হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৬৪+৬৫+৬৬

0
469

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৪)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৪৯)
দরজায় কলিং বেল বাজতেই তমালিকা সিকদার গিয়ে দরজা খুলে দিতেই দেখলেন দরজার বাহিরে হাসিমুখে তরু আর সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছেন। এতোদিন পর নিজের মাকে নিজের সামনে দেখামাত্র তরু ‘মা কেমন আছো তুমি?’ বাক্যটি উচ্চারণ করে তমালিকাকে জড়িয়ে ধরে। তমালিকা হাসিমুখে বললেন….

—“ওরে…ছাড়..ছাড়…পাগলী মেয়ে আমার। আমি অনেক ভালো আছি।”

তরু ওর মাকে ছেড়ে দিয়ে বললো….
—“মা…বাবা কোথায়? বাবাকে দেখছি না যে?”

—“তোর বাবার হঠাৎ জরুরী মিটিং পড়ে গিয়েছে। তাই অফিসে গিয়েছেন। এসে পড়বেন সন্ধ্যার ভিতর। জামাই বাবাজিকে দেখছি না যে! সে আসলো না?”

—“এসেছে মা। আমাদের নামিয়ে দিয়ে উনি গাড়িটা পার্কিং সাইডে রাখতে গিয়েছেন।”

সেইসময় সন্ধ্যা গাল ফুলিয়ে অভিমানের স্বরে বললো….
—“আমাকে তো কেও পাত্তাই দিচ্ছেন না। যেনো এখানে আমি নেই ই!”

সন্ধ্যার এরূপ কথা শুনে তরু আর তমালিকা দু’জনেই হেসে দিলেন। তমালিকা সন্ধ্যার সামনের গিয়ে দাঁড়িয়ে ওর গাল আলতো ভাবে টেনে দিয়ে বললেন….

—“ইসস…অনেক বড় ভু*ল হয়ে গিয়েছে। আমার মিষ্টি মামনিটাকে তো আমি এতোসময় লক্ষই করি নি। আয় দেখি একটু জড়িয়ে ধরি তোকে।”

তমালিকার এরূপ কথা শুনে সন্ধ্যা সব ওর অভিমান দূরে সরিয়ে রেখে তমালিকাকে জড়িয়ে ধরলেন। এর মাঝেই পিছন থেকে কুশলের কন্ঠস্বর ভেসে আসে…..

—“শ্বাশুড়ি মা…বিয়ের পর এই প্রথম আপনার মেয়ের একমাত্র জামাই আপনাদের বাসায় এসেছে তাই এবার মেয়েকে সাইডে রেখে জামাইকে খুব ভালোভাবে আদর যত্ন করা শুরু করুন। মূলত জামাই আদর খাওয়ার জন্যই এসেছি আমি।”

তরু ঘাড় ঘুরিয়ে কুশলের দিকে তাকিয়ে ভেং*চি কাটলো। তমালিকা হাসিমুখে বললেন….

—“তা আর বলতে হয় জামাই বাবাজি! আমাদের তো কোনো ছেলে নেই। তাই তোমাকেই আমাদের নিজের ছেলে বলে করি। তোমার আদর-যত্নে বিন্দুমাত্র ত্রু*টি হয়ে দিবো না। এখন ভিতরে এসো তোমরা।”

অতঃপর ওরা তিন বাসার ভিতরে প্রবেশ করে।তমালিকা তরুকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“তরু…জামাই বাবাজিকে রুমে নিয়ে যা। অনেকটা পথ জার্নি করে এসেছিস তোরা। ফ্রেশ হয়ে রেস্ট কর। আমি তোদের জন্য রুমেই ঠান্ডা শরবত পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

তরুনিমা কুশলের সামনে হালকা ঝুঁকে ডান হাত সামনের দিকে বাড়িয়ে হাসি মুখে বললো….

—“চলুন জামাই রাজা!”

কুশল গলা খেঁ*কড়ে হালকা কাশি দিয়ে বললো….
—“এখন নিজেকে সত্যিই রাজা বলে মনে হচ্ছে।”

ওদের এরূপ কান্ড দেখে তমালিকা আর সন্ধ্যা হাসতে থাকেন। কুশল আর তরু সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। তমালিকা সন্ধ্যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন….

—“মিষ্টি মামনি…তুই আমায় সাথে আয়।”

সন্ধ্যা হাসিমুখে তমালিকার সাথে চলে গেলো।

লম্বাসময় পর তরুনিমা আর নিজের রুমে আসতে পারলো। বিয়ের করে এ বাড়ি থেকে ও বাড়িতে যাওয়ার পূর্ব মূহূর্ত পর্যন্তও প্রতিটা জিনিস যেভাবে যেই যেই স্থানে রেখে গিয়েছিলো এখন সেভাবে সেই সেই স্থানেই সেগুলো রাখা আছে। বেডের পিছনে তরুর হাস্যোজ্জ্বল একটা ছবি বিশালাকার ফ্রেমে বেঁধে টাঙিয়ে রাখাবস্থায় দেখতে পায় কুশল। কুশলের দৃষ্টি সেই ছবির উপরেই স্থির হয়। মুগ্ধ ওর সেই চাহনি। তরু বেডের অপরপ্রান্তে থাকা আলমারীর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আলমারির দুটো পাল্লা খুলতেই দেখে সেখানে এক সাড়িতে কুশলের পরিধান করার জন্য কিছু টি-শার্ট আর ট্রাউজার রাখা আছে। আরেকপ্রান্তে তরুর পরিধান করার জন্য জামা-কাপড়গুলো রাখা আছে। তরু ওর ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে কুশলের জন্য একসেট কাপড় বের করে কুশলের পাশে এসে দাঁড়িয়ে কাপড়গুলো ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো….

—“দেখেছেন মা আপনার পরিধান করার জন্য নতুন জামা-কাপড় ও কিনে আলমারীতে গুছিয়ে রেখেছেন। আসার সময় তো তাড়াহুড়োর বশে আপনার পরিধানের জন্য কোনো কাপড় নেওয়ার কথা স্মরণ ই ছিলো না আমার। এখন ভাবছিলাম আপনি ফ্রেশ হয়ে কি পড়বেন! মা আমার সেই চিন্তা দূর করে দিলেন।”

কুশল তরুর দিকে তাকিয়ে ওর হাত থেকে কাপড়গুলো নিয়ে একটু ভাবের স্বরে বললো……
—“দেখতে হবে তো শ্বাশুড়ি মা টা কার!”

তরু ভেং*চি কে*টে বললো…
—“সবসময় নিজের গুণ-গান গাওয়া। মানে একটু সুযোগ পেলেই নিজের ঢোল নিজে পি*টা*নো*তে মিস করবেন না৷ শুনে রাখুন তিনি আপনার শ্বাশুড়ি মা হওয়ার আগে আমার মা হন। তাই এই ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ক্রেডিট শুধু আমার।”

কুশল কিছুসময় তরুর দিকে শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থেকে মুখে কিছু না বলে টুপ করে ওর গালে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে ওয়াশরুমের ভিতরে চলে যায়। কুশলের আকস্মিক এমন কাজে তরু পুরো থ হয়ে যায়। পরক্ষণেই লজ্জায় তরুর গাল হালকা লাল বর্ণ ধারণ করে। ঠোঁটে লজ্জার হাসির রেখা ফুটিয়ে গালের সেই স্থানে হাত রেখে বললো….

—“অ*স*ভ্য কোথাকার।”

তরু ওর রুমের আসবাবপত্র গুলো আলতো হাতে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে সেইসময় কুশল ওয়াশরুমের দরজা হালকা খুলে তরুকে বললো….

—“তরুনিমা…তোয়ালে টা দাও তো। তোয়ালে আনতে ভুলে গিয়েছি।”

কুশলের এরূপ কথায় তরু কিছুটা অবাক হয়। ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করে…
—“ওয়াশরুমে তো একটা এক্সট্রা তোয়ালে থাকার কথা। মা তো সবসময় রাখেন। আজ হয়তো রাখতে ভুলে গিয়েছেন!”

এই ভেবে তরু আলমারী খুলে একটা তোয়ালে বের করে ওয়াশরুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করে ডান হাত বাড়িয়ে তোয়ালেটা এগিয়ে দেয়। কুশল তোয়ালে সমেত তরুর হাত ধরে হ্য*চ*কা টান দিয়ে ওকে ওয়াশরুমের ভিতরে এনে দেওয়ালের সাথে চেপে ধরে। কুশলের আকস্মিক এমন কাজে তরু কিছু ভ*য় পেয়ে যায়। চোখ-মুখ খিঁ*চে বন্ধ করে রেখেছে সে। কুশল মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে তরুর ভী*ত মুখশ্রীর দিকে তাকিয়ে আছে। তরুর সামনের কিছু চুল ওর মুখের উপর এসে পড়েছে। কুশল হালকা ফু দিয়ে সেই চুলগুলো সরিয়ে দেয়। তরু পিটপিট করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখে সে কুশলের বাহুডোরে ব*ন্দী হয়ে আছে। তরু কুশলের চোখের দিকে তাকায় কুশলের এই চাহনী যেনো ওকে মে*রে*ই ফেলবে। তরুর হার্ট স্বাভাবিক এর তুলনায় অনেক দ্রুত বিট করছে। কুশলের মুখশ্রী তরুর মুখের উপর বেশ সন্নিকটে থাকায় ওর গরম নিঃশ্বাস তরুর মুখের উপর আ*ছ*ড়ে পড়ছে। তরু কাঁ*পা গলায় বললো….

—“এ-এভাবে টেনে ভিতরে আনার মানে কি!”

কুশল তরুর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে যায়। তরু চোখ খিঁ*চে আবার বন্ধ করে দু’হাতে নিজের ওড়নার নিচের অংশ মুষ্টিবদ্ধ করে নেয়। কুশল তরুর কানে ফিসফিসিয়ে বললো….

—“বউকে বউয়ের মতো করে আদর করতে মন ব্যকুল হয়ে উঠেছে ভিষণ।”

কুশলের এরূপ কথায় তরুর নিঃশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়। কুশল তরুর কানের লতিতে হালকা ভাবে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিতেই তরু ওর দু’হাত কুশলের উন্মুক্ত বুকের উপর রেখে ধা*ক্কা প্রয়োগ করে নিজের থেকে একটু দূরে সরিয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বের হতে নিলে কুশল তরুর এক হাত ধরে হ্য*চ*কা টান দিয়ে নিজের উন্মুক্ত বুকের উপর এনে ফে*লে। কুশল একহাতে তরুর দু’হাত ধরে ওর কমোরের পিছনে ঠেকিয়ে রাখে। কুশল আর তরুর মাঝে এখন মাত্র কয়েক ইন্ঞ্চির দূরত্ব আছে। কুশল ঘোর লাগা কন্ঠে বললো….

—“এভাবে বাঁ*ধা দিয়ে দূরে সরিয়ে আর য*ন্ত্র*ণা দিও না বউ। আমার তোমাকে প্রয়োজন…ভিষণ ভাবে প্রয়োজন। আমি তোমাকে পুরোপুরি ভাবে নিজের করে পেতে চাই। আমার য*ন্ত্র*ণা কমাতে আমাকে সাহায্য করো প্লিজ…!”

তরু পুরোপুরি ভাবে বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছে যেনো। ওর সম্পূর্ণ শরীর অসার হয়ে এসেছে। চোখ বন্ধ রেখে জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে সে৷ কুশল তরুর কপালে আর দু’গালে আলতো ভাবে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে ওকে পাঁজা কোলে তুলে নেয়। তরু সঙ্গে সঙ্গে দু’হাতে কুশলের গলা জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মুখ লুকায়। তরুর সম্মতি আছে বুঝতে পেরে কুশলের ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠে। কুশল তরুকে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেড়িয়ে বিছানার কাছে এসে ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তরু এখনও চোখ বন্ধ করে আছে। কুশল তরুর উপর কিছুটা ঝুঁকে বললো…..

—“চোখ মেলো বউ…তাকাও আমার দিকে!”

তরু চোখ মেলে তাকায়। কুশল যেই না তরুর ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে নিজের ওষ্ঠদ্বয় মিলাতে নিবে এমন সময় ওদের পিছনে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সিকদার বাড়ির কাজের
মেয়ে ললিতা শরবতের ট্রে হাতে রাখা অবস্থায় উল্টো ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্রুততার স্বরে বললো….

—“আমি কিছু দেখি নি…কিছু দেখি নি আমি!”

ললিতার কন্ঠ শোনা মাত্র কুশল আর তরুর ধ্যন ভা*ঙে। কুশল দ্রুততার সাথে তরুর উপর থেকে সরে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে পরে। তরু বেশ লজ্জা পেয়ে যায়। কুশলের দিকে তাকাতেই কুশলের চুপসে যাওয়া মুখশ্রী দেখে তরু শব্দ করে হেসে উঠে। তরুর হাসি শুনে কুশল তরুর দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো….

—“তোমাকে তো আমি পরে দেখে নিবো। আমার মু*ডে*র দফা-রফা অবস্থা দেখে খুব হাসি পাচ্ছে তাই না! হাসি বের করবো।”

এই বলে কুশল দ্রুত কদমে ওয়াশরুমের ভিতরে চলে যায়। তরু কোনো ভাবেই নিজের হাসি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। শোয়াবস্থা থেকে উঠে হাসতে হাসতে বললো….

—“ললিতা…ভিতরে আয়।”

ললিতা ভিতরে এসে কুশলকে দেখতে না পেয়ে বললো….
—“ভু*ল সময়ে এসে গিয়েছি বুবু! এরপর থাইকা দরজা আটকাইয়া রাইখেন।”

তরু নিজের হাসি থামিয়ে বললো….
—“মাথায় দিবো একটা গা*ট্টা। পুঁ*চ*কে মেয়ের পাঁকা পাঁকা কথা। ট্রে টা ওখানে রেখে যা।”

ললিতা শরবতের ট্রে টা বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে মিটমিটিয়ে হেসে বললো….
—“দুলাভাই লজ্জা পাইছেন তাই না বুবু!”

তরু হাসি দিয়া মাথা উপর নিচ নাড়ায়। ললিতা আর কিছু না বলে হাসি মুখে দ্রুত পায়ে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়।

#চলবে ইনশাআল্লাহ………….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৫)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৫০)
সিকদার ভিলায় ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলছিলো কুশল, সন্ধ্যা, তমালিকা, তরুনিমা। সেইসময় তরুনিমা শান্ত স্বরে বললো….

—“তোমরা গল্প করো আমি একটু পর তোমাদের সাথে আবারও জয়েন করছি।”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“কোথায় যাচ্ছো তুমি!”

—“উপরে!”

—“কিন্তু….!”

এই বলে তরু কুশলকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে দ্রুত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। তমালিকা একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন….

—“যেতে দাও ওকে জামাই বাবা। অরুর কথা মনে পড়ে গিয়েছে হয়তো ওর। তাই উপরে ওর রুমেই গেলো হয়তো। মেয়েটা আমাদের মাঝে আর না থাকলেও এই বাড়ির প্রতিটি কোণায় কোণায় ওর স্মৃতি মিশে আছে। তরু-অরুর খুনসুটির স্মৃতিগুলো চোখ বন্ধ করলে আজও চোখের সামনে ভেসে উঠে।”

সন্ধ্যা তমালিকা একহাত জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বললো….
—“আন্টি..জানি অরু আপুর শূন্যতা কেও কখনও পূরণ করতে পারবে না। কিন্তু আমি তো তোমাদের একজন মেয়ে বলো! আমাকে না হয় অরু আপু ভেবে নিও তোমরা।”

তমালিকা ঠোটে স্মিত হাসির রেখা ফুটিয়ে অন্য হাত দিয়ে সন্ধ্যার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। কুশন শান্ত স্বরে বললো….

—“আমার পক্ষে এখানে বসে তরুনিমার ফেরার অপেক্ষা করা সম্ভব না মা। আমি যাচ্ছি ওর কাছে। জীবন সঙ্গী হয়েছি যখন তখন জীবন সঙ্গীনীর সুখ-দুঃখ, ভালো-খারাপ সব রকম পরিস্থিতিতেই তার পাশে থাকতে হবে।”

এই বলে কুশল সোফা ছেড়ে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে যায়। কুশলকে উপরে যেতে দেখে তমালিকা একহাতে চোখের কোণায় জমে থাকা পানিটুকু মুছে ফেললেন।

(১৫১)
তাহিরের বাবা-মা রেবেকা তালুকদার ও তমিজ তালুকদার তাদের নিজ রুমে বিছানায় বসে আছেন। সেইসময় তাহির আর হুমায়রা একত্রে তাদের রুমে প্রবেশ করে। তাহির শান্ত স্বরে বললো…

—“মা-বাবা তোমাদের সাথে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আমার কথা বলার আছে।”

রেবেকা হাসিমুখে বললেন….
—“এখানে এসে আগে বোস তোরা। তারপর যা বলার বলিস!”

তাহির আর হুমায়রা বিছানায় গিয়ে বসে। রেবেকা আর তমিজ তাহিরের উপর শান্ত দৃষ্টি স্থির করে রেখেছেন। তাহির শান্ত স্বরে বললো…
—“তরুনিমা সিকদারের কথা মনে আছে তোমাদের মা-বাবা!”

তাহিরের মুখে তরুর নাম শুনে রেবেকার হাসি মাখা মুখ মূহূর্তের মধ্যেই গম্ভীর হয়ে গেলো। তিনি তমিজের দিকে একপলক দেখে গম্ভীর স্বরে বললেন…

—“হঠাৎ ঐ মেয়ের কথা উঠালি কেনো তুই!”

—“মা-বাবা…শান্ত মস্তিষ্কে আগে আমার সম্পূর্ণ কথাগুলো শুনতে হবে তোমাদের।”

—“ঐ মেয়ের কথা মনে করিয়ে দিয়ে আবার বলছিস শান্তও থাকতে!”

—“মা.. তরুনিমা আর ওর পরিবারের উপর অনেক রাগ তোমাদের মনে জমে আছে আমি সেটা মানছি। কিন্তু এই বিষয়ে ওদেরও কোনো দো*ষ নেই। ৫ বছর আগে পরিস্থিতি আমাদের এমন একটা মোড়ে দাঁড় করিয়েছিলো যে ওদের জায়গা থেকে ওদের মনে হয়েছিলো ওরা সঠিক। যা হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। আমি আমার জীবন থেকে যে ৫টা বছর হারিয়ে ফেলেছি এখন রেশা-রেশি করলেই কি আমার জীবনে ঐ ৫টা বছর আর ফিরে আসবে? আসবে না তো! তাহলে এখন এসব ভেবে মাথা গরম করো না।”

—“কিন্তু…!”

হুমায়রা শান্ত স্বরে বললো….
—“খালামনি…তাহির তো ঠিকই বলেছে। যা হওয়ার তা হয়েই গিয়েছে। এখন আমাদের উচিত এসব নিয়ে যতো রাগ , ঘৃ*ণা আমাদের মনে জমে আছে সেগুলো মন থেকে পুরোপুরি ভাবে বের করে দেওয়া।”

রেবেকা আর কোনো প্রতিত্তুর করলেন না। তাহির বললো….
—“চৌধুরী গ্রুপ অফ কোম্পানির নাম তো শুনেছো তোমরা। ২০ বছর আগে সেই কোম্পানির CEO ছিলেন মি.রায়হানুল চৌধুরী।”

তমিজ কিছুটা ভাবুক স্বরে বললেন….
—“হুম..হুম..চিনি তো ওনাকে। সেইসময় ওনার কোম্পানির সাথে আমাদের কোম্পানির একটা প্রোজেক্টের বিষয়ে চুক্তি হয়েছিলো। সেই স্বার্থেই ওনার সাথে পরিচয় হয়েছিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, আমাদের কোম্পানির সাথে চুক্তি করার কয়েকদিনের মাথায় ওনার গাড়ি এ*ক্সি*ডেন্ট হয়েছিলো। আর সেই এ*ক্সি*ডে*ন্টের কারণে তিনি মাথায় গু*রু*তর আ*ঘা*ত পেয়েছিলেন। আর কো*মা*য় চলে গিয়েছিলেন। এরপর চৌধুরী গ্রুপ অফ কোম্পানির সাথে আমি চুক্তিটা ভে*ঙে দিয়েছিলাম। পরে ওনাদের অবস্থা যে কেমন হয়েছে আর কে যে কোম্পানির দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেসব নিয়ে আর খোঁজ নেওয়া হয় নি।”

তাহির বললো….
—“রায়হানুল চৌধুরী কোনো গাড়ি এ*ক্সি*ডে*ন্টের কারণে মাথায় গু*রু*তর আ*ঘা*ত পেয়ে কো*মায় যান নি বাবা। উনি আর ওনার স্ত্রী খুব বড় ষ*ড়*য*ন্ত্রে*র শিকার হয়েছিলেন।”

তমিজ অবাক স্বরে বললেন….
—“মানে!”

অতঃপর তাহির ২০ বছর আগে রায়হানুল ও তার স্ত্রীর সাথে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা খুলে বললো। সম্পূর্ণ ঘটনা শুনে হুমায়রা আর রেবেকা দু’জনের চোখ বেয়েই অঝোর ধারায় নোনাজল গড়ে পড়ছে। তমিজ পুরোপুরি ভাবে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন। পুরো পরিবেশে পিন-প*ত*ন নিরবতা বিরাজ করে। তাহির দেওয়াল ভে*ঙে আবারও বললো….

—“তরুনিমার সাথে রায়হানুল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে রওনাক আজমাইন কুশলের বিয়ে হয়েছে কয়েকমাস হলো। কুশলের মায়ের খুনি আর ওর বাবাকে কো*মা*য়
রাখার পিছনে যে ৪জন দায়ী! ওর মেজো ও ছোট চাচা-চাচীরা তাদের মধ্যে ২জন ওর মেজো চাচা-চাচী কুশল ও ওর বোন সন্ধ্যাকে নিজেদের সন্তান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আসছেন ৮বছর বয়সে যখন কুশল কো*মা থেকে ফিরে আসে তখন থেকে। কিন্তু এই কাজ করার পিছনেও তাদের একটা লক্ষ্য আছে। কুশলের বয়স যখন ৩০ বছর পূর্ণ হবে তখন ও চৌধুরী পরিবার থেকে বড় অংশের সম্পত্তি মালিকানা লাভ করবে। সেই সম্পত্তিটুকুও নিজেদের নামে করে নিতে ওরা কুশল আর সন্ধ্যার বড় ধরনের ক্ষ*তি করতে দু’বার ভাববে না।”

হুমায়রা বললো….
—“ঐ অ*মানুষ গুলোকে তাদের আর কোনো ষ*ড়*য*ন্ত্রে সফল হতে দেওয়া যাবে না তাহির। এক এক করে ওদের সব কয়টাকে কঠিন থেকে কঠিনতম শা*স্তি দিতে হবে।”

—“হুম…কুশল আজ সকালে আমায় কল করে এই সবকিছু বলেছিলো। আর আমার থেকে একটা সাহায্যও চেয়েছে সে। আর আমি ওকে বলে দিয়েছি যে আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে ওর প্রতিটি পদক্ষেপে সহযোগিতা করবো।”

রেবেকা একহাতে নিজের চোখের পানি মুছে একটু কঠিন স্বরে বললেন…
—“না…এসবের কোনো দরকার নেই। ঐ অ*মানুষ গুলো ভিষণ নি*র্দ*য় আর সাং*ঘা*তি*ক। নিজেদের স্বা*র্থে সামান্য তম আ*ঘা*ত লাগলে ওরা আরো ভ*য়ং*কর হয়ে উঠবে। আর কোনো ভাবে ওরা যদি জানতে পারে তুই এসবের মাঝে জড়িত আছিস তখন ওরা তোরও অনেক বড় ক্ষ*তি করে দিবে। আমি আমার ছেলেকে এতো বড় ঝুঁ*কি*র মাঝে কিছুতেই যেতে দিবো না। কুশলের মা-বাবার সাথে ভিষণ অ*ন্যায় করা হয়েছে আমি মানছি আর এর জন্য আমার মনেও যথেষ্ট খা*রাপ লাগা কাজ করছে তবুও তোর এসবের মাঝে যাওয়ার কোনো দরকার নেই বাবা।”

তাহির শান্ত স্বরে বললো…
—“মা…আজ যদি কুশলের জায়গায় আমি থাকতাম! তখনও কি তুমি এই কথা বলতে পারতে!”

তাহিরের এরূপ কথা শুনে রেবেকা কয়েক সেকেন্ড এর জন্য থ*ম*কে গেলেন। তাহির আবারও বললো…

—“সৎ আর ভালো মানুষগুলোর বি*প*দের সময় তাদের পাশে দাঁড়ানোর তাদের সাহায্য করার শক্তি, সামর্থ্য থাকা স্বত্তেও তাদের পাশে না দাঁড়ালে আমাদের আর ঐ অ*মানুষগুলোর মাঝে পার্থক্য কি থাকবে বলো তো! ২দিন পর যখন জানতে পারবো আমাদের একটু সাহায্য না পাওয়ার কারণে ঐ অ*মানুষ গুলোর নি*র্ম*ম ষ*ড়*য*ন্ত্রে*র শিকার কুশল, নিলাদ্র, সন্ধ্যা আর তরুনিমাকে হতে হয়েছে তখন কি তোমার আমার মাঝে আ*ফ*সো*স কাজ করবে না! তখন আ*ফ*সো*স করেই বা কি হবে বলো! অ*ন্যায়*কারী ও অ*ন্যায় সহন*কারী দু’জনের আল্লাহর কাছে সমান অ*প*রাধী মা।”

রেবেকা তাহিরের হাত ধরে বললেন…..
—“তোকে বাঁ*ধা দেওয়ার বা না করার কোনো মুখ আমার নেই। শুধু এতোটুকুই বলবো এসবের মাঝে তোর কিছু হয়ে গেলে সেই য*ন্ত্র*ণা আমি সহ্য করতে পারবো না বাবা।”

তাহির ওর মাকে শান্ত করতে বললো….
—“আমার কিচ্ছু হবে না মা। তুমি নিশ্চিন্ত থেকো, আর আমাদের জন্য দোয়া করো। সকল পা*পী আর অ*মানু গুলোকে যেনো এই দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরের জন্য মুছে ফেলতে পারি আমরা।”

—“ইনশাআল্লাহ তোরা সফল হবি বাবা। আল্লাহ সবসময় তোদের তার হেফাজতে রাখুক।”

রেবেকার এরূপ কথাটুকু শুনে ওরা তিনজন একসাথে ‘আমিন’ শব্দ উচ্চারণ করে। তাহির বললো….

—“কিন্তু মা-বাবা…তোমাদেরকেও ছোট্ট একটা কাজের দায়িত্ব নিখুঁত ভাবে পালন করতে হবে যে!”

তমিজ বললেন…..
—“কি কাজ!”

—“নিলাদ্রের কথা বললাম না! কুশল ওর বাড়ির লোকদের সামনে নিলাদ্রকে আমার আপন ছোট ভাই হিসেবে পরিচয় দিয়েছে।”

—“মানে!”

—“নিলাদ্র ঐ অ*মানুষ গুলোর সম্পর্কে সবকিছু জানতে পারায় ওরা ওকে মে*রে ফেলার চেষ্টা করেছিলো। আল্লাহর রহমতে কুশল-তরুনিমা নিলাদ্রকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো। কিন্তু নিলাদ্রের জীবনের ঝুঁ*কি আছে বুঝতে পেরে কুশল নিলাদ্রের মতো অন্য একজনের মৃ*ত দেহ জোগার করে তাদের সামনে নিয়ে গিয়েছিলো আর তাদের বিশ্বাস করিয়েছিলো যে নিলাদ্র মা*রা গিয়েছে। এ*ক্সি*ডে*ন্টে নিলাদ্র ওর মুখে বা*জে ভাবে আ*ঘা*ত পেয়েছিলো তাই ওর প্লাস্টিক সা*র্জা*রি করতে হয়েছে। এখন নিলাদ্র সম্পূর্ণ আলাদা চেহেরা পেয়েছে। সন্ধ্যা আর নিলাদ্র একে-অপরকে ভালোবাসে। ঐ অমানুষগুলোকে শা*স্তি দিতে নিলাদ্র অনেক বড় ভূমিকা পালন করবে। তাই সন্ধ্যার সাথে নিলাদ্রের বিবাহকার্য সম্পন্ন করা অতিব জরুরী হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেহেতু ঐ অ*মানুষ গুলো ও দুনিয়ার সামনে নিলাদ্র মৃ*ত তাই ওদের সামনে যাওয়ার জন্য নতুন চেহারার অধিকারী নিলাদ্রের নতুন পরিচয়, নতুন পরিবারের প্রয়োজন। কুশল নিলাদ্রের নতুন নাম দিয়েছে সৌহার্দ্য তালুকদার। ২-৩ দিনের মধ্যে সন্ধ্যার সাথে সৌহার্দ্যের বিয়ের দিন তারিখ চূড়ান্ত করতে তোমাদের ওর বাবা-মা, আমাকে আর হুমায়রাকে ওর বড়ভাই-ভাবী সেজে ওর সাথে চৌধুরী মেনশনে যেতে হবে।”

নিজেকে তাহিরের ন*ক*ল বউ সেজে চৌধুরী মেনশনে যেতে হবে শুনে হুমায়রার হিঁ*চ*কি উঠে যায়। তাহির বেডসাইড টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে হুমায়রাকে দেয়। হুমায়রা এক নিঃশ্বাস সবটুকু পানি পান করে। রেবেকা বিষয়টা নিয়ে কিছুসময় ভাবার পর শান্ত স্বরে বললেন…

—“হুম সবই তো বুঝলাম। কিন্তু চৌধুরী পরিবারের মেয়ের বিয়ে বলে কথা। সমাজের নামি-গুণি আরো ১০ জন মানুষও সেখানে উপস্থিত হবেন। তাদের মধ্যে কেওই যে তোর বাবাকে চিনবেন না এমন তো না! ব্যবসায়িক সূত্রে তোর বাবা তো কম মানুষজনদের উঠাবসা করেন নি তাই না! তখন কেউ যদি এটা জিঙ্গাসা করে যে আমাদের ছোট ছেলে আবার আসলো কোথায় থেকে ওকে তো এর আগে কেও দেখে নি, আবার তুই-ই বা কবে বিয়ে করে নিলি! কাওকে কেনো জানালাম না? তখন আমরা কি উত্তর দিবো!”

তাহির ভাবুক স্বরে বললো……
—“বলবে…সৌহার্দ্য একটু অন্যরকম স্বভাবের ছিলো। লোকজন এর মাঝে আসা বা তাদের সাথে এতো খোলাখুলি ভাবে মেলামেশা করা ছোট থেকেই পছন্দ করতো না। তাই অনেক ছোটতেই ওকে আমেরিকাতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। সেখানে থেকেই বড় হয়েছে সে। ডাক্তারি পড়াশোনা কমপ্লিট করে কিছুদিন হলো দেশে ফিরেছে ব্যস।”

—“হুম..ঠিক আছে। কিন্তু আমার একটা ইচ্ছে আছে।”

—“কি ইচ্ছে বলো মা!”

রেবেকা একপলক তমিজ আর হুমায়রার দিকে তাকিয়ে বললেন….
—“সৌহার্দ্যকে নিজেদের ছোট ছেলে হিসেবে সকলের সামনে স্বীকৃতি দিতে আমার বা তোর বাবার কোনোরূপ আ*প*ত্তি নেই এ বিষয় তুই সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। কিন্তু আমরা চাই তুই আর হুমায়রা যে বিবাহিত এটা মি*থ্যে না হোক।”

তাহির অবাক স্বরে বললো…
—“মানে!”

—“মানেটা ভিষণ সহজ। দেখ বাবা…তুই, আমরা সকলেই জানি অনেক আগে থেকেই হুমায়রা তোকে পছন্দ করে নিজের জীবনসঙ্গী রূপে তোকে পেতে চায়। হুমায়রার বাবা-মায়ের ও হুমায়রার এই ইচ্ছে পূরণে সম্মতি আছে। আমি আর তোর বাবাও এটাই চাই যে তুই আর হুমায়রা এবার বিয়েটা করে নে। আমাদেরও তো যথেষ্ট বয়স হয়ে গিয়েছে, নাতি-নাতনীদের মুখে দাদু-দাদীমা ডাক শোনার অনেক ইচ্ছে হয়। তাই সন্ধ্যা আর সৌহার্দ্যের বিয়ের আগে পারিবারিক ভাবে হলেও তোর আর হুমায়রার বিবাহকার্য সম্পন্ন করতে চাই আমরা।”

নিজের মায়ের মুখে এরূপ ইচ্ছের কথা শুনে তাহির কি বলবে কি রিয়েক্ট করবে তা ভেবে পাচ্ছে না। হুমায়রা কিছুটা লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে নেয়। কিছুসময় পর তাহির একপলক হুমায়রার দিকে দেখে বললো….

—“ঠিক আছে…তোমাদের এই ইচ্ছে আমি পূরণ করবো। আগে সৌহার্দ্য আর সন্ধ্যার বিয়ের দিন তারিখ চূড়ান্ত করার কাজ সম্পণ্ন করতে হবে তারপর পারিবারিক ভাবে আমার আর হুমায়রার বিবাহকার্য সম্পন্ন হবে।”

তাহির যে এতো সহজে বিয়ের বিষয়ে সম্মতি জানাবে হুমায়রা তা কল্পনাও করতে পারে নি। অবাক দৃষ্টি নিয়ে তাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে সে। তমিজ আর রেবেকার চেহারায় একরাশ খুশির ছাপ স্পষ্ট হয়।

(১৫২)
সিঁড়ি বেয়ে উপরে অরুর রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কুশল লক্ষ্য করে তরুনিমা ওর বড় বোনের সকল জিনিস ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছে। কুশল নিরবতা বজায় রেখেই অরুর রুমের ভিতরে প্রবেশ করে। তরু কুশলের উপস্থিতি টের পেয়েও ওকে কিছু বলে না। কুশল অরুর বেডের একপার্শে রাখা একটা বই রাখার টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছুটা কৌতুহলের সাথে টেবিলের ড্রয়ার খুলে। সেখানে থেকে কুশল একটা ধুলো জমা ডায়েরি বের করে হাতে নেয়। তরু পিছন ঘুরতেই কুশলের হাতে অরুর ডায়েরি দেখে দ্রুততার স্বরে বললো…

—“খুলবেন না ওটা।”

আকস্মিক তরুর কন্ঠে নি*ষে*ধা*জ্ঞা বাক্যটি শুনে কুশল কিছুটা ভ*র*কে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওর হাত থেকে অরুর ডায়েরিটা মেঝেতে পড়ে যায়। কুশল ডায়েরিটা উঠাতে উঠাতে বললো….

—“সরি…সরি…আমি জানতাম না এটা খোলা নি*ষে*ধ।”

—“আপু কখনও আমাকে এই ডায়েরিটা খুলে পড়তে দেয় নি। এটাতে কি আছে জানতে অনেকবার ওকে অনেক প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু প্রতিবারই শুধু একটাই জবাব পেয়েছিলাম এটা তার পারসোনাল বিষয়। আর আমি যেনো ভুলেও এই ডায়েরিতে হাত না দেই। এরপর আমি আর কখনও এই ড্রয়ার খুলি নি। আপু মা*রা যাওয়ার পরেও না। ডায়েরিটা আগের জায়গাতেই রেখে দিন।”

কুশল ডায়েরিটা উঠিয়ে আগের স্থানে রাখতে নিলে ডায়েরির ভিতর থেকে একটা ৬-৭ ইন্ঞ্চি লম্বা ও চওড়া সাইজের ছবি মেঝেতে পড়ে যায়। ছবিটা উল্টো হয়ে পড়ায় কুশল বা তরু কেওই এটা বুঝতে পারছে না কিসের ছবি এটা! কুশল স্বাভাবিক ভাবেই মেঝের উপর থেকে ছবিটা উঠায়। ছবির উপরে ভিষণ ধুলো জমে থাকায় চেহারাগুলো বোঝা যাচ্ছে না। কুশল ডায়েরিটা টেবিলের উপর রেখে পকেট থেকে রুমাল বের করে ছবিটির উপর থেকে ধুলোগুলো পরিষ্কার করে। পরিষ্কার হওয়ার পর ছবিতে থাকা মানুষটিকে দেখে কুশল অতন্ত্য অবাক হয়ে যায়।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৬৬)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(১৫৩)
কুশল অবাক স্বরে বললো….
—“তরুনিমা….রাজবীরের ছবি তোমার বোনের ডায়েরির ভাঁজে কি করছে!”

কুশলের এরূপ কথা শুনে তরু বেশ অবাক হয়। ‘কোথায় দেখি’ শব্দ দু’খানা উচ্চারণ করে দ্রুত পায়ে কুশলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে ওর হাত থেকে ছবিটা নিয়ে নিজে দেখে। তরু কিছুসময় নিরব থাকার পর বললো…

—“এই কারণে আমার এমনটা মনে হয়েছিলো সেদিন।”

—“মানে!”

—“৫ বছর আগে বড়পু বেঁচে থাকাকালীন যখন আমি প্রথম তার এই ডায়েরিটা হাতে নিয়েছিলাম তখন ডায়েরির ভাঁজে আমি ওনার ছবিটা দেখেছিলাম। আপু আমার হাতে ওনার ছবি আর আপুর ডায়েরিটা দেখার পর আমার হাত থেকে জিনিস দু’টো ছিনিয়ে নিয়েছিলো আর অনেকটা রেগে গিয়েছিলো। এরপরই আমি আর আপুর ডায়েরিতে হাত দেই নি। সেদিন আপনার কাজিনকে যখন সামনা-সামনি তখন এই কারণেই আমার মনে হয়েছিলো যে আমি তাকে এর আগেও হয়তো কোথাও দেখেছি। কিন্তু মনে করতে পারছিলাম না তখন যে ওনাকে আমি কোথায় দেখেছি। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে আপুর সাথে ওনার সম্পর্ক কি ছিলো!”

—“আমাদের এই ডায়েরিটা খুলে দেখা উচিত। হয়তো এই ডায়েরি রাজবীরের ছবির পাশাপাশি আরো এমন কিছু আছে যা থেকে আমরা এটা জানতে পারবো যে তোমার আপুর সাথে রাজবীরের সম্পর্ক কি ছিলো!”

তরুনিমা কিছুটা সংকোচ বোধ নিয়ে বললো….
—“কিন্তু এটা করাটা কি ঠিক হবে!”

—“ধোয়াশা ক্লিয়ার করার জন্য আমাদের এই কাজটা করতেই হবে তরুনিমা।”

তরু একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো….
—“ঠিক আছে।”

কুশল তরুনিমার হাত ধরে অরুর বিছানায় গিয়ে পাশাপাশি বসে ডায়েরিটা খুলতেই প্রথম পৃষ্ঠায় দেখতে পায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘অরুর জীবনের কিছু স্মরণীয় মুহূর্ত’। পরবর্তী পৃষ্ঠায় যেতেই যা দেখতে পায় কুশল তা পড়তে শুরু করে….

—“২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর…….
আজকের এই দিনটি আমার জীবনে অনেক স্পেশাল। আজকের আমি আমার কর্মজীবনের ১ম মাসের স্যলারি হাতে পেয়েছি। অর্থের পরিমাণ কম হলেও আমি এই সামান্য অর্থ দিয়ে আমার মা-বাবা আর আমার ছোট্ট মিষ্টি বোনের জন্য টুকটাক কিছু কিনতে পেরেছি। মা-বাবা সারাজীবন ধরে আমাদের জন্য তাদের সবটা উজার করে দিয়েছেন। আজ তাদেরকে নিজের উপার্জিত অর্থ দিয়ে কিছু কিনে দিতে পেরে, তাদের মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে থাকতে দেখে আমার মনের ভিতরে কি যে শান্তি কাজ করছিলো তা বলে বোঝাতে পারবো না। তাই আজকের এই স্পেশাল মুহূর্ত টুকু নিয়ে আমার ডায়েরির পাতায় কয়েক লাইন লিখে রাখলাম।”

এরপর কুশল আরো কয়েকটা পেইজ পাল্টায়। আর প্রতিটি পেইজেই অরু নিজের জীবনে স্পেশাল মনে করেছে যে দিনের মূহূর্ত গুলো সেগুলো সাল ও তারিখ সহ লিখে রেখেছে। এভাবে আরো কয়েকটা পেইজ উল্টে পাল্টে পড়ার পর একটা পেইজে এসে কুশল থেকে যায়। সেখানে লেখা ছিলো……

—“২০১৭ সালের ১০ ডিসেম্বর……
জীবনে সাংবাদিকতার পেশা বেছে নেওয়া কোনো সহজ বিষয় না। সব পেশাতেই নিজের কাজের প্রতি সবার লয়াল থাকা উচিত। যেদিন আমি প্রথম এই পেশায় এসেছিলাম সেদিন আমি নিজের কাছে নিজেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলাম যে আমি আমার কাজের প্রতি সবরকম পরিস্থিতিতে লয়াল থাকবো। লয়াল থাকতে গিয়ে বেশিরভাগ সময়েই জীবনের মায়া ত্যগ করে সবরকম তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে আর সেই তথ্যগুলো সঠিক হাতে তুলেও দিতে হয়েছে। আমাদের চারপাশে ভালো-খারাপ-খুব ভালো-জ*ঘ*ন্য*তম খারাপ এমন চার শ্রেণির মানুষ বসবাস করে। এদের ভিতর কিছুজন এমন আছে যারা আমাদের সামনে খুব ভালো মানুষের মু*খো*শ পড়ে চলাফেরা করবে আর আড়ালে নি*কৃ*ষ্ট রূপ ধারণ করে বিভিন্ন পা*প কর্মে লিপ্ত হবে। আর আমরা যেনো তাদের কোনোভাবেই সন্দেহ করতে না পারি সেদিকেও তারা পুরো সতর্ক থাকবে। এরপর একদিন জানতে পারলাম কয়েক মাস ধরে গ্রামের মেয়েরা হুট করে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে! পরবর্তীতে তাদের আর কোনো খোজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে আমার মনে বড় ধরনের সন্দেহ কাজ করে। আর আমি মনে মনে ঠিক করি এই জ*ঘ*ন্য কাজের পিছনে যে বা যারা দায়ী তাদের মুখোশ আমি সমাজের সকলের সামনে খুলে ফেলবো। এরপর আমি একটা পরিকল্পনা করি। গোপনীয়তা বজায় রেখে নিজের জীবনের ঝুঁ*কি নিয়ে সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী আমি কাজ করে মেয়েদের উধাও হয়ে যাওয়ার বিষয়ে সম্পূর্ণ তথ্য গুলো সংগ্রহ করতে সক্ষম হই। প্রমাণ হিসেবে আমার কাছে একটা ভিডিও ক্লিপ ছিলো যেখানে আমি রেকর্ড করেছিলাম শহর থেকে অনেকদূরে একটা গহীন জঙ্গলের ভিতর পোড়া বাড়িতে কিছু অসহায় মেয়েকে হাত-পা, মুখ বেঁধে ফেলে রাখা হয়েছে। সেইসময় চৌধুরী গ্রুপ অফ কোম্পানির বর্তমান CEO মি.সায়মন চৌধুরীর ছোট ভাই রিজভী চৌধুরীর একমাত্র ছেলে রাজবীর চৌধুরী তার কিছু সহচরদের সাথে নিয়ে সেখানে এসে সেই অসহায় মেয়েগুলোর উপর নির্মম ভাবে অ*ত্যা*চা*র করে। এমন দৃশ্য দেখে আমি অনেক বেশিই অবাক হয়েছিলাম। কারণ এই চৌধুরী পরিবারের সাথে পারিবারিক আর ব্যবসায়িক দিক থেকে আমাদের মাঝের বন্ডিংটা যথেষ্ট ভালো ছিলো। বিগত বছর গুলো ধরে আমি আর আমার পরিবার এমন নি*কৃ*ষ্ট মানুষের সাথে উঠাবসা করে এসেছি ভাবতেই আমার সর্বশরীর রাগে-ঘৃ*ণা*য় রি রি করে উঠেছিলো। সেদিন আমি ভিডিও ফুটেজটি নিয়ে সাবধানতার সাথে বাড়ি ফিরে আসি। এরপর খুব ভালো ভাবে খোঁজ-খবর নেওয়ার পর জানতে পারি যে রাজবীর চৌধুরী লোক লাগিয়ে বিভিন্ন অজ পাড়া-গাঁ থেকে গরীব, অসহায় মেয়েদের ভালো কাজ দেওয়ার লো*ভ দেখিয়ে শহরে আনতেন আর তাদের এভাবেই গু*ম করে দিতেন। আর এতোবড় পা*প কাজের পিছনে যে তিনি দায়ী তা সম্পর্কে কেও যেনো কখনও বিন্দুমাত্র সন্দেহ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও করে রাখতেন। আজ সকালে আমি সেই ভিডিও ফুটেজটি আর সংগ্রহ করা বাকি তথ্যগুলো নিয়ে অফিসে গিয়ে আমার বসের সাথে পারসোনালি কথা বলি। বস মনোযোগ সহকারে আমার সব কথাগুলো শোনার ও ভিডিও ফুটেজটি দেখার পর আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন আমি যেনো এই বিষয় নিয়ে আর ঘাটাঘাটি না করি। রাজবীর চৌধুরী অনেক বড় মাপের মানুষ। বড় বড় মন্ত্রী, পুলিশ অফিসারদের তিনি কিনে নিয়েছেন। আর অত্যন্ত নিপুনতার সাথে বহু বছর ধরে তিনি এই কাজটি করে আসছেন। এর আগেও নাকি আরো একজন পুরুষ সাংবাদিক রাজবীর চৌধুরী এই কাজের সম্পর্কে নানান প্রমাণ সংগ্রহ করেছিলো কিন্তু ২-৩ দিনের মাথায় গলির নর্দমায় তার গলা কা / টা লা*শ পাওয়া গিয়েছে। সেই সাংবাদিক তো নিজের জীবন হারিয়েছেই তার পাশাপাশি যে কাজের জন্য তার পরিণতি ওমন হয়েছিলো সেই কাজের সব প্রমাণ খুব যত্নসহকারে রাজবীর চৌধুরী মুছে ফেলেছিলেন। আমি যে তার কাজের এতো বড় প্রমাণ সংগ্রহ করেছি আর এই প্রমাণ যদি আমার চ্যনেল থেকে প্রচার করা হয় তবে তিনি আমাদের সকলকেই পুরোপুরি ভাবে নিশ্চিহ্ন করে দিবেন। আমি বসকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম যে এখন যদি আমরা রাজবীর চৌধুরীর এই পা*প কাজকে দ*মি*য়ে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহন না করি তাহলে আগামী বছর গুলোতে যে আমাদের ঘরের মা-বোনেরা তার শি*কা*র হবেন না তারই বা কি নিশ্চয়তা আছে! কিন্তু বস আমার কোনো কথা শুনেন নি। আমি রাগের বশে তাকে বলে দেই আপনারা এই অন্যায় মুখ বু*জে সহ্য করলেও আমি করবো না। তখন বস আমায় বললেন আমি যেনো তার কাছে রিজাইন লেটার জমা দিয়ে তারপর যা করার করি। আমিও তাই রিজাইন লেটার জমা দিয়ে আজ বাসায় চলে এসেছি। ২দিন পর আমার ছোট বোন তরুনিমা এঙ্গিয়েজমেন্টের অনুষ্ঠান আছে। অনুষ্ঠানের দিন রাজবীর চৌধুরী সহ শহরের নামি-গুণি শতশত মানুষ উপস্থিত হবেন। আর সেদিন সবার সামনে আমি এই ভিডিও ফুটেজটি বড় পর্দায় প্লে করবো। তখন রাজবীর চৌধুরীর আর করার মতো কিছুই থাকবে না।”

কুশল এরপরের পৃষ্ঠাগুলো উল্টে-পাল্টে দেখে আর কিছুই লেখা নেই সেই পৃষ্ঠাগুলো সম্পূর্ণ সাদা। তরু স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। কুশল বললো….

—“এর মানে তোমার বোনের মৃ*ত্যু*র জন্য দায়ী আর কেও না রাজবীর নিজেই। আর এই কারণেই ৫বছর আগে রাজবীর কাওকে কিছু না জানিয়ে হুট করেই আমেরিকাতে চলে গিয়েছিলো। আর ৫বছর ধরে সেখানেই থেকেছে সে।”

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….