#শ্রাবণ_ধারায় |২১|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
হাতে একগুচ্ছ কালো গোলাপ মুখে স্নিগ্ধ হাসি।কপালে ও সরু নাকে বিন্দু বিন্দু নোনাজল।ছোট ছোট চঞ্চল চক্ষুদ্বয় খুঁজছে প্রিয় সে মুখ।ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে এদিকে ওদিকে চিনিকে খুঁজে চলেছে বারিশ।কোথাও না দেখে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে এলো তার।গৃহকর্মী মিতু এগিয়ে এলো বারিশের দিকে।বিনয়ী স্বরে বলে,
– স্যার ম্যাম রান্নাঘরে আছেন।
লাজুক হেসে মাথা নত করে ঘাড়ে হাত দিলো বারিশ।উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে খাবার টেবিলের উপর তোড়াটি রেখে এগিয়ে গেল রান্না ঘরের দিকে।মিতুও বারিশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মুখে হাত চেপে হেসে তার কাজে মনোযোগ দিলো।বারিশ রান্নাঘরের দরজায় গিয়ে থমকে গেল।কালো সিল্কের শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে খুন্তি নাড়ছে চিনি।রেশমি চুলে দূর্বল হাত খোঁপা এখনই খসে পড়বে পড়বে ভাব।ঘাড়ের ঘামগুলো ঘাড়ে থাকা ছোট ছোট চুলগুলোকে শুভ্র ত্বকে বেশ দৃঢ়ভাবে লেপ্টে আছে।মেঘহীন পেটের এক অংশ স্পষ্ট দৃশ্যমান।সেদিকে নজর যেতেই ঢক করে একটি ঢোক গিলল বারিশ।কয়েকবার চোখের পলক ফেলে।এগিয়ে আসে এক কদম দু কদম করে।নিঃশব্দে কাছে এসে শাড়ির আঁচল কোমর থেকে খুলে দেয় সে।আচমকা পেটে অস্পষ্ট ছোঁয়া পেতেই লাফিয়ে ওঠে চিনি।খুন্তি হাতে পিছন ঘুরে তাকায় সে।খুন্তিটি রাখে বারিশের মুখ বরাবর তাতে মাথাটা হালকা পিছনে সরিয়ে নেয় বারিশ।চোখের সামনে বারিশকে দেখতেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল চিনি।বড় এক শ্বাস ফেলে বলল,
– ওহ্ আপনি?
বারিশ ঠোঁট বাকালো।এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,
– কেন অন্যকারো কি এত সাহস আছে যে আমার বউয়ের কোমরে হাত দিবে?
মুখ ভেংচি দিলো চিনি।নিজে নিজে বিড়বিড়িয়ে বলল,
– এহ্! ঢং দেখে আর বাঁচি না।যান তো এখান থেকে রান্না করতে দেন।
বারিশ চিনির কথায় ঠোঁট চেপে হাসে।দৃষ্টি ফেলে চুলোয় রাখা ফ্রাইপ্যানের উপর।চিনি আচঁল সামলে রান্না করতে গিয়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। তা দেখে বারিশ নিঃশব্দে আবারও আঁচলটি কোমরের একপাশে গুঁজে দিলো।কেঁপে উঠলো চিনি।অবাক স্বরে বলল,
– কি করছেন?
বারিশ স্বাভাবিক কন্ঠেই উত্তর দিলো,
– আঁচল ছেড়ে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে তোমার তাই গুঁজে দিলাম।
চিনি কপাট রাগ দেখিয়ে বলল,
– খুলতেই বা বলেছিল কে আর গুঁজে দিতেই বা বলছে কে?
– চিনি!
সহসা বারিশের শীতল কন্ঠে চিনির নাম শুনে থমকে গেল চিনি।জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে ঘুরে বারিশের দিকে ফিরলো চিনি।বারিশ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে গম্ভীরতরার ছাপ স্পষ্ট। চিনি এবার এককদম এগিয়ে তার ডান হাত বারিশের কাঁধে রাখল।জিজ্ঞেস করলো,
– কি হয়েছে বারিশ?কোনো সমস্যা?ফারিশ ভালো আছে?
বারিশ করুণ চাহনিতে চিনির দিকে ফিরলো।চোখ তার করুণ সুরে আর্তনাদ করে বলছে আমার মন ভালো নেই।আমি ভালো নেই।চিনি বিস্মিত হলো বারিশের এমন আহত দৃষ্টিতে। আবারও জানতে চায়লো,
– বারিশ কি হয়েছে?সবকিছু কি ঠিক আছে?ফারিশ সুস্থ আছে?
বারিশ উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে আশ্বাস দেয় ফারিশ ঠিক আছে। চিনি ভ্রু কুঞ্চন করে বলে,
– তাহলে কি হয়েছে?
বারিশ এতোক্ষণে মুখ খোলে।ভারি কন্ঠে উত্তর দেয়,
– মাকে পুলিশ নিয়ে গিয়েছে।
চিনি চমকিত হয়।চোখ দুটো কোটর থেকে বের করে বলে,
– কি বলছেন? কখন?কিভাবে?ফারিশ এখন কোথায়?
– একটু আগেই আমিই পুলিশ কেস করেছি।ফারিশ এখনও হাসপাতালে।কিন্তু বিশ্বাস করো আমার একদমই ভালো লাগছেনা।মাকে হ্যান্ডকাফ পরিহিত অবস্থায় দেখে আমার বুকটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছিল।আমার মন বলছে মাকে সাহায্য করি আবার তার কৃতকর্মের কথা মনে পড়তেই থমকে যাচ্ছি আমি।
চিনি তপ্ত শ্বাস ফেলল।দৃষ্টি শান্ত করে বারিশের চোখে চোখ রাখল।বারিশের চোখে উদ্বেগ স্পষ্ট। চিনি বারিশের গালে তার ডান হাতের তালুতে আলতো ছুঁয়ে দিলো।গালে হাত রেখেই অতি নরম স্বরে বলল,
– দেখুন তার জীবনে যথেষ্ট সংগ্রাম কষ্ট তা আমিও মানি আপনিও মানেন।তাই বলে সে তার কষ্ট লাঘব করার জন্য অসদুপায় অবলম্বন করবে?আল্লাহ মানুষকে কষ্ট দিয়ে তার সততাকে পরীক্ষা করেন।আর সেই পরীক্ষায় পাশ করার জন্য আমরা তার বিরুদ্ধে যেতে পারিনা তাই না?আর তাছাড়া সে তো এখানে খারাপ ছিলনা।আপনি তাদের জন্য যথেষ্ট করেছেন।তাতেও তারা সন্তুষ্ট নন।
দীর্ঘ এক গরম নিঃশ্বাস ত্যাগ করল বারিশ।নিঃশ্বাসের সাথে বেরিয়ে এলো একরাশ হতাশা আর আফসোস! দেশে ফেরার পর সে রাণীকে তার নিজের মায়ের মতো করে যত্নে রেখেছে।মাকে মাটিতে রাখার আগে তাকে একবার চোখের দেখাও দেখতে পারেনি সে।এ যে বিদেশ!বিদেশ থেকে যে এমন হুটহাট যাওয়া আসা সম্ভব নয়।পাঁচ বছর বয়স থেকে রাণী আর ফারিশকে সে তাদের বাড়িতে পেয়েছে।প্রথমে তাদের পরিচয় সম্পর্কে তেমন বিস্তারিত না জানেনি সে।তার মা শুধু ফারিশকে দেখিয়ে বলেছিল,”এটা তোর ছোট ভাই।” আর রাণীকে দেখিয়ে বলেছিল,”এটা তোর ছোট মা।আমাকে যেমন মা ডাকিস ওনাকেও ডাকবি বুঝলি।” বারিশ সেদিন ফ্যাল ফ্যাল করে শুধু ফারিশ আর রাণীকে দেখেছিল।রাণীর অদ্ভুত চাহনি তার পছন্দ না হলেও সে কোনো টু শব্দ সেদিন করেনি।একটু বুঝ হতেই যখন সে জানতে পারে রাণী তার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী তখন তার বেশ রাগই লেগেছিল।তবুও সে কখনো প্রকাশ করেনি।তার মায়ের সাথে রাণীর সব বিষয়ে একটা অঘোষিত পাল্লা চলত।সেও তার অপছন্দের তালিকায় ছিল।তবু সে কখনো একটা কথাও বলেনি।রাণীর সাথে সর্বদা বিনয়ী আচরণ করে এসেছে সে।দেশে এসে মাকে আর কাছে না পেয়ে যখন মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিল তখন এই রাণীই তাকে মায়ের মতো মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিল,
– ভেঙে পড়িস না বাবা আমি আছি তো।
পরিবারের সকলে যখন তাকে একা ফেলে অস্ট্রেলিয়া তখন রাণী আর ফারিশই ছিল তার পাশে।তাকে সুন্দর স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে তাকে বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।অতঃপর ঘটকের বদৌলতে চিনির সাথে তার বিয়ে হয়।সেই মানুষগুলো থেকে একের পর এমন অমানবিক আচরণ মেনে নিতে পারছে না বারিশ। যখনই ভাবছে তাকে ভালোবাসা,আগলে রাখা,তার বিপদে তার খুঁটি হয়ে তার পাশে থাকা সবটাই ছিল তাদের স্বার্থ উদ্ধারের প্রথম ধাপ তখনই বুক ফেটে বেরিয়ে আসতে চায়ছে একরাশ বেদনা।মনে মনে ভাবছে হয়তো সে ভালোবাসার যোগ্য নয়!তাই তাকে কেউ কখনো মন থেকে ভালোবাসেনি।এমন কি সে যাকে মায়ের জায়গা দিয়েছিল সেও না।মস্তিষ্কে কথাগুলো আলুথালুভাবে ঘুরপাক খেতেই আরো একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে বারিশের ভিতর থেকে।ফোঁস করে শ্বাস ফেলতেই চিনি ভ্রুযুগল উঁচিয়ে তার দিকে তাকায়।বারিশের হাতে আলতো ছুঁয়ে মোলায়েম স্বরে বলে,
– যান ফ্রেশ হয়ে নেন।আপনার খাবার তৈরি হয়ে গিয়েছে।
ভ্রম কাটে বারিশের সটান দাঁড়িয়ে গম্ভীর স্বরে বলে,
– ফারিশকে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর ব্যবস্থা করছি।
চিনি বারিশের চোখের মণির দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ ভাবল।ভাবুক স্বরে বলল,
– কবে যাচ্ছে?
– কাল পরশু।
বলেই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য কদম ফেলল বারিশ। আচমকা কিছু মনে পড়তেই পিছু ডাকে চিনি।বারিশ দরজার কাছে এসে থেমে যায়। শরীর না ঘুরিয়ে শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ রাখে চিনির চোখে।দৃষ্টিতে প্রশ্ন বিদ্যমান।চিনি ভাবনার ভঙ্গিতে বলে,
– আচ্ছা মাকেও ফারিশের সাতে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়?
ফ্যাল ফ্যাল করে চিনির দিকে চেয়ে থাকে বারিশ।চিনির কতাটি কর্ণগহ্বরে প্রবেশ করতেই দুই ভ্রু জাগিয়ে কিছু একটা ভাবে সে।কোনো উত্তর না দিয়ে বেরিয়ে যায় রান্নাঘর থেকে।আসার সময় খাবার টেবিলের উপর রাখা ফুলের তোড়াটি চোখে পড়তেই কদম থমকে যায় তার।ফুলের দিকে দৃষ্টি দিয়ে রান্না ঘরে একপলক তাকায়।এগিয়ে গিয়ে তোড়াটা হাতে নিয়ে স্বর উঁচিয়ে ডাকে চিনিকে,
– চিনি?
হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে এলো চিনি।জোরে জোরে শ্বাস টেনে বললো,
– কি হয়েছে? কি হয়েছে? কোনো সমস্যা?
চিনিকে এভাবে হাঁপাতে দেখে বারিশ ঘাবড়ে যায়।চিনির কাঁধে হাত রেখে বলে,
– তেমন কিছু না।এমনভাবে দৌড়ে এলে কেন?আমি তো এটা দেওয়ার জন্য তোমাকে ডেকেছিলাম।
বলে তোড়াটি চিনির দিকে এগিয়ে দিলো বারিশ।চোখের সামনে একগুচ্ছ কালো গোলাপ জ্বলজ্বল করতেই চমকে উঠলো চিনি।দুই ঠোঁটের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হলো।চোখ কপালে তুলে একবার তোড়াটি দেখছে তো একবার বারিশকে।বারিশের বেশ ভালোই লাগচে চিনিকে এমন চমকিত ভঙ্গিতে দেখতে।চিনি এতো বেশি চমকে যাবে সে আশা করেনি।চিনি গোলাপটি নাকের সামনে নিয়ে গোলাপটি অদ্ভুত মিষ্টি ঘ্রাণ নিলো।চকচকে চোখে বারিশের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি রেখা আঁকলো ঠোঁটে।সে হাসি দেখে আনমনেই বারিশের ঠোঁট মেলে গেল।এ যেন কোনো ছোঁয়াচে রোগ!তার হাসি চোখের সামনে ভাসতেই অজান্তে ঠোঁটে হাসি ফোটে অপরজনের।চিনি ফুলগুলোকে আলতো ছুঁয়ে বলল,
– খুবই সুন্দর আমার অনেকদিনের ইচ্ছা ছিল কালো গোলাপের।ভালোবাসি আপনাকে।
কেঁপে উঠল বারিশ। হঠাৎই চিনি তাকে এই শব্দটি বলবে সে কল্পনাও করতে পারেনি।সে ভেবেছিল বেশি হলে চিনি তাকে “ধন্যবাদ” জানবে।কিন্তু আচমকা এ শব্দ শুনে সটান বিমূর্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।ঠোঁট দু’টো কোনো মতে নাড়িয়ে বলল,
– কি?
দুষ্টু হাসে চিনি।তোড়াটি বুকে চেপে দুলে দুলে বলে,
– আবার শোনার ধান্দা না?সব বুঝি আমি।আর বলবো না।
এই প্রথম চিনি তাকে “ভালোবাসি” বলেছে।এই মুহুর্তের অনুভূতি প্রকাশের মতো এতো ক্ষমতা বোধহয় বারিশের নেই।মনে মনে ভাবলো “আনন্দ উদযাপনে যদি এখন নিজের জীবনটাও দিয়ে দেওয়া হয়।তবু বুঝি তা কম হয়ে যাবে।”
চিনি লাজুক ভঙ্গিতে মাতা নিচু করে মুচকি মুচকি হাসছে।কলের পুতুলের মতো নিঃশব্দে চিনির দিকে দু’কদম এগিয়ে এলো বারিশ। চিনি মাথা নত করেই দেখলো বারিশ পা দু’টো তার দিকে এগিয়ে এসেছে।শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সে।শ্বাস প্রশ্বাস ঘন হলো।শূন্য দৃষ্টিতে চিনির দিকে তাকিয়ে চিনির নত মাথায় হাত রাখল বারিশ।আলতোভাবে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অস্ফুট ক্ষীণ স্বরে বলল,
– ভালোবাসি চিনি।অনেক বেশি চাই তোমাকে।
চলবে…