শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-২০+২১

0
400

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২০|

বিকেলের দিকে যখন শরৎ বাড়ি থেকে বের হচ্ছিল, ঠিক সেই সময় প্রিয় কোত্থেকে যেন উদয় হলো চুলটা বাঁধতে বাঁধতে। প্রিয়কে ওর সাথে তাল মিলিয়ে হাঁটতে দেখে শরৎ থেমে দাঁড়ায়। প্রিয় ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-“কী?”

শরৎ-ও প্রশ্ন করে,
-“কী?”

প্রিয় হাতের ইশারায় বলল,
-“চলেন।”
-“কোথায়?”
-“আজব প্রাণী তো! জানেন না কোথায় যাবেন?”
-“আমি যেখানে ইচ্ছা যাই, আপনি পিছু নিচ্ছেন কেন?”
-“পিছু কই নিচ্ছি? পাশাপাশি যাচ্ছি। এই দেখেন। পায়ের দিকে তাকান। এক কদমও পিছে আছি, বলেন?”

শরৎ সত্যি সত্যি পায়ের দিকে তাকায়। পিছেই আছে অবশ্য। প্রিয় তৎক্ষনাৎ এক কদম এগিয়ে এসে সোজা বরাবর হয়ে দাঁড়ায়,
-“মিস্টেক! এখন দেখেন, লাইন টেনে মাপেন পারলে।”

শরৎ মুখোমুখি হলো। ট্রাউজারের পকেটে হাত গুঁজে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
-“সমস্যা কী?”

প্রিয় খিক খিক করে হেসে বলল,
-“আপনার সাথে যাব, চলেন।”
-“এবার এসেছেন নিজস্ব সত্তায় ফিরে। এতক্ষণ কি অন্যের থেকে হাওলাত করা সত্তা নিয়ে চলছিলেন?”
-“যারটা নিয়েই চলি, আপনার কী? আপনারটা নিয়েছি?”
-“বহুকাল পর বিরক্ত হলাম। আসেন, আপনাকে পুরষ্কৃত করি।”
-“ধন্যবাদ, মহামান্য। বাট যার তার থেকে পুরষ্কার নিলে আমার জাত চলে যাবে।”

ওরা পাশাপাশি হাঁটছে। সেই সাথে ভদ্র ভাষায় একে-অপরকে পঁচিয়ে যাচ্ছে। আশে-পাশের মানুষজন দেখলে ভাববে, কী আন্তরিক এরা একে-অপরের প্রতি। অথচ কথাগুলো শুনলেই এদের ভাবনা ১৮০° এঙ্গেলে আছাড় খাবে।

প্রিয় জিজ্ঞেস করল,
-“হেঁটে যাচ্ছেন কেন? বাড়ি থেকে গাড়ি নিয়ে বের হতেন।”

শরৎ বাঁকা হাসে,
-“হ্যাঁ, তারপর কর্দমাক্ত মাটির রাস্তায় ড্রাইভিং করে গাড়ি উলটে গিয়ে খালে পড়লে আপনার সাথে সাথে আমিও পটল তুলতাম।”

প্রিয়র মুখ থমথমে হয়ে এলো। তবুও নিজের পক্ষে সাফাই গাইল,
-“হ্যাঁ তো কী হয়েছে? তুললে তুলতেন। ৮০০ কোটি মানুষের মাঝে একজন মরলে খুব একটা কিছু হবে না।”

শরৎ হাসিমুখে প্রিয়র ভুলটা ধরিয়ে দিলো,
-“দু-জন হবে, ম্যাডাম৷ আমি মরলে আপনি বাঁচবেন কী করে?”

প্রিয় হেসে হেসে তাল মেলাল,
-“আপনি ড্রাইভিংয়ে থাকতেন, আর আমি আপনার পাশের সিটে। অ্যাক্সিডেন্টের চান্স পেলেই লাফ দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে যেতাম।”
-“সিট বেল্ট নামেও একটা বস্তু আছে, খুলতে খুলতে ততক্ষণে পৃথিবী থেকে টুশশশশ….”
-“আপনি চরম বেয়াদব।”
-“আপনি একটু কম বেয়াদব। বেয়াদবির কোয়ান্টিটি যা-ও আপনার মধ্যে আছে, আদবের তো দেখাও পাওয়া যায় না।”
-“কথা-বার্তা না বলে চলেন।”
-“চলেন, ম্যাডাম।”

_____
-“উহুম উহুম! আসতে পারি, প্রহর ভাইয়া?”

প্রহর বিছানায় হেলান দিয়ে ফোন চাপছিল। আপাতত তার এই কাজ। সে মানুষের সাথে সহজে যেহেতু মিশতে পারে না, তাই ফোনই ভরসা। ফোনের অপর প্রান্তে আয়াত ছিল। প্রহর সবসময়ই আয়াতের লেইম জোক্সগুলো উপভোগ করে। ওটা ভেবেই কপালে হাত রেখে মুচকি হাসল। তখনই মেয়েলি আওয়াজটা তার কানে এসে বিঁধল। প্রহরের হাসি থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে দরজার পানে তাকায়। নীহিন জবাবের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। প্রহর বলল,
-“এসো।”

নীহিন এগিয়ে গিয়ে বলল,
-“মা বলেছে, ভাইয়ারা বিলপাড়ে মাছ ধর‍তে যাবে, তুমি যাবে কি না জিজ্ঞেস করতে। এখানে একা থাকতে বোধহয় ভালো লাগছে না তোমার।”

প্রহরের বিরক্তি লাগল,
-“ভালো লাগছে এভাবেই।”
-“আচ্ছা, আমি যাই তবে?”
-“যাও।”
-“প্রহর ভাইয়া?”
-“বলো।”
-“এখানে একা ঘরে সকাল থেকে বসে আছ, দমবন্ধ হয়ে আসছে না? অন্তত বারান্দায় এসে বসো।”
-“তুমি যেতে পারো।”

নীহিন অত্যন্ত দুঃখী মুখ নিয়ে বিদায় হলো। প্রহরের হাত তখন ফোনের কী-বোর্ডে চলমান,
-“এরপর?”

আয়াত কিছুক্ষণ বিভিন্ন কথা বলছিল, প্রহরের রিপ্লাইয়ে লিখল,
-“এরপর অনেক কিছু। একা একা বিয়ে খাচ্ছিস, আমাকে নিয়ে গেলি না।”
-“তোর বাবা আমাদের সাথে যেতে দিত?”
-“বাবা তো যেতেই দিত। তুই নিয়েছিস আমাকে?”
-“উঁহু।”
-“হ্যাঁ সে-ই! কেন নিবি আমাকে? ওখানে আমাকে নিয়ে গেলে তো তোর ইটিশপিটিশ হবে না। বুঝি না মনে করেছিস? সব বুঝি।”

আনমনেই প্রহর হাসল,
-“আর কী বোঝেন?”
-“আর বুঝি, প্রহর মশাই সুযোগ সন্ধানী। ইটিশপিটিশের সুযোগ খোঁজে।”
-“ইটিশপিটিশ কী?”
-“ইটিশপিটিশ হচ্ছে টাঙ্কি মারা।
-“টাঙ্কি মারা কী?”
-“টাঙ্কি মারা মানে লাইন মারা।”
-“লাইন মারা কী?”
-“লাইন মারা হচ্ছে মেয়ে দেখলেই চোখ টিপ দেওয়া, নিজের হ্যান্ডু লুক নিয়ে মেয়েদের সামনে দিয়ে ঘোরা। আর ছাগলের স্বভাব আয়ত্ত করা।”
-“ভাষার শ্রী কী চমৎকার! কিন্তু ছাগলের স্বভাব?”
-“মানে ওই ছুকছুকানো স্বভাব। হুমায়ুন আহমেদ স্যার বলেছেন, পুরুষ এবং ছাগল—এই দুটোকেই চোখে চোখে রাখতে হয়। এরা কখন কী-সে মুখ দেয়, বলা যায় না।”
-“তাই, না?”
-“জি।”
-“হুমায়ুন আহমেদ স্যার আর কী বলেছেন?”
-“আরও বলেছেন—পুরুষ জাতির অনেক দুর্বলতার এক দুর্বলতা হচ্ছে, তারা মনে করে মেয়ে মাত্রই তার প্রেমে পড়ার জন্যে পাগল হয়ে আছে।”
-“উম.. তারপর?”

প্রহর হাসছে। ওপাশে আয়াতের মুখেও হাসি। সে হুমায়ুন-ভক্ত। বিভিন্ন উক্তি বলে যেতে লাগল। প্রহরও মিটিমিটি হাসছে। তখন আয়াত আবার লেখে,
-“হুমায়ুন আহমেদ স্যারের অনেকগুলো সত্যি কথার মাঝে একটা কথা আমার বেশ পছন্দের।”
-“কোনটা?”
-“এই পৃথিবীতে প্রায় সবাই, তার থেকে বিপরীত স্বভাবের মানুষের সাথে প্রেমে পড়ে।”
-“সুন্দর কথা তো!”
-“হুঁ, তবে তুই এত সময় নিচ্ছিস কেন, প্রহর?”

আয়াতের ম্যাসেজের মাঝেই তার আকুলতা প্রকাশ পাচ্ছে। প্রহর রিপ্লাই দিলো না। আলগোছে ফোনটা বেডসাইড টেবিলের ওপর ফেলে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়ল। আজ অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছে, এতটা কথা বলাও ঠিক হয়নি। কিন্তু কী করবে? সে ধীরে ধীরে অনেক বাজেভাবে এই চঞ্চল মেয়েটায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। এতটাও উচিত নয়…

______
উত্তরপাড়ার সরু রাস্তার দু-ধারে পানি উঠেছে, সেই সাথে রাস্তাটাও ডুবে গেছে প্রায়। বেশিরভাগ লোকেরাই ঘাটে থেকে নৌকা নিয়ে যাতায়াত করছে। তাছাড়া শুকনো রাস্তার শেষ সীমানাতেও কয়েকটা নৌকা বেঁধে রাখা আছে।

শরৎ আর প্রিয় সেদিকে যেতেই একজন লোক বলে উঠল,
-“আরে শামসুল ভাইয়ের পোলা না তুমি?”

শরৎ বলল,
-“জি, চাচা।”
-“বহুত দিন পর দেখলাম। বাড়ি আইছো কবে?”
-“কাল এসেছি।”
-“পাশেরজন কে?”
-“কাজিন।”
-“কী?”

শরৎ হালকা কেশে প্রিয়কে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আমার লেজ ধরে ঘোরা ছাড়া আর কিছু কি পারেন? নিজের আইডেন্টিটিটা আপনি দেবেন নাকি আমি দেবো? আপনি দিলে জাতের একটা দিতে পারবেন, আমি দিলে…”

শেষটুকু আর উচ্চারণ করা লাগল না, প্রিয় বলে উঠল,
-“রিধি আপুর খালাতো বোন আমি।”
-“ওহহো! তুমি ওই দুষ্ট মেয়েটা? বাচ্চাকালে তো সবাইরে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইছিলা। কত্ত বড়ো হইয়া গেছ। আগের মতোই শান্ত আছ। ভিত্রে ভিত্রে এখনও শয়তানি করো নাকি? তোমার বয়সের সবগুলাই তো বড়ো হইয়া গেছে, ওরা আগে তোমাকে একনামে চিনত। কী নামে মনে আছে? মিচকা শয়তান।”

এই বলে লোকটা হেসে উঠল। প্রিয় চোখ পিটপিট করে শরতের দিকে তাকায়। শরৎ তখন অন্যদিকে তাকিয়ে হাসছিল। সামনে দণ্ডায়মান লোকটার নাম আজিজ, এক সময় তাদের জমিদারবাড়ির এলাকায় থাকত, এদিকে বাড়ি তুলেছে তার যুগ পেরিয়েছে। প্রিয় তাকেও কম জ্বালায়নি। এই মেয়েটা সব ভুলে গেলেও, কেউই তাকে ভুলতে পারেনি। সে মানুষই এমন ছিল, যেখানে যেত সেখানে সবাইকে এন্টারটেইন করে বেড়াত। বাবা ছোটবেলায় একটা কথা বলেছিল প্রিয়কে, ‘ইউ ওয়্যার বর্ন টু ইন্টারটেইন, লি’ল চেরি।’

প্রিয়র সেই কথাটা মনে নেই, সেই সাথে সেই সত্তাটাও হারিয়েছে বহু আগে। সে এখন চুপচাপ থাকে, কাউকে জ্বালায় না, রাগ দেখায় না, কাউকে হাসানোরও চেষ্টা নেই। তবে আজ কেন যেন শরৎকে জ্বালাতে ইচ্ছে করছে। বোধহয় সকালে শাহানাজের বলা কথা শুনে পুরোনো আবছা স্মৃতি মনে পড়ে যাওয়াতেই!

আজিজ তখন জিজ্ঞেস করে,
-“তা বাবা, এদিকে কই যাইতেছ?”
-“তেমন কোথাও না, চাচা। পানি দেখতে এসেছি। নৌকা দিয়ে ঘুরেই চলে যাব।”
-“তাইলে আমার নৌকায় চলো। তোমাদের ঘুরায় নিয়া আসি।”

শরৎ বিনাবাক্যে রাজি হয়ে গেল। নৌকা একটা গাছের সাথে বাঁধা ছিল। আজিজ গিয়ে নৌকার গুণ ধরে সামান্য টেনে সামনে নিয়ে এলো, প্রিয় আর শরৎকে উদ্দেশ্য করে বলল,
-“আসো তোমরা।”

প্রিয়র দিকে তাকিয়ে শরৎ বলল,
-“যেতে পারবেন না-কি সাহায্য প্রয়োজন?”

যাহ! এই ছেলেটা এত ভালো হলো কী করে? প্রিয়র মনে প্রশ্ন উদয় হয়। সেই প্রশ্নকে সুন্দর মতো অদৃশ্য আগুনে পুড়িয়ে দিয়ে শরৎ বলল,
-“আমার হেল্প বোঝেন তো? তুলে সুন্দরমতো একটা আছাড় দেবো। নৌকার পাটাতনেও পড়তে পারেন আবার কাদা পানিতেও। ডিপেন্ড করে কতটা জোরে আছাড়টা দেবো। রেগুলার জিম করা শরীরটাকে দেখে শক্তি বোধহয় আন্দাজ করেই নিয়েছেন, কি?”

প্রিয়র নাক ফুলে উঠল। সে আজিজের দিকে তাকিয়ে বলল,
-“চাচা, একটু শক্ত করে ধরবেন নৌকাটা।”

তারপর পাশের গাছের সাহায্যে বহু মুশকিলে নৌকাতে উঠল। ক’বার মনে হয়েছিল পড়েই যাবে। ওদিকে শরৎ ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয় উঠে পড়তেই, সেও উঠে এলো। আজিজ উঠে বৈঠাটা টেনে পানিতে নামাল। ধীরে ধীরে নৌকাটি চলমান হলো।
পানির সাথে বৈঠার সংঘর্ষে ক্ষণিকের মাঝেই তারা বিলের দিকে চলে এলো। আকাশে তখন মিঠারোদ, গায়ে সয়ে পড়ার মতোই। প্রিয় হাতের ফোনটা শরতের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
-“ছবি তুলতে জানেন তো? নাকি বৈশিষ্ট্যহীন লোকটাকে বেগুন বলে ডাকব?”

শরৎ পা সোজা রেখে পেছনের মেঝেতে হাত রেখে হেলে বসে ছিল। ফোনটা নিয়ে ক্যামেরা অন করল। প্রিয় বিভিন্ন পোজ নিল, শরৎও ক্লিক করতে লাগল। প্রিয় বুঝল না, শরৎ ব্যাক ক্যামেরার বদলে সেলফি ক্যামেরা অন করেছে আর নিজের ছবি তুলছে। প্রিয়র দিকে তার মন নেই।

প্রিয় উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
-“আমি পিছে ঘুরে শাহরুখ খানের পোজে টাইটানিক ফিল নেব, আপনি ছবি তুলতে থাকেন। দাঁড়িয়ে তোলেন।”

শরৎ দাঁড়াল। ছবি তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করল,
-“সাঁতার পারেন?”

প্রিয় ডানে তাকিয়ে বিলের জলে চোখ রেখে হেসে বলল,
-“সবাইকে নিজের মতো বেগুন ভেবে বসে আছেন? অবশ্যই সাঁতার পারি, বাবা ছোটবেলাতেই শিখিয়েছিল।”
-“গ্রেট।”

বলতে দেরি পেছন থেকে ধাক্কা দিতে দেরি নেই। সেকেন্ডের ব্যবধানে প্রিয় বিলের জলে পড়ে গেল। প্রথমে মস্তিষ্ক হ্যাং হয়ে যাওয়ায় কিছুক্ষণ হাবুডুবু খেলো, এরপর নিজেকে জলের সাথে ভাসিয়ে রাখল। একহাত দিয়ে সামনের চুলগুলো পেছনের দিকে সরিয়ে মুখের পানি মুছল। চোখের মাস্কারা ছড়িয়ে কালো হয়ে ভয়াবহ দেখাচ্ছে ওকে। শরৎ মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। প্রিয় বড়ো বড়ো চোখে ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল,
-“এটা কী হলো?”

চলবে..?

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২১|

রাতের আকাশে বাঁকা চাঁদটি আলো ছড়াচ্ছে কোনোরকম। সেই ক্ষীয়মান আলো কাঠের জানালার পাল্লা ভেদ করে মেঝেতে আছড়ে পড়ছে। রুমে জ্বলছে মৃদু আলো। এই সময়ে প্রিয়র তীব্র আলো পছন্দ নয়। রাতের খাবার খাওয়া খানিকক্ষণ আগেই চুকিয়েছে সে। বিকেলের সেই ঘটনাটা মস্তিষ্ক থেকে সড়ছেই না। যতবার ভাবছে, ততবারই উত্তেজিত পড়ছে। মুখে এসে যাচ্ছে কিছু খাস বাংলার গালি। কীভাবে কীভাবে যে নিজেকে ঠান্ডা রেখেছে, প্রিয় নিজেও জানে না। ঠান্ডা রাখতে রাখতে সর্দি বাঁধিয়ে নিয়েছে।

বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে সে, কোলে টিস্যু বক্স। মিনিটে দু-চারটা হাঁচি এক নাগাড়ে এসে ক্ষণিকের বিরতি নিচ্ছে। প্রিয় বিরক্ত হয়ে পড়ে। মনে মনে আরও দু’টো গালি উচ্চারণ করল ওই শরৎকালের উদ্দেশ্যে। অসভ্য লোক! শরৎ নাম রাখল কেন ওর? শরৎকাল হবে নরম, কোমল, প্রশান্তিদায়ক। অথচ এটা?

প্রিয় অতিষ্ঠ হয়ে দু’ধারে মাথা নাড়ে। পরক্ষণেই আবার হাঁচি আসতে লাগে। এভাবেই পেরোল অনেকটা সময়। আস্তে-আস্তে সর্দি নেমে যেতে লাগে। প্রিয়র ঘুম প্রয়োজন। রাত তখন এগারোটা ছুঁইছুঁই। উঠে রুমের লাইট জ্বালাল। আলমারিটা খুলে প্রয়োজনীয় সামগ্রীর মধ্যে থেকে ওষুদের বাক্সটা বের করল। রাতের খাওয়ার পর এখন শুধু ঘুমের ওষুধ নিতে হবে। আশ্চর্যজনকভাবে প্রিয় সেই ওষুধের প্যাকেটটা খালি দেখতে পেয়েই চমকে গেল। কাল শেষ হয়েছে, আর প্রিয়র খেয়ালই নেই।

একহাতে কপাল চাপড়াল। তারপর আবার লাইট অফ করে বিছানায় চলে গেল। ফোন ঘাটছে। ঘুম পাচ্ছে, কিন্তু কেন যেন ঘুমোতে পারছে না। অদ্ভুত আওয়াজ পাচ্ছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে তার মাথা খারাপ হতে থাকে। এ-পাশ ও-পাশ করতে করতেই হুট করে উঠে বসে। কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ফোন খুঁজতে লাগে। বুকটা কাঁপছে তার।

সাইড টেবিলে ফোন ছিল। উলটো-পালটাভাবে খুঁজতে গিয়ে অস্থিরতায়, অধীরতায় ভুলবশত কাঁচের গ্লাসটা মেঝেতে বিকট শব্দ তুলে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আশ্চর্য! সেই শব্দ প্রিয়র কানেই এলো না। সে ইচ্ছাকৃতভাবে এবার টেবিলের ওপর সব হাতড়ে হাতড়ে ফেলে দিলো। অবশেষে ফোন পেল। পাগলের মতো কার্যকলাপ তার।

ফোন পেয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই টর্চ অন করে। দেখতে পায় কী অসম্ভবভাবে তার হাত-পা কাঁপছে। অন্ধকারে আশে-পাশে তাকাল। কিছু দেখা যাচ্ছে না। চাঁদটাও মেঘের পিছে গা লুকিয়েছে। প্রিয় অন্ধকারে ফার্নিচারগুলোকে বিভিন্ন কুৎসিত আকৃতির হয়ে যেতে দেখল। পর্দাগুলোও যেন ওর দিকে তেড়ে আসছে! উলটো দিকের কাউচটা একটা বিশ্রী রকমের জন্তুর আকৃতির হয়ে গেল। প্রিয়র ভয় মাত্রা ছাড়াতে লেগেছে। সে হাঁপাচ্ছে। নিঃশ্বাস নিচ্ছে ঘন ঘন। ফাঁকা ঘরে বাতাসটাও আসছে না আর। স্বকীয় নিঃশ্বাসের প্রকট শব্দে প্রিয় নিজেই আঁতকে উঠল।

দৌড়ে গিয়ে লাইট অন করল সবগুলো। অসাবধানতাবশত ছিটকে আসা কাঁচের ছোট্ট একটা টুকরোয় তার পায়ে সামান্য ক্ষত হলো। সাদা মেঝেতে লাল ছোপ ছোপ রক্ত। প্রিয় তা দেখতে পেল না, অনুভব করতে পারল না। মস্তিষ্কের ভ্রম তার শারীরিক যন্ত্রণাকে দাবিয়ে রেখেছে। সে যেভাবে ছুটে গিয়েছিল সেভাবেই ছুটে এসে বিছানায় বসে পড়ল।

পা দুটো বুক বরাবর তুলে, দু’হাতে জড়িয়ে চুপিসাড়ে বসে আছে। এখনও কাঁপছে। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। সব স্বাভাবিক। আর কিছু নেই, কিচ্ছু না। মাথা দ্রিমদ্রিম করছে, মনে হচ্ছে মগজটা কেউ চটকাচ্ছে। হৃদস্পন্দন অস্বাভাবিক হারে স্পন্দিত হচ্ছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। ঘামছে প্রচণ্ড। তারপর অকারণেই ডুকরে কেঁদে উঠল। কান্নার আওয়াজ তার কানে পৌঁছাতেই সে নিজের ডান হাতের পিঠটা কামড়ে ধরে কাঁদতে লাগল।

___
দোতলার দক্ষিণের এদিকের রুমগুলো যথাক্রমে শরৎ, প্রিয়, প্রহর, নীহিন-রূপা-আরহা, আরুশি-নিধি, রিধিমার। একদমই ভেতরের দিকে শরতের রুম। তার পরেই প্রিয়র। তার পর প্রহরের। এখন এ-পাশে সবাই ঘুম, তাই আওয়াজটা কারোরই কানে এলো না।

শরৎ একটা বই পড়ছিল। গ্লাস পড়ে যাওয়ার আওয়াজ পেতেই কান খাঁড়া হয়ে আসে তার। পরপরই আরও কিছু পড়ে যাওয়াতে শরৎ নিজের বিছানা থেকে উঠে পড়ে, করিডোর দিয়ে বেরিয়ে যায়। প্রিয়র পশ্চিমের দরজা খোলা ছিল। লাইট অন!

কান্নার আওয়াজ পেয়েই শরৎ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায়। চোখ উঠিয়ে দেখে বিছানায় গুটিশুটি মেরে বসে আছে প্রিয়। একহাত কামড়ে ধরে কান্নার আওয়াজ বন্ধ করল। শরীরের কম্পন দৃশ্যমান। শরৎ এগিয়ে যেতে নিয়েও গেল না। ফিরতি রাস্তা ধরে নিজের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়াল। প্রিয়র বয়স এখন ২৪। এই বয়সে, এই যুগের অবিবাহিত মেয়েরা অবশ্যই সিঙ্গেল থাকে না। হবে হয়তো কোনো রিলেশনশিপের ঝামেলা। সেজন্যই কাঁদছে। শরতের ধারণা, এভাবে এতরাতে কোনো মেয়ের ঘরে যাওয়া উচিত হবে না।
তাই তো ফিরে যেতে নিল। নিজের রুমের সামনে এসে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতে যাবে, ওমনিই কী যেন হলো।

পিছে মুড়ে কোথাও না থেমে সোজা প্রিয়র রুমে ঢুকে গেল শরৎ। প্রিয়র কান্না থেমেছে। কান্নার বদৌলতে হেঁচকি উঠে গেছে। শরৎ প্রিয়র দিকে এগিয়ে গিয়ে ওর পাশে দাঁড়াল। সামনে কিছু একটার উপস্থিতি অনুভব করে প্রিয় মুখ তুলে তাকায়। অনাকাঙ্ক্ষিত পুরুষটাকে দেখে নেহাতই মস্তিষ্কের ধোঁকা মনে করল।

শরৎ দেখতে পেল, ওপাশের ফ্লোরে ভাঙা কাঁচের টুকরোর সাথে পানি পড়ে আছে। ওদিকটায় সামান্য রক্তও দৃশ্যমান। প্রিয় উঠে দাঁড়াতে গেলেই শরৎ বলে উঠল,
-“স্টপ! ওখানেই বসে থাকো।”

প্রিয় বসে থাকে। শরৎ সেন্টার টেবিলের ওপর থেকে পানির বোতল নিয়ে এসে প্রিয়র হাতে দিয়ে বলল,
-“ড্রিংক ইট।”

প্রিয় বোতলটা হাতে নেয়। শরৎ নিজের বোন-হোয়াইট ফুল স্লিভসের টিশার্টের স্লিভস ফোল্ড করল। তারপর করিডোর থেকে একটা স্কুপ এনে কাচের টুকরোসহ যতটুকু পানি সম্ভব হয়েছে তাতে তুলে নিয়ে বাইরে রেখে, সুন্দর মতো মেঝেটা পরিষ্কার করল।

প্রিয় পানি খেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল। শরৎ সব কাজ শেষ দিয়ে ওর মুখোমুখি টানটান হয়ে দাঁড়াল। জিজ্ঞেস করল,
-“রাত-বিরেতে কান্না কার জন্য তা জিজ্ঞেস করাটা বোকামি। বাট আই ওয়ান্ট টু সে, কার জন্য চোখের জল ফেলা উচিত আর কার জন্য নয়—তা বোঝার মতো তোমার বয়স কম হয়নি।”

প্রিয় বাঁ হাতের পিঠ দিয়ে ডান গালের জল মুছে নিয়ে বড়ো করে শ্বাস টানে। শরতের চোখে চোখ রেখে মিনমিনে স্বরে বলে,
-“চোখের জল যে প্রতিবার নির্দিষ্ট একটা মানুষকে কেন্দ্র করেই হবে, তার মানে নেই।”

সে চোখে বেশিক্ষণ তাকানো যায় না। প্রিয় দৃষ্টি সরিয়ে নিল। শরতের চাহনি হলো আরও দৃঢ়। সে অনিমেষ তাকিয়ে বলল,
-“মরা-কান্না কাঁদছ কী জন্য?”

প্রিয় কথা বলতে গিয়ে ঠোঁটটাও কেঁপে উঠল,
-“আমি জানি না।”
-“কেন জানো না?”
-“জানি না।”
-“কী?”
-“জানি না।”

প্রিয়র কথার ধরন কেমন যেন অপ্রকৃতস্থ শোনাচ্ছে। শরতের কপাল কুঁচকে যায়। তন্মধ্যে প্রিয় বিরবির করে যাচ্ছে, জানি না, জানি না, জানি না…

শরতের বুঝতে সময় লাগল না আর, এগিয়ে গিয়ে প্রিয়র পাশে বসে পড়ল। ওর মাথায় হাত রেখে বলে উঠল,
-“কিচ্ছু হয়নি। জাস্ট টেক অ্যা ডিব ব্রিথ। সবকিছু নরমাল আছে।”

প্রিয় কেমন ঘোর লাগানো চোখে তাকায়, পরক্ষণে ওর থেকে ছিটকে সরে আসে। গলার স্বর তুঙ্গে তুলে বলে,
-“রুম থেকে বের হও।”
-“প্রিয়, শোনো।”
-“বেরোতে বলছি। কথা শুনতে পাচ্ছ না? কী চাইছ? আর কী চাইছ? মরে যাই?”

শরৎ ওর দিকে আরও এগিয়ে আসতে নিলে, প্রিয় সর্বোচ্চ চিৎকার করে কেঁদে ওঠে,
-“মরে যাব, প্রমিস! কাছে আসবে না। চলে যাও। আল্লাহর দোহায় লাগে তোমায়। আর পারছি না নিতে।”

শরৎ সরে গেল,
-“রিল্যাক্স! কাছে আসছি না। শোনো আমার কথা..”
-“কিচ্ছু শুনতে চাই না। লেট মি লিভ.. আমি বাঁচতে চাই..”

শরৎ বলে উঠল তবুও,
-“যে-কোনো ডিসিশনের আগে জাস্ট থিংক এবাউট ইওয়োর প্যারেন্টস। হড়বড়ে কাজ করবে না। ঘুমিয়ে যাও। ফোনে সূরা আর-রহমান প্লে করে শোনো। ভালো লাগবে। এগেইন বলছি, উলটা-পালটা কিছু ভাববে না। আমি পাশের রুমেই আছি। সমস্যা হলে ডাকবে।”

প্রিয় আবার বলে,
-“যাও প্লিজ। যাও না…”

শরৎ চলে যায়। প্রিয় বিড়বিড় করতে থাকে শরতের প্রস্থানের দৃশ্যে,
-“শ্রেয়ান, তোমাকে ছাড়া আমি খুব ভালো আছি। দেখেছ? শান্তি? প্লিজ আমার শান্তি নষ্ট করতে আর এসো না। শ্রেয়ান, আমি তোমাকে চাই না। আর চাই না। কেন বার বার আসছ? আর নিতে পারছি না আমি। আমি বাঁচতে চাই তো। কেন আসছ? সহ্য হচ্ছে না ভালো আছি? তবুও কেন? কী চাও? মরে যাই? মরব? না, মরব না। ভালোবাসি না, মরব না..”

প্রিয় উলটা-পালটা বকতে থাকে। অথচ সে যে শরতের মধ্যে শ্রেয়ানকে দেখতে পেয়ে ওমন রিয়্যাক্ট করল, তা শরৎ টের পেল না। নিজের রুমে এসে অস্থির ভঙ্গিমায় বসে মাথার চুলগুলো টানল কিছুক্ষণ।

___
রাতে আর প্রিয় ঘুমোল না, ঘুম এলো না। গায়ে একটা পাতলা চাদর পেঁচিয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল। শরতের রুমের পাশ দিয়েই সে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নেমে গেল, অথচ শরৎ দেখতে পেল না। প্রিয় বাগানের রাস্তা হয়ে কালকের সেই কাঙ্ক্ষিত জায়গাটিতে চলে এলো। ঐশ্বরিক সৌন্দর্য পায় সে এখানটায়।

প্রিয় বিলের শানে বসে জলে পা ভেজাল। এখানটায় চাঁদের আলো তীক্ষ্ণ। শান্তি লাগছে তার। এতক্ষণের কান্নাকাটির জন্য চোখ-মুখ ফুলে আছে। শুক্লা পঞ্চমীর আলোয় প্রিয়কে এরূপে দেখে যে কোনো পুরুষের মরণ ঘনাবে।

ঠিক সেই মুহূর্তে প্রিয় উপলব্ধি করল, তার পাশে তার বড়ো আকাঙ্ক্ষিত মানুষটির উপস্থিতি। সে গা ছুঁইছুঁই হয়ে বসে আছে। প্রিয় মেকি রাগ দেখিয়ে তাকে বলল,
-“অপেক্ষা করাতে ভালো লাগে খুব, না? আসতে দেরি করলে কেন এত? কথা বলব না তোমার সাথে।”

সাদা শার্ট পরিহিত পুরুষটি প্রিয়র চোখে চোখ রেখে হাসে।

চলবে…