সংসার পর্ব-০৪

0
301

#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব-০৪

রূপায়ন চোখ তুলে তাকাল। অরুপের চোখ, মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ। তার ভাইবোন গুলো কবে এতটা স্বার্থপর হয়ে গেল? অথচ এই ভাইবোনগুলোর জন্যই রূপায়ন নিজের যৌবন হাসিমুখে বিসর্জন দিয়েছিল। দিপা বলল,
-‘কী হলো কথা বলছিস না বড়দাভাই?
রূপায়ন সে কথার উত্তর না দিয়ে, দৃঢ় কণ্ঠে বলল,
-‘ বেড়াতে এসেছিস, যতদিন খুশি থাক। তবে আমি কী করব না করব! সেই ব্যপারে যদি কেউ একটাও কথা বলিস বা নাক গলানোর চেষ্টা করিস। তোদের মতো আমিও ভুলে যাব, তোরা আমার সন্তানতূল্যে ভাইবোন।
কথাটা বলেই চলে গেল রূপায়ন। দীপা কেঁদে দিল। মাকে চিৎকার করে বলল,
-‘তোমার ছেলের যৌবনে টান ধরেছে মা। সে এখন বিয়ে করার জন্য মরে যাচ্ছে। কেন এত বয়সে বিয়ে করতে হবে তাকে? মেয়ে দেখে এসেই এতবড় কথাটা আমাকে বলে দিল। বউ বাড়িতে এলে বোধহয় বাপের বাড়ি আসাই বন্ধ করে দিবে আমাদের।
অরুপ বলল,
-‘ এখনো সময় আছে মা। বড়দাভাইকে আটকাও?
নন্দিতাদেবী আজ আর চুপ করে থাকতে পারল না। বলল,
-‘কেন আটকাবো? রূপায়ন বিয়ে করলে সম্পত্তি ভাগ হয়ে যাবে দেখে? তুই পুরো সম্পত্তি, দোকান, একা লুটেপুটে খেতে পারবি না দেখে? এতে তোর স্বার্থ লুকিয়ে আছে। আমি মা হয়ে তোকে বিয়ে করাতে পারলে রূপায়নকে কেন বিয়ে দিতে পারব না? আমারই ভুল হয়েছে। সারাজীবন বড়ছেলেটার ঘাড় ভেঙে তোদের খাইয়ে, পড়িয়েছি। কখনো বড় ছেলেটার মনের ভেতর কী চলে, বোঝার চেষ্টা করিনি।

-‘ওমনি…ওমনি… পল্টি খেলে মা তুমি?
-‘অরুপ…মুখ সামলে কথা বল।
দিপা বলল,
-‘এতই যখন বড়ছেলের জন্য অস্থির। তাহলে এতদিন বড়ছেলেকে বিয়ে দাওনি কেন?
-‘তোদের জন্য বিয়ে দেইনি। তোরা তো শ্বশুরবাড়ির সংসার করিস। তোদের ননদ, শাশুড়ীকে ভাল লাগে না। ঝগড়াঝাঁটি করে প্রায়ই বাবার বাড়ি এসে পরে থাকিস। তোর ননদ তো তোর ভয়ে তার বাপের বাড়ি আসাই বন্ধ করে দিয়েছে। রূপায়নের বউয়েরও যদি তোদের মতো ননদ, শাশুড়ী ভাল না লাগে! তখন কোথায় যাবি তোরা?
দিপা দমে গেল। অরুপের বউয়ের সামনে মা এতবড় কথা বলতে পারল? অরুপের কথাশুনে মাথা গরম করে, আজ এই বাড়িতে আসাই ভুল হয়েছে।
নন্দিতাদেবী বলল,
-‘রূপায়ন এতগুলো বছর পর যখন, মুখ ফুটে বিয়ের কথা বলেছে। তখন তোরা আর কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াবি না। ছেলেটা সারাজীবন ত্যাগ করেই গেল। বিনিময়ে কী পেল!

রাতে অনুপমা নিজে থেকে ফোন দিল। রূপায়ন ফোন রিসিভ করে, চুপ করে রইল।
-‘মন খারাপ?’
রূপায়নের ঘনঘন নিঃশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছে। অনুপমা চিন্তিত হলো। আবারও বলল,
-‘কী হয়েছে? আমাকে বলা যায় না?
-‘আমার বিয়ের কথা শুনে, আমার ভাইবোনগুলো একটুও খুশি না। অথচ ওদের জন্য আমি কী করিনি অনুপমা?
-‘স্বার্থে টান পরলে, চেনা মুখ গুলো হঠাৎ করেই অচেনা হয়ে যায়।
-‘ঠিকই বলেছো। আমিই ভুল ছিলাম। ওরা আমায় স্বার্থের জন্যই ভালোবেসেছে।
-‘মন খারাপ করবেন না। একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।

অনুপমার জেঠী যতই বলুক, ছেলের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নেওয়ার দরকার নেই। হাজার হলেও মা-বাপ মরা মেয়ে। অচেনা ছেলের সাথে এভাবে হুট করে বিয়ে দেওয়া যায় না। তাই রাতুলকে দিয়ে রূপায়নের দোকানে, বাড়ির আশেপাশে খোঁজ লাগিয়েছিল। সবাই রূপায়নকে ছেলে হিসাবে ভাল বলেছে। খুব প্রশংসাও করেছে। রূপায়নের রঙের দোকানও বড়। ছেলেটার বেশ নাম, ডাক।
রূপায়নকে ফোন করে, পঞ্জিকা দেখে, বিয়ের দিনক্ষণও বলে দিয়েছে জেঠু।

পহেলা ফাল্গুন রূপায়ন- অনুপমার বিয়ে। রূপায়ন আজ সকালে বিয়ের শাড়ি, গহনা, কসমেটিক ঘটককে দিয়ে অনুপমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে। ও সরাসরি মন্দিরে চলে যাবে। ফোনে অনুপমাকে বলে দিয়েছে, ‘রেডি হয়ে জেঠু, জেঠীসহ আর কে কে আসবে! সবাইকে সাথে নিয়ে মন্দিরে চলে আসো। আমি অপেক্ষা করব।’

অনুপমাকে রাতুলদাদার বউ, লালরঙা বেনারসি শাড়ি পরিয়ে দিল। ফর্সামুখে হালকা পাউডার লাগিয়ে দিল, তারপর কপালের মাঝখানে বড় একটা লাল টিপ পরিয়ে দিয়ে চারপাশে সুন্দর করে নকশা এঁকে দিল। চোখে মোটা করে কাজল টেনে, ঠোঁটে লাল টুকটুকে লিপস্টিক পরিয়ে দিল। রূপায়নের পাঠানো স্বর্ণের গলার হার, হাতের বালা, কানেরদুল, আংটি পরিয়ে দিয়ে, চুলগুলো বউ খোঁপা বেঁধে, মাথায় বউ ওড়না পরিয়ে দিল।

-‘কই হলো তোদের? জেঠী তাড়া দিতে এসে অনুপমাকে দেখে, বুকে টেনে নিল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘বধূবেশে আমাদের অনুপমাকে কী সুন্দর লাগছে। আর্শীবাদ করি, জীবনে অনেক সুখী হ মা।
অনুপমা, জেঠীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। জেঠী বলল,
-‘চল দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর শোন, তোর ব্যাগে দুটো সুতি শাড়ি দিয়ে দিয়েছি। তোর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে পরিস। আর তোর যখন যা প্রয়োজন হবে। সব সময় বরের কাছে বলবি। তোর জেঠু বলেছে, রূপায়ন ছেলেটা খুব ভাল।
অনুপমা কেঁদে দিল। চেনা বাড়িঘর ছেড়ে, চলে যেতে হবে, ভাবতেই মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল। জেঠী মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কাঁদে না মা। কোন মেয়েই বাপেরবাড়ি চিরদিন থাকে না। আমিও খুব ছোটবেলায় এই বাড়ির বউ হয়ে এসেছিলাম। সংসারের মায়ায় পড়ে গিয়েছি। এখন বাপের বাড়ির কথা মনেও পড়ে না। চল..চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।

রূপায়নের বন্ধু গোবিন্দ পুরো মন্দিরটা ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে ফেলেছে। আবার সাথে ক্যামেরাও নিয়ে এসেছে। রূপায়ন বরবেশে অনুপমার জন্য অপেক্ষা করছে। আর বার বার ঘড়ি দেখছে। গোবিন্দ নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘কী বন্ধু কেমন লাগতেছে?
-‘অস্থির।
-‘সবারই বিয়ের আগ মুহূর্তে এমন অস্থির অস্থির লাগে বন্ধু। নতুন সম্পর্ক, নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হওয়ার আগে ঠোঁটের কোণে ঝিলমিলে হাসি, বুকের ভেতর দুরুদুরু করে। ইশ, আমিও যদি এই বয়সে তোর মতো আরেকটা বিয়ে করতে পারতাম!
রূপায়ন, গোবিন্দর মাথায় চাট্টি মেরে বলল,
-‘তোর বউকে ফোন করে বলব?
-‘এই না না..খবরদার না। তাহলে আর তোর বিয়ে উপলক্ষে রাতে ভালমন্দ খাওয়া কপালে জুটবে না।
-‘তুই শুধু শুধু ঝামেলা করলি গোবিন্দ। অনুপমাকে নিয়ে নাহয় এখান থেকে বিয়ের পর, আমার বাড়িতেই উঠতাম।
গোবিন্দ বলল,
-‘তোর ভাইবোনদের তো আমার ভাল করে চেনা আছে। একেকটা হারামী বুঝলি! তুই নতুন বউ নিয়ে বাড়ি গেলেই ওরা অশান্তি শুরু করবে। তার থেকে বরং নতুন বউ নিয়ে দুটোদিন আমার বাসায় থাকবি। সুন্দর মুহূর্তগুলো উপভোগ করবি। ভালমন্দ খাবি দাবি । তারপর বউ নিয়ে বাড়ি ফিরবি। জেনেশুনে এই মধুর সময়গুলো হেলায় হারাবি কেন?
‘জীবনে অনেক রাত আসবে বন্ধু। তবে সুখরাতেই যদি সুখী না হও। তারজন্য সারাজীবন আফসোস করতে হবে।’

অনুপমা জেঠীর হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে, ধীরে ধীরে কালী মন্দির এলো। অনুপমাকে বধূবেশে দেখে মুগ্ধতায় রূপায়নের দুচোখ জুড়িয়ে গেল। এই মেয়েটার বাড়াবাড়ি সৌন্দর্য দেখে, রূপায়নের মাথা নষ্ট হওয়ার যোগাড় হয়েছে। বুকের ভেতর মৃদু কাঁপুনি। অনুপমাও মুখ তুলে রূপায়নের দিকে একটুখানি তাকাল। মুচকি হেসে চোখ নামিয়ে নিল। গোবিন্দ, রূপায়নের বউ দেখে নীচু কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল,
-‘চাঁন্দের মতো সুন্দরী মেয়েটা কোত্থেকে জোগাড় করলি বন্ধু? তোদের বাড়ির সবাই নতুন বউয়ের রুপের আগুনে ঝলসে যাবে বন্ধু। বিশেষ করে তোর ছোটভাইয়ের বউটা, হিংসায় জ্বলেপুড়ে মরবে।
রূপায়ন চোরা হেসে এগিয়ে গেল। জেঠুকে বলল,
-‘আসতে কোন সমস্যা হয়নি তো আপনাদের?
-‘না বাবা। চলো লগ্ন বয়ে গেল।

রূপায়ন-অনুপমা মা কালীকে সাক্ষী রেখে, বিয়েতে বসল। পুরোহিত মশাই মন্ত্র পাঠ করছে। অনুপমা নকশা আঁকা পিঁড়িতে বসে, পানপাতা দিয়ে মুখ ঢেকে এলো। সবার বলায়, আস্তে আস্তে পানপাতা সরাতেই শুভদৃষ্টি হলো, দুজনই দুজনকে দেখে লাজুক হাসল। মালা বদল হলো। জেঠু কণ্যা সম্পাদান করে অনুপমার হাত রূপায়নের হাতে তুলে দিল।
সাত পাঁক ঘুরে, অনুপমার সাদা সিঁথিতে রূপায়ন লালরঙা সিঁদুর লেপ্টে দিল। অনুপমা আবেশে দুচোখ বুজে ফেলল। মনে মনে বলল, ‘আমার মৃত্যুর এক সেকেন্ড আগ পর্যন্ত যেন, বরের দেওয়া সিঁদুর সিঁথিতে পরতে পারি ভগবান।’
রূপায়ন নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘তুমি এই মুহূর্ত থেকে একান্তই আমার হয়ে গেলে অনুপমা। আমাদের এই পবিত্র বন্ধন যেন সাতজনম অটুট থাকে।’
গোবিন্দ, রূপায়ন- অনুপমার অনেকগুলো কাঁপল ছবি তুলে দিল।

রূপায়ন সবাইকে রাতে থেকে যেতে বলল। কেউ রাজি হলো না। গোবিন্দর বাসা থেকে ভরপেট খেয়েদেয়ে রাতের বাসেই চলে গেল। অনুপমা জেঠু জেঠীকে বিদায় দেওয়ার সময় অনেক কাঁদল। তারা সবাই চলে যেতেই রূপায়ন, অনুপমার হাতদুটো আলতো করে ধরে বলল,
-‘মন খারাপ করো না। আমি সময় পেলেই তোমাকে তোমার বাড়ি থেকে ঘুরিয়ে আনব।
গোবিন্দ বলল,
-‘বন্ধু অনেক রাত হয়েছে। বৌদিকে ঘরে নিয়ে যা…রেস্ট নে।
রূপায়নের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-‘আজ কিন্তু কালরাত্রি। উল্টাপাল্টা কিছু করো না বন্ধু। কথাটা বলেই গোবিন্দ ব্যস্ত পায়ে নিজের ঘরে চলে গেল।

রূপায়নদের যে ঘরে শুতে দেওয়া হয়েছে। সেই ঘরটা গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। ঘরের মেঝেতে মোমবাতি দিয়ে লাভ আর্ট করেছে। মোমবাতিগুলো মিটিমিটি জ্বলছে। রূপায়ন বিড়বিড় করে বলল,
-‘শালা বাসরঘর সাজিয়ে ফেলেছে। আবার বলে, উল্টাপাল্টা কিছু করিস না।
রূপায়নের সাথে একাকী ঘরে অনুপমার মিশ্র অনুভূতি হচ্ছে। ভালোলাগা, ভয়, লজ্জা।
রূপায়ন, অনুপমার হাত ধরে খাটে বসিয়ে দিল। নিজেও পাশে বসল। বলল,
-‘আমাকে এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই অনুপমা। আমি তোমার প্রিয়জন হতে চাই!
অনুপমা মাথা নেড়ে সায় দিল। রূপায়ন আলতো করে অনুপমার মাথাটা নিজের বুকের মাঝে রাখল। আবেগী কণ্ঠে বলল,
-‘শরতের একপলশা বৃষ্টির মতো হঠাৎ করে, আমার জীবনে আসার জন্য, আমার ধু ধু মরুভূমির মতো তৃষ্ণার্ত বুকে উষ্ণতার শীতল ছোঁয়া দিয়ে, আমাকে নতুন এক সম্পর্ক, কিছু সুন্দর মূহুর্ত, সুখ সুখ অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক অনেক…………!

(চলবে)