শুক্লপক্ষের পরিশেষে লর্ব-২৩+২৪

0
359

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৩|

-“ফোন পিক করেন, প্রিয়শ্রী। আপনারই বাসার বাইরে আছি।”

নম্বরটা অপরিচিত, ট্রু কলারে কলার আইডি দেখাচ্ছে। ম্যাসেজটা শ্রেয়ানের। পরপরই তার কল। প্রিয় অনুত্তেজিত অবস্থায় কল রিসিভ করল। ওপাশ থেকে শ্রেয়ান সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কী খবর? কোনো ম্যাসেজ-ট্যাসেজ নেই? রাগ নামেনি, না?”

প্রিয় প্রলম্বিত শ্বাস টেনে হাসে,
-“তোমার প্রতি রাগ নেই আমার, শ্রেয়ান।”

থেমে নিয়ে আবারও বলে ওঠে,
-“তোমার প্রতি আমার আর রাগ নেই, অভিমান নেই, অভিযোগ নেই। সত্যি বলছি, তোমার জন্য আর দু’চোখে মুগ্ধতা নেই, আবেশ নেই, প্রেম নেই… খেয়াল করে দেখো, কিচ্ছুটি নেই।”

প্রিয়র কথা শুনে শ্রেয়ান চুপ মেরে গেল। প্রিয় আবার বলল,
-“তোমার খবর কী?”

মিনমিনে স্বরে শ্রেয়ান বলল,
-“তোমাকে ছাড়া একটুও ভালো নেই। ঘুম আসে না, খেতে ইচ্ছে করে না। কেবল তোমার কথা মনে পড়ে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। ইচ্ছে করে তোমাকে বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখি। দূরত্ব এত বিশ্রী কেন, প্রিয়শ্রী?”

প্রিয়র হাসি মলিন হয়ে এলো। শ্রেয়ান বলতে লাগল,
-“তুমি পালটে গেলে কেন? আমার প্রিয় তো ফুল ছিল, তুমি কেন পাথর হলে? আগের মতো হয়ে যাও প্লিজ, খুব মিস করি তোমায়। জানো? রাস্তায় হাঁটতে গেলেও তোমার কথা মনে পড়ে, এই শহরের প্রায় সব রাস্তাতেই আমাদের ঘোরা হয়েছিল। ফোন হাতে নিলে ভুলক্রমে ইনবক্স চেক করি, রিসেন্ট কল চেক করি। তোমার কল-ম্যাসেজ না পেলেই বুকটা ভেতর থেকে ভারি হয়ে আসে। এরকম কেন করছ? এত বেশি ভালোবাসি, এর বিপরীতে কষ্ট কেন দিচ্ছ?”

প্রিয় সবটা শোনে। ছোট্ট করে প্রশ্ন করে,
-“কষ্ট হচ্ছে?”

ত্বরিতে স্বীকার করে শ্রেয়ান,
-“ভীষণ কষ্ট হচ্ছে, প্রিয়শ্রী! তোমাকে ছাড়া আমি ভালো নেই, একটুও না। প্লিজ, দেখা দাও। তারপর আমাকে মারো-কাটো সব করো। শুধু কাছে থাকো।”

প্রিয় বলে ওঠে,
-“প্রকৃতি কিছুই ভোলে না, শ্রেয়ান। তুমি কারো সাথে কোনো জুলুম করলে, ঘুরে-ফিরে একই জুলুমের শিকার তুমি নিজেও হবে। ব্যাপারটা হতে আমি অবগত। তাই বাড়তি করে ভেতর থেকে কোনো শাপ আসেনি। কিন্তু প্রকৃতি যে এত জলদি আমাকে ন্যায্যতা দেবে, আমি বুঝতেই পারিনি! তাও কি-না আমার মাধ্যমেই!”

-“প্রিয়শ্রী!”

শ্রেয়ানের কম্পিত জবাব। প্রিয় স্থিরচিত্তে বলে,
-“হু..?”
-“ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।”
-“আমিও বাসি, শ্রেয়ান।”
-“তবে ফেরো আরেকটিবার। এদিক চেয়ে দেখো, আমি মুখিয়ে আছি…”

প্রিয় চোখ বুঁজে নেয়, টলমল করা অশ্রুগুলো আলগোছে কার্ণিশ ভিজিয়ে দেয়। এদিক-ওদিক তাকায় তা গোপন করার অভিলাষে। সফল হয় অবশ্য। স্থির-শান্ত প্রিয় খানিকটা পর বলে ওঠে,
-“আমার খুব ইচ্ছে করে তোমার কাছে ফিরতে।”

শ্রেয়ানের মুখ তৎক্ষনাৎ উজ্জ্বল হয়ে আসে। সে কিছু বলতে যাবে, তার আগেই প্রিয় জানায়,
-“কিন্তু আমি ফিরব না।”

বুক চিরে বেরিয়ে আসতে দীর্ঘশ্বাসেরা তখন তাণ্ডবে মত্ত, শ্রেয়ানের কণ্ঠও ভেজা। সে উৎকণ্ঠিত গলায় শুধায়,
-“কেন?”

ফিসফিসিয়ে প্রিয় বলে,
-“কারণ মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হতে নেই, পূরণের আশায় থাকতে নেই, পূরণের অভিলাষে মজতে নেই…”

বলার আর কিছু বাকি থাকল না শ্রেয়ানের। আরেকবার শুধাতে চাইল, দেখা করার কথা। কিন্তু নিজেকে ব্যক্তিত্বহীন পুরুষ হিসেবে সে কখনই ভাবতে পারে না বলে এরকম করতে পারছে না। তবুও বার বার প্রিয়র কাছে ছুটে আসছে। মেয়েটাকে ছাড়া সত্যিই সে ভালো নেই। খুব চায়। হয়তো সারাটাক্ষণ না, কিন্তু যখন মনে পড়ে, তখন চাওয়া-পাওয়ার হিসেবেরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

শ্রেয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আপনমনে প্রিয় বিরবির করতে লাগল,
-“তুমি প্রচণ্ড সুখী হও, শ্রেয়ান। লেবু মাত্রাতিরিক্ত চিপলে তেতো হয়ে যায়, তোমার সেই প্রচণ্ড সুখও একদিন তোমার কাছে বিশ্রী ঠেকুক। সুখের সংসারে তুমি চোখ বন্ধ করলেই যাতে দেখতে পাও, একটি মেয়ের হাহাকারের কারণ ছিলে তুমি। অনুতপ্ততা বোঝো? শ্রেয়ান, তুমি অনুতপ্ত হও। মন থেকে। সেই অনুতপ্ততা আজন্মকাল স্থায়ী হোক।”

শ্রেয়ান সবটা শুনতে পেল না। বোঝার তাগিদে শুধাল,
-“কী বললে?”
-“আমাকে আর কল করবে না, শ্রেয়ান।”

শ্রেয়ান তাতে খামোকাই অভিমানের সুর খুঁজল, মস্তিষ্কের ভ্রম সেখানে অভিমানটা দেখিয়েও দিলো। একবুক শ্বাস টেনে তাই বলল,
-“করলে কী হবে?”
-“আমি দূর্বল হয়ে পড়ব আবারও..”
-“আমি চাই তুমি দূর্বল হও।”
-“আমি চাই না।”
-“কারো প্রতি দূর্বলতা সাংঘাতিক জিনিস, না চাইলেও তুমি ফিরবেই।”
-“দূর্বলতা গলা চেপে ধরায় নিঃশ্বাস রোধ হোক, মৃত্যু হোক.. আমি ফিরব না।”

শ্রেয়ানের বুকটা ধুক করে উঠল। ওদিকে প্রিয় ততক্ষণে কলটা ছেড়েছে। পা ভেঙে বসে পড়েছে মেঝেতে। শূন্য দৃষ্টিতে মাথা নুইয়ে তাকিয়ে আছে। বুকের ভেতরটা দ্রিমদ্রিম শব্দে চিৎকার করছে। অথচ সে শান্ত! প্রিয়শ্রী জানে, ব্যথাটা কত গভীর! হয়তো সে ফিরতে পারত, হয়তো সে শ্রেয়ানকে আরেকটা সুযোগ দিতেই পারত। কিন্তু তা সম্ভব নয়। প্রশ্ন আসে—কেন সম্ভব নয়? উত্তরে একটা কথাই বারংবার উঁকি মেরে বসে, “অসুস্থ ভালোবাসার ন্যায় কুৎসিততম অনুভূতি কেউ না পাক..”

রুমে প্রবেশ হলো নীহিনের। প্রিয় স্তব্ধ বসে আছে। নীহিন প্রিয়কে এরূপে বসে থাকতে দেখে অস্থির পায়ে এগিয়ে এলো। উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“প্রিয়দি, কী হয়েছে?”

প্রিয় চুপ হয়ে চায় ওর পানে, নরম স্বরে বলে,
-“একা থাকতে দেবে একটু?”

থমকে যায় নীহিন। প্রথমে কিছু বলতে গেলেও, পরবর্তীতে ওকে ছেড়ে রুম থেকে বেরোয়। প্রিয় উঠে চলে যায় মনোহরার কাছে। মনোহরা পানের বাটা সাজাচ্ছিলেন চেয়ারে বসে বসে। প্রিয় তাকে দেখে বলল,
-“বুবুজান, আসি?”

মনোহরা তাকালেন ওর দিকে,
-“আসুন।”

প্রিয় এগিয়ে গিয়ে মনোহরার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। কোল থেকে পানের বাটাটা সরিয়ে টেবিলের ওপর রেখে কোলে নিজের মাথা গুঁজল। মনোহরা হেসে চুলে হাত বোলাতে লাগলেন,
-“মন খারাপ?”
-“খুব।”
-“কেন?”
-“ও ফোন করেছিল।”

মনোহরাকে সেদিনই শ্রেয়ানের বিষয়টা প্রিয় খুলে বলেছিল। মনোহরা শুরুতে কিছুটা কঠোর হলেও, পরে নিজের কোমলতা ওকে দেখিয়ে বলেন, ‘জীবন থেকে সর্বদা ভালো কিছুই যে পাবেন, এমনটা নয়। ভালো-খারাপ যাই পাবেন, শিক্ষা নেবেন। এটাই বেঁচে থাকার মূল উদ্দেশ্য।’

মনোহরা বললেন,
-“কল দিয়েছিল তো কী হয়েছে?”
-“ফিরতে বলছে।”
-“আপনি রাজি?”
-“না।”
-“কেন না?”
-“সেখানে সুখ নেই, বুবুজান। ”
-“তো জড়িয়েছিলেন কেন?”
-“ভুল ছিল..”
-“এখন সঠিক করছেন?”
-“বোধহয়।”
-“তবে উদাসীনতা কীসের?”
-“নিজের প্রতি প্রবল অবিশ্বাস আমার। আশঙ্কায় বুকটা কাঁপে। আবারও যদি একই ভুল করে বসি? আবারও যদি তার চোখে চোখ রাখি? আরও একবার যদি তার প্রেমে পড়ে যাই?”
-“প্রেমে পড়া এতই সহজ, প্রিয়শ্রী?”
-“তার প্রতি আমার এক আকাশ সমান দূর্বলতা আছে।”
-“দূর্বলতা কাটিয়ে উঠুন।”
-“কীভাবে?”
-“নতুন কারো সাথে জড়িয়ে যান।”

প্রিয় আঁতকে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে,
-“অসম্ভব, বুবুজান।”
-“কেন?”

প্রিয় ভাবে, তবে এই কেনর উত্তর তার জানা নেই। প্রিয়কে চুপ হয়ে যেতে দেখে মনোহরা খানিকটা হেসে বললেন,
-“আরেকটিবার সম্পর্কে জড়ালে কি মন্দ হবে?”
-“ভয় করে, বুবুজান।”
-“কীসের ভয়?”
-“সেই কান্না, সেই ফোঁপানো, সেই শ্বাসকষ্ট, সেই বুকে ব্যথা, সেই রাতজাগা, সেইসব যন্ত্রণা! আমি ভাবতে পারছি না আর.. সেকেন্ড টাইম নেওয়ার সাহস করি কী করে? বুবুজান, কাঁদতে কাঁদতে শ্বাসে টান লাগত, চোখ উলটে আসত, বুকের সেই তীব্র ব্যথা! গলা দিয়ে চিৎকারও আসত না। আমি সেকেন্ড টাইম পারব না আর..”

চুলে বিলি কাটতে থাকা হাতটি ক্ষণকালের জন্য থমকে যায় মনোহরার। পরপরই চলমান হয় পূর্বের ভঙ্গিমায়। কোমল স্বরে বলেন,
-“শিক্ষা পেয়েছেন? মানুষ চেনার শিক্ষা? ভুল মানুষকে ভালোবাসার পরিণতির শিক্ষা? অনুভূতির খেলার জঘন্যতার শিক্ষা? পেয়েছেন?”
-“পেয়েছি।”
-“এগোন। আর ভুল করবেন না।”
-“বুবুজান..”
-“আজই বলছি না। নিজেকে গুছিয়ে নিন। আমি আপনার বাবা-মায়ের সাথে বাকিটা কথা সেরে নেব।”
-“জি আচ্ছা।”
-“এখন রুমে গিয়ে রেস্ট করুন, ভালো লাগবে।”
-“আচ্ছা বুবুজান, আসছি।”

প্রিয় নিজের রুমে চলে যায়। মন খারাপের রেশটা অনেকাংশেই কমেছে। রুমে এসে বসতেই, করিডোরের দরজায় করাঘাত হলো। বিরক্তিতে প্রিয়র কপাল কুঁচকে এলো। আলস্যতা নিয়ে উঠে গিয়ে দরজা খুলল। সামনে শরৎ। প্রিয়র কুঁচকানো কপালের ভাঁজ আরও গভীর হলো। শরৎ বলল,
-“নীহিন ডেকে যায়নি?”

কপাল শিথিল হলো প্রিয়র লোকটার আসার উদ্দেশ্য জানতে পেরে। বড়ো ভাব নিয়ে বলল,
-“ওলে বাবালে! আমি যাচ্ছিলাম না বলে একা লাগছে আপনার? তো আগে বলবেন না, ইউ আর মিসিং মি.. আমি এক্ষুনি যেতাম। চলুন যাই।”

প্রিয় শরৎকে পাশ কাটিয়ে হাঁটা দিলো। শরৎ দু-ধারে মাথা নেড়ে ওর পিছে পিছে আসতে লাগল। সামনে প্রিয় এগোচ্ছে। ফুল স্লিভস ফোল্ড করে নিল প্রিয়, খুলে যাওয়া চুলগুলো কাটার সাহায্যে উঁচুতে কোনোরকম আটকে ফেলল। বাঁধা অমান্যকারী বেশ কতকগুলো চুল কপালের দু’পাশ হয়ে নেমে আছে।

শরৎ তা লক্ষ করে নিজের ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে রাখা হাতদুটো বের করল। পরনের লাইট গ্রে কালারের টিশার্টের স্লিভস ফোল্ড করতে লাগল। বাঁ হাত দিয়ে চুলে ব্যাকব্রাশ করল।

প্রিয় হাঁটতে হাঁটতেই বলল,
-“এখন কে কাকে কপি করছে?”

শরৎ কপাল কুঁচকে হাতের ডানে তাকাতেই, জানালার গ্লাসে নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেল। নিজের পক্ষ নিয়ে বলল,
-“আপনার মতো কুর্তার হাতা গুঁজছিলাম নাকি আমি? দেখতে তো পাচ্ছি, আমি একটা সো ড্যাম হট টিশার্ট পরে আছি। আপনি কি অন্যকিছু দেখতে পাচ্ছেন? তাহলে তো সমস্যা। এই দেখুন তো, এখানে কয় আঙ্গুল?”

এটা বলে প্রিয়র চোখের সম্মুখে নিজের ডান হাতের তিনটি আঙ্গুল তুলে ধরল। প্রিয় ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল,
-“নিজেকে এই সাদা শার্ট পরে হিরো ভাবেন? হট হিরো? সরি! লাগছেন না।”

শরৎ প্রিয়র কথায় ভুল ধরল,
-“প্রথমত হিরো ভাবার প্রশ্নই ওঠে না, কারণ আমি হিরোই, হ্যান্ডসাম-হট হিরো। অস্বীকার করতে পারবেন না। আর এটা শার্ট না, টিশার্ট। তাও সাদা নয়; লাইট গ্রে। আপনার চোখে আসলেই সমস্যা আছে।”
-“এই যে, মশাই! সাদাকে সাদা বলতে শিখুন। দীর্ঘদিন নীল রঙ মেরে, রঙ মরে যাওয়া সাদা শার্টকে এমনই দেখায়।”

শরৎ হাসে,
-“অভিজ্ঞ আপনি?”
-“সত্যে অভিজ্ঞ। কে সত্য বলল না বলল, তা বুঝি।”
-“মিথ্যে ধরতে পারেন, প্রিয়?”

শরতের আওয়াজ হুট করেই নরম হয়ে আসে। প্রিয় তাকায় শরতের দিকে,
-“মিথ্যে ধরতে পারি।”
-“আর মিথ্যেবাদীদের?”
-“পারি না।”

নিজের অপারগতা বিনা দ্বিধায় স্বীকার করে নিল প্রিয়। শরৎ বলল,
-“আপনার ছোটবেলার ঘটনাটা মনে আছে? আপনার খালামণি ছোটবেলায় সেটা আমাদের প্রায়ই শোনাত।”
-“কোনটা?”

শরৎ মুচকি হেসে বলে,
-“ছোট বাচ্চারা হামাগুড়ি দিয়ে খেলতে পছন্দ করে, দুষ্টুমি করতে পছন্দ করে, বাবা-মাকে প্রচুর জ্বালায়। অথচ আপনি ওমন কিছুই করেননি। এইজন্য আঙ্কেল-আন্টি আপনাকে নিয়ে প্রচুর টেনশন করত। আপনার ফার্স্ট বার্থডেতে আপনি খাটের শেষাংশ ধরে ধরে হেঁটেছেন, প্রথমবার নিজের পায়ে ভর রেখেছেন এভাবে। তারপর পড়ে গেছেন, তারপর আবার উঠেছেন, আবার হেঁটেছেন। এভাবেই অনেকটা সময় কেটেছে। আপনি ফ্লোরে মুখ থুবড়ে পড়ার সময় চোখ-মুখ কুঁচকে কাঁদার ভঙ্গিমা করেছিলেন অবশ্য, তবে কাঁদেননি। পড়েছেন, উঠেছেন, আবার পড়েছেন আর শিখেছেন।”

প্রিয় হা করে শুনছিল৷ এটা সে জানে। এই কথাটা সবার মুখেই শুনেছে। শরৎ প্রিয়র দিকে তাকিয়ে আবার বলল,
-“লাইফ আপনাকে আপনার ফার্স্ট বার্থডেতেই জীবন চলার শিক্ষাটা দিয়ে দিয়েছিল। আপনি ভুললেন কী করে?”

প্রিয় হোঁচট খায় সিঁড়ির সামনে এসে। শরৎ একহাতে ত্বরিতে ওর বাঁ হাতটা টেনে ধরে উঁচু গলায় বলে ওঠে,
-“সাবধানে!”

প্রিয় নিজেকে সামলে নিয়ে শরতের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয়। ঠিক সেই মুহুর্তেই শরৎ প্রিয়র বাঁ-হাতে অসংখ্য কাটাকাটির দাগ এক ঝলকে দেখতে পায়। কিছু দাগ খুব পুরোনো, কিছু দাগ তারও অধিক পুরোনো। আঁড়াআঁড়িভাবে, লম্বালম্বিভাবে, সবভাবে অসংখ্য দাগ। প্রিয় অপ্রস্তুত হয়ে স্লিভস ঠিক করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে যায়। অসংখ্যাত প্রশ্নের দানা বাঁধতে থাকে শরতের মনে।

চলবে..?

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|২৪|

শান্তিকুঞ্জের সম্মুখের দিকটায় ডেকোরেশনের লোকেদের প্রচণ্ড ভীড়, সেই সাথে বাড়ির কর্তাদের ঘেমে-নেয়ে সবকিছুর দেখভাল। অনুজ্জ্বল রোদ, বাতাসটাও তীব্র বলে কিছুটা শান্তি লাগছে। মেহমানদের আসা শুরু হয়েছে তুমুলভাবে। বাড়ির গিন্নিরা তাদের আপ্যায়নে ব্যস্ত। এক খণ্ড বসার সুযোগটা নেই কারোর।
এর মধ্যে জয়ার শরীর খারাপ করায় তাকে নিয়ে ব্যস্ত আছেন তার শাশুড়ি আশরিফা। এ বাড়িতে বউদের মেয়ের মতোই আদরে রাখা হয়।

মনোহরার ভাষ্যমতে, ‘সবাই বলে মেয়েদের নিজের কোনো ঘর নেই। প্রথমে বাবার ঘর, তারপর স্বামীর ঘর, শেষে সন্তানের ঘর। প্রথমে বাবার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেওয়া লাগে, এরপর স্বামী, শেষে সন্তান। এভাবেই একটা মেয়ের জীবন শেষ হয়। তবে সেই মেয়ের নিজের বলতে রইল কী? সে নিজেকে বুঝবে কখন? নিজের ইচ্ছেকে প্রাধান্য দেবে কখন? আমার বাড়িতে মেয়েদের জন্য আলাদাই নিয়ম থাকবে। এই বাড়িতে ছেলেদের যতটা অধিকার, তার চেয়ে কিঞ্চিৎ পরিমাণ বেশি আমি আমার মেয়েদের দেবো। মেয়েরা তো মায়ের জাত; আমার যেই ছেলের মনে মেয়েদের প্রতি বিন্দুমাত্র অসম্মান জন্মাবে, আমার সেই ছেলেকে আমি তৎক্ষনাৎ ত্যাজ্য করব। কঠিন শোনাচ্ছে? মেয়েদের সম্মান তারও অধিক কঠিন ও দামী কিছু। আমি আপোষে আসব না কখনও। আমি চাই না, এক্ষেত্রে আমার মেয়েরাও কখনও আপোষে আসুক।’

সেই কথা বাড়ির প্রতিটি সদস্য মনে রেখেছে। মনোহরার কথাগুলোর মাঝে তিনি একবারও ছেলের বউ উচ্চারণ করেননি, তিনি প্রতিবারই বলে গেছেন ‘আমার মেয়েরা’। এখানে গিয়ে আবেগি হয়ে ওঠে বাড়ির সকল মেয়ে-বউরা। তাই তারাও তা মেনে চলেন। নিজেদের বউদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম মেনে এসেছেন।

আশরিফা জয়ার চুলের গোড়ায় সামান্য পরিমাণ তেল দিয়ে বললেন,
-“মাথা যন্ত্রণা করতেছে, আম্মু?”

জয়ার প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা করছে, তবুও চেপে গেল,
-“সমস্যা নেই, আম্মু। একটু ঘুমালেই ভালো লাগবে। তুমি যাও। বাড়িতে অনেক মেহমান আসছে। ওদিকে তোমার প্রয়োজন।”

আশরিফা খাটের ওপর উঠে বসে বললেন,
-“কোলে মাথ রাখ তো। আয়, চুলে বিলি কেটে দিই, ভালো লাগবে।”

ছলছল চোখে জয়া শাশুড়ির কোলে মাথা রেখে বলল,
-“শুধু শুধু আম্মু..”
-“মার খাবি? চুপ থাক। ওদিকে ভাবিরা আছেন, দেখে নেবেনি।”

জয়া দুইহাতে আশরিফার কোমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজল। আশরিফা হেসে উঠলেন,
-“পাগল মেয়ে!”

গোধুলির এই মিষ্টি ঝাঁজালো রোদের শাসানি অমান্য করে বাড়ির পশ্চিমের বাগানের দিকটায় খোলা আকাশের নিচে গোল হয়ে বসে আছে একদল ছেলে-মেয়ে। রিধিমা গিয়ে মাঝের বোতলটা ঘুরিয়ে দিলো। সবার দৃষ্টির মধ্যমণি এখন এই বোতলটা। প্রচণ্ড তেজে ঘুরতে ঘুরতে অবশেষে তার ঘুর্ণন গতি কমতে লাগল। সবার গভীর মনোযোগে বোতলের মুখের দিক চেয়ে আছে। সেটা অবশেষে থামার প্রস্তুতি নিল। আর থেমে গেল। বোতলের মুখের দিকে লক্ষ করে সবাই ওপাশের মানুষটার দিকে একত্রে তাকাল।

নিশান হেহে করে হেসে উঠল। কর্লার গুছিয়ে নিয়ে বলল,
-“বোতলও মানুষ চেনে। স্পেশ্যাল কে, তা জানে।”

কেউ যেন শুনলই না তা। রিধিমা জিজ্ঞেস করল,
-“এই নিশ্যাইন্যা! কী নিবি? ট্রুথ নাকি ডেয়ার?”

নিশান ভাব নিয়ে বলল,
-“অভ্যিয়াসলি, আ’ম অ্যা ডেয়ারিং পার্সন!”

ডেয়ার দিলো উলটো দিকে বসে থাকা নিধি,
-“বড়ো আব্বুকে কল দে। কল দিয়ে বল তুই রিলেশনে আছোস ছয় বছর ধরে। আর তোর গার্লফ্রেন্ড এবার ক্লাস ফাইভে, সিক্সে উঠলেই তুই বিয়ে করতে চাস। পারমিশন নে।”

কেশে উঠল নিশান। একত্রে সবার হাসি তখন আকাশ কাঁপিয়ে তুলল। নিশান অবশ্যই একজন সাহসী ছেলে। সে ফট করে কল লাগাল তার বাবাকে। রিং হতে লাগল। তৃতীয় রিংয়ে কল রিসিভ হলো।

ওপাশ থেকে সানোয়ার সাহেব বললেন,
-“হ্যাঁ বলো।”
-“বাবা, কী করেন?”
-“ফ্রন্ট ইয়ার্ডে আছি, তুমি? কিছু বলবা? বলো জলদি। কাজ করছি।”

নিশান গলা ঝেড়ে নিল,
-“বাবা, আসলে খুব ইম্পর্ট্যান্ট একটা কথা ছিল।”
-“হ্যাঁ, শুনছি। বলো।”
-“আসলে, বাবা..”
-“কী?”
-“আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি।”
-“কী? মজা নিচ্ছ, নিশান?”
-“না, বাবা। আ’ম সিরিয়াস।”
-“তোমার ওসবের বয়স হয়নি এখনও। মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো।”
-“বাবা, বয়স আরও ছয় বছর আগেই হয়েছে।”
-“মানে?”
-“সম্পর্কে আছি ছয় বছর ধরে।”

ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না। নিশান ডাকে,
-“বাবা!”
-“ছয় বছর আগে তোর বয়স কত ছিল?”

নিশান হিসেব করে জানায়,
-“বাবা, ১৭।”
-“কোন ক্লাসে ছিলি?”
-“মেট্রিক পাশ।”
-“দাড়ি গজিয়েছিল?”
-“না..”
-“আর তুই সেই বয়সে প্রেম করছোস? আবার আমারে বলতেছোস? জুতা খাস না কতদিন?”
-“বাবা, ওমন করেন কেন?”
-“তোরে জুতাব ব্যাটা, সামনে আসিস খালি।”

নিশান এবার বোম ফাটাল,
-“বাবা, আমি বিয়ে করতে চাই ওকে। ও বলেছে, কদিন পর ক্লাস সিক্সে উঠবে। এর মধ্যে বিয়ে যদি না করি ও হারপিক খেয়ে সুইসাইড করবে। বাবা, আমার নিব্বি মরলে ওর নিব্বাও মরে যাবে। আপনি কি চান আপনার ছোটগ্যাদা এভাবে মরে গিয়ে ইতিহাস গড়ুক? যদি না চান তবে আমাদের প্রথম অপশন ‘হ্যাঁ আমি বিয়াত্তে কবুল’-এ নির্দ্বিধায় ক্লিক করেন। আব্বা, আপনে রাজি?”

সানোয়ার সাহেব খেঁকিয়ে উঠলেন,
-“মশকরা হচ্ছে, হারামজাদা?”
-“হয়, এট্টু। রাইগেন না, বাবা। লাভ ইউ।”

নিশান কল কেটে দিলো। আটকে রাখা হাসিতে চারপাশ মুখরিত হয়ে উঠল। বোতল আবারও ঘোরানো হলো। এবার গিয়ে থামল নীহিনের দিকে। নীহিন ট্রুথ নিল। রূপা বলল,
-“বাচ্চা-কাচ্চা মানুষ! তোকে আর কী জিজ্ঞেস করি?”

প্রিয় সরু চোখে নীহিনের লাজুক মুখপানে তাকিয়ে থেকে বলে,
-“শেষ মিথ্যে কখন বলেছ? আর কী বলেছ?”

নীহিন এদিক-ওদিক তাকাল। মিনমিনে স্বরে বলল,
-“আমি মিথ্যা বলি না।”

আর তারপরই বলে উঠল,
-“এটাই শেষ মিথ্যে, আর এখন তোমাকে বললাম।”

রিধিমা শুধায়,
-“এর আগে?”
-“একবারই প্রশ্ন করা যায়, রিধিমাদি।”

হাসল নীহিন। রিধিমা আফসোসের ভঙ্গিমায় মাথা নাড়ে। প্রিয় সেভাবেই তাকিয়ে থাকে। নীহিন সেই মিথ্যের প্রকাশ ঘটাতে চায়নি বলেই এমন কাজ করল, ব্যাপারটা হতে সে অবগত।
আবার বোতল ঘোরানো হলো। এবার বোতলটি শরতের দিকে এসে থামল। রিধিমা বলল,
-“দাদাভাই, কী নেবে বলো?”

শরৎ বলল,
-“ট্রুথ।”

হইহই শুরু হলো কে জিজ্ঞেস করবে তা নিয়ে। সবাই আপনমনে বিভিন্ন প্রশ্ন নির্ধারিত করে ফেলেছে ইতোমধ্যে। সবাইকে ছাপিয়ে প্রশ্নটা প্রিয় করেই ফেলল,
-“গার্লফ্রেন্ড আছে?”

হুট করেই সব স্তব্ধ হয়ে গেল। কেউ কোনো রা করছে না। গাছ থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ে, মাটির ওপর পড়ে থাকা পাতাদের সাথে লেগেও শব্দ করছে। সেই শব্দও যেন স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। গোলকের অভ্যন্তরে বসে থাকা সবার দৃষ্টি শরতে নিবদ্ধ। তারা জানে শরৎ নেতিবাচক জবাবই দেবে। তবুও ধৈর্যে কুলোচ্ছে না। অপেক্ষারাও জ্বালাচ্ছে।

শরৎ সেসব দেখে হাসে, দু-দিকে মাথা নেড়ে বলে,
-“আছে।”

বিস্ফোরণ হলো বোধহয়! কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। শরতের গার্লফ্রেন্ড আছে? এই বয়সে থাকাটা স্বাভাবিকই বটে, তবুও কেন যেন কেউই মেনে নিতে পারছে না। কেউ কখনই শরৎকে ফোনে কারো সাথে ঢের সময় অবধি কথা বলতে দেখেনি, কোনো মেয়ে বিষয়ক কারণে শরৎকে জড়াতে দেখেনি। ওরা অনেক খোঁজ নিয়েছে শরতের ব্যাপারে, তবুও কোনো সন্দেহজনক কিছু পায়নি। এখন কীভাবে কী?

এর মধ্যে শরৎ এগিয়ে এসে বোতল ঘোরাল। বোতলটা প্রহরের দিকে মুখ করে থামলে সবাই সেদিকে খেয়াল দেয়, অথচ মন পড়ে আছে শরতের খানিকক্ষণ আগের কনফেশনেই।

প্রহর ডেয়ার নিল। ওকে বলা হলো গান গাইতে। নীহিন শরতের রুম থেকে ওর গিটারটা এনে দিলো। প্রহর সুর তুলল..

আমি যে মাতাল হাওয়ারই মত হয়ে
যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে
আমি যে মাতাল হাওয়ারই মতো হয়ে
যেতে যেতে পায়ে পায়ে গেছি জড়িয়ে

কী করি ভেবে যে মরি বলবে কী লোকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে
কী নামে ডেকে বলব তোমাকে
মন্দ করেছে আমাকে ঐ দু’টি চোখে..

নীহিনের মনের মাঝে ভালো লাগার ফুলের কুড়ি জন্মাল। তার কিশোর-হৃদয়ে কিছু একটা হলো, অদ্ভুত কিছু একটা হলো। সর্বনাশা দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইল ওদিকটায়।

বোতল ঘোরানো হলো আবার। রিধিমার দিকে ঘুরল। ও ডেয়ার নিল। ওকে আরহা বলল,
-“দিভাই, তুমি জিজুকে কল দাও। কল দিয়ে বলো, তুমি পালিয়ে বিয়ে করতে চাও। বিয়ের আগের দিন রাতে হলুদ শেষে সবাই যখন ঘুমোতে যাবে, সেই ফাঁকে দুইজন পালাবে।”

রিধিমা বলল,
-“পাগল? ও যা সিরিয়াস! ফোনেই বকে-ঝকে শেষ করে দেবে!”

তবুও শেষমেষ রিধিমা তাশিনকে কল দিলো। তাশিন কাজিনদের মাঝে বসে তাদের বিভিন্ন প্ল্যানিংস শুনছিল। হঠাৎ কল আসায় সে সম্মুখে উপস্থিত সবাইকে বলল,
-“এক সেকেন্ড!”

এই ফাঁকে তার ছোট ভাই কলার আইডি দেখে নিল। তাশিন আস্তে-ধীরে ওখান বারান্দার দিকে থেকে কেটে পড়ল। এর মাঝে সকলের পিঞ্চ করে হাসি-তামাশা শুনতে ভুলল না। মুচকি হাসল সে। বারান্দায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে কানে ফোন ঠেকাল। ঠোঁটের কোণে হাসি রেখে বলল,
-“মিসড্ মি, ম্যাডাম?”

রিধিমা অপ্রস্তুত হলো। শুভ্র গালে ধরা দিলো লালচে আভা। ফোনটা স্পিকারে ছিল। এদিকে সবাই ঠোঁট চেপে হেসে যাচ্ছে। রিধিমা নিজেকে স্বাভাবিক করতে চাইল,
-“বয়েই গেছে আপনাকে মিস করতে।”

ওপাশের ভদ্রলোক আরও হাসল,
-“তাই না?”
-“হ্যাঁ তাই!”
-“তবে তো ভীষণ ভুল করলে। তোমার উচিত ছিল আমাকে মিস করা। প্রতিটি আলাদা আলাদা মুহূর্তে তোমার উচিত আমাকে ভিন্নভাবে অনুভব করা। তুমি করলে না কেন? তবে কি আমার ভালোবাসা তোমাকে টানছে না? উম..ঠু ব্যাড!”

রিধিমা মরেই যাবে এবার। কী শুরু করল লোকটা? এদিকে বলতেও পারছে না পাশে ভাই-বোনেরা বসে আছে। ইশ!
রিধিমা প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল,
-“আমার একটা শখ আছে।”
-“আপনার সব শখ পূরণের দায়িত্ব আমার তো। বলুন, শুনি।”
-“বলছিলাম..”
-“হু, বলছিলেন?”
-“চলুন পালিয়ে যাই।”
-“কী? আব্.. ওকে…”

বিস্মিত কণ্ঠের ইতিবাচকতার সাথে তাশিনের আওয়াজে সামান্য হাসিটাও মিশ্রিত। রাগের বদলে লোকটা হাসছে? বুঝে এলো না রিধিমার। তাশিন তখন বলল,
-“পালিয়ে বিয়ে করার ইচ্ছেটা মাসখানেক আগ অবধি আমারও ছিল। সেই টিনেজ থেকে বিভিন্ন প্ল্যান করে এসেছি। আপনার সাথে প্রেম করার পর মনে হলো, ফাইনালি আমার প্ল্যান সাক্সেসফুল হবে। ইনফ্যাক্ট আপনার বাড়িতে যেদিন প্রোপোজাল পাঠালাম, সেদিনও আমার রুমে বসে বসে প্ল্যান কষেছি পরদিন কীভাবে পালানো যায়। আপনি না আসতে চাইলে কী করব? কিছু গুণ্ডা ভাড়া করব, এরপর কিডন্যাপ করব। তারপর বিয়ে, বাসর, বছরের মধ্যে এক বাচ্চা, দ্বিতীয় বছরে দ্বিতীয় বাচ্চা, তৃতীয় বছরে তিন নাম্বারটা… এভাবে চলতে চলতে পার্সোনাল ক্রিকেট টিম নিয়ে আপনার বাপের বাড়িতে গিয়ে তাদের মানাব। আমার এত এত প্ল্যান সব আপনার বাড়ির লোকদের অসামান্য আন্তরিকতার জন্য ক্যান্সেল হলো। দুদিন সিগারেটও খেতে পারিনি দুঃখে, জানেন? চলেন পালাই।”

এপাশে সবার হাসি থেমেছে। তব্দা খেয়ে বসে আছে একেকজন। তাদের ভোলাভালা দুলাভাই তলে তলে এই রকমের শয়তান বেরোল? সবাই পারে না কেঁদে দেয়। রিধিমা ত্বরিতে কল কেটে দিয়ে সবার দিকে তাকায়। সবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় চকচকা মুখগুলো দেখে রিধিমা হে হে করে হেসে বলে,
-“বি ইজি, মেবি কাজিনরা মিলে ওর গ্লাস এক্সচেঞ্জ করে শরবতের বদলে স্বর্গীয় কিছু দিয়ে গেছে। আর নাহলে এত মানুষের গ্যাঞ্জামে জামাই আমার পাগলাইয়া গেছে।”

সব স্বাভাবিক হলো আস্তে-ধীরে। এরপর আবার বোতল ঘোরানো হলো। এবার থামল প্রিয়র দিকে। প্রিয় নরম গলায় বলল,
-“ডেয়ার।”

সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে প্রিয়র ডেয়ারটা দিলো শরৎ। ইশ! প্রিয়র মুখটা দেখার মতো হয়ে গেল…

চলবে…