#সংসার
#লেখা_Bobita_Ray
পর্ব- ১৮
রূপায়ন পরপর তিনটে বড় অর্ডার ডেলিভারি দিয়েছে। কিছু টাকা সংসার খরচ বাবদ হাতে রেখে, বাকি টাকা ব্যাংকে জমা করে দিল। বাড়ি যাওয়ার সময়, ফুটপাতের ফলের দোকান থেকে দরদাম করে, মাল্টা, আনার, আপেল কিনে নিল।
অনুপমা শুয়ে ছিল। ইদানীং প্রচণ্ড মাথা ঘুরে, শরীর থরথর করে কাঁপে। আর এত পরিমাণ ঘাম হয়। ফ্যানের বাতাসেও শরীর ঘামে চিটচিট করে। নিপা এসে অনুপমার ঘা ঘেঁষে বসল। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
-‘কিছু খাবা বৌদি?
অনুপমা চোখ মেলে তাকাল। ধীর কণ্ঠে বলল,
-‘না। এখন কিছু খাব না। তোমার বড়দাভাই কী এসেছে?
-‘না তো!
বলতে বলতে রূপায়ন ঘরে এলো। অনুপমাকে দেখে মৃদু হেসে দিল। ঘামে ভেজা শার্টটা টেনে খুলতে খুলতে বলল,
-‘অনেক বড় অর্ডার ডেলিভারি দিলাম আজ। আমাদের বাবুটা অনেক ভাগ্য নিয়ে আসছে! বুঝলে অনুপমা?
নিপার মনটা হিংসায় জ্বলে গেল। বড়দাভাইয়ের সাথে ভাল কিছু ঘটলেই সবসময় বাবুটাকে টানে। অসহ্য!
রূপায়ন বেলকনিতে গিয়ে, প্যান্ট ছেড়ে লুঙ্গি পরে ঘরে এলো। কিছু ফল অনুপমার জন্য তুলে রেখে, বাকি ফলগুলো নিপার হাতে ধরিয়ে দিল। বলল,
-‘এগুলো মাকে নিয়ে দিবি। যা…
নিপা উঠে গেল না। ফলগুলো হাতে নিয়ে বসে রইল। রূপায়ন, হাতমুখ ধুয়ে, ফলগুলো ধুয়ে, কেটে নিয়ে এলো। অনুপমাকে আস্তে করে ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দিল। মুখের সামনে ফলের বাটি ধরে বলল,
-‘খাও.?
অনুপমা ফলের বাটি হাতে নিয়ে, নিপাকে বলল,
-‘তুমিও নাও?
নিপা নিল। রূপায়ন, অনুপমার পাশে বসে নিজেও খেলো, অনুপমাকেও খাইয়ে দিল। স্বামী-স্ত্রীর এত ভালোবাসা , এত আদর-যত্ন দেখে, নিপার চোখে জল এসে গেল। সৌরভের সাথে প্রেম করেই বিয়ে করেছিল নিপা। তারপরও সৌরভের কেন নিপাকে ঠকিয়ে আরেক জনকে বিয়ে করতে হলো? সৌরভের সাথে খুনসুটিময় রাতগুলোর কথা মনে পড়লেই অনুপমাকে প্রচুর হিংসে হয় নিপার। সবকিছু লণ্ডভণ্ড করে দিতে ইচ্ছে করে। এমনকী অনুপমাকে গলা চেপে ধরে মেরে ফেলতেও ইচ্ছে করে। তবে কী নিপা পাগল হয়ে যাচ্ছে? নিপাকে যারা যারা ভালোবাসতো, তারাই একটু একটু করে দূরে সরে যাচ্ছে। বড়দাভাইটাও এখন আর নিপাকে ভালোবাসে না বোধহয়। শুধু দায়িত্বগুলো একটার পর আরেকটা পালন করে যায়৷ আগে সব ভাইবোন একসাথে বসে কত গল্পগুজব করতো, রাতভর আড্ডা চলত। আর এখন? বড়দাভাই দোকান থেকে ফিরেই সোজা নিজের ঘরে চলে আসে। বৌদিকে নিয়ে ব্যস্ত থাকে৷ সব নষ্টের মূল এই বৌদির পেটে বেড়ে ওঠা বাচ্চাটা। নিপার মন জানে! এই বাচ্চাটা কোন কারণে নষ্ট হয়ে গেলে, বড়দাভাই আবার আগের মতো হয়ে যাবে৷
-‘কী রে নিপা যা..
নিপা থতমত খেলো। অবাক হয়ে বলল,
-‘কোথায়..কোথায় যাব?
-‘মাকে ফলগুলো দিয়ে আয়।
-‘বড়দাভাই তোর কাছে টাকা হবে?
-‘কেন কী কিনবি?
মনে মনে বলল,
-‘তোর বাচ্চা নষ্ট করার ঔষধ কিনবো রে গাধা।
মুখে বলল,
-‘একটু দরকার ছিল।
রূপায়ন শার্টের পকেট থেকে পাঁচশো টাকার দুটো নোট বের করে নিপার হাতে ধরিয়ে দিল। নিপা টাকা গুলো নিয়ে খুশি মনে চলে গেল।
রাতটা একপ্রকার ছটফটিয়ে কাটলো নিপার। পরেরদিন সকাল সকাল বাসা থেকে বের হয়ে গেল। আশেপাশের ঔষধের দোকানদার একনামে বড়দাভাইকে চিনে। নিপা রিস্ক নিল না। অপরিচিত একটা দোকানে ঔষধ কিনতে গেল। দোকানদার অদ্ভুত চোখে একবার নিপার দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার ঔষধের দিকে। বলল,
-‘এই ঔষধ দিয়ে কী করবেন আপনি?
নিপা কাঁদো কাঁদো মুখ করে, নীচু কণ্ঠে বলল,
-‘একটা অবিবাহিত মেয়ে এই ঔষধ দিয়ে কী করে? আসলে…
দোকানদার বিরক্ত হয়ে বলল,
-‘থাক..থাক আর বলতে হবে না। এগুলো কোত্থেকে যে আসে!
ঔষধগুলো প্যাকেট করে দিয়ে বলল,
-‘নিয়ম জানা আছে?
নিপা মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বোঝাল। একটা পাঁচশো টাকার নোট দোকানদারের হাতে দিয়ে তড়িৎ গতিতে চলে গেল। দোকানদার চিল্লিয়ে বলল,
-‘এই যে ম্যাম শুনে যান?
নিপা আর সেদিকে ফিরেও তাকাল না। একটা রিকশা ডেকে তাতে চেপে বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ফোন বের করে দেখল, জয়ন্তর অনেকগুলো মিসকল। নিপা কলব্যাক করে বলল,
-‘এতবার ফোন দিয়েছো কেন জয়ন্তদা?
-‘তোমার বৌদি বাপের বাড়ি গেছে। বাসা একদম ফাঁকা। আজ একবার চলে আসো না নিপা বেবী?
-‘আজ আসতে পারব না।
-‘তা বললে তো হবে না জান! পাঁচমিনিট টাইম দিলাম। চলে আসো?
-‘ বললাম তো আমি এখন যেতে পারব না জয়ন্তদা।
জয়ন্ত শুকনো ঠোঁট জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে বলল,
-‘ তোমার কত সুন্দর সুন্দর ছবি আমার কাছে আছে নিপা। ওই ছবিটা বেশি সুন্দর, যেটা স্নান করার সময় নগ্ন হয়ে তুলেছিলে। তোমার মুখের এক্সপেরিমেন্টটা সেই ছিল। আরেকটা আছে, ওই যে তোমার বুকের…
নিপা ভীতু কণ্ঠে
-‘চুপ করো জয়ন্তদা।
-‘আমি তো চুপ করেই থাকতে চাই জান। শুধু তুমি এসে আমাকে খুশি করে দাও..?
-‘আমি আজ যেতে পারব না। বললাম তো!
-‘তাহলে যে ছবিগুলো ফেসবুকে তোমার নাম, ঠিকানাসহ ভাইরাল হয়ে যাবে নিপা বেবী।
-‘ছিঃ তুমি এতটা খারাপ?
-‘তোমার থেকে বোধহয় বেশি খারাপ না। আমি অপেক্ষা করছি। জলদী চলে আসো..!
নিপা ফোনটা রেখে দিয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগল। সৌরভের সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর পর, নিপা প্রায়ই পাশের বাড়ির জয়ন্তদার বউয়ের কাছে গিয়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজের দুঃখের গল্প করতো। জয়ন্তদা বাসায় থাকলে ওদের সাথে বসে নিপার দুঃখের গল্প খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতো। নিপাকে সমবেদনা জানাতো। একদিন নিপা ঝড়বৃষ্টি মাথায় করে, বিকেল বেলা গিয়ে দেখল, বৌদি বাসায় নেই। সারাবাড়িতে জয়ন্তদা একা। নিপাকে জোর করে রুমের ভেতরে টেন নিল জয়ন্ত। তারপর দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে বলল,
-‘আরেহ.. ভয় পাচ্ছো কেন নিপা? তোমার বৌদি বাসায় নেই তো কী হয়েছে? আমি তো আছি। তোমার সব দুঃখের গল্প শুনবো আজ। শুধু তাই নয়, অতিরিক্ত সুখ দিয়ে সমস্ত দুঃখের অবসান ঘটিয়ে দেব।
এই ঝড়বৃষ্টির দুপুরে, ফাঁকা বাড়িতে নিপাকে একাকী পেয়ে জয়ন্ত এতটাই ভালোবাসা দিল। ভীতু, অস্থির, ছটফটে নিপাও ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে গেল। নিজে থেকেই ঘনিষ্ঠ হলো জয়ন্তর সাথে।
সেই থেকে শুরু। প্রায়ই কাউকে না বলে, এখানে-সেখানে জয়ন্তর সাথে চলে যায় নিপা। জয়ন্তর আবদার রাখতে ইমোতে নিজের নগ্ন ছবি দেয় নিপা। কখনো অর্ধনগ্ন হয়ে জয়ন্তর সাথে ভিডিও কলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে। জয়ন্ত, নিপাকে টাকাও দিতো। কিন্তু কে জানতো, বেঈমানটা নিপাকে এইভাবে ব্ল্যাকমেইল করবে? নিজের বোকামীর জন্য এখন প্রচুর রাগ লাগছে। ইচ্ছে করছে জয়ন্তদার টুটি চেপে ধরতে। নিপারও দিন আসবে! তখন কাউকে ছাড়বে না নিপা।
যে ঔষধ অনুপমার জন্য কিনে এনেছিল নিপা। কেন জানত, কিছুদিনের ব্যবধাণে সেই ঔষধ নিজেকেই খেতে হবে? পিরিয়ডের ডেট হিসেব করে ও প্রেগন্যান্সি কিট পরিক্ষা করে জানতে পারল নিপাও প্রেগন্যান্ট। দুইমাস রানিং..
জয়ন্তর অবৈধ সন্তান নিপার গর্ভে। ভাবতেই রাগে, দুঃখে ঘাম ছুটে গেল। এই বাড়ির কেউ যদি ভুলেও এই কথা জানতে পারে! তাহলে যে কী হবে? ভাবলেই নিপার দম বন্ধ হয়ে আসে। খুব বেশি দেরি হওয়ার আগেই নিপা একদিন রাতে সাহস করে ঔষধগুলো খেয়ে ফেলল। মাত্র কিছুক্ষণের ব্যবধাণে পেটের ভেতর ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেল। অসহ্য পেট ব্যথা সহ্য করতে না পেরে নিপা চিৎকার করে কেঁদে দিল। রূপায়ন ধড়ফড়িয়ে উঠে বসল। হন্তদন্ত পায়ে দরজা খুলে নিপার ঘরে ছুটে গেল। ততক্ষণে সীমা, অরুপও এসে গেছে। রূপায়ন দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল,
-‘কী হয়েছে নিপা কাঁদছিস কেন? দরজাটা খুল?
অতিরিক্ত ব্যথায়, আতঙ্কে, ভয়ে, নিপার হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। এদিকে পেটের ব্যথা ক্রমশ বাড়ছে। তবে দরজা খোলার সাহস পাচ্ছে না। রূপায়ন দৌঁড়ে গিয়ে মায়ের ঘর থেকে চাবি এনে দরজাটা খুলে ফেলল। ভেতরে ঢুকে, নিপাকে বিছানায় গলাকাটা মুরগির মতো কাতরাতে দেখে, অস্থির হয়ে বলল,
-‘কী হয়েছে নিপা? এমন করছিস কেন?
সীমা ঘরের লাইট জ্বেলে দিল। বিছানায় তাজা রক্ত দেখে সবাই ভয় পেয়ে গেল। রক্তের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সবাই আঁতকে উঠল। নিপার পুরো সালোয়ার রক্তে ভেজা। সীমা অস্ফুট স্বরে বলল,
-‘নিপা বোধহয় বাচ্চা নষ্ট করছে!
অরুপ রেগে বলল,
-‘তোমার মাথা ঠিক আছে সীমা? কী সব যা-তা বলছো?
সীমা শুকনো ঢোক গিলে বলল,
-‘আমি ঠিকই বলছি।
রূপায়ন, নিপার একহাত চেপে ধরে, অস্থির কণ্ঠে বলল,
-‘তুই এমন করছিস কেন নিপা?
নিপা বুঁজে আসা কণ্ঠে বলল,
-‘আমাকে বাঁচা বড়দাভাই? আমি মরে গেলাম।
রূপায়ন, সীমাকে বলল,
-‘ওর পোষাক পাল্টে দাও। অরুপ রাস্তায় গিয়ে দ্যাখ কোন গাড়িটারি পাওয়া যায় না কী!
সীমা জোর করে নিপার পোশাক পাল্টে দিল। রূপায়ন পাজকোলা করে ধরে, নিপাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল। একালার মানুষের মুখে মুখে রটে গেছে। নিপা অবৈধ সন্তান নষ্ট করতে গিয়ে, ধরা খেয়েছে। জামাইয়ের সাথে না ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে? তাহলে নিপার পেটে কার সন্তান ছিল?
ছোট মেয়ের অপকর্মের কথা জেনে নন্দিতাদেবী খুব ভেঙে পড়লেন। ছিঃ মেয়েটা নামতে নামতে এতটা নীচে নেমে গেছে! ভাবতেও ঘৃণা লাগছে।
রূপায়ন, নিপার মুখোমুখি বসল। হিম শীতল কণ্ঠে বলল,
-‘বাচ্চাটা কার ছিল নিপা?
নিপা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল। রূপায়নের রক্তলাল চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে, চোখ নামিয়ে নিল নিপা। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
-‘সৌরভের।
অরুপ তেড়ে এলো। নিপার গালদুটো চেপে ধরে বলল,
-‘ সত্যি করে বল বাচ্চাটা কার ছিল? ঢঙ মারাইলি, সৌরভের সাথে সংসার করবি না। তাহলে সৌরভের বাচ্চা তোর পেটে আসলো কেমনে?
-‘আহ্.. নিপাকে ছাড় অরুপ। ওর শরীর খুব দূর্বল।
-‘তুই চুপ কর বড়দাভাই। হারামী গুলো বাড়তে বাড়তে অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এই ঘটনা লোক জানাজানি হলে মান-সম্মান থাকবে?
রূপায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-‘অনুপমা ফোন দিয়েছিল। রীতিমতো পুরো এলাকায় মুখে মুখে নিপার ঘটনাটা রটে গেছে। অনেকেই না কী এই রাত্রিবেলা, বাড়ি বয়ে এসে, খুব কৌতূহল নিয়ে নিপার ব্যপারটা জিজ্ঞেস করছে। মাকে খুব অপমান করেছে।
অরুপ বলল,
-‘বেশ হয়েছে। এবার ও লোকের সামনে মুখ দেখাবে কীভাবে আমিও দেখে নেব!
নন্দিতাদেবী এত মানসিক চাপ আর নিতে পারল না। এই রাত্রিবেলা স্ট্রোক করে বসল। কেউ জানতেও পারল না। উপরের ঘরে একটা প্রাণপাখি চিরদিনের মতো এই দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে। নন্দিতাদেবীর দমটা যখন ভেতর থেকে বেড়িয়ে গেল, তখন মানসপটে একটা মুখ ভেসে উঠল। ‘রূপায়ন’ বহুকষ্টে দুঠোঁট নেড়ে বিড়বিড় করে বলল,
-‘আমার এই বড় ছেলেটাকে ভাল রেখো ঠাকুর।
মুখদিয়ে নালার সাথে প্রাণটাও ভেতর থেকে ফুড়ুৎ করে বেড়িয়ে গেল। সময়ের সাথে সাথে মাটির নরম দেহখানা ধীরে ধীরে শক্ত আর ঠাণ্ডা হয়ে এলো। আহা..যে ছেলেমেয়েদের জন্য সারাটা জীবন একাকী কাটিয়ে দিল নন্দিতাদেবী। মৃত্যুর সময় সেই ছেলেমেয়েদের কাউকেই আর পাশে পেল না। এসেছিল একা! চলেও গেল একা। শুধু পড়ে রইল, কিছু খুচরো সম্পর্ক, কিছু মায়া, কিছু স্মৃতিকথা।
(চলবে)