#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৩)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১০৬)
ডাক্তার আকরামের কল পেয়ে কুশল দ্রুত নিজের আস্তানা থেকে বেড়িয়ে সৌহার্দ্যকে (নিলাদ্রের নতুন নাম সৌহার্দ্য ইশরাক) যেই ক্লিনিকে ভর্তি ছিলো সেই ক্লিনিকের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরে। বেশকিছুসময় ড্রাইভ করার পর সঠিক গন্তব্যস্থলে এসে পার্কিং সাইডে গাড়ি রেখে কুশল ক্লিনিকের ভিতরে প্রবেশ করে সরাসরি ডাক্তার আকরামের পারসোনাল কক্ষে চলে যায়। কুশল আকরাম সাহেবের কক্ষে প্রবেশ করতেই তিনি শান্ত স্বরে বললেন….
—“বসুন মি.কুশল চৌধুরী।”
কুশল শান্ত মুখশ্রী নিয়ে চেয়ারে বসে পরে। আকরাম সাহেব বললেন…..
—“আপনার ভর্তিকৃত পেশেন্ট মি.সৌহার্দ্য ইশরাকের কিছুসময় পূর্বেই জ্ঞান ফিরেছে। আপাতত কড়া ডোজের ঘুমের ঔষধ ইনজেক্ট করে ওনাকে ঘুমিয়ে রাখা হয়েছে। আর চিন্তার কোনো কারণ নেই। ওনার যে ক্রি*টি*ক্য*ল অবস্থা ছিলো তাতে এতো তাড়াতাড়ি ওনার সেন্স ফেরার আশা আমরা করি নি। সম্পূর্ণই আল্লাহ তায়ালার অশেষ রহমত বলতে পারেন। যেহেতু ওনার সেন্স ফিরে এসেছে তাই আগামী পরশু সকালেই ওনার মুখে থাকা ব্য*ন্ডে*জটি আমরা খুলে ফেলতে পারবো। ওনার প্লা*স্টি*ক সা*র্জা*রি করা হয়েছে তাই নতুন চেহেরা দেখার পর উনি হয়তো কিছুটা অস্বাভাবিক আচারণও করতে পারেন। তাই পরশু সকালে ওনার শুভাকাঙ্ক্ষী আরো যদি কেও থাকেন তাহলে তাকে নিয়ে আপনাকে এখানে উপস্থিত থাকতে হবে।”
কুশল কিছুটা চিন্তিত ভাব নিয়ে বললো….
—“সৌহার্দ্যের স্মৃতিশক্তি লো*প পাওয়া নিয়ে কোনো রি*স্ক আছে কি ডাক্তার সাহেব!”
—“যেহেতু ভিষণ বা*জে ভাবে ওনার এ*ক্সি*ডে*ন্টটি হয়েছিলো তাই ওনার স্মৃতিশক্তি লো*প না পাওয়ার বিষয় নিয়ে আমি শতভাগ নিশ্চিয়তা দিতে পারছি না আপনাকে। তবে আল্লাহর উপর ভরসা রেখে ভালোকিছুরই আশা রাখুন।”
—“জ্বি, আমি তাহলে এখন উঠছি।”
—“ঠিক আছে।”
অতঃপর কুশল বসাবস্থা থেকে উঠে আকরাম সাহেব এর কক্ষ থেকে বেড়িয়ে যায়।
(১০৭)
তমালিকা সিকদার এর মুখে তাহিরের বলা সব কথা শোনার পর তরুনিমার মনেও তাহিরকে নিয়ে ভালো খারাপ দুইরকম চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে। তরুনিমা মনে মনে ভাবে…….
—“তাহিরের জন্যই আজ কুশল সুস্থাবস্থায় চলাফেরা করছে এটা তো মিথ্যে নয়। যদি তাহির মনে মনে খারাপ বা অসৎ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে আজ চৌধুরী মেনশনে আসতো তাহলে প্রথমত বি*ষা*ক্ত ঔষধী সেবন করার হাত থেকে আমাকে আর দ্বিতীয়ত নিজের প্রাণকে ঝুঁ*কি*র সামনে ফেলে কুশলকে বাঁচাতো না। পাঁচ বছর আগে বড়পুর মৃ*ত্যু*র দিন শুধুমাত্র তাহিরের হাতে র*ক্ত মাখা ছু*ড়ি*টি দেখেই আমরা সবাই ওকেই বড়পুর খু*নি বানিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলাম। একটা বার পুরো বিষয়টা যাচাই করে দেখারও প্রয়োজন মনে করি নি। তবে কি তাহিরকে আমি বা আমরা যে ঘৃ*ণ্য নজরে দেখি তা শুধুমাত্রই ভু*ল বোঝাবোঝির থেকে সৃষ্টি হয়েছে! উফহহহ আমার মাথা কাজ করছে না। কোনটা ঠিক আর কোনটা যে ভু*ল তা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছি না। এখন এসব নিয়ে চিন্তা-ভাবনা না করে তাহিরের সুস্থ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করাটাই মনে হয় সঠিক হবে।”
এই বলে তরুনিমা ঘাড় ঘুরিয়ে ও.টির সামনে রাখা চেয়ারে বসারত হুমায়রার দিকে তাকায়। হুমায়রাকে এখনও কান্না করতে দেখে তরুর মাঝে বেশ খারাপ লাগা কাজ করছে। পরক্ষণেই তরুনিমা একবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে হুমায়রার দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তমালিকা ও তারেক সিকদার সেখানেই রাখা চেয়ারে পাশাপাশি বসে পরে। তরুনিমা হুমায়রার পাশে গিয়ে বসে শান্ত স্বরে হুমায়রাকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“তুমি তাহিরের কে হও!”
হুমায়রা অশ্রুসিক্ত নয়নে তরুর দিকে একপলক তাকিয়ে পরপরই দৃষ্টি সরিয়ে মেঝের উপর স্থির করে বললো….
—“কাজিন।”
—“ওহহ।”
—“তুমিই সেই না, যাকে শেষ বারের মতো একপলক দেখার জন্য তাহির ওনার কাছে নত হয়ে বাচ্চাদের মতো কান্না করে অনুরোধ করেছিলো!”
হুমায়রার এমন কথায় তরু কিছুটা অবাক হয়। হুমায়রা একহাতে নিজের দু’চোখের পানি মুছে নিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো…..
—“আজ অনুষ্ঠান পর্বে পরপর ২বার যাচ্ছে তাই বলে তুমি যাকে অ*প*দ*স্থ করলে সেই মানুষটার কারণেই তোমার সোহাগের মানুষটা সুস্থাবস্থায় চলাফেরা করতে পারছে স্বস্তির সাথে প্রতিটি নিঃশ্বাস ফেলছে। তোমার সোহাগের মানুষটাকে বাঁচাতে গিয়ে আজ সেই ঘৃ*ণ্য মানসিকতার মানুষটা নিজের জীবন-মৃ*ত্যু*র সাথে ল*ড়া*ই করছে। এমন পরিস্থিতিতে এসে দাঁড়িয়ে কি তোমার মধ্যে অনুশোচনা বোধ কাজ করছে! আজ ঐ মানুষটাকে এতোটা অ*প*মা*ন মূলক কথা না শুনালেও হয়তো চলতো এমন চিন্তা-ভাবনা কাজ করছে তোমার মাঝে! নাকি এমনটা ভাবছো আজ যদি ঐ মানুষটা আর জীবিত অবস্থায় অপারেশন থিয়েটার থেকে বের ই না হতে পারে তবে তার কাছে আর ক্ষমা চাওয়া হবে না তোমার। নিজের মনের উপর থাকা পাহাড় সমতুল্য বোঝাটা কখনই আর নামাতে পারবে না। সারাজীবন এই বোঝাটাকেই বয়ে বেড়াতে হবে তোমায়।”
হুমায়রার এরূপ কথাগুলো শুনে তরু যেনো বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতিত্তোরে ওরও যে কিছু বলা উচিত তা বোঝার ক্ষমতাটুকুও যেনো তরুর ভিতর থেকে লোপ পেয়ে গিয়েছে। হুমায়রা চোখ তুলে সামনের দিকে লক্ষ্য করতেই কুশলকে হেঁটে হেঁটে ও.টির দিকে অগ্রসর হতে দেখে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে অন্যত্র দৃষ্টি সরিয়ে নিলো।
কুশল এসে ও.টির সামনে দাঁড়ানোর কিছুসময় পর পরই ও.টির দরজার উপর জ্বলতে থাকা লাল বাতিটি নিভে যায়। পরক্ষণেই ও.টির ভিতর থেকে একজন পুরুষ ডাক্তারকে বেড়িয়ে আসতে দেখে হুমায়রা বসাবস্থা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তমালিকা আর তারেকও ওদের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ান। কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“ডাক্তার…তাহিরের অবস্থা এখন কেমন!”
ডাক্তার নিজের চেহারার উপর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট রেখে বললেন….
—“ওনার বুকের বাম পার্শে বি*দ্ধ হওয়া গু*লি*টি আমরা বের করেছি। কিন্তু ওনার অবস্থা ভিষণ সমীচীন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিছুসময় পর ওনাকে আই.সি.ইউ তে সিফট করা হবে। আমরা আমাদের সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করবো ওনাকে বি*প*দ*সীমা থেকে বের করে আনার। কিন্তু আগামী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে যদি ওনার সেন্স না ফেরে তাহলে আমাদের আর করার কিছুই থাকবে না। আল্লাহর কাছে ওনার সুস্থতা কামনা করুন। এখন উনিই একমাত্র ভরসা।”
এই বলে ডাক্তার চলে যান। হুমায়রা ধপ করে চেয়ারের উপর বসে পরে আবারও কান্না করতে করতে বললো…..
—“সব শেষ হয়ে গেলো, সব….সবটা শেষ হয়ে গেলো। আমার তাহিরকে আজ ঐখানে আসতে দেওয়াই উচিত হয় নি।”
হুমায়রার এমন কথা শুনে কুশল কিছুটা অ*প*রা*ধী দৃষ্টি নিয়ে ওর দিকে তাকায়। তরুনিমা নিজের মধ্যে থাকা সকল সং*কো*চ বোধকে দ*মি*য়ে রেখে আবারও হুমায়রার পাশে বসে। হুমায়রা কিছুটা রাগ নিয়ে কান্নামিশ্রিত কন্ঠে তরুকে উদ্দেশ্য করে বললো….
—“চলে যাও তুমি আমার সামনে থেকে। তোমাকে আমার একটুও স*হ্য হচ্ছে না। তোমাকে দেখলেই আমার চোখের সামনে তাহিরের য*ন্ত্র*ণা দায়ক মুখশ্রী ভেসে উঠছে।”
তরুনিমা মুখে কিছু না বলে হুমায়রাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। হুমায়রা প্রথমত নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেও পরপরই হাল ছেড়ে দিয়ে হু হু করে কান্না করতে থাকতে। অজানা কারণে তরুর দু’চোখ ও নোনাজলে ভরে উঠে।
(১০৮)
নিজের ঘরে মুখশ্রী জুড়ে বি*ষ*ন্ন*তা ছাপ ফুটিয়ে রেখে ফ্রেমে বাঁধা নিলাদ্রের একটা ছবি হাতে নিয়ে বিছানায় বসে আছে সন্ধ্যা। সন্ধ্যা ছবির উপর হাত বোলাতে বোলাতে অভিমানের স্বরে বললো….
—“আজ কতোদিন হলো আপনাকে একপলক দেখার জন্য আমার দু’চোখ ও মন যে কতোটা ছটফট করছে আপনি তে সেই খবর রাখেন নি আর না রাখার প্রয়োজন মনে করেছেন। যেদিন মেজো ভাইয়া আমাকে আপনার কাছে নিয়ে যাবে সেদিন আপনার সব কর্মের হিসাব সু*দে-আসল উশুল যদি না করেছি তবে আমার নামও সন্ধ্যা চৌধুরী নয়। আমাকে এতোটা য*ন্ত্র*ণা দেওয়ার অধিকার আমি আপনাকেও দেই নি। আপনি আপনার সীমা ল*ঙ্ঘ*ণ করেছেন। তাই যথাযথ শা*স্তিও আপনাকে পেতে হবে। সেই শা*স্তি আমি নিজ হাতে দিবো।”
—“কাকে শা*স্তি দেওয়ার কথা বলছিস তুই দিদিভাই?”
আকস্মিক নিজের পিছন থেকে সাগরিকা চৌধুরীর কন্ঠস্বর শোনামাত্র সন্ধ্যা কিছুটা ভরকে গিয়ে ওরণার নিচে নিলাদ্রের ছবিটা আড়াল করে দাদীমার দিকে ঘুরে বসে হাসিমুখে বললো….
—“আমার একজন বান্ধবী কল করেছিলো একটু আগে।
আজ সন্ধ্যাতেই ওর জন্মদিনের পার্টি ছিলো। কিন্তু আমি তো বড় ভাবীর জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানের কারণে সেখানে যেতে পারলাম। তাই আগামীকাল বিকালেই যদি আমাকে আলাদা ভাবে ট্রিট দেওয়ার ব্যবস্থা না করে তাহলে ওকে আমি কঠিন শা*স্তি দিবো।”
সেইসময় সাবরিনা ও কামিনী হাসিমুখে সন্ধ্যার রুমে প্রবেশ করে। সাবরিনা শান্ত স্বরে বললো….
—“আগামীকাল তোর বাসার বাহিরে যাওয়া বারণ সন্ধ্যা।”
মায়ের মুখে এমন কথা শুনে সন্ধ্যা অবাক স্বরে বললো…
—“কেনো মা?”
কামিনী বিনুনী নাড়াতে নাড়াতে সন্ধ্যার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দু’হাতে ওর দু’গাল টেনে দিয়ে নিজের বত্রিশপা*টি দাঁত বের করে বললো….
—“কারণ আগামীকাল তোমাকে দেখতে আসবে।”
সন্ধ্যা অত্যন্ত অবাক হয়ে বললো….
—“দেখতে আসবে মানে! কি বলছো কি তোমরা এসব?”
কামিনী সন্ধ্যার সামনে থেকে সরে দাঁড়াতেই সাবরিনা বললো….
—“এই সামান্য বিষয় নিয়ে এতোটা অবাক হওয়ার কি আছে সন্ধ্যা! বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়স হয়ে গিয়েছে তোমার। ভালো বংশ, ভালো ছেলের সন্ধান যেহেতু পেয়েছি তাই তোমাকে বিয়ে দিতে তো আমাদের কারোরই কোনো দ্বিমত নেই।”
—“কিন্তু মা…!”
—“কোনো কিন্তু না সন্ধ্যা। আগামীকাল ছেলেপক্ষ তোমাকে দেখতে আসবে আর তুমি ভদ্র ভাবে তাদের সামনে যাবে এটাই আমার শেষ কথা।”
সন্ধ্যা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে সাগরিকা চৌধুরীর দিকে তাকায়। সাগরিকা চৌধুরী শান্ত স্বরে বললেন….
—“আহা আমার নাতীনটার উপর রাগ হইও না তো তুমি মেজো বউমা। আমি বুঝাইয়া কইতাছি ওরে। তোমরা যাও দেখি এখন এইখান থেকে।”
—“হুম…আপনার নাতনীকে সঠিক বুঝ দিন মা। ছোট চল এখন, অনেক কাজ পরে আছে।”
এই বলে সাবরিনা ও কামিনী দু’জনেই সন্ধ্যার রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। সাগরিকা চৌধুরী সন্ধ্যার পাশে বসতেই সন্ধ্যা সাগরিকা চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। সাগরিকা চৌধুরী সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত স্বরে বললেন….
—“তুই কি কাওকে পছন্দ করিস দিদিভাই! যদি করে থাকিস তাহলে নির্দ্বিধায় আমাকে তার কথা জানাইয়া দে। কুশল দাদুভাইকে দিয়ে তার সকল খোঁজ-খবর নেওয়ার পর যদি বুঝি ছেলেটা ভালো তাহলে ঐ ছেলের সাথেই তোর বিয়া দেওয়ার ব্যবস্থা আমি করমু।”
দাদীমার মুখে এমন কথা শুনে সন্ধ্যার বুক ভে*ঙে কান্না বেড়িয়ে আসার উপক্রম হয়। কিন্তু অনেক ক*ষ্টে সন্ধ্যা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে। কারণ নিলাদ্র যে বেঁচে আছে এই কথা বাহিরের আর কোনো ব্যক্তির কাছে প্রকাশ না করা নিয়ে কুশল ও তরুর কড়া নি*ষে*ধা*জ্ঞা রয়েছে। তাই নিজের পছন্দের পুরুষ থাকা স্বত্বেও তাঁকে সবার সামনে আনা এইমূহূর্তে সন্ধ্যার পক্ষে অসম্ভব।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১০৯)
নিজের ঘরে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে পায়চারী করছে আর একের পর এক কুশলকে কল করছে সন্ধ্যা। কিন্তু প্রতিবারই কল বেজে উঠে আপনা-আপনি কেটে যাচ্ছে দেখে সন্ধ্যা বিরবিরিয়ে বললো…..
—“মেজো ভাইয়া ফোন তুলছে না কেনো! এখন আমি কি করবো!”
পরমূহূর্তে আরো বেশ কয়েকবার কল দেওয়ার পরেও কুশলের কোনো রেসপন্স না পেয়ে সন্ধ্যা হতাশ হয়ে ফোনটা বিছানার উপর ছুঁ*ড়ে মে*রে বিছানার পাশে গিয়ে বসে দাঁত দিয়ে আলতো ভাবে নিচের ঠোঁট কা*ম*ড়ে ধরে কান্না নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করে বললো…..
—“নিলাদ্র…..কোথায় আপনি! কি অবস্থায় আছেন আপনি! আপনাকে আমার খুব প্রয়োজন। প্লিজ তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে আমার কাছে চলে আসুন। প্লিজ…!”
(১১০)
আইসিইউ এর বেডে ঘুমন্ত অবস্থায় শুয়ে আছে তাহির। আইসিইউ এর দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ছোট্ট কাঁচের দেওয়াল ভেদ করে তাহিরের উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছে হুমায়রা। সেইসময় হুমায়রার ফোন বেজে উঠলে ওর ধ্যন ভা*ঙে। হাতে থাকা ফোনটি সামনে আনতেই ফোন স্ক্রিনে তাহিরের মা রেবেকা তালুকদারের নাম্বার থেকে কল এসেছে দেখতে পেয়ে হুমায়রা কলটি রিসিভ করে আবারও তাহিরের দিকে তাকিয়ে রয়। রেবেকা কিছু উত্তেজনার স্বরে বললেন….
—“হিমু….মা….কোথায় আছো তোমরা? এখনও বাসায় ফিরছো না যে! অনেক সময় ধরে আমি আর তোমার খালু জান তাহিরের ফোনে কল দিয়ে যাচ্ছি কিন্তু প্রতিবারই ওর ফোন বেজে বেজে আপনা-আপনি কে*টে যাচ্ছে। তোমরা ঠিক আছো তো? কোনো বি*প*দ হয় নি তো মা?”
হুমায়রা চোখ দিয়ে নিরবে কয়েক ফোঁটা অশ্রুপাত করে বললো….
—“খালা আমি আর তাহির দু’জনেই সম্পূর্ণ সুস্থ আছি। আমি অনেক বছর পর বাংলাদেশে আসলাম তাই তাহিরের কাছে বায়না করেছিলাম আমাকে যেনো সে শহর থেকে দূরে দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখায়। আশেপাশের দর্শনীয় জায়গাগুলো ঘোরা শেষ করে বাসায় ফিরতে আরো ২-৩দিন সময় লাগবে। আমরা তো পূর্ব থেকে পরিকল্পনা করে বাসা থেকে বের হই নি তাই আমার আর তাহিরের দুজনের ফোনেই চার্জ স্বল্প পরিমাণে বেঁচে আছে। যখন তখন ফোন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আপনারা আমাদের জন্য চিন্তা করবেন না।”
—“আচ্ছা ঠিক আছে মা…সাবধানে ঘোরা-ফেরা করো তোমরা। তুমি তাহিরের সাথে আছো জন্যই আমি আর তোমার খালু কিছুটা চিন্তা মুক্ত আছি। তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে এসো দু’জনেই কেমন!”
—“জ্বি….আচ্ছা।”
এই বলে হুমায়রা কল কেটে দিয়ে ফোন বন্ধ করে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশে থাকা চেয়ারের কাছে গিয়ে বসে পরে বললো….
—“আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন খালা…খালু..! আপনাদের থেকে এতো বড় একটা সত্য লুকিয়ে যাওয়ার জন্য আমি ভিষণ দুঃখিত। কিন্তু নিরুপায় হয়ে আমাকে আপনাদের সাথে মি*থ্যে কথা বলতে হলো।”
(১১১)
পরেরদিন সকালে……..
হাসপাতালে তাহিরের চিকিৎসার জন্য খরচ হওয়া যাবতীয় বিল পরিশোধ করার সময় কুশল ওর পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখে সন্ধ্যার নাম্বার থেকে অনেকগুলো মিসডকল উঠে আছে। তাহির মুখ দিয়ে ‘চ’ এর মতো শব্দ উচ্চারণ করে বিল পরিশোধ করে দেয়। পরক্ষণেই কুশল সন্ধ্যার নাম্বারে কল দিতেই কিছুসময় রিং হওয়ার পরপরই কল রিসিভ হয়। ফোনের ওপাশ থেকে সন্ধ্যা অস্থির কন্ঠে বললো…..
—“মেজো ভাইয়া…কোথায় আছো তুমি! গতকাল রাত থেকে কতোবার কল করেছি তোমায় কিন্তু একবারও তুমি কল রিসিভ করলে না। সবকিছু ঠিক আছে তো!”
—“গতকাল সন্ধ্যার পার্টিতে আমাকে বাঁচাতে গিয়ে যে গু*লি বি*দ্ধ হয়েছিলো ওকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এসব নিয়েই একটু ব্যস্ত ছিলাম। আর ফোনও সাইলেন্ট ছিলো তাই এতোবার কল দিয়েছিস তবুও বুঝতে পারি নি। এদিকে সবকিছুই ঠিক আছে। তোর কি হয়েছে! এতোবার কল দিয়েছিস যে? বাসায় সবাই সুস্থ আছেন তো?”
—“মেজো ভাইয়া….নিলাদ্রের এখন কি অবস্থা! আমায় ওনার কাছে কবে নিয়ে যাবে তুমি! এদিকে বাসায় মা, চাচী, দাদীমা সবাই আমার বিয়ের জন্য ছেলে পছন্দ করেছেন। আজ বিকালে ছেলেপক্ষ আমাকে দেখতেও আসবেন। মেজো ভাইয়া…. তুমি তো জানো আমি আর নিলাদ্র একে-অপরকে কতোটা ভালোবাসি! মেজো ভাইয়া…. কিছু একটা করো তুমি। বাসার সবার এই সিদ্ধান্ত থেকে মন উঠিয়ে নেওয়ার কাজ তুমি ব্যতিত আর কারোর পক্ষে করা সম্ভব না। নিলাদ্রকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না মেজো ভাইয়া…! কিছু একটা করো। এই সমস্যার একটা সঠিক সমাধান বের করো তুমি প্লিজ।”
সন্ধ্যার সম্পূর্ণ কথা শুনে কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“এতো বেশি উত্তেজিত হওয়ার মতো কিছুই হয় নি সন্ধ্যা। মাথা ঠান্ডা রাখ…দেখতে আসলেই বিয়ে হয়ে যায় না। আমি দেখছি কি করা যায়।”
—“ঠিক আছে।”
এই বলে সন্ধ্যা কল কেটে দেয়। সেইসময় তরুনিমা দ্রুত পায়ে হেঁটে কুশলের সামনে এসে কমোরে একহাত ও বুকের মাঝবরাবর আরেক হাত রেখে দাঁড়িয়ে হাঁ*পা*তে শুরু করে। কুশল ওর ফোনটা পকেটে রেখে ভ্রু কুঁচকে তরুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো…..
—“কি হয়েছে তোমার! এভাবে হাঁ*পা*চ্ছো কেনো? ”
তরুনিমা জোড়ে জোরে বারকয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো……
—“তাহির…তাহিরের জ্ঞান ফিরেছে কুশল। ও এখন পুরোপুরি ভাবে বি*প*দ মুক্ত রয়েছে। একটু পর তাহিরকে আইসিইউ থেকে আলাদা কেবিনে সিফট করার ব্যবস্থা করবেন বলেছেন ডাক্তার সাহেব। কেবিনে সিফট করা পর্যন্ত আমাদের একটু অপেক্ষা করতে হবে।”
তরুর এরূপ কথা শুনে কুশল একবার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললো…..
—“শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। ইয়া আল্লাহ… আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। চলো এখন তাহিরের সাথে দেখা করে আসি।”
অতঃপর কুশল আর তরুনিমা আইসিইউ এর দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
.
.
.
কুশল আর তরুনিমা আইসিইউ এর সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই হুমায়রা বসাবস্থা থেকে উঠে ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো….
—“আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা। তাহিরের সমীচীন অবস্থা দেখে আমার মাথা ঠিক ছিলো না। রাগের বশে তোমাদের অনেক ছোট-বড় কথা শুনিয়ে ফেলেছিলাম। আমি আমার ব্যবহারের জন্য ভিষণ ভাবে দুঃখিত।”
তরুনিমা স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“আমরা তোমার মনের অবস্থা বুঝতে পেরেছি আপু। তাই তোমার ব্যবহারে আমরা খারাপ কিছু মনে করি নি। এসব নিয়ে মনের ভিতর কোনোরূপ অনুশোচনা রেখো না, ভুলে যাও এসব।”
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“তাহিরের কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো। ওর জন্য আমি আবারও মৃ*ত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরেছি। আল্লাহ তায়ালা ওকে পুরোপুরি ভাবে সুস্থ করে দিক এই দোয়াই করছি।”
কুশল আর তরুর কথাগুলো শুনে হুমায়রার মন অনেকটা হালকা হয়ে যায়। সেইসময় আইসিইউ এর দরজা খুলে যায়। ২জন নার্স তাহিরকে একটা স্ট্রেচারে শুইয়ে আইসিইউ থেকে বাহিরে বের করে। তাহির চোখ মেলে ওদের তিনজনের দিকেই তাকায়। এখানে তরুনিমার উপস্থিতি তাহির আশা করে নি। তবুও তরুনিমাকে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তাহিরের মনেও কিছুটা স্বস্তি কাজ করছে। নার্স দু’জন তাহিরকে কেবিনে রেখে আসার জন্য সেদিকে অগ্রসর হয়। কুশল তরুনিমা ও হুমায়রাও ওদের পিছন পিছন যেতে শুরু করে। কিছুসময় পর তাহিরের জন্য নির্ধারিত কেবিনের সামনে এসে দাঁড়াতেই একজন নার্স ওদের তিন জনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন। আমরা পেশেন্টকে ভিতরে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে তার সাথে আপনাদের দেখা করার সুযোগ করে দিবো।”
নার্সের কথানুযায়ী ওরা তিনজন কেবিনের বাহিরেই দাঁড়িয়ে রয়। নার্স দু’জন তাহিরকে নিয়ে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করেন। বেশ কিছুসময় পর নার্স দু’জন কেবিন থেকে বের হয়ে ওদের তিনজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন….
—“এবার আপনারা একজন একজন করে পেশেন্ট এর সাথে স্বল্প সময় হাতে নিয়ে সাক্ষাৎ করতে পারেন। তবে ওনার শরীরে খারাপ প্রভাব ফেলতে পারে এমন উত্তেজনা মূলক কথা ওনাকে বলবেন না।”
প্রথমত হুমায়রা তাহিরের সাথে দেখা করতে ওর কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। হুমায়রা তাহিরের পাশে দাঁড়াতেই তাহির ভ্রু কুঁচকে হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললো….
—“কি রে স্টু*পি*ডের মতো কাঁদতে কাঁদতে নিজের চেহারার এ কি হাল করেছিস তুই! কি ভেবেছিলি আমি মা*রা যা….!”
তাহিরকে পুরো কথা শেষ করতে নি দিয়ে হুমায়রা সঙ্গে সঙ্গে একহাত দিয়ে তাহিরের মুখ চেপে ধরে রাগী স্বরে বললো…
—“চুপ…একদম চুপ…! যতোসব আজে-বা*জে কথা বলা। মুখ দিয়ে আর একটা আজে-বা*জে শব্দ বের করলে বরাবরের মতো এই মুখ সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করে দিবো বলে দিলাম।”
তাহির ওর মুখের উপর থেকে হুমায়রাকে নিজের হাত সরিয়ে নিতে চোখ দিয়ে ইশারা করে। হুমায়রা নিজের হাত সরিয়ে নিতেই তাহির বললো…..
—“বড় ভাই হই আমি তোর। আমার সাথে এতো কড়া ভাষায় কথা বলতে তোর বিবেকে বাঁধছে না!”
তাহিরের মুখে আবারও বড় ভাই সম্বোধন করে কথা বলতে শুনে তাহিরের হাতে খুব জোড়ে একটা চিমটি কেটে দেয়। তাহির ব্য*থা*য় মুখ দিয়ে ‘আহহহহ’ শব্দ উচ্চারণ করে বললো….
—“ডা*ক*নী রেএএএ….!”
হুমায়রা দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো….
—“পৃথিবীতে বসবাসরত সকল পুরুষকে আমি আমার বড়-ছোট ভাই, চাচা, মামা, খালু হিসেবে মেনে নিতে পারবো কিন্তু তোমাকে কখনও ভাই বলে মানতে পারবো না। কারণ তোমাকে আমি ভালোবাসি, তোমাকে আমি আমার জীবনসঙ্গী রূপে আপন করে নিতে চাই। তাই আর কখনও যদি আমার সামনে নিজেকে আমার বড় ভাই বলে সম্বোধন করার বিন্দুমাত্র চেষ্টাও করো তবে তোমাকে নিজ হাতে খু*ন করবো আমি বলে দিলাম।”
এই বলে হুমায়রা হনহনিয়ে তাহিরের কেবিন থেকে বেড়িয়ে যায়। হুমায়রার এরূপ কথা শুনে তাহিরের মুখ অটোমেটিক হা হয়ে যায়। তাহির অত্যন্ত অবাক দৃষ্টি নিয়ে হুমায়রার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়।
#চলবে ইনশাআল্লাহ….
#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৪৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)
(১১২)
হুমায়রাকে রাগী মুখশ্রী নিয়ে তাহিরের কেবিন থেকে বের হতে দেখে তরুনিমা হুমায়রার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছুটা অবাক ভাব নিয়ে বললো….
—“এই তো কিছুসময় আগেই চেহারায় হাসি হাসি ভাব স্পষ্ট রেখে কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করলে তুমি। এইটুকু সময়ের ভিতর তোমার আর তাহিরের মাঝে কি এমন কথপোকথন হলো যার দরুণ তুমি এতোটা রাগান্বিত ভাব নিয়ে কেবিন থেকে বেড়িয়ে আসলে জানতে পারি কি!”
হুমায়রা রাগে ফোঁ*স ফোঁ*স করতে করতে চেয়ারে বসে বললো…
—“নতুন করে কি আর হবে! সবই আমার পো*ড়া কপালের দো*ষ। ভিতরে যে গু*নো*ধ*র*টা শুয়ে আছে ওকে নিজের সবটা উজার করে ভালোবাসাটাই আমার সবথেকে বড় ভু*ল হয়েছে। অপাত্রে সুজিনিস ঢালা তো ভু*ল ই। ঐ গু*নো*ধ*র*টার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য নিজেকে কতোটা স*স্তা বানিয়ে ফেলেছি তবুও কু*ত্তা আমাকে বলে কি না ওকে বড় ভাইয়ের নজরে দেখতে! বলে এসেছি, আর একবার যদি আমার সামনে নিজেকে আমার বড় ভাই বলে সম্বোধন করে তাহলে ওকে নিজ হাতে খু*ন করবো আমি।”
কথাগুলো বলেই হুমায়রা জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে শুরু করে। হুমায়রার রাগী স্বরে বলা তাহিরকে নিয়ে ওর মনের কথা গুলো শোনার পর পুরো বিষয়টা ভালোভাবে বুঝে উঠতে তরুর কয়েক সেকেন্ড সময় লাগে। পরমুহূর্তেই অজানা কারণে তরুর ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠে। তরু হুমায়রার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াতেই কুশলকে তাহিরের কেবিন থেকে বের হতে দেখতে পায়। তরু কুশলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“আমি কি তাহিরের সাথে এই মুহূর্তে একান্তে কিছু কথা বলতে ওর কেবিনের ভিতরে যেতে পারি!”
তরুর মুখে এমন অনুমতি মূলক প্রশ্ন শুনে কুশল শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তরুর দিকে তাকিয়ে রয় কিছুসময়। পরক্ষণেই চোখ দিয়া ইশারা করে তরুকে তাহিরের কেবিনের ভিতর প্রবেশ করতে বলে কুশল। তরু ঠোঁটের কোনে স্মিত হাসির রেখা স্পষ্ট রেখে তাহিরের কেবিনের ভিতরে প্রবেশ করে। তাহির চোখ তুলে সামনের দিকে লক্ষ্য করতেই তরুনিমাকে নিজের সামনে আবিষ্কার করে। তরুনিমা প্রতিটি কদম ফেলে তাহিরের দিকে যতোই অগ্রসর হচ্ছে তাহিরের হৃদপিণ্ডের গতি স্বাভাবিক এর তুলনায় ধীরে ধীরে ততোই বাড়তে শুরু করেছে। তরুনিমা তাহিরের হাতের বাম পার্শে বেডের মাঝবরাবর এসে দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির রেখে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললো…
—“এখন কেমন লাগছে আপনার! বুকের ভিতর খুব বেশি ব্য*থা করছে নাকি?”
তাহির একবার ঢোক গিলে নিয়ে ধীর স্বরে বললো….
—“শরীরের এই ক্ষ*তে*র ব্য*থা মনের গহীনে হওয়া ক্ষ*তে*র ব্য*থা*র কাছে ভিষণ তু*চ্ছ। মনের গহীনের সেই ক্ষ*তে*র ব্য*থা সহ্য করে নেওয়ার মতো পদক্ষেপ যখন গ্রহন করতে পেরেছি তখন শরীরের এই ক্ষ*তে*র ব্য*থা গ্রহন করে নেওয়া আমার কাছে খুবই ছোট বিষয়।”
—“আপনার কাছে আমি ২দিক থেকে ঋণী হয়ে রইলাম। আজ আপনি আমার প্রাণ বাঁচানোর পাশাপাশি নিজের জীবনের পরোয়া না করে আমার স্বামীর প্রাণ ও বাঁচিয়েছেন।”
—“তুমি মানো বা না মানো তোমার প্রতি সৃষ্টি হওয়া আমার ভালোবাসা নামক অনূভুতি গুলো মি*থ্যে নয়। হয়তো তুমি আজ অন্য কারোর হয়ে গিয়েছো কিন্তু এই কারণে তো আমি তোমাকে ঘৃ*ণা করতে পারি না। আর যাকে ভালোবাসা যায় তাকে কখনও ঘৃ*ণা করা যায় না। ভালোবাসা যেমন আপন করে নিজের কাছে আগলে রাখতে শেখায় তেমনি ভালোবাসার মানুষটির সুখের জন্য ত্য*গ স্বীকার করতেও শিখাও। আমি তো তোমাকে ভালোবেসে নিজের করে নিতে পারি নি। তোমাকে যে নিজের করে পেয়েছে সে যেনো সারাজীবন ধরে তোমাকে ভালোবেসে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারে তাই তার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে আমি আরো হাজার বার নিজের প্রাণকে নিয়ে ঝুঁ*কি*র সম্মুখীন হতে পারি।”
—“একবার এমন কাজ করে আমাকে ঋনী করে দিয়েছেন কিন্তু আর কখনও এমন কাজ করার কথা চিন্তাও করবেন না। আপনার কাছে আপনার জীবনের কোনো মূল্য নাই থাকতে পারে কিন্তু আরো এমন অনেক মানুষ আছে যাদের কাছে তাদের জীবনের চেয়ে আপনার জীবনের মূল্য শত গুণে বেশি।”
—“কাদের কথা বলছো তুমি!”
—“প্রথমত আপনার জন্মদাত্রী মা ও বাবা। দ্বিতীয়ত আপনার কেবিনের বাহিরে বসারত মেয়েটি।”
—“হিমুর কথা বলছো তুমি….! ওর কথা বাদ দাও। অল্প বয়সেই অত্যাধিক পেঁকে গিয়েছে সে। একটু আগেই আমাকে ভালোবাসার কথা বললো! বাচ্চা মেয়ে…ভালোবাসার বুঝে টা কি! আবেগের বশীভূত হয়ে এমন মনগড়া কথা অনেক বলা যায়। আরেকটু বড় হলে, নিজের ভিতর ম্যচিউরিটি চলে আসলে এসব আবেগ চিরকালের জন্য ঘাড় থেকে নেমে যাবে।”
—“হিমু আবেগের বশীভূত হয়ে আপনার কাছে নিজের মনের অনুভূতি গুলোর বহিঃপ্রকাশ করে নি। আমি ওর চোখে আপনার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসা দেখেছি। আপনার গু*লি লাগার সময় থেকে সেন্স ফেরার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ওর চোখ জোড়া থেকে পড়া প্রতিটি অশ্রুকণা যেনো চিৎকার করে বলছিলো সে আপনাকে কতো বেশি ভালোবাসে। যখন ডাক্তার বলেছিলো যে আগামী ৪৮ঘন্টার ভিতর আপনার সেন্স না ফিরলে আপনাকে হয়তো আর বাঁচানো সম্ভব হয়ে উঠবে না তখন ওর চোখে আপনার ভালোবাসা পাওয়ার আগেই আপনাকে হারিয়ে ফেলার এক অতৃপ্ত য*ন্ত্র*ণা*র ছাপ দেখতে পেয়েছিলাম আমি। একটাবার কিছু সময়ের জন্য ওর চোখের দিকে নিজের চোখ দু’টো স্থির করে রাখিয়েন। আপনিও ওর চোখের মনির মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি ও নিজের প্রতি ওর সীমাহীন ভালোবাসা গুলোও দেখতে পারবেন। দয়াকরে আবেগ বলে এই সত্যিকারের ভালোবাসাটিকে নিজের জীবন থেকে হারিয়ে যেতে দিবেন না।”
কথাগুলো বলে তরুনিমা একবারের দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরপায়ে তাহিরের কেবিন থেকে বের হয়ে আসে। তরুর বলা প্রতিটি শব্দ এখনও যেনো তাহিরের কানে বাজছে। তরুনিমাকে কেবিন থেকে বের হতে দেখে কুশল শান্ত স্বরে বললো……
—“আমাদের এক্ষুণি বাসায় ফিরতে হবে তরুনিমা। বিকালে সন্ধ্যাকে দেখার জন্য ছেলেপক্ষ আসবে।”
কুশলের মুখে এরূপ কথা শুনে তরুনিমা অত্যন্ত অবাক হয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে বললো…
—“কিন্তু নিল….!”
তরু পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই কুশল তরুর ঠোঁট জোড়ার উপর নিজের শাহাদত আঙুল ঠেকিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বললো….
—“দেওয়ালের ও কান আছে তরুনিমা।”
তরুনিমা কুশলের কথার ভাঁজ বুঝতে পেরে একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে হুমায়রার কাছে গিয়ে বসে বললো….
—“নিজের খেয়াল রেখো। তুমি সুস্থ না থাকলে তোমার তাহিরের খেয়াল এমূহূর্তে আর কে রাখবে বলো! নিজের রাগকে কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করো সবসময়। ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য যেই যু*দ্ধ করতে হয় তাতে জয় লাভ করা এতো সহজ বিষয় না হিমু৷ আমরা আসছি এখন।”
হুমায়রা শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তরু আর কুশলের দিকে তাকায়। অতঃপর তরুনিনা আর কুশল হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে যায়।
(১১৩)
কুশল আর তরুনিমা চৌধুরী মেনশনের মূল দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতেই ড্রয়িং রুমে পরিবারের সবার সাথে বাহিরের আরো কয়েকজন কম ও মধ্য বয়সের পুরুষ-মহিলাকে বসে থাকতে দেখতে পেয়ে দু’জনেই বুঝতে সক্ষম হয় এরাই আজ সন্ধ্যাকে দেখার জন্য এখানে এসেছে। কুশল ও তরুনিমা ধীরপায়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াতেই সাগরিকা চৌধুরী হাসিমুখে বললেন….
—“এই যে আমার মেজো নাতী কুশল চৌধুরী ও মেজো নাত বউ তরুনিমা চৌধুরী এসে গিয়েছে। দাদু ও দিদি ভাই ওনাদের সাথে পরিচিত হয়ে নাও। উনি হচ্ছেন শরীফ ইসলাম। তোমাদের দাদুভাই এহমেত চৌধুরীর খুব কাছের বন্ধু সালজুক ইসলামের একমাত্র ছেলে উনি। উনি হচ্ছে শরীফের স্ত্রী জয়নাব ইসলাম আর ও হচ্ছে ওদের একমাত্র ছেলে সাইফুদ্দিন ইসলাম।”
সাগরিকা চৌধুরীর মুখে নিজের নাম শুনে সাইফুদ্দিন ডান হাত দিয়ে নিজের চোখের উপর থেকে কালো সানগ্লাসটা খুলে ফেলে বললো….
—“ওহহহ…কাম অন গ্রাণ মা….আমাকে সাইফুদ্দিন নামে কল করো না। এই নেইম টা সো বোরিং। সো আমাকে সাইফ বলে কল করো… অনলি সাইফ।”
সাইফের মুখে এমন আধভা*ঙা ইংরেজি শুনে তরুনিমা মুখ কুঁচকে ফেলে। কুশল ওর চেহারায় শান্ত ভাব স্পষ্ট রেখে নিজের জন্য নির্ধারিত করা সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে পড়ে। সাইফের কথার ধরণ এমন হওয়া নিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যদের যে কোনোরূপ সমস্যা নেই তা তাদের হাস্যোজ্জ্বল চেহারা দেখেই বুঝতে পেরেছে তরুনিমা। সাবরিনা চৌধুরী হাসিমুখে তরুনিমাকে বললেন….
—“মেজো বউ মা….এবার সন্ধ্যাকে ওনাদের সামনে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো।”
তরুনিমা জোরপূর্বক নিজের মুখে হাসি স্পষ্ট রেখে সন্ধ্যার রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। কিছুসময় পর সন্ধ্যার রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে তরু দরজায় টোকা দিতে গিয়ে দেখে দরজা খোলা। তরু দরজা ঠেলে রুমের ভিতর প্রবেশ করতেই দেখে সন্ধ্যা বিছানার উপর বসে হু হু করে কান্না করছে। তরু অস্থির হয়ে সন্ধ্যার কাছে গিয়ে বললো….
—“সন্ধ্যা….আমার জান….! কি হয়েছে তোমার এভাবে কান্না করছো কেনো তুমি!”
সন্ধ্যা তরুর দিকে ঘুরে বসে ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো….
—“মেজো ভাবী….সব শেষ হয়ে গিয়েছে। আমার আর নিলাদ্রের এক হওয়ার জন্য আর কোনো রাস্তা খোলা নেই। আমাকে তোমারা সেদিন কেনো মৃ*ত্যু*র হাত থেকে বাঁচিয়েছিলে বলো তো! আমি মা*রা গেলেও শান্তি পাবো। তবুও বেঁচে থাকতে নিলাদ্র ব্যতীত অন্য কোনো পুরুষের সহধর্মিণী হিসেবে পরিচয় বহন করতে পারবো না।”
—“সন্ধ্যা মাথা ঠান্ডা করো। এখন এমন ছেলেমানুষী আচারণ করার জন্য কোনোরূপ সময় নেই। নিজের আবেগ, রাগকে কন্ট্রোলে রাখার চেষ্টা করো। ওনারা শুধু তোমাকে দেখার জন্যই এসেছেন। বিয়ে হওয়ার জন্য অনেক টা পথ অতিক্রম করতে হবে। যেকোনো বিষয় নিয়ে তোমার মেজো ভাইয়ার উপর তো তুমি ভরসা করো তাই না!”
তরুর বুক থেকে মাথা তুলে বললো….
—“হুম।”
—“এই ভরসার বাঁধণটা ধরে রাখো। আর চিন্তা মুক্ত থাকো এটা ভেবে যে, নিলাদ্র ভাইয়া বেঁচে থাকাকালীন ২য় কোনো পুরুষের সাথে তোমার বিয়ে হতে দিবে না তোমার মেজো ভাইয়া। এখন পরিবারের সবার সম্মান রক্ষার খাতিরে ওনাদের সামনে যেতে হবে তোমায়।”
—“আচ্ছা।”
তরুনিমা সন্ধ্যার চোখের পানি মুছে দিয়ে ওকে তৈরি করে ছেলে পক্ষের সামনে নিয়ে আসে। সন্ধ্যা মাথা নিচু রেখে বসে আছে।
#চলবে ইনশাআল্লাহ…..