#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|১২+১৩|
কী ভয়ানক দুটো অপশন। অথচ প্রিয়র যেকোনো একটিকে বেছে নিতে সময় লাগল না। সে যেন প্রস্তুত ছিল। তার ধারণা, এরকম দুটো অপশন সামনে না রাখা হলে, সে মরার আগ অবধি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগবে। প্রিয় সকল দ্বিধাকে পাশে রেখে গায়ের ব্যথাকে সয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। মায়ের ঝুঁকে থাকা মুখের অভিমুখে তাকিয়ে ভেজা আওয়াজে বলে উঠল,
-“আমি তোমায় চুজ করলাম, আম্মু।”
তারপর যেভাবে পেরেছে নিজের রুমে প্রবেশ করে দরজা আটকে ফেলেছে। শরীরের ব্যথার চেয়ে মনের ব্যথা তীব্র। মস্তিষ্ক স্মৃতিচারণ করছে। একবার ভাবছে শ্রেয়ানের সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত, পূনরায় ভাবছে মায়ের সাথে বন্ধুসুলভ আচরণ। সেদিনই তো শ্রেয়ান তাকে প্রপোজ করল, রোজ ঢের রাত অবধি ফোনে প্রেমালাপ চলত। একে অপরের সাথে সব ধরনের কথা বলত। বর্তমানে কে, কেমন, কী পছন্দ করে—এসব কথা শেষ দিয়ে নিজেদের অতীতের গল্প বলত। কখনও কথা শেষ হতো না। সে রাতেই না লুকিয়ে-চুরিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে দু’জন পুরো শহরের যতটা পেরেছে পায়ে হেঁটে বেড়াল? সবই তো ঠিক ছিল। কী থেকে কী হয়ে গেল হঠাৎ? ওরা বলে, দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়। ওরা কি জানে, দূরত্ব দূরে যাওয়ার গল্প শোনায়, দূরত্ব ভুল বোঝাবুঝি বাড়ায়। ওরা কি জানে, দূরত্ব মাঝেতে দেয়াল বানায়? জানে না। দূরত্ব সুন্দর নয়। চোখেচোখে রেখে করা কথার আঘাতও দূরত্বের চেয়ে ঢের ভালো। প্রিয়র অন্তত তাই লাগত। কিন্তু এখন আর সেসব বলে লাভ নেই।
বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে। আর পারছে না। তীব্র ব্যথায় গাঁ কেঁপে কেঁপে জ্বর আসছে। চোখ খুলে রাখা দায়!
প্রিয়র চলে যেতেই নাহারা প্রহরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“ওর কাছে যেয়ো না এখন। নিজেকে সামলাতে দাও। ক’দিন বোনের খেয়াল রেখো। আর ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো তোমার বাবার কানে দিয়ো না। মানুষটা ভীষণ কষ্ট পাবে। আপাতত ওর হাতে ফোন দিয়ো না। সম্ভব হলে, ওর বা তোমার কোনো বান্ধবীকে বলো ওর কাছে এসে থাকতে। আত্মীয়দের কাউকে আনা যাবে না, সবাই জেনে যাবে।”
প্রহর জানাল,
-“ঠিক আছে।”
-“আজই আসতে বলো।”
-“রাত ৮টা বাজে, আম্মু!”
-“তোমার বোনকে একা রাখতে পারব না আমি। ওর নিজের প্রতি মায়া নেই। মরে পড়ে থাকলেও কেউ টের পাব না।”
-“আচ্ছা।”
প্রহরের থেকে ইতিবাচক জবাব পেয়েই নাহার নিজের রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করেই এতক্ষণের শক্ত খোলস ভেঙে পড়ল। নুইয়ে পড়ল তার ভেতরের সত্তা। চোখ ভিজে উঠল, অশ্রু মেঝে স্পর্শ করল, অন্তরটা হয়ে উঠল অশান্ত। মেয়েটা কেন এমন ভুল পথে গেল!
____
রুমে পৌঁছিয়েই প্রহর আয়াতের নাম্বারে কল লাগাল। আয়াত ফেসবুকিং করছিল। এভাবে হুট করেই প্রহর কল পেয়ে আনন্দে চেহারা উজ্জ্বল হয়ে উঠল। প্রহর তাকে সচরাচর কল দেয় না। সে নিজেই কারণে-অকারণে জোর খাটায়। বলা যায়, সারাটাক্ষণ রোড-সাইডারদের মতো প্রহরকে টিজ করে বেড়ায়। প্রহরও বখাটেদের মতো আয়াতকে প্রতিবার ইগনোর করে। আয়াত তাতে দমে যায় না। প্রহরকে দেখলেই সিটি বাজানো, ডাবল মিনিং কথা-বার্তাসহ আরও অনেক কিছুই করে যায়।
স্ব-অভ্যেসে আবৃত থেকেই আয়াত কল রিসিভ করে বলল,
-“ইয়েস, বেইব! মিস করছিলি?”
প্রহর আয়াতের কথাটাকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে শুধাল,
-“কী করছিস?”
-“তোকে মিস করছি রে, জানু। তুই? জানিস, তোদের ব্যাচমেট রাদিফ আছে না? ও আজ আমাকে প্রপোজ করেছে। আমি জানতাম ও আমাকে পছন্দ করে। কিন্তু বুঝিনি, সরাসরি প্রপোজ করে দেবে। তাই একটু অবাক হওয়ার নাটক করেছি। নীল রঙের একটা অবাক হয়ে জমে যাওয়ার ইমোজি আছে না? ওটা দিয়ে বলেছি—আমি তো প্রহরের গার্লফ্রেন্ড, ভাইয়া আপনি জানেন না? বেচারা তা শুনে এতটাই শক খেয়েছে যে সঙ্গে সঙ্গে ভাবি ডেকে সরি-টরি বলে বাঁচে না। তোর নামের মধ্যে জাদু আছে বিশ্বাস কর। আমার সব প্রবলেম মিনিটে সলভ হয়ে যায়..”
প্রহর গভীর শ্বাস ফেলল। এই মেয়ের অনুভূতি সে বুঝতে পারে, অনুভব করতে পারে। কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে পারে না। সর্বদা এড়িয়ে যায়। সে কাছ থেকে প্রিয়র পরিস্থিতি দেখেছে, প্রিয়কে কাঁদতে দেখেছে। তারপর এসবের প্রতি বিতৃষ্ণা এসে গেছে আর জড়ানোর সাহস পায় না।
তাই সোজা কথায় এলো,
-“আমার বাসায় আসতে পারবি?”
বিষম খেলো আয়াত। এদিক-ওদিক তাকিয়ে নিশ্চিতকরণ প্রশ্ন শুধাল,
-“আরেকবার বলবি?”
-“আমার বাসায় আসতে হবে। প্রয়োজন।”
আয়াতের মাথাটা এখনই একটা দুষ্টুমি আইডিয়া নিয়ে লাফাচ্ছিল, প্রহরকে আচ্ছামতো জ্বালানো যেত। কিন্তু যখনই প্রহর ‘প্রয়োজন’ শব্দটা উচ্চারণ করল, সেই মুহূর্তে আয়াত নিভে গেল। নরম সরে জিজ্ঞেস করল,
-“কোনো সমস্যা?”
-“হুঁ।”
-“কবে আসতে হবে?”
-“আজ।”
কিছুটা থেমে আবারও জিজ্ঞেস করল,
-“পারবি? বাড়ি থেকে আসতে দেবে?”
-“দেবে। আসছি।”
-“এক সপ্তাহের প্যাকিং করে আসিস।”
-“ওকে।”
এমন সুযোগে আয়াতের খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে। দৌড়ে বাবার রুমে চলে গেল। এখন গিয়ে আবদার জুড়ে বসবে এক ফ্রেন্ডের বার্থডে সেলিব্রেটের জন্য তার বাসায় গিয়ে থাকার। তাতে অবশ্যই রাজি হবে। পরে না হয় কিছু একটা বলে আরও ক’দিনেরটা ম্যানেজ করা যাবে। যাক! পরেরটা পরে দেখা যাবে।
____
প্রিয় শ্রেয়ানের সাথে আর কন্ট্যাক্ট করেনি, কিন্তু শ্রেয়ান পিছুও ছাড়েনি। তিনদিন ধরেই গাড়ি নিয়ে সময়ে-অসময়ে ব্যালকনির সামনের রাস্তায় এসে ৩ বার করে হর্ন বাজিয়ে যায়। প্রিয় থমকে থাকে। সে নিজেকে আটকাতে হিমশিম খায়। খুব কষ্ট হয় তার।
আয়াত এসে যথাসম্ভব প্রিয়র কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করেছে, সবসময় প্রিয়কে ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। সে কথার ছলে সারাক্ষণ প্রিয়কে হাসাতে চায়। কিন্তু প্রিয় উদাসী হয়ে থাকে, হাসে না। সে খুব লক্ষ করেছে, ইদানিং প্রিয় কান্না করে না। কী যেন ভাবতে থাকে! তারপর হুটহাট চমকে ওঠে। তখন আয়াত অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে।
বারান্দায় বসে বসে বই পড়ছিল প্রিয়, আয়াত ঠিক তার সামনের দোলনাটিতে দোল খেতে খেতে ফোন টিপছে। এরই মধ্যে আবারও সেই তিনবারের হর্নটা বাজতে লাগল। প্রিয় জমে গেল। তার নজর বিক্ষিপ্ত, শ্বাস এলোমেলো। ব্যাপারটা আয়াত লক্ষ করল। সেই গাড়িটা চলে গেল আরও ১৫ মিনিট পর। প্রিয়ও স্বাভাবিক হলো। পরিস্থিতি অনুকূলে আসতেই আয়াত প্রিয়কে বলে উঠল,
-“আপু, কোনো সমস্যা?”
প্রিয় ডানে-বাঁয়ে মাথা নেড়ে নেতিবাচকতা প্রকাশ করল। আয়াত দম ফেলে বলতে লাগল,
-“কিছু কথা বলতে চাই। বলব?”
প্রিয় প্রশ্নাত্মক চোখে তাকায় ওর দিকে। আয়াত হেসে হেসে বলে,
-“জীবন কখনও কারো জন্য থেমে থাকে না। সবচেয়ে সত্য একটি কথা, সবচেয়ে ফলে যাওয়া একটি কথা। মানো তো?”
মলিন আওয়াজে প্রিয় বলল,
-“মানি।”
-“মুভ অন করছ না কেন?”
-“আমি আসলে বুঝতেই পারছি না কী হচ্ছে। কী করব সেটা কীভাবে বুঝি, বলো?”
-“ডিটেইলস বলো তো।”
-“সম্পর্কটা একদিনের নয়। সাড়ে চার বছরেরও বেশি। পরিচয়ের শুরু থেকে ধরতে গেলে পাঁচ বছর পেরিয়েছে। একটা মানুষের সাথে আমার এতটা সময় জড়িয়ে থাকাটা.. আমি রেশ কাটাতে পারছি না। চোখ বন্ধ করলেও মনে হচ্ছে, এই তো কালই ওর সাথে কথা হয়েছে। মনে হচ্ছে, এই তো কালই সব ঠিক ছিল, কালই আমি শেষ রাত অবধি বকবক করলাম ওর সাথে। তারপর চোখ খুলতেই দেখি আমার সাজানো দুনিয়ার সবকিছু এলোমেলো। সেদিনই না সব ঠিকঠাক ছিল? আমি আসলে মানতে পারছি না কীভাবে কী হলো.. আমি সব ভুলতে পারছি না।”
প্রিয় এটুকু বলে থামল। চোখ বন্ধ করে চেয়ারের পেছনে ঝুঁকল, মাথা গিয়ে ঠেকল দেয়ালে। মিনমিনে স্বরে পুনরায় বলল,
-“ওর ভালোবাসা ছিল চোরাবালির ন্যায়। যতক্ষণ আমি স্বাভাবিক ছিলাম, ততক্ষণ আমি এর ভয়াবহতা অনুভব করতে পারিনি। যেই আমি উঠে পড়ার চেষ্টা করতে লাগলাম, ওমনি চোরাবালি আমাকে আঁকড়ে ধরে ভেতরের দিকে টানতে লাগল। মৃত্যু ছাড়া না আর উপায় পাচ্ছি না। এদিকে আমি সুইসাইড করার মতো সাহসীও নই; মৃত্যুতে আমার প্রচুর ভয়। আমি দিগবিদিকশূন্য হয়ে তাকিয়ে আছি। শান্তি প্রয়োজন। আল্লাহ আমায় মৃত্যু দিক…”
আয়াত অকস্মাৎ চেঁচিয়ে উঠল,
-“আল্লাহ! কী বলো! চুপ! এসব বলতে নেই। আমরা যারা তোমায় ভালোবাসি, তারা সবসময় চাই তোমার সব দোয়া পূরণ হোক। এখন তুমি এমন দোয়া করলে কীভাবে কী হবে?”
প্রিয় মলিন হাসে,
-“হলে মন্দ হবে না।”
-“খুব মন্দ হবে। প্রহরের কথা ভাবছ না? আন্টি-আঙ্কেলের কথা ভাবছ না?”
-“ভাবছি। ভাবছি বলেই নিঃশ্বাস নিচ্ছি।”
-“আপু, তুমি খুব ডিপ্রেসড, বুঝেছি। কিন্তু আমার কথা শোনো।”
-“হুঁ।”
আয়াত উঠে এসে প্রিয়র পাশের বেতের চেয়ারটিতে বসল। হাত থেকে বই নিয়ে সেন্টার টেবিলে রেখে প্রিয়র দু’হাত ধরে বলল,
-“আমার দিকে তাকাও, আপু।”
প্রিয় তাকায় ওর দিকে। আয়াত চোখে চোখ রেখে বলে,
-“আমি তোমাকে উপদেশ দেবো না। উপদেশ দেওয়া আমার পছন্দ নয়। আমি তোমাকে দেবো কিছু কথা। মন দিয়ে শোনো। পৃথিবীতে বিকলাঙ্গ অসংখ্য মানুষ আছে। কারো দুটো চোখ নেই, হাত নেই, পা নেই, কথা বলতে পারে না.. তারা কিন্তু আছে, মরে যায়নি।
যাদের দুটো চোখ নেই, তারা পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে পারছে না। যাদের দুটো পা নেই, তারা হাঁটতে পারছে না। যাদের হাত নেই, তারা প্রতি মুহূর্তে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। যারা গরীব, দিনে এনে দিনে খায়, তারা দু মুঠো খাওয়ার জন্য সারাটাক্ষণ লড়াই করে যায়; ভালো-মন্দ দেখে না, জাস্ট খাবারটা হলেই চলে যায়। পৃথিবীতে এমন অসংখ্য মানুষ বেঁচে আছে। তারা বেঁচে থাকার জন্য সব করে। আচ্ছা বলো তো, তোমার কষ্ট কি তাদের চেয়েও বেশি? দিব্যি খাচ্ছ, ঘুরছ, ফিরছ, দেখছ…”
আয়াত থেমে গিয়ে প্রিয়র দিকে তাকায়। প্রিয় অনিমেষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চাহনি কথা বলছে। সেই চাহনি অভিমানে সিক্ত হচ্ছে, অভিযোগের পসরা সাজাচ্ছে। সেই চাহনি জানাচ্ছে, সে ভালো নেই। আয়াত আলগোছে বলে ওঠে,
-“তুমি ভালো নেই, না? আপু, পৃথিবীটা আসলে খারাপ না, কেউ তার জীবনের পুরোটা সময় খারাপ থাকে না। আজ তুমি ভালো নেই, কালকের দিনটা কি তোমার সুখের ছিল না?”
প্রিয়র স্বীকারোক্তি,
-“ছিল।”
-“আচ্ছা আপু, বলো তো। লাইফে প্রথমবার কোন জিনিসে ফেইল হয়েছ? আর কোনটার আফসোস সবগুলোর চেয়ে বেশি ছিল?”
প্রিয় কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে জানাল,
-“একাদশের হাফ ইয়ার্লিতে প্রথমবার ফেইল করেছিলাম। সেটার আফসোসই বেশি ছিল। বরাবরই প্রথম সারির ছাত্রী ছিলাম আমি। সেই আমি কীভাবে ফেইল হয়েছিলাম, মানতে পারছিলাম না।”
আয়াত হেসে বলল,
-“কেমন লাগছিল তখন? দাঁড়াও, আমি গ্যেস করি। উম.. নাওয়া-খাওয়া-ঘুম সব হারাম হয়ে গিয়েছিল, জ্বর জ্বর এসেছিল, কথা বলতে গেলেই ভয়ে গা কাঁপা-কাঁপি হতো, নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা হতো, বাবা-মার দিকে তাকালেই কান্না পেত, তাই না?”
প্রিয় ওপর-নিচ মাথা নাড়ায়। আয়াত আবার জিজ্ঞেস করে,
-“এরপর আবার কখন ফেইল করেছ? যেটাতে ভয়ডর কিছুই লাগেনি?”
-“অনার্স থার্ড ইয়ারে।”
-“তখন তো ভয় লাগেনি, কান্না পায়নি। তাই-কি?”
-“হুঁ।”
আয়াত প্রশস্ত হাসল,
-“দুঃখ সাময়িক। আজ যেই কারণটায় তুমি কষ্ট পাচ্ছ, মরে যেতে চাইছ—কাল সেটা মনে পড়লেই হাসি পাবে। এই যে, আজ যেই সিচুয়েশনটা পার করছ, অতীতের সবগুলোর তুলনায় এটা অসহনীয় না?”
-“হ্যাঁ।”
-“হাফ ইয়ার্লির সেই ফার্স্ট টাইম ফেইলেও তোমার এই সেম ফিলিংসটা হয়েছিল। তখনও মনে হয়েছিল লাইফ শেষ, সব শেষ!”
প্রিয় ব্যাপারটা ধরতে পেরে বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে রইল। আয়াতের হাসি চওড়া হলো,
-“ফেইলিয়ার ইজ দ্যা ফার্স্ট স্টেপ অব্ বিয়িং অ্যা সাকসেসফুল হিউম্যান। তখন তুমি পড়াশোনায় আরও মনোযোগী হয়েছিলে। আমি শুনেছি, তুমি বোর্ড প্লেস করেছিলে। তো এখন থেমে যাচ্ছ কেন? ভয় পাচ্ছ কেন? সামনে যে আরও সুখ পাবে না, তা ভাবছ কেন? জীবনটা কিন্তু খুব সুন্দর! ক্ষণিকের কষ্টে হেরে যেয়ো না। আপু, আমি কখনও তোমাকে বলব না, ‘আমরা পাশে আছি।’
আমি সবসময় তোমাকে বলে যাব, তুমি কি নিজের জন্য এনাফ নও? নিজেকে দেখো, নিজেকে খুশি রাখতে হলে যদি খুব খারাপ হয়ে যেতে হয়, তাহলে হও। নিজের চেয়ে ওপরে কাউকে প্রায়োরিটি দেবে না। তোমার আগে কেউ নেই, কিচ্ছুটি নেই। যেইখানে সুখ পাবে, সেইখানে যাবে। যেইখানে দুঃখ পাবে জাস্ট লাথ মেরে উড়িয়ে দিয়ে চলে আসবে। আপু, পৃথিবীটা ভীষণ সুন্দর! ভীষণ!”
প্রিয় উজ্জ্বল দৃষ্টি গিয়ে পড়ে আয়াতের চোখ মুখে। মেয়েটা হাসছে, মেয়েটার চোখ হাসছে। প্রিয় ধরতে পারল, এই মেয়েটা ভীষণ ম্যাচিওর। প্রিয় বুঝল, এই মেয়েটার ব্যক্তিত্ব খুব সুন্দর।
_____
রাজধানীর গ্রিনরোডের একটা টঙের দোকানের পাশের ফুটপাতে বসে আছে তিন যুবক। তার মধ্যে দু’জনই অফিস আওয়ার শেষে এখানে ছুটে এসেছে। আরেকজনের আজ অফডে ছিল। ভীষণ ক্লান্তি নিয়ে আসা হলেও একে-অপরের সান্নিধ্য পেয়ে এক নিমিষেই সকল ক্লান্তি হাওয়ায় মিইয়ে গিয়েছে। হাসি-তামাশার মাঝে হুট করে সাদিক চায়ের দোকানির উদ্দেশ্যে বলে উঠল,
-“মামা, চা দিয়া যাও তো তিনডা।”
রউফ বলে উঠল,
-“মামা, আজ আমারে চিনি বেশি দিয়া আদা চা দিয়ো।”
দোকানি করিম উদ্দীন পান খাওয়া লাল পাটির সবগুলো দাঁত বের করে হেসে বলল,
-“দিতাছি, মামা। আজ সফেদ মামা আহে নাই?”
আদিল আর চুপ রইল না। তার চাপা রাগ বেরিয়ে এলো সহাস্যে,
-“বুঝছ মামা, ওই ব্যাটায় গোপনে বিয়াত্যা। বউকে টাইম দিতে গিয়া এনে খেয়াল নাই।”
সাদিক হি হি করে হাসতে লাগল, রউফ চশমাটা মুছে নিল এই ফাঁকে। আদিল খোঁচা দিয়ে বলল,
-“এই চারচোক্ষা! দ্যাখ তো, এনে কয় আঙ্গুল?”
সামনে দুইটা আঙ্গুল ধরে জিজ্ঞেস করল। সাদিকের হাসি থামে না। এরই মধ্যে হুট করেই রউফ খেয়াল করে তার ডানে পাশে কেউ এসে ঠাস করে বসে পড়ে। সাদিফ, আদিল, রউফ পর্যায়ক্রমে বসেছিল। তার পাশে এসে ছেলেটা বসে পড়েছে। গায়ের সাদা শার্টটি ঘামে ভিজে জুবুথুবু। গলার কাছের দুটো বোতাম খুলে ফেলল। গোছানো চুলগুলোও অন্যহাতে এলোমেলো করে দিলো। পরপর স্লিভসের বোতাম খুলে ফোল্ড করতে করতে করিমকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“মামা, একটা পানি দেও। কেমন আছ বলো তো?”
করিম উদ্দীন জলদি পানির বোতল এনে দিলো, সাথে চমৎকার করে হেসে বলল,
-“আল্লাহ ভালা রাখছে, তুমি ভালা আছ?”
ছেলেটা দু’দিকে মাথা নেড়ে ইতিবাচকতা প্রকাশ করে। দোকানিটা মাঝবয়স্ক। অথচ তার আধবয়সী বালকদের সাথে মিশতে কোনো সংকোচ আসে না। এই ছেলেরা এমনই! প্রতি সপ্তাহেই তো আসে।
করিম হেসে হেসে বলতে লাগল,
-“মামারা কইল, তুমি নাকি বিয়া করি ফেলছ। গিন্নিরে লুকায় রাখছ ক্যান?”
ছেলেটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বন্ধুদের দিকে তাকায়। তারা তিনজনই তার দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে নিজেদের দিকে তাকাতে দেখে সকলেই একত্রে ডান দিক থেকে মাথাটা বায়ে কাৎ করে দৃষ্টি স্থির করল বাঁ দিকের অদূরে। এত এত নাটক দেখে ছেলেটা অতিষ্ঠ ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ায়।
ভার্সিটি লাইফ শেষে সবাই যে যার মতো ব্যস্ত হয়ে পড়লেও এই সার্কেলটা অন্যরকম। প্রতি সপ্তাহের এই নির্দিষ্ট দিনটিতে সকলেই সন্ধ্যা থেকে ঢের রাত অবধি করিমের চায়ের দোকানের সামনে বসে আড্ডা দেয়। বরাবরের মতোই আজ সেই বড়ো আকাঙ্ক্ষিত সাপ্তাহিক দিনটি।
কথার মাঝে হুট করেই সাদিক বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“ভাই, তোরে কি অন্য কোনো রঙে দেখার সৌভাগ্য আমাদের এজন্মে হইব না? মানত করা লাগব? এক পায়ে খাড়াইয়া, এক হাত উঁচা কইরা ‘জয় বাবা শমশেরুদ্দীন, পোলাডার মাথাত্তুন সাদা রঙের ভুত নামায় দিন’ জপা লাগব? ক?”
বাকি দুইজনের থেকে সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এলো ‘সহমত ভাই’ প্রতিধ্বনি। সাদা শার্ট পরিহিত ভীষণ অগোছালো বালকটি তখন হাসে। হাসতে হাসতে বলে,
-“সাদা শুদ্ধতার প্রতীক, সাদা শুভ্রতার রঙ। আমার এই রঙের নেশা এই জীবনে কাটবে না।”
ভীষণ রাগে আদিল জিজ্ঞেস করেই বসে,
-“তো বউরে কি বিধবা বানায়া বিয়া করবি?”
সে আরও হাসে,
-“তার আপত্তি না থাকলে, অবশ্যই।”
চলবে…