#শ্রাবণ_ধারায় |২৫+২৬|
#সাদিয়া_আক্তার_জ্যোতি
সকাল সকাল সারাঘর লাল-সাদা গোলাপের ঠাঁসাঠাসি দেখে চোখ ধাঁধিয়ে গেল আমার।জিজ্ঞেসু দৃষ্টিতে বারিশের দিকে তাকালম।সে প্যান্টের পকেটে দু’হাতে পুরে নির্বিকার ভঙ্গিতে আমার দিকে এগিয়ে এলো।ঘাড় নাড়িয়ে বলল,
– তোমার নার্ভাসনেস-কে আরো বাড়িয়ে না দিতে কাল রাতে কোনো আয়োজন করা হয়নি।সকল ভয় কাটিয়ে সুন্দর একটি রাত্রিযাপনের পর এই স্বাগতমটি তোমার প্রাপ্য ছিল।আমার অগোছালো জীবনে তোমাকে স্বাগতম।
সে তার নেশালো কন্ঠে কথাগুলো আমার চোখে চোখ রেখে বললো।আমি শুধু মুগ্ধ নয়নে তার দিকে চেয়ে আছি।সকালের সোনালি আলোতে তার মুখের মুচকি হাসি যেন আয়নায় পড়া সূর্যের আলোর মতো আমার চোখে ঝলকানি দিয়ে উঠলো।তবু আমি চোখ সরালাম না।আরো দৃষ্টি আরো গভীর করলাম।কেন সরাবো?সে তো অর্ধাঙ্গী!আমার অঙ্গ! আমার অঙ্গের দিকে আমি নিষ্পলক চেয়ে থাকবো।তাতে কার আপত্তি আছে শুনি?
বারিশ তার ডান হাতটি আমার দিকে এগিয়ে দিলো।আনমনেই সে হাতে হাত রাখলাম আমি।বিছানা থেকে পা নামাতেই অতি কোমল কিছু পায়ের পাতায় বিচরণ করতে লাগলো।সামান্য ভেজাও আছে বুঝি!বারিশের থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিচে তাকালাম।পায়ের নিচে লাল গোলাপের পাপড়ি ওয়াশরুম পর্যন্ত।আবার চোখে বিস্ময় নেমে এলো আমার।চট করে মাথা তুলে তাকালাম বারিশের দিকে।সে মিষ্টি হাসি দিলো।আমাকে ইশারা করলো সামনে এগিয়ে যেতে।বিশাল বড় বাথরুমের একপাশে একটি বাথটাব।যেটা এই মুহুর্তে লাল গোলাপের পাপড়িতে সজ্জিত। এখানেও আমাকে স্বাগত করার আয়োজন করা হয়েছে?প্রশ্ন মাথায় আসতেই আমি আবার বারিশের দিকে তাকালাম।সে ভ্রু উঁচিয়ে নির্বিকার স্বরে বলল,
– আজ বাড়ির প্রতিটি কোণা তোমাকে স্বাগতম জানাবে।তাই এতো অবাক হওয়ার কিছু নেই।আমার মিষ্টি বউ!
মুখে হাত দিয়ে হাসে চিনি। কিছু একটা ভেবে ভ্রু কুঁচকে কোমরে হাত বেঁধে পিছনে ফিরে বারিশকে বলল,
– দরজা ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবেন?যান! আমি গোসল করবো না?
বারিশ বুকে হাত গুঁজে হেয়ালি করে বলল,
– করো তা আমি তো আর নতুন কেউ না।কাল পর্যন্ত ছিলাম এখন আর নেই।
– উফ্ যাবেন আপনি?
বারিশ মুখ বাঁকিয়ে বলল,
– যাচ্ছি। আমি অতটাও অভদ্র নই,হুহ্!
বলেই চলে গেল বারিশ। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে জোরে একটি শ্বাস টানলাম।অনুভব করলাম হৃৎপিণ্ডে প্রজাপতির একে বেঁকে উড়ে যাওয়া।নিজেকে নিখুঁতভাবে গুছিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলাম।আমাকে বের হতে দেখে বারিশ ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে বলল,
– এতো সময় লাগে তোমার!আমি বিরক্ত হয়ে গিয়েছি।
আমি চট জলদি অপরাধী স্বরে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে বললাম,
– সরি সরি!একটু দেরি হয়ে গেল।
– চলো এবার নিচে।
আস্তে আস্তে বারিশের যত্নগুলো আরো গাঢ় হতে লাগলো।আমার আর তার সম্পর্কটা একদম পাঁচমিশালী!কখনো আমরা একে অপরের খুব কাছের বন্ধু,কখনো চন্দ্রবিলাশের সঙ্গী, কখনো বৃষ্টিবিলাসের সঙ্গী,কখনো একে অপরের খুব প্রিয় মানুষ!সব মিলিয়ে দু’জন দু’জনের আস্থার জায়গা।আমরা অনেক বেশি গল্প করি।বারিশ আমাকে তার জীবনের নানা ঘটনা বলে আমি বারিশকে নিজের অনেক অভিজ্ঞতার কথা বলি।আমরা মনে করি আমরা দু’জন দু’জনের সাথে যত কথা বলবো আমাদের মাঝে সবকিছু তখন কোমল ও সহজ-সরল হবে।আর যত কথা কম বলা হবে ততই জটিলতা বাড়বে।দিনশেষে আমরা কেউ কাউকে বুঝতে পারবো না।
একদিন বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের ধূসর মেঘ দেখছিলাম।শ্রাবণ মাস বৃষ্টি খুব বেশি তা নয়।তবে মাঝে মাঝে এমন ধূসর মেঘ ভেঙে ধরনীর বুকে রহমতের পানি বর্ষিত হয়।বর্ষার ঠিক আগ মুহুর্তে এই ধুসর কালোমেঘ দেখতে বেশ লাগে আমার।হঠাৎ কিছু একটা মস্তিষ্কে কড়া নাড়তেই শিরদাঁড়া সোজা করে সটান দাঁড়িয়ে পড়ি আমি।
দ্রুত পায়ে ঘরে এসে কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি খুঁজতে থাকি।অবশেষে জিনিসটি পেতে তা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাই।মুখে প্রাণোচ্ছল হাসি নিয়ে বেরিয়ে আসি রুম থেকে।চটজলদি ফোন করি বারিশকে।সঙ্গে সঙ্গে ফোনটি রিসিভও হয়।বারিশের এই জিনিসটাও আমার খুব ভালো লাগে।সে যেখানেই থাকুক না কেন আমি কল করলে সে কল রিসিভ করবেই।সে রিভিস করতে আমি তাকে কোনো কথা বলতে দিলাম না।বললাম,
– তাড়াতাড়ি বাড়ি আসবেন।
বলেই বারিশকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফোনটা কেটে দিলাম আমি।এরপর বারিশ অনবরত কল করতে থাকে আমাকে।আমি আর ফোন তুলিনি।কিছু সময়ের ব্যবধানে বাড়িতে হাজির হলো বারিশ।বিধস্ত অবস্থায় ঘরে প্রবেশ করলো সে।সারা শরীর ঘামে ভেজা।তাকে দেখে সামান্য মায়া হলো আমার।ভাবলাম “ইশশ!বেচারাকে এভাবে এভাবে টেনে না আনলেও পারতাম।” পরক্ষণেই ভাবলাম এনেছি ঠিক করেছি।এতো বড় একটা সুখবর সে আসা পর্যন্ত পেটের ভিতরে কিভাবে লুকিয়ে রাখতাম?বারিশের চোখ দু’টো রক্ত লাল হয়ে আছে।আমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে সে।জোরে জোরে শ্বাস টেনে বলল,
– এভাবে ডেকেছ কেন?কি হয়েছে?ফোনে কিছু বললেও না।
আমার বেশ অনুশোচনা হতে লাগলো।আমি অপরাধী সুরে বললাম,
– তেমন সিরিয়াস কিছু না।এভাবে না এলেও হতো।
– যে ভাবে ডাকলে মনে হলো কি না কি হয়ে গিয়েছে। তাই তো ছুটে এলাম দেখতে।মিটিংটাও ক্যান্সেল করতে হলো!
আমি নত স্বরে বললাম,
– সরি!
আমার এই কথা সেই কথা শুনে বারিশ ক্ষিপ্ত হলো।দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
– এখন আসল কথা বলবে?কেন ডেকেছ?
আমি দৃষ্টি নত রেখে আমতা আমতা করতে থাকলাম।সে আমায় ধমক দিয়ে বলল,
– আরে বলো না হয়েছে?
আমি বারিশের ধমকে ঘাবড়ে গেলাম।মুখ ফসকে বলে ফেললাম,
– বাচ্চা!
স্থির হয়ে গেল বারিশ।ঘাড় বাঁকিয়ে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি দাঁত দিয়ে জিহ্বা কেঁটে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলাম।বারিশের মস্তিষ্কে কিছু একটা নাড়া দিতেই চোখ কপালে উঠে গেল তার।দুই ঠোঁটের মাঝে দুরত্ব সৃষ্টি হলো।বিস্ময় কন্ঠে বলল,
– কি?
আমার কন্ঠনালি থেকে আর কোনো শব্দ বের হলো না।আমি আমি গুম হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম নিজের জায়গায়।বারিশ একপা দুপা করে এগিয়ে এলো।ঠোঁটে দেখা গেল কোমল হাসি।সে এগিয়ে এসে আমার মাথায় তার ডান হাত রাখলো।নিচু স্বরে বলল,
-আলহামদুলিল্লাহ!
আনমনে আমিও হাসলাম।মুখে হাসি নিয়েই মাথা তুললাম তার চোখে চোখ রেখে বললাম,
– অভিনন্দন।
– তোমাকেও অভিনন্দন।
আমি উপর নিচ মাথা নাড়ালাম।সেদিন আমাদের খুশির সীমা ছিলনা।আমরা কাউকি কিছু সেভাবে জানাতে পারিনি।ভেবেছিলাম কিছু দিন পর সবাইকে জানাবো।কিন্তু কে জানত কিছুদিন পর আমরা নিজেরাই এমন কিছু জানতে পারবো যেটা জানার পর আমাদের সকল খুশি এক মুহুর্তে হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।আমার কিছুদিন পরই মিসক্যারেজ হয়ে যায়।আমি সে সময় ঘরে দরজা দিয়ে কেঁদেছিলাম।বারিশও এই ধাক্কাটা সামলাতে না পেরে সেও ভিষণ কষ্ট পায়।আমাকে কোন শব্দ চয়নে শান্তনা দেওয়া উচিত তা সে বুঝে উঠতে অক্ষম হয়।তাই দুই যাবৎ বাড়িতেই আসেনি সে।তখন অবশ্য আমার তার উপর অসংখ্য অভিমান,অভিযোগ জন্মে।যে সময় আমার তাকে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সে সময় সে আমাকে একা রেখে কোথাও উধাও হয়ে হয়ে গেল।ফিরে আসার পর প্রায় একসপ্তাহের মতো তার সাথে কথা বলিনি।সে সর্বক্ষণ আমার পিছু পিছু ঘুরত আর ক্ষমা চায়তো তবে আমি তাকে কোনোভাবেই গায়ে মাখিনি।গুণে গুণে সাত দিন পর তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।গায়ে সর্বশক্তি দিয়ে তার ডান গালটা লাল করে দিলাম।সে শুধুই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে ছিল।পরে অবশ্য আমাকে এ নিয়ে খোঁটা দিতে ভুলেনি সে।উঠতে বসতে সবসময় বলতো,
– পৃথিবীর সব থেকে নিষ্ঠুরতম বউ তুমি।তোমার নাম যে চিনি রেখেছে সে নির্ঘাতই এক অবলা প্রাণী তা নাহলে এমন চিরতার তিতা স্বভাবের মেয়ের নাম কোনো পাগলও চিনি রাখবে না।তুমি এতটাই নিষ্ঠুরতম যে নিজের বরের গাল ফাটায় রাতদিন ছাব্বিশ ঘন্টা।
তার সুর দিয়ে টেনে টেনে বলা কথায় আমি কঠিন স্বরে বললাম,
– রাত দিনে ছাব্বিশঘন্টা হয়না চব্বিশ ঘণ্টা হয়।এতো বড় কোম্পানি চালান অথচ এখন সময়ের হিসাবটাও ঠিক করতে পারেন না।
আমার কথায় সে অবাক হওয়ার ভান করে বললো,
– আচ্ছা চব্বিশ ঘণ্টা হয় নাকি?তুমি না বললে তো জানতামই না।তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ মিসেস মৃধা।
আমি মুখ ভেংচি দিলাম।প্রথম সন্তানকে না পওয়ার কষ্টটা আমাকে এতো বেশি আঘাত করেছিল যে আমি অনেক খিটখিটে আর কর্কশভাষী হয়ে যাই।আমি নিজের অজান্তেই সবার সাথে খুব বাজে ব্যবহার করতে থাকি।কারো সাথে ভালো করে কথা বলতাম না।কেউ কোনো সাধারণ প্রশ্ন করলেও আমি খুব কর্কশ গলায় জবাব দিতাম।সারাদিন অফিস করে বারিশ বাড়ি ফেরার পর তাকে আবার আমার এই খিটখিটে মেজাজ সহ্য করতে হতো।কিন্তু সে কখনো আমার উপর গলা চড়িয়ে কোনো কথা বলেনি।শান্তভাবে আমাকে আকার ইঙ্গিতে বোঝানোর চেষ্টা করতো আমি যেটা করছি সেটা ঠিক না।কিন্তু আমি তখন কিছুই বোঝার মতো অবস্থায় ছিলামনা।কেউ কিছু বলতে আসলে উল্টো তাকে কথা শুনিয়ে দিতাম।এভাবেই চলে গেল বেশকিছু দিন।আমি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে শুরু করলাম।এবং আমার আবারও মা হওয়ার সৌভাগ্য হলো।তবে এ সৌভাগ্যটা বুঝি আমার কপালে স্থায়ীভাবে বসে না।এবারও আগের মতো আমি আমার সন্তানকে হারালাম।আর বিষয়টা আমাকে এমনভাবে আঘাত করলো যে আমি মানসিকভাবে নিজেকে সামলে নিতেই পারছিলাম না।এবার প্রতিটি মুহুর্তে বারিশ আমার পাশে ছিল।আমাকে প্রতিমুহূর্তে আশ্বাস দেওয়া আমার যত্ন নেওয়া সবকিছু নিজে হাতে করেছে সে।আমি তার সাথে অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি এসময়ে তবে সে আমাকে কিছুই বলতো না।শুধু আমাকে শক্ত করে নিজের বুকে জরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম স্বরে বলত,
– এমন করেনা চিনি। সব ঠিক হয়ে যাবে একটু ধৈর্য ধরো।আল্লাহর উপর ভরসা রাখো।তিনি সব ঠিক করে দিবেন।
বারিশ এই নরম কন্ঠে আমার হৃদয় আরো পুড়ে উঠলো।আমি নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলাম না।বারিশের বুকে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে উঠি আমি।ভাবতে থাকি আমার সাথেই কেন এমন হয়ে চলেছে বার বার!
তৃতীয়বারেও আমার সাথে একই ঘটনা ঘটে।মানসিকভাবে এতোটাই অসুস্থ ছিলাম যে তখন ঠিক ভুল বিচার করার মতো অবস্থায় ছিলাম না।আর এটারই সুযোগ নেয় আমার শাশুড়ি “রাণী মৃধা”। তৃতীয় বার আমি নিশ্চিত হয়ে বুঝতে পারছিলাম না যে আমি সত্যিই অন্তঃসত্ত্বা। তাই টেস্টের জন্য হাসপাতালে যাই।কিন্তু বাড়িতে ফিরতেই আমার পিরিয়ড শুরু হয়।তখন বুঝতে পারি আমার ধরণা ভুল ছিল আমি প্রেগন্যান্ট নই।এ ঘটনার দুইদিন পর বারিশ অফিস থেকে ফিরে আমাকে একটা ফাইল কাবার্ডে রাখার জন্য দেয়।কৌতুহল বশত আমি ফাইলটি খুলে দেখার দুঃসাহস করি।এবং ফাইলটির ভিতরেই দেখতে পাই আমার করা প্রেগ্ন্যাসি টেস্ট এর রিপোর্ট। সেখানে স্পষ্ট লেখা আমি প্রেগন্যান্ট।তাহলে?কোনোকিছুর হিসাব মেলাতে না পেরে এক জায়গায় থমকে বসে থাকি আমি।মাথাটা ইদানীং একটু বেশিই ব্যাথা হচ্ছে। চোখ থেকে অনবরত পানি ঝরে চলেছে আমার।ঘরে প্রবেশ করেন আমার শাশুড়ি। হাতের রিপোর্টে উঁকি দিতেই সে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে জ্বল জ্বল চোখে আবেগি স্বরে বললেন,
– মিষ্টি বউ?এতো বড় খবরটা আমাদের এখনও দেওনি?আমি তো ভাবতেও পারিনি বারিশ কখনো বাচ্চা নিবে।
থমকে যাই আমি।ভ্রু কুঁচকে দৃষ্টি উপর করি।মা মুখে আনন্দের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।সন্দিহান কন্ঠে জানতে চাই,
– মানে।
মা থতমত মুখে বলল,
– মা..মানে কিছু না।তুমি আগে বলো এই কথা এতদিনে আমাদের জানাওনি কেন?বারিশ নিষেধ করেছে নাকি?
আমার সন্দেহ আরো বাড়লো।আমি সন্দেহের উৎপত্তি মায়ের বলা প্রথম কথাটি থেকে।এখন এই সন্দেহ কাটাতে আমাকে রহস্য উন্মোচন করতে হবে।আর যতক্ষণ না আমি রহস্য উন্মোচন করে আসল কাহিনিটা জানবো ততক্ষণ মনের মধ্যে এটি এমনই গলায় আড়াআড়ি কাঁটা আঁটকে যাওয়ার মতো খচখচ করতে থাকবে।তাই আমি আমাকে চেপে ধরলাম তার বলা কথাটির মর্মার্থ আমাকে বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য।সে বলতে নারাজ।আমতা আমতা করে কোনোভাবে কাটিয়ে যেতে পারলেই তার রক্ষা। তবে আমি ছাড়বো বলে ধরিনি।তাই তাকে অনবরত চাপ দিতে থাকলাম বলার জন্য।এক পর্যায়ে সে বাধ্য হয়ে বলে উঠলো,
– আসলে এই কথাটা শুণতে তুমি ভীষণ কষ্ট পাবে।তোমার আর বারিশের সম্পর্কে চির ধরবে যা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারবো না।বারিশ যেমনই হোক সে আমর ছেলে। আমি কখনো চাইবো না সে কষ্টে থাকুক।
আমি স্থির দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে আছি।আর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি তার কথার মর্মার্থ বোঝার জন্য। সে একটি ছোট শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
– আসলে বারিশের বাবা তার সব সম্পত্তি উইলে বারিশের বাচ্চার নামে লিখে গিয়েছে।তাই বারিশ বিয়ে করতেই চায়ছিল না।কারণ বিয়ের পর বাচ্চা হলে সব সম্পত্তির মালিকানা হারাতে হবে।ও বিয়ের সময় শর্তও দিয়েছিল ও যাকে বিয়ে করবে সে যেন কখনো মা হতে না পারে।
চমকে উলাম আমি।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিনা বারিশ এমন কিছু চায়তে পারে।আমি বিস্ময় নিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে মায়ের দিকে চেয়ে আছি।মা আমার থুঁতনিতে হাত রেখে বিগলিত হেসে বললেন,
– কিন্তু আমি খুব খুশি হয়েছি যে তুমি অবশেষে বারিশের এই ভুল ধারণাটাকে ভাঙতে সক্ষম হয়েছ।এবং এই বংশের নতুন প্রজন্মকে পৃথিবীতে আনার জন্য ওকে রাজি করিয়েছ।আমি জানতাম তুমিই পারবে।তবে বারিশ এতো তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে যাবে ভাবিনি।আমার কি যে ভালো লাগছে তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।আচ্ছা আমি যাই দেখি সবাইকে মিষ্টি খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি।
আমি মূর্তির মতো নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছি।আমার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।বারিশ যদি বাচ্চা নাই চায়বে তাহলে বাচ্চার কথা শুনে তার মুখে যে হাসি ফুটেছিল তা কি কৃত্রিম ছিল?বারিশ নিজেই কি তাহলে?হয়তো! আমাকে নিজের সম্পর্কে অজ্ঞাত রেখেই হয়তো নিজের কাজ হাসিল করতে চেয়েছিল সে।এবং সক্ষমও হয়েছে।তিন তিনবার সে আমার সাথে একই কাজ করেছে।একদিকে ইচ্ছা করছে কিছু বিশ্বাস না করতে কিন্তু সকল প্রমাণ বারিশের প্রতিকূলে।তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি আর বারিশের সাথে থাকবোনা।বারিশকে দেখলেই আমার বাচ্চাদের কথা মনে পড়বে।দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো আমি।তাই কাউকে কিছু না জানিয়েই আমি বারিশ মেনশন থেকে বেরিয়ে আসি।আসার সময় একটি হাতে লেখা চিঠিও রেখে আসিনি।আমি কাউকে কৈফত দিতে বাধ্য নই।আর যে আমার সন্তানের খুনি তাকেও মোটেও না।বাড়ি থেকে বেরিয়ে আমি আমার সাথে যোগাযোগের সকল রাস্তা বন্ধ করে ফেললাম।কিছু দিনের জন্য স্বদেশ ত্যাগ করে পাড়ি জমালাম বিদেশ।দেড় মাসের মাথায় দেশে ফিরে একটি টেলিভিশন সেন্টারে যোগ দিলাম নিউজ এডিটর অর্থাৎ সংবাদ সংস্করণের কাজে।দেশে আসার পর জানতে পারি বারিশকে মানসিক হাসপাতালে রাখা হয়েছে কাউন্সিলিং এর জন্য।মনে মনে ভাবলাম,”তাকে অনেক আগেই ওখানে পাঠানো উচিত ছিল। যে লোকটা সম্পত্তির জন্য নিজের বাচ্চাকে খুন করে তাকে অন্তত সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বলা যায় না।”
চলবে…