হৃদকোঠোরে রেখেছি তোমায় পর্ব-৭৭

0
594

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭৭)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(২০৬)
কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“তরুনিমা, সন্ধ্যা তোমাদের দু’জনকে একটা বিষয় জানানো উচিত বলে আমি মনে করছি।”

তরুনিমা আর সন্ধ্যা দু’জনেই কুশলের দিকে প্রশ্নসূচক দৃষ্টি স্থির করে। নিলাদ্র চেয়ারের সাথে অর্ধশরীর এলিয়ে দিয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। পরক্ষণেই কুশল বললো….

—“বাবা কো*মা থেকে ব্যক করেছেন ১মাস পূর্বেই।”

কুশলের মুখে এরূপ কথা শুনে তরুনিমা আর সন্ধ্যা অনেক বেশিই অবাক হয়ে যায়। সন্ধ্যার চোখ জোড়া মুহূর্তের মধ্যেই নোনাজলে টইটম্বুর হয়ে উঠে। সন্ধ্যা নিলাদ্রের দিকে তাকাতেই নিলাদ্র হাসিমুখে মাথা উপর নিচ নাড়ায়। তরুনিমা বললো….

—“আপনি সত্যি বলছেন কুশল! বাবা সত্যিই কো*মা থেকে ব্যক করেছেন!”

—“হুম তরুনিমা।”

—“কিন্তু আপনি এতো বড় খুশির খবরটা আমাদের জানাতে এতো দেড়ি কেনো করলেন বলুন তো!”

কুশল স্মিত হাসি দিয়ে বললো….
—“সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম মাত্র।”

সন্ধ্যা ওর দু’গাল ছুঁয়ে কয়েক ফোঁটা নোনাজলে ফেলে বললো….
—“আমি বাবার কাছে যেতে চাই মেজো ভাইয়া। তার কন্ঠে ‘মা’ ডাক শুনতে চাই।”

—“এখনও সেই সময় আসে নি বোন আমার। ধৈর্য ধর। শ*ত্রু*দের মাঝেই বাবা আছেন তাই ওদের সকলের প*ত*ন না ঘটানো পর্যন্ত বাবার সাথে দেখা করা যাবে না। কারণ আমাদের একটা ভু*ল পদক্ষেপের কারণে বাবার জীবন ঝুঁ*কি*র মাঝে পড়ে যাবে।”

সন্ধ্যা নিরবে অশ্রু ঝরাতে শুরু করে। তরুনিমা একহাতে সন্ধ্যাকে জড়িয়ে ধরে ওকে শান্ত করার চেষ্টা করে। কুশল আবারও বললো….

—“দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ প্রতিদিন বাবাকে এক প্রকার ক্ষ*তি*কর ঔষধ ইন*জে*ক্ট করে আসছিলো অ*মানুষ গুলো। বাবাকে বাড়িতে আনার পর প্রথম রাতেও সেই চেষ্টা করেছিলো ওরা। দূ*র্ভা*গ্য ব*শ*ত তখন তারা সফল হয়েছিলো। পরবর্তীতে বাবার চিকিৎসার জন্য নিলাদ্রকে ঠিক করার পর নিলাদ্রের স*ন্দে*হে*র কথা জানামাত্র আমি বাবার নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে তার রুমে আমি ও নিলাদ্র ব্যতিত ২য় কোনো ব্যক্তির প্রবেশ নি*ষে*ধ করে দিয়েছিলাম। এরপর অ*মানুষগুলোর সব চেষ্টা বৃ*থা হতে শুরু করেছিলো আর ওরাও হাল ছেড়ে দিয়েছিলো। সে সম্পর্কে আমরা সবাই অবগত। দীর্ঘদিন যাবৎ ঐ ক্ষ*তি*কর ঔষধ বাবার শরীরে ই*ন*জেক্ট না হওয়ায় বাবা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছিলেন। ১মাস পূর্বে বাবা পুরোপুরি ভাবে সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন। শুরুতে বাবা আমাকে চিনতে পারেন নি। পরে তাকে আমার পরিচয় দিলাম। বাবা আমাকে তার বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। সেইসময় পৃথিবীর ভিতর সবথেকে শান্তির স্থল মনে হয়েছিলো আমার বাবার বুক। অতঃপর বাবাকে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করলাম। সব শোনার পর বাবা ভিষণ ই আফসেট হয়েছিলেন। এরপর বাবাকে বুঝালাম। বাবা সেদিন থেকে মি*থ্যে কো*মা*য় থাকার নাটক করে যাচ্ছেন আমার কথানুযায়ী। ব্যস আর কিছুদিন তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।”

কুশলের কথাগুলো শুনে সন্ধ্যা কান্না থামিয়ে শান্ত হয়ে যায়। পরক্ষণেই তরুনিমা নিলাদ্রকে তার পরবর্তী কাজের কথা বলে দেয়। অতঃপর ওরা সকলেই ক্লিনিক থেকে বেরিয়ে আসে নিজ নিজ গন্তব্যে যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
.
.
.
দুইদিন পর বিকেল বেলা…..
চৌধুরী মেনশনে ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যরা। নিলাদ্র আর সন্ধ্যাও এসেছে দুপুরের একটু আগে। কামিনী এখন রুমের বাহিরে থাকা পুরো সময় ওড়না দিয়ে খুব ভালো ভাবে নিজের মাথা ঢেকে রাখে। সাবরিনা আর সায়মন ও বিষয়টা নিয়ে আর বাড়তি ঘাটাঘাটি না করে নরমাল নিতে শুরু করেছে। সকলেই যখন গল্প, আড্ডা নিয়ে ব্য*স্ত ছিলো সেইসময় তরুনিমা চোখ দিয়ে সন্ধ্যাকে ইশারা করে। তরুনিমার ইশারা বুঝতে পেরে সন্ধ্যা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললো……

—“তোমরা সবাই গল্প করো আমি একটু রুমে যাবো। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস নিতে হবে। রয়ে গিয়েছে এখানেই। মেজো ভাবী তুমিও একটু চলো আমার সাথে হাতে হাতে সাহায্য করে দিবে।”

তরুনিমা হাসিমুখে বললো…
—“ঠিক আছে চলো।”

এই বলে তরুনিমাও সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর তরু আর সন্ধ্যা স্থান ত্য*গ করে। উপস্থিত বাকিরা বিষয়টাকে নরমালিই নেয়। সন্ধ্যা তরুর সাথে নিজের রুমে এসে বিছানার উপর থেকে নিজের হ্যন্ডব্যগটা নিয়ে তার ভিতর থেকে নিলাদ্রের দেওয়া দু’টো ক্ষ*তি*কর ঔষধীর কাঁচের ছোট বোতল বের করে। পাশাপাশি দু’টো হ্যন্ড গ্লোবস বের করে তরুনিমাকে দেয় হাতে পড়ার জন্য। তরুনিমা গ্লোবস দু’টি নিজের হাতে পড়ে নিয়ে ঔষধের বোতল দু’টো নেয়। সন্ধ্যা শান্ত স্বরে বললো…

—“মেজো ভাবী..সময় কিন্তু খুব কম। যা করার খুব দ্রুত করবে আর সাবধানে।”

—“হুম..তুমি দরজার সামনে এসে দাঁড়াও আমি দ্রুতই কাজ শেষ করবো।”

অতঃপর তরুকে নিয়ে নিজের রুম থেকে বেড়িয়ে কামিনীর রুমের সামনে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে যায় সন্ধ্যা। তরু দ্রুততার সাথে রুমের ভিতরে প্রবেশ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে সেখানে থাকা প্রতিটি জিনিস খুব ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এরপর নিজের হাতে থাকা ঔষধের বোতল দু’টোর মুখ খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে সেখানে রাখা বডি লোশন ও ফেস ক্রিমের ভিতর সেই ঔষধ দু’টোই একটু বেশি পরিমানে মিশিয়ে দিয়ে পূর্বের জায়গায় রেখে দেয়। এরপর ঔষধের বোতল দু’টো হাতে নিয়ে ওয়াশরুমের ভিতরে প্রবেশ করে সেখানে থাকা কামিনীর বডিওয়াশ ও ফেসওয়াশের ভিতরেও মিশিয়ে দিয়ে তা পূর্বের জায়গায় রেখে দিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে। দরজার বাহিরে এখনও সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে আছে। তরুনিমা সন্ধ্যার পাশে এসে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে বললো….

—“কাজ শেষ হয়েছে, চলো এখন।”

অতঃপর ওরা দু’জন স্থান ত্যগ করে।
.
.
.
রাতের বেলা….
নিজরুমে বিছানায় বসে ফোন দেখছে রিজভী। সেইসময় কামিনী ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখা টুলে বসে চিরুনি নিয়ে চুল চিরুনি করতে ধরেও থেমে গিয়ে ওভাবেই হাত খোঁপা করে নেয়। পরক্ষণেই নিজের সম্পূর্ণ মুখে, গলায় ক্রিম ও শরীরের বাকি অংশে লোশন মেখে নিয়ে আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে বিছানায় গিয়ে বসতে বসতে বললো….

—“চুল উঠার ভ*য়ে এখন আর চুল চিরুনি করতেই ইচ্ছে করে না জানো! সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেলো। কি হওয়ার কথা ছিলো আর কি দিন দেখতে হলো আমাদের।”

রিজভী ফোনটা বেডসাইড টেবিলের উপর রেখে বললো…
—“এসব ভেবে আফসেট হইও না কামিনী। সৌন্দর্য কি আর সারাজীবন একরকম থাকে বলো! বয়স তো কম হচ্ছে না আমাদের। ছেলেকে হারালাম, এখন আমরা দু’জনেই আমাদের একে-অপরের বেঁচে থাকার একমাত্র সম্বল।”

কামিনীও একবার দীর্ঘশ্বাস ফেললো মাত্র।

(২০৭)
ক্লিনিকে নিজ কেবিনে বিছানায় আধশোয়া হয়ে আছে হুমায়রা। শরীরের ক্ষ*ত গুলো এখন অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে। কে*টে যাওয়া স্থান গুলো থেকে বেশ কয়েকদিন আগেই সেলাই গুলো খুলে ফেলেছে ডাক্তার। ক্ষ*ত গুলো পূরণ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। বাসায় এই অবস্থায় নিয়ে গেলে তাহিরের বাবা-মা অত্যাধিক দু*শ্চি*ন্তা করবে ভেবে ক্লিনিকেই রয়ে গিয়েছে হুমায়রা, তাহির দু’জনেই। তাহির ওর বাবা-মাকে হুমায়রার সাথে ঘুরতে এসেছে এমন বাহানা শুনিয়েই বুঝিয়ে রেখেছে। কুশল, তরুনিমা মাঝেমাঝেই ওদের সাথে দেখা করতে ক্লিনিকে আসা-যাওয়া করেছে। তাহির আর হুমায়রা দু’জনেই কুশলদের বর্তমান আপডেট ও পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে অবগত রয়েছে। তাহিরকে খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে কেবিনের ভিতর প্রবেশ করতে দেখে হুমায়রা মুখ ভার করে বললো….

—“হাসপাতালের এসব সামন্য ঝাল-লবন যুক্ত পাতলা স্যুপ , ফল-মূল আর তিনবেলা ইয়া বড় বড় তিত করলার থেকেও জ*ঘ*ন্য তি*ক্ত ঔষধগুলো খেতে খেতে আমার রুচি পুরোপুরি ন*ষ্ট হয়ে গিয়েছে তাহির। আমি আর এসব খেতে পারবো না। আমি খালামনির হাতের রান্না করা ঝাল ঝাল মুরগী, মাছের ভুনা দিয়ে গরম ভাত খেতে চাই। হাতে থাকা এসব অ*খাদ্য তুমি ডা*স্ট*বিনে ফেলে দাও।”

তাহির খাবারের ট্রে টা হুমায়রার কোলের উপর রেখে বিছানার পাশে থাকা চেয়ারটি টেনে সেখানে বসে বললো…..

—“পুরোপুরি সুস্থ হয়ে না উঠা পর্যন্ত এসব অ*খাদ্য গুলোই তোকে খেতে হবে বুঝলি! নিজের ইচ্ছে মতো খাবার আরো ১মাস পর থেকে খেতে পারবি।”

হুমায়রা চোখ বড় বড় করে তাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“কি বললে তুমি! আরো এক মাস আমাকে এসব অ*খাদ্য খেতে হবে? তোমার কি মনে হয় আমি ততোদিন বেঁচে থাকবো!”

তাহির হুমায়রায় উপর রাগী দৃষ্টি স্থির করে ধ*ম*কের স্বরে বললো…
—“মা*র*বো টেনে এক থা*প্প*র! ফা*জি*ল মেয়ে কোথাকার! ম*রা*র কথা বলিস কোন সাহসে হ্যা?”

হুমায়রা ঠোঁট উল্টে বললো…
—“মা*রো মা*রো…অবলা, নিরীহ মেয়েটাকে একলা পেয়ে নিজের ইচ্ছে মতো অ*ত্যা*চা*র-নি*র্যা*ত*ন করতেছো তো। একবার বাড়িতে ফিরতে দাও শুধু এই সবকিছুর হিসাব সু*দে-আসলে উশুল যদি না করেছি আমার নামও হুমায়রা তালুকদার নয় হুম।”

তাহির দাঁতে দাঁত পি*ষে বললো….
—“১০ মিনিটের ভিতর যদি এখানে থাকা সব খাবার খাওয়া শেষ না হয় তাহলে তোর কি ক*রু*ণ অবস্থা আমি করবো তা তুই কল্পনাও করতে পারবি না।”

তাহিরের এরূপ কথা শুনে হুমায়রা ওর নিঃশ্বাস বন্ধ করে করে ট্রের উপর বাটিতে রাখা স্যুপ গুলো খাওয়া শেষ করে। এরপর তাহির হুমায়রাকে ওর রাতের ঔষধ গুলো বের করে ওর হাতে দেয়। হুমায়রা ছলছল নয়নে একবার তাহিরের দিকে তাকায় তো আরেকবার হাতে থাকা বিশাল আকারের ঔষধ গুলোর দিকে তাকায়। তাহিরের চোখ রা*ঙা*নি*কে হজম করতে না পেরে হুমায়রা এক নিঃশ্বাসে সবগুলো ঔষধ পানির সাহায্যে গিলে ফেলে শব্দ করে ঢেঁকুর তুলে। হুমায়রার এমন কাজে তাহির ওর চেহারার ধরণ পানশেটের মতো করে বললো….

—“মেয়ে হয়েও এমন কাজ করিস কি করে তুই! ষ্যাহ, কি জ*ঘ*ন্য।”

হুমায়রা চোখ ছোট ছোট করে তাহিরের দিকে তাকিয়ে বললো….
—“কেনো? মেয়েদের কি শব্দ করে ঢেঁকুর তোলা বারণ! এটা কি খুব বড় কোনো অ*প*রা*ধ?”

তাহির হুমায়রার কোলের উপর থেকে খাবারের ট্রে টা নিয়ে টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো….

—“সব বিষয়ে এমন ত*র্ক করিস কেনো তুই?”

—“ত*র্ক! ত*র্ক কোথায় করলাম? তুমি যেভাবে আমার ঢেঁকুর তোলাকে জ*ঘ*ন্য বললে মনে হলো আমি কোনো দ*ন্ড*নী*য় অ*প*রা*ধ করে ফেলেছি আর এর জন্য আমাকে ফাঁ*সি*র থেকেও বড় কোনো সা*জা দেওয়া উচিত!”

হুমায়রার এরূপ কথা শুনে তাহির ওর ঠোঁটে হালকা বাঁ*কা হাসির রেখা ফুটিয়ে ওর দু’পাশে দু’হাত রেখে ওর দিকে অনেকটা ঝুঁ*কে যায়। হুমায়রা শুকনো ঢোক গি*লে বিছানার সাথে যতোটা সম্ভব নিজের পিঠ ঠেকিয়ে নেয়। তাহির হুমায়রার মুখের আরো অনেকটা কাছে নিজের মুখ এগিয়ে নিয়ে আসে। তাহিরের দৃষ্টি হুমায়রার দু’চোখের উপর স্থির। হুমায়রার দৃষ্টি এই মূহূর্তে ভিষণ চন্ঞ্চল হয়ে রয়েছে। তাহির ধীরস্বরে বললো…..

—“শা*স্তি*র কথা যখন বললিই তখন তোর এই ঢেঁকুর তোলার মতো জ*ঘ*ন্য কাজের জন্য তোকে শা*স্তি দিলে বিষয়টা ম*ন্দ হয় না।”

হুমায়রার নিঃশ্বাস ভাড়ি হয়ে এসেছে ইতিমধ্যেই। হুমায়রা ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে বললো…….

—“এ-এটা কো-কোনো জ*ঘ*ন্য কাজের ভিতর প-পরে না। তাই শা*স্তি পাওয়ারও কোনো প্রশ্নই উঠছে না। স-সরো আমার সা-সামনে থেকে৷”

তাহির বাঁকা হেসে বললো….
—“তুই এভাবে কাঁ*প*ছিস কেনো! তোর কন্ঠ, তোর ঠোঁট জোড়াও বা এভাবে কাঁ*প*ছে কেনো বলতো! আমার চোখের সাথে চোখ মিলিয়েও বা কথা বলতে পারছিস না কেনো তুই হুম!”

—“ত-তুমি আমার সা-সামনে থেকে সরো। তাহলেই আমি স্বা-স্বাভাবিক হয়ে যাবো।”

তাহির হুমায়রার এরূপ কথা শুনে ওর দিকে আরো কিছুটা ঝুঁ*কে যায়। হুমায়রা সঙ্গে সঙ্গে নিজের চোখ-মুখ খিঁ*চে বন্ধ করে ফেলে। কিয়ৎক্ষণ এভাবেই পেরিয়ে যায়। তাহিরের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে হুমায়রা চোখ মেলে তাকাতেই তাহির হুমায়রার ঠোঁটের ভাঁজে নিজের ঠোঁট মিলিয়ে দেয়। হুমায়রা একহাত দিয়ে বিছানার চাদর মুষ্টিবদ্ধ করে ধরে। এভাবেই পেরিয়ে যায় আরো বেশ কিছু সময়। তাহির হুমায়রার ঠোঁটের ভাঁজ থেকে ঠোঁট সরিয়ে ওর কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বললো…

—“অ*সুস্থ তুই তাই তোর প্রাপ্য শা*স্তি*টা আপাতত হিসাবের খাতায় লিখে রাখলাম। সময় মতো প্রয়োগ করবো।”

এই বলে তাহির হুমায়রার কাছ থেকে সরে কেবিনের একপার্শে থাকা সোফার উপর গিয়ে বসে। হুমায়রা নিচের দিকে দৃষ্টি স্থির করে লজ্জাজনক হাসি দেয় মাত্র।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭৭ পর্বের ২য় অংশ)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(২০৮)
দুইদিন পর দুপুরবেলা…
কামিনী ওর হাত-পা, গলা-মুখ শরীরের বিভিন্ন অংশ যথাসম্ভব চুলকানোর চেষ্টা করতে করতে গোসল করে ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে বি*র*ক্তি নিয়ে বললো….

—“উফহহহ…সকাল থেকেই সর্বশরীর কেমন চুলকাতে শুরু করেছে। এতো চুলকাচ্ছি কিন্তু আরাম পাওয়ার বদলে মনে হচ্ছে চুলকানীর মাত্রা আরো বেড়েই চলেছে। এর জন্য গোসল পর্যন্ত করলাম কিন্তু ফলাফল তো শূন্যই। কি যে হলো আমার।”

কামিনী কোনো ভাবেই চুলকানো বন্ধ রাখতে পারছে না।
.
.
.
বিকেলের পর পর…..
রিজভী ক্লান্ত মুখশ্রী নিয়ে গলার টাই-টা ঢিলে করতে করতে রুমে প্রবেশ করে বললো….

—“শরীর যেনো এখন আর সামান্য প্রেসার ও নিতে পারছে না। অল্পতেই দুনিয়ার সব ক্লান্তি শরীরে এসে জেঁকে বসে। এভাবে কি চ..!”

রিজভী পুরো কথা শেষ করার পূর্বেই নিজের সামনে কামিনীকে প্রায় উ*ন্মা*দে*র মতো নিজের সর্বশরীর চুলকাতে চুলকাতে নখের আঁ*চ*রে চামড়া ছিঁ*লে র*ক্ত বের করতে দেখে অত্যন্ত অবাক হয়ে তার দিকে ছুটে গিয়ে বাঁধা প্রয়োগ করতে করতে বললো….

—“কামিনী…কামিনী…কি করছো টা কি তুমি! এভাবে উ*ন্মা*দে*র মতো নিজের শরীর চুলকানো বন্ধ করো। কেমন নখের আঁ*চ*রে শরীরের বিভিন্ন অংশের চামড়া ছিঁ*লে র*ক্ত বের করেছো দেখেছো একটা বার! কামিনী..!”

রিজভীর কথাগুলো কামিনীর কান পর্যন্ত পৌঁছাচ্ছে না যেনো এই মূহূর্তে। রিজভী কোনো ভাবেই কামিনীকে থামাতে না পেরে দ্রুত নিলাদ্রকে কল করে। ওপাশ থেকে নিলাদ্র কল রিসিভ করতেই রিজভী অ*স্থির কন্ঠে বললো….

—“জামাই বাবা…তোমার চাচীর কি যেনো হয়েছে। সকালে যখন অফিসে গেলাম ওকে রেখে তখন স্বাভাবিক ই ছিলো। একটু আগেই বাসায় ফিরলাম দেখি ও কেমন উ*ন্মা*দের মতো নিজের শরীর চুলকাচ্ছে। চুলকাতে চুলকাতে একেবারে র*ক্তা-র*ক্তি অবস্থা করে ফেলেছে। তবুও থামছে না। আমি কিছুতেই ওকে থামাতে পারছি না।”

নিলাদ্র তালুকদার ভিলায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুমে বিছানায় বসে আছে সন্ধ্যার সাথে। ফোনে লাউডস্পিকার অন থাকায় রিজভীর বলা কথাগুলোও সন্ধ্যাও শুনতে পেরেছে। সন্ধ্যার ঠোঁটে হাসির রেখা ফুটে উঠে। নিলাদ্র তরুনিমার পূর্ব থেকে বলানুযায়ীই কাজ করতে শান্ত স্বরে বললো…

—“চাচা..আপনি শান্ত হোন। বাড়ির বাকি সদস্য থেকে লুকিয়ে রাখার মতো বিষয়টা আর নেই। আপনি এই মূহুর্তে রুমের বাহিরে যান। সার্ভেন্টদের ডাকুন। চাচীকে চেয়ারে বসিয়ে দড়ি দিয়ে শক্ত-পোক্ত ভাবে তাকে বেঁ*ধে রাখার ব্যবস্থা করুন। নয়তো এভাবে চাচী নিজের শরীর চুলকাতে থাকলে তার অনেক বড় কোনো ক্ষ*তি হয়ে যাবে। আমি খুব তাড়াতাড়িই আপনাদের ওখানে চলে আসবো।”

রিজভী নিলাদ্রের কথা মেনে নিয়ে কল রেখে দিয়ে দ্রুততার সাথে রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে সার্ভেন্টদের ডাকতে শুরু করে। রিজভীর এমন ডাকে সার্ভেন্টরা সহ চৌধুরী মেনশনে উপস্থিত বাকি সদস্যরাও নিজ নিজ রুম থেকে বেড়িয়ে ড্রয়িংরুমে এসে উপস্থিত হয়। রিজভী কয়েকজন মহিলা সার্ভেন্টকে নিজের রুমে আসতে বলে এই মূহূর্তে। সাবরিনা অবাক স্বরে প্রশ্ন করলেন….

—“কি হয়েছে রিজভী…হঠাৎ এভাবে শো*র-গো*ল করতে শুরু করেছো কেনো তুমি?”

সাবরিনার প্রশ্ন রিজভীর কান পর্যন্ত পৌঁছালেও তিনি তার কোনো প্রতিত্তুর না করে সার্ভেন্টদের নিয়ে নিজের রুমের দিকে দ্রুততার সাথে হেঁটে যেতে শুরু করেন। পরক্ষণেই সাবরিনা সহ উপস্থিত বাকি সদস্যরাও রিজভীদের রুমের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে। তরুনিমা যেতে যেতে ধীর স্বরে কুশলকে উদ্দেশ্য করে বললো….

—“শুরু হয়ে গিয়েছে শ*ত্রু পক্ষের উপর দাবায় আমাদের দেওয়া পরবর্তী চালের রিয়াকশন।”

কুশল তরু দু’জনের ঠোঁটেই হাসির রেখা স্পষ্ট ফুটে উঠে। সাবরিনা, সাগরিকা, অনন্যা রিজভী-কামিনীর রুমের ভিতরে এসে দাঁড়াতেই কামিনীর এমন ক*রু*ণ অবস্থা দেখে অত্যন্ত অবাক হয়ে মুখে হাত দেয়। সাবরিকা অ*স্থির কন্ঠে বললেন….

—“হায় আল্লাহ..এ কি দশা হয়েছে ছোট বউমার!”

রিজভী সার্ভেন্টদের সহযোগিতায় অত্যন্ত কষ্টে কামিনীকে চেয়ারের সাথে বেশ শক্ত-পোক্ত ভাবে বেঁ*ধে ফেলতে সফল হয়। বেঁধে ফেলার পরও কামিনী নিজেকে সেখান থেকে ছাড়ানোর জন্য ভিষণ ছ*ট-ফ*ট করতে শুরু করেছে। সার্ভেন্টরা রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। রিজভী ধ*প করে বিছানায় গিয়ে বসে পড়ে।

কুশল আর তরুনিমা রুমের এক পার্শে নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে কামিনী আর রিজভীকে পর্যবেক্ষণ করছে শুধু। সাগরিকা লাঠিতে ভর দিয়ে ধীর পায়ে রিজভীর পাশে বিছানায় গিয়ে বসে ওনার কাঁধে একহাত রেখে বললেন….

—“বউমার এমন অবস্থা হলো কি করে রিজভী বাবা! সকাল বেলা তো সুস্থ-স্বাভাবিকই ছিলো। হুট করে এমন আচারণ কেনো করছে?”

রিজভী হ*তা*শা ও মলিনতা মিশ্রিত কন্ঠে বললেন…

—“জানি না মা ওর কি হয়েছে। সকাল বেলা তো আমিও ওকে সুস্থ-স্বাভাবিক দেখেই অফিসে গিয়েছিলাম। অফিস থেকে এসেই দেখি এমন অবস্থা। জানি না কি হচ্ছে আমাদের পরিবারের সবার সাথে। একের পর এক সবার জীবনে স*ম*স্যার দেখা দিচ্ছে।”

সাবরিনা বললেন…
—“সত্যিই কি তুমি কিছু জানো না রিজভী? নাকি আমাদের থেকে সত্যটা লুকিয়ে যাচ্ছো? কয়েকদিন ধরেই কামিনীর আর তোমার অ*স্বাভাবিক আচারণ আমরা সবাই লক্ষ্য করছি। হুট করেই তো কারোর জীবনে কোনো স*ম*স্যার দেখা দেয় না। ছোট একটা বিষয় থেকেই স*ম*স্যার সূচনা হয়। আর ধীরে ধীরে তা বড় আকার ধারণ করে। হুট করে কামিনীর পর্দা করার চিন্তা যে আমাদের মনে স*ন্দে*হের সৃষ্টি করে নি এটাও অ*স্বীকার করবো না। যদি সত্যিই কিছু লুকিয়ে রাখো আমাদের থেকে তাহলে সে সম্পর্কে আমাদের অবগত করো।”

সাবরিনার কথাগুলো শুনে রিজভী আরো বেশি অ*শান্ত হয়ে পড়ে। কি করবে কি বলবে তা সে বুঝে উঠতে পারছে না। কামিনী অত্যন্ত নড়া-চড়া করার চেষ্টা করায় ওনার মাথায় থাকা ওড়না পুরোপুরি ভাবে সরে যায়। তখন সবাই-ই লক্ষ্য করে কামিনীর মাথার বেশিরভাগ জায়গা থেকেই চুল উঠে গিয়েছে। কামিনীর চেহারার এখন যা*চ্ছে-তাই অবস্থা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কুশল, তরুনিমা ব্যতিত উপস্থিত বাকিরা স্ত*ব্ধ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে কামিনীর দিকে। এখন বাকিদের বুঝতে আর বাকি থাকে না কামিনীর হুট করে পর্দা করতে চাওয়ার পিছনে আসল কারণ কি। রিজভী লজ্জায় মাথা নুইয়ে দু’হাতে নিজের মুখ ঢেকে রেখেছে।
.
.
.
বেশকিছু সময় পর…..
নিলাদ্র আর সন্ধ্যা চৌধুরী মেনশনে এসে সোজা কামিনীদের রুমে আসে। রুমে প্রবেশ করতেই সায়মন ব্যতিত চৌধুরী পরিবারের সব সদস্যকে সেখানে দেখতে পায় ওরা। সন্ধ্যা ধীর পায়ে তরুর পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। চেয়ারের সাথে বাঁধা অবস্থায় কামিনীর র*ক্তা*ক্ত নেতিয়ে পড়া অবস্থা দেখে ওর চেহারার ধরণ পরিবর্তন হয়ে যায়। কামিনীর সাথে শত বড় শ*ত্রু*তা থাকলেও তার ক*রু*ন অবস্থা মনুষ্যত্ব বোধে গিয়ে হা*না দিচ্ছে সন্ধ্যার। সন্ধ্যা শুধু একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিলাদ্র কামিনীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিরব হয়ে ওকে কিছুসময় পর্যবেক্ষণ করে। রিজভী অনেক ক*ষ্টে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বললো….

—“জামাই বাবা..! আমার স্ত্রীর কি দ*শা হয়েছে দেখো একটা বার। ওর এই ক*রু*ণ অবস্থা যে আমি কিছুতেই দেখতে পারছি না৷ সহ্য হচ্ছে না। চুল উঠে যাওয়ার বিষয়টা নরমালি নিতে শুরু করেছিলাম দু’জনেই কিন্তু হুট করে ওর কি হলো বুঝতে পারছি না। উ*ন্মা*দে*র মতো নিজের শরীর চুলকিয়ে র*ক্তা-র*ক্তি করে কি যাচ্ছে তাই অবস্থা বানিয়েছে দেখো একটা বার!”

নিলাদ্র পরক্ষণেই একবার কুশল-তরুনিমার দিকে তাকায়। তরুনিমার বলানুযায়ীই নিলাদ্র এখন পর্যন্ত প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়েছে নিয়ে যাচ্ছেও। নিলাদ্র শান্ত স্বরে বললো…

—“চাচা…চাচীর ঠিক কি স*ম*স্যা হয়েছে, কেনো তিনি এমন উ*ন্মা*দে*র মতো আচরণ করছে সে সম্পর্কে আমি এই মূহূর্তে কিছুই বলতে পারছি না। এই ধরণের স*ম*স্যা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো পেশেন্ট আমার কাছে আসেন নি। চাচীই প্রথম। তাই চাচীর স*ম*স্যা সম্পর্কে অবগত হতে আমার চাচীর ব্লাড ও ইউরিন এর টেস্ট করতে হবে। রিপোর্ট গুলো হাতে পাওয়ার পরই আমি চাচীর ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারবো। আপাতত চাচীকে ঘুমিয়ে রাখতে হবে আমাদের সারাক্ষণ। আর তাকে এই বাধন থেকেও মুক্ত করা যাবে বা। নয়তো তিনি আবারও নিজের শারীরিক ক্ষ*তি করে বসবেন। তাই আমি চাচীর শরীরে ঘুমের ঔষধ ইনজেক্ট করে দিচ্ছি। এরই রিয়েকশন আগামীকাল সকাল পর্যন্ত থাকবে। আপনি চাচীর ইউরিন টা মেনেজ করে আমায় দিবেন শুধু। আমি এক্ষুণি তার ব্লাড টাও নিচ্ছি। আর তিনি শরীরে নখ দিয়ে যে ক্ষ*ত গুলো করেছেন সেগুলোও পরিষ্কার করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি।”

রিজভী শুধু উপরনিচ মাথা নাড়িয়ে ‘আচ্ছা’ জবাব বুঝায়। সাবরিনা বললেন….

—“যা যা করা উচিত তুমি তাই তাই করো সৌহার্দ্য বাবা। শুধু ছোটকে সুস্থ করে দাও।”

নিলাদ্র ইন*জে*ক*শনের সিরিঞ্জে ঔষধ ভরতে ভরতে বললো….
—“সুস্থ করে দাওয়ার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহ তায়ালা আছেন। আমি তো উছিলা মাত্র।”

এই বলে নিলাদ্র একটা ফাঁকা সিরিঞ্জ হাতে নিয়ে কামিনীর হাত থেকে পরিমাণ মতো র*ক্ত নেয়। অতঃপর ওর শরীরে অন্য ইন*জে*ক*শনটি পুশ করে দেয়। হাতে-পায়ে, মুখে, গলায় যতোটা দেখা সম্ভব ততোটুকু জায়গার ক্ষ*ত স্থান গুলো সেভলন দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যন্ডেজ করে দেওয়ার কাজ সম্পন্ন করে নিলাদ্র বললো….

—“চাচা…চাচীর শরীরের ভিতরের অংশের ক্ষ*ত গুলো আপনি সাবধানে পরিষ্কার করে দিয়েন। আমি তো আমার সাথে কোনো নার্স আনি নি। তাই এই কাজ টুকু আপনি করুন। চিন্তা করবেন না। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন।”

এই বলে নিলাদ্র রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। পর পর বাকিরাও স্থান ত্যগ করে। সকলে বেড়িয়ে গেলে রিজভী বিছানা থেকে উঠে রুমের দরজা ভিতর থেকে আঁটকে দিয়ে কামিনীর সামনা-সামনি মোড়া নিয়ে বসে তার শরীরের ভিতরের অংশগুলোর ক্ষত গুলো সাবধানে পরিষ্কার করে দিতে দিতে দু’চোখ বেয়ে নিরবে অশ্রু ঝড়াতে শুরু করে। নিজের চোখের সামনে নিজের সবথেকে প্রিয় ও ভালোবাসার মানুষটির এমন ক*রু*ণ অবস্থা হতে দেখা ও তাকে য*ন্ত্র*ণা সহ্য করতে দেখার মধ্যে যে কলিজা ছিঁ*ড়ে আসার মতো য*ন্ত্র*ণা হয় তা রিজভী খুব ভালো ভাবেই উপলব্ধি করতে পারছে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…..

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭৭ পর্বের ৩য় অংশ)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(২০৯)
পরেরদিন সকাল বেলা…..
ড্রয়িংরুমে সোফায় বসে আছে চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্যরা। সাগরিকা আর রিজভী ব্যতিত উপস্থিত কারোর চেহারায় কামিনীর রিপোর্ট জানার জন্য অ*স্থিরতা কিংবা চি*ন্তা*র ছাপ ফুটে নেই। রিজভী একটু পর পর মূল দরজার দিকে তাকাচ্ছে নিলাদ্র কামিনীর রিপোর্ট নিয়ে আসছে কি না দেখতে। সেইসময় সায়মন নিজের হাতে থাকা ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত স্বরে বললেন….

—“আমার পক্ষে আর এখানে বসে বসে সময় ন*ষ্ট করা সম্ভব না। আজ মালেশিয়া থেকে বিশেষ কয়েকজন ক্লাইন্টের আসার কথা আছে। তাদের সাথে নতুন প্রজেক্ট নিয়ে মিটিং করতে হবে। আমি এখন অফিসে যাচ্ছি। তোমরা সবাই তো আছোই এখানে তাই এদিকটা তোমরাই হ্যন্ডেল করে নিতে পারবে। আর রিজভী তুই কামিনী সুস্থ হয়ে না উঠা পর্যন্ত বাসাতেই থাক ওর পাশাপাশি। ওর তোকে প্রয়োজন পড়বে। অফিসের সকল কাজ আমি একাই সামলে নিতে পারবো।”

এই বলে সায়মন মূল দরজা দিয়ে বাহিরে চলে যায়। রিজভী শান্ত দৃষ্টি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে রয়। তরুনিমা মনে মনে বললো…

—“এক ভাইয়ের দূর্বলতা দেখেও আরেক ভাই নিজের আখের গুছিয়ে নিতেই ব্যস্ত হয়ে আছে। এই নাকি এরা একই নাড়ি ও র*ক্তে*র সম্পর্কের ভাই। এদের কারোর ভিতরেই বিন্দুমাত্র মনুষ্যত্ব বোধ নেই।”

তরুনিমার চিন্তার ঘোর কাটে সন্ধ্যার কথায়….
—“ঐতো সৌহার্দ্য এসেছে।”

উপস্থিত সকলেই নিলাদ্রের দিকে তাকায়। নিলাদ্র ওর হাতে কালো রংয়ের একটা ব্যগ নিয়ে ড্রয়িং প্লেসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। নিলাদ্র সন্ধ্যার পাশে এসে বসে। ওর চেহারায় চি*ন্তা আর ভা*র ভা*র ভাব ফুটে থাকতে দেখে রিজভীর অ*স্থিরতা আগের থেকে কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রিজভী অ*স্থির কন্ঠে বললেন…

—“সৌহার্দ্য বাবা…রিপোর্টে খা*রা*প কিছু নেই তো বলো! তোমার চাচী আবার আগের মতো সুস্থ-স্বাভাবিক হয়ে যাবে তো?”

নিলাদ্র ওর হাতে থাকা ব্যগটির ভিতর থেকে একটা ফাইল বের করে রিজভীর দিকে এগিয়ে দেয়। রিজভী নিলাদ্রের হাত থেকে ফাইল টা নেয়। নিলাদ্র একবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো….

—“আমি আপনাকে বা বাড়ির কাওকেই মি*থ্যে কোনো আশ্বাস দিবো না চাচা। আপনি নিজেই চাচীর রিপোর্ট গুলো দেখে নিন। চাচীর শরীর থেকে সংরক্ষিত ব্লাড দিয়ে আমি কয়েক ধরণের টেস্ট করিয়েছিলাম। এছাড়াও ইউরিনের ও টেস্ট করিয়েছিলাম। এখানে সবগুলো রিপোর্ট ই রাখা আছে। রিপোর্ট গুলো হাতে পাওয়ার পর তা দেখে আমি পুরোপুরি ভাবে হ*তা*শ হয়ে পড়েছি। সবথেকে আশ্চার্যের বিষয় হলো চাচী একই সাথে কয়েক ধরণের গু*রু*তর রো*গে আ*ক্রা*ন্ত হয়ে গিয়েছেন। প্রথম রোগটির নাম ‘নিপাহ ভাইরাস’। এটি মূলত খেজুরের কাঁচা রস পান করেই ফলেই হয়ে থাকে। আর এই রোগের কারণে পেশেন্ট একধরণের মতিষ্কের প্রদাহ ও তীব্র জ্বরে আ*ক্রা*ন্ত হয়ে থাকে। এই রোগে আ*ক্রা*ন্ত হওয়ার পর বেশিরভাগ রোগীরই মৃ*ত্যু ঝুঁ*কি ৯৫% হয়ে থাকে। আর যদিও আল্লাহর রহমতে মৃ*ত্যু*র দুয়ার থেকে কোনো রোগী ফিরে আসে তবে সে হয়তো পুরোপুরি ভাবে নিজের স্মৃতি শক্তি হারিয়ে ফেলবে নয়তো চিরতরের জন্য প্য*রা*লা*ই*সড হয়ে যাবেন। দ্বিতীয় রোগটি হলো জল*ব*সন্ত বা চিকেন*প*ক্স। এটি একটি সং*ক্রা*ম*ক জাতীয় রোগ। ভেরিসেলা জোস্টার নামক একটি ভাইরাসের সংক্রমণ থেকেই এই রোগের সৃষ্টি হয়ে থাকে। আ*ক্রা*ন্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশি, ত্বকের সংস্পর্শ এমনকি তার ব্যবহৃত পোশাকের মাধ্যমেও সং*ক্র*মণ ছড়িয়ে থাকে। আ*ক্রা*ন্ত ব্যক্তির ত্বকে ফুঁ*স*কুড়ি দেখা দেওয়ার ২ দিন আগে থেকে শুকিয়ে যাওয়া ফুঁ*স*কুড়ির খোসা থেকেও অন্যরা সং*ক্র*মিত হতে পারে। ভাই*রা*সটি শরীরে প্রবেশের ১০-১২ দিনের মধ্যেই লক্ষণ প্রকাশ হয়ে থাকে। ত্বকে প্রথমে ঘা*মা*চির মতো গুটি উঠতে থাকে। যা পরবর্তীতে ফুঁ*স*কুড়িতে পরিণত হয়। ফুঁ*স*কুড়ি দেখা দেওয়ার ২-৩ দিন আগে থেকেই শরীরে প্রচন্ড ব্য*থা অনুভূত হয়। এছাড়াও জ্বর দেখা দেয়, পেট*ব্য*থা হতে পারে। লালচে ফুঁ*স*কুড়িতে চুল*কা*নি ও জ্বা*লা-পো*ড়ার অনুভূতি হয়। চাচীর শরীরে এখন এই দু’টো রোগই খুব বা*জে ভাবে জেঁ*কে বসেছে। এছাড়াও ‘অ্যলোপেশিয়ার’ স*ম*স্যা তো আছে। এই রোগ গুলো থেকে চাচীকে বাঁচিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা ১০০% এ ১% আছে হয়তো। যতো দিন যাবে চাচীর শরীরের ততোই অ*ব*নতি হয়ে শুরু করবে। আমি আমার সবটুকু জ্ঞান প্রয়োগ করবো। এইসব রোগ সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সাথেও পরামর্শ করবো। যদি চাচীকে য*ন্ত্র*ণা থেকে কিছুটা উপশম দিতে পারি। আল্লাহর উপর ভরসা রাখুন। এছাড়া আর বলার কিছুই নেই।”

রিজভী ইতিমধ্যেই সকলের সামনে দু’চোখ দিয়ে নোনাজল ফেলতে ফেলতে বললেন…

—“গত পড়শু রাতেই কামিনী বলছিলো ওর সর্বশরীরে কেমন ব্য*থা অনুভব হচ্ছে। আমি ওর স*ম*স্যাকে তখন হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম সারাদিন রুমের ভিতরেই বিছানায় শুয়ে বসে কাটিয়ে দাও। তাই এই অবস্থা হয়েছে। এখন বুঝতেছি ওর ছোট ছোট স*ম*স্যা গুলো সাধারণ ছিলো না। আহহহ…কামিনী…আহহহ!”

সাগরিকা রিজভীর কাঁধে হাত বুলিয়ে ওনাকে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। সাবরিনা বললেন…

—“কামিনীর রোগ গুলো যেহেতু সং*ক্রা*ম*ক তাহলে ওর থেকে আমাদের সবাইকেই দূরে দূরে থাকতে হবে। কিন্তু কামিনীর এই ক*রু*ণ মূহূর্তে ওর সেবাযত্ন করবে কে! কোনো নার্স বা সার্ভেন্ট ও তো ঠিক করা সম্ভব না।”

রিজভী দু’হাতে নিজের চোখের পানি মুছে বললো….
—“আমার বউয়ের সেবা-যত্ন করার জন্য বাহিরের কাওকে প্রয়োজন নেই। আমি একাই কামিনীর সেবা-যত্ন করবো।”

—“তুমি কি করে ওর সেবা-যত্ন করবে শুনি! শুনলে না জামাই বাবা কি বললো! কামিনীর রোগটি সং*ক্রা*মি*ত। ওর সংস্পর্শে যেই যাবে সেই স্বইচ্ছায় নিজের মৃ*ত্যু*কে গ্রহন করবে। আর তুমি যদি জোরপূর্বক ওর সেবা-যত্ন করতে যাও তাহলে প্রয়োজনের স্বার্থে তোমাকে বাহিরে আসা-যাওয়া করতে হবে। তখন এবাড়িতে তোমার স্পর্শ করা যেকোনো জিনিস থেকেই আমরাও সং*ক্র*মি*ত হয়ে যেতে পারি। কামিনীর একার জন্য এতোগুলো মানুষের জীবন তো ঝুঁ*কি*র মাঝে ফেলতে পারি না।”

সাবরিনার এরূপ কথায় রিজভীর মাথায় যেনো রাগ চ*ড়ে বসে। রিজভী সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে রাগী স্বরে বললেন….

—“তো থাকুন আপনি আপনার পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে, সুখে শান্তিতে। এই দুনিয়ায় আমার পরিবার বা আমার আপন বলতে যদি কেও থেকে থাকে সে শুধু মাত্র আমার স্ত্রী কামিনী। আমার সবরকম পরিস্থিতিতে কামিনী আমার পাশে থেকেছে। আজ ওর বি*প*দের সময় আমি যদি ওর পাশে না থাকি তাহলে আমি স্বামী নামে ক*ল*ঙ্ক হয়ে যাবো। এতো বড় ক*ল*ঙ্কের বোঝা নিয়ে স্বার্থ*পর এই দুনিয়ায় বেঁচে থাকার থেকে নিজের স্ত্রীর সেবায় স্বইচ্ছায় মৃ*ত্যু*কে বেছে নেওয়াই উত্তম বলে মনে করি আমি। কামিনীকে নিয়ে এই মূহূর্তে আমি এই বাড়ি থেকে চিরতরের জন্য বেড়িয়ে যাবো।”

এই বলে রিজভী নিজেদের রুমের দিকে অগ্রসর হতে নিলে নিলাদ্র বলে উঠলো….
—“দাঁড়ান চাচা..!”

রিজভী থেমে যায়। নিলাদ্র আবারও বললো…
—“রাগের বশী*ভূ*ত হয়ে কোনো ভু*ল সিদ্ধান্ত নিলে চলবে না আমাদের চাচা। মাথা ঠান্ডা করুন আর এখানে এসে বসুন।”

রিজভী জোড়ে জোড়ে বারকয়েক নিঃশ্বাস ফেলে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করে আবারও পূর্বের স্থানে এসে বসে পরেন। সাবরিনা শুধু একবার ভেং*চি কাটলেন। নিলাদ্র শান্ত স্বরে বললো…

—“চাচীর এই অবস্থা নিয়ে আপনি যদি বাহিরে কোথাও যান তাহলে সেখানে আপনার আশেপাশে আরো শত শত মানুষের সং*ক্র*মিত হওয়ার চান্স থাকবে। চাচী এখানে বাসাতেই থাকুক। এখানেই তার চিকিৎসার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা আমি করে দিবো। চাচীর চিকিৎসার স্বা*র্থে আমাকে তো তার সংস্পর্শে যেতেই হবে। তাই চাচীর সংস্পর্শে যারা যারা যেতে ইচ্ছুক সবার নিরাপত্তার জন্য বিশেষ ইউনিফর্মের ব্যবস্থাও আমি করে দিবো। তখন আর সং*ক্র*মি*ত হওয়া নিয়ে কোনো ভ*য় থাকবে না।”

নিলাদ্র এরূপ কথাগুলো শুনে রিজভীর রাগ পুরোপুরি ভাবে শেষ হয়ে যায়। রিজভী শান্ত স্বরে বললেন….

—“তোমার উপর আমি চিরকৃতজ্ঞ হয়ে থাকবো জামাই বাবা।”

নিলাদ্র হাসিমুখে বললো….
—“এভাবে বলবেন না চাচা। আপনাদের সবাইকে নিয়েই তো আমার পরিবার। তাই আপনাদের বি*প*দের সময় পাশে থাকতে পারাতে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি।”

সন্ধ্যা ওর ঠোটে হালকা হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে মনে মনে বললো…
—“হু..হু..ভালো মশলা মাখাতে জানেন আপনি জামাই জান। ডাক্তারির পাশাপাশি অভিনয়েও যে প্রচুর দক্ষ আপনি তা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছি।”

নিলাদ্র আবারও বললো…
—“কুশল ভাই..তুমি যদি ফ্রী থাকো তাহলে আমার সাথে একটু বাহিরে যেতে পারবে! আসলে স্টাডির কারণে লম্বা সময় পর বিদেশ থেকে এদেশে এসেছি তাই সবার জন্য ভালো মানের ইউনিফর্ম কিনতে কোথায় যাওয়াটা বেটার হবে সেটা বুঝে উঠতে পারছি না।”

কুশল শান্ত স্বরে বললো….
—“হুম স*ম*স্যা নেই আমি ফ্রী-ই আছি। চলো একসাথেই যাওয়া যাক।”

—“সন্ধ্যা…তুমি কি যাবে আমাদের সাথে!”

সেইসময় অনন্যা বললো…
—“ওহ-হোওও সবকিছুর ভিরে আমি তো ভু*লেই গিয়েছিলাম আজকে আমাকে ডাক্তারের কাছে যেতে হবে চেক আপ এর জন্য। তরুনিমা আর সন্ধ্যা তোমরা দু’জন বরং আমার সাথে চলো। আমি তো একলা সামলে নিতে পারবো না।”

সাবরিনা বললেন…
—“হুম বড় বউমা ঠিক বলেছে। মেজো বউমা…সন্ধ্যা মা..তোমরা দু’জন বড় বউমার সাথেই যাও। সাবধানে থেকো সবাই। আর সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফেরার চেষ্টা করিও কেমন!”

তরুনিমা বললো…
—“ঠিক আছে মা। বড় ভাবী..আপনি রুমে গিয়ে তৈরি হয়ে নিন। আমি আর সন্ধ্যাও তৈরি হয়ে নেই। তারপর বের হবো কেমন!”

অনন্যা বললো…
—“আচ্ছা ঠিক আছে।”

নিলাদ্র সোফা ছেড়ে উঠে বললো…
—“ঠিক আছে। তোমরা তোমাদের হাতের কাজ শেষ করো। আমি আর কুশল ভাই ও কাজটা শেষ করে একটু ক্লিনিকে যাবো। তারপর বাসায় ফিরবো। আর চাচা..ইউনিফর্ম না আনা পর্যন্ত আপনি আর চাচীর রুমে যাইয়েন না। আপাতত অন্য রুমে গিয়ে বিশ্রাম করুন।

অতঃপর নিলাদ্র আর কুশল মূল দরজা দিয়ে বেড়িয়ে যায়। অনন্যা, সন্ধ্যা, তরুনিমা নিজ নিজ রুমে যায় তৈরি হওয়ার জন্য। সাবরিনা আর সাগরিকাও নিজের রুমে চলে যায়। রিজভী নিলাদ্রের কথানুযায়ী আপাতত অন্য রুমে যায় রেস্ট করার জন্য।

#চলবে_ইনশাআল্লাহ

#হৃদকোঠোরে_রেখেছি_তোমায়🖤(৭৭ পর্বের ৪র্থ অংশ)
#Maisha_Jannat_Nura (লেখিকা)

(২১০)
চৌধুরী মেনশন থেকে আগে ও পরে কুশল, নিলাদ্র আর তরু, সন্ধ্যা, অনন্যা বের হয়ে বাহিরে এসে একত্র হয়েছে।কুশল ড্রাইভ করছে। বাকিরাও ঐ গাড়িতেই আছে। ওদের উদ্দেশ্য এখন কনকের কাছে যাওয়া অর্থ্যাৎ কুশলের গোপন আস্তানায় যাওয়া। বেশ লম্বা সময় ধরে ড্রাইভ করার পর গন্তব্যস্থলে পৌঁছায় ওরা। সকলেই গাড়ি থেকে নেমে আস্তানার ভিতরে প্রবেশ করে সরাসরি কনকের জন্য বরাদ্দকৃত রুমের দিকে অগ্রসর হয়। বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে কনক। সেইসময় রুমের দরজা পেরিয়ে ওদের সবাইকে ভিতরে প্রবেশ করতে দেখে কনকের সম্পূর্ণ মুখশ্রী জুড়ে খুশিরা মেলা জুড়ে বসে। অনন্যা কনকের পাশে এসে বসে কনকের ডান হাত ধরে হাতের উপর একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে হাসিমুখে বললো…

—“কেমন আছো তুমি?”

কনক হাসিমুখে অনন্যার কপালে একবার ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বললো…
—“তোমার ভালোবাসায়, ভাই-বোনদের দোয়ায় আর আল্লাহর রহমতে এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি অনন্যা।”

—“আমি আর আমাদের অনাগত সন্তান তোমাকে ভিষণ ভাবে মিস করি প্রতিটি সেকেন্ড।”

—“তোমাদের দু’জনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতেই আমার সময় যে কিভাবে পার হয়ে যায় আমি বুঝতেই পারি না।”

—“এই দুরত্ব যে আর সহ্য হচ্ছে না কনক।”

—“ধৈর্য ধরো বউ। কথায় আছে ধৈর্যের ফল সুমিষ্ট হয়।”

সন্ধ্যা অনন্যার পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধের উপর আলতো ভাবে নিজের ডান হাত রেখে শান্ত স্বরে বললো…

—“আর কিছুদিন এর-ই অপেক্ষা বড় ভাবী। সব শ*ত্রু*দের প*ত*ন ঘটলে আমরা আবার একসাথে সুখে-শান্তিতে থাকতে শুরু করবো ইনশাআল্লাহ।”

অনন্যা সন্ধ্যার হাতের উপর নিজের বাম হাত রেখে ওর দিকে তাকিয়ে উপরনিচ মাথা নাড়ায়। অতঃপর বাকিরা বিছানার দু’পাশে রাখা সোফা জোড়ায় বসে পরে। কনক কুশলের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো….

—“ঐদিকে কি অবস্থা ভাই!”

কুশল শান্ত স্বরে বললো…
—“সবকিছু আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই হচ্ছে। খুব বেশি সময় লাগবে না কামিনী নামক কা*ল না*গী*নি*র চ্য*প্টা*র ক্লো*জ করতে। এরপর একে একে বাকিদের পরিণতিও ততোটাই ভ*য়ং*কর হবে। শুধু কিছুটা সময়ের অপেক্ষা।”

কনক শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে বললো…
—“বাবা কেমন আছে ভাই?”

—“আল্লাহর অশেষ রহমতে বাবা ভালো আছেন। আমি প্রতিদিন সময় করে তার রুমে যাই। তার রুমে আমি শুকনো খাবার, বিভিন্ন মেডিসিন, সময় কাটানোর জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিয়েছে।”

সন্ধ্যা মলিন স্বরে বললো…
—“ঐ ব*দ্ধ করে ২৪ টা ঘন্টা কাটাতে হচ্ছে বাবাকে। আগে তো বাবা অ*সুস্থ ছিলেন তাই এই বিষয় নিয়ে এতো চি*ন্তা ছিলো না। কিন্তু এখন তো তিনি সুস্থ। একজন সু্স্থ এভাবে কতোদিন ব*দ্ধ ঘরে সুস্থ থাকতে পারবে মেজো ভাইয়া! সূর্যের আলো-প্রাকৃতিক বাতাস এর ও প্রয়োজন পড়ে যেকোনো ধরনের মানুষের। বাবাকে কি বাহিরে আনা সত্যিই অ*সম্ভব?”

সন্ধ্যার এরূপ প্রশ্ন শুনে উপস্থিত সকলেই কুশলের দিকে দৃষ্টি স্থির করে। হয়তো সকলের মনে-ই এই প্রশ্নটি ঘুরপাক খাচ্ছে। কুশল নিজের দৃষ্টি মেঝের উপর স্থির রেখে শান্ত স্বরে বললো….

—“আমি নিরুপায় বোন। বাবা এখন সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এই বিষয়ে যদি শ*ত্রু*রা এতোটুকুও স*ন্দে*হ করেন তাহলে বাবার জীবন চরম ঝুঁ*কি*র মাঝে পরে যাবে। কারণ শ*ত্রু*দের পা*প কর্মের সম্পর্কে চা*ক্ষু*ষ সা*ক্ষী শুধু মাত্র আমাদের বাবা-ই দিতে পারবেন। বাবার চোখের সামনে তিল তিল করে য*ন্ত্র*ণা দিয়ে দিয়ে ওরা চারজন আমাদের জন্মদাত্রী মা-কে মে*রে ফেলেছে। বাবা যেনো সু*স্থ হতে না পারে ওদের পা*প কর্ম যেনো আজীবন ধরে চা*পা পরে থাকে তার জন্যই ওরা দীর্ঘ ২০ বছর যাবৎ বাবাকে ক*ড়া ডোজের ক্ষ*তি*কর ঔষধ ই*ন*জে*ক্ট করে এসেছেন। এই সবকিছু চিন্তা করেই আমাদের কাছে শান্ত থাকা আর ধৈর্য ধরা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। বাবাকে ঐ ব*দ্ধ রুমের ভিতর সুস্থ রাখার জন্য যা যা করা উচিত আমি সব করেছি, করে যাবোও।”

উপস্থিত আর কেও এই বিষয় ২য় কোনো প্রশ্ন উঠায় না।

(২১১)
কামিনীর রুমের দরজার বাহিরে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে চেয়ারে বাঁ*ধা রত অবস্থায় স্থির হয়ে থাকা কামিনীর দিকে তাকিয়ে নিজের দু’চোখ বেয়ে ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরাচ্ছে রিজভী। নিজের প্রিয়তমা স্ত্রীর কখনও এমন ক*রু*ণ পরিনতি হতে পারে সে সম্পর্কে ভুলেও কল্পনা করে নি রিজভী। বুকের ভেতরটা একটু পর পর যেনো মো*চ*ড় দিয়ে দিয়ে উঠছে। রিজভী শান্ত স্বরে বললো…

—“এই দুনিয়াটা, দুনিয়ার বুকে থাকা সকল প্রাণী বিশেষ করে মানুষ জাতিরা যে ভিষণ ভিষণ স্বা*র্থ*পর হয় তা আজ খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারলাম আমি কামিনী। একদিন সম্পত্তি পাওয়ার লো*ভে যেই রক্তের সম্পর্কের নিজের মায়ের পেটের বড় ভাই-ভাবীকে নিজেদের পথের কাঁ*টা মনে করে এই দুনিয়ার বুক থেকে সরিয়ে দিতে আরেক ভাইয়ের সজ্ঞ দিয়েছিলাম আজ সেই ভাই-ভাবীর সন্তানের জন্য আমরা সন্তান হা*রা হলাম। হ্যা এটা ঠিক যে আমরা আমাদের সন্তানের মৃ*ত্যু*র প্র*তি*শো*ধ নিয়েছি। ওদের ও নিজেদের সন্তান হা*রা*নো*র য*ন্ত্র*ণা*র আ*গু*নে দ*গ্ধ করেছি কিন্তু এতেও তো মনের ভিতরটা শান্ত করতে পারছি না। জীবনের বেঁচে থাকার একমাত্র স*ম্ব*ল ছিলে যেই তুমি সেই তোমার অবস্থাও কতোটা ক*রু*ণ হয়ে গিয়েছে। সুস্থ হয়ে উঠবে তো তুমি কামিনী! বলো না তুমি সুস্থ হয়ে উঠবে। সাধারণ ভাবে তোমার কা*ছে যাওয়ার এই নি*ষে*ধা*জ্ঞা নামক দেওয়ালটা কবে ভে*ঙে যাবে বলো না! এতো কাছে থেকে তোমাকে ছুঁ*তে না পারার ক*ষ্ট টা যে আমায় কুঁ*ড়ে কুঁ*ড়ে খাচ্ছে। তোমার কিছু হয়ে গেলে যে আমি বাঁচতে পারবো না। জীবিত থাকা আমার জন্য তখন হা*রা*ম হয়ে যাবে।”

রিজভীর কথা শেষ হতেই পিছন থেকে সাবরিনা বলে উঠলো…
—“জীবিত থাকা সত্যিই তোর জন্য হা*রা*ম হয়ে গিয়েছে রে নি*মো*খা*রাম।”

সাবরিনার কন্ঠ শোনা মাত্র রিজভী যেই না পিছন ফিরতে নিবে ওমনি সময় সাবরিনা ওর হাতে থাকা কাঁচের বড় ফুলদানীটা দিয়ে স্ব*জো*ড়ে রিজভীর মাথায় বা*রি দেয়। আকস্মিক সাবরিনার এমন আ*ক্র*মণে কা*বু হয়ে যায় রিজভী। মু*খ থু*বরে মেঝের উপর পরে যায় তিনি। ফুলদানির ভে*ঙে যাওয়া কাঁচের টুকরো গুলো রিজভীর সম্পূর্ণ মুখে, বুকে, হাতে, গলায় গেঁ*থে গেঁ*থে যায়। সাবরিনাকে এমন কাজ করতে পিছন থেকে সাগরিকা দেখে ফেলে স্ব-জোরে চি*ল্লি*য়ে উঠে বললেন….

—“মেজো বউমা…এ তুমি কি করলে? ছোট খোকা….!”

সাগরিকার কন্ঠ কানে পড়া মাত্র সাবরিনা চ*ট করে পিছন ঘুরে তাকিয়ে সাগরিকাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা অ*প্রস্তুত হয়ে গেলেও পরমুহূর্তেই তার ঠোঁটে বাঁ*কা হাসির রেখা ফুটে উঠে।

রুমের ভিতর থেকে বাহিরে ঘটতে থাকা সকল ঘটনার আওয়াজ রায়হানুল স্পষ্ট শুনতে পারছেন। রায়হানুল এর চেহারায় চি*ন্তার ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠে। রায়হানুল আর এক মুহূর্ত দেড়ি না করে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে নিজের ফোনটা নিয়ে কুশলকে কল করার চেষ্টা করে। কিন্তু প্রতিবারই কল আপনা-আপনি ডিস*কানেক্ট হয়ে যায়। রায়হানুল এর মাঝে চি*ন্তা আর ভ*য়ে*র মাত্রা কয়েকগুণ বেড়ে যায়। রায়হানুল কুশলকে পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত করতে পরপর কয়েকটা মেসেজ সেন্ড করে ওর নাম্বারে। কিন্তু মেসেজের ডেলিভারি হওয়ার নোটিফিকেশন ও শো হয় না। রায়হানুল তার ফোনটা বিছানার উপর রেখে চিন্তিত কন্ঠে বললেন….

—“মা..ছোট খোকা বলে এভাবে চিৎ*কার করলেন কেনো? আর কি যেনো ভা*ঙা*র শব্দ ও শুনতে পেলাম।সবরিনা রিজভীর সাথে কি খা*রা*প কিছু করেছে। ওরা এবার মায়ের কোনো ক্ষ*তি করে দিবে না তো! না না এ হতে পারে না। ২০ বছর আগে ওরা আমার চোখের সামনে আমার স্ত্রীকে মে*রে ফেলেছে। আমাকে আমার সন্তানদের থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এবার কিছুতেই ওদের আমার মায়ের কোনো ক্ষ*তি করতে দিবো না। আমাকে বাহিরে যেতেই হবে। যে করেই হোক মাকে ওদের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।”

এই বলে রায়হানুল দ্রুততার সাথে বিছানা থেকে নেমে দরজার দিকে অগ্রসর হয়।

(২১২)
নিলাদ্র শান্ত স্বরে ওদের সকলকে উদ্দেশ্য করে বললো…
—“এবার আমাদের এখান থেকে বেড়োনো উচিত। ইউনিফর্ম কেনার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছি। সেগুলো কিনতে আমার মার্কেটে যেতে হবে। সেখানেও বাড়তি কিছু সময়ের প্রয়োজন।”

নিলাদ্রের কথায় ওরা সকলেই সম্মতি জানায়। অতঃপর ওরা কনকের থেকে বিদায় নিয়ে আস্তানা থেকে বের হয়ে গাড়ির কাছে আসে। এবার নিলাদ্র ড্রাইভ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই সে ড্রাইভিং সিটে বসে। কুশল নিলাদ্রের পাশের সিটে বসে। বাকিরা অনায়াসেই আসার সময়ের মতো পিছনের সিটে বসে পরে। নিলাদ্র গাড়ি স্টার্ট করে। গাড়ি তার আপন গতিতে চলছে। জ*ঙ্গ*ল থেকে বের হয়ে মূল রাস্তায় উঠতেই কুশলের ফোনে একের পর এক নোটিফিকেশন আসতে শুরু করে। যার শব্দ ওরা সকলেই শুনতে পারে। কুশল ওর পকেট থেকে ফোনটা বের করে নোটিফিকেশন এ ক্লিক করে ফোন মেসেজের এপপ এ ঢুকে। রায়হানুলের পাঠানো এতোগুলো মেসেজ পড়ার পর কুশলের মনেও চি*ন্তা আর ভ*য় কাজ করতে শুরু করে। কুশল গাড়ির উপর হাত দিয়ে স্বজোরে বা*রি দিয়ে বললো….

—“সি*ট সি*ট….নিলাদ্র গাড়ি থামা দ্রুত।”

কুশলের এরূপ কথায় নিলাদ্র সহ বাকিরা অবাক হয়ে যায়। তরুনিমা বললো….

—“কি হয়েছে কুশল…আপনি হঠাৎ গাড়ি থামাতে বলছেন কেন?”

নিলাদ্র রাস্তার একপার্শে গাড়ি থামায়। অতঃপর কুশলের কথানুযায়ী ওরা দু’জনেই সিট এক্সচেঞ্জ করে। সন্ধ্যা অবাক স্বরে বললো….

—“মেজো ভাইয়া কি হয়েছে বলবে তো আমাদের।”

কুশল গাড়ি স্টার্ট করে অত্যন্ত দ্রুত গাড়ি চালাতে শুরু করে। নিলাদ্র বললো….
—“ভাই..কি হয়েছে তোর। আস্তে গাড়ি ড্রাইভ কর। বড় ভাবী প্রেগন্যন্ট।”

কুশল ফুলস্পিডে গাড়ি চালাতে চালাতে বললো….
—“বাড়িতে খুব বড় ঝা*মে*লা তৈরি হয়েছে। আমাদের যতোদ্রুত সম্ভব ওখানে পৌঁছাতে হবে। বাবা-দাদীমার জীবন ঝুঁ*কি*র মাঝে পড়েছে। সবকিছু একনিমিষে এলোমেলো হয়ে গেলো।”

কুশলের এরূপ কথা শুনে ওরা সকলেই ‘হায় আল্লাহ’ বলে উঠে।

#চলবে ইনশাআল্লাহ…….