে কল দিলো। ওর গলা না‌ শোনা অবধি চিন্তা মুক্ত হবেনা। দরকার হলে এখনি রওয়ানা দিবে সেখানে। বোনকে নিয়ে আসবে সঙ্গে করে। ওরা মা মেয়ে সবসময় এমন করে। কোনোকিছু তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করেনা। ইরহামের মনে হয় এদের এইসব কারবারির চক্করেই একদিন সে হার্ট অ্যাটাক করে ফেলবে। এতো চিন্তা আর নেওয়া যাচ্ছেনা। তৃণা তুমিও নাই বাসায়। আমার খুব অস্থির লাগছে…

হ্যালো ভাইয়া

রুমি! কেমন আছিস?

ভালো তুমি?

আর ভালো? তুই একা এতোদূর কেন গেলি? আমার জন্য অপেক্ষা করা গেল‌না? আমার কত চিন্তা হচ্ছে জানিস?

ভাইয়া তুমি চিন্তা করোনা, আমি ভালো আছি। আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না।

ইরহাম দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললো, কবে আসবি? ভাইয়া আসবো তোকে নিতে?

আমি চলে আসবো ভাইয়া। হয়তো নানাভাই ও আসবেন আমার সঙ্গে। তোমাকে আসতে হবেনা ভাইয়া। তুমি আম্মাকে বকিও না। আমিই আসলে জেদ‌ ধরে এসেছি। জানো ভাইয়া নানু অনেক ভালো। আমাকে অনেক আদর করলেন। নানাভাই একটু রাগী তবে বয়সের ভারে মন নরম হয়েছে। সবাই আমাকে পেয়ে অনেক খুশি হয়েছে। আমার অনেক ভালো লাগছে এখানে।

ইরহাম চুপ করে রুমির উচ্ছাসে ভরা কন্ঠ শুনতে লাগলো। মনের মধ্যে একটা চাপা ভয়, আদরের ছোট বোনটাকে চিরতরে হারিয়ে ফেলার ভয়! ওরা রুমিকে আর আসতে দিবেনা হয়তো, সমাজের চোখে রুমি তো তার আপন বোন নয়। কিন্তু মনের দিক থেকে কি সে পর? সম্পর্কের জোর দেখানোর অধিকার কি আর ইরহামের থাকবে? ইরহাম ফোন রেখে বাইকের চাবি হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। এই মুহূর্তে তৃণাই পারবে তার অস্থিরতা প্রশমণ করতে। এই বুক ভার হওয়া আশঙ্কা সত্যি না হোক। কখনোই সত্যি না হোক….

শরৎচন্দ্রের বৈকুণ্ঠের উইল বইটা শেষ করে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়াতেই ইরহাম তাঁকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় তৃণা ভীষণ চমকে উঠলেও কাঁধের কাছে উষ্ণ জলের স্পর্শ পেতেই ব্যতিব্যস্ত গলায় বললো, এই কি হয়েছে আপনার? কাঁদছেন কেন? সবাই ঠিকাছে তো?

এখন কিছু জিজ্ঞাসা করবে না প্লিজ, আমাকে জাস্ট জড়িয়ে রাখো। তোমাকে জড়িয়ে থাকতে দাও…..

তৃণা পরম মমতায় ওর পিঠে হাত বুলাতে লাগলো। মনে মনে নানান দুশ্চিন্তা উঁকি দিলেও আপাতত মুখটা বন্ধই রাখলো।

চলবে,,,