সে আমার শরৎফুল পর্ব-৪৫ এবং শেষ পর্ব

0
407

#সে_আমার_শরৎফুল #পর্ব৪৫

#আরশিয়া_জান্নাত

নার্সিং হোমের করিডরে অস্থিরচিত্তে বসে আছে তাহমিনা। একমাত্র মেয়ের এহেন অবস্থায় কোনো মা ই স্বাভাবিক থাকার কথা না। ওয়াজেদ সাহেব উপরে শক্ত থাকলেও মনে মনে তিনিও শঙ্কিত। ইরহামকে খবর দেওয়া হয়েছে এখানে আসার পরপরই। সে হয়তো এতোক্ষণে রওয়ানা ও হয়ে গেছে। ডাক্তার কিছু না বলা অবধি কারো মনেই শান্তি নেই। তাহমিনা আপন মনে বলেই যাচ্ছে, কত করে বলেছি আমার মেয়ে আমার কাছে থাকুক। এই সময়টায় কত দিক খেয়াল রাখতে হয়। শুনলোই না আমার কথা। আজ আমার কাছে থাকলে এই দশা হতো?

আহা তাহমিনা চুপ করো। বিপদাপদের হাত পা আছে? যা হবার তা হবেই। অযথা এসব বলো না,,

বিপদ হবার ছিল হতোই, কিন্তু আমরা তো চোখে চোখে রাখতাম তাই না? এরকম একা পড়ে থাকতে হতো না ওকে। তুমি বুঝতে পারছোনা ও যদি আমায় ফোন না করতো কি হতো ভাবো?

এসব বাদ দিয়ে আল্লাহ আল্লাহ করো।

তাহমিনা নিরবে কেঁদেই যাচ্ছে। তামজিদ মায়ের পাশে বসে মাকে সান্ত্বনা দেওয়ার বৃথা চেষ্টা করছে। নার্স কে বের হতে দেখেই তাহমিনা ছুটে গেল‌ তার কাছে। পরিচিত মানুষ হওয়ায় জিজ্ঞাসা করতেই বললো, চাচী তৃণা আপার ফুড পয়জনিং হয়েছে। অনেক বার বমি হওয়াতে দূর্বল হয়ে পড়েছিল। আরেকটা সমস্যা আছে, আপুর শরীরে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ খুবই কম।

ওর গর্ভের বাচ্চা ঠিক আছে তো বিথী?

হ্যাঁ, আল্লাহর রহমতে ঠিক আছে। চিন্তার কিছু নেই।

তাহমিনা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।

নিশ্চয়ই তোমার মেয়ে বাইরের ফুচকা চটপটি খেয়েছে।‌ কতবার বারণ করি ঐসব খোলা খাবার না খেতে। আমাকে বললে আমি ঘরেই সব করে দেই। তাও শুনেনা। তোমরা বাপ মেয়েরা আমার কথা একটু ও শুনো‌না।

তৃণার জ্ঞান ফিরতেই দেখে ইরহাম তার সামনে মাথা নীচু করে বসে আছে। হাত বাড়িয়ে তাকে ছুঁতেই ইরহাম তার হাত মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি ফেলল। ধীর গলায় বলল, এখন কেমন লাগছে?

আমি ঠিক আছি।

আমি কত ভয় পেয়েছি জানো?

স্যরি…

তুমি স্যরি বলছো কেন? আমার ই দোষ হয়েছে আসলে। আমি তোমার প্রপার কেয়ার করতে পরিনাই। আমি ভেবেছি এখানে সবাই আছে, তোমাকে ঢাকায় নিয়ে একা রাখা ঠিক হবেনা। আমার বাড়িতেও মানুষ নেই। তুমি আমার কথা ভেবে তোমাদের বাড়ি গেলেনা। গেলে হয়তো আজ এমনটা ঘটতো‌না…

এই থামবেন আপনি? ইশ কেউ দেখলে কি ভাববে বলুন তো? কান্না থামান প্লিজ

ইরহাম ওর বুকে মাথা রেখে বললো, আমার তোমাকে হারানোর ক্ষমতা নেই তৃণা। আমি খুব দূর্বল মনের মানুষ। উপরদিয়ে যতটা স্ট্রং মনে হয় অতোটা স্ট্রং আমি নই। আমি যে কিভাবে এই পথটা এসেছি আমি জানিনা,,,

তৃণা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দূর্বল গলায় বলল, শান্ত হোন। আমার কিছু হয়নি। আমি এখন ঠিক আছি।

তাহমিনা একপ্রকার জোর করেই মেয়েকে নিজ বাড়িতে নিয়ে গেল। তাকে অবশ্য মানা করার জো কারো নেই। রুমানা অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো। তার আরো যত্নবান হওয়া উচিত ছিল।
যাক বিশেষ ক্ষতি হয়নি এতেই সবাই শোকরগুজার।

নওরিন এখন আধো আধো বুলিতে দাদা বলতে পারে, এ নিয়ে ওয়াজেদ সাহেবের আনন্দের শেষ নেই। ওয়াসী বলে, বা বা বলো বা বা

নওরিন সমান তালে বলে যায় দা দা

ওয়াসী মন খারাপ করে বলল, এটা অন্যায়, আমার মেয়ে আমাকে না ডেকে দাদা দাদা করে কেন! আব্বু সত্যি বলো কি ঘুষ দিয়েছ ওকে?

ওয়াজেদ সাহেব হোহো করে হেসে বলেন, আমার নাতনী তোর মতো অপদার্থ না‌। সে বুদ্ধিমতি হবে বলেই বাবার বাবাকে আগে ডাকছে। দেখি দাদু ভাই বাবাকে শুনিয়ে দাও তো “আল্লাহ”

নওরিন দাদার দিকে চেয়ে খিলখিল করে হাসে।

রিপা আর তাহমিনা সেসব দেখে মুচকি হাসে।

সময় তার আপন গতিতে চলছে। দেখতে দেখতে সপ্তাহ পেরিয়ে মাস হয়ে যায়। ক্যালেন্ডারের পাতার মতো জীবনের গল্প এগোতে থাকে নিজস্ব ধারাবাহিকতায়। রুমি তার আপননিবাসে দিনাতিপাত করছে রক্তের আপনজনদের ছায়ায়। ওখানে কেউ ওকে জারজ বলে হেয় করেনা, বিয়ে ভাঙার দুঃসাহস করেনা। উপহাস করেনা, আপদ ভাবেনা। ইনফ্যাক্ট খুব ভালো ঘরে বিয়ে ঠিক হয়েছে ওর। অবশ্য এমন বনেদি বাড়ির মেয়ের বিয়ে কি যার তার সাথে হবে? এখানে ওর পরিচয় ভিন্ন হলেও ওখানে ওর মানমর্যাদা অনেক বেশি। চৌধুরী বাড়ির নাতনি বলে কথা! ফাইনাল পরীক্ষার সময় বিবাড়িয়া এসে কয়দিন থেকে পরীক্ষা দিয়ে গেছে। রুমানা মেয়ের বাহ্যিক পরিবর্তন দেখে আপনমনে হাসে। আসলেই কোকিলরা উড়ে গেলে আর ফেরে না কাকের বাসায়,,,
অবশ্য এতে তার দুঃখ নেই, যে যেখানে ভালো থাকে সেখানেই থাকুক। মেয়েরা পরের বাড়ির রত্ন হয়। এমন নয় এখানে থাকলেও এতোদিন তার কাছে থাকতো। বিয়ের পর তো এমনিই চলেই যেত! পার্থক্য এই তার উপর এখন রুমানার অধিকার নামমাত্র। সেটা আসলে অধিকার ও নয়। রুমানার মাঝেমধ্যে মনখারাপ লাগে, এতো বছর লালন পালন করে মানুষ করেছে মায়া তো লাগবেই। পালা জিনিসের জ্বালা একটুবেশি বৈকি!
মনকে সবসময় বুঝ দেন তিনি তো তার স্বামীকে হারানোর পরই একা হয়ে গেছেন। অন্যরা তাকে একাকীত্বের ভয় দেখবে আর কি? তার সময় কাটে আগের মতোই বই পড়ে, নয়তো ছাদবাগানে। এই জীবনে তার আর কোনো দায়িত্ব বাকী নেই। না আছে কোনো তাড়া। তিনি আপনভুবনে চড়ে বেড়ান মনমর্জিমতো।
তৃণার এখন সাত মাস চলে, মায়ের পেট উঁচু করে একজন তার বেড়ে উঠার জানান দিচ্ছে। তৃণা অনাগত সন্তানের সাথে কত কথা বলে। সেও যেন যে নড়েচড়ে মাকে বোঝায় সে মন দিয়ে সব শুনছে। ইরহাম ফোন করে সবসময় তার খোঁজ খবর নেয়, সপ্তাহান্তে বাড়ি এসে একদিন তৃণাকে সময় দেয় আরেকদিন নিজের বাড়িতে থাকে। মাইশাও পালাক্রমে এসে মাকে সঙ্গ দেয়, কিংবা সাথে করে নিয়ে যায়। তাও ভাগ্যভালো একই শহরে সবাই আছে। চাইলেই যখন তখন চলে আসা যায়। এমন অনেক বাবা-মা আছেন যারা জীবনের শেষ সময়ে সম্পূর্ণ একা বাস করেন। ছেলেমেয়েরা যারযার জীবনে ব্যস্ত হয়ে ফুরসতই পায়না মাতৃক্রোড়ে ফেরার।

ইরহাম ফলের বাটি নিয়ে তৃণার সামনে বসে বলল,

কি ব্যাপার তৃণা এসব কি শুনছি তোমার নামে? এরকম করার মানে কি হুম?

আমি আবার কি করলাম?

তুমি মাকে এতো জালাচ্ছ কেন? তোমাকে না নিষেধ করা হয়েছে ভাজাপোড়া কম খেতে? বুঝো না কেন তোমার গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়!

ওমা আমার কি দোষ? আম্মু বলে যা খেতে মন চায় বলতে, মনে মনে সাধ লুকিয়ে রাখলে বাচ্চার মুখ দিয়ে শুধু লালা পড়বে,,, তাই তো আমি আমার ইচ্ছে সব বলে দেই। অমনি আপনার কাছে নালিশ করলো?

আমি এতো কথা শুনতে চাই না। আমি চাই আমার বৌ বাচ্চা দুজন সুস্থ থাকুক। ওদের ভালো থাকাটাই মুখ্য।

আসল সমস্যা শুনুন। মানুষ যা খেতে ভালোবাসে তা খাওয়াই নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর আবার সবাই আদর করে জিজ্ঞেস করে কি খেতে চাও বলো। বললে যখন নিষেধ ই করবা জিজ্ঞেস করার দরকার কি হুম?

তুমি তো অবুঝ না কলিজা। তুমি তো জানো কেন তোমায় নিষেধ করা হয়। তারপরো গাল ফুলালে চলে?

হুহ! ঐসব মন ভুলানো কথা বৈকি।

ইরহাম স্নিগ্ধ দৃষ্টি তে তৃণার দিকে তাকায়। তার চেহারায় মাতৃত্বের সৌন্দর্য বিরাজমান। শরীর টা একটু ভেঙেছে যদিও। কনসিভ করার পর থেকে খাওয়া-দাওয়া ঠিকঠাক করতেই পারেনা, সবকিছু তে নাক তুলে। তাও শখ করে কেউ যদি কিছু খাওয়াতে যায় বমি করে ভাসিয়ে দেয়। তাই কেউ আর জেদ করেনা। ওর যা ভালো লাগে তাই খাওয়া হোক। তবুও খেয়ে পুষ্ট থাকুক। তাহমিনা বলেন তৃণার বুঝি ছেলে হবে। তার ধারণা ভুল হয় না। তৃণার হাবভাব দেখলে বোঝাই যায় ছেলেই হবে ওর। তৃণা প্রায়ই বলে আপনার ছেলে মেবি ফুটবল খেলোয়াড় হবে, আমার পেটকে বল ভেবে বসে আছে!

ইরহাম ওকে জড়িয়ে বলে, খুব কষ্ট হয় কিক মারলে তাই না?

ঐ একটু আধটু হয়ই। তবে সবচেয়ে কষ্ট হয় ঘুমাতে। ও আসার পর আমি হাত পা ছড়িয়ে লম্বা ঘুম দিবো।

ইরহাম বলে, আল্লাহ তোমাদের সহীহ সালামত উদ্ধার করলেই আমি নিশ্চিত হবো। তারপর তোমার যা ইচ্ছে হয় করো।

তৃণা ইরহামের বুকে মাথা রেখেই মুখ তুলে চায়, আদুরে ভঙ্গিতে বলে, এই শুনুন।

হুম?

আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি জানেন সেটা?

তাই নাকি? আমি তো জানতাম ই না…

উহ! আমি তো সবসময়ই বলি, তাই দাম নেই আর কি।

এই কি বলো তুমি এসব? আমার কাছে তোমার প্রতিটা কথার অনেক দাম আছে।

তাহলে বলেন ভালোবাসেন?

বলি বা না বলি সবসময় ই ভালোবাসি!

তৃণা খুশিতে ঝলমল করে উঠে, ইরহাম ওর কপালে চুমু এঁকে বলে, পাগলি বৌ আমার।

পরিশিষ্ট: নীল আকাশে সাদামেঘ ভাসছে। তিতাস নদীর চারদিকে সাদা কাশফুলে ভরে উঠেছে। বেশিরভাগ মেয়েরাই নীল শাড়ি পড়ে কাশবনে ছবি তুলছে।
তৃণা আর ইরহাম এসেছে নদীর পাড়ে বেড়াতে। তাদের ছেলে আকাশ কাশফুল এনে বলল, বাবা দেখো আম্মুর শরৎফুল!

উহু বাবাই এটা শরৎফুল না কাশফুল।

না না শরৎফুল।

তৃণা ছেলেকে কাছে টেনে বলল, ওরে আমার প্রশ্নের কারখানা এটা কাশফুল। আর তোমার বাবা হচ্ছে শরৎফুল।

বাবা শরৎফুল কেন? বাবা তো মানুষ। মানুষ কি ফুল হয়?

কে বলে মানুষ ফুল হয় না? হয় তো। যেমন তুমি আমার শুভ্র বেলি ফুল, তোমার বাবাকে আমি শরৎকালে পেয়েছিলাম তো তাই আমি তার নাম দিয়েছি শরৎফুল।

ওও এই ব্যাপার, তাহলে আমিও তোমাকে একটা নাম দিবো আম্মু।

কি নাম?

উমম কি নাম দেওয়া যায়? আচ্ছা বাবা তুমি আম্মুকে কোনো নাম দাও নি কেন? চলো আমরা একসঙ্গে আম্মুর জন্য নাম খুঁজি। আম্মু কোন ফুলের মতো দেখতে??

ইরহাম একপলক চায় তার প্রিয় মানুষ টার দিকে। তৃণাও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছে তার দিকে। ইরহাম বলল, তোমার মা নিজেই একটা ফুল। তার আলাদা নামকরণের দরকার পড়েনা।

আকাশ এই উত্তরে বিশেষ সন্তুষ্ট হলোনা, সে মহা উৎসাহে ভাবতে লাগলো কোন ফুলটা তার মায়ের মতো সুন্দর!

তৃণা ভ্রু কুঁচকে বলল, খুব চালাক আপনি! কি সুন্দর কথা এড়ালেন।

ইরহাম মাথা চুলকে বোকার মতো হাসতে লাগলো।
এই হাসিই যে বড় অস্ত্র তৃণার মন গলানোর….

#সমাপ্ত