শুক্লপক্ষের পরিশেষে পর্ব-৪৬+৪৭

0
332

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪৬|

ভীষণ শীতল এক সন্ধ্যেতে শরৎ অফিস থেকে ফিরে প্রিয়কে কল দিলো। বরাবরের মতো শুধাল,
-“কী করছেন, প্রিয়? আমি লেট আজ, তাই না?”

প্রিয় বারান্দায় বসে ছিল, আকাশ দেখছিল। পরনে একটা নীল পাড়ের লাল শাড়ি। নীল ফুল স্লিভসের ব্লাউজ। হাতে স্বর্ণের দুটো চিকন চুড়ি। নাকে ছোট একটা স্বর্ণদানা জ্বলজ্বল করছে। সকালে কিছু কেনাকাটা করার সময় কী মনে করে যেন প্রিয় গোল্ডের দোকানে ঢুকে পড়েছিল। চোখ গিয়ে আটকেছিল এই দুটো জিনিসে। নিজেকে তখনই তাতে কল্পনা করে নেয়, আর তারপর কিনে নেয়। সেই থেকেই পরে আছে সেসব। বাড়ি এসে সেই যে শাওয়ার নিয়ে শাড়ি পরে নিজেকে বউ সাজিয়ে নিয়েছে, এখনও ওভাবেই রয়েছে। তার ভেতর কেমন গিন্নিপনা দেখা যাচ্ছে! কণ্ঠটাও অত্যাধিক কোমল। চোখদুটোতে একরাশ স্নিগ্ধতা ছেয়ে আছে। এই তো সেদিন যখন দীর্ঘক্ষণ দু’জনের চোখাচোখির সন্ধিকাল ছিল, মুগ্ধতায় আবেশিত হয়ে শরৎ ছোট-ছোট অক্ষরে বলে বসেছিল,
-“পদ্ম, পদ্ম, পদ্মলোচনা আমার!”

আড়ষ্টতায় তখন প্রিয় কিংকর্তব্যবিমুঢ় বনে গেলেও আপাতদৃষ্টিতে এখন সে কিঞ্চিৎ হেসে ফেলল। কেন হাসল? ‘আজ’-কে চুপচাপ বসিয়ে রেখে ‘গতদিন’-এর গল্প ভেবে হাসল? পাগল মেয়ে!

শরৎ প্রিয়র নিশ্চুপতায় শুধাল,
-“ম্যাডাম, হাসছেন কেন?”

শব্দ হচ্ছিল না হাসির, দেখাদেখি হওয়ার সম্ভাবনাটাও তলানিতে। প্রিয়র হাসি থেমে গেল, পদ্মলোচনে চমক ফুটে উঠল। ম্লান হয়ে আসা সূর্যের আলো তখন প্রিয়র অবাক দৃষ্টিতে মিলন ঘটাল। নাকফুলটা মুখটার সৌন্দর্য কয়েক শতগুণ বাড়িয়ে তুলল। প্রিয়! গোধূলি কন্যা!

নিজস্বতায় চমক লুকিয়ে, থেমে থেমে প্রিয় শুধাল,
-“বুঝলেন কেন?”

হো হো করে শরৎ হেসে ফেলে বলল,
-“সেই পুরুষ কোনো পুরুষই নয়, যে নিজের নারীকে মুখস্ত না রাখে। প্রিয়, আপনি আমার ভীষণ শখের, আপনাকে আমি গোটাটা জানি।”

প্রিয় গা এলিয়ে দিলো দোলনায়। ভাঁজ করে কাঁধে তুলে রাখা শাড়ির আঁচলটা গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বড়ো অবমূল্যায়ন করে বলল,
-“আপনি তো আমাকে পেয়েছেনই নীরজ, এখনও কীসের এত উপরি কথা-বার্তা?”

যেন কৌতুল শুনল শরৎ,
-“উপরি কথা? ম্যাডাম, আমি প্রেমিক নই, প্রেমিক হওয়ার বয়সটা আমার নেই। সো ওসব উপরি কথা বলাটা আমার সাথে যায় না।”

কথাটা বলে থামল সে, এই পর্যায়ে সামান্য দাম্ভিকতার সাথে বলল,
-“তবে একজন আদর্শবান ও ভীষণ দায়িত্বশীল স্বামী আমি। যার সর্বোপরি দায়িত্ব হলো স্ত্রীকে সন্তুষ্ট রাখা। স্ত্রী যদি দুটো রসিকতায়ও খুশি হয়, তবে তাই করা। বেশি বেশি তার প্রশংসা করা। আমি আপনার প্রশংসায় কোনো ত্রুটি রাখব না, আমি আপনাকে কখনও অসন্তোষে রাখব না।”

কথাটায় কিছু না কিছু ছিল, প্রিয়র কথাখানা চাপা পড়ল। আমতা-আমতা করতে লাগল। শরৎ গলার টাইটা ঢিলে করে সোফায় কাউচে এলিয়ে বসে পড়ল। ক্লান্ত আওয়াজে বলল,
-“কী করছেন? কী, প্রিয়?”

জবাবে প্রিয় প্রসঙ্গক্রমে নিজের মতামত দিলো,
-“নীরজ, চলুন সোশ্যাল ম্যারেজ করি। কার্ড ছাপাতে বলুন। আজ ৯ তারিখ। আগামী শুক্রবার, ২০ তারিখ আমরা বিয়ে করব।”

বোধহয় ক্লান্তি মাথায় চড়ে গেছে তার। ভাবখানা এমন করে চোখ দু-খান বুঁজে ফেলল। পরক্ষণেই বড়ো বড়ো করে তাকাল সে। আওয়াজ যথেষ্ট স্বাভাবিক তার। নিশ্চিত হতে শুধাল,
-“আবার বলেন।”

ঘাবড়ে গেল প্রিয়,
-“মানে.. বলছিলাম.. এভাবে বিবাহিত ব্যাচেলর থাকাটা কেমন একটা না?”

শরতের দু-চোখের মুগ্ধতা ভরপুর। সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। স্পষ্ট দু-চোখে ফুটে উঠেছে তার প্রিয়তমা স্ত্রীর লাজুক মুখখানা। ক্ষণিকের মুগ্ধতা ও আবেশে দু-চোখ জুড়িয়ে এলো, বুঁজে নিল, ফের বলল,
-“আবার শুনতে চাইছি, ফুল।”

প্রিয় থমকে যায় সহসা। দোল খেতে থাকা দোলনাটাও মেঝে ও পায়ের ঘর্ষণে থামিয়ে দেয়। সময় নেয়। নিজেকে অত্যাধিক কোমল করে তোলে। অপরিমেয় নমনীয়তার সাথে বলে,
-“বিয়ে করতে চাই।”

হাসল শরৎ,
-“উঁহু, এভাবে না।”
-“সোশ্যালিজম মেইনটেইন করি, চলুন।”
-“পারব না।”
-“আমাকে জ্বালাচ্ছেন, নীরজ?”
-“উঁহু। সঠিকভাবে বলেন।”
-“উফফ! আর কী?”
-“ম্যাচিউরিটি সাইডে রাখেন।”
-“কীভাবে?”
-“যেভাবে চাইছি আপনাকে, ঠিক ওভাবে।”

অতঃপর প্রিয় না ভেবে বড়ো করে একটা শ্বাস টেনে বলল,
-“আমার ভীষণ ম্যাচিউর জীবনে এক মুঠো পাগলামি হিসেবে আপনাকে চাই। যখন-তখন দুজন পাগল হব, রাত-বিরেতে ছাদে বসে থাকব, রাস্তা দিয়ে হাঁটব, বৃষ্টিতে কাঁদায় মাখামাখি করব, অকারণে হাসব, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে যাওয়ার আগ মুহূর্তে চাওয়া-পাওয়ার হিসেবে বসব, প্রাপ্তির আকাশটিতে আমার এখন একজন মানুষ আছে। তা ভেবে আবারও হেসে উঠব। আমি বুঝতে পেরেছি, একা থাকাটা ভীষণ টাফ। আই গ্যেস.. আই গ্যেস আই নিড ইউ..”

এক চিলতে সুখ শরতের আওয়াজে,
-“অ্যান্ড দ্যাটস হাউ, আই ওয়ান্টেড ইউ!”

প্রিয় ত্বরিতে কল কেটে দিলো। তারপর সেই যে বিছানায় গা এলালো, আর উঠল না। উবু হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকাকালীন হুট করেই আজ বহুদিন পর প্রিয়র কল্পপুরুষের আগমন ঘটল, আচমকা! তার মুখটা কেমন উদাসীন। সে সোজা হয়ে পাশে শুয়ে পড়ল। প্রিয় তা লক্ষ করে বলল,
-“বহুদিন বাদে এলে! কেমন আছ?”

কল্পনায় উত্তরগুলো প্রসঙ্গ কাটল,
-“খুব খুশি তুমি?”

প্রিয় ভাবল। সে কি আদৌও খুশি? ভেবে ভেবে উত্তর পেল না। তবে টের পেল, দুঃখে থাকার মতো তো কিছু হয়নি। কাত্ হয়ে শুয়ে থাকায় চুলগুলো মুখে বিছিয়ে পড়েছে, লাস্যময়ী চোখগুলোয় কত গল্প! প্রিয় কল্পপুরুষকে বলল,
-“খুব।”
-“শুভ কামনা নতুন জীবনের জন্য।”

প্রিয় হেসে ফেলল,
-“রেগেছ, প্রাণ?”
-“নাহ।”
-“তোমার চেহারার অভিব্যক্তি আমি আজ ধরতে পারছি না।”
-“পারার কথাও নয়।”

প্রিয় জড়িয়ে আসা আওয়াজে বলল,
-“কেন বলো তো?”

সে চুপ থাকল। প্রিয়র চোখে চোখ রাখল। চোখ ছোঁয়াতে লাগল কপালে, সিঁথিতে, ভ্রু-তে, গালে, নাকে এসে থেমে গেল। মিষ্টি হেসে বলল,
-“তোমার বরের মতো করে বলতে গেলে—বিবিজান লাগছে।”

প্রিয় আহ্লাদী হয়ে বলল,
-“তুমি ইদানিং দেখা দাও না কেন, প্রাণ?”
-“কারণ আমি দুঃখ।”
-“তবে বলছ, আমি সুখে আছি?”
-“বলছি।”
-“তাহলে তুমি আর আসবে না?”
-“আসব।”
-“কবে আসবে?”
-“যখন যখন তুমি যন্ত্রণায় কাতরাবে!”
-“বদদোয়া করছ?”
-“না।”
-“তবে?”
-“সত্য বলছি।”
-“কীভাবে।”
-“যেভাবে একটা মানুষ গোটা জনমভর সুখে থাকতে পারে না।”

প্রিয় প্রলম্বিত শ্বাস টেনে সোজা হয়ে শুয়ে রইল। সিলিংয়ে দৃষ্টি স্থির তার,
-“তোমাকে আমি ছাড়তে চাই না। পৃথিবীতে নিজের বলতে একমাত্র তুমিই আমার আছ।”
-“আমাকে তুমি হারাবেও না কখনও।”

প্রিয় ছলছলে চোখে তাকালে সে হেসে বলে,
-“ভেবে দেখো। আমি তোমার প্রিয় পুরুষ, বাস্তবে যার অস্থিত্ব নেই। বাস্তবে যে আছে, খুব শীঘ্রই সে আমার থেকেও অধিক প্রিয় হয়ে যাবে তোমার কাছে। তখন আমি আর তোমার মানুষটা অভিন্ন হব। মানসিকভাবে ও শারীরিকভাবে একজন হব।”

প্রিয় কিছুক্ষণ ভেবে জিজ্ঞেস করল,
-“তবে তোমার আওয়াজ আজ এত অভিমানী কেন?”
-“কারণ খুব শীঘ্রই এই আমিটা বিলীন হব।”

প্রিয় আঁতকে উঠে পাশে তাকায়, হালকা আসমানী রঙা বিছানার চাদরের ওপর তার সুতির শাড়ির নীলচে প্রান্তদেশ বাদে কিচ্ছুটি নেই।

_____
তুশি আজ বেশ সেজেছে। গায়ে কাঞ্জিভরম শাড়ি, হাতে বেশ মোটাসোটা বালা, গলায় জড়োয়ার হার৷ মিষ্টি মুখটিতে খুশি জ্বলজ্বল করছে। আজ শ্রেয়ানের মা-বাবার ম্যারেজ অ্যানিভার্সেরি উপলক্ষে বাড়িতে ছোটখাটো একটা অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। শ্রেয়ান অফিসে যায়নি আজ, বাসা থেকেই কাজ করছে। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আছে, কোলে ল্যাপটপ, হাতের আঙুলগুলো বিক্ষিপ্তভাবে কী-বোর্ডে। মুখভঙ্গি সিরিয়াস।
তুশি বেশ মজা পেল। একবার আয়নায় নিজেকে দেখছে, নিজের গায়ের গয়না ঠিক করছে। আবার আঁড়চোখে স্বকীয় স্বামীকে দেখছে।

ধরা পড়ল ঠিক তখন, শ্রেয়ান সামনে দৃষ্টি স্থির রেখে বলল,
-“কী ব্যাপার? কিছু চাই?”

জিভে কামড় দিলো তুশি। আয়নার দিকে নিজেকে দেখতে লাগল। তারপর আবার সোজা হয়ে শ্রেয়ানের দিকে দু’কদম এগোল। সামান্য কেশে উঠল তুশি। শ্রেয়ান বলল,
-“হুঁ, বলো।”
-“বলছি, কেমন লাগছে আমায়?”

শ্রেয়ান তাকাল একবার। লাজুক মুখটিতে উপচে পড়া খুশি মেয়েটার। তা দেখে কিঞ্চিৎ হাসল, বলল,
-“সুন্দর দেখাচ্ছে।”

আহ্লাদিত হয়ে তুশি বলল,
-“আপনাকেও।”
-“তাই না?”
-“জি।”

শ্রেয়ান হো হো করে হেসে বলল,
-“থ্যাংক ইউ!”

অমন মনোমুগ্ধকর হাসি দেখে তুশির মুহূর্তেই মনে হলো, ‘আচ্ছা! তার স্বামী কি এভাবেই অন্যকারোর প্রশংসা করেছে? এভাবেই হেসেছে অন্যের জন্য?’

বুক ভার হয়ে উঠল তার। মুহূর্তেই তৈরি মলিনতা চেহারায় স্পষ্ট ফুটে উঠল। শ্রেয়ান তুশির ডানহাতের কবজি ধরে পাশে বসালো। নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
-“কী হয়েছে? মন খারাপ হলো কেন?”

সহসা স্বীকারোক্তি দিলো তুশি,
-“আপনি কি এভাবেই অন্য কাউকে সুন্দর বলতেন? অন্য কাউকে নিজের মেনে ভালোবাসতেন?”

ভালোবাসতো, নিজের মানতো, সর্বোচ্চতে প্রশংসা করতো! মেয়েটি ছিল প্রিয়। ছিল? এখন নেই? শ্রেয়ান নিজের ভেতর থেকে উত্তর পায় না। জবাবে কিছু বলতে পারে না। শ্রেয়ানের থেকে সান্ত্বনামূলক কধা শুনতে না পেয়ে তুশির মনটা কেঁদে ওঠে। তার স্বামীর দু-চোখ অন্য কারো জন্য মুগ্ধতা ছিল? সে কীভাবে মেনে নেবে এসব? চোখ ভিজে এসেছে। জল গড়িয়ে পড়বে। এমতাবস্থায় শ্রেয়ান বলে উঠল,
-“দুনিয়াতে সকল অনুভূতিই নশ্বর। অবিনশ্বর যদি কিছু থেকে থাকে, ওটা হলো—আমি তোমার স্বামী।”

তুশি আমোদিত হলো। বোকাবাবু শ্রেয়ান টের পেল না—“অনুভূতি সব অমর, তাদের মৃত্যু নেই, তারা ছাঁই হয়ে উড়ে যায়, মিশে যায় মাটিতে। প্রিয় তার অপ্রিয় অনুভূতি। যাকে সে নিজ দায়ে ভস্ম করেছে।”

চলবে..

#শুক্লপক্ষের_পরিশেষে
#লেখনীতে_নবনীতা_শেখ
|৪৭|

শান্তিকুঞ্জের চারপাশটা কী সুন্দর আলোক উৎসবে মেতেছে! শব্দে, আনন্দে, আয়োজনে কোণায় কোণায় ভরে উঠেছে। বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে নেতৃত্ব দিচ্ছে শুভ্র। পরনে মেরুন রঙা শেরওয়ানি, সাদা পাঞ্জাবি। সামনে দুটো পিচ্চির হাতাহাতি চলছে, তা দেখে শুভ্র একহাত উঁচিয়ে বলল,
-“ভাইয়েরা আমার, থামো থামো। উৎসব তো কেবল শুরু। আমার দাদাভাই আমাকে ভাবি দিয়েছে। এই উপলক্ষে প্রতিমাসে আমার বাড়িতে তোমাদের দাওয়াত। মারামারি কোরো না কেউ। আসো মিলে যাই।”

ছেলে দুটো একে-অপরের দিকে দু-বার তাকাল। ঝগড়া মাঝপথে থেমে আছে। এখন কি কন্টিনিউ করবে? কিন্তু কীভাবে করবে? তাদের লিডার তাদেরকে থামার আদেশ দিয়েছে যে! এরপরের চোখাচোখিতে ছেলে-দুজন মুচকি হাসল একে-অপরের দিকে তাকিয়ে। তারপর কোলাকুলি করল। একগাল হেসে শুভ্র বলল, “গুড বয়েস!”

‘আয়না দেখা’ এর সময়টাতে প্রিয় লজ্জা পাচ্ছিল ভীষণ, আর শরৎ মুগ্ধ হয়ে সেই লাজুকতা দেখে গেছে। রিধিমারা হাসতে হাসতে ঢলে পড়েছিল একে-অপরের গায়ে। যখন প্রিয়কে জিজ্ঞেস করা হলো, আয়নায় কী দেখতে পাচ্ছে।

নিষ্পলক তাকিয়ে প্রিয় বলেছে,
-“আমার মানুষ।”

একই প্রশ্ন শরৎকে করাতে, সে উত্তর দিয়েছে।
-“ব্যক্তিগত নারী।”

শরৎ ও প্রিয়র বিয়ে সম্পন্ন হলো কিছুক্ষণ আগে। বিভিন্ন আনুষ্ঠানিকতা শেষে প্রিয়কে শান্তিকুঞ্জের দোতলার শেষ ঘরটিতে বসিয়ে রাখা হয়। বাসর সাজিয়েছে ছেলে-মেয়েরা। কামিনী ফুল দিয়ে বাসর। প্রিয়র পরনে একটা সাদা লেহেঙ্গা আর সিলভার জুয়েলারি। সব সাদার মাঝে ঠোঁটে গাঢ় গোলাপি লিপস্টিক। কী ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে!

মাথার ওড়নাটা ঠিক করতে গিয়ে জুয়েলারির রিনঝিন শব্দ হতে লাগল। খট করে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করল শরৎ। আর মুহূর্তেই দরজা আটকে ফেলল। ক্লান্ত সে। বসে পড়ল সামনের সোফাতেই। একহাতের পিঠে কপালের ঘাম মুছে নিল। ভ্রু কুঁচকে প্রিয় বলল,
-“অমন করে কে আসে? মনে হলো যুদ্ধ করে আসছেন, নীরজ ভাই।”

দু-হাত দু-পাশে ছড়িয়ে সোফায় ঘাড় এলিয়ে ফেলেছে শরৎ। একবার উঁচিয়ে তাকাল আবার। খানিকক্ষণ আগে করা কথার জবাবে বলল,
-“কম কী? আপনার দেবর/ননদগুলোর সংখ্যা তো নগন্ত। তাই না? উফফ! কী গ্যাঞ্জামরে ভাই! বলে যে নো মানি, নো হানি। কেন রে? ঘর আমার, বউ আমার। আবার আমাকেই টাকা দিয়ে টিকিট কেটে ভেতরে ঢোকা লাগবে? ২/৪ জন হলে মানা যেত, কিন্তু। চ্যাহ! আমার অর্ধেক মান্থের স্যালারি।”

প্রিয় আঁতকে উঠল,
-“নীরজ ভাই, আপনি কিপটা? ফাইনালি এক কিপটুস লোকের সাথে বিয়ে হলো আমার?”

শরৎ হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। তারপর বলল,
-“এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন বিয়ে করার জন্য মরেই যাচ্ছিলাম আমি।”

প্রিয়র গলার সাইড দিয়ে একটু জ্বলুনি হচ্ছে। ওদিকে হাত দিয়ে ডলতে ডলতে বলল,
-“তা নয়তো কী?”

চোখ বন্ধ করে শরৎ বলল,
-“আমি কখনোই আপনার জন্য রোডসাইড রোমিও সাজিনি।”
-“তবে আকারে ইঙ্গিতে বুঝিয়েছেন—আমাকে আপনি না পেলে যেন আপনার গোটা দুনিয়াটা বৃথা হয়ে যেত!”

একগাল হেসে শরৎ বলল,
-“শোনেন বিবিজান, কেউ কাউকে না পেলে যেমন মরে না, তেমনই কাউকে পেলে জীবন ধন্য অথবা না পেলে দুনিয়া বৃথা হয়ে যায় না। তাই বলে যে আপনাকে না পেলে আমার কিছুই হতো না, তা-ও নয়। কিছু হতো অবশ্য। কী হতো, জানেন?”

ছোট করে জিজ্ঞেস করল প্রিয়,
-“কী হতো?”
-“আপনাকে না পেলে আমার আমৃত্যু আফসোস থেকে যেত। আকাশের দিকে তাকালে বলতে ইচ্ছে হতো, ‘ইশ! আমার নিজস্ব আকাশ নেই।’ আমার এই অগোছালো জীবনটা গুছিয়ে নেওয়ার অত তাগিদ থাকত না। অফিস শেষে বাউন্ডুলে সেজে এ-রাস্তা ও-রাস্তা বাইক নিয়ে ছোটাছুটি ভোলা হতো না। আরামসে কাজ করতে করতে রাতেও আমার স্টে করে যাওয়ায় রেকর্ডটা অন্য কেউ ভাঙতে পারতো না অফিসে। এখন আর পারি না। আধ ঘন্টার কাজ ১০ মিনিটে করার চেষ্টা করি। মাথায় সেট হয়ে থাকে সবসময়—বাসায় ফিরতে হবে। ফিরেই একজনকে কল করতে হবে। দিনের এত ক্লান্তি, সব মুছে যায় তৎক্ষণাৎ। আমি মিথ্যে বলছি না একবিন্দুও। কখনও কখনও ভীষণ কাজের প্রেশারেও আপনাকে আমার প্রয়োজন পড়ে, খুব মনে পড়ে। ছুটে যাই আপনার কাছে। কিছু সময় আপনার নামে দিয়ে অফিসে ফিরি। এনার্জেটিক হয়ে ফিরি না? এরপর ধুমসে কাজগুলো করতে থাকি। বাসায় ঢের কাজ নিয়ে আসি। রাত জাগি। পরদিন আবারও অফিস। সেদিন বিকেলের আগেই ফেরা হয়। বাসায় ফিরে ঘুমোনোর আগে আপনার কথা মনে পড়ে। মনে হয়—আচ্ছা, মেয়েটা কী করছে এখন? অফিস থেকে তো ফিরেছে, খেয়েছে কিছু? কল দিই এরপর। আপনার আওয়াজ তখন আমার কাছে আফিমের মতো কাজ করে আর নিজেকে লাগে আজন্ম নেশাখোর। পাঁচদিনের অভুক্ত মানুষের মতো আচরণ করি, নাওয়া-খাওয়া-ঘুম বাদ দিয়ে আপনিনামক নেশাদ্রব্য সেবন করে যাই। ব্যাপারটা সাংঘাতিক। আর..”

ত্বরিতে প্রিয় বলে ওঠে,
-“এসব বলবেন না।”

কপাল কুঁচকে শরৎ হেসে ফেলল,
-“কেন?”

অন্যমনস্কভাবে প্রিয় বলল,
-“আপনার প্রতি অসম্ভব প্রেম আসবে।”
-“এলে ক্ষতি কী?”

ভারি ব্যথিত আওয়াজে প্রিয় বলল,
-“প্রেমের মরা জলে ডোবে না।”

কেউ কেউ প্রেমে পড়ে, কেউ বা প্রেমে মরে। যে পড়ে, সে উঠতে পারে, বাঁচতে পারে। অথচ মৃতকে আমরা জীবিত করতে পারি না। তাছাড়া যারা প্রেম করে, তাদের ডোবার জন্য জলের প্রয়োজন পড়ে না। তারা এমনিই ডোবে। প্রিয় একবার ডুবেছিল। আরেকবার ডুববে? নাহ! ভাবাও কেমন অদ্ভুত!

প্রিয় ইতস্তত করতে করতেই শরৎ উঠে দাঁড়াল, হাঁটতে হাঁটতে কাবার্ডের সামনে গেল। কাবার্ড খুলে একটা হালকা রঙের সুতির শাড়ি বের করে প্রিয়কে দিয়ে বলল,
-“প্লিজ চেঞ্জ করেন। এখনও কেন গায়ে এই শ কেজির লেহেঙ্গা জড়িয়ে আছেন। এটা জড়িয়ে বেঁচে কীভাবে আছেন? নিঃশ্বাস তো ঠিকভাবে নিতে পারছেন না। আই অ্যাডমিট ইট, আপনাকে ভীষণ সুন্দর দেখাচ্ছে। অনুষ্ঠান শেষ না? ছবি তোলা হয়েছে না? এখন তো চেঞ্জ করেন। আর কে দেখবে? গেস্টরাও চলে গেছে অর্ধেক।”

প্রিয়র গলায় আশ্চর্যের মাত্রা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে,
-“কিন্তু আমি তো সেজেছি আপনার জন্য।”

শরৎ থেমে গেল। চোখ পিটপিট করে শুধাল,
-“আসলেই বলেছেন নাকি মুখ ফসকে বেরিয়েছে?”
-“না, আসলেই বলেছি।”
-“ওকে, দেন..”

বলে শরৎ চেয়ার টেনে এগিয়ে বসল প্রিয়র মুখোমুখি। চোখে তার হাসির ঝলক। প্রিয় তাকে আর কিছু বলল না। সে-ও তাকিয়ে রইল৷ চোখের সাথে চোখের সন্ধিক্ষণ যখন প্রায় মিনিট পাঁচেক পেরোল, শরৎ নিষ্পলক রয়ে গেল, মুগ্ধতার শীর্ষে পৌঁছে বলল,
-“মাশাআল্লাহ! আমার বউ!”

প্রিয়র পলক ফেলার আগেই একটা শুষ্ক চুমু এসে থামল কপালের ঠিক মাঝখানটায়।

___
নীহিন করিডোরে এসে খেয়াল করল ওখানে প্রহর দাঁড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। প্রহর নিজেও নীহিনের উপস্থিতি লক্ষ করে। কল কেটে ফেলল তৎক্ষনাৎ। নীহিনও সঙ্গে সঙ্গে বলল,
-“প্রহর ভাই, ঘাবড়াবেন না। আমি যাচ্ছি।”

প্রহর আটকাল ওকে,
-“শোনো।”

নীহিন এগিয়ে এসে পাশে দাঁড়িয়ে বলল,
-“জি, বলুন।”

ভণিতা না করে সরাসরি প্রহর বলল,
-“নিজের ওপর কারো ভীষণ রকমের রাগ নিয়ে বেঁচে থাকতে নেই। নীহিন, তুমি কি আমার ওপর রেগে আছ?”

প্রথমবার প্রহর ওকে নাম ধরে ডাকল। প্রিয়তমের মুখের নিজের নামটা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর শব্দ। সে রেশ কাটতেই নীহিন মুচকি হেসে বলল,
-“রেগে নেই।”
-“সত্যিই তো?”
-“জি।”
-“অভিমান?”
-“আপনি আমার অভিমান ভাঙাতে আসবেন না জেনেও তা মনে পোষার সাহস কী করে করি—বলুন তো, প্রহর ভাই?”
-“বেশ ভালো বলেছ।”

একগাল হেসে নীহিন বলল,
-“ধন্যবাদ।”

প্রহরের হাতের কফির মগটাতে সে একটা চুমুক দিয়ে বলল,
-“বাচ্চা মানুষদের রাগতে নেই, অভিমান করতে নেই। তাদের শুধু পড়াশোনায় মন দিতে হয়।”
-“জি, জানি।”
-“এসএসসির রেজাল্ট কী?”
-“জিপিএ ফাইভ।”
-“এইচএসসির প্রিপারেশন?”
-“বেশ ভালো।”
-“অ্যাডমিশনে কীসের ইচ্ছে আছে?”
-“মেডিকেল।”
-“তাহলে তো নাওয়া-খাওয়া ভুলতে হবে।”
-“জি।”

নীহিনের এই ছোটখাটো উত্তরে ইন্ট্রোভার্ট প্রহর বলার মতো শব্দের ভীষণ অভাব বোধ করছে। কিছুটা সময় কাটল। প্রহর চুপ রইল। নীহিনও যাচ্ছে না। তার মনে হচ্ছে, অনুভূতিরা মৃত হওয়া পথে আর এটা মনের ভেতর এক আকাশ সমান লালিত ভালোবাসা নিয়ে প্রিয়তমকে তার শেষ দেখা৷ এরপরও দেখা হবে, এরপরও কথা হবে, এরপরও আড্ডা হবে, এরপরও প্রহর জিজ্ঞেস করবে ‘প্রিপারেশন কেমন? রেজাল্ট কেমন?’, এরপরও বিভিন্ন সাজেশন দেবে, এরপরও এমন শুক্লা একাদশীর রাতে তারা একত্রে কোথাও না কোথাও চাঁদ দেখবে—কিন্তু মনের ভেতর আর ভালোবাসা থাকবে না। কী ভয়ানক কথা!

বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতায় প্রহর বলে উঠল,
-“আমি কখনও কাউকে উপদেশ দিই না, দিতে পছন্দ করি না। তোমাকেও দেবো না। এমনিই কিছু কথা বলব।”
-“বলুন, প্রহর ভাই।”
-“একটা মানুষের জীবনের সবচেয়ে ভয়াবহ স্টেজটা হচ্ছে কিশোর বয়স; যেই বয়সটায় তুমি আছ এখন। এই বয়সে মনে রঙিন প্রজাপতি উড়বে। এই বয়সে মনে ফ্যান্টাসি কাজ করবে। এই বয়সে সব ক্ষতিকর কাজগুলো করতে ইচ্ছে করবে। নিষিদ্ধতাও এই বয়সেই আকর্ষণীয়। ছোটবেলায় মাটি দিয়ে খেলেছ না?”
-“হু।”

প্রহর হেসে বলল,
-“প্রথমে মাটি নেওয়া, জল নেওয়া, এরপর দুটো পরিমাণমতো মিশিয়ে বিভিন্ন জিনিসের আকৃতি, এবং শেষে রোদে শুকাতে দেওয়া। এই তো? মাটিটাকে তোমার জীবন আর এই বয়সটাকে ধরো রোদে শুকাতে দেওয়ার ধাপটা। এই বয়সে যত উত্তাপ সহ্য করে টিকে থাকতে পারবে, যত উত্তাপের মাঝে থেকে নিজেকে বিশুদ্ধ তৈরি করতে পারবে—ততটা সুন্দর হবে মাটির গঠন, তোমার জীবনের আকৃতি। তোমার মন হয়তো অনেক কিছুই বলবে। কেন না এই বয়সে মনটা কথা বেশি বলে। কিন্তু মনের বিরুদ্ধে গিয়ে যে নিজের ভালোটা বেছে নিতে পারে, সে সেরা। রিমেম্বার ওয়ান থিং—মন সর্বদা তোমার ভালো চাইবে না। ম্যাক্সিমাম টাইম মন যা চাইবে, তা তোমার জন্য অসম্ভব ক্ষতিকর।
এই বয়সটাই বড়ো ক্ষতিকর। এই বয়স বাঁধা শুনতে চায় না, এই বয়স নেতিবাচকতা শুনতে চায় না, এই বয়স খারাপ দিকে আকৃষ্ট হয়। তোমার ধারণা আছে। তুমি ভুক্তভোগী। এই বয়স তোমাকে ভীষণ রকমের একটা কষ্ট দিয়েছিল। ভুল না হলে, সেই কষ্টটা আমি। ভুলটা পাপ হওয়ার আগে যদি নিজেকে সংবরণ না করো—মাটি ভেঙে যাবে। ফুল ঝরে পড়বে।”

নীহিন অনুভূতিশূন্য হয়ে তাকিয়ে রইল, প্রহর তা দেখে মলিন হাসল,
-“নীহিন! তুমি ভীষণ মিষ্টি একটা মেয়ে।”
-“আর আপনি অন্য কারোর।”
-“আমি অন্যের না হলে, বোধহয় তোমাকে একটা সুযোগ দিতে দ্বিধা করতাম না।”
-“আপনি অন্যের না হলে, আপনাকে পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করতে কার্পন্য করতাম না।”
-“নীহিন!”
-“হু-উম?”
-“তুমি ভালো থেকো। মিষ্টি মেয়ে, তোমার মিষ্টত্ব সর্বদা থাকুক। আর তোমার ভবিতব্য তোমার প্রথম ভালোবাসা ভুলিয়ে দেওয়ার মতো ভালোবাসুক।”

মিহি করে হেসে ফেলল নীহিন,
-“আপনাকে ধন্যবাদ, প্রহর ভাই।”
-“কেন?”
-“আমাকে ভালোবাসা চেনানোর জন্য। সেজন্য আমি আপনার কাছে আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকব।”

কিছুটা থেমে নীহিন আবার বলল,
-“আমি চাই না, আপনার আর আমার মাঝে সংকোচের বিশ্রী দেয়াল তৈরি হোক। আপনি আমার ভাবির ভাই, সেই সঙ্গে আমার ভীষণ পছন্দের মানুষ। শেষ অবধি একটা সুন্দর অ-সম্পর্ক থাকুক আমাদের অ-প্রেমের। আপনাকে আমি কখনও অপ্রস্তুরবোধ করতে দেবো না, তিন সত্যি।”

প্রহর হেসে বলল,
-“এরকম মনোভাবেই থেকো সবসময়। পজিটিভিটি কতটা প্রয়োজন মানুষের ভেতর জানা নেই তোমার। কেবল মাত্র পজিটিভ থিংকিং দিয়ে মানুষ বিষকেও অমৃতরূপে সেবন করতে পারে। মৃত্যু সমান যন্ত্রণাকেও গা-সওয়া করে নিতে পারে।”

এভাবে তাদের কথা চলল আরও কিছুটা সময়। দুজনেই একে-অপরের সাথে সহজ হয়েছে। কে বলবে—তাদের মধ্যকার সম্পর্কের জটিলতা কতখানি কেমন! দেখতে তো লাগে যেন সবই স্বাভাবিক!

চলবে..