#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_18
চিন্তিত ভঙ্গিতে কামরার এদিক থেকে ওদিক পায়চারি করছে সুলতান। সকাল থেকে যেন তার নাওয়া-খাওয়া হারাম হয়ে গেছে। পাশেই মাহতাব নথিপত্রের সিন্দুক খুলে বসেছে। খুব মনোযোগ দিয়ে কিছু একটা খুঁজে চলেছে সে। আজ খুব সকালে পার্শ্ব সাম্রাজ্য থেকে বার্তাবাহক এসেছিল। এতো সকালে বার্তাবাহককে আসতে দেখে অবাক হয়েছিল সকলে। সুলতান উমার বার্তা পাঠিয়েছেন সন্ধির চুক্তিনামাতে না কি সুলতান শাহজাইনের সাক্ষর নেই। অথচ সুলতান নিজে সেখানে সাক্ষর করেছিল। তার স্পষ্ট মনে আছে সে কথা। আবার ব্যবসায়িক নথিপত্রেও না কি একপাক্ষিক সুবিধা বেশি উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু সাক্ষর করার আগে সে সবকিছু দেখে নিয়েছিল। তখন সব ঠিক ছিল। হুট করে কী হলো মাথাতেই আসছে না। সুলতান উমার দ্রুতই তাদেরকে নিজ সাম্রাজ্যে আহ্বান জানিয়েছেন। নতুবা সে এই সন্ধির প্রস্তাব নাকচ করে দেবেন এও জানিয়েছে। এদিকে নিজেদের নথিপত্র দেখতে এসে আরেক কান্ড। প্রয়োজনীয় নথিপত্র যেই কামরায় রাখা হয় সেই কামরার তালা বন্ধ কিন্তু ভেতরে সিন্দুকের তালা খোলা পড়ে আছে। সিন্দুকের ভেতরে না আছে সন্ধির চুক্তিনামা আর না আছে পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংঘটিত হওয়া ব্যবসায়িক কোনো নথিপত্র। আচমকা মহল থেকে নথিপত্রের হেরফের যেন কিছুতেই মানতে পারছেন না সুলতান। আশ্চর্যের বিষয় হলো সিন্দুকের চাবি সুলতানের কামরায় থাকে আর সেটা এখনো সেই স্থানেই ছিল। যার অর্থ কেউ চাবি নিয়ে তালা খুলে সবকিছু সরিয়ে ফেলে পুনরায় চাবি রেখে গেছে নির্দিষ্ট স্থানে। এতো সময় তার নিকট ছিল! মাহতাব সেই কখন থেকে খুঁজেই চলেছে কিন্তু সবকিছু মিললেও, মিলছে না পার্শ্ব সাম্রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত কোনো নথিপত্র। অবশেষে না পেয়ে হতাশ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল মাহতাব। সিন্দুক থেকে নথিপত্র গায়েব! মহলের ভেতর এমন কাজ কে করতে পারে? চিন্তায়, হতাশায় মাহতাবের যখন নাজেহাল অবস্থা, সুলতান তখন গম্ভীর স্বরে বলে উঠলেন, “সিন্দুকে নতুন তালা লাগিয়ে দাও মাহতাব। খুব দ্রুতই পার্শ্ব সাম্রাজ্যে যেতে হবে। পারলে আজই।”
“কিন্তু মহামান্য, আজ তো শাহ নদীর সমস্ত বণিক আর সওদাগরদের ডেকে পাঠানো হয়েছে মহলে। আপনার সাক্ষর ছাড়া তো চুক্তিনামা মঞ্জুর হবে না।” বলল মাহতাব।
“কখন আসবে?”
“এইতো এলো বলে। তাদের কি আজ চলে যেতে বলব? আপনি পার্শ্ব সাম্রাজ্য থেকে ফিরলে পরে আবার আসবে।”
“না মাহতাব। কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারলে এতগুলো মানুষের দায়িত্ব নিয়েছি কেন আমি? আসুক তারা। প্রয়োজনে বিকালে রওনা হব আমরা।”
“আপনি যা ভালো বোঝেন।” মাথা ঝুঁকিয়ে বলল মাহতাব।
দ্বারের দিকে এগিয়ে গেলেন সুলতান। হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লেন কারন ছাড়াই। পেছনে না ঘুরেই শক্ত কন্ঠে বললেন, “যত দ্রুত সম্ভব শত্রু শনাক্ত করো মাহতাব। আমার সাম্রাজ্য ঠিক নেই। ঝড় ধেয়ে আসছে তড়িৎ বেগে। পরিচিত শত্রুর আঘাতের মোকাবিলা করা যায় কিন্তু কাছের মানুষ শত্রুর আবরনে মুড়ে গেলে তাকে মোকাবিলা করার আগে শনাক্ত করতে হয়। আর এই শনাক্ত করার সময়টাই তার জন্য সুবর্ণ সুযোগ হয়ে দাঁড়ায়।”
চলে গেলেন সুলতান। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল মাহতাব। সুলতানের কথার গভীরতা ঠাহর করতে সামান্য সময় লাগলো তার। বাক্যগুলোর মর্মার্থ বুঝে উঠতেই মুখের অভিব্যক্তি বদলে গেল তার। অবাক স্বরে বিড়বিড়িয়ে বলল, “কাছের মানুষ!”
শেহজাদি মাইরা আজ সকালেই চলে গেছে নিজ সাম্রাজ্যে। এখানে না কি তার আর মন টিকছে না। তাই পিতা-মাতার কাছে ফিরে গেছে সে। সুলতানা নিজেও আর বাঁধা দিতে চাননি। ছোট থেকেই মাইরা নিজ সাম্রাজ্য ছেড়ে অন্য কোথাও থাকতে পারে না। একেবারেই মানিয়ে নিতে পারে না সে। এখানে এসে তো তবুও অনেকগুলো দিনই কাটালো। এটাই তো বড় আশ্চর্যের বিষয়! মাইরা চলে গিয়ে যেমন একজন সদস্য কমেছে মহল থেকে ঠিক তেমনি আরো দু’জন সদস্য বেড়েছে। এলিজা সুলতানের আদেশে সসম্মানে মহলে নিয়ে আসা হয়েছে আব্দুর রহমান ও জারনাবকে। মহলের অতিথি তারা। আদর-যত্নের কোনো কমতি নেই। উশখুশ করছেন আব্দুর রহমান। তার হুট করে এই পরিবেশে এসে মানিয়ে নিতে সময় লাগছে। তার উপর অনুশোচনাবোধ তো আছেই। তবে জারনাবের মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন নেই। সে সমস্ত স্থানে নিজেকে মানিয়ে নিতে সক্ষম। কিন্তু সে ঠিক করেছে কিছুদিন থেকে জোভিয়াকে বলে কয়ে চলে যাবে তারা। আত্মসম্মানেরও একটা ব্যপার-স্যাপার আছে। এভাবে এখানে এসে পড়ে থাকা তার সম্মানের সাথে ঠিক যাচ্ছে না। সূক্ষ্ম একটা ভালো লাগাও কাজ করছে। এই প্রথম সে জোভিয়াকে সম্রাজ্ঞীর সাজে দেখেছে। কী যে সুন্দর লাগছিল! জীবনের প্রথম সুলতানের সামনে দাঁড়িয়েছে। তার সঙ্গে আলাপচারিতা করেছে। ভয় লাগছিল খানিক। যদিও ছোট বোনের স্বামী তবুও সে এই সাম্রাজ্যের সুলতান। ভাবা যায়! জারনাবের সার্বক্ষণিক দেখাশোনার জন্য ফাইজাকে রাখা হয়েছে। তবে জারনাব নিজের কাজ নিজে করতেই অভ্যস্ত তাই ফাইজাকে তেমন কিছু করতেই হচ্ছে না। যাও বা করতে চাচ্ছে সেটাও নিষেধ করে দিচ্ছে জারনাব। এতো ছোট মেয়েকে দিয়ে কাজ করাতে তার ভালো লাগছে না। তাই আজ ফাইজা প্রচন্ড খুশি। ইচ্ছামতো সাজতে পারবে। আহ! কী শান্তি! এমন কাউকেই তো চেয়েছিল সে!
ভ্রু কুচকে তার দিকে তাকালো জারনাব। এসে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করছে সে। মেয়েটা চঞ্চল প্রকৃতির তবে সুন্দর। একটু কাজ করতে হচ্ছে না দেখেই এতো খুশি! সে অবাক স্বরে শুধাল, “এতো আনন্দ কেন?”
নিজ মনে হেসে কুটিকুটি হচ্ছিল ফাইজা। আচমকা প্রশ্নে চমকে উঠলো সে। তবে মুহুর্তেই আবার সামলে নিলো নিজেকে। খানিক এগিয়ে এসে ফিসফিসিয়ে বলল, “আমিতো বেগম আসার পর থেকেই খুশি। আজ কাজ করতে হচ্ছে না বলে আরেকটু বেশি খুশি।”
“তাই না কি? তা বেগম এসে কী এমন রাজকার্য উদ্ধার করেছে?”
বেগম সম্পর্কে এমন বাক্য ব্যবহার করাতে কপাল কুচকাল ফাইজা। পরক্ষণেই ভাবলো বড় বোন তো, বলতেই পারে। সে খুশিতে গদগদ হওয়ার ভাব ধরে বলল, “বেগম যেদিন থেকে এসেছে সেদিন থেকে মাজেদা বানুর ঘুম হারাম হয়ে গেছে। বেচারি বেগমের নিঃশ্বাসের শব্দ পেলেও থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। যখন ভীতুর মতো কাঁপাকাপি করে তখন কী বিশ্রি যে লাগে তাকে দেখতে! সে আর কী বলবো।”
তার উত্তেজনায় জল ঢেলে জারনাব বলে উঠলো, “কিন্তু এই মাজেদা বানুটা কে?”
বিরস মুখে তাকালো ফাইজা। অতঃপর বিজ্ঞ ব্যক্তির ন্যায় ভাব ধরে বলল, “আরে আমাদের রন্ধনশালা যে পরিচালনা করে। মানে রাঁধুনিদের প্রধান আর কী।”
“তা তার প্রতি তোমার এতো রাগ কেন? তার কষ্টে বড় খুশি হচ্ছো যে?”
“আপনি তো জানেন না, ঐ মহিলা কী পরিমাণ খাইষ্টা। আমি প্রথম দিন এসে একটু ভুল করেছি ব্যাস আমাকে সপাটে একটা থাপ্পড় মেরে বসলো। কত্ত বড় খারাপ মহিলা ভাবতে পারছেন? এই মহলের সবাই খুব ভালো শুধু দুইটা মানুষ ছাড়া।”
“আরেকজন কে?” শুধাল জারনাব।
চোরা দৃষ্টিতে আশেপাশে নজর বুলালো ফাইজা। দ্বারের বাইরে উঁকি দিয়ে একবার দেখে নিয়ে অত্যন্ত ধীর কন্ঠে বলল, “কাউকে বলবেন না যেন। এই মহলে তার আবার খুব কদর! সৈনিক প্রধান আছে না? উনি আরেক খাইষ্টা। আমাকে কি-না ভাল্লুক বলে! আচ্ছা, আপনিই বলুন আমি কি ভাল্লুকের মতো দেখতে?”
আগত হাসি চেপে গেল জারনাব। এখন হাসলে মেয়েটা কষ্ট পাবে। জোরপূর্বক নিজের মুখভঙ্গি গুরুতর রেখে বলল, “মোটেই না। তুমি তো অনেক সুন্দর। উনি ভুল বলেছে।”
উল্লাসে লাফিয়ে উঠলো ফাইজা। আনন্দ ধ্বনি তুলে বলল, “আপনি খুব ভালো।”
নিজের গুরুগম্ভীর অঙ্গভঙ্গি বজায় রেখে নিজ কামরায় প্রবেশ করলেন সুলতান। মাথায় এখন তার আকাশসম চিন্তা। অথচ সম্মুখের দৃশ্য অবলোকন করতেই যেন সমস্ত দুশ্চিন্তা হাওয়ায় ভেসে পালালো। এই দৃশ্য দেখে নিঃসন্দেহে বলা যায় সে ভাগ্যবান। বড়বড় শ্বাস টেনে নিজের গলার খাদ আড়াল করতে চাইল সে। তার উপস্থিতি বোধহয় টের পেল না কামরার বাকি দু’জন মানুষ। বেগম তোহফাকে কথা বলানোর চেষ্টা করছে। বারবার ঠোঁট নাড়িয়ে বলছে, “আম্মু বলো, আমার সাথে সাথে বলো। আল্লাহ্!”
ঠোঁট নাড়াচ্ছে তোহফা। আপ্রান চেষ্টা করছে কথা বলার জন্য। তবে গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোচ্ছে না। বারবার চেষ্টা করার ফলে কাশি উঠে যাচ্ছে তার। বেগম তাকে পানি খাইয়ে স্বাভাবিক করে পুনরায় বলছে, “চেষ্টা করো আম্মু। পারবে তুমি। সবসময় চেষ্টা করতে থাকবে। শুধু মনে রাখবে উপরওয়ালা চাইলে সব সম্ভব। তোমাকে শুধু তার নিকট চাইতে হবে আর চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। গলার স্বর হারিয়ে যায়নি তোমার।”
তোহফা পুনরায় চেষ্টা করছে, পুনরায় বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে তার স্বর। কষ্ট হচ্ছে তার। তবুও চেষ্টা করছে। ছোট্ট মুখটা লাল হয়ে উঠেছে। তখনই বেগম বলে উঠলো, “এখনকার মতো থাক। পরে আবার চেষ্টা করবে, কেমন?”
উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো তোহফা। এগিয়ে এলেন সুলতান। তাকে দেখতেই তোহফ দৌড়ে এলো তার নিকট। আদুরেভাবে কোলে তুলে নিলেন তিনি। চোখ বড়বড় করে বললেন, “আমার আম্মাকে বুঝি অত্যাচার করছে তার আম্মাজান?”
দ্রুতবেগে ডানে-বামে মাথা নাড়ালো তোহফা। চোখ পিটপিট করে তাকালো তার দিকে। ধীরে-সুস্থে তাকে দ্বারের কাছে নামিয়ে দিলেন সুলতান। তার দিকে ঝুঁকে পড়ে কপালে চুম্বন করে বললেন, “তাহলে যাও। খালামণি এসেছে দেখেছো? গিয়ে ভাব জমিয়ে এসো। এখন আব্বু আর আম্মু একটু আলাদা কথা বলবে।”
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না তোহফা। দৌড়ে বেরিয়ে গেল কামরা থেকে। বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সেবিকা তাকে নিয়ে গেল জারনাবের কামরার দিকে। সোজা হয়ে দাঁড়ালেন সুলতান। অধর বিকৃত করে ভাব নেবার ভঙ্গিতে বলে উঠলেন, “আমার বুঝদার আম্মা।”
ভ্রু কুচকে তার দিকেই চেয়ে আছেন বেগম। আচমকা সুলতান হতবাক স্বরে বলে উঠলেন, “তুমি আবার এভাবে তাকিয়েছো! অকালে হৃদস্পন্দন বন্ধ করে মারতে চাও আমাকে?”
কিছুই বললেন না বেগম। তার দিকে চেয়ে নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। পছন্দ হলো না বোধহয় সুলতানের। চোখ-মুখ কুচকে নিলো সে। দু’হাত বাড়িয়ে খানিক ধমকের সুরে বললেন, “কাছে এসো।”
এগিয়ে এলেন বেগম। তার খুব কাছে এসে মিশে গেল বুকের সাথে। বুকের পাশে হাত ঘোরাতে ঘোরাতে মিহি স্বরে বলল, “আপনার চেহারার এমন হাল কেন সুলতান?”
“আজ হয়তো পার্শ্ব সাম্রাজ্যে যেতে হতে পারে।”
“জানি, শুনলাম।” ছোট্ট জবাব বেগমের।
“হয়তো আজকের রাতটা থাকা লাগবে সেখানে।” পুনরায় বললেন সুলতান।
“সকালে দ্রুত ফিরে আসবেন। আমি অপেক্ষা করবো আপনার জন্য।”
“কতগুলো দিন পর তোমাকে পেলাম। যেতে ইচ্ছে করছে না।” আহত কন্ঠ সুলতানের।
“তাহলে মাহতাবকে পাঠিয়ে দিন।” আগ্রহী স্বরে বলল বেগম।
“কিন্তু আমার সাক্ষর প্রয়োজন পড়বে। ওখানে আমার থাকাটা জরুরি।”
“তাহলে যান।”
“এক রাতের ব্যবধানে আবার আমাকে ভুলে যেও না। দুইটা বছর দূরে থেকেছো আর সহ্য করতে পারব না।”
“ভুলে যাবো! সাধ্য নেই যে।”
অধর প্রসারিত করলেন সুলতান। বাহুবন্ধন আরো শক্ত হলো পূর্বের তুলনায়। সে আবেশি কন্ঠে বলে উঠলেন, “তাহলে কথা দিচ্ছ? আমার হয়ে থাকবে তুমি।”
“মরনের পরেও।” সোজা জবাব বেগমের।
“তোমার কাছে আসলেই আর ভালো লাগে না এই দায়িত্বে ঘেরা জীবন। এই সাম্রাজ্য, এই দায়িত্ব- সবকিছু ফিকে লাগে। ইচ্ছে তো করে সব ত্যাগ করি, ছেড়ে দেই সাম্রাজ্যের ভার। সবকিছু মাহতাবকে বুঝে দিয়ে তোমাকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যায়।”
“আর তোহফা?” শুধাল বেগম।
“ওকেও নেব সাথে।”
“শাশুড়ি আম্মা?”
“তাকেও নেব।”
“আপনার পিতা?”
“সেও সাথে যাবে।”
“তাহলে বাদ থাকলো কে?”
“আহ! বিভ্রান্ত করো না তো। তোমার কাছে একটু নিজের অনুভূতি প্রকাশ করেও শান্তি নেই। কেউ যাবে না, কেউ না। শুধু তুমি আর আমি থাকবো সেখানে।”
হাসলো বেগম। এমন সময় দ্বারে কেউ কড়া নাড়লো। বেগম সরে যেতে চাইলেও ছাড়লেন না সুলতান। বরং অতিমাত্রায় বিরক্ত হলেন তিনি। ভেসে এলো মাহতাবের কন্ঠস্বর।
“অপরাধ মার্জনা করবেন মহামান্য। ওনারা সবাই চলে এসেছে। কী বলবো তাদেরকে?”
“গিয়ে ওদের বসতে দাও মাহতাব। আমি এখুনি আসছি।”
শাহ নদীতে বানিজ্য করা শতাধিক বণিক ও সওদাগর এসেছে মহলে। তাদের সঙ্গে নদীকেন্দ্রিক যে চুক্তি হয়েছিল তার মেয়াদ বৃদ্ধির জন্যই মূলত তাদের এখানে ডেকে পাঠানো হয়েছে। মহলের মাঝখানে গোলাকার বিশাল ফাঁকা স্থানটাতে বসতে দেওয়া হয়েছে তাদের। সকলেই নিজেদের জন্য নির্ধারিত কেদারায় বসে অপেক্ষা করছে সুলতানের আগমনের জন্য। তাদেরকে চুক্তি সম্পর্কিত সবকিছু বুঝিয়ে দিচ্ছে মাহতাব। তবে তাদের মাঝে একজন বণিক খুবই অমনোযোগী। যখন থেকে এসেছে তখন থেকে তার চেহারায় দুশ্চিন্তার ভাজ। একমনে কিছু একটা ভাবছে সে। লক্ষ করলো মাহতাব। চুক্তিনামা হাতে করেই এগিয়ে এলো তার দিকে। চঞ্চল দৃষ্টিতে চেয়ে শুধাল, “আপনার নাম?”
হঠাৎ কন্ঠে সচকিত হয়ে উঠলো বণিক। দ্রুতই নিজেকে সংবরণ করে বলল, “আবরার জাওয়াদ।”
“কোনো সমস্যা? তখন থেকে দেখছি আপনি অমনোযোগী। সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারেন।”
“না মানে, কোনো সমস্যা নেই। আসলে কাউকে নিয়ে সবসময় ভাবতে থাকা আমার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। তার উপর তাকে দেখিনা ক’দিন হয়ে গেল। তাই দুশ্চিন্তা হচ্ছে। আমি দুঃখিত।”
বাক্যগুলো যেন কঠিনভাবে ভাবালো মাহতাবকে। সেও তো কাউকে নিয়ে ভাবে, দুশ্চিন্তা করে। সে কোথায়, কেমন আছে সেটাও জানা নেই। এই অনুভূতির সঙ্গে গভীরভাবে পরিচিত সে। কী নিষ্ঠুর এই অনুভূতি! আর কখনো দেখা হবে কি-না সেটাও জানা নেই। তবে সে চাই তাদের আর দেখা না হোক। হয়তো সে অনেক আগেই অন্যের অর্ধাঙ্গী হয়ে গেছে। অন্যকে ভালোবেসেছে, ভুলেছে আজমাইন মাহতাব নামের মানুষটাকে! এখন হয়তো তার এই এক তরফা ভালোবাসা পীড়া দেবে তাকে! ভাবতেই অবাক লাগে তার ভালোবাসার ঠিকানা সে জানে না! এটাও জানে না সে কতটা পরিবর্তন হয়েছে না কি আগের মতোই আছে? সেই কিশোরী কতোটা বড় হয়েছে? তার সেই নিষ্পাপ মুখটাও কি বদলে গেছে? কিছুই জানে না সে। অথচ ভালোবাসাটা ঠিক আগের মতোই রয়েছে। একটুও ফিকে হয়নি। নিজেকে সামলে নিলো সে। বণিকের কাঁধে হাত রেখে তাকে আশ্বস্ত করে নিজ স্থানে ফিরে গেল। অবশেষে অপেক্ষার পালা শেষ হলো। বেশ কয়েকজন সৈনিক সমেত সেখানে উপস্থিত হলেন সুলতান। সৈনিকগুলো পেছনেই দাঁড়িয়ে পড়লো সারি সারিভাবে। বিশাল রাজকীয় কেদারায় বসলেন সুলতান। সকলে সমস্বরে সালাম দিলো তাকে। মুচকি হেসে উত্তর দিলেন তিনি। পাশেই সমস্ত নথিপত্র হাতে দাঁড়িয়ে রইল মাহতাব। নিজের বিষাদকে ঢেকে দিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। শুরু হলো হিসেবের যোজন-বিয়োজন। চুক্তির মেয়াদ বাড়ানো নথিপত্রগুলো বিলিয়ে দেওয়া হলো সকলের মাঝে। সকলে একবার করে সবকিছু দেখে নিয়ে সাক্ষর করে পত্রগুলো ফিরিয়ে দিলো মাহতাবের নিকট। এবার সুলতানের সাক্ষরের পালা।
ভাগ্য বোধহয় আজ অন্য কিছুই চাইছিল। ফাইজা জারনাবকে নিয়ে মহল ঘুরতে বেরিয়েছিল। সাথে ছিল তোহফাও। তার নতুন খালামণিকে খুব পছন্দ হয়েছে তাই তার কোলে চড়ে বসে আছে। তখনই তাতে বাঁধ সাধলো বেগম। তোহফাকে নিজের কোলে টেনে নিয়ে বলল, “খালামণির কোলে এত সময় আছো, তার তো হাত ব্যথা হয়ে গেছে। দুষ্টুমি করোনি তো?”
হাসলো জারনাব। তোহফার গালে আলতো চুম্বন করে বলল, “ওর আম্মাকে পেলেছি আমি আর ওকে রাখতে পারবো না? তোমার চেয়ে দুষ্টু কম আছে তোমার মেয়ে।”
মায়ের কোল থেকেই ঝাঁপিয়ে পড়ে খালামণিকে চুম্বন করলো তোহফা। মৃদুস্বরে হাসলো বেগম। সামনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তাই না কি? একদিনেই দেখি ব্ড্ড ভাব হয়ে গেছে তোমাদের। তা আমাকে আবার ভুলে যেও না যেন।”
তার গলা জড়িয়ে ধরে কাঁধে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো তোহফা। বোধহয় ঘুম পাচ্ছে তার। বেগম পুনরায় বলল, “বুবু, চলো মহল ঘুরিয়ে আনি তোমাকে। সবার সাথে পরিচিতও তো হতে হবে।”
নিজের চুক্তিনামা নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছিল আবরার। সুলতান তার চুক্তিনামাতে সাক্ষর করছেন। সাক্ষর শেষ হলেই সে পেয়ে যাবে আরো এক বছর এই নদীতে বানিজ্য করবার অনুমতি। তবে সেদিকে ধ্যান নেই তার। সে তো ভাবছে জোভিয়ার কথা। মেয়েটাকে না দেখে যেন থাকতেই পারছে না সে। অথচ মেয়েটা কেমন নিষ্ঠুরের মতো দোকানটা বন্ধ করে রেখেছে। বাড়ি বয়ে যাবার সাহসও হচ্ছে না। আবার যদি জোভিয়ার আব্বা বেরিয়ে আসে! কিন্তু জোভিয়াকে যে তার দেখতেই হবে। তাই সে ঠিক করেছে যা হয় হবে, এখান থেকে সোজা সে জোভিয়াদের বাড়িতেই যাবে। যদি এক নজর দেখতে পায় সেই তো কত! আনমনে আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে হঠাৎ সুলতানের পেছনের দিকে কিয়ৎ দূরে নজর গেল তার। হুট করে যেন জায়গায় জমে গেল সে। নয়নজোরায় ফুটে উঠলো অসীম বিস্ময়। থরথর করে কাঁপছে তার শরীর। নাহ! ভুল দেখেছি! নিজ মনকেই শাসিয়ে উঠলো সে। কিন্তু তাতে কি আর সত্য বদলে যায়? ঠিকই তার সামনে দিয়ে জোভিয়া রাজকীয় পোশাকে তোহফাকে কোলে করে তার বুবুর সাথে কথা বলতে বলতে হেঁটে চলে যাচ্ছে। কী রাজকীয় তার বাচনভঙ্গি! এক মুহুর্তের জন্যও তার মনে এলো না জোভিয়া এখানে কী করছে। তার পূর্বেই নজর গেঁথে গেল জোভিয়ার মাথায় জ্বলজ্বল করা সফেদ পাথরের সম্রাজ্ঞীর তাজটাতে। কয়েক মুহুর্তের জন্য যেন থমকাল সে! তাল হারিয়ে নিচে পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিলো কেদারা ধরে। অসম্ভব! সব মিথ্যা! নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখছে সে!
বিচলিত ভঙ্গিতে হন্তদন্ত হয়ে চোখ কচলে পুনরায় তাকালো সে। এবারো সেই একই দৃশ্য! অজানা বেদনায় ছটফট করে উঠলো সে। ভয়ঙ্করভাবে ধ্বক ধ্বক করছে তার হৃদয় আঙিনা। কোনোমতে পাশের কেদারায় বসে থাকা সওদাগরের কাঁধে হাত রাখলো। সওদাগর জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই সে আঙুল বাড়িয়ে দেখিয়ে দিলো জোভিয়াকে। সওদাগর হাসতে হাসতে বলল, “আরে তুমি তো আবার অন্য সাম্রাজ্যের। সুলতানাকে দেখোনি আগে? উনি আমাদের সম্রাজ্ঞী। সুলতানের বেগম, এলিজা সুলতান। তোমার দেখার কথাও নয়। সুলতানা তো অনেকদিন মহলে ছিলো না। শত্রুর জন্য অন্য কোথাও ছদ্মবেশ ধরে ছিলো। ইদের আগেই ফিরেছেন মাত্র। আর ঐ বাচ্চাটা শেহজাদি তোহফা। সুলতানের একমাত্র কন্যা। তাকে তো আগে দেখেছো মনে হয়।”
গলা শুকিয়ে এলো বণিকের। বিনা মেঘেই কোথাও যেন বজ্রপাত হলো বিকট শব্দে। এই কঠিন সত্য হজম করার শক্তি তার হলো না। নিমেষেই টলমল করে উঠলো তার আঁখিজোড়া। বারংবার কানে বাজছে জোভিয়ার বলা সেই কথাখানা ‘আফসোস করবেন আপনি, শীঘ্রই আফসোস করবেন’। অথচ কী আশ্চর্য! তার বিন্দুমাত্র আফসোস হচ্ছে না। শূন্য হয়েছে তার অনুভূতি। এক মুহুর্তের জন্য যেন নিজের অস্তিত্ব ভুললো সে। কাঁপছে তার চোয়াল। মাহতাব তার দিকে বাড়িয়ে দিলো চুক্তিনামা। অথচ হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে পারলো না বণিক। অসাড় হয়ে এসেছে তার শরীর। সামান্যতম নড়াচড়া করতে গেলেই টাল হারিয়ে মেঝেতে পড়লো সে। হকচকিয়ে গেল সকলে। ঝরঝর করে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা মুছে নিলো সে সকলের আড়ালেই। কাতর চোখে আবারো ফিরে তাকালো বেগমের দিকে। সবাই তাকে টেনে উঠাচ্ছে অথচ তার দৃষ্টি সুলতানের পেছনে। একদৃষ্টে কিছু একটা দেখছে সে। লক্ষ করলো সুলতান। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে ঘুরে তাকালো সে। পেছনের দৃশ্য দেখার জন্য হয়তো প্রস্তুত ছিলেন না তিনি। অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন মুহুর্তেই। তার দিকেই আতঙ্কিত দৃষ্টিতে চেয়ে আছে বেগম। সে যেন থমকে গেছে নিজ স্থানে। তার হাতের কব্জি চেপে ধরে রেখেছে জারনাব। সুলতানের চাহনি দেখে ঢোক গিলল সে। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব সে। বণিককে এখানে মোটেও আশা করেনি। বেগমের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। কিন্তু সতর্ক হলো জারনাব। বেগমের হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে লাগল ভেতরের দিকে। উচ্চ কন্ঠে বলল, “ভেতরে চলো জোভিয়া। অনেক মহল দেখেছি আর দেখতে হবে না।”
এই কন্ঠ গিয়ে পৌছালো না মাহতাব পর্যন্ত। পৌছালে হয়তো তার অবস্থা বণিকের মতোই করুণ হতো। অথচ তার ভাগ্য আজ প্রসন্ন। সে অনুভব করতে পারলো না নিজের হৃদয়ের আহাজারি। বারবার জোভিয়াকে ডাকছে জারনাব। কিন্তু তার কন্ঠ বেগমের কান পর্যন্ত পৌছালো বলে মনে হলো না। সে সেভাবেই চেয়ে আছে সুলতানের দিকে। তাকে টেনে নিয়ে ভেতরে চলে গেল জারনাব। সুলতান পুনরায় শক্ত চোখে দেখে নিলো বণিককে আবারো ঘুরে তাকালো নিজের পেছনে। বিচক্ষণ সুলতান সমস্ত ঘটনা যেন মুহুর্তেই উপলব্ধি করে নিলো। হুট করে শূন্য হলো তার দৃষ্টি। হাত থেকে গড়িয়ে পড়লো চুক্তিনামা। পোশাকের একটা অংশ মুষ্টিতে পুরে নিয়ে চোখদুটো বন্ধ করে নিলেন তিনি। বড়বড় শ্বাস নিয়ে দমাতে চাইলেন নিজের অস্তিত্ব। লুকাতে চাইছে বুঝি নিজের অভিব্যক্তি। এত কেন কষ্ট হচ্ছে?
সবাইকে হতবাক করে দিয়ে এক ছুটে মহল ছেড়ে বেরিয়ে গেল বণিক। তার চুক্তিনামা হাতে অবাক হয়ে সেদিকে চেয়ে থাকলো মাহতাব। সুলতানের অভিব্যক্তি তখনও শূন্য। সে যেন আজ পাথর হয়ে গেছে। প্রধান ফটক পেরোতেই অজস্র বালুর মধ্যে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো বণিক। চিৎকার করে উঠলো গগণ কাঁপিয়ে। তার সফেদ টুপিটা মাথা থেকে খুলে বালুর মধ্যে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কাঁদছে সে। হ্যাঁ, একজন শক্ত-সামর্থবান পুরুষ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে কাঁদছে। কিছুক্ষণ পর কান্নার শক্তিটাও ফুরিয়ে এলো তার। উন্মাদের ন্যায় নিজের পাঞ্জাবি খামচে ছিড়ে ফেলল সে। শখ করে আজ নতুন পাঞ্জাবি পড়েছিল জোভিয়াকে দেখতে যাওয়ার আশায়। কিন্তু খোদা যে তার জন্য এমন নির্মম উপহার তৈরি করে রেখেছিল তা কে জানতো? রক্ত লাল চোখ নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো সে। ভাঙা গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিলো, “কেন তুমি এত অপূর্ণতা আমার ভাগ্যে লিখলে? জন্ম হতেই মাকে কেড়ে নিলে। এতিম বানিয়ে দিলে। তোমার এই এতোবড় দুনিয়ায় আমার একটা পরিবার নেই। যখন কাউকে স্ত্রী বানিয়ে একটা ছোট্ট পরিবার গড়তে চাইলাম তাকেও এত নৃশংসভাবে কেড়ে নিলে? বারবার কেন আমারই স্বপ্ন ভঙ্গ হয়?”
চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রুকণা বালুতে পড়ে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। দু’হাতে মুখ গুঁজে পুনরায় চেঁচিয়ে উঠলো সে। কাতর কন্ঠ দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। তবুও টেনে টেনে তাচ্ছিল্য স্বরে বলে উঠলো, “সে আমার নয়। তার পুরো পৃথিবী জুড়ে অন্যের বিচরণ। অথচ তাকে ঘিরে আমার অগণিত স্বপ্ন, অজস্র উন্মাদনা! কেন আরো আগে তার দেখা পেলাম না আমি? কেন আমার আগে অন্য কেউ তার হৃদয়ে নিজের বাসস্থান গড়ে নিলো?”
চলবে…….
#সম্রাজ্ঞী
#লিয়ানা_লিয়া
#পর্ব_19
কামরায় ঢুকে সশব্দে দ্বার আটকে দিলেন সুলতান। গম্ভীর আর শক্ত তার মুখভঙ্গি। দৃষ্টি মেঝের দিকে সীমাবদ্ধ। আতঙ্কিত নয়নে পালঙ্কে বসে ছিলো বেগম। হঠাৎ শব্দে চমকে ওঠার পরিবর্তে অসহায় চোখে তাকালো সুলতানের দিকে। উপলব্ধি করার চেষ্টা করলো তার অভিব্যক্তি। কিন্তু নাহ! ব্যর্থ হলো সে। যেই শক্ত আবরনে সুলতান নিজেকে আবৃত করে নিয়েছেন তা ভেদ করে তার ভাবাবেগ বোঝা বড্ড মুশকিল। সুলতান পালঙ্কের দিকে আসার আগেই সে উঠে এগিয়ে গেল তার দিকে। বুক ঢিপ ঢিপ করছে ভয়ে-আতঙ্কে। এমন পরিস্থিতিতে কখনো যে পড়তে হবে তা সে আগে ভাবেনি। কী বিদঘুটে সময়! খানিক সময় নীরবে পেরিয়ে যাবার পর কাঁপা কাঁপা হাতে সুলতানের মুখে হাত রাখতে গেলেই দু’পা পিছিয়ে গেল সে। এবার যেন মনের ভেতর তীর খুঁজে বেড়ানো তার ভয়টাই সত্যি হলো। ছলছল করে উঠলো তার আঁখিজোড়া। অশ্রু গড়িয়ে মেঝেতে পড়ার পূর্বেই আচমকা তাকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরলেন সুলতান। বাহুবন্ধন শক্ত করে ধমকের সুরে বললেন, “কান্নার কী হয়েছে? সবার সামনে এতো ভাব ধরে বেড়াও আর আমার কাছে আসলেই ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদতে শুরু করো। কী সমস্যা?”
তার বাহুবন্ধন ঠেলে দিয়ে গলা উঁচু করে তাকালো বেগম। আহত স্বরে বলল, “আপনি কি আমাকে সন্দেহ করছেন? অবিশ্বাস করছেন?”
“সন্দেহ করার মতো কিছু করেছো না কি তুমি?” শীতল কন্ঠে শুধালেন সুলতান।
তার এমন গুরুগম্ভীর স্বর যেন আরোও বিচলিত করে তুলল বেগমকে। ঘাবড়ে গেল সে। অজানা আতঙ্কে টপ টপ করে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো চোখ বেয়ে। বাহুবন্ধন মুক্ত করে সরে দাঁড়ালেন সুলতান। দু’হাতে আগলে নিলেন বেগমের মুখখানি। অতঃপর বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন, “আবার কাঁদছ! কান্নাকাটি করার মতো কী হয়েছে? কিছু বলেছি তোমাকে আমি? বলো, রাগ করেছি? অযথা কান্নাকাটি করলে এখন এক থাপ্পড়ে মাথা থেকে সমস্ত ভূত নামিয়ে দেবো।”
“অবিশ্বাস করছেন না?”
“আগে কখনো অবিশ্বাস করেছি? এইযে এতোগুলো দিন মহলে ছিলে না। ফিরে আসার পর আমি কি একবারও জানতে চেয়েছি কোথায় ছিলে তুমি? আমার কাছে ফিরে এসেছো এটাই কি অনেক নয়? আর তাছাড়া যখন আমি তোমার চোখ দেখেই উপলব্ধি করতে পারছি ঘটনা কী ঘটেছে তাহলে ভুল কেন বুঝব? আগেই নিজে নিজে বেশি ভেবে বসে আছো।”
“বিশ্বাস করুন, উনার সাথে আমার সেরকম কোনো কথোপকথনও কখনো হয়নি। যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করেছি। তবে লোকটা সত্যিই ভালো মানুষ। তিনি নিজেও জানতেন না আমার জীবনে কেউ আছে তাই এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।” হরবরিয়ে বলে গেল বেগম।
এতোক্ষনও নিজের মুখভঙ্গি গম্ভীর করে রেখেছিলেন সুলতান। তবে এবার যেন সূক্ষ্ম কষ্ট ধরা দিলো তার মুখশ্রীতে। মুহুর্তেই কপালে কিঞ্চিত ভাঁজের সৃষ্টি হলো। তিনি আবারো নিজের সাথে সজোরে আকড়ে নিলেন বেগমকে। কাঁধে মাথা রেখে ক্ষীণ স্বরে বললেন, “আমি কখনোই অন্য পুরুষের গুণগান শুনতে চাইনি তোমার মুখে। আজ সেটাও শুনতে হচ্ছে। লোকটা কি বেশিই ভালো ছিলো?”
“হুম?” হকচকিয়ে গেলেন বেগম।
“কই, আমার গুণগান তো কখনো করো না তুমি? আমাকে কী কী না উপাধি দিয়েছো! নষ্ট, খারাপ, নোংরা- আরো কত কী। আর ঐ ছেলেটার গুণগান করছো আমার কাছে? সে কি খুব বেশি ভালো?”
আগ্রহী নয়নে চাইলেন সুলতান। শান্ত তার ভঙ্গিমা। বিপদ সংকেত ঠিকই উপলব্ধি করে নিলেন বেগম। সে নিজেই আরো মিশে গেল সুলতানের সাথে। নিজের দু’হাত সুলতানের পিঠে নিয়ে আরো শক্ত করলো বন্ধনী।
“কী হলো? বললে না?” পুনরায় শুধালেন সুলতান।
“বাদ দেন তো। বাইরের মানুষকে নিয়ে এতো আলোচনা করতে হবে না।”
রসকসহীনভাবে মৃদুস্বরে হাসলেন সুলতান। অজান্তেই তার চোখদুটো রক্ত বর্ণ ধারন করেছে। এই বুঝি চোখ ফেটে গড়িয়ে পড়বে রক্তের বিন্দু। বেগমের কাঁধের ওপর মাথাটা রেখেই বলে উঠলেন, “তোমার দিকে যতবার তাকাই ততবার আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। আজ যখন ঐ লোকটা তোমার দিকে সেই একই নজরে তাকিয়েছিল আমার ভালো লাগেনি। বিশ্বাস করো, একটুও ভালো লাগেনি আমার। কত রাগ নিজের মাঝে দাফন করেছি তা একত্রিত করলে হয়তো একটা বিশাল পাহাড় তৈরি হয়ে যেত।”
“বাদ দেন না এসব কথা। সে তো চলেই গেছে।”
“আমি যদি কোনোদিন ঘৃণ্য কোনো অপরাধ করে ফেলি। বা ধরো, পূর্বে এমন কোনো নিকৃষ্ট অপরাধ করেছি যা তোমার জানার বাইরে। হঠাৎ কখনো যদি এমন কিছু জানতে পারো সেদিন কি আমাকে ঘৃণা করবে তুমি?”
আচমকা এমন কথাতে চমকালেন বেগম। কী হয়েছে সুলতানের? হঠাৎ এমন কথা বলছে কেন? পুনরায় ভেসে এলো সুলতানের উত্তেজিত কন্ঠ।
“বলো? আমায় ছেড়ে চলে যাবে তুমি?”
“আমি জানি না আপনি এসব কেন বলছেন, কী কারনে বলছেন। কিন্তু আমার জবাব একটাই- আপনি যদি কখনো পৃথিবীর সবচেয়ে নিকৃষ্টতম ব্যক্তি হিসেবে প্রমাণিত হন, সেদিনও পুরো দুনিয়ার বিরুদ্ধে গিয়ে আমি আপনার হাত ধরবো।”
স্বস্তির শ্বাস ফেললেন সুলতান। প্রশান্তিতে ভরে উঠলো হৃদয়। আচমকা সরে এলো বেগমের থেকে। হনহন করে দ্বারের দিকে হাঁটতে হাঁটতে সামান্য উচ্চস্বরে বললেন, “তাহলে ভুলে যাও ঐ ছেলেটার সমস্ত কার্যকলাপ। মনে রাখবে না সে ভালো কি খারাপ। ভাবনাতেও আনবে না তাকে। গুণগান তো দূরের কথা। তোমার কল্পনাতেও অন্য কারোর বিচরণ আমাকে হিং’স্র করে তোলে। কোনো নিষ্পাপের খুনি বানিয়ো না আমাকে।”
কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। হাঁ করে সেদিকে চেয়ে আছে বেগম। কিয়ৎ ক্ষণ পরে কপাল কুচকে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো, “হিংসুটে কোথাকার।”
“বাহ! নতুন উপাধি! খারাপ না ভালোই। চালিয়ে যাও। আমি শুধু চিন্তায় আছি কবে যেন চরিত্রহীনের উপাধিটাও আমাকে দিয়ে দাও তুমি।”
দ্বারে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে উঠলেন সুলতান। আচমকা তাকে ফিরে আসতে দেখে অবাক হলেও তার কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল বেগম। বারবার কীভাবে সব শুনে ফেলে? নিজ মনে দু’চারটে কথা বলেও শান্তি নেই! এগিয়ে এলেন সুলতান। সিন্দুক খুলে নিজের তলোয়ার বের করতে করতে বললেন, “অস্ত্র চালানো ভুলে গেছো না কি? এসেছো পর্যন্ত শুধু ধেই ধেই করে এর পেছনে লাগছো, ওর পেছনে লাগছো। চলো, অনুশীলন করবে। আর ভুলে গেলে শিখিয়ে দিচ্ছি আমি।”
“না, আমার সব মনে আছে। কিছুই ভুলি নাই। পরে অনুশীলন করবো। এখন বুবুর কাছে যাবো। সে মনে হয় এতোক্ষনে চিন্তায় শুকিয়ে গেছে।”
“চিন্তায় মানুষ শুকিয়েও যায় আজকাল! কীসের এতো চিন্তা?” ভ্রু কুচকে তাকালেন সুলতান।
“তেমন কিছু না। আপনি যান না, অনুশীলন করেন।”
“তারমানে তুমি অনুশীলন করবে না?”
“তা কখন বললাম? পরে করবো।”
“কিছু মনে আছে বলে মনে হয় না। আর তুমি তো আগের চেয়ে দ্বিগুণ ত্যাড়া হয়েছো। পেটের ওপর এতোবড় ক্ষতচিহ্ন অথচ তুমি বলেছো তোমার উপর কে আক্রমণ করেছিল তার চেহারা তুমি দেখোই নি। চিহ্ন দেখে নিশ্চিতভাবে বোঝা যাচ্ছে সামনে থেকে আঘাত করা হয়েছিল। তার মানে দাঁড়ায় তুমি মিথ্যে বলছো। বাঁচাতে চাইছো কাউকে?”
“মিথ্যা যখন ধরেই ফেলেছেন তাহলে আর জানতে চাইবেন না। তাকে ক্ষমা করে দিয়েছি আমি। আপনিও তাকে শাস্তি দেবার কথা ভুলে যান।”
সুলতান কিছু বলার পূর্বেই ছুটে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে গেছে বেগম। হতবাক হলেন সুলতান। বেগমের হঠাৎ কী হলো! নিজের ওপর প্রাণঘাতী আক্রমণ করার পরেও কি কাউকে ক্ষমা করা যায়? কে হতে পারে? শুধু ছুড়ির আঘাত করেই থামেনি, আগুন পর্যন্ত ধরিয়ে দিয়েছিলো তাকে মারতে আর সে কি-না বরছে ক্ষমা করে দিয়েছে! আকাশ কুসুম ভাবতে ভাবতে সে এগিয়ে গেল মহলের বাইরের উদ্যানের দিকে। অস্ত্র ধরা হয় না বেশ কিছুদিন যাবত। অনুশীলন করতে হবে।
জারনাব চিন্তিত ভঙ্গিতে পুরো ঘর পায়চারি করছে। এতো চিন্তা সে কস্মিনকালেও করেনি। এই বণিক তো নিজে কষ্ট পেলোই সাথে জোভিয়াকেও ফাঁসিয়ে দিলো। সুলতান আবার ভুল বুঝে রাগ করছে না কি কে জানে। চিন্তায় ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। ফাইজা হাঁ করে তখন থেকে তাকে দেখে যাচ্ছে। সে এতোটুকু বুঝতে পারছে চিন্তাটা বেগমের জন্য কিন্তু কেন? বেগমের কি ছোট বাচ্চা যে তাকে নিয়ে এতো চিন্তা করতে হবে? ফর্সা মুখটা দেখো কেমন লাল হয়ে গেছে। এখনি মনে হয় দম বন্ধ হয়ে যাবে। সে দৌড়ে গিয়ে এক পাত্র পানি এনে দিলো। ভ্রু কুচকে তাকালো জারনাব। সে তো পানি চাইনি। তবুও পাত্রটা নিয়ে ঢকঢক করে পানিটুকু খেয়ে নিলো সে। এমন সময় কামরায় প্রবেশ করলো এলিজা সুলতান। তাকে দেখতেই পাত্র রেখে ছুটে গেল জারনাব। ব্যস্ত স্বরে শুধালো, “সুলতান কি বেশি রাগ করেছে? বকাঝকা করেছে?”
আমলে নিলো না বেগম। চুপচাপ পালঙ্কে গিয়ে বসে পা দোলাতে লাগলো। এবার গলা শুকিয়ে এলো জারনাবের। মেয়েটা এভাবে চুপ করে আছে কেন? সুলতান ভুল বুঝে সত্যিই রাগ করেছে না কি? সে ধীর পায়ে বেগমের পাশে গিয়ে বসলো। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললো, “মন খারাপ?”
চোখ বড়বড় করে তাকালো ফাইজা। ছোট বাচ্চাকেও তো কেউ এমনভাবে আদর করে জানতে চাই না মন খারাপ কি-না। তার চাহনি লক্ষ করলো বেগম। সে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই চুপসে গেল ফাইজা। জারনাব পুনরায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “কী হলো? বলছো না কেন কিছু? কী বলেছে সুলতান?”
“কিছুই বলেনি বুবু। রাগও করেনি, বকাও দেয়নি।”
“তাহলে মুখটাকে এমন করে রেখেছো কেন?” ভ্রু কুচকে শুধাল জারনাব।
“চিন্তা করছি।” ভাবুক স্বরে বললো বেগম। তবে খুব একটা পাত্তা দিলো না জারনাব। সে ভালোভাবেই জানে এখন যদি জিজ্ঞেস করা হয় কী চিন্তা করছো তাহলে জোভিয়া কখনোই বলবে না। তবে সে স্বস্তি পেয়েছে সুলতান জোভিয়াকে ভুল বোঝেনি শুনে। তাদের ভালোবাসা অটুট থাক এটাই সে চায় সবসময়। হঠাৎ কী ভেবে গলা ঝেড়ে বলে উঠলো, “সুলতান না কি আজ পার্শ্ব সাম্রাজ্য যাবে। তা কখন? বিকাল তো হয়ে এলো।”
আড়চোখে একবার তার দিকে তাকালো বেগম। অকপটে বলে বসলো, “আজ অন্তত সে মহল ছেড়ে বেরোচ্ছে না। এমনিতেই মেজাজ খারাপ ছিলো। তার উপর আবরার জাওয়াদ এসে আরেক চিন্তা মাথায় গেঁথে দিয়ে গেছে। সে তো আজ কোথাও যাবে না আমি নিশ্চিত। তলোয়ার নিয়ে বেরিয়েছে ভং ধরতে। অনুশীলন না ছাই করবে। একটু পরেই সুর সুর করে কামরায় চলে আসবে। তারপর যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলেও সে আর বেরোবে না।”
আকস্মাৎ এহেন কথাতে কাশি উঠে গেল জারনাবের। ফাইজা দৌড়ে পানি এনে সামনে ধরতেই চোখ রাঙিয়ে তাকালো সে। কটমট করে বললো, “পানি খাইয়েই মেরে ফেলতে চাইছো না কি?”
ফাইজা হকচকিয়ে দ্রুত পানি সরিয়ে নিলো। হেসে উঠলো বেগম। হাসতে হাসতে বললো, “চলো, শাশুড়ি আম্মার সাথে আলাপ করিয়ে আনি।”
“না থাক। উনি খুব গম্ভীর। আমার ভয় লাগে।” ভীত স্বরে বললো জারনাব।
অমনি পালঙ্ক ছেড়ে নেমে তার হাত চেপে ধরলো বেগম। টানতে টানতে বললো, “আরে চলো তো। উনি শুধু মনের স্বাদ মেটানোর জন্য উল্টা-পাল্টা কথা বলেন। ওগুলো কানে তুলবে না। ভাববা যে তুমি কিছু শোনোইনি। তাছাড়া খুব ভালো মানুষ সে। শুধু আমাকে দেখতে পারে না এই যা। সে নিজের মেয়েটা গোনে না, আমাকে কীভাবে গোনাই ধরবে?”
কপাল কুচকাল জারনাব। তার সাথে দ্বারের বাইরে যেতে যেতে কিঞ্চিত রাগান্বিত স্বরে বললো, “বেশি কথা বলো না। সবসময় শাশুড়ির পেছনে লেগে থাকলে দেখতে পারবে কীভাবে? আমি তোমাকে চিনি না ভেবেছো?”
“আমি কবে উনার পেছনে লেগেছি? উনিও উনার ছেলের মতো কূটনৈতিক বুদ্ধিতে ভরপুর।” বিস্মিত নয়নে চেয়ে বললো বেগম।
তোহফাকে কোলে নিয়ে তাদের দিকেই আসছিল মাহতাব। তোহফা ছুটোছুটি করছে কোল থেকে নামার জন্য। অথচ মাহাতাব তাকে বারবার শুধাচ্ছে আম্মার কাছে যাবে না কি ফুফির কাছে যাবে। কিন্তু সে কারোর কাছেই যাবে না। তাই বেগমকে খুঁজতে খুঁজতে এদিকে আসতেই হুট করে বেগমের কন্ঠের সাথে নতুন কোনো কন্ঠস্বর পেয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। এই কন্ঠ তো মহলের কারোর নয়। তবুও খুব চেনা লাগছে কন্ঠটা। বেশ কিছুক্ষণ মনে মনে আওড়ালো সে। কিন্তু ঠাহর করতে পারলো না। দূর-দূরান্ত পর্যন্ত এই কন্ঠের অধিকারীকে নিজ মস্তিষ্কে খুঁজে পেল না সে। কন্ঠটা ধীরে ধীরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে। কৌতূহলী হলো সে। আগ্রহী নয়নে চেয়ে থাকলো সেই কন্ঠের অধিকারীকে দেখার জন্য। অথচ তার আশায় জল ঢেলে সেখানে হাজির হলো শেহজাদি তানহা। তাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসু স্বরে শুধাল, “আপনি এখানে কী করছেন, সৈনিক প্রধান?”
চমকে উঠলো মাহতাব। শেহজাদিকে মোটেও এখন আশা করেনি সে। নতুন কন্ঠের অধিকারীকে দেখার ইচ্ছাটা মাঠে মারা গেল তার। সে সবসময় শেহজাদি তানহাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলার চেষ্টা করে। যার কারন শেহজাদি তানহার এই দৃষ্টি, এই চাহনি- সবকিছু যেন গভীর কোনো ইঙ্গিত দিয়ে যায় তাকে। কিন্তু সে কোনোভাবেই সেই ইঙ্গিতকে নিজ মস্তিষ্কে ঠাঁই দিতে চায় না। একেতো তাদের বংশ মর্যাদা এক নয় তার উপর তার মস্তিষ্ক জুরে অন্য কারোর বিচরণ। হৃদয়ে অন্য কারোর বসবাস। সে গলা খাকারি দিয়ে বলে উঠলো, “শেহজাদি তোহফাকে দিতে এসেছিলাম বেগমের কাছে।”
“ঠিক আছে, আমার কাছে দিন।” এগিয়ে এলো তানহা।
তোহফাকে কোলে তুলে নিলো সে। অথচ এখনো ছটফট করছে তোহফা। নামতে চাইছে কোল থেকে। তানহা উপলব্ধি করতে পারলো সে জারনাবের কাছে যেতে চাইছে। সে মুচকি হেসে শুধাল, “খালামণির কাছে যাবে?”
সঙ্গে সঙ্গে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকাতে শুরু করলো তোহফা। মৃদুস্বরে হাসলো তানহা। তোহফার কপালে চুম্বন করে বলল, “চলো।”
সে চলে যেতেই হুট করে মাহতাবের মনে পড়লো মহলে তো নতুন দু’জন মানুষ এসেছে। তারমানে ঐ নতুন নারী কন্ঠটা তাদেরই একজনের। তাহলে এত চেনা চেনা লাগছে কেন কন্ঠটা? ভাবতে ভাবতে সে প্রধান দ্বারের দিকে এগোলো। বিকাল হয়ে যাচ্ছে অথচ সুলতানের কোনো খোঁজ নেই। আজ তো পার্শ্ব সাম্রাজ্যে যাওয়ার কথা তাদের। এমন সময় তলোয়ার হাতে প্রধান দ্বার দিয়ে প্রবেশ করলেন সুলতান। থমথমে তার মুখভঙ্গি। গটগট করে নিজ কামরা দিকে এগোতে নিলে সামনে এসে দাঁড়ায় মাহতাব। ব্যস্ত স্বরে শুধাল, “আমরা কখন যাচ্ছি মহামান্য? ঘোড়া বের করতে বলব সেবকদের?”
কিছু একটা ভাবলেন সুলতান। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন, “আজ কোথাও যাচ্ছি না মাহতাব। ব্যক্তিগত কিছু সমস্যা আছে। আগামীকাল যাবো।”
বলেই হনহন করে কামরার দিকে এগিয়ে গেল সে। অবাক হলো মাহতাব। হঠাৎ করে কী হলো সুলতানের?
চলবে………